চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৯শে ডিসেম্বর

বিল্বমূলে ও পঞ্চবটীতলায় শ্রীরামকৃষ্ণ

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিল্ববৃক্ষের নিকট মণির সহিত কথা কহিতেছেন। বেলা প্রায় নয়টা হইবে।

আজ বুধবার, ১৯শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩ (৫ই পৌষ, ১২৯০)। কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথি।

বিল্বতল ঠাকুরের সাধনভূমি। অতি নির্জন স্থান। উত্তরে বারুদখানা ও প্রাচীর। পশ্চিমে ঝাউগাছগুলি সর্বদাই প্রাণ-উদাসকারী সোঁ-সোঁ শব্দ করিতেছে, পরেই ভাগীরথী। দক্ষিণে পঞ্চবটী দেখা যাইতেছে। চতুর্দিকে এত গাছপালা, দেবালয়গুলি দেখা যাইতেছে না।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ না করলে কিন্তু হবে না।

মণি — কেন? বশিষ্ঠদেব তো রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, রাম, সংসার যদি ঈশ্বরছাড়া হয়, তাহলে সংসারত্যাগ করো।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাসিয়া) — সে রাবণবধের জন্য! তাই রাম সংসারে রইলেন — বিবাহ করলেন।

মণি নির্বাক্‌ হইয়া কাষ্ঠের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই কথা বলিয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া যাইবার জন্য পঞ্চবটী অভিমুখে গমন করিলেন। বেলা ৯টা হইয়া গিয়াছে।

শ্রীরামকৃষ্ণের সহিত মণির কথা চলিতেছে পঞ্চবটীমূলে।

মণি (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — জ্ঞান ভক্তি দুই-ই কি হয় না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — খুব উঁচু ঘরের হয়। ঈশ্বরকোটির হয় — যেমন চৈতন্যদেবের। জীবকোটিদের আলাদা কথা।

“আলো (জ্যোতিঃ) পাঁচপ্রকার। দীপ আলোক, অন্যান্য অগ্নির আলো, চান্দ্র আলো, সৌর আলো ও চান্দ্র সৌর একাধারে। ভক্তি চন্দ্র; জ্ঞান সূর্য।

“কখনও কখনও আকাশে সূর্য অস্ত না যেতে যেতে চন্দ্রোদয় দেখা যায়। অবতারাদির ভক্তিচন্দ্র জ্ঞানসূর্য একাধারে দেখা যায়।

“মনে করলেই কি সকলের জ্ঞান ভক্তি একাধারে দুই হয়? আধার বিশেষ। কোন বাঁশের ফুটো বেশি, কোন বাঁশের খুব সরু ফুটো। ঈশ্বর বস্তু ধারণা কি সকল আধারে হয়। একসের ঘটিতে কি দুসের দুধ ধরে!”

মণি — কেন, তাঁর কৃপায়? তিনি কৃপা করলে তো ছুঁচের ভিতর উট যেতে পারে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কিন্তু কৃপা কি অমনি হয়? ভিখারি যদি পয়সা চায়, দেওয়া যায়। কিন্তু একেবারে যদি রেলভাড়া চেয়ে বসে?

মণি নিঃশব্দে দণ্ডায়মান। শ্রীরামকৃষ্ণও চুপ করিয়া আছেন। হঠাৎ বলিতেছেন, হাঁ বটে, কারু কারু আধারে তাঁর কৃপা হলে হতে পারে; দুই-ই হতে পারে।

[‘নিরাকার সাধনা বড় কঠিন’ ]

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীতলায় মণির সহিত কথা কহিতেছেন বেলা প্রায় ১০টা হইল।

মণি — আজ্ঞা, নিরাকার সাধন কি হয় না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — হবে না কেন? ও-পথ বড় কঠিন। আগেকার ঋষিরা অনেক তপস্যার দ্বারা বোধে বোধ করত, — ব্রহ্ম কি বস্তু অনুভব করত। ঋষিদের খাটুনি কত ছিল। — নিজেদের কুটির থেকে সকালবেলা বেরিয়া যেত, — সমস্ত দিন তপস্যা করে সন্ধ্যার পর আবার ফিরত। তারপর এসে একটু ফলমূল খেত।

“এ-সাধনে একেবারে বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে হবে না। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ — এসব বিষয় মনে আদপে থাকবে না। তবে শুদ্ধমন হবে। সেই শুদ্ধমনও যা শুদ্ধ আত্মাও তা। মনেতে কামিনী-কাঞ্চন একেবারে থাকবে না —

“তখন আর-একটি অবস্থা হয়। ‘ঈশ্বরই কর্তা আমি অকর্তা’। আমি না হলে চলবে না এরুপ জ্ঞান থাকবে না — সুখে দুঃখে।

“একটি মঠের সাধুকে দুষ্টলোকে মেরেছিল, — সে অজ্ঞান হয়ে গিছল। চৈতন্য হলে যখন জিজ্ঞাসা করলে কে তোমায় দুধ খাওয়াচ্ছে। সে বলেছিল, যিনি আমায় মেরেছেন তিনিই দুধ খাওয়াচ্ছেন।”

মণি — আজ্ঞা হাঁ, জানি।

[স্থিতসমাধি ও উন্মনাসমাধি ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, শুধু জানলে হবে না; ধারণা করা চাই।

“বিষয়চিন্তা মনকে সমাধিস্থ হতে দেয় না।

”একেবারে বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ হলে স্থিতসমাধি হয়। স্থিতসমাধিতে দেহত্যাগ হতে পারে, কিন্তু ভক্তি-ভক্ত নিয়ে একটু থাকবার বাসনা আছে। তাই দেহের উপরেও মন আছে।

“আর এক আছে উন্মনাসমাধি। ছড়ানো মন হঠাৎ কুড়িয়ে আনা। ওটা তুমি বুঝেছ?”

মণি — আজ্ঞা হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ছড়ানো মন হঠাৎ কুড়িয়ে আনা। বেশিক্ষণ এ-সমাধি থাকে না, বিষয়চিন্তা এসে ভঙ্গ হয় — যোগীর যোগ ভঙ্গ হয়।

“ও-দেশে দেয়ালের ভিতর গর্তে নেউল থাকে। গর্তে যখন থাকে বেশ আরামে থাকে। কেউ কেউ ন্যাজে ইট বেঁধে দেয় — তখন ইটের জোরে গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে। যতবার গর্তের ভিতর গিয়ে আরামে বসবার চেষ্টা করে — ততবারই ইটের জোরে বাইরে এসে পড়ে। বিষয়চিন্তা এমনি — যোগীকে যোগভ্রষ্ট করে।

“বিষয়ী লোকদের এক-একবার সমাধির অবস্থা হতে পারে। সূর্যোদয়ে পদ্ম ফোটে, কিন্তু সূর্য মেঘেতে ঢাকা পড়লে আবার পদ্ম মুদিত হয়ে যায়। বিষয় মেঘ।”

মণি — সাধন করলে জ্ঞান আর ভক্তি দুই কি হয় না?

শ্রীরামকৃষ্ণ — ভক্তি নিয়ে থাকলে দুই-ই হয়। দরকার হয়, তিনিই ব্রহ্মজ্ঞান দেন। খুব উঁচু ঘর হলে একাধারে দুই-ই হতে পারে।

প্রণামপূর্বক মণি বেলতলার দিকে যাইতেছেন।

বেলতলা হইতে ফিরিতে দুপ্রহর হইয়া গিয়াছে। দেরি দেখিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ বেলতলার দিকে আসিতেছেন। মণি, সতরঞ্চি, আসন, জলের ঘটি লইয়া ফিরিতেছেন, পঞ্চবটীর কাছে ঠাকুরের সহিত দেখা হইল। তিনি অমনি ভূমিষ্ঠ হইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — আমি যাচ্ছিলাম তোমায় খুঁজতে। ভাবলাম এত বেলা, বুঝি পাঁচিল ডিঙিয়ে পালালো! তোমার চোখ তখন যা দেখেছিলাম — ভাবলাম বুঝি নারাণ শাস্ত্রীর মতো পালালো। তারপর আবার ভাবলাম, না সে পালাবে না; সে অনেক ভেবে-চিন্তে কাজ করে।

<

Mahendranath Gupta ।। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত