জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা
মলয় রায়চৌধুরী

গীতায় সর্বজ্ঞ ভগবান বলেছেন বটে অনেক কিছু, কিন্তু যা-যা বলেছেন তার কেবল একটা করেই মানে হয় না, বুঝলি? পাঁচ হাজার ফিট থেকে কী ভাবে, ডানা না ঝাপটিয়ে, শুধু দুপাশে আলতো মেলে দিয়ে, বাতাসে সাঁতরে দশ হাজার ফিট ওপরে উঠে যাওয়া যায়, তা বংশের একমাত্র জীবিত সদস্য, নাতি শিলাদকে শেখাচ্ছিল বৃদ্ধ শকুন যাতুধান তরফদার।
যাতুধান তরফদারের মাথায় আর গলায় পালক থাকলে ওকে মনে হতো ঈগল, এই বয়সেও এমন দশাসই গড়নপেটন, উড়াল, ব্যক্তিত্ব, আচরণ, চালচলন আর কাছার সাদা পালকের মেলতাই। কিন্তু ও এই দেশের এক অতি বৃদ্ধ শকুন, এককালের বিশাল পরিবারের অভিজ্ঞ কুলপতি, যার পরিবারে যুবক নাতি শিলাদ ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।
ল্যাজে মাথা রেখে ঘুমোতে-ঘুমোতে ফোঁপাচ্ছিল শিলাদ। একফাঁকে ওর ঘুমন্ত হাঁ-মুখের ভেতর দিয়ে ওর মগজে পা টিপে-টিপে যে মহাসাথীর মহাকংকাল ঢুকে পড়েছে, আর একটু-একটু করে হয়ে গেছে পেটরল-কুঁয়োর ধোঁয়াক্কার আগুন বমি করতে থাকা দশ-ঠ্যাঙের পেল্লাই গর্ণাখ্যাঁদা চিনা ড্র্যাগন, তা টের পায়নি ও, শিলাদ। যবে, ঘুমের ভেতর ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের।
ঘুমের ভেতর জেগে-ওঠা শিলাদ নামের ঘরেলু গিরগিটিকে ড্র্যাগন বলল, তুই তো আস্ত গাধা। তুই যাকে জঙ্গিলাজীবন ভেবে হাহুতাশ করছিস সে ঘরানা বহুকাল তামাদি হয়ে গেছে। দেশে-দেশে জঙ্গিলাদের এখন হুদোহুদো ঘরানা। তুই কি জানিস পেরুতে তেগু নামের তিন ফিটের গিরগিটি হয়; স্যালামানডাররা আসলে মাফিয়া ডন, মোটেই গিরগিটি নয়; মার্কিন গিরগিটিরা মাঝরাতে বেরোয়; মিশরের কোমোডো গিরগিটিরা দশ ফিট অব্দি হয়; অনেক গিরগিটির পা হয় না; আফরিকার গিরগিটিরা নিজেদের মধ্যে লড়লে কী হবে, সর্পরাষ্ট্রর গ্রাস থেকে বাঁচতে নিজের ল্যাজ মুখে পুরে পাক খায়: আফগানিস্তানের গিরগিটিদের সহজে ধরা যায় না, কাত হয়ে বালিতে পিছলে অনেকদুর চলে যায়? জঙ্গিলাজীবন আর রোমান্টিক নেই।
হামি সত্যিই কনফিউজড, ঘুমের মধ্যে ঘুমোতে-ঘুমোতে নিজেকে বলতে শুনল শিলাদ।
তোকে তো তোর দাদু বলেছিল যে ভাষ্যকার নিজের আর ক্লায়েন্টের স্বার্থ মাথায় রেখে বাক্য বুকনি বিপ্লব বড়বড়াঙ ব্যধি ব্যাখ্যা করে। তুই যদি জঙ্গিলা জীবনকে ওদের মতন অ্যাডভেঞ্চারাস চাকরি হিসাবে নিতিস, তাহলে এরকম বিপর্যস্ত হতিস না।
ভাবিনি এভাবে স্বপ্নভঙ্গ হবে, স্বপ্নের মধ্যে নিজেকে শ্লেষ্মামাখা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল শরটবদন শিলাদ ।
উড়োনছু ড্র্যাগন পেটরল-আগুনের ধোঁয়াক্কার শ্বাস ভলকে-ভলকে ছাড়তে-ছাড়তে বলল, স্বপ্নভঙ্গ বলে কিছু হয় না, অবস্হা বুঝে নিজেকে বদলাতে হয়। তার ফলে জীবনের উদ্দেশ্য আপনা থেকেই পাল্টি খায়। এই আমাকেই দ্যাখ না, ছিলুম ঞহাসাথী, হয়ে গেছি কুমিরঠেঙে ঘোড়ামুখো ড্র্যাগন। আমাকে কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না, ওরা জাস্ট আমার কংকালটাকে ভয় পায়। কেননা কংকালটা হল আমার রাজনৈতিক জীবনের কিংবদন্তি।
আমার তাহলে কী হবে? জীবন তো দেখছি আটার ফেলিয়র। ইন্সটলমেন্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমের মধ্যে বলল শিলাদ।
ব্যর্থ হবে কেন? অভয় দিল দশপদ ড্র্যাগন। কয়েক ভলক কেরোসিনগন্ধী আগুনের বমি উগরে শুধোল, অন্য অনেক উপায় আছে, সেগুলো যাচাই কর। এভাবে ভেঙে পড়লে চলে নাকি।
আপনি আমায় সাহায্য করুন না; এভাবে হেরে যাওয়া গিরগিটি জীবনের চেয়ে কয়রা কেউটের ছোবলের সামনে শুয়ে আত্মহত্যা করা ঢের ভাল। কাল সকালে বেরিয়েই কোনো তেলককাটা চশমাপরা ময়ূরের নজরে পড়ে শহিদ হব। দেড় ঘনফিটের একটা শহিদস্তূপ তো অন্তত হবে, তা সে সুলভ শৌচাগার চত্বরে হলেও হোকগে।
ভেবে বল, তুই কী চাস। আমি তো হতে চেয়েছিলুম সমাজবদলকারী। হয়ে গেলুম সেলাম-নেয়া উড়োনছু কংকাল।
কেয়ার ফ্রি লাইফ চাই, কাঁধের ওপর উদ্দেশ্যপূর্তির নোংরা বস্তা যাতে না বইতে হয়। আই ওয়ান্ট টু জাস্জট র্্রিক আউট, চিল আউট, হ্যাভ ফান।
তথাস্তু।
নিঃশ্বাসের আগুন সশব্দে নিভে গেল।
ঘুম ভেঙে গেল শিলাদ তরফদারের।
বুড়ো হয়েছে বলে কুঁকড়ে যায়নি যাতুধান; বার্ধক্যেও লম্বাণ এক মিটার, দুদিকে ডানা ছড়ালে চওড়ায় সাড়ে তিন মিটার। ওর চিন্তা করার ক্ষমতার মতনই, দৃষ্টিশক্তি প্রখর, ওষুধ-বিষুধ খেতে হয় না। হাওয়ায় সাঁতরে ওপরে, আরও ওপরে, তারও ওপরে, উঠে গিয়েও, টেলিসকোপিক চোখে অনেকটা এলাকা দেখতে পায় যাতুধান, আবার ঠিক তলায় কোনো জিনিসকে, তা সে যতই ক্ষুদে হোক, আই গ্লাস নজর মেলে, বেশ কয়েক গুণ বড়ো করে দেখতে পারে। দেখার, পরখ করার, এই সব তরিকার তালিম শিলাদকে দিচ্ছে যাতুধান।
পালকের সাদা-কালো রুমাল গলায় বেঁধে, হাওয়ার সরের ওপর ভেসে বেড়াবার বয়সে পৌঁছে, মনমরা একাকীত্বে ভোগা আরম্ভ করেছে শিলাদ তরফদার। একদিন, বোধহয় দোলের সময়, পাঁচ হাজার ফিট উঁচু থেকে আকাশ চিরে কয়েক মুহূর্তে মাটির কাছাকাছি নেমে গিয়ে প্লাসটিকের জাপানি ঘুড়িকে, যেটাকে দেখতে শকুনকুমারীর মতন, প্রেম নিবেদন করে সাড়া পায়নি শিলাদ। প্রণয়ঘটিত এই অঘটন আবার ঘটেছিল বিশ্বকর্মাপুজোর ভরা দুপুরে। সেই থেকে যাতুধান ওকে সব ব্যাপারে প্রশিক্ষিত করার ভার নিয়েছে।
হাতেকলমে নানা কাজকারবার শেখার সময়কালে, পুরোনো পালক ঝরে গিয়ে সবে নতুন পালক গজিয়েছে শিলাদের, এসে পড়েছে যখন-তখন সঙ্গমের অবরোহী ঋতু, শকুন যুবতীর খোঁজে বহু ব্যর্থ ওড়াউড়ির শেষে, সাতসকালে, একজন বয়স্কা ভূবনচিল যখন বটগাছের ন্যাড়া ডালে বসে তৃপ্তি করে মুর্গিছানার হৃৎপিন্ড চোষায় মগ্ন, শিলাদ তার অন্যমনস্ক পিঠে আলতো করে নেমে, ধর্ঢ়ণ করার চেষ্টা করেছিল। অসবর্ণ সঙ্গমের হবোহবো মুহূর্তে, ওই চিলগৃহিণীর পরিবারের লোকজন শিলাদকে ঘিরে ফেলে হৈ-চৈ বাধাতে, প্যাঁদানির ভয়ে মেঘের এগলি-সেগলি হয়ে ও পালায়, চিলেদের অনধিগম্য আকাশে, যেখানে ওকে হাঁপাতে দেখে, জেরা করে সবকিছু জানার পর, যাতুধান ওকে বুড়ি শঙ্খচিল, খুকি উটপাখি আর সোমথ্থ টার্কিদের নামঠিকানা বাতলায়, যাদের ওপর আচমকা বসে তাড়াতাড়ি পায়ুসঙ্গম বা থর্ষণ সেরে কেটে পড়া যায়, যদিও তাতে মন ভরবে না, উল্টে আনচান বেড়ে অসুখ করবে। বাট দেন, দ্যাট ইজ লাইফ।
গন্ধের সু-কু সম্পর্কেও শিক্ষা দিতে বাধ্য হয়েছে যাতুধান, কেননা মাঠে ফেলে দেয়া নিচু জাতের দেবী-দেবতার রঙচটা খোড়ো মূর্তিকে মানুষের লোভনীয় মড়া মনে করে একবার শীতকালে নেমে গিয়ে বোকা বনেছিল শিলাদ। যাতুধান বুঝিয়েছে যে মানুষের পুজো-করা কোনো জিনিসই শকুনদের মুখে তোলার মতন নয়। ওসব কাক-শালিকের মতন ছোটলোকরা খায়।
ওই যে দূরে ঘনসবুজ সবুজ আর ফিকেসবুজ বনাঞ্চল, সেখানে যেতে বা তার ওপর দিয়ে উড়তে শিলাদকে বারণ করেছে যাতুধান। ওখানকার পাতাঢাকা গাছগুলো, জাম আমলকি পলাশ চম্পা গেঁদা নারিচা বরমালা উদল টুনকড়াই ধরমারা হরীতকী বহেড়া জলপাই নাগেশ্বর কদম চালতা বানরহোলা বাটনা শিমুল কলক জারুল উড়ি গর্জন গামারি সুন্দরী, ওগুলো শকুন-আবাসনের উপযুক্ত নয়। বাড়ি করার জন্যে সবসময় খুঁজতে হবে মরা দলছুট একা গাছ। যখন পরিবারের সবাই বেঁচেছিল, তখন একান্নবর্তী গুমুতে মাস ছয়েক চান করিয়ে অমন একটা বাছাই-করা গাছকে একটু-একটু করে মেরে ফেলে কাঠপ্রাসাদ বানিয়ে নায়া যেত। প্রায় নির্বংশ হবার ফলে, আর তা সম্ভব নয়।
নবাবি আমলে, তার আগে সুলতানি আমলে, তার আগে গুলতানি আমলে, কেমন মন্ডামেঠাই পাওয়া যেত, ন্যাড়া ছালওঠা অর্জুনগাছের ডালে বসে, রোদে রোদানো শ্মশান ধোঁয়ায়, গোলাপি গর্বিত গ্রীবা উঁচিয়ে, শিলাদকে ওর পূর্বপুরুষের সুখি জীবনের গল্প শোনাচ্ছিল যাতুধান। সে-সময়ে নিচু জাতের, নিচু জাতের চেয়ে নিচু জাতের, তার চেয়েও নিচু জাতের, অঢেল দাসী বাঁদি চাকরানি ঝি কামিলনি নড়ি আমিনী কিংকরী ভাতুনি প্রেষিনী খানজাদনি পুষতো খানদানি লোকেরা।
তারা মরে গেলে তাদের অচ্ছুৎ মড়া না পুঁতে না পুড়িয়ে ভাসিয়ে দিত নদীতে, যার ওপর আরাম করে বসে ভাবতে-ভাবতে হাসতে-হাসতে কাশতে-কাশতে ভাসতে-ভাসতে ঠাকুর্দার বাপ-পিতেমো চলে যেত অনেক-অনেক দূরে। কত ভাগাড় দেখা হতো। কত শ্মশান। কত তান্ত্রিকের যোগাড়যন্তর। স্বাদ বদলাতে একান্নবর্তী শকুনরা এক ভাসন্ত মড়া থেকে উড়ে গিয়ে আরেক ভাসন্ত মড়ায় গিয়ে বসত।
আজকাল যে-সব মড়া পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই গরু ছাগল আর ভেড়ার রুগি লাশ। গরু-মোষের স্বাস্হ্যবান মড়া হলে তার মাংসে এত কীটনাশক যে অক্কা অনিবার্য। ওসব খেয়েই তো শকুনরা আজ নির্বংশ। পার্টি-অপার্টির লোকেরা খুনোখুনি করে লাশ ফেললে পুলিশে তুলে নিয়ে যায়, আমাদের খেতে দেয় না। মর্গের বাইরে যে মড়াগুলো ফেলে দেয় সেগুলো চুরি করে নিয়ে যায় কংকালের ব্যাপারীরা। তার ওপর নতুন আপদ হয়েছে বিদ্যুতের চুল্লি। নাতিকে বোঝায় দাদু।
হাইল হাওড় বাওড় নদনদী খালবিল ঝিল পুকুর ডোবা, বহু জায়গার ওপর দিয়ে উড়েছে শিলাদ। ওড়ে প্রতিদিন। ব্রেকফাসগট বা লাঞ্চ করার জন্যে একটাও ভাসন্তি লাশ দেখতে পায় না। ওড়াই সার। ডানার বগলে ব্যথা ধরে। অথচ দাদু বলেছে এবার দেবীর দোলায় আগমন বলে মড়ক লেগে অনেক ভাল-ভাল পচা লাশ পাওয়া যাবে। ভবিষ্যৎ নাকি উজ্জ্বল।
কিছুদিন আগে, মানুষের পায়ের বিষে হাপিস ঘাসের ধুলোপথের শেষে, ঝোপঝাড় কাদাবালির কিনারায়, পাতলা কুয়াশা ফুটো করে শিলাদ দেখতে পেয়েছিল একটা উদোম ল্যাংটো পোঁদ উপুড় করা লাশ। চাখবে বলে বাঁক নিয়ে নামতে যাচ্ছিল শিলাদ। ওকে অমন লোভী বাঁক নিতে দেখে, আকাশের শীত থেকে গরমে নামতে-নামতে চিৎকার করে উঠল দাদু, খাসনি খাসনি, মুখ দিসনি, ছুঁসনি, চলে আয় চলে আয়।
—-কেন দাদু? ছালন তো বেশ সরেস মনে হচ্ছে।
—-ওকে পোড়ালে ও হিঁদু হয়ে যেত আর পুঁতে দিলে মোচোরমান, তাই ওকে ওভাবে ফেলে দিয়েছে। ওর মড়া বদ-ভাবনার বাতাসে ভরা, খেলেই তোর বায়ু রোগ হতো। আর উড়তে পারতিস না।
সব ব্যাপারে দাদু বারণ করে বলে মেজাজ খিঁচড়ে থাকে শিলাদের। সকাল০বিকাল হ্যান করিসনি ত্যান করিসনি ওখানে যাসনি সেখানে বসিসনি। কোকিলের মশালা মিউজিক শোনা বারণ, বসন্ত বউরির হিপ-হপ শোনা নিষিদ্ধ, বুলবুলির র‌্যাপ শোনা যাবে না, পা নাচানো যাবে না হাড়িচাচার রক এন রোলের তালে, টুনটুনির জ্যাজ শুনলে কানে পালক দিতে হবে, বেনেবউ হাঁস ঘুঘু ময়ূরের বাংলাস্তানি ব্যান্ড শোনা হারাম। এই আকাশ ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে শিলাদের।
দাদু বুঝতে পারে না যে হাওয়া এত নোংরা হয়ে গেছে যে রাগসঙ্গীত তাতে খেলতে পারে না। পাখিদের গলায় কীটনাশক বিষ আর ধোঁয়া আটকে এমন অবস্হা যে বাতাসে ধ্রুপদ-ধামার বিলোলেও তা পপ আর পেপি হয়ে যাবে। কে এসব বোঝাবে দাদুকে? রাতদিন গীতা বা চন্ডীপাঠ বা পদাবলী কেত্তন । মহালয়ার দিন সকালে বাজল, ব্যাস, যথেষ্ট।
একদম ভাল্লাগে না এখানে, নিজেকে জানার উপায় নেই, নিজেকে ব্যাবহারের সুযোগ নেই, ধ্যাৎ, বোরিং, মানে হয় না কোনো। নিজেকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলছিল শিলাদ, বাজ পড়ে মুন্ডকাটা তালগাছের টঙে বসে। পাশে, ফরহাদ মজহার মিয়াঁর সেগুনবাগিচার বাগানে, মুনিয়া বদরি বাবুই চড়ুই টিয়া বক দলপিপি তিতির ক্যানারি দোয়েল মিলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিল নন্দনতত্বের কিচিরমিচির নিয়ে। এদের পচিয়ে আচার করে খেতে বলেছে দাদু; সবরকম রঙের প্রাণী খেলে স্বাস্হ্য নাকি ভাল থাকে। অথচ শিলাদের ইচ্ছে করে রোজ একটা রঙ বেছে নিয়ে সেই রঙের পাখির পিঠে বসে, মাথার চাঁদিতে চঞ্চু টিপে ধরে, দুপাশে ডানা নামিয়ে ইয়ে করে।
শিলাদের স্বগতোক্তি শুনে, পাশের তালগাছে ব্যাঙমালপো খেতে-খেতে তুরঘুন বাজপাখি, যার পূর্বপুরুষ আকবর বাদশার বাঁ হাতে বসে শিকারে যেত বলে গুজব, মুখ তুলে শুধোল, তুই বাঞ্চোত ডোমের পুত গিধই থেকে গেলি। মনে-মনে শিলাদ বলল, ছ্যাঃ, এদের সঙ্গে থাকা যাবে না; যেতেই হবে এখান থেকে; এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে; যেদিকে দুডানা যায় চলে যাব।
মনমরা দেখে, মেঘের গলির রুপো বিক্রির দোকানগুলোর মাঝ দিয়ে শিলাদকে নিয়ে ডানা চালিয়ে হন-হন করে উড়তে-উড়তে যাতুধান বলল, গীতায় ভগবান কী বলেছেন তাতে কিছি এসে যায় না; আসল ব্যাপার হল ভাষ্যকাররা কী বলছেন!
—-ভাষ্যকার? সে আবার কী?
—-এই যেমন কাশ্মীরে বোমাবাজদের সম্পর্কে যে ধরনের ভাষ্য দেয়া হয়, ত্রিপুরার বোমাবাজদের সম্পর্কে তার চেয়ে গরম ভাষ্য দেয়া হয়। কেননা ত্রিপুরায় ভাষ্যকারের মেসো-জ্যাঠা-কাকা-মামা থাকে। কাশ্মীরে ভাষ্যকারের কেউ থাকে না।
—-ধ্যাত্তেরি, তোমার ওই রাজনৈতিক ক্যালাকাকোলা আমার একদম ভাল্লাগে না।
—-তোর ভালর জন্যেই বলছি। পরিস্হিতি বুঝে, হালচাল বুঝে, আখেরের কথা ভেবে, প্রতিটি ব্যাখ্যা তৈরি কর।
—-ভাবাভাবির কী আছে। ফালতু!
—-সব বলছি। এই যে শঙ্কর, রামানুজ, বল্লভাচার্য, শ্রীধরস্বামী, নিম্বকাচার্য, মাধবাচার্য, কেবলভক্তি, বলদেব বিদ্যাভূষণ, মধুসূদন সরস্বতী, ওনারা তো তোর-আমার জন্যে ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করেননি; করেছেন নিজেদের আর চেলাদের জন্যে। তা তুইও তাই কর। লাইফ এনজয় কর। জমমে অব্দি আমায় দেখছিস তো? দুঃখও এনজয় করি।
গ্রীষ্মের এক-দুদিন আগে, হবু-হবু কালবৈশাখী এড়াতে, দাদু আর নাতি পাগুটিয়ে ডানা চালিয়ে দৌড়োচ্ছিল তপন ভেড়ার বানানো বনের বনায়ন পেরিয়ে নিমটোলার দিকে। ঝড় নয়, ঝাঁক-ঝাঁক মেমনয়েড পাখির উড়ন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ-মদ্যিখানে পড়ে যাতুধানের কাছছাড়া হয়ে গেল শিলাদ। পুবপক্ষ ওকে পশ্চিমপক্ষের সেনাপতি মনে করে পায়ের ছোরাছুরি আর ঠোঁটের তরোয়াল চালিয়ে শিলাদকে আধমরা করে ফেলে দিল ,মাটিতে। রক্তাক্ত মরণাপন্ন শিলাদের মনে হল, ওর সামনে তরোয়াল হাতে, খালিগায়ে সোনার লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে মিশরের ন্যাড়ামাথা ফ্যারাও তৃতীয় আমেনহোতেপ, যার গল্প দাদুর কাছে অনেকবার শুনেছে। শকুনমাথা-মুকুট বাঁ হাতে মাটিতে নামিয়ে রাখল ফ্যারাও।
সম্রাটকে দেখে শিলাদের মনে পড়ল। দাদু বলেছিল, ট্রয়ের যুদ্ধে একিলিসের কাছে হেরে যাবার পর, মেমননের শব যখন চিতায় দাহ করা হচ্ছিল তখন ধোঁয়ার কুন্ডলি থেকে অজস্র মেমনয়েড পাখি জন্মেছিল, যারা দুটো পরস্পরবিরোধী অংশে ভাগ হয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করে দিয়েছিল। সেই থেকে ফিবছর মেমননের স্মৃতিতে একদল পাখি জেতে আর আরেকদল হারে।
শিলাদ পড়ে গিয়েছিল হেরোদের দলে। মৃত্যুমুখী শিলাদের আবছা সন্দেহ জাগল, তাহলে দাদু কি বিজয়ী দলে পড়ে গিয়েছিল?
আমেনহোতেপ বলল, তুমি তো মরতে চলেছ, তোমার শেষ ইচ্ছা কী?
শিলাদ নিজেকে বলতে শুনল, জাঁহাপনা, আমি একা, সঙ্গিনীহীন, উড়ে-উড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সেক্স বলতে শুধু ইভ টিজিং; আমি পুরোদমে নাইট-লাইফ এনজয় করতে চাই; জীবনের মানে খুঁজতে চাই। নিজেকে ডিফাইন করতে চাই।
মেমনয়েড পাখিরা যেমন ঝাঁক বেঁধে উদয় হয়েছিল তেমনই হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।
শিলাদ টের পেল ও একটা গাবগাছের গাছনির্মিত কোটরবাড়ির ভেনিশিয়ান জানালা থেকে মুখ বের করে, ঘন রাত হলেও, নাইটভিশান চোখ দিয়ে চারিদিক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আশেপাশের গাছের আর এই গাছটার ডালে-ডালে কোটরবাড়ির দরজায় পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে প্যাঁচাপেঁচি বুলেভার্দের দামি-দামি কলগার্ল। খুড়ুল্লে প্যাঁচা যার গায়ে বুটিদার বুটিক শাড়ি, ছাইরঙা টু-পিসে হুতুমনি, ফিল্ম স্টারের ডিজাইনার পোশাকে লক্ষ্মীপ্যাঁচা, বাদামি চুড়িদার কুর্তায় ভুতুমনি, খয়েরি মিনি স্কার্ট-ব্লাউজে কালপ্যাঁচা। ঠোঁট দিয়ে গায়ের পোকা বেছে রূপটান দিচ্ছে ভুতুমনি।
সামনে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিল শিলাদ, বিশাল দিঘিটায় ভাসছে পদ্মলতা পানিফল কচুরিপানা টোপাপানা কলমিশাক হেলেঞ্চা পাটিবেত শাপলা মাখানা বিষকাঁটা হিজজ বরকন উকল জাতের ভাসন্তি-ডুবন্তি লতাপাতা।ঘাই মারছে তেলাপিয়া। ব্যাঙানির পিঠে চেপে ফেরি পার হচ্ছে ব্যাঙ। চোর-পুলিশ খেলছে জলঢোঁড়া।
দাদু কোথায়? যুদ্ধ জিতে কি মেমনয়েডদের সঙ্গে উড়ে বিলীন হয়ে গেল? ফ্যারাও কি ফিরে গেল মিশরে, পিরামিডের গুপ্তকবরে? হেলেসপন্টের তীরে মেমননের দীর্ঘ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল ফ্যারাও। সকালের প্রথম সূর্যকিরণ তার ওপর পড়লে অলৌকিক সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা সেই আলোকে আহ্বান জানাত। রাতের জীবন চেয়ে শেষে কি এই ঘন অন্ধকার জুটল? আমি এখন কোথায়? আমার পালকের রঙ এরকম কেন? মনে হচ্ছে যেন গ্রীবা নেই, ঠোঁট আর ডানা ছোট হয়ে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি কে? চিন্তায়, চিন্তার আক্রমণে, শিলাদ বিপর্যস্ত।
একটা ছুটকোছোট প্যাঁচা, মাপে কাঁচা, বয়সে পাকা, শিলাদের জানলার আলসেতে এসে বসল ফুড়ুৎ কায়দায়। গলা নামিয়ে, অভিবাদন জানিয়ে বলল, গুড মর্নিং স্যার উলুক, আমি আপনার পছন্দ-অপছন্দ জানি, সেই হাউস অব লর্ডসের দিনগুলো থেকে । আপনি তো লর্ড ধর্মঠাকুরের সেক্রেটারি। হ্যালি বেরি আর মার্লিন মনরো মেশালে যে অপরূপা হয়, তা-ই আছে স্যার, বসনিয়া আলবানিয়া ক্রোয়েশিয়া সার্বিয়া থেকে এনে টাটকা স্টক করা। আমরা এক্সট্রা বেনিফিটও দিই স্যার। আপনার অবৈধ প্রেম যাতে ব্রেকিং নিউজ হয় তার জন্যে নিউজ চ্যানেলদের বলে দেব, সে বাবদ এক্সট্রা দিতে হয়ে না, বিজ্ঞাপন থেকে কভার করে নেব।
আগন্তুকের গড়গড় করে বলা সেল্সম্যানীয় কথা শুনে নিজের সদ্য পাওয়া খ্যাতি আর আত্মপরিচয়ের মুখোমুখি হল শিলাদ তরফদার। গ্রেট গুডনেস, ও কিনা এখন একজন সুটেডবুটেড প্যাঁচা। কী হতে চেয়েছিল আর কী হয়েছে।ওর দীর্ঘশ্বাস-মাখা উক্তি, থ্যাৎ, ভাল্লাগে না, শুনে, ছুটকোছোট প্যাঁচা ওকে উ*ফুল্ল করতে চাইল, ভাল্লাগবে স্যার উলুক, অবশ্যই ভাল্লাগবে, আমি দুবছরের গ্যারেন্টি আর তিন বছরের ওয়ারেন্টি দিচ্ছি, একবার এসে চোখ আর লিঙ্গ সার্থক করুন, তারপর বলবেন। ক্যাশ ডিসকাউন্ট আছে।
জলজমা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে, ছুটকোছোটর পাশাপাশি উড়ে, পাঁচতলা মাল্টিপ্লেক্সের জানলায় বসানো অকেজো এসি মেশিনের খপ্পরে নেমে, সলমা-সিতারা বসানো দুধ-সাদা শিফন শাড়িতে, ঠোটে ল্যাকমে লিপস্টিক, চোখে কাজল, হাফল্যাংটি হাফমডেলি, কোলাব্যাঙি পারফিউম-মাখা যুবতী প্যাঁচার সান্নিধ্যে পোঁছে, ছোটকোছোট প্যাঁচাসুন্দরীকে বলল, কথাটথা বলে রফা করা নাও, আমি ভোররাতে আসব। তারপর শিলাদের দিকে ফিরে, ম্যাডামের নাম নিঋিতি কোনার।
কী ভাবে শুরু করবে ভাবছিল শিলাদ। কিছুক্ষণেই যার সঙ্গে শোবে, এমন সুশ্রী সুবেশা অপরিচিতার সঙ্গে কথা বলার মাত্রা ওর জানা নেই। ইতস্তত ভাবটাই বা কাটানো যায় কী ভাবে? নিঋিতির জানা আছে প্রেমিকদের প্রাথমিক সমস্যা; তাই ওই শুরু করল। আপনি আমাকে রিতি রিতু রিতা যে উচ্চারণ আপনার পছন্দ, সেই নামে ডাকবেন।
নিঋিতির খথাটা শেষ হতেই, গ্রেনেড ফাটার আর গুলি চলার শব্দে শিলাদকে চমকে উঠতে দেখে ও বলল, ও কিছু নয়, সম্ভবত সন্ত্রাসবাদীরা খুনোখুনি খেলতে বেরিয়েছে, কিংবা বোধহয় চিনের কয়লাখনিতে সাপ্তাহিক বিস্ফোরণ হল।
নিঋিতির বিছানাটা পালকের ছোট-ছোট ছুনিগুলি দিয়ে বানানো, তার ওপরে লাউডগা সাপের চামড়ার সবুজ চাদর পাতা। লইটা মাছের মুসল্লম আর ইঁদুরের মেটে-ভরা পরোটা খেতে দিয়ে নিঋিতি গা ঘেঁষে বসে শুধোল, আমাদের শাস্ত্রে বেশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ, আমরা তাই সাময়িক বিয়ে করি।
এসোগো, তা-ই করি, বলে শুরু করতে গিয়ে, দীর্ঘ গলার বদলে গ্রীবাহীন হবার দুঃখ পেয়ে বসল শিলাদকে। ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাতা গিয়ে বুঝল তা প্রায় অনুপস্হিত, চুমু খেতে গেলে মাথা ঠুকে যাবার যোগাড়; যা আছে তা শকুনের মতন বহু উদ্দেশ্যপূর্ণ নয়, প্রথিবীকে শবমুক্ত করারও অনুপযুক্ত।
শিলাদের অস্বস্তির ভিন্ন ব্যাখ্যা করে নিঋইতি বলল, তুমি কি প্রথমবার? দাঁড়াও দেখিয়ে দিচ্ছি কী ভাবে এগোবে। এ নাও কন্ডোম, এটা পরে নাও, ঝিঁঝির আন্তর্বাস-ডানা দিয়ে তৈরি মিউজিকাল কন্ডোম। তালে-তালে দ্রুতলয়ে সঙ্ঘীতের মূচ্ছনায় পোঁছে ঠিক সময়ে বিলম্বিত লয়ে নেমে আসতে হবে, আর তুমিও তখন নেমে আসবে। ডোন্ট ওয়ারি, বি হ্যাপি, ডানা দিয়ে শিলাদকে জড়িয়ে বলল নিঋিতি। অ্যারোবিক্স ক্যারামতির কাজ যখন শীর্ষে উঠে বিলম্বিত লয়ে ফুরিয়ে আসছে, নিঋইতি আশ্চর্য হবার নকল মুখভঙ্গী আর তৃপ্ত হবার খাঁটি দেহভঙ্গী করে জানাল, কন্ডোম তো ফেটে উপচে পড়ছে গো, কতকালের মজুতকরা ভাঁড়ার, মধুসাগরের দুকুলে যে প্লাবন! নামতে-নেমতে শিলাদ বলল, প্রিয়ে, মাই লাভ, এখনও কয়েক সাগর রাবড়ির স্টক আছে, খেপে-খেপে সাময়িক বিবাহে খরচ করব অ্যাঁ?
এভাবে, সরকারি কর্মীর মতন, শিলাদের ঘুমিয়ে দিন যায়, জেগে রাত যায়। ভাঁড়ার মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়, মজুত হয় খরচ হয়। একদিন দুপুর একটা নাগাদ চড়াইপাখিদের চেঁচামেচিতে ওদের ঘুম ভেঙে গেল।লাউডগা সাপের সবুজ চামড়া-পাতা বিছানায় শুয়ে কোটরবাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শিলাদ দেখল, বাবুইপাখির যে ঝুলন্ত বাড়িগুলো বাবলাগাছ থেকে ঝুলছে, তার বাইরে শখানেক চড়াইপাখি জোরে-জোরে স্লোগান দিচ্ছে, চলবে না চলবে না, চক্রান্তকারীর হলুদডানা গুঁড়িয়ে দাও গুঁড়িয়ে দাও, আমাদের আবাসন বানিয়ে দিতে হবে দিতে হবে, কুটোকাঠি এনে দিতে হবে দিতে হবে, বাবুইবাসা চলবে না চলবে না।
আরেকদিন, ওইরকম সময়েই, নিঋইতিকে ডানা জড়িয়ে উদোম শুয়ে আছে, আচমকা কাকমাগি আর কোকিলমাগির অশ্লীল চেল্লাচিল্লিতে ঘুম ভেঙে গেল শিলাদের। বাটামাছের কাঁটায় গড়া ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড সরিয়ে দেখল, কাকমাগি অনুযোগ করছে যে কোকিলমাগি ওর চুবড়ি থেকে ডিম তুলে ফাটিয়ে দিয়েছে। জবাবে কোকিলমাগি বলছে, শিকনিখোরের বেসুরো ডিম ও বাঁ পা দিয়েও ছোঁবে না।
প্রতিদিন অমন কিচাইন। এর সঙ্গে যোগ হল একমাসের বেশি রোজ ভোরে ঘুমোতে যাবার সময় থেকে সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙার সময় পর্যন্ত ভোত, লোট আর ফোট উৎসবের ছ্যাঁচোড়দের এই ধরনের অবিরাম গলাবাজি । বাস্তুঘুঘুর বক্তৃতায়: ঘুঘুঘু আমাকে আমাকে ঘুঘুঘু। শহুরে কাকের কাকাকা কাকাকা আমাকে আমাকে কাকাকা। জালালি পায়রার বকবক বকম বকম আমাকে আমাকে বকবক বকম বকম। পাতিহাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক আমাকে আমাকে প্যাঁকপ্যাঁক। হাড়িচাচার ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচা আমাকে আমাকে ঘ্যাঁচাঘ্যাঁচা। জংলি মোরগের কোঁকোর কোঁ কোঁকোর কোঁ আমাকর আমাকে কোঁকোর কোঁ। জলে স্হলে অন্তরীক্ষে সর্বত্র এই বুকনিবাতেলার চোঙা।
দালাল ছুটকোছোট, যার নাম শিলাদ জেনেছে, মিস্টার কিছুলাল আধাকায়স্হ বলে, তাকে জানাল, ওহে, এই পয়সাঅলা ছোটলোকদের পাড়ায় তো টেকা দায়, আমি তো বোধহয় কালা হয়ে গেলুম; ব্যাঙের মেটিং গান, সাপ-সাপিনীর যৌননাচের ঝংকার, ছুঁচোর কেত্তন, ল্যাঠামাছের চাচাচা কিচ্ছু শুনতে পাই না।
নিঋইতির আশঙ্কা হল যে শিলাদের মন ভরে গেছে, এবার বোধহয় বিয়ের মেয়াদি করার ভেঙে অন্য কোনো মডেলের সঙ্গে লিভ টুগেদারের তাল করছে। শিলাদের মেজাজ ফুরফুরে করে তোলার জন্যে উন্দুরিয়ান, ছুঁচাম্বো, খরগোশ্ত, খানাপোনা, টিকটিকানো, ব্যাঙথাই, ওয়াটারঢোঁড়া ইত্যাদি নামের বিখ্যাত রেস্তরাঁ আর বারে নিয়ে গেল।
শিলাদের সত্যিই ভাল না-লাগার জ্বর আসতে লেগেছিল ধিকিধিকি; চিনন চিনন করে চাগিয়ে উঠছিল অনভিপ্রেত উদাসীনতা। শকুন হয়ে একরকমের যৌন-অযৌন একঘেয়েমির ক্লন্তি পোষণ করতে বাধ্য হতো; প্যাঁচা হয়ে লালন করতে হচ্ছে আরেক ধরনের। মাথার দুদিকে রোঁয়ার ধুচুনি টুপি-পরা ঢাউসবুক পিঙ্গলনয়না প্যাঁচামডেল, যে জোনাকির হার গলায় দেবদারু গাছের কোটরবাড়ি থেকে শিলাদকে ইশারা করে, ওই যুবতীর কাছে গিয়েও এই বোরডাম কাটবে বলে মনে হয় না।
দুজনে অন্য কোথাও বরং যাওয়া যাক। ইঁদুরচন্দ্রিমা করতে-করতে শিলাদ নিঋিতিকে বলল, হে প্যাঁচাতমা খড়িসুন্দরী, এখানে আর ভাল লাগছে না, চলো অন্য কোথাও গিয়ে ব্যাঙচন্দ্রিমা বা কাঠবিড়ালি-চন্দ্রিমা করি। নিঋিতি সায় দিল, হ্যাঁ চলো চলো, এবার আবার দেবীর দোলায় আগমন বলে মানুষের স্নেহধন্য ইঁদুরও এই অঞ্চলে ফুরিয়ে যেতে পারে; গাঁয়ে-গঞ্জে ভোট, লোট আর ফোট উৎসবের ফলে অনেক মানুষ ইঁদুরের বাড়ি থেকে ধান চুরি করছে তা তো আমরা স্বচক্ষে নাইটভিশানে দেখেছি।
ওরা আরও উঁচু বাড়িতে উড়ে গিয়ে এগারোতলার দক্ষিণমুখো অব্যবহৃত কাচের জানলার আলসেতে বাসা বাঁধল, যে বহুতলটা, ছুটকোছোট মিস্টার কিছুলাল আধাকায়স্হের বয়ান অনুযায়ী, বিশ্বব্যাঙ্কের স্হানীয় দপতর। নিঋিতি জানাল, এই জানলায় আমার বিলিতি ঠাকুর্দা আমাএ দেশি ঠাকুমার সঙ্গে মেয়াদি করারে বিয়ে করে তিন বচ্ছর ছিল। আমার মা মাসিরা মামারা তাই খুব ফর্সা, আমিও ঠাকুর্দার গায়ের রঙ পেয়েছি।
শিলাদ বুঝতে পারছিল যে খারাপ লাগার ক্রিয়াটা রয়েছে ওর নিজের প্যাঁচা-মস্তিষ্কে, ঘাপটি মেরে, তাতে ফর্সা-তামাটে-কালোর কিছু করার নেই, চব্বিশ ঘন্টার অহরহ সঙ্গম করেও তা যাচ্ছে না, নানা সুরের মিউজিকাল কন্ডোম পরা সত্বেও।
আরও নরম বিছানা পেতেছে নিঋিতি। সামনের দিকে ড্যাবডেবে কাজলটানা চোখ হওয়ায়, পুরো মাথাটা ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে সংসারের কাজ করে ও। শিলাদেরও অমন চোখ, তাই পুরো মাথা ঘুরিয়ে নিঋিতির কাজকর্ম দ্যাখে। অদ্ভুত কায়দায় ও পেতেছে বিছানাটা।ওর দ্বিতীয় পাকস্হলীতে যা যায়, সে-সব হাড়-পালক-লোম জমা করে নিখুঁত ছোট-ছোট ছুনিগুলি বানি্য়ে কেশে-কেশে বের করে। আর সেইসব গুলি দিয়ে বিছানা পাতে। এই বিছানা পাতার জন্যে রোজ ও একটা সাদা খরগোশ বা সাদা লক্কা পায়রা ধরে এনে নিজে খেয়েছে, শিলাদকে খাইয়েছে।
ভেতর থেকে কুরে-কুরে ভাল না-লাগার ব্যারামে, ভাল খাওয়া-দাঔবা করেও শিলাদ রোগা হয়ে যাচ্ছিল। ছুটকোছোট একদিন বেড়াতে এসেছিল, তখন নিঋিতি গেছে পি এন পি সি করতে, আর সেই সঙ্গে সবাইকে খবর দিতে যে ও শিগগিরই দুটো যমজ ডিম প্রসব করতে চলেছে, অশথ্থগাছের নার্সিংকোটরে বেড বুক করা হয়ে গেছে, শিলাদের ডিগডিগে চেহারা দেখে বলল, এ কি স্যার উলুক, বিশ্ব ব্যাঙ্কের কোয়ার্টারে থেকেও আপনার এরকম দুর্ভিক্ষায়িত নাকনকশা মাসকাঠামো হয়ে গেছে!
ছুটকোছোট চলে যাবার পর, তখনও নিঋিতি বাড়ি ফেরেনি, তারাগুলো টিপটিপ করে অন্ধকার আকাশে পড়া আরম্ভ হয়েছে, শিলাদের শরীর জ্ঞান হারিয়ে এগারোতলা জানলা থেকে হাওয়ার সরের ওপর নেমে গেল।

Malay Roy Choudhury ।। মলয় রায়চৌধুরী