শ্রীচৈতন্যের মাতা-পিতার পূর্বজন্মের কাহিনি

পূর্বকালে বিষ্ণু শর্মা নামে একজন নিরহঙ্কারী, সদাচারী, মিষ্টভাষী, সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার স্ত্রীও স্বামীর মতো। ভিক্ষাই ব্রাহ্মণের জীবিকা।

নিত্যদিনের মতো ব্রাহ্মণ ভিক্ষায় বেরিয়েছেন। গৃহে ব্রাহ্মণী হরিনামের মালা জপ করছেন। এমন সময় ব্রাহ্মণী কুটিরের ভিতর থেকেই দেখলেন একজন জটাজুট ধারী সন্ন্যাসী কুটিরের দ্বারে এসে ভিক্ষা চাইছেন। ব্রাহ্মণী ভাবলেন, সন্ন্যাসীকে কি দিয়ে আপ্যায়ণ করবেন, ঘরে যে কিছুই নেই। পরনে ও শতচ্ছিন্ন একটি শাড়ী। কুটিরের বাহিরে আসতেও লজ্জা করছে। তখন তিনি ভিতর থেকেই বললেন–আসুন, বসুন এই পিঁড়িতে। আমার স্বামী ভিক্ষায় বেরিয়েছেন। তিনি এলেই রান্না করে আপনার সেবার ব্যবস্থা করব। এখন আপনি হাত মুখ দুয়ে একটু জল সেবা করুন।

সন্ন্যাসী ঠাকুর দেখল, যে এরা সত্যিই খুবই দরিদ্র। ভাবলেন, দীর্ঘদিন তপস্যা করে যে স্পর্শমণি আমি পেয়েছি, তাই দিয়ে এই কুটির বাসিনীকে যদি ধনী করে তুলি তাতে মন্দ কি? দারিদ্র্যের জ্বালা আমি বুঝি। সেই জ্বালা দূর করবার জন্য শিবের আরাধনা করে আমি এই স্পর্শমণি পেয়েছি।

তারপর সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণীকে বললেন–আমার বড় ক্ষুধা মা। ত্রিশ বছর অনাহারে থেকে শিবের বরে আমি একটি পাথর পেয়েছি। গৃহে ফিরতে আমার অনেক পথ যেতে হবে। তাই ভাবলাম তোমার কুটিরেই কিছু আহার করি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য। তোমাদের এমন দুর্দশা যে, সামান্য কিছু আহারও বাড়িতে নেই। কি আর করা যাব, ততক্ষণে আমি স্নান সেরে আসি। এক কাজ কর মা তোমার বাড়িতে যত লোহা আছে এই স্পর্শমণি দিয়ে সব সোনা করে নাও। তোমাদের দুঃখ ঘুচবে, আর ভিক্ষা করে খেতে হবে না।

এই বলে সেই স্পর্শমণিটি সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণীকে দিতে চাইলে, তিনি সেটি নিজের হাতে না নিয়ে শুধু বললেন–ওখানে রেখে দিন। সেটি রেখে সন্ন্যাস স্নানের জন্য চলে গেলেন।

ব্রাহ্মণী তখন চিন্তা করলেনবড় গরীব আমরা, ভিক্ষা ছাড়া আর কোনো সংস্থান নেই আমাদের। ব্রাহ্মণ বুড়ো হয়েছেন। আর কতদিন ভিক্ষা করবেন। কোনো ছেলেপুলে ও আমাদের নেই যে শেষের দিনে আমাদের দেখবে। এই পাথরের দ্বারা আমরা যদি বড়লোক হতে পারি, তাহলে আমাদের আর কোনো চিন্তা থাকবে না।

আবার তিনি ভাবলেন–না, স্বামী আগে ফিরে আসুন। তিনি যা বলবেন, তাই হবে। আমি না হয় তাকে বুঝিয়ে বলব। যদি তিনি স্বীকার করেন তো ভালই, না হলে সন্ন্যাসীর জিনিস সন্ন্যাসীকে ফিরিয়ে দেব।

এই রকম সাত পাঁচ ভাবছেন ব্রাহ্মণী। সেই সময় ভিক্ষে করে ব্রাহ্মণ ফিরে এলেন। ব্রাহ্মণী সন্ন্যাসী ঠাকুরের সব কথা তাকে বললেন।

সব শুনে ব্রাহ্মণ বললেন–ওসব পাপের জিনিস ব্রাহ্মণী, ঘরে রাখতে নেই ওসব কি হবে বড়লোক হয়ে? এই তো বেশ আছি। ভগবান আমাদের ভাগ্যে যা দিয়েছেন, তার বেশি কিছু আশা করা উচিত নয়। যখন আমি অথর্ব হয়ে পড়ব, আর ভিক্ষায় যেতে পারব না, গোবিন্দই তখন আমাদের দেখবেন, আমাকে মণিটি দাও, আমি নদীতে ফেলে দিয়ে আসি।

ব্রাহ্মণী বাধা দিয়ে বললেন–না, সেটা করা উচিত হবে না। আমরা গরীব তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু সন্ন্যাসী ঠাকুর যখন তার এই মণিটি চাইবেন, তখন কী উত্তর দেব?

ব্রাহ্মণ বললেন–তখন যা হয় দেখা যাব। এই নদীতে ফেলে দিয়ে আসি। ব্রাহ্মণী আর কোনো প্রতিবাদ করলেন না। ব্রাহ্মণ স্পর্শমণিটি নদীতে ফেলতে চলে গেলেন।

সন্ন্যাসী স্নান সেরে এসে দেখলেন ব্রাহ্মণের কুটিরে কোনো সোনা নেই। লোহার টুকরোগুলো তেমনিই পড়ে আছে। তিনি ব্রাহ্মণীকে জিজ্ঞাসা করলেন–কই আমার স্পর্শমণিটা দাও। আর তোমার বাড়ির কোনো লোহাকেই তো সোনা করে নাওনি দেখছি।

ব্রাহ্মণী ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন–আমার স্বামী ওসব পছন্দ করেন না। তাই তিনি সেই মণিটি নদীতে ফেলে দিয়েছেন।

এই কথা শুনে সন্ন্যাসী রাগে জ্বলতে লাগলেন এবং গভীর দুঃখে সে বলতে লাগলেন–হায়! হায়! এ আমার কি সর্বনাশ হলো গো। ত্রিশ বছর কঠোর সাধনা করে যে মণি পেলাম, তার গুরুত্ব না বুঝে সেটিকে নদীতে ফেলে দিলেন। এই বলে সন্ন্যাসী কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন। এই সময় ব্রাহ্মণ ফিরে এসে সন্ন্যাসীর সেই দৃশ্য দেখলেন। তাকে দেখে সন্ন্যাসী উঠে পড়ে বললেন–তুমি আমার এ কি সর্বনাশ করলে। আমার শিবদত্ত মণিকে তুচ্ছ জ্ঞান করলে। তুমি গরীব ব্রাহ্মণ, কেমন করে বুঝবে স্পর্শমণির গুণ। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট দেখে করুণা করতে গেলাম আর তুমি ভিক্ষুক হয়ে সেটা নদীতে ফেলে দিয়ে এলে?

সন্ন্যাসীর দুঃখ দেখে ব্রাহ্মণ বললেন–আপনার যখন এত প্রয়োজন মণিটির, তাহলে আবার কুড়িয়ে দিলেই হবে। আমার সঙ্গে চলুন। ঘর্ঘরা নদীতে এসে ব্রাহ্মণ অল্পজলে নেমেই সেই মণিটি কুড়িয়ে দিলেন। বললেন–এই নিন আপনার সেই মণি।

মণিটি হাতে নিয়ে সন্ন্যাসী বললেন–এটা তো সেই মণি নয়। শিব প্রদত্ত স্পর্শমণিটি ছিল বেশ ছোট। এটাতো দেখছি বেশ বড়। তুমি কি আমাকে বালক ভেবেছ? কঁচকে হীরা বলছ?

ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করলেন–আপনার মনিটির কি গুণ ছিল?

সন্ন্যাসী বলল যে সেটি কোনো লোহাতে ঠেকালে সেটি সোনা হয়ে যাবে।

ব্রাহ্মণ বললেন–আপনি লোহা এখানে কোথায় পাবেন? এক কাজ করুন, কত নুড়ি, পাথর পড়ে আছে। তাতেই একটু ছুঁড়ে দেখুন না।

সন্ন্যাসী অবহেলা ভরে একটি পাথরে মণিটি ঠেকাতেই সেটি উজ্জ্বল সোনায় পরিণত হল। পাশে ছিল কয়েকটি কাটা গাছ। সেই গাছগুলিও মণির স্পর্শে সোনা হয়ে গেল।

সন্ন্যাসী অবাক হয়ে ভাবলেন যে মণি শুধুমাত্র লোহাকেই সোনা করতে পারে, কিন্তু কাটা গাছ, নুড়ি-পাথর সোনা হচ্ছে কিভাবে? এই ব্রাহ্মণ কে? যিনি ইচ্ছে করলে অসীম ধনসম্পদের অধিকারী হতে পারেন। অথচ তার মনে বিন্দুমাত্র লোভ নেই। ভিক্ষাই যাঁর সম্বল। সাধারণ নন এই ব্রাহ্মণ। নিশ্চয়ই এই ব্রাহ্মণ এমন কোনো ধনে ধনী, যার সন্ধান অন্য কেউ জান না।

সন্ন্যাসী মণিটি ঘর্ঘরার জলে ফেলে দিয়ে ব্রাহ্মণের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেন–আপনিই প্রকৃত ধনী। তা না হলে এই পার্থিব ধনকে এমন করে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলতে পারতেন না। দয়া করে আমাকে আপনার গোপন ধনের এক কণা দিন।

বিষ্ণুর উপাসক ব্রাহ্মণ বললেন–এ জগতে বিষ্ণু ছাড়া বড় ধন আর কি আছে? তাকে আশ্রয় করে, নির্বিকার চিত্তে তার শরণ নিলে কোনো অভাব থাকে না।

সন্ন্যাসীকে ব্রাহ্মণ বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষা দিলেন।

ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী বিষ্ণুর তপস্যায় বসলেন। সেই তপস্যার তেজে সূর্যমণ্ডল উত্তপ্ত হয়ে উঠল। চঞ্চল হয়ে উঠল দেবলোক। কি চান ব্রাহ্মণ?

ব্রাহ্মণ যেন মনে মনে এই চাইছেন–হে বিষ্ণু, মানুষকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে না রেখে, তাদের চৈতন্য দাও। তারা তোমাকে যেন ভুলে না যায়। কলির মোহ-ফঁদে যাতে পা না দেয়।

স্বর্গের কশ্যাপ অদিতি, মথুরার বসুদেব দেবকী, অযোধ্যার দশরথ কৌশল্যা তারা এলেন নবদ্বীপে জগন্নাথ মিশ্র আর শচীদেবী রূপে, এই ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী তাদেরই সঙ্গে মিলে গেলেন।

সেই সূর্যমণ্ডলের তেজ প্রথমে এল জগন্নাথ মিশ্রের শরীরে, তার থেকে শচীদেবীর অঙ্গে।

ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে সন্ধ্যার সময় সকলঙ্ক চন্দ্রে গ্রহণের ছলে জগতের সকল জীবকে হরিনাম বলতে বলতে নবদ্বীপ ধামে অকলঙ্ক শ্রীগৌরহরি আবির্ভূত হলেন। অন্তরীক্ষ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল। দেবতারা স্তবগান করছে–হে শচীনন্দন, তুমি যুগে যুগে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছে। কখন নৃসিংহ, কখন মৎস্য, কখন বরাহ, কখন বামন রূপে ধরে পৃথিবীকে বারে বারে তুমিই উদ্ধার করেছ। কলির মানুষরা স্রষ্টাকে অস্বীকার করছে। তারা আত্মজ্ঞান হারা। নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। মোহ-মায়ার জালে তারা আবদ্ধ। পৃথিবীর এই দুর্দিনে তোমার আবার আবির্ভাব হল। তুমি অসুর বিনাশকারী। কলির মানুষেরা প্রত্যেকেই অসুরভাবাপন্ন। প্রেম দান করে অসুরভাব থেকে সকলকে মুক্ত কর। জীবকে চৈতন্য দান কর। জগতে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে তুমি খ্যাতি লাভ করবে।

যবন শক্তি যখন ভারতবর্ষকে গ্রাস করতে উদ্যত হল, চারিদিকে বৌদ্ধধর্ম যখন প্রবল হয়ে উঠেছে–ঠিক সেই সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার ভাবকান্তি অঙ্গীকার করে অবতীর্ণ হলেন নবদ্বীপে। অল্প বয়সেই পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন তিনি। গৃহী হয়ে ও সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে প্রেমধর্ম প্রচার করলেন। সবরকম বিভেদ প্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে একাকার করে দিলেন। তাঁর অপ্রতিহত গতির সামনে বৌদ্ধ ও যবন শক্তি থমকে দাঁড়িয়ে গেল।

<

Prithviraj Sen ।। পৃথ্বীরাজ সেন