১০. ঔলক্য দর্শন

যে মহর্ষি এই দর্শনের প্রণয়ন করিয়াছেন তাঁহার নাম কণাদ ও উলুক, এজন্য এই দর্শনকে কণাদ ও ঔলুক্যদর্শন কহে । অন্যান্যদর্শনানভিমত বিশেষনামক একটি স্বতন্ত্র পদার্থ নির্দিষ্ট থাকায় ইহাকে বৈশেষিক দর্শনও বলিয়া থাকে । আর যখন বেদান্ত, সস্থ্য, পতঞ্জল, মীমাংসা, ন্যায় ও বৈশেষিক, এই কয়েকট দশন সুপ্রসিদ্ধ ষড় দর্শন বলিয়। পরিগণিত হইতেছে, এবং ঔল ক্য দর্শনই বৈশেষিক দর্শন ইহা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে, তখন এই ঔপূক্যদর্শন যে ষড়দর্শনান্তর্গত, তাহ বল। পুনরুক্তি মাত্র ।

এই মতে অত্যন্ত দুঃখনিবৃত্তির নাম মুক্তি । যে দুঃখনিবৃত্তি হইলে কোন কালেই আর দুঃখ ন জন্মে, ভাহীকে অত্যন্ত দুঃখনিবৃত্তি কহে । ঐ মুক্তি আত্মসাক্ষাৎকারস্বরূপ তত্ত্বজ্ঞান ব্যতীত জন্মে না ; কিন্তু ঐ তত্ত্বজ্ঞান সহজোপায়সাধ্য নহে, প্রথমতঃ শ্ৰুতি, স্মৃতি ও পুরাণাদিদ্বারা আত্মার স্বরূপ ও গুণাদি শ্রবণ করিতে হয় ; পরে আত্মার স্বরূপ ও গুণাদি গুভিতে যেরূপ নির্দিষ্ট আছে উহ। যুক্তিসিদ্ধ হইতেছে কি ন—এই সন্দেহনিরাসার্থ তাহার অনুমান স্বরূপ মনন করিম নিদিধ্যাসন (যোগবিশেষ) করিতে পারিলে, তত্ত্বজ্ঞান হয়, নতুবা তত্ত্বজ্ঞানের উপায়ান্তর নাই। এজন্য শাস্ত্রে শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন, এই তিনটাই তত্ত্বজ্ঞানের উপায়রূপে নির্দিষ্ট আছে ; ভস্মধ্যে শ্রবণের উপনিষদাদি অনেক সাধন আছে । ভগবান কণাদ মহর্ষি, শিষ্যপ্রার্থনামুরোধে মননের অদ্বিতীয় সাধন স্বরূপ দশাধ্যায়াত্মক এই শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন। (১)

এই শাস্ত্রের সকল অধ্যায়েই দুই দুইটী আহ্নিকনামক বিরামস্থান আছে। তন্মধ্যে প্রথমাধ্যায়ের প্রথমাহিকে দ্রব্য, গুণ ও কৰ্ম্ম পদার্থ, দ্বিতীয়াহ্নিকে জাতি ও বিশেষ পদার্থ নিরূপিত হইয়াছে ; দ্বিতীয়ের প্রমাহ্নিকে পৃথিবী, জল, তেজঃ বায়ু ও আকাশ পদার্থ, দ্বিতীয়ে দিক ও কাল ; তৃতীয়ের প্রথমে আত্মা, দ্বিতীয়ে অন্তঃকরণ; চতুর্থের প্রথমে শরীরোপযোগী, দ্বিতীয়ে শরীর ; পঞ্চমের প্রথমে শারীরিক কৰ্ম্ম, দ্বিতীয়ে মানসিক কৰ্ম্ম ; ষষ্ঠের প্রথমে দানের ও প্রতিগ্রহের ধৰ্ম্ম, দ্বিতীয়ে চতুরাশ্রমী ব্যক্তিদিগের ধৰ্ম্ম ; সপ্তমের প্রথমে বিশেষরূপে বুদ্ধিভিন্ন গুণ পদার্থ, দ্বিতীয়ে বুদ্ধির সহিত গুণ পদার্থ ও সমবায় পদার্থ ; অষ্টমের প্রথমে সবিকল্পক (২) ও নিৰ্ব্বিকাল্পক প্রত্যক্ষ, দ্বিতীয়ে বিশিষ্টবৈশিষ্ট্যাবগাহী প্রত্যক্ষ ; নবমের প্রথমে অলৌকিকসন্নিকৰ্ষাদিজন্য প্রত্যক্ষ, দ্বিতীয়ে অনুমান, (৩) দশমের প্রথমে আত্মগুণের পরস্পর ভেদ, দ্বিতীয়ে বিশেষরূপে সমবায়ি প্রভৃতি কারণত্রয় নিরূপিত হইয়াছে ।

এই মতে প্রত্যক্ষ ও অনুমানাতিরিক্ত প্রমাণান্তর নাই । অন্যান্য দর্শনকারকের শব্দাদি যে সমস্ত প্রমাণ স্বীকার করেন সে সকলই অনুমান স্বরূপ, অনুমানাতিরিক্ত নহে ; এবং পদার্থ দ্বিবিধ ভাব ও অভাব । ভাব পদার্থ দ্রব্য, গুণ, কৰ্ম্ম, জাতি, বিশেষ ও সমবায় ভেদে ষড়বিধ ৷ তন্মধ্যে দ্রব্য পদার্থ নয় প্রকার ; পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক্‌, আত্মা ও মনঃ । যে দ্রব্যের গন্ধ আছে তাহার নাম পৃথিবী, যেমন ফল পুষ্পাদি ; আর যে দ্রব্যের গন্ধ নাই সে পৃথিবী নয়, যেমন জলাদি । এ স্থলে এরূপ আপত্তি করিও না যে, গন্ধ না থাকিলে যদি পৃথিবী না হয়, তবে প্রস্তরাদিতে গন্ধ নাই, উহা পৃথিবী না হউক, যেহেতু প্রস্তরাদিরও গন্ধ আছে, কিন্তু ঐ গন্ধ উৎকট নহে এ জন্য উহার উপলব্ধি হয় না । প্রস্তরাদিতে গন্ধের উপলব্ধি না হইলেও উহাতে গন্ধ আছে, ইহা অনুমানসিদ্ধ ।

যে দ্রব্যের স্নেহগুণ আছে, তাহাকে জল পদার্থ কহে ; জল ব্যতীত আর কাহারও স্নেহগুণ নাই । যাহার উষ্ণ ম্পর্শ আছে, তাহ তেজঃ পদার্থ। যাহার স্পর্শ স্বাভাবিক অমুঞ্চাশীত, অর্থাৎ না শীভল না উষ্ণ মধ্যমরূপ, তাহকে বায়ু কহে । বায়ুর যে বক্রভাবে গতিশক্তি আছে তাহ। অনুমানসিদ্ধ। দেখ যদি বায়ুর ঐ রূপ গতিশক্তি না থাকিত, ভবে কখনই গবাক্ষ দ্বারের সমস্থত্রপাতস্থানাতিরিক্ত স্থানে বায়ু দ্বারা প্রদীপ নিৰ্ব্বাণ হুইত না । পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু এই চারিট দ্রব্য প্রত্যেকে নিত্য ও অনিত্য ভেদে দ্বিবিধ। পরমাণুরূপ পৃথিব্যাদি নিত্য, তদতিরিক্ত অনিত্য । যাহার নিজের অবয়ব নাই, কিন্তু ষে পরম্পরায় সকলেরই অবয়ব এবং যাবৎ স্থম্ম পদার্থের শেষসীমাস্বরূপ, তাহাকে পরমাণু কহে । রবিকিরণ সম্পর্কে গবাক্ষদ্বারের নিকট ত্রসরেণু স্বরূপ যে স্থায় পদার্থ দৃষ্ট হয়, তাহাকে ভিন অংশে বিভক্ত করিলে যত হয় তাহার এক অংশকে দ্বাণুক, আর দ্বাণুকের দুই অংশের এক অংশকে পরমাণু কহে। এই চারিট দ্রব্যেরই আকার আছে, এভদতিরিক্ত সকল দ্রব্যই নিরাকার ও নিত্য । এবং এই চারিট দ্রব্যঘটিত এক একটা শরীর আছে, যথা পার্থিব, জলীয়, তৈজস ও বায়বীয় । তন্মধ্যে পার্থিব শরীর মনুষ্যাদির, জলীয় শরীর বরুণলোকে প্রসিদ্ধ, তৈজস শরীর স্থৰ্য্যলোকস্থিত জীবের, এবং বায়বীয় শরীর পিশাচাদির । যে দ্রব্যের গুণ শব্দ তাহীকে আকাশ কহে । যে স্থানে যত শব্দ হইতেছে, সে সমুদয় আকাশে আছে, আকাশ ব্যতীত শব্দের আশ্রয়ান্তর নাই ।

পৃথিবী অবধি আকাশ পর্যন্ত পাঁচটা দ্রব্য ঘটিত এক একটি ইন্দ্রিয় আছে, ঐ ঐ ইন্দ্রিয় দ্বারা এক একটা অসাধারণ গুণাদির উপলব্ধি হইয়া থাকে। যথা পার্থিবেন্দ্রিয় নাসিক দ্বারা গন্ধাদির, জলীয়েন্দ্রিয় রসনা দ্বারা মধুর রসাদির, তৈজসেন্দ্রিয় নয়ন দ্বারা রূপাদির, বায়বীয়েন্দ্রিয় ত্বক দ্বার উষ্ণ স্পশাদির, এবং আকাশেন্দ্রিয় শ্রোত্র দ্বারা শ দাদির উপলব্ধি হইয় থাকে যাহাকে অবলম্বন করিয়৷ জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ব্যবহার হইয়া থাকে তাহার নাম কাল । উভয়ে এক মাতাপি তার সন্তান হইলেও যে ব্যক্তি অধিক কাল জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাকে জ্যেষ্ঠ, আর যে ব্যক্তি অপকাল জন্মিয়াছে তাহাকে কনিষ্ঠ বলিয়া যে নির্দেশ করা যাইতেছে, তাহার প্রধান কারণ ক ল ৷ যদি কাল না থাকিত, তবে কখনই কালঘটিত এরূপ ব্যবহার হইত না । কাল একমাত্র, তবে যে ক্ষণ, দিন, মাস ও বৎসরাদিরূপ বিভিন্ন ব্যবহার হইয় থাকে সে কেবল উপাধিভেদনিবস্কন । যেমত কটক ও কুণ্ডলাদিরূপ উপাধি ভেদে এক সুবৰ্ণকে বিভিন্ন রূপে নির্দেশ করা যাইতেছে, সেইরূপ ক্ষণাদি এক কালেরই উপাধি মাত্র, বস্তুতঃ বিভিন্ন নহে । যাহার সদ্ভাবে দূরত ও নৈকট্য ব্যবহার হইয়। থাকে তাহাকে দিক্ৰ কহে। যদিও দিক নিত্য এবং একমাত্র, তথাপি শাস্ত্রকারের এক এক বস্তুর সন্নিকর্ষ ও বি প্রকর্ষ ভেদে উহার এক একটা উপাধি প্রদান করিয়াছেন। এজন্য ঐ ঐ উপাধির ভেদ লইয়া দিকের বিভিন্নরূপভা প্রতীতি হয়। যথা যে দিক উদয়গিরির সন্নিহিত তাহাকে পুৰ্ব্ব, আর যাহা উহার বিপ্রকৃষ্ট তা হাকে পশ্চিম, যাহা সুমেরু পৰ্ব্বতের সন্নিহিত তাহাকে উত্তর এবং যাহা উহার বিপ্রকৃষ্ট তাহাকে দক্ষিণ দিক কহে ।

যাহার চৈতন্য আছে সে আত্মপদবাচ্য | আত্মা সকল ইন্দ্রিয় ও শরীরের অধিষ্ঠাতা, আত্মা না থাকিলে কোন ইন্দ্রিয়দ্বারাই কোন কার্য্য সম্পন্ন হইত না । যেমত রথগমনদ্বারা সারথির অনুমান করা যায়, সেইরূপ জড়াত্মক দেহের চেষ্টাদি দেখিয়া আত্মাও অনুমিত হইতে পারে । চৈতন্য শক্তি শরীরাদির সম্ভবে না ; কারণ যদি ঐ শক্তি শরীরাদির থাকিত, তবে মৃত ব্যক্তির শরীরেও চৈতন্যের উপলব্ধি হইত সন্দেহ নাই । এবং যখন আমার শরীর ক্ষীণ হইয়াছে, আমার চক্ষুঃ বিকৃত হইয়াছে এইরূপ সকল লোকেরই প্রতীতি হইতেছে, তখন আত্মা যে শরীর ও ইন্দ্রিয় হইতে পৃথক তাহ স্পষ্ট রূপে প্রতিপন্ন হইতেছে । আত্মা দ্বিবিধ, জীবাত্মা ও পরমাত্মা | মনুষ্য, কীট, পতঙ্গ প্রভূতি সকলই জীবাত্মপদবাচ্য, পরমাত্ম এক মাত্র পরমেশ্বর । যাহার দ্বারা সুখ দুঃখাদির অনুভব হয়, শরীরান্তৰ্ব্বত্তী এমত এক সুক্ষ পদার্থকে মন কহে । উহা অন্তরেন্দ্রিয় শব্দে নির্দিষ্ট হয় ।

রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সখযোগ, বিভাগ, পরত্ব, অপরত্ব, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা দ্বেষ, যত্ব, গুরুত্ব, দ্রবত্ব, স্নেহ, সংস্কার, ধৰ্ম্ম, অধৰ্ম্ম শব্দ ভেদে গুণপদার্থ চতুৰ্ব্বিংশতিবিধ । নীল পীতাদি বর্ণকে রূপ কহে । রূপ (৪) ঐ ঐ বর্ণভেদে নানাবিধ, যে বস্তুর রূপ নাই, তাহা দৃষ্টিগোচর হয় না, আর যাহার রূপ আছে, তাহ। দৃষ্ট হইয়া থাকে ; এজন্য রূপকে দর্শনের কারণ বলিয়া স্বীকার করিতে হয় ।

রস ষড়বিধ ; যথা কটু কষায়, তিক্ত, অস্ত্র, লবণ আর মধুর । গন্ধ দ্বিবিধ ; সৌরভ ও অসৌরভ। পদ্মপুষ্প ও পদ্ধাত্র প্রভৃতির গন্ধ সৌরভ অর্থাৎ উত্তম গন্ধ, এবং মুত্র ও পুরীষাদির গন্ধ অসৌরভ অর্থাৎ দুর্গন্ধ। উষ্ণ, শীত এবং অনুষ্ণাশীত ভেদে স্পর্শ ত্রিবিধ। পৃথিবীতে যে কাঠিন্য ও কোমলতাদির অনুভব হইয়া থাকে, তাহীও স্পৰ্শবিশেষ, গুণাস্তুর নহে | একত্ব, দ্বিত্ব ও ত্রিত্বাদি ভেদে সংখ্যা নানাবিধ । যদি সংখ্যা পদার্থ না থাকিস্ত, তবে একটা মৎস্য, দুইটী পশু, তিন জন মনুষ্য-এইরূপ গণনা করা যাইত না; যে হেতু ঐ রূপ গণনা সংখ্যা-পদাথকে অবলম্বন করিয়াই হইয়া থাকে । তন্মধ্যে একত্ব ংখ্যা একটি মাত্র বস্তুতে থাকে, দ্বিত্ব একে থাকে ন৷ দুয়ে থাকে, ত্রিত্ব একে বা দুয়ে থাকে ন৷ তিনে থাকে । উত্তরোত্তর সংখ্যারও এই রীতি অাছে । পরিমাণ চারি প্রকার ; স্থূল, স্বক্ষ দীর্ঘ ও হ্রস্ব । যাহাকে অবলম্বন করিয়৷ “ঘটঃ পটাৎ পৃথক” অর্থাৎ ঘট পট-হইত্তে পৃথগুভূত এই রূপ ব্যবহার হইয়া থাকে তাহাকে পৃথকত্ব কহে । অসন্নিকৃষ্ট বস্তু দ্বয়ের মিলন এবং সন্নিকৃষ্ট বস্তুদ্বয়ের বিয়োগকে যথাক্রমে সংযোগ ও বিভাগ (৫) কহে । পরত্ব ও অপরত্ব গুণ প্রত্যেকে দৈশিক ও কালিক ভেদে দ্বিবিধ : দৈশিক পরত্ব “অমুক নগর হইতে অমুক নগর দূর” এইরূপ দূরত্ব-বুদ্ধির, আর দৈশিক অপরস্থ “অমুক স্থান হইতে অমুক স্থান নিকট এইরূপ নৈকট্য জ্ঞানের কারণ । অার কালিক পরত্ব ও অপরত্ব যথাক্রমে জ্যেষ্ঠত্ব ও কমিষ্ঠত্ব-ব্যবহারের উপযোগী ।

বুদ্ধিশব্দে জ্ঞান বুঝায় । জ্ঞান দ্বিবিধ, যথা প্রম!

ও ভ্ৰম 1, যাহার যে যে গুণ ও দোষ আছে, তাহাকে তত্ত্বৎ গুণ ও দোষশালী বলিয়। জানাকে যথার্থ জ্ঞান এবং প্রম কহে ; যেমন জ্ঞানী ব্যক্তিকে পণ্ডিত বলিয়া এবং অন্ধকে অন্ধ বলিয়া জানা । এবং যাহার যে যে গুণ ও দোষ নাই, তাহাকে সেই সেই গুণ ও দোষশালী বলিয়৷ জানাকে অযথার্থ জ্ঞান এবং ভ্রম কহে ; যেমন পণ্ডিতকে মুখ বলিয়া ও রক্ষুকে সৰ্প বলিয়া জানা । ভ্রমের একীি অনুগত কারণ কিছুই নাই, এক এক ভ্রম এক এক দোষ বশতঃ ঘটিয়া থাকে ; পিত্ত্বাধিক্য রূপ দোষ ঘটিলে অতি শুভ্ৰ শস্থকেও পীতবর্ণ দেখা যায়, অভিছ্রতা-নিবন্ধন অতিবৃহৎ চন্দ্রমগুলকেও ক্ষুদ্র জ্ঞান হয় এবং মণ্ডকের বসা দ্বারা সম্পাদিত অঞ্জন নয়নে অৰ্পণ করিলে বংশকেও সর্প বলিয়া বোধ হয় । ঐ ঐ দোষ দ্বারা যখন ভ্রম ঘটে, তখন আর সহসা যথার্থ জ্ঞান হয় না ; যত ক্ষণ ঐ ঐ দোষ দূরীকৃত না হয়, স্তত ক্ষণ ঐ ঐ ভ্রম থাকে । দেখ, শঙ্খ অতিশুভ্ৰ, শঙ্খ শুভ ব্যতীত পীত হয় নাই, এইরূপ

শত শত উপদেশ পাইলেও, কিংবা সেই শঙ্খককেই শ্বেত্ত বলিয়া পূৰ্ব্বে নিশ্চয় করিলেও, যখন পিত্তাধিক্য হয়, তখন কোন ক্রমে শঙ্খকে পীত বই আর শ্বেত বোধ হয় না ।

নিশ্চয় ও সংশয় ভেদেও জ্ঞানের দ্বিবিধ বিভাগ করা যাইতে পারে । এই ভবনে মনুষ্য আছে, আর এই ভবনে মনুষ্য আছে কি না—এইরূপ জ্ঞানদ্বয়কে যথাক্রমে নিশ্চয় ও সংশয় কহে । সংশয় নানা কারণে শ্বটিতে পারে । কখন পরম্পর-বিরুদ্ধ-বাক্য-রূপ বি প্রতিপত্তি বাক্য শ্রবণে উহ! ঘটিয়া থাকে ; যথা, যখন, গৃহে মনুষ্য আছে কিনা কিছুই নিশ্চয় নাই, তৎকালে যদি এক জন বলে এইগৃহে মনুষ্য আছে, আর অন্য জন কহে, ন কই এ গৃহে ত মনুষ্য নাই, তখন সে গৃহে মনুষ্য আছে কি না কিছুই নিশ্চয় করা যাইতে পারে না, কেবল সংশয়ারূঢ়ই ङ्झे८ऊ श्ध्न ! আর সংশয় কখন, সাধারণ ও অসাধারণ ধৰ্ম্ম দর্শন হইলেও, হইয়া থাকে । দেখ, যখন দেখা যাইতেছে কোন গৃহে লেখনী ও পুস্তক উভয়ই আছে, আর কোন গৃহে লেখনী মাত্র আছে পুস্তক নাই, তখন ইহাই স্পষ্ট প্রতিপন্ন হইতেছে যে, লেখনী থাকিলেই পুস্তক থাকে এমত নিয়ম নাই । লেখনী থাকিলে পুস্তক থাকিলেও থাকিতে পারে এবং পুস্তকের অভাব থাকিলেও থাকিতে পারে ; সুতরাং লেখনী পুস্তক ও তদভাবের সহচররূপ সাধারণ ধৰ্ম্ম হইল। সাধারণ ধৰ্ম্মরূপ লেখনী দর্শনে কোন ব্যক্তি নিশ্চয় করিতে পারে যে, এই গৃহে পুস্তক আছে ; প্রত্যুত ঐ লেখনী দর্শনে এরূপ সংশয়ই হইয়া থাকে যে, এ স্থানে পুস্তক অাছে, কি না ? অার সন্দিগ্ধ বস্তু ও ভদভাবের সহিত যে বস্তুর সহাবস্থান পুৰ্ব্বদৃষ্ট ন হইয়াছে এমন্ত অবস্থায় সেই বস্তুর দর্শনকে অসাধারণধৰ্ম্মদর্শন কহে ; যেমন ষে ব্যক্তির, নকুল থাকিলে সৰ্প থাকে কি না থাকে একতরের নিশ্চয় নাই, সে ব্যক্তি যদি নকুল দেখে, তবে তাহার সপ বা তদভাব কাহারই নিশ্চয় হয় না, কেবল সৰ্প আছে কি না, এমত সংশয়ই হইয়া থাকে । বিশেষ দর্শন হইলে সংশয়ের নিবৃত্তি হয় । বিশেষ পদে , ষে বস্তুর সংশয় হয়, তাহার ব্যাপ্যকে বুঝায় । যে বস্তু না থাকিলে যে বস্তু থাকে না, তাহার ব্যাপ্য সেই বস্তু হয়, যথা বহ্নি না থাকিলে ধুম থাকে না বলিয়া বহ্নির ব্যাপ্য ধুম, সুতরাং যত ক্ষণ না ধূম দর্শন হয় তত ক্ষণ বহ্নির সংশয় থাকে ; কিন্তু ধুম দৃষ্টিপথে পতিত হইলেই বহ্নির সংশয় প্রস্থান করে ।

অনুভব ও মরণ ভেদে বুদ্ধিও দুই প্রকার হইতে পারে ।

সুখ ও দুঃখ যথাক্রমে ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্ম দ্বারা উৎপন্ন হয় । সুখ যাবতীয় প্রণীর অভিপ্রেত এবং দুঃখ অনভিপ্রেত । আনন্দ ও চমৎকারাদি ভেদে সুখ, আর ক্লেশদি ভেদে দুঃখ নানাবিধ । অভিলাষকেই ইচ্ছা কহে । সুখে এবং দুঃখাভাবে ইচ্ছা ঐ ঐ পদার্থের জ্ঞান হইলেই সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। সুখ ও দুঃখনিৰ্বত্তির সাধনে সুখসাধনতা-জ্ঞান ও দুঃখনিবর্ভকত-জ্ঞান হইলে, অর্থাৎ “এই বস্তু হইতে আমার সুখ আর এই বস্তু হইতে আমার দুঃখনিবৃত্তি হইবে? এইরূপ জ্ঞান হইলে, যথাক্রমে সুখ ও দুঃখ নিবৃত্তির উপায়ে ইচ্ছা জন্মে । দেখ, যে ব্যক্তি জানে অকৃ চন্দনাদি আমার সুখজনক এবং ঔষধপান আমার দুঃখনিবৰ্ত্তক, তাহারই ঐ ঐ বিষয়ে ইচ্ছা জন্মে ১ আর যfহার ঐ রূপ জ্ঞান না থাকে তাহার কখনই ঐ ঐ বিষয়ে ইচ্ছা জন্মে না। ইষ্ট সাধনত জ্ঞানের ন্যায়, চিকীর্ষার আরও দুইটি কারণ আছে ; যথা কৃতিসাধ্যতাজ্ঞান, আর বলবদনিষ্টসাধনতাজ্ঞানের অভাব । এই বিষয় আমি করিতে পারি এইরূপ জ্ঞানের নাম কৃতিসাধ্যতাজ্ঞান । আর এই বিষয় করিলে আমার মহৎ অনিষ্ট ঘটবে এইরূপ জ্ঞানের অভাবকে বলবদনিষ্টসাধনত জ্ঞানের অভাব বলে । দেখ, ষোগাভ্যাস করা অমদাদির কৃতিসাধ্য নহে এইরূপ যাহাদিগের স্থির নিশ্চয় অাছে, কখনই তাহাদিগের যোগাভ্যাস করিতে ইচ্ছা জন্মে ন । কিন্তু অনায় সেই যোগাভ্যাস করা যাইতে পারে এইরূপ যোগীদিগের নিশ্চয় থাকায় তাহারা তদ্বিষয় সম্পাদনে অভিলাষী হইতেছেন। এবং ষে ব্যক্তি জানে যে, এই ফলটি সুমধুর বটে, কিন্তু সৰ্পদষ্ট হওয়াতে ইহা বিষাক্ত হইয়াছে, সুতরাং ইহা ভক্ষণ করিলে প্রাণত্যাগ হইবে সন্দেহ নাই ; মে ব্যক্তির কখনই সে ফল ভক্ষণে প্রবৃত্তি জন্মে না । কিন্তু যাহার ঐরূপ জ্ঞান না থাকে, সে তৎক্ষণাৎ ঐ ফল ভক্ষণে চিকীযু হয় । যে বিষয় হইতে দুঃখ হইবার সম্ভাবনা থাকে সে বিষয়ে দ্বেষ জন্মে, যদি সে বিষয় হইতে কোন ইষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা না থাকে । দেখ, এ সময় গমন করিলে রবিকিরণোত্তাপে ক্লাস্ত-কলেবর হইতে হইবে— ইহা জানিয়া কোন ব্যক্তির সে সময় গমনে দ্বেষ না জন্মে ? কিন্তু যদি তৎকালে এমত নিশ্চয় থাকে যে, এ সময় গমন করিলে একটু রেশ হয় বটে, কিন্তু সহস্র মুদ্রা পাওয়া যাইতে পারে, তবে তৎকালে গমনে কোন ব্যক্তির দ্বেষ জন্মে ? বরং অনেকেই যাইবার নিমিত্ত সমুৎসুক হইয়া থাকে।

ষত্ব তিন প্রকার ; প্রবৃত্তি, নিৰ্বত্তি আর জীবনযোনি । যে বিষয়ে যাহার চিকীর্ষা থাকে, সে বিষয়ে তাহার প্রবৃত্তি জন্মে । আর যাহার যে বিষয়ে দ্বেষ থাকে, সে তদ্বিষয় হইতে নিবৃত্ত হয় । এ জন্য প্রবৃত্তি ও নিৰ্বত্তির প্রতি যথাক্রমে চিকীর্ষ (৬) , ও দ্বেষ কারণ । যে যত্ব থাকায় জীবিত থাকা যায়, তাহাকে জীবনষোনি যত্ন কহে। জীবনযোনি যত্ব না থাকিলে জন্তু সকল ক্ষণ-কালও জীবিত থাকে না, এই জন্য ইহার জীবনষোনি নাম অস্বর্থ হইতেছে। ঐ যত্ন দ্বারাই প্রাণিগণের শ্বাস প্রশ্বাসাদি নিৰ্ব্বাহিত হইতেছে ।

গুরুত্ব পতনের কারণ ; যাহার গুরুত্ব নাই, সে পতিত হয় না, যেমত তেজঃপ্রভৃতি । দ্রবত্ব ক্ষরণের কারণ । ইহা স্বাভাবিক ও নৈমিত্তিক ভেদে দ্বিবিধ । জলের দ্রবত্ব স্বাভাবিক । পৃথিবী ও কোন কোন ভেজের দ্রবত্ত্ব নিমিত্তাধীন হইয়া থাকে বলিয়া ঐ ঐ পদার্থের দ্রবত্ত্বকে নৈমিত্তিক দ্রবত্ব কহে ; যেমত তত্যন্ত অগ্নিসংযোগে ইষ্টকাদিরূপ পৃথিবী এবং সুবর্ণরূপ তেজঃপদার্থ দ্রবীভূত হইয়া যায় । জলের ষে গুণের সম্ভাবে তদার শক্ত প্রভৃতি চূর্ণ বস্তু পিঞ্জীকৃত হয়, তাহাকে স্নেহ কহে । স্নেহ উৎকৃষ্ট ও অপকৃষ্ট ভেদে দ্বিবিধ ৷ উৎকৃষ্ট স্নেহ অগ্নিপ্রজ্বলনের, আর অপকৃষ্ট স্নেহ অগ্নি নিৰ্ব্বাণের কারণ। যথা, ভৈলান্তৰ্ব্বত্ত জলীয়ভাগের উৎকৃষ্ট স্নেহ থাকায় উহার দ্বার। অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া থাকে এবং অন্যান্য জলের অপকৃষ্ট স্নেহ থাকায় ভদূর অগ্নি নিৰ্বাপিত হইয়া যায়।

সংস্কার ত্ৰিবিধ ; বেগ, স্থিতিস্থাপক ও ভাবনা । বেগ ক্রিয়াদি দ্বারা উৎপন্ন হইয়া থাকে । যে বস্তুর বেগ যত ক্ষণ থাকে, তাহার গতিশক্তিও তত ক্ষণ থাকে । বেগ নিৰুত্ত হইলেই গতিশক্তি নিৰ্ব্বত্ত হইয়া যায় ; যেমত শর বিক্ষেপ করিলে শরের বেগ জন্মে, এবং ঐ বেগ দ্বারা শরের গতিশক্তি জন্মে ; আর যত ক্ষণ শরের বেগ থাকে তত ক্ষণ তাহার গতিশক্তিও থাকে । ব্লক্ষের শাখা আকর্ষণ করিয়া বিমোচন করিলে যে গুণের সম্ভাবে উহা পূৰ্ব্বস্থান-স্থিত হয়, তাহাকে স্থিতিস্থাপক সংস্কার কহে । ষে সংস্কার দ্বার। পূৰ্ব্বাহভূত বস্তু সকলের মরণ হয়, তাহীকে ভাবন সংস্কর কহে । যে বিষয়ে ঐ সংস্কার না থাকে, সে বিষয়ের স্মৃতি হয় না। এজন্য ঐ সংস্কারকে স্মৃতির কারণ কহে । সংস্কার উপেক্ষানাত্মক জ্ঞান হইতে হইয় থাকে ; যে বস্তু জানিতে ইচ্ছা থাকে তাহার উপেক্ষানৰ্ম্মিক জ্ঞান হয়, আর যে বিষয়, দর্শনেচ্ছ না থাকিলেও, সহসা দৃষ্টিপথে পতিত হইয়৷ জ্ঞাত হয়, সে বিষয়ের ঐ জ্ঞানকে উপেক্ষাত্মক জ্ঞান কহে । ফলতঃ উপেক্ষাত্মক ও অনুপেক্ষাত্মক জ্ঞান অনুভবসিদ্ধ জ্ঞানবিশেষ, উহা সবিশেষ ব্যক্ত করা সুকঠিন । দেখ, তুণ আর রমণী উভয়েই দৃষ্টিপথে পতিত হয় বটে ; কিন্তু তৃণ ও রমণী দর্শনে বথাক্রমে ইচ্ছার অসদ্ভাব ও সদ্ভাব থাকায়, ঐ ঐ বিষয়ে উপেক্ষাত্মক ও অনুপেক্ষাস্মক জ্ঞান জন্মে ; এ জন্য ঐ ঐ বিষয়ে যথাক্রনে ংস্কারের অতুৎপত্তি ও উৎপত্তি হইয়া থাকে । সুতরাং তৃণের সংস্কার না থাকায় তৃণ বিষয়ক স্মৃতি হয় না ; পরন্তু রমণী বিষয়ক সংস্কার থাকাতে রমণী সৰ্ব্বদাই স্মৃতি পথারূঢ়া হয় । ষে সংস্কার দৃঢ় কিংবা দৃঢ়তর না হয়, তাহ। অলপ কালেই বিনষ্ট হয় । যে বিষয়ের বারংবার আলোচনা করা যায়, সে বিষয়ে দৃঢ় এবং তদধিক আলোচনায় দৃঢ়তর ংস্কার জন্মে । ঐ ঐ সংস্কার অধিক কাল থাকে এবং যত ক্ষণ যে ব্যক্তির বসন কিংবা ভূষণাদির দর্শনরূপ উদ্বোধকের সমবধান ন হইতেছে, তত ক্ষণ সে ব্যক্তি পুৰ্ব্বাবগত হইলেও কেবল সংস্কার দ্বার স্মৃতিপথারূঢ় হইতেছে না, এ জন্য সংস্কার যে স্মৃতিবিষয়ে মৰ্ত্তব্য বস্তুর অনুষঙ্গীর জ্ঞানাদিরূপ উদ্বোধকের সহায়তা অবলম্বন করে তাহার আর সন্দেহ কি ?

ধৰ্ম্ম শুভাদৃষ্ট ও পুণ্যাদি-পদবাচ্য । ইহা গঙ্গাস্বান ও যাগাদিদ্বার জন্মে এবং কৰ্ম্ম নাশা নদীর জলস্পশাদিতে বিনষ্ট হয়, এজন্য হিন্দুধৰ্ম্মাবলম্বী ব্যক্তিরা অদ্যাপি ঐ নদীর জল স্পর্শ করেন না। ঐ ধৰ্ম্মম্বারা স্বৰ্গাদি হয় । অধৰ্ম্মকে দুরদৃষ্ট ও পাপ কহে । অধৰ্ম্ম অবৈধ কৰ্ম্মানুষ্ঠানে জন্মে এবং প্রায়শ্চিত্ত|দির দ্বারা বিনষ্ট হয় । ইহা নরকভোগের প্রধান কারণ । ঐ ধৰ্ম্মাধৰ্ম্ম তত্ত্বজ্ঞান হইলে অভ্যার জন্মে না, এজন্য তত্ত্বজ্ঞানীর পক্ষে বৈধ বৈধ সকল কৰ্ম্মই সমান বলিয়া পরিগণিত হয় ।

শব্দ দ্বিবিধ, ধ্বনি আর বর্ণ। মৃদঙ্গাদি দ্বারা যে শব্দ জন্মে তাহাকে ধ্বনি এবং কণ্ঠাদি হইতে ষে শব্দ উৎপন্ন হয় তাহাকে বর্ণ কহে । ঐ বর্ণাত্মক শব্দ স্বর ব্যঞ্জন ভেদে দ্বিবিধ t শব্দ অনিত্য হইলেও « সো২য়ং কঃ ” ( সেই ক-ই এই) এইরূপ পুৰ্ব্বোৎপন্ন ককারের সহিত পরোৎপন্ন ককারের যে অভেদ প্রতীতি হইয় থাকে, তদূর বাস্তবিক অভেদ সিদ্ধ হইবেক না । যেমত, যে ঔষধ পান করিয়া নীলমণি আরোগ্য প্রাপ্ত হইয়াছেন তুমি সেই ঔষধ পান কর ইত্যাদি স্থলে সেই ঔষধের সঞ্জাতীয় ঔষধে সেই ঔষধ পান কর ইত্যাদি বাক্যের তাৎপৰ্য্য বলিতে হয় ; সেইরূপ সেই ক সজাতীয় এই ক, এইরূপ অর্থে ‘‘সোহয়ং কঃ” ইত্যাদি বাক্যের তাৎপর্য্য স্বীকার করিতে হইবে ।

গুণপদার্থ দ্রব্যমাত্রে থাকে আর কোন পদার্থে থাকে ন। তন্মধ্যে নীল পীতাদি রূপ, কটু কষায়াদি রস, গন্ধ, অ ভুঞ্চাশীত স্পর্শ, সংখ্যা অবধি অপরত্ব পর্য্যস্ত সাতুটী, ভাবন ভিন্ন সংস্কার, গুরুত্ব আর দ্রবস্তু, এই ক একটি গুণ পৃথিবীতে আছে । শুক্লরাপ, মধুর রস, শীতস্পশ, সংখ্যাদি অপরত্ব পর্য্যন্ত ক একট, গুরুত্ব, দ্রবত্ত্ব, স্নেহ ও বেগ জলের গুণ । এ স্থলে আপাততঃ এরূপ আপত্তি উথাপিত হইতে পারে যে, যদি জলের শুক্ল রূপ ও মধুর রস ব্যতিরিক্ত অন্য রূপ বা রস না থাকে, তবে যমুনার জলে নীলস্য ও সমুদ্রজলে লবণরসের অনুভব হয় কেন ? কিন্তু ঐ আপত্তি স্থূলদশদিগেরই রমণীয় বলিতে হইবে ; যেহেতু যমুনাজলেরও শুক্লরুপ আছে ইহা ঐ জলকে উৎক্ষে পণ করিলে স্পষ্ট লক্ষিত হয় এবং সমুদ্রজলে লবণরূপ পার্থিব ভাগ মিশ্রিত থাকায় উ হাতে লবণরসের উপলব্ধি হয়, বাস্তবিক জলের লবণ রস নাই ; দেখ, যন্ত্র দ্বারা সমুদ্রজল হইতে লবণভাগকে পৃথক্ভূক্ত করিলে আর সমুদ্রজলে লবণরসের অনুভব হয় না । যদি বস্তবিক মমুদ্র জুলের লবণ রস থাকি ভ, তবে কথনই তাহার বিগম হইত না ।

জলের মাধুর্য গুণ হরীতকী ভক্ষণ করিয়া জল পান করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় । ঐ মাধুর্য্যগুণ হরীতকীর বল। যাইতে পারে না, কারণ তাহা হইলে কেবল হরীতকী ভক্ষণ করিলে তদ্বিপরীত কষীয় রসের অনুভব হইভ না । গীভস্পর্শ লল ভিন্ন আর কুত্রপি নাই, তবে যে সৃষ্ট চন্দনাদিতে শৈতোপলব্ধি হয়, সে তৎসংযুক্ত জলীয়ভাগের বলিতে হইবে, বাস্তবিক যদি চন্দনেরই শৈত্য গুণ থাকিত, তবে শুষ্ক চন্দনেও শৈস্থ্যে পলব্ধি হইভ । সকল জলেরই শীতস্পর্শ আছে; তপ্ত জলের যে উষ্ণত প্রতীক্তি হয়, সে তৎসংযুক্ত অদৃশ্য তেজের বলিতে হইবে ; জলের হইলে অগ্নিসংযোগব্যক্তিরেকেও উহাতে উষ্ণতার প্রতীতি হ ষ্টত । সকল জলেই দ্রবত্ত্বগুণ আছে ; কর কাদিতে যে কাঠিন্য বোধ হইয়া থাকে সে (উহার দ্রবত্ত্ব প্রতিরুদ্ধ থাকায় ) ভ্রম মাত্র । যখন ঞ্জল ভিন্ন অন্য কোন বস্তু দ্বারা গোধুমচূর্ণ প্রভূতিকে ভ্ৰক্ষণ করিয়া গোলাকুতি করা যায় না, তখন এক মাত্র জলেরই যে স্নেহ গুণ আছে তাহা বলা বাহুল্য ।

ভাস্কর শুক্ল রূপ, উষ্ণ স্পর্শ, সংখ্যাদি সাতটি ও (৭) দ্রধত্ব এই কএকটি গুণ তেজঃপদার্থে আছে । সুবর্ণ ও মরকত মণি প্রভূতির ও শুক্ল রূপ আছে, তবে ষে পী তত্ব ও নীলত্বাদির অনুভব হয়, সে কেবল ভৎসংযুক্ত পীত নীলাদি পৃথিবীভাগেরই বলিতে হইবে, উহাদিগের শুরু রূপ তদূর অভিভূত থাকায় দৃষ্ট হয় না । স্বর্ণের শুরুরূপ উহা দ্রবীভূত হইলে স্পষ্ট প্রস্তীত হয় । এবং চন্দ্রকিরণাদিতে যে শীত্ত স্পর্শের অনুভব হয়, তাহাও তন্মিশ্রিত জলীয় ভাগের বলিতে হইবে, যেহেতু সকল ষ্ট্ৰেঞ্জেরই উষ্ণ গৰ্শ আছে । স্বাভাবিক অনুষ্ণাগীত স্পর্শ, সংখ্যা প্রভৃতি সাতট আর বেগ, বায়ুর গুণ । বায়ুর যে কখন কখন উষ্ণতা ও শৈত্যের উপলব্ধি হয়, সে বায়ু কর্তৃক আনীত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তৈজস ও জলীয় ভাগের বলিতে হইবে ; যেহেতু বায়ুর, পুষ্করিণ্যাদির নিকটেই শৈত্যের এবং দহ নাদির নিকটেই উষ্ণতার অনুভব হয় । যদি বায়ুর স্পৰ্শই ঐ ঐ রূপ হুইত, তবে সৰ্ব্বদাই ঐ ঐ রূপ স্পর্শের উপলব্ধি হইত ।

শদ, সংখ্যা, পরিমাণ, পৃথকত্ব, সংযোগ ও বিভাগ এই কয়েকটা গুণ আকাশে আছে । কাল আর দিকের গুণ সংখ্যাদি পাঁচটা । সংখ্যাদি পাঁচটী, বুদ্ধি, সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ, যত্ব, ভাবনাত্মক সংস্কার, ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্ম, এই চৌদটী গুণ জীবাত্মার ; জীবাত্মার যে যে গুণ আছে, প্রায় সে সকলই পরমাত্মার আছে, কেরল দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, ভারন, ধৰ্ম্ম ও অধৰ্ম্ম এই কয়েকটা মই । পরমাত্মার জ্ঞান, ইচ্ছা, যত্ব প্রকৃতি কএকটা গুণ নিত্য । সংখ্যাদি সাতটা চার বেগ

মনের গুণ !

ক্রিয়াকে কৰ্ম্ম কহে | কৰ্ম্মপদার্থ উৎক্ষেপণ, অবক্ষে পণ, স্বাকুঞ্চন, প্রসারণ ও গমন ভেদে পঞ্চবিধ ।

উদ্ধ প্রক্ষেপকে উৎক্ষেপণ, অধোবিক্ষেপকে অৰক্ষেপণ, বিস্তুত বস্তু সকলের সঙ্কোচ করাকে আকুঞ্চন, আর সঙ্কচিত বস্তু সকলের বিস্তার করাকে প্রসারণ কহে। ভ্রমণ, উদ্ধ জ্বলন, তিৰ্য্যগগমন প্রভূতির গমনেই অন্তর্ভাব হইবে, ইহার স্বতন্ত্র ক্রিয়া নহে। কিয়া পৃথিবী, জল, তেজঃ, বায়ু আর মনঃ এই পাচটা দ্রব্যে থাকে ।

জাতি পদার্থ নিত্য এবং অনেক বস্তুতে থাকে, ৰথ ঘাটত্ব জাতি সকল ঘটেই আছে ৷ পর ও অপর তেদে জাতি দ্বিবিধ । যে জাতি অধিক স্থানে থাকে ত{হাকে পর জাতি, আর যাহা অপ দেশে থাকে তাহাকে অপর জাতি কহে । দেখ, সত্তা জাতি দ্রব্য, গুণ আর ক্রিয়া তিনেই আছে বলিয়৷ উহাকে পরজাতি এবং ঘটত্ব ও নীলস্থাদি জাতি কেবল ঘটে ও কেবল নীলাদিতে থাকায় উহাদিগকে অপর জাতি কহে । দ্রব্যত্ব, গুণত্ব ও ক্রিয়াত্মাদি জাতি সত্ত। অপেক্ষা অম্পদেশে থাকায় অপর জাতি, আর ঘটত্বাদি অপেক্ষা অধিক স্থানে থাকায় পর জাতি, অপর জাতি উভয়ই হইতে পারে ।

বিশেষ পদার্থ নিত্য । আকাশ ও পরমাণু প্রভৃতি এক একটা নিত্যদ্রব্যে এক একটা বিশেষ পদার্থ আছে। যদি বিশেষ পদার্থ না থাকিত, তবে কখনই পরমাণু সকলের পরস্পর বিভিন্ন রূপতায় নিশ্চয় করা যাইত না । দেখ যেমত অবয়বী বস্তুদ্বয়ের পরস্পরের অবয়বগত বিভিন্নত দর্শনে বিভিন্ন রূপতা নিশ্চয় করা যাইতেছে, সেরূপ পরমাণু প্রভূতির ত অবয়ব নাই, তবে কি রূপে তাহাদিগের বিভিন্ন ভা নিশ্চয় করা যাইতে পারে ? কিন্তু বিশেষ পদার্থ স্বীকার করিলে এরূপ দোষ হয় না । কারণ তাহা হইলে, এই পরমাণুক্তে ষে বিশেষ আছে, তাহ অন্য পরমাণুতে নাই বলিয়। এই পরমাণু অন্য পরমাণু হইতে ভিন্ন, এবং অন্য পরমাণুতে যে বিশেষ আছে তাহা অপর পরমাণুতে নাই, এজন্য অন্য পরমাণু অপর পরমাণু হইতে পৃথক—এই রীতি ক্রমে যাবতীয় পরমাণুর পরস্পর বিভিন্নরূপতা নিশ্চয় করা যাইত্তে পারে ।

দ্রব্যের সহিত গুণ ও কৰ্ম্মের, দ্রব্য, গুণ ও কৰ্ম্মের সহিত জাভির, নিত্য দ্রব্যের সহিত বিশেষ পদার্থের যে সম্বন্ধ এবং অবয়বের সহিত অবয়বীর যে সম্বন্ধ, তাহকে সমবয় পদার্থ (৮) কহে । যেরূপ হস্তের সহিত পুস্তকের সম্বন্ধ পুস্তক হইতে হস্ত উত্তোলন করিলে থাকে না, সমবায় সম্বন্ধ সেরূপ নহে, যেহেতু দ্রব্যত্বের সম্বন্ধ ব্যতিরেকে কখনই দ্রব্য থাকে না এবং অবয়বের সম্বন্ধ ত্যাগ করিয়া কখনই অবয়বী থাকে না । অতএব ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে, সমবায় সম্বন্ধ সৰ্ব্বদাই বিদ্যমান আছে । এজন্য উহাকে নিত্য সম্বন্ধ কহে ।

অভাব দ্বিবিধ ; ভেদ ও সংসর্গাভাব । গৃহ হইতে পুস্তক ভিন্ন, পুস্তক গৃহ নহে, লেখনীতে ঘটের ভেদ আছে ইত্যাদি স্থলে যে অভাব গ্রতীয়মান হয়, তাহাকে ভেদ কহে । অত্যন্তাভাব, ধ্বংস ও প্রাগভাব ভেদে সংসর্গাভাব ত্ৰিবিধ । এ গৃহে বস্ত্র নাই, নীলকমল তুমি গৃহে গমন করিও না, অদ্য আমার অধ্যয়ন হইল না ইত্যাদি স্থলে যে অভাব বুঝায় তাহাকে অত্যন্তাভাব কহে । অত্যন্তাভাব আর ভেদের উৎপত্তি বা বিনাশ কিছুই নাই। যে বস্তুর যাহাতে উৎপত্তি হইবে সে বস্তুর তাহতে পূৰ্ব্বে যে অভাব থাকে তাহাকে প্রাগভাব কহে । এই সুত্রে বস্ত্র হইবে এবং এই স্বর্ণে অলঙ্কার হইবে ইত্যাদি স্থলে ঐ অভাব প্রতীয়মান হয় । প্রাগভাবের উৎপত্তি নাই বটে, কিন্তু বিনাশ আছে ।

দেখ, যত ক্ষণ স্থত্রে বস্ত্র না হয় তত ক্ষণ সুত্রে বস্ত্রের প্রাগভাব থাকে বটে, কিন্তু বস্ত্র হইলেই উহা আর থাকে না। বিনষ্ট হইয়া যায় । বিনাশকে ধ্বংস কহে । যখন ঘাট বিনষ্ট হইবে, বস্ত্র ধ্বস্ত হইতেছে, আমার পক্ষীটি বহুকাল বিনষ্ট হইয়াছে, এরূপ ব্যবহার দ্বার স্পষ্ট জানা যাইছেড়ে যে, ধ্বংসের ও উৎপত্তি আছে ; তখন ধ্বংসের যে উৎপত্তি নাই এই কথায় কিরূপে বিশ্বাস করা যাইতে পারে, কিন্তু “ধ্বংসের ধ্বংস হইরে বা হইতেছে” এরূপ ব্যবহার হইতেছে না বলিয়া ধ্বংসের ষে ধ্বংস নাই ইহা স্বীকার করা যাইতে পারে ।

এই সপ্ত পদার্থতিরিক্ত পদার্থান্তর নাই । ইহাদিগের মধ্যেই তাবৎ পদার্থ অন্তর্ভূত হইবে। অন্ধকারাদি স্বতন্ত্র পদার্থ নহে ; যেহেতু আলোকের অভাবকেই অন্ধকার কহে । তদতিরিক্ত অন্ধকার পদার্থে কোন প্রমাণ নাই ; তবে যে “নীলং স্তমশ্চলভি” (অর্থাৎ নীলবর্ণ অন্ধকার চলিতেছে ) এরূপ ব্যবহার হইয়া থাকে তাহা ভ্ৰমীন বলিতে হইবে ; যেহেতু অভাব পদার্থের নীলগুণ ও চলনক্রিয়া সম্ভবে না । সকল পদার্থকেই জানিতে ও শ দদ্বারা নির্দেশ করিতে এবং প্রমাণ সিদ্ধ করিতে পারা যায় বলিয়া সকল পদার্থকেই জ্ঞেয় বাচ্য ও প্রমেয়রূপে নির্দেশ করা যায়।

———————-

(১) এই অংশ বৈশেষিক দর্শনীৰ লোকন ব্যতিরেকে সাধারণের অনায়াসে বোধগম্য হইবেক এমত প্রত্যাশ করা যাইতে পায়ে না ।

(২) বৈশেষিক সূত্রোপস্কারমতে ইহা লিখিত হইল ।

(৩) “যদিও সর্ব্বদর্শন সংগ্রহগ্রন্থে “দশমে অনুমানভেদ প্রতিপাদনম্‌”  অর্থাৎ দশমাধ্যায়ে অনুমানের ভেদ প্রতিপাদিত হইয়াচে, এইরূপ লিথিত আছে, তথাপি এস্থলে আমরা তদনুবৰ্ত্তী হইতে পারলাম না ; যেহেতু বৈশেষিক দর্শনের দশমাধ্যায়ে বাস্তবিক অনুমানভেদ নির্দিষ্ট হয় নাই ; সুতরাং প্রকৃত গ্রন্থবিরুদ্ধ, বৈশেষিক সূত্রোপস্কার পরিষ্কৃত পথাবলম্বনে অগত্যা সম্মত হইতে হইল । সংগ্রহ গ্রস্থে যে ঐ রূপ লিখিত আছে, তাহ, ৰোধ করি, লিপিকরুভ্রমবশতই ঘটিয়া থাকিবে। গ্রন্থকারের ভ্রম বল! আমিদিগের উদ্দেশ্য নহে ।

(৪) তর্কামৃতগ্রন্থের মতে শুক্ল, নীল, পীত, রক্ত, হরিত, কপিশ ও চিত্র এই সপ্ত প্রকার রূপ ।

(৫) সংযোগ ত্রিবিধ, যথা একস্ক্রিয়াজন্য, উভয়ক্রিয়াজন্য ও সংযোগজন্য বিভাগ ও তিন প্রকার ; একক্রিয়াজন্য, উভয়ক্রিয়াজন্য ও বিভাগজন্য ।

(৬) কেবল চিকীর্ষাই প্রবৃত্তির কারণ নহে, উপাদানপ্রত্যক্ষও কারণ (সহকারী) হইয় থাকে।

(৭) যদিও এস্থলে সামান্যতঃ তেজের গুণ লিখিত হই ল, তথাপি সকল ণ্ডেজের দ্র ত্ব গুণ নাই, স্বর্ণ প্রভৃতির আছে, অগ্নিপ্রভৃতির নাই।

(৮) এই মতে সমবায় পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না, কিন্তু নৈয়ায়িকেরা ইহার প্রত্যক্ষ স্বীকার কবিয়া থাকেন ।

 

(প্রুফরীড আবশ্যক)

<

Super User