পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৪ই ডিসেম্বর

মণি, রামলাল, শ্যাম ডাক্তার, কাঁসারিপাড়ার ভক্তেরা

অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা ও সংক্রান্তি — শুক্রবার ১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। বেলা প্রায় নয়টা হইবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ঘরের দ্বারের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব বারান্দায় দাঁড়াইয়া আছেন। রামলাল কাছে দাঁড়াইয়া আছেন। রাখাল, লাটু নিকটে এদিক-ওদিকে ছিলেন। মণি আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন।

ঠাকুর বলিলেন, “এসেছো? তা আজ বেশ দিন।” তিনি ঠাকুরের কাছে কিছুদিন থাকিবেন, ‘সাধন’ করিবেন। ঠাকুর বলিয়াছেন, কিছু করিলেই কেউ বলে দেবে, “এই এই”।

ঠাকুর বলিয়া দিয়াছেন, এখানে অতিথিশালার অন্ন তোমার রোজ খাওয়া উচিত নয়। সাধু কাঙালের জন্য ও হয়েছে। তুমি তোমার রাঁধবার জন্য একটি লোক আনবে। তাই সঙ্গে একটি লোক এসেছে।

তাঁহার কোথায় রান্না হইবে? তিনি দুধ খাইবেন, ঠাকুর রামলালকে গোয়ালার কাছে বন্দোবস্ত করিয়া দিতে বলিলেন।

শ্রীযুক্ত রামলাল অধ্যাত্ম রামায়ণ পড়িতেছেন ও ঠাকুর শুনিতেছেন। মণিও বসিয়া শুনিতেছেন। রামচন্দ্র সীতাকে বিবাহ করিয়া অযোধ্যায় আসিতেছেন। পথে পরশুরামের সহিত দেখা হইল। রাম হরধনু ভঙ্গ করিয়াছেন শুনিয়া পরশুরাম রাস্তায় বড় গোলমাল করিতে লাগিলেন। দশরথ ভয়ে আকুল। পরশুরাম আর একটা ধনু রামকে ছুঁড়িয়া মারিলেন। আর ওই ধনুতে জ্যা রোপণ করিতে বলিলান। রাম ঈষৎ হাস্য করিয়া বামহস্তে ধনু গ্রহণ করিলেন ও জ্যা রোপন করিয়া টঙ্কার করিলেন! ধনুকে বাণ যোজনা করিয়া পরশুরামকে বলিলেন, এখন এ-বাণ কোথায় ত্যাগ করব বল। পরশুরামের দর্প চূর্ণ হইল। তিনি শ্রীরামকে পরমব্রহ্ম বলে স্তব করিতে লাগিলেন।

পরশুরামের স্তব শুনিতে শুনিতে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট! মাঝে মাঝে “রাম রাম” এই নাম মধুরকণ্ঠে উচ্চারণ করিতেছেন।

*  *  *

শ্রীরামকৃষ্ণ (রামলালকে) — একটু গুহক চণ্ডালের কথা বল দেখি!

রামচন্দ্র যখন “পিতৃসত্যের কারণ” বনে গিয়াছিলেন, গুহকরাজ চমকিত হইয়াছিলেন। রামলাল ভক্তমাল পড়িতেছেন —

নয়নে গলয়ে ধারা মনে উতরোল। চমকি চাহিয়া রহে নাহি আইসে বোল ৷৷
নিমিখ নাহিক পড়ে চাহিয়া রহিল। কাষ্ঠের পুতুলি প্রায় অস্পন্দ হইল ৷৷

তারপর ধীরে ধীরে রামের কাছে গিয়া বলিলেন, আমার ঘরে এস। রামচন্দ্র তাঁকে মিতা বলে আলিঙ্গন করিলেন। গুহ তখন তাঁহাকে আত্মসমর্পণ করিতেছেন —

গুহ বলে ভাল ভাল তুমি মোর মিতে। তোমাতে সঁপিনু দেহ পরাণ সহিতে ৷৷
তুমি মোর সরবস প্রাণ ধন রাজ্য। তুমি মোর ভক্তি, মুক্তি, তুমি শুভকার্য ৷৷
আমি মর‌্যা যাই তব বালায়ের সনে। দেহ সমর্পিণু মিতা তোমার চরণে ৷৷

রামচন্দ্র চৌদ্দবৎসর বনে থাকিবেন ও জটাবল্কল ধারণ করিবেন শুনিয়া গুহও জটা বল্কল ধারণ করিয়া রহিলেন ও ফলমূল ছাড়া অন্য কিছু আহার করিলেন না। চৌদ্দবৎসরান্তে রাম আসিতেছেন না দেখিয়া, গুহ অগ্নি প্রবেশ করিতে যাইতেছেন, এমন সময় হনুমান আসিয়া সংবাদ দিলেন। সংবাদ পাইয়া গুহ মহানন্দে ভাসিতেছেন। রামচনদ্র ও সীতা পুষ্পক রথে করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

দয়াল পরমানন্দ, প্রেমাধীন রামচন্দ্র, ভক্তবৎসল গুণধাম।
প্রিয় ভক্তরাজ গুহ, হেরিয়া পুলক দেহ, হৃদয়ে লইয়া প্রিয়তম ৷৷
গাঢ় আলিঙ্গন দোঁহে, প্রভু ভৃত্যে লাগি রহে,
অশ্রুজলে দোঁহা অঙ্গ ভিজে ৷৷
ধন্য গুহ মহাশয়, চারিদিকে জয় জয়,
কোলাহল হল ক্ষিতি মাঝে ৷৷

[কেশব সেনের যদৃচ্ছালাভ — উপায় — তীব্র বৈরাগ্য ও সংসারত্যাগ ]

আহারান্তে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটু বিশ্রাম করিতেছেন। মাস্টার কাছে বসিয়া আছেন। এমন সময় শ্যাম ডাক্তার ও আরও কয়েকটি লোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উঠিয়া বসিলেন ও কথা কহিতে লাগিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কর্ম যে বরাবরই করতে হয়, তা নয়। ঈশ্বরলাভ হলে আর কর্ম থাকে না। ফল হলে ফুল আপনিই ঝরে যায়।

“যার লাভ হয়, তার সন্ধ্যাদি কর্ম থাকে না। সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লীন হয়। তখন গায়ত্রী জপলেই হয়। আর গায়ত্রী ওঁকারে লয় হয়। তখন গায়ত্রীও বলতে হয় না। তখন শুধু ‘ওঁ’ বললেই হয়। সন্ধ্যাদি কর্ম কতদিন? যতদিন হরিনামে কি রামনামে পুলক না হয়, আর ধারা না পড়ে। টাকা-কড়ির জন্য, কি মোকদ্দমা জিত হবে  বলে, পূজাদি কর্ম — ও-সব ভাল না।”

একজন ভক্ত — টাকা-কড়ির চেষ্টা তো সকলেই করছে দেখছি। কেশব সেন কেমন রাজার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — কেশবের আলাদা কথা। যে ঠিক ভক্ত সে চেষ্টা না করলেও ঈশ্বর তার সব জুটিয়ে দেন। যে ঠিক রাজার বেটা, সে মুসোহারা পায়। উকিল-ফুকিলের কথা বলছি না, — যারা কষ্ট করে, লোকের দাসত্ব করে টাকা আনে। আমি বলছি, ঠিক রাজার বেটা। যার কোন কামনা নাই সে টাকা-কড়ি চায় না, টাকা আপনি আসে। গীতায় আছে — যদৃচ্ছালাভ।

“সদ্‌ব্রাহ্মণ, যার কোন কামনা নাই, সে হাড়ির বাড়ির সিধে নিতে পারে। ‘যদৃচ্ছালাভ’। সে চায় না, কিন্তু আপনি আসে।”

একজন ভক্ত — আজ্ঞা, সংসারে কিরকম করে থাকতে হবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ — পাঁকাল মাছের মতো থাকবে। সংসার থেকে তফাতে গিয়ে, নির্জনে ঈশ্বরচিন্তা মাঝে মাঝে করলে, তাঁতে ভক্তি জন্মে। তখন নির্লিপ্ত হয়ে থাকতে পারবে। পাঁক আছে, পাঁকের ভিতর থাকতে হয়, তবু গায়ে পাঁক লাগে না। সে লোক অনাসক্ত হয়ে সংসারে থাকে।

ঠাকুর দেখিতেছেন, মণি বসিয়া একমনে সমস্ত শুনিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (মণিদৃষ্টে) — তীব্র বৈরাগ্য হলে তবে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। যার তীব্র বৈরাগ্য হয়, তার বোধ হয়, সংসার দাবানল! জ্বলছে! মাগছেলেকে দেখে যেন পাতকুয়া! সেরকম বৈরাগ্য যদি ঠিক ঠিক হয়, তাহলে বাড়ি ত্যাগ হয়ে পড়ে। শুধু অনাসক্ত হয়ে থাকা নয়। কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। মায়াকে যদি চিনতে পার, আপনি লজ্জায় পালাবে। একজন বাঘের ছাল পরে ভয় দেখাচ্ছে। যাকে ভয় দেখাচ্ছে সে বললে, আমি তোকে চিনেছি — তুই আমাদের ‘হরে’। তখন সে হেসে চলে গেল — আর-একজনকে ভয় দেখাতে গেল।

“যত স্ত্রীলোক, সকলে শক্তিরূপা। সেই আদ্যাশক্তিই স্ত্রী হয়ে, স্ত্রীরূপ ধরে রয়েছেন। অধ্যাত্মে আছে রামকে নারদাদি স্তব করছেন, হে রাম, যত পুরুষ সব তুমি; আর প্রকৃতির যত রূপ সীতা ধারণ করেছেন। তুমি ইন্দ্র, সীতা ঈন্দ্রাণী; তুমি শিব, সীতা শিবানী; তুমি নর, সীতা নারী! বেশ আর কি বলব — যেখানে পুরুষ, সেখানে তুমি; যেখানে স্ত্রী, সেখানে সীতা।”

[ত্যাগ ও প্রারব্ধ — বামাচার সাধন ঠাকুরের নিষেধ ]

(ভক্তদের প্রতি) — “মনে করলেই ত্যাগ করা যায় না। প্রারব্ধ, সংস্কার — এ-সব আবার আছে। একজন রাজাকে একজন যোগী বললে, তুমি আমার কাছে বসে থেকে ভগবানের চিন্তা কর। রাজা বললে, সে বড় হবে না; আমি থাকতে পারি; কিন্তু আমার এখনও ভোগ আছে।

“নটবর পাঁজা যখন ছেলেমানুষ, এই বাগানে গরু চরাত। তার কিন্তু অনেক ভোগ ছিল। তাই এখন রেড়ির কল করে অনেক টাকা করেছে। আলমবাজারে রেড়ির কলের ব্যাবসা খুব ফেঁদেছে।

“এক মতে আছে, মেয়েমানুষ নিয়ে সাধন করা। কর্তাভজা মাগীদের ভিতর আমায় একবার নিয়ে গিছিল। সব আমার কাছে এসে বসল। আমি তাদের মা, মা বলাতে পরস্পর বলাবলি করতে লাগল, ইনি প্রবর্তক, এখনও ঘাট চিনেন নাই! ওদের মতে কাঁচা অবস্থাকে বলে প্রবর্তক, তারপরে সাধক, তারপর সিদ্ধের সিদ্ধ।

“একজন মেয়ে বৈষ্ণবচরণের কাছে গিয়ে বসলে। বৈষ্ণবচরণকে জিজ্ঞাসা করাতে বললে, এর বালিকাভাব!

“স্ত্রীভাবে শীঘ্র পতন হয়। মাতৃভাব শুদ্ধভাব।”

“কাঁসারিপাড়ার ভক্তেরা গাত্রোত্থান করিলেন; ও বলিলেন, তবে আমরা আসি; মা-কালীকে, আর আর ঠাকুরকে দর্শন করব।

<

Mahendranath Gupta ।। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত