তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ৪ঠা জানুয়ারি

মণিকে উপদেশ 

আজ শুক্রবার, ৪ঠা জানুয়ারি, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ, বেলা ৪টার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতে বসিয়া আছেন। সহাস্যবদন। সঙ্গে মণি, হরিপদ প্রভৃতি। ৺আনন্দ চাটুজ্যের কথা হরিপদের সহিত হইতেছে ও ঘোষপাড়ার সাধন-ভজনের কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ ক্রমে নিজের ঘরে আসিয়া বসিয়াছেন। মণি, হরিপদ, রাখালাদি ভক্তগণও থাকেন, মণি বেলতলায় অনেক সময় থাকেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — বিচার আর করো না। ওতে শেষে হানি হয়। তাঁকে ডাকবার সময় একটা ভাব আশ্রয় করতে হয়। সখীভাব, দাসীভাব, সন্তানভাব বা বীরভাব।

“আমার সন্তানভাব। এভাব দেখলে মায়াদেবী পথ ছেড়ে দেন — লজ্জায়।

“বীরভাব বড় কঠিন। শাক্ত ও বৈষ্ণব বাউলদের আছে। ওভাবে ঠিক থাকা বড় শক্ত। আবার আছে — শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুরভাব। মধুরভাবে সব আছে — শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য।

(মণির প্রতি) — “তোমার কোন্‌টা ভাল লাগে?”

মণি — সব ভাবই ভাল লাগে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সব ভাব সিদ্ধ অবস্থায় ভাল লাগে। সে অবস্থায় কামগন্ধ থাকবে না। বৈষ্ণব শাস্ত্রে আছে চন্ডীদাস ও রজকিনীর কথা — তাদের ভালবাসা কামগন্ধ বিবর্জিত!

“এ-অবস্থায় প্রকৃতিভাব। আপনাকে পুরুষ বলে বোধ থাকে না। রূপ গোস্বামী মীরাবাঈ স্ত্রীলোক বলে তাঁর সহিত দেখা করতে চান নাই। মীরাবাঈ বলে পাঠালেন ‘শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ’, বৃন্দাবনে সকলেই সেই পুরুষের দাসী; গোস্বামীর পুরুষ অভিমান করা কি ঠিক হয়েছে?”

সন্ধ্যার পর মণি আবার শ্রীরামকৃষ্ণের পাদমূলে বসিয়া আছেন। সংবাদ আসিয়াছে শ্রীযুক্ত কেশব সেনের অসুখ বাড়িয়াছে। তাঁহারই কথা প্রসঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের কথা হইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — হ্যাঁগা; ওদের ওখানে কি কেবল লেকচার দেওয়া? না ধ্যানও আছে? ওরা বুঝি বলে উপাসনা।

“কেশব আগে খ্রীষ্টান ধর্ম, খ্রীষ্টানী মত খুব চিন্তা করেছিলেন। — সেই সময় ও তার আগে দেবেন্দ্র ঠাকুরের ওখানে ছিলেন।”

মণি — কেশববাবু প্রথম প্রথম যদি এখানে আসতেন তাহলে সমাজ সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত হতেন না। জাতিভেদ উঠানো, বিধবা বিবাহ, অন্য জাতে বিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কর্ম লয়ে অত ব্যস্ত হতেন না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেশব এখন কালী মানেন — চিন্ময়ী কালী — আদ্যাশক্তি। আর মা মা বলে তাঁর নামগুণকীর্তন করেন।

“আচ্ছা, ব্রাহ্মসমাজ ওইরকম কি একটা পরে দাঁড়াবে?”

মণি — এ-দেশের মাটি তেমন নয়। ঠিক যা, তা একবার হবেই।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হ্যাঁ, সনাতন ধর্ম ঋষিরা যা বলেছেন, তাই থেকে যাবে। তবে ব্রাহ্মসমাজ ও ওইরকম সম্প্রদায়ও একটু একটু থাকবে। সবই ঈশ্বরের ইচ্ছায় হচ্ছে যাচ্ছে।

বৈকালে কলিকাতা হইতে কতকগুলি ভক্ত আসিয়াছিলেন। তাঁহারা অনেক গান ঠাকুরকে শুনাইয়াছিলেন। তন্মধ্যে একটি গানে আছে “মা, তুমি আমাদের লাল চুষি মুখে দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছ; আমরা চুষি ফেলে যখন তোমার জন্য চিৎকার করে কাঁদব তখন তুমি আমাদের কাছে নিশ্চয় দৌড়ে আসবে।”

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — তারা, কেমন লাল চুষির গান গাইলে —

মণি — আজ্ঞা, আপনি কেশব সেনকে এ লাল চুষির কথা বলেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — হ্যাঁ; আর চিদাকাশের কথা — আরও সব অনেক কথা হত; আর আনন্দ হত। গান, নৃত্য হত।

<

Mahendranath Gupta ।। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত