দুদিন আগে যখন এসেছিলাম, তখন একরকম মনে হয়েছিল গ্রামটাকে; আজ আমার মনে হচ্ছে আরেক রকম। তার কারণ মন বলছে এই সুন্দর গ্রামের কোনও একটা গোপন জায়গায় গলায়-ফাঁসি-দিয়ে-মরা মানুষের লাশ লুকিয়ে আছে। হঠাৎ যদি দেখি—

নাঃ—ও সব ভাবব না। তা হলে বেড়ানো মাটি হয়ে যাবে।

কিন্তু বাঁশি বনের মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে আলো কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাহসটা আবার কমে গিয়েছিল। সেটাকে বাড়িয়ে দিল মূকাভিনেতা বেণীমাধব।

আরে, আমি যে আপনাদের বাড়িই যাচ্ছিলাম। বললুম না শুকুরবার বিকেলে এসে অভিনয় দেখিয়ে যাব।

কী করি বলে ভাই, বললেন লালমোহনবাবু।এমন একটা বিপর্যয় ঘটে যাবে সে কি জানতাম? এর পরে আর অ্যাকটিং দেখার মুড থাকে? তুমিই বলো।

তা যা বলেছেন স্যার। তা আপনারা ক’দিন আছেন তো?

হ্যাঁ, তা দিন তিনেক তো আছিই।

এ দিকে চল্লেন কোথায়?

কোনদিকে যাওয়া যায় তুমিই বলো না।

বাদুড়ে-কালী দেখেছেন স্যার? সপ্তদশ শতাব্দীর টেম্পল। এখনও কিছু হাতের কাজ রয়ে গেছে দেয়ালে। চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।

আমি যে সকলে দেখেছি মন্দিরটা সেটা আর বললাম না। সত্যি বলতে কী, তখন যা মনের অবস্থা ছিল তাতে হাতের কাজটাজ চোখে পড়েনি।

মিনিট তিনেক যেতেই মন্দিরটায় পৌঁছে গেলাম। এখানে সকালেই আসা উচিত। সন্ধেবোলা গা-টা একটু ছমছম করে। পাশেই আবার একটা বটগাছ। তার একটা বুরি মন্দিরের চুড়োটাকে আকড়ে ধরে খুলি ফাটিয়ে দিয়েছে।

এইখেনটায় বলি হত। স্যার, বটগাছের গুড়ির পাশে একটা জায়গা দেখিয়ে বলল বেণীমাধব।

বলি? লালমোহনবাবু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

নরবলি, স্যার। গোসাঁইপুরের ডাকাত ওয়ার্লড ফেমাস নেদো ডাকাতের ইতিহাস পড়েননি? ওই নিয়েই তো আপনার একটা রহস্য-রোমাঞ্চের বই হয়ে যায়। ভেতরটা দেখবেন? টর্চ আছে?

ভেতরটা এর মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেছে।

ভেতর? ধরা গলায় বললেন লালমোহনবাবু। টর্চ তো আনিনি ভাই। শুনিচি বাদুড়-টাদুড়…

বাদুড়ের তো এখন ইভিনিং এক্সকারশন স্যার। এইতো সবে চরতে বেরিয়েছে। বাদুড় দেখতে চাইলে–

না ভাই, চাই না। বরং না দেখাটাই বাঞ্ছনীয়।

চলে আসুন স্যার। মাচিস জ্বেলেছি। একটা বিড়ি ধরালুম স্যার।কিছু মাইন্ড করবেন না তো।

নো নো ভাই, মাইন্ড কী, তুমি পাঁচটা বিড়ি একসঙ্গে ধরাও না।

বেণীমাধব বিড়ি ধরিয়ে জ্বলন্ত দেশলাইটা মন্দিরের দরজার জায়গায় ধরলা, আর আমনি এক লাফে আমার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এল। লালমোহনবাবু চারবার জী-জী-জী-জী বলে থেমে গেলেন।

জীবনবাবুর মৃতদেহ! মন্দিরের ভিতরে থামের আড়ালে নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামার খানিকটা উঁকি মারছে। সকালে হাতে ঘড়ি ছিল, এখন নেই।

এই দেখুন, কে কাপড় ফেলে গেছে।

বেণীমাধব দিব্যি –এগিয়ে যাচ্ছিলেন, বোধহয় কাপড়গুলো উদ্ধার করে তার মালিককে ফেরত দিতে, লালমোহনবাবু তার শার্টের কোনা খামচে ধরে বললেন, ওটা লা-লাশ! পুশ-পুশ পুশ পুলিশের ব্যাপার!

মূকাভিনেতা লাশ শুনেই মূক মেরে গিয়েছিলেন—এইবার দেখলাম তার অভিনয়। অবাক থেকে শুরু করে এক ধাপে আতঙ্কে পৌঁছে তিনি দেখিয়ে দিলেন কথা না বলে কী করে পিটুটান দেওয়ার অভিনয় করতে হয়। আমরাও আর অপেক্ষা না করে এই বিভীষিকাময় পরিবেশ থেকে ঘুরে জোরে হেঁটে বাড়িমুখে রওনা দিলাম।

ফেলুদা দেখলাম ফিরে এসেছে। বলল, আমন ফ্যাকাশে মেরে গেছিস কেন? চটপট রেডি হয়ে নে। পনেরো মিনিটের মধ্যে আত্মা নামবে।

লালমোহনবাবু ফেলুদাকে দেখেই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বললেন, একটা ইম্পরটান্ট ডিসকভারি করে এলুম। অবিশ্যি এক নয়, দুজনে। জীবনবাবুর লাশ পড়ে রয়েছে বাদুড়ে কালীর মন্দিরে। পুলিশকে জানাবেন, না খুঁজতে দেবেন?

আমি জানতাম সুধাকর দারোগাকে লালমোহনবাবুর মোটেই পছন্দ হয়নি, তাই খুঁজতে দেবেন। ফেলুদা বলল, মন্দিরের ভেতরে গেসলেন?

নো স্যার। লাশ তো হ্যান্ডল করা বারণ, তাই আর যাইনি। তবে বিয়ান্ড ডাউট জীবন মল্লিক।

ঠিক আছে। সুধাকরবাবু এসছিলেন একটু আগে। বোধহয় ভট্টাচার্য মশায়ের ওখানে আসছেন। তখন খবরটা দিয়ে দিলেই হবে।

দশ মিনিটের মধ্যে আমরা রওনা দিয়ে দিলাম। তুলসীবাবু বললেন যে একবার উকিলবাবুর বাড়ি থেকে চন্ট করে ঘুরে আসতে হবে। কালকের অনুষ্ঠানটা যে ভেস্তে যেতে পারে সেটা ওঁকে জানানো দরকার।

যাবার পথে ফেলুদা বলল যে মৃগাঙ্কবাবু নাকি জীবনলালের আত্মা নামানোর ব্যাপারে আপত্তি দূরের কথা, রীতিমতো আগ্রহ দেখিয়েছেন। বাইরে থেকে আরও জন তিনেক লোক এসেছেন, তাদের বাইরে বসিয়ে রেখে আগে আমাদের কাজটা করে দেবেন।

মৃগাঙ্কবাবুর ঘরে আজ তক্তপোষের বদলে রয়েছে একটা কাঠের টেবিল, আর সেটাকে ঘিরে টিন আর কাঠে মেশানো পাঁচটা চেয়ার। এরই একটাতে বসে আছেন মৃগাঙ্ক ভটিচার্য। টেবিলের মাঝখানে রয়েছে একটা পিদিম, আর তার পাশেই একটা কাগজ আর পেনসিল। এ ছাড়া ঘরে রয়েছে দুটোর বদলে একটা বেঞ্চি, আর দুটো মোড়া। বেঞ্চিতে বসে আছে ভাগনে নিত্যানন্দ।

আমরা তিনজনে তিনটে চেয়ারে বসলাম, একটা খালি রইল তুলসীবাবুর জন্য।

তুলসীচরণের জন্য অপেক্ষা করব কি? প্রশ্ন করলেন মৃগাঙ্কবাবু।

পাঁচ মিনিট দেখা যেতে পারে, বলল ফেলুদা।

আমি জানতাম। সেদিন আপনাকে দেখেই উপলব্ধি হয়েছিল যে আমার কাছে আব্বার আসতে হবে। ভদ্রলোকের গলাটা এই অন্ধকার ঘরে গমগম করছে। মৃগাঙ্কবাবু বলে চললেন, বিজ্ঞান অর্থ বিশেষ জ্ঞান; পরলোকগত আত্মার সঙ্গে যোগস্থাপন হল এই বিশেষ জ্ঞানের শ্ৰেষ্ঠ জ্ঞান। সুতরাং যারা প্রকৃত বৈজ্ঞানিক, তারা এই বিশেষ জ্ঞানকে হেয় জ্ঞান করে না।

জ্ঞান জ্ঞান করে এই ঘ্যানঘ্যাননি আমার ভাল লাগছিল না। ভদ্রলোক এবার আরম্ভ করলেই পারেন।

আপনারা সকলেই পরলোকগত জীবনলালকে প্রত্যক্ষ করেছেন, এবং তিনি সদ্য মৃত। এই দুই কারণে আজকের অধিবেশনের চূড়ান্ত সাফল্য আমি আশা করি। আত্মা এখনও নরলোক হতে পরলোকে উত্তীর্ণ হবার অবকাশ লাভ করেনি। অনেক পার্থিব বন্ধন মুক্ত করে তবে আত্মার উত্তরণ। জীবনলালের আত্মা এখনও আমাদের পরিপাশ্বে বিদ্যমান। সে আমার আবাহনের অপেক্ষায় আছে। সে জানে আমি তাকে ডাকলে পাব, আমি জানি তাকে ডাকলে সে আসবে। জীবনলালের আত্মা ত্রিকালজ্ঞ, অবিনশ্বর। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তার অবাধ গতি। আমার এই লেখনী হবে তারই লেখনী। তারই জ্ঞান, তারই উপলব্ধি, তারই বিশ্বাস, ব্যক্তি হবে তারই ভাষায় আমার এই লেখনীর সাহায্যে।

এবার ফেলুদার মুখ খুলল! এ অবস্থায় কথা বলা ওর পক্ষেই সম্ভব, কেননা আমার গলা শুকিয়ে গেছে, আর আমার বিশ্বাস লালমোহনবাবুরও।

আপনি কী লিখছেন সেটা জানার জন্য সকলেরই কৌতুহল হবে, অথচ আমি ছাড়া আর সকলেই টেবিলের উলটা দিকে বসেছে, লেখা পড়া সম্ভব নয়। আমি যদি সকলের সুবিধের জন্য পড়ে দিই তাতে আপনার আপত্তি আছে কি?

কোনও আপত্তি নেই, বললেন মৃগাঙ্কবাবু, আপনি স্বচ্ছন্দেই লেখা পড়ে শুনিয়ে দিতে পারেন। আপনার জিজ্ঞাস্য তো একটাই, নয় কি?

তিনটে-ডাকাতের পরিচয়, খুনির পরিচয় এবং কখন কী ভাবে খুনিটা হয়।

উত্তম, বললেন মৃগাঙ্কবাবু।

Satyajit Ray ।। সত্যজিৎ রায়