অষ্টম পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১০ই জুন

দক্ষিণেশ্বরে মণিরামপুর ও বেলঘরের ভক্তসঙ্গে

[শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত নিজ চরিত]

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নিজের ঘরে কখনও দাঁড়াইয়া, কখনও বসিয়া ভক্তসঙ্গে কথা কহিতেছেন। আজ রবিবার, ১০ই জুন, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ, জ্যৈষ্ঠ, শুক্লা পঞ্চমী, বেলা ১০টা হইবে। রাখাল, মাস্টার, লাটু, কিশোরী, রামলাল, হাজরা প্রভৃতি অনেকেই আছেন।

ঠাকুর নিজের চরিত্র, পূর্বকাহিনী বর্ণনা করিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — ও-দেশে ছেলেবেলায় আমায় পুরুষ মেয়ে সকলে ভালবাসত। আমার গান শুনত। আবার লোকদের নকল করতে পারতুম, সেই সব দেখত ও শুনত। তাদের বাড়ির বউরা আমার জন্য খাবার জিনিস রেখে দিত। কিন্তু কেউ অবিশ্বাস করত না। সকলে দেখত যেন বাড়ির ছেলে।

“কিন্তু সুখের পায়রা ছিলুম। বেশ ভাল সংসার দেখলে আনাগোনা করতুম। যে-বাড়িতে দুঃখ বিপদ দেখতুম সেখান থেকে পালাতুম।

“ছোকরাদের ভিতর দু-একজন ভাল লোক দেখলে খুব ভাব করতুম। কারুর সঙ্গে সেঙাত পাতাতুম। কিন্তু এখন তারা ঘোর বিষয়ী। এখন তারা কেউ কেউ এখানে আসে, এসে বলে, ও মা! পাঠশালেও যেমন দেখেছি এখানেও ঠিক তাই দেখছি।

“পাঠশালে শুভঙ্করী আঁক ধাঁধা লাগত! কিন্তু চিত্র বেশ আঁকতে পারতুম; আর ছোট ছোট ঠাকুর বেশ গড়তে পারতুম।”

[Fond of charitable houses; and of Ramayana and Mahabharata]

“সদাব্রত, অতিথিশালা — যেখানে দেখতুম সেখানে যেতুম, গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতুম।

“কোনখানে রামায়ণ কি ভাগবত পাঠ হচ্ছে, তা বসে বসে শুনতুম, তবে যদি ঢঙ করে পড়ত, তাহলে তার নকল করতুম, আর অন্য লোকেদের শুনাতুম।

“মেয়েদের ঢঙ বেশ বুঝতে পারতুম। তাদের কথা, সুর নকল করতুম। কড়েঁরাড়ী বাপকে উত্তর দিচ্ছে ‘যা-ই’। বারান্দায় মাগীরা ডাকছে, ‘ও তপ্‌সে-মাছোলা!’ নষ্ট মেয়ে বুঝতে পারতুম। বিধবা সোজা সিঁথে কেটেছে, আর খুব অনুরাগের সহিত গায়ে তেল মাখছে! লজ্জা কম, বসবার রকমই আলাদা।

“থাক বিষয়ীদের কথা।”

রামলালকে গান গাহিতে বলিতেছেন। শ্রীযুক্ত রামলাল গান গাহিতেছেন:

১। কে রণে নাচিছে বামা নীরদবরণী,
শোণিত সায়রে যেন ভাসিছে নবনলিনী।

এইবার রামলাল রাবণবধের পর মন্দোদরীর বিলাপ গান গাহিতেছেন:

২। কি করলে হে কান্ত! অবলারি প্রাণ কান্ত,
হয় না শান্ত এ প্রাণান্ত বিনে।

[রামনামে শ্রীরামকৃষ্ণ বিহ্বল — গোপীপ্রেম]

শেষ গানটি শুনিতে শুনিতে ঠাকুর অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন, আর বলিতেছেন, “আমি ঝাউতলায় বাহ্যে করতে গিয়ে শুনেছিলাম, নৌকার মাঝি নৌকাতে ওই গান গাচ্ছে; ঝাউতলায় যতক্ষণ বসেছিলাম খালি কেঁদেছি; আমাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে এল।”

৩। শুনেছি রাম তারক ব্রহ্ম, মানুষ নয় রাম জটাধারী ৷
পিতে কি নাশিতে বংশ, সীতে তার করেছ চুরি ৷৷

অক্রূর শ্রীকৃষ্ণকে রথে বসাইয়া মথুরায় লইয়া যাইতেছেন দেখিয়া গোপীরা রথচক্র আঁকড়াইয়া ধরিয়াছেন ও কেহ রথচক্রের সামনে শুইয়া পড়িয়াছেন। তাঁরা অক্রূরকে দোষ দিতেছেন। শ্রীকৃষ্ণ যে নিজের ইচ্ছায় যাইতেছেন তাহা জানেন না।

৪। ধোরো না ধোরা না রথচক্র, রথ কি চক্রে চলে,
যে চক্রের চক্রী হরি, যাঁর চক্রে জগৎ চলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — গোপীদের কি ভালবাসা, কি প্রেম। শ্রীমতী স্বহস্তে শ্রীকৃষ্ণের চিত্র এঁকেছেন, কিন্তু পা আঁকেন নাই; পাছে তিনি মথুরায় চলে যান।

“আমি এ-সব গান ছেলেবেলায় খুব গাইতাম। এক-এক যাত্রার সমস্ত পালা গেয়ে দিতে পারতাম। কেউ কেউ বলত, আমি কালীয়দমন-যাত্রার দলে ছিলাম।”

একজন ভক্ত নূতন উড়ানি গায়ে দিয়া আসিয়াছেন। রাখালের বালক স্বভাব, কাঁচি এনে তাঁর চাদরের ছিলা কাটিতে আসিয়াছেন। ঠাকুর বলিলেন, “কেন কাটছিস? থাক না, শালের মতো বেশ দেখাচ্ছে। হাঁগা, এর কত দাম?” তখন বিলাতী চাদরের দাম কম ছিল। ভক্তটি বলিলেন, এক টাকা ছয় আনা জোড়া। ঠাকুর বলিলেন, “বল কি গো। জোড়া! এক টাকা ছয় আনা জোড়া!”

কিয়ৎক্ষণ পরে ঠাকুর ভক্তকে বলিতেছেন, “যাও, গঙ্গা নাওগে; এঁকে তেল দে রে।”

স্নানান্তে তিনি ফিরিয়া আসিলে, ঠাকুর তাক হইতে একটি আম্র লইয়া তাঁহাকে দিলেন। বলিতেছেন, এই আমটি একে দিই; তিনটা পাশ করা। আচ্ছা, তোমার ভাই এখন কেমন?

ভক্ত — হাঁ, তাঁর ঔষধ ঠিক পড়েছে, এখন খাটলে হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — তার একটি কর্মের যোগাড় করে দিতে পার? বেশ তো তুমি মুরুব্বি হবে।

ভক্ত — ভাল হলে সব সুবিধা হয়ে যাবে।

<

Mahendranath Gupta ।। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত