অতিপ্রাকৃত গল্পে গল্পের চেয়ে ভূমিকা বড় হয়ে থাকে।

গাছ যত-না বড়, তার ডালপালা তার চেয়েও বড়। এই গল্পেও তাই হবে। একটা দীর্ঘ ভূমিকা দিয়ে শুরু করব। পাঠকদের অনুরোধ করছি তাঁরা যেন ভূমিকাটা পড়েন। এর প্রয়োজন আছে।

 

আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে।

বাবা-মার একমাত্র ছেলে, দেখতে রাজপুত্র না হলেও বেশ সুপুরুষ। এম এ পাস করেছে। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করা এবং গ্রুপ থিয়েটার করা–এই দুইয়ে তার কর্মকাণ্ড সীমিত।

বাবা-মার একমাত্র ছেলে হলে যা হয়-বিয়ের জন্যে অসংখ্য মেয়ে দেখা হতে লাগল। কাউকেই পছন্দ হয় না। কেউ বেশি লম্বা, কেউ বেশি বেঁটে, কেউ বেশি ফর্সা, কেউ বেশি কথা বলে, আবার কেউ-কেউ দেখা গেল। কম কথা বলে। নানান ফ্যাকড়া।

শেষ পর্যন্ত যাকে পছন্দ হল, সে-মেয়ে ঢাকা ইডেন কলেজে বিএ পড়ে— ইতিহাসে অনার্স মেয়ের বাবা নেই। মার অন্য কোথায় বিয়ে হয়েছে। মেয়ে তার বড়চাচার বাড়িতে মানুষ। তিনিই তাকে খরচপত্র দিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন।

আমার মামা এবং মামী দু জনের কেউই এই বিয়ে সহজভাবে নিতে পারলেন না। যে-মেয়ের বাবা নেই, মা আবার বিয়ে করেছে–পাত্রী হিসেবে সে তেমন কিছু না। তা ছাড়া সে খুব সুন্দরীও না। মোটামুটি ধরনের চেহারা। আমার মামাতো ভাই তবু কেন জানি একবারমাত্র এই মেয়েকে দেখেই বলে দিয়েছে—এই মেয়ে ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না। মেয়ের বাবা নেই তো কী হয়েছে? সবার বাবা চিরকাল থাকে নাকি? মেয়ের মার বিয়ে হয়েছে, তাতে অসুবিধাটা কী? অল্প বয়সে বিধবা হয়েছেন, তাঁর তো বিয়ে করাই উচিত; এমন তো না যে, দেশে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ।

মামা-মামীকে শেষ পর্যন্ত মত দিতে হল, তবে খুব খুশিমনে মত দিলেন না, কারণ মেয়ের বড়চাচাকেও তাঁদের খুবই অপছন্দ হয়েছে। লোকটা নাকি অভদ্রের চূড়ান্ত। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। চামার টাইপ।

বিয়ের দিন তারিখ হল।

এক মঙ্গলবার কাকড়াকা ভোরে আমরা একটা মাইক্রোবাস এবং সাদা রঙের টয়োটায় করে রওনা হলাম। গন্তব্য ঢাকা থেকে নব্বই মাইল দূরের এক মফস্বল শহর। মফস্বল শহরের নামটা আমি বলতে চাচ্ছি না। গল্পের জন্যে সেই নাম জানার প্রয়োজনও নেই।

তেত্রিশ জন বরযাত্রী। অধিকাংশই ছেলেছোকরা। হৈচৈয়ের চূড়ান্ত হচ্ছে। এই মাইক বাজছে, এই মাইক্রোবাসের ভেতর ব্রেক ডান্স হচ্ছে, এই পটকা ফুটছে। ফাঁকা রাস্তায় এসে মাইক্রোবাসের গিয়ারবক্সে কী যেন হল। একটু পরপর বাস থেমে যায়। সবাইকে নেমে ঠেলতে হয়। বরযাত্রীদের উৎসাহ তাতে যেন আরো বাড়ল। শুধু আমার মামা অসম্ভব গম্ভীর হয়ে পড়লেন। আমাকে ফিসফিস করে বললেন, এটা হচ্ছে অলক্ষণ। খুবই অলক্ষণ। রওনা হবার সময় একটা খালি জগ দেখেছি, তখনি মনে হয়েছে একটা কিছু হবে। গিয়ারবক্স গেছে, এখন দেখবি চাকা পাংচার হবে। না হয়েই পারে না।

হলও তাই একটা কালভার্ট পার হবার সময় চাকার হাওয়া চলে গেল। মামা বললেন, কি, দেখলি? বিশ্বাস হল আমার কথা? এখন বসে-বসে আঙুল চোষ।

স্পেয়ার চাকা লাগাতেও অনেক সময় লাগল। মামা ছাড়া অন্য কাউকে বিচলিত হতে দেখলাম না।

বরযাত্রীদের উৎসাহ মনে হল আরো বেড়েছে। চিৎকার হৈচৈ হচ্ছে! একজন গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। শুধুমাত্র বিয়েবাড়িতে পৌঁছানোর পরই সবার উৎসাহে খানিকটা ভাটা পড়ল।

মফস্বল শহরের বড় বাড়িগুলি সাধারণত যে-রকম হয়, সে-রকম একটা পুরনো ধরনের বাড়ি। এইসব বাড়িগুলি এমনিতেই খানিকটা বিষগ্ন প্রকৃতির হয়। এই বাড়ি দেখে মনে হল বিরাট একটা শোকের বাড়ি। খা-খী করছে চারদিক। লোকজন নেই। কলাগাছ দিয়ে একটা গেটের মতো করা হয়েছে, সেটাকে গেট না-বলে গেটের প্ৰহসন বলাই ভালো। একদিকে রঙিন কাগজের চেইন, অন্য দিকে খালি{ হয় রঙিন কাগজ কম পড়েছে, কিংবা লোকজনের গোট প্রসঙ্গে উৎসাহ শেষ হয়ে গেছে। আমার মামা হতভম্ব। বরযাত্রীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ব্যাপারটা কি?

হাফশার্ট-পরা এক চ্যাংড়া ছেলে এসে বলল, আপনারা বসেন। বিশ্রাম করেন।

আমি বললাম, আর লোকজন কোথায়?

মেয়ের বড়চাচা কোথায়? সেই ছেলে শুকনো গলায় বলল, আছে, সবাই আছে। আপনারা বিশ্ৰাম করেন।

আমি বললাম, কোনো সমস্যা হয়েছে?

সেই ছেলে ফ্যাকাসে হাসি হেসে বলল, জ্বি-না, সমস্যা কিসের? এই বলেই সে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। আর বেরুল না!

বসার ঘরে চাদর পেতে বরযাত্রীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা। বারান্দায় গোটা দশেক ফোন্ডিং চেয়ার। বিয়েবাড়ির সজ্জা বলতে এইটুকুই।

মামা বললেন, বলেছিলাম না। অলক্ষণ? এখন বিশ্বাস হল? কী কাণ্ড হয়েছে কে জানে। আমার তো মনে হয় বাড়িতে মেয়েই নেই। কারের সঙ্গে পালিয়েটালিয়ে গেছে। মুখে জুতোর বাড়ি পড়ল, স্রেফ জুতোর বাড়ি।

মামা অল্পতেই উত্তেজিত হন। গত বছর তাঁর ছোটখাটো ক্টোক হয়ে গেছে। উত্তেজনার ব্যাপারগুলি তাঁর জন্যে ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমি মামাকে সামলাতে চেষ্টা করলাম। হাসিমুখে বললাম, হাত-মুখ ধুয়ে একটু শুয়ে থাকুন তো মামা। আমি খোঁজ নিচ্ছি কী ব্যাপার।

মামা তীব্র গলায় বললেন, হাত-মুখটা ধোব কী দিয়ে, শুনি? হাত-মুখ ধোবার পানি কেউ দিয়েছে? বুঝতে পারছিস না? এরা বেইজ্জতির চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছে।

কী যে বলেন মামা!

কথা যখন অক্ষরে-অক্ষরে ফলবে, তখন বুঝবি কী বলছি। কাপড়চোপড় খুলে ন্যাংটো করে সবাইকে ছেড়ে দেবে। পাড়ার লোক এনে ধোলাই দেবে। আমার কথা বিশ্বাস না-হয়, লিখে রাখি।

মামার কথা শেষ হবার সঙ্গে-সঙ্গেই খালিগায়ে নীল লুঙ্গি-পরা এক লোক প্লাষ্টিকের বালতিতে করে এক বালতি পানি এবং একটা মগা নিয়ে ঢুকল। পাথরের মতো মুখ করে বলল, হাত-মুখ ধোন। চা আইতাছে।

মামা বললেন, খবরদার কেউ চা মুখে দেবে না, খবরদার! দেখি ব্যাপার কী।

ভেতরবাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসছে। বিয়েবাড়িতে কান্না কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু এই কান্না অস্বাভাবিক লাগছে। মধ্যবয়স্ক এক লোক এক বিশাল কেন্টলিতে করে চা নিয়ে ঢুকল!! আমি তাঁকে বললাম, ব্যাপার কী বলেন তো ভাই? সেই লোক বলল, কিছু না।

ভেতরবাড়ির কান্না এই সময় তীব্র হল। কান্না এবং মেয়েলি গলায় বিলাপ। কান্না যেমন হঠাৎ তুঙ্গে উঠেছিল, তেমনি হঠাৎই নেমে গেল। তার প্রায় সঙ্গে— সঙ্গেই মেয়ের বড়োচাচা ঢুকলেন। ভদ্রলোককে দেখেই মনে হল তাঁর ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে। তিনি নিচু গলায় যা বললেন, তা শুনে আমরা স্তম্ভিত। কী সর্বনাশের কথা! জানলাম যে কিছুক্ষণ আগেই তাঁর বড় ছেলে মারা গেছে। অনেক দিন থেকেই অসুখে ভুগছিল। আজ সকাল থেকে খুব বাড়াবাড়ি হল। সব এলোমেলো হয়ে গেছে এই কারণেই। তিনি তার জন্যে লজ্জিত, দুঃখিত ও অনুতপ্ত; তবে যত অসুবিধাই হোক–বিয়ে হবে। আজ রাতে সম্ভব হবে না, পরদিন।

এই কথা বলতে-বলতে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

আমার মামা খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ। অল্পতে রাগতেও পারেন, আবার সেই রাগ হিমশীতল পানিতে রূপান্তরিত হতেও সময় লাগে না। তিনি মেয়ের বড়চাচাকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে ফেললেন। কাতর গলায় বললেন, আপনি আমাদের নিয়ে মোটেও চিন্তা করবেন না। আমাদের কিছু লাগবে না, আপনি বাড়ির ভেতরে যান বেয়াই সাহেব।

অদ্ভুত একটা অবস্থা! এর চেয়ে যদি শুনতাম মেয়ে পালিয়ে গেছে, তাও ভালো ছিল। কারো ওপর রাগ ঢেলে ফেলা যেত।

আমরা বরযাত্রীরা খুবই বিব্রত বোধ করছি। স্থানীয় লোকজন এখন দেখতে পাচ্ছি। তারা বোধহয় এতক্ষণ ভেতরের বাড়িতে ছিলেন। আমরা বসার ঘরেই আছি। খিদেয় একেক জন প্রায় মরতে বসেছি। খাবার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে কি না বুঝতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে খাবারের কথা জিজ্ঞেসও করা যায় না। একজন মামাকে কানেকানে এই ব্যাপারে বলতেই তিনি রাগী গলায় বললেন, তোমাদের কি মাথাটাথা খারাপ হয়েছে-এত বড় একটা শোকের ব্যাপার, আর তোমরা খাওয়ার চিন্তায় অস্থির! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এক রাত না খেলে হয় কী? খবরদার, আমার সামনে কেউ খাবারের কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবে না।

আমরা চুপ করে গেলাম। বার-তের বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে এসে পানিভর্তি একটা পানদান রেখে গেল। কাঁদতে-কাঁদতে মেয়েটি চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এখনও কাঁদছে।

মামা মেয়েটিকে বললেন, লক্ষ্মী সোনা, তোমাদের মোটেই ব্যস্ত হতে হবে না। আমাদের কিছুই লাগবে না।

রাত আটটার দিকে থাকা এবং খাওয়ার সমস্যার একটা সমাধান হল! স্থানীয় লোকজন ঠিক করলেন, প্রত্যেকেই তাঁদের বাড়িতে একজন-দুজন করে গেষ্ট নিয়ে যাবেন। বিয়ে হবে পরদিন বিকেলে।

 

আমাকে যিনি নিয়ে চললেন, তাঁর নাম সুধাকান্ত ভৌমিক। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্তসমর্থ চেহারা। এই বয়সেও দ্রুত হাঁটতে পারেন। ভদ্রলোক মৃদুভাষী। মাথার চুল ধবধবে সাদা। গেরুয়া রঙের একটা চাদর দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন বলেই কেমন যেন ঋষি-ঋষি লাগছে।

আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু, আপনার বাসা কত দূর?

উনি বললেন, কাছেই।

গ্রাম এবং মফস্বলের লোকদের দূরত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তাদের কাছেই আসলে দিল্লি হনুজ দূর অস্তের মতো। আমি হাঁটছি তো হাঁটছিই।

অনুগ্রহায়ণ মাস। গ্রামে এই সময়ে ভালো শীত থাকে। আমার গায়ে পাতলা একটা পাঞ্জাবি। শীত ভালোই লাগছে।

আমি আবার বললাম, ভাই, কত দূর?

কাছেই।

আমরা একটা নদীর কাছাকাছি এসে পড়লাম! আঁতকে উঠে বললাম, নদী পার হতে হবে নাকি?

পানি নেই, জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিন।

রাগে আমার গা জ্বলে গেল। এই লোকের সঙ্গে আসাই উচিত হয় নি। আমি জুতো খুলে পায়জামা গুটিয়ে নিলাম। হেঁটে নদী পার হওয়ার কোনো আনন্দ থাকলেও থাকতে পারে। আমি কোনো আনন্দ পেলাম না, শুধু ভয় হচ্ছে কোনো গভীর খানাখন্দে পড়ে যাই কি না। তবে নদীর পানি বেশ গরম।

সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনাকে কষ্ট দিলাম।

ভদ্রতা করে হলেও আমার বলা উচিত, না, কষ্ট কিসের  তা বললাম না! নদী পার হয়ে পায়জামা নামাচ্ছি, সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ছেলের কে হন?

ফুপাতো ভাই।

বিয়েটা না-হলে ভালো হয়। সকালে সবাইকে বুঝিয়ে বলবেন।

সে কী? মেয়েটার কারণে ছেলেটা মরল। এখন চট করে বিয়ে হওয়া ঠিক না। কিছুদিন যাওয়া উচিত।

কী বলছেন এ-সব!

ছেলেটা সকালবেল বিষ খেয়েছে। ধুতুরা বীজ। এই অঞ্চলে ধুতরা খুব হয়।

আপনি বলছেন কী ভাই?

ছেলের বাবা রাজি হলেই পারত। ছেলেটা বাঁচত। গোঁয়ারগোবিন্দ মানুষ। তার না মানেই না।

ছেলে-মেয়ের এই প্রেমের ব্যাপারটা সবাই জানে নাকি?

জানবে না কেন? মফস্বল শহরে এইসব চাপা থাকে না। আপনাদের শহরে অন্য কথা। আকছার হচ্ছে।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ কী সমস্যা! বাকি পথ দু জন নীরবে পার হলাম!

পুরোপুরি নীরব বলাটা বোধহয় ঠিক হল না। ভদ্রলোক নিজের মনেই মাঝেমাঝে বিড়বিড় করছিলেন। মন্ত্রটন্ত্র পড়ছেন বোধহয়।

ভদ্রলোকের বাড়ি একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। একতলা পাকা দালান। প্রশস্ত উঠেন। উঠোনের মাঝখানে তুলসী মঞ্চ। বাড়ির লাগোয়া দুটি প্রকাণ্ড কামিনী গাছ। একপাশে কুয়া আছে। হিন্দু বাড়িগুলো যেমন থাকে, ছবির মতো পরিচ্ছন্ন। উঠোনে দাঁড়াতেই মনে শান্তি-শান্তি একটা ভাব হল। আমি বললাম, এত চুপচাপ কেন? বাড়িতে লোকজন নেই?

না।

আপনি একা নাকি?

হুঁ।

বলেন কী। এক-একা এত বড় বাড়িতে থাকেন।

আগে অনেক লোকজন ছিল। কিছু মরে গেছে। কিছু চলে গেছে ইণ্ডিয়াতে। এখন আমি একাই আছি! আপনি স্নান করে ফেলুন।

স্নান-ফান লাগবে না। আপনি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করুন, তাহলেই হবে।

একটু সময় লাগবে, রান্নার জোগাড় করতে হবে।

আপনি কি এখন রান্না করবেন?

রান্না না করলে খাবেন কী? বেশিক্ষণ লাগবে না।

ভদ্রলোক গামছা, সাবান এবং একটা জলচৌকি এনে কুয়ার পাশে রাখলেন।

স্নান করে ফেলুন। সারা দিন জার্নি করে এসেছেন, স্নান করলে ভালো লাগবে। কুয়ার জল খুব ভালো। দিন, আমি জল তুলে দিচ্ছি।

আপনাকে তুলতে হবে না। আপনি বরং রান্না শুরু করুন। খিদেয় চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে।

এই লুঙ্গিটা পরুন। ধোয়া আছে। আজ সকালেই সোডা দিয়ে ধুয়েছি। আমার আবার পরিষ্কার থাকার বাতিক আছে, নোংরা সহ্য করতে পারি না।

ভদ্রলোক যে নোংরা সহ্য করতে পারেন না, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তিনি রান্না করতে বসেছেন উঠোনে। উঠোনেই পরিষ্কার ঝকঝকে মাটির চুল। সুধাকান্তবাবু চুলার সামনে জলচৌকিতে বসেছেন। থালা, বাটি, হাঁড়ি সবই দেখি দু বার তিন বার করে ধুচ্ছেন।

সুধাকান্তবাবু।

বলুন।

আপনি বিয়ে করেন নি?

না।

চিরকুমার?

ঐ আর কি।

আপনি করেন কী?

শিক্ষকতা করি। হাই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক। মনোহরদি হাই স্কুল।

রান্নাবান্না। আপনি নিজেই করেন?

হ্যাঁ, নিজেই করি। এক বেলা রান্না করি। এক বেলা ভাত খাই, আর সকালে চিড়া, ফলমূল-এ—সব খাই।

কাজের লোক রাখেন না কেন?

দরকার পড়ে না।

খালি বাড়ি পড়ে থাকে, চুরি হয় না?

না। চোর নেবে কী? আমি এক জন দরিদ্র মানুষ। আপনি স্নান করে নিন। স্নান করলে ভালো লাগবে।

অপরিচিত জায়গায় ঠাণ্ডার মধ্যে গায়ে পানি ঢালার আমার কোনোই ইচ্ছে ছিল কুৰুসুধাকান্তবাবু মনে হচ্ছে আমাকে না ভিজিয়ে ছাড়বেন না। লোকটি সম্ভবত শুচিবাইগ্রস্ত।

 

কুয়ার পানি নদীর পানির মতো গরম নয়, খুব ঠাণ্ডা। পানি গায়ে দিতেই গা জুড়িয়ে গেল। সারা দিনের ক্লান্তি, বিয়েবাড়ির উদ্বেগ, মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা—সব ধুয়ে-মুছে গেল। চমৎকার লাগতে লাগল। তা ছাড়া পরিবেশটাও বেশ অদ্ভুত। পুরনো ধরনের একটা বাড়ি। ঝকঝকে উঠোনের শেষ প্রান্তে শ্যাওলা-ধরা কুয়া। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ। কামিনী ফুলের গাছ থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি গন্ধ। এক ঋষির মতো চেহারার চিরকুমার বৃদ্ধ রান্না বসিয়েছেন। যেন বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কোনো দৃশ্য।

সুধাকান্তবাবু?

বলুন!

রান্নার কত দুর?

দেরি হবে না।

এক-একা থাকতে আপনার খারাপ লাগে না?

না, অভ্যোস হয়ে গেছে।

বাসায় ফিরে আপনি করেন কী?

তেমন কিছু করি না। চুপচাপ বসে থাকি।

ভয় লাগে না?

সুধাকান্তবাবু এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না।

খাবার আয়োজন সামান্য, তবে এত চমৎকার রান্না আমি দীর্ঘদিন খাই নি। একটা কিসের যেন ভাজি, তাতে পাঁচফোড়নের গন্ধ-খেতে একটু টক-টক। বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি, তাতে ডালের বড়ি দেওয়া! ডালের বড়ি এর আগে আমি খাই নি! এমন একটা সুখাদ্য দেশে প্রচলিত আছে তা-ই আমার জানা ছিল না। মুগের ডাল! ডালে ঘি দেওয়াতে অপূর্ব গন্ধ।

আমি বললাম, সুধাকান্তবাবু, এত চমৎকার খাবার আমি আমার জীবনে খাই নি। দীর্ঘদিন মনে থাকবে।

সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি ক্ষুধার্ত ছিলেন, তাই এত ভালো লেগেছে। রুচির রহস্য ক্ষুধায়। যেখানে ক্ষুধা নেই, সেখানে রুচিও নেই।

আমি চুমৎকৃত হলাম।

লোকটির চেহারাই শুধু দার্শনিকের মতো না, কথাবার্তাও দর্শনঘেঁষা।

সুধাকান্তবাবু উঠোনে পাটি পেতে দিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর সিগারেট হাতে সেখানে বসলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করা যেতে পারে। সুধাকান্তবাবুকে অবশ্যি খুব আলাপী লোক বলে মনে হচ্ছে না। এই যে দীর্ঘ সময় তাঁর সঙ্গে আছি, তিনি এর মধ্যে আমার নাম জানতে চান নি। আমি কী করি তাও জানতে চান নি। আমি এই মানুষটির প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ বোধ করছি, কিন্তু এই লোকটা আমার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করছে না। অথচ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা মাষ্টারি করে, তারা কথা বলতে খুব পছন্দ করে। অকারণেই কথা বলে।

প্রায় মিনিট পনের আমরা চুপচাপ বসে থাকার পর সুধাকান্তবাবু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আপনি করছিলেন এক-একা আমি এই বাড়িতে থাকতে ভয় পাই কি না, তাই না?

আমি বললাম, হ্যাঁ, তাই।

সুধাকান্তবাবু বললেন, ভয় পাই। প্রায় রাতেই ঘুমুতে পারি না, জেগে থাকি। ঘরের ভেতর আগুন করে রাখি। হারিকেন জ্বালান থাকে। ওরা আগুন ভয় পায়। আগুন থাকলে কাছে আসে না।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কারা?

তিনি জবাব দিলেন না।

আমি বললাম, আপনি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

আমি মনে-মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। পৃথিবী কোথায় চলে গিয়েছে–এই বৃদ্ধ তা বোধহয় জানে না! চাঁদের পিঠে মানুষের জুতোর ছাপ পড়েছে, ভাইকিং উপগ্রহ নেমেছে মঙ্গলের মরুভূমিতে, ভয়েজার ওয়ান এবং টু উড়ে গেছে বৃহস্পতির কিনারা ঘেষে, আর এই অঙ্কের শিক্ষক ভূতের ভয়ে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে রাখছে। কারণ, অশরীরীরা আগুন ভয় পায়।

আমি বললাম, আপনি কি ওদের দেখেছেন কখনো?

না।

ওদের পায়ের শব্দ পান?

তাও না।

তাহলে?

বুঝতে পারি।

বুঝতে পারেন?

জ্বি। আপনি যখন আছেন, আপনিও বুঝবেন।

ওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে পাব, তাই বলছেন?

হুঁ, তবে ওদের না, এক জন শুধু আসে।

তাও ভালো যে এক জন আসে। আমি ভেবেছিলাম দলবল নিয়ে বোধহয় চলে আসে। নাচ গান হৈ-হল্লা করে।

আপনি আমার কথা একেবারেই বিশ্বাস করছেন না?

ঠিকই ধরেছেন, বিশ্বাস করছি না। অবশ্য এই মুহূর্তে আমার গা ছমছম করছে। কারণ, আপনার পরিবেশটা ভৌতিক।

সুধাকান্তবাবু বললেন, ওরা কিন্তু আছে।

আমি চুপ করে রইলাম। এই বৃদ্ধের সঙ্গে ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে তর্ক করার কোনো অর্থ হয় না! থাকলে থাকুক।

আমার কাছে যে আসে, সে একটা মেয়ে।

তাই নাকি?

জ্বি, এগার-বার বছর বয়স।

বুঝলেন কী করে তার বয়স এগার-বার? আপনাকে বলেছে?

জ্বি-না! অনুমান করে বলছি।

তার নাম কি? নাম জানেন?

জ্বি-না।

সে এসে কী করে?

সুধাকান্তবাবু বললেন, মেয়েটি যে আসছে এই কি যথেষ্ট নয়? তার কি আর কিছু করার প্রয়োজন আছে?

আমি চুপ করে গেলাম। আসলেই তো, অশরীরী এক বালিকার উপস্থিতিই তো যথেষ্ট। সুধাকান্তবাবু বললেন, আপনি নিজেও হয়তো দেখতে পারবেন! আমি চমকে উঠলাম। ভদ্রলোক সহজ স্বরে বললেন, আমি ছাড়াও অনেকে দেখেছে।

সুধাকান্তবাবু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন এবং তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বিকট একটা হাসি শুনলাম। উঠোন কাঁপিয়ে গাছপালা কাঁপিয়ে হো-হো করে কে যেন হেসে উঠল। সুধাকান্তবাবু পাশে না থাকলে অজ্ঞানই হয়ে যেতাম। আমি তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠলাম, কে, কে?

সুধাকান্তবাবু বললেন, ওটা কিছু না।

আমি ভয়-জড়ানো গলায় বললাম, কিছু না মানে?

ওটা খাটাশ। মানুষের মতো শব্দ করে হাসে।

বলেন কী! খাটাশের নাম তো এই প্রথম শুনলাম! এ তো ভূতের বাবা বলে মনে  হচ্ছে! এখনো আমার গা কাঁপছে।

জল খান। জল খেলে ভয়টা কমবে।

সুধাকান্তবাবু কাঁসার গ্লাসে করে পানি নিয়ে এলেন। খাটাশ নামক জন্তুটি আরেক বার রক্ত হিম-করা হাসি হাসল। সুধাকান্তবাবু যদি কিছু না বলতেন তাহলে ভূতের হাসি শুনেছি, এই ধারণা সারা জীবন আমার মনের মধ্যে থাকত।

লোকটার প্রতি এই প্ৰথম আমার খানিকটা আস্থা হল। আজগুবি গল্প বলে ভয় দেখান এই লোকের ইচ্ছা নয় বলেই মনে হল। এ-রকম ইচ্ছা থাকলে, এই ভয়ংকর হাসির কারণ সম্পর্কে সে চুপ করে থাকত।

সুধাকান্তবাবু বললেন, ঐ মেয়েটার কথা শুনবেন?

হ্যাঁ, শোনা যেতে পারে। তবে আমি নিজে অবিশ্বাসী ধরনের মানুষ, কাজেই গল্পের মাঝখানে যদি হেসে ফেলি কিছু মনে করবেন না।

এই গল্পটা কাউকে বলতে ভালো লাগে না। অবশ্যি অনেককে বলেছিা! এখানকার সবাই জানে।

আপনার গল্প এখানকার সবাই বিশ্বাস করেছে?

সুধাকান্তবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, আমি যদি এখানকার কাউকে একটা মিথ্যা কথাও বলি, এরা বিশ্বাস করবে। এরা আমাকে সাধুবাবা বলে ডাকে। আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে কোনো মিথ্যা কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না। আমি থাকি এক-একা। আমার প্রয়োজনও সামান্য। মানুষ মিথ্যা কথা বলে প্রয়োজন এবং স্বার্থের কারণে। আমার সেই সমস্যা নেই। এইসব থাক, আমি বরং গল্পটি বলি।

বলুন।

ভেতরে গিয়ে বসবেন? এখানে মনে হচ্ছে একটু ঠাণ্ডা লাগছে। অগ্রহায়ণ মাসে হিম পড়ে।

আমার অসুবিধা হচ্ছে না, এখানেই বরং ভালো লাগছে। গ্রামে তেমন আসা হয় না। আপনি শুরু করুন।

সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করতে গিয়েও শুরু করলেন না; হঠাৎ যেন একটু অন্য রকম হয়ে গেলেন। যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছু দেখতে চেষ্টা করছেন। খসখস শব্দ হল। নতুন কাপড় পরে হাঁটলে যেমন শব্দ হয়, সে-রকম। তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কাঁচের চুড়ির টুং-টুং শব্দের মতো শব্দ। আমি বললাম, কী ব্যাপার বলুন তো?

সুধাকান্তবাবু ফ্যাকাসে মুখে হাসলেন। আমি বললাম, কিসের শব্দ হল?

তিনি নিচু গলায় বললেন, ও কিছু না, আপনি গল্প শুনুন। আজ ঘুমিয়ে কাজ নেই, আসুন গল্প করে রাত পার করে দিই।

গা-ছিমছমে পরিবেশ। বাড়ির লাগোয়া ঝাঁকড়া কামিনী গাছ থেকে কামিনী ফুলের নেশা-ধরান গন্ধ আসছে। কুয়ার আশেপাশে অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে–নিভছে। উঠোনের চুলা থেকে ভেসে আসছে পোড়া কাঠের গন্ধ। আকাশ-ভরা নক্ষত্ৰবীথি।

সুধাকান্তবাবু গল্প শুরু করলেন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ