কুস্তির প্যাঁচ

যে লোকটা রোজ ভোররাতে উঠে দেড়শো বুকডন আর তিনশো বৈঠক দেয়, তারপর জিমনাস্টিকস করে, বালির বস্তায় ঘুষি মারে এবং কুংফু ক্যারেট জুডো অভ্যাস করে, তার আবার মর্নিংওয়াকের কি প্রয়োজন, এটা অনেকেরই প্রশ্ন। কিন্তু গোয়েন্দা বরদাচরণ এর জবাব দিতে পারবেন না। তবে এটা ঠিক যে, আজও প্রতিদিন সকালে তাকে দাদুর সঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে যেতে হয়। যখন থেকে হাঁটতে শিখেছেন, সেই তখন থেকে আজ অবধি রোজ।

বরদাচরণের দাদুর বয়স পঁচাশি। যৌবনকালে নামকরা কুস্তিগির ছিলেন। অনেক মেডেল কাপ শিল্ড পেয়েছেন। এখনও শালগাছের মতো ঋজু ও প্রকাণ্ড শরীর। রোজ কুড়ুল চালিয়ে দু’মন করে কাঠ কাটেন। পুকুরে ঘণ্টাখানেক সাঁতরান। কুয়ো থেকে বিশ-ত্রিশ বালতি জল তোলেন। যৌবনে গোটা একটা খাসির মাংস খেয়ে ফেলতে পারতেন! ডিম খেতেন দু’ডজন করে। আধ সের ঘি। পাঁচ সের দুধ। এখন আর অত খান না। তবু যা খান, তা তিনটে লোকের খোরাক। সকালে উঠে পরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নিয়ে

ফুসফুস পরিষ্কার করতে প্রাতঃভ্রমণ তাঁর নিত্যকর্ম। এখনও তার চুল পাকেনি। দাঁত পড়েনি, চামড়া কোচকায়নি। পঁচাশি বছরেও দিব্যি সুঠাম চেহারা অম্বিকাঁচরণের। তবে কিনা লোকটা একটু বাতিকগ্রস্ত। তাঁর কাছে সবকিছুই সেই আগের মতোই আছে, কিছুই পাল্টায়নি।

এই যে বরদাচরণ এখন পূর্ণযুবক, ইয়া দশাসই লম্বা-চওড়া চেহারা, তার ওপর নামকরা গোয়েন্দা, এসব অম্বিকাঁচরণের খেয়ালেই থাকে না। সকালে উঠেই তিনি দাঁতন করে, পুজোপাঠ সেরে থানকুনিপাতা আর কলি-ওঠা ছোলা খেয়ে হাঁক দেন, “দাদুভাই ও দাদুভাই।” ডাক শুনে মনে হয় যেন তিন-চার বছর বয়সী নাতিকে ডাকছেন। সেই ডাক শুনে বরদাচরণ গুটিগুটি দাদুর কাছে এসে দাঁড়ান। তারপর দাদুর হাত ধরে পিছু পিছু বেরিয়ে আসেন। দাদু অম্বিকাঁচরণ যেভাবে বহুকাল আগে ছোট বরদাচরণকে সাবধানে নর্দমা পার করাতেন, এখনও তেমনি হাত ধরে নদৰ্মা পার করে দেন। গাড়িঘোড়া দেখলে বলেন, “সরে এসো দাদুভাই, চাপা দেবে যে!” কুকুর বা গোরু দেখলে হাঁ হাঁ করে ওঠেন, হাতের লাঠিটা আপসাতে আপসাতে বলেন, “যাঃ যাঃ, দাদুভাই ভয় পেয়ে কাঁদবে!”

বরদাচরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কী আর করবেন! পরশুদিনও তিনি একজন ডাকাতকে ধরতে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমেছেন। গত মাসেই তিনি খুনী রঘুবীর সিংয়ের পিস্তলের মুখে পড়েছিলেন। এই তত সেদিন কুখ্যাত একদল হাইজ্যাকারের পিছু নিয়ে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক বোয়িং সাতশো সাঁইত্রিশ বিমানের একেবারে কেবিনের মধ্যে দুর্দান্ত ফাঁইট করে চারজন বিমান-ছিনতাইকারীকেই ঘায়েল করে এলেন। কিন্তু দাদুকে সে-কথা কে বোঝাবে?

দাদুর সঙ্গে বরদাচরণের এই মর্নিংওয়াক দেখে সবাই ভারী অবাক হয়।

হঠাৎই একদিন একখানা ঘটনা ঘটল। যাকে বলা যায় বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। প্রায় ষাট বছর আগে মুর্শিদাবাদের এক নবাবের বাড়িতে বিখ্যাত পাঞ্জাবী কুস্তিগীর শের সিংকে অম্বিকাঁচরণ হারিয়ে দেন। তাই নিয়ে খুব হৈ-চৈ হয়েছিল। নবাব খুশি হয়ে সোনায় বাঁধানো একখানা কাপ উপহার দিয়েছিলেন অম্বিকাঁচরণকে। এখনকার বাজারে সেই কাপটার দাম হেসেখেলে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা তো হবেই। অম্বিকাঁচরণ একখানা কাঁচের বাক্সে যত্ন করে কাপটা রেখে দিয়েছিলেন। নিজ হাতে রোজ মোছেন, কেউ এলে দেখান। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, কাপটা নেই। তার বদলে কাঁচের বাক্সে একটা চিরকুট পড়ে আছে। তাতে লেখা : “অম্বিকাভাই, লড়াইটায় জোচ্চুরি ছিল। তুমি আমাকে চিত করতে পারেনি। আমার কোমরটা মাটিতে লেগেছিল মাত্র। কিন্তু নবাবের ব্যাপার্টি তখন এমন জগঝম্প বাজনা শুরু করে দিল আর তাই শুনে তুমি জিতেছ ভেবে সব মেয়ে-বউরা এমন শাঁখ বাজাতে আর উলু দিতে লাগল যে, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ওরকম আওয়াজ আমি জীবনে শুনিনি। তোমাকে কাঁধে নিয়ে লোকের সে কী নাচ! আমি নবাবকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু কে কার কথা শোনে? নবাব আমাকে আমলই দিলেন না। সেই থেকে মনের মধ্যে আগুন পুষে রেখেছি। ইচ্ছে ছিল তোমাকে অনেক আগেই হারিয়ে দিয়ে প্রমাণ করি যে, তোমার চেয়ে আমি অনেক বড় কুস্তিগীর। কিন্তু সেই সুযোগ আর এতকালের মধ্যে ঘটে ওঠেনি। নানা ধান্ধায় আমাকে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তবে সর্বদাই আমি তোমার খোঁজখবর রেখেছি। এতদিন বাদে ফের তোমার পাত্তা মিলেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসে তোমাকে পেলাম না। দেখলাম, সেই ট্রফিটা তোমার ঘরে আজও সাজানো আছে। দেখে পুরোনো স্মৃতিটা চাগিয়ে উঠল। রক্ত গরম হয়ে গেল, হাত পা নিশপিশ করতে লাগল। সামনে তোমাকে পেলে রদ্দা লাগাতাম। যাই হোক, এই ট্রফিটা আমি আমার বলেই মনে করি। তাই এটা চুপিচুপি নিয়ে যাচ্ছি। এতে যদি তোমার আপত্তি থাকে, তবে আগামীকাল বেলা বারোটার মধ্যে জেমিনি হোটেলের বারো নম্বর ঘরে এসো। ট্রফিটি যদি নিতান্তই ফেরত পেতে চাও, তাহলে আমার সঙ্গে আর-একবার তোমাকে কুস্তি লড়তে হবে। যদি তুমি জেতো, তাহলে তোমাকে ট্রফি তো ফেরত দেবই, ওস্তাদ বলেও মেনে নেব। আর যদি তুমি হারো, তাহলে আমাকে ওস্তাদ বলে সেলাম জানাবে। ইতি শের সিং।”

এই চিরকুট পেয়ে অম্বিকাঁচরণ তো মহা খাপ্পা। বাতাসে ঘুষি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বলতে লাগলেন, “ব্যাটা শের সিংয়ের এত সাহস! সেদিন লড়াইতে যে ওর লেংটি খুলে নিইনি, তাই ওর সাত জন্মের ভাগ্যি! এমন প্যাঁচ মেরেছিলাম যে ব্যাটা একেবারে কুমড়ো গড়াগড়ি। আবার বলে কিনা সেদিন ওই নাকি জিতেছিল। আয় না ব্যাটা, এখনও এই বুড়ো বয়সে ভেলকি দেখিয়ে তোকে এরোপ্লেন-পাঁচ মেরে ধোবিপাটে আছড়ে মারতে পারি কি না, দেখে যা!”

বরদাচরণ তাড়াতাড়ি দাদুকে ধরে বসিয়ে পাখার বাতাস-টাতাস দিয়ে একটু ঠাণ্ডা করে বললেন, “সেদিন কী ঘটেছিল তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু এতদিন পরে লোকটা আবার কুস্তি লড়তে চায় কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। শের সিংয়ের বয়স এখন কত হবে বলো তো?”

অম্বিকাঁচরণ একটু চিন্তা করে বললেন, “আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় তো হবেই। তা তার এখন নব্বইয়ের কম না।”

চোখ কপালে তুলে বরদাচরণ বললেন, “নব্বই! এই বয়সেও লোকটা কুস্তি লড়তে চায়? নাঃ দাদু, লোকটা দেখছি সাঙ্ঘাতিক।”

অম্বিকাঁচরণ মাথা নেড়ে বললেন, “সাঙ্ঘাতিক তো বটেই। শের সিংয়ের নাম শের সিং হলো তো খালি হাতে একটা রয়েল বেঙ্গল বাঘ মেরে। আসামের জঙ্গলে বুনো মোষের সঙ্গেও নাকি একবার হাতাহাতি করেছিল। এমন দাপট ছিল যে, সহজে তার সঙ্গে কেউ লড়তে রাজি হতো না।”

বরদাচরণ বললেন, “এ-রকম লোককে একবার চোখের দেখা দেখে আসার দরকার। চলো দাদু, কাল তোমার সঙ্গে আমিও যাব।”

পরদিন অম্বিকাঁচরণ নাতি বরদাচরণের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন। জেমিনি হোটেল তাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরেও নয়। দোতলায় উঠে বারো নম্বর ঘরের বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে অম্বিকাঁচরণ বাজখাই গলায় চেঁচাতে লাগলেন, “কোথায় শের সিং? বেরিয়ে আয় ব্যাটা। অম্বিকাকে চিনিস না! আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন।”

ঘরের ভিতর থেকে একটা হুঙ্কার শোনা গেল। “এসেছিস? সিংহের গুহায় শেষে ঢুকবার মতো সাহস হলো তোর!”

বলতে বলতে দড়াম করে দরজা খুলে গেল!

শের সিংকে দেখে বরদাচরণের চোখ ছানাবড়া। পঁচাশি বছরেও তার দাদু অম্বিকাঁচরণের স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভাল বটে, কিন্তু নব্বইতে শের সিং যেন প্রকৃতই সিংহ। ইয়া বুকের ছাতি, বিশাল দুটো শালখুটির মতো হাত, পাকানো মোচ, বাবরি চুল।

দুজনেই দুজনের দিকে কিছুক্ষণ রোষকষায়িত লোচনে চেয়ে রইলেন। পাছে এখানে দুজনেই লেগে যায়, সেই ভয়ে বরদাচরণ তাড়াতাড়ি দু’জনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন।

শের সিং জিজ্ঞাসা করলেন, “এটি কে?”

অম্বিকা বললেন, “নাতি।”

শের সিং সঙ্গে সঙ্গে ভারী নরম হয়ে বললেন, “নাতি! তা আগে বলতে হয়। এসো খোকা, এসো, তোমার দাদুর সঙ্গে ঝগড়া আছে বটে, কিন্তু তোমার সঙ্গে তো নেই। তা ছাড়া শিশুরা হচ্ছে জগতের আনন্দ।”

“খোকা” |||||||||| “শিশু” এইসব বিশেষণ শুনে বরদাচরণ হাসবেন কি কাঁদবেন তা বুঝতে পারছেন না।

ঘরে ঢুকে বরদা দেখেন বেশ লম্বাচওড়া চেহারার এক যুবক বসে বসে একটা পেতলের গামলায় পুঁটুনি দিয়ে বাদামের শরবত বানাচ্ছে। শের সিং বললেন, ‘অম্বিকা, এই দ্যাখো, এ হচ্ছে আমার নাতি। ও ভাবে, আমি বুড়ো হয়েছি, তাই সব সময়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকে।”

অম্বিকাঁচরণ যুবকটির থুতনি নেড়ে দিয়ে বললেন, “বাঃ বাঃ দিব্যি দেখতে হয়েছে তো খোকাটিকে!”

শের সিং বললেন, “কাজিয়া পরে হবে। আগে শরবত খাও।”

অম্বিকা বললেন, “শরবত না হয় খাচ্ছি। কিন্তু আমার বাড়িতে এ কদিন যে দুটো ডালভাত খেতেই হবে শের সিং।”

এরপর দু’পক্ষের বেশ সম্ভাব হয়ে গেল। অনেকক্ষণ বসে দু’জন নানা কথা কইলেন। হাসিঠাট্টাও হলো। গল্পগুজবে অনেকটা বেলা কাবার করে অম্বিকা উঠলেন। বরদাচরণ স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন, দুই বুড়োর কুস্তিটা বোধহয় এড়ানো গেল।

কিন্তু বিদায় দেওয়ার সময় শের সিং হঠাৎ বললেন, “তাহলে অম্বিকা, কুস্তিটা কবে হচ্ছে?”

অম্বিকাঁচরণ সতেজে বললেন, “যেদিন বলবে। কাল বললে কাল।”

“তাহলে কালই, ভাড়া পিটিয়ে দাও। ফুটবল মাঠে দু’জনে নেমে পড়ব।”

“তাই হবে।”

খবরটা বিদ্যুৎবেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অতীতের বিখ্যাত পালোয়ান শের সিং যে এখনও বেঁচে আছেন তাই অনেকে জানত না, তার ওপর অম্বিকাঁচরণ যে একদা শের সিংকে হারিয়েছিলেন সে খবরও অনেকের অজ্ঞাত। সুতরাং তুমুল উত্তেজনা দেখা দিল। রাতারাতি ফুটবলমাঠের মাঝখানে কুস্তির মাটি তৈরি হয়ে গেল। চারদিকে চেয়ার বেঞ্চি সাজানো হতে লাগল। ভিড় সামলানোর জন্য বাঁশের বেড়া তৈরি হলো। সকাল থেকে ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বাচ্চা কাতারে কাতারে এসে চারদিকে জায়গা দখল করতে লাগল। পঁচাশি বছরের একজন মানুষের সঙ্গে নব্বই বছর বয়সী আর-একজনের লড়াই। সোজা কথা তো নয়!

কিন্তু মুশকিল হল, অম্বিকাঁচরণের সকাল থেকেই শরীর খারাপ, সকাল থেকেই রোদে বসে বারবার বগলে থার্মোমিটার দিচ্ছেন। বরদাচরণকে ডেকে বলছেন, “দ্যাখ তো দাদু, কত উঠল।”

বরদাচরণ থার্মোমিটার দেখে বলেন, “সাড়ে সাতানব্বইতেই তো দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।”

“থার্মোমিটারটা তাহলে একেবারেই গেছে। আমার তো মনে হয় এক শো এক-এর কম না। দে তো, আবার লাগিয়ে দেখি।”

বরদাচরণ দাদুর কপালে হাত দিয়ে বলেন, “রোদে বসে গা একটু গরম হয়েছে বটে, কিন্তু জ্বর বলে তো মনে হয় না।”

অম্বিকাঁচরণ খেঁকিয়ে উঠে বলেন, “তুই জ্বরের কী বুঝিস? এ হলো নাড়ির জ্বর। ভিতরে ভিতরে গুমরে-গুমরে ওঠে।”

বরদাচরণ বুঝলেন, দাদু লড়তে চান না, কিন্তু না লড়লেও নয়। চারদিকে খবর রটে গেছে। কাতারে কাতারে লোক আসছে লড়াই দেখতে।

বরদাচরণ বা অম্বিকাঁচরণ জানেন না যে, ওদিকে শের সিংয়ের শিবিরেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। ভোররাত্রি থেকেই শের সিং তার নাতিকে বলছেন, “দ্যাখো ভাই, আমার পেটে খুব ব্যথা হয়েছে।”

নাতি বলল, “জীবনে তোমার কোনোদিন তো পেটে ব্যথা হয়নি দাদু!”

শের সিং খিঁচিয়ে ওঠেন, “হয়নি বলেই কি হতে নেই? আমার দারুণ ব্যথা হয়েছে, মনে হয় কলেরাই হলো বোধহয়।”

“কলেরা হলে তো ভেদবমি হয়।”

“তুই খুব বেশি জেনে গেছিস। কলেরা কতরকমের হয় জানিস? ভিতরে ভিতরে আমার ভেদবমি শুরু হয়ে গেছে।”

নাতি ফাঁপরে পড়ে গেল। লড়াই না হলে যে দাদুর সম্মান থাকবে না।

“বেলা বাড়তে লাগলো। অম্বিকাঁচরণ কম্বলমুড়ি দিয়ে সেই যে শুয়ে পড়েছেন, আর নড়াচড়ার নাম নেই। এদিকে শের সিং সেই যে বাথরুমে ঢুকে দরজা দিয়েছেন, আর বেরোনোর কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

অগত্যা বরদাচরণ দাদুর অবস্থার কথা জানাতে শের সিংয়ের কাছে। রওনা হলো, আর শের সিংয়ের নাতিও নিজের দাদুর কথা জানিয়ে ট্রফিটা ফেরত দিয়ে আসতে রওনা হলো অম্বিকাঁচরণের বাড়ি।

বরদাচরণ যখন শের সিংয়ের ঘরে এসে হাজির হলেন, তখনও শের সিং বাথরুমে।

বরদাচরণ খুব বিনয়ী গলায় ডাকলেন, “শেরদাদু! ও শেরদাদু!”

বাথরুমের ভিতর থেকে খুব সতর্ক গলায় শের সিং সাড়া দিলেন, “কে রে? কী চাই?”

বরদাচরণ খুব কুণ্ঠিতভাবে বললেন, “শেরদাদু, আমি বরদাচরণ, আমার দাদু অম্বিকাঁচরণের সকাল থেকেই টাইফয়েড।”

‘‘অ্যাঁ!”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, ডাক্তাররা বলছে, ব্যামো খারাপের দিকে যেতে পারে।”

“সত্যি বলছ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

সঙ্গে সঙ্গে বাথরুমের ভিতরে একটা রণহুঙ্কার শোনা গেল। তারপর দড়াম করে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে শের সিং হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য হেসে বললেন, “আরে এ তো আমি আগেই জানতাম। অম্বিকার মুরোদ কী তা সেই ষাট বছর আগেই আমার জানা হয়ে গেছে। লড়াইয়ের নামে যার জ্বর আসে সে আবার মরদ! ছোঃ ছোঃ।”

ওদিকে শের সিংয়ের নাতি কাচুমাচু মুখে গিয়ে অম্বিকাঁচরণের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, “অম্বিকাদাদু! ও অম্বিকাদাদু!”

“কে?” কম্বলের ভিতর থেকে অম্বিকাঁচরণ ক্ষীণস্বরে বললেন, “কে?”

“আমি শের সিংয়ের নাতি। দাদুর যে ভোর-রাত্রি থেকে খুব ভেদবমি হচ্ছে। ডাক্তার বলছে কলেরা।”

“সত্যি তো?”

“আজ্ঞে সত্যি। দাদু তো বাথরুম থেকে বেরোতেই পারছেন না।”

কম্বলটা এক ঝটকায় নামিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন অম্বিকা। তারপর হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বললেন, “হবে না? ভয়ের চোটে পেটখারাপ হয়েছে। আমার আগেই জানা ছিল। মুর্শিদাবাদে সেই যে ওকে ধাবিপাটে আছাড় মেরেছিলাম, তা কি আর ও ভুলে গেছে?”

শের সিং আর অম্বিকাঁচরণ দু’জনেই ভাবলেন, লড়াইটা যখন হবেই না তখন ফুটবলমাঠে গিয়ে জনসাধারণের সামনে বুক ফুলিয়ে ওয়াকওভার নিয়ে আসবেন।

দু’জনেই তড়িঘড়ি রওনা হয়ে পড়েলেন আসরে। অম্বিকা জানেন শের সিংয়ের কলেরা। শের সিং জানেন অম্বিকার টাইফয়েড। দুজনেই তাই নিশ্চিন্ত।

ফুটবলমাঠ ভিড়ে ভিড়াক্কার। দুদিক থেকে দু’জনকে ঢুকতে দেখে লোকেরা হৈ-হৈ করে উঠল। অম্বিকা ভাবলেন, তাঁকে দেখেই লোকে হৈ চৈ করছে। শের সিং ভাবলেন, তাঁকে দেখে।

হুঙ্কার দিয়ে দু’জনেই লাফিয়ে পড়লেন দঙ্গলে। তারপরই দু’জনে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলেন পরস্পরের দিকে। কেউই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

অম্বিকাঁচরণ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে একটা হাত শের সিংয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “দ্যাখো তো নাড়িটা। জ্বর মনে হয় একশো এক ছাড়িয়ে গেল।”

শের সিং নাড়ি ধরে বললেন, “দুইয়ের কম না। এবার আমার পেটটা একটু টিপে দ্যাখো তো, বড় ব্যথা।”

অম্বিকা শের সিংয়ের পেট টিপে দেখে বললেন, “ও বাবা, কলেরার একেবারে মস্ত একটা ডেলা দেখছি যে!”

ব্যাপারটা বুঝতে জনসাধারণের একটু সময় লাগল বটে, তারপর হোঃ হোঃ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সমস্ত মাঠ।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়