অমুর ডায়েরি-২

সব গোলমাল হয়ে যায়। ‘মন’ যা-বলতে চায়, মুখ তা বলে না। তবু যত কথা তা, মুখ-ই বলে। সারাদিন।

বিষ্ণুদের বই ছিল-না? ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’। আমি নাম রেখেছি অগ্নিশিখা। কোনোদিন একটি কবিতা লিখব। অগ্নিশিখা তোমাকে নিয়ে।

বেশ লাগল অনেক অনেকদিন পর চাঁদের আলোয় নানা ফুলের গন্ধভরা পথে কারো পাশাপাশি হাঁটতে; এমন মানুষ, যে-নীচুস্বরে কথা বলে, যাকে দেখে মনে হয় সে, উচ্চস্বরে কর্কশভাষায় কখনো ঝগড়া করতে জানে না। যে গরমের দুপুরবেলায় তার পুরুষ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলে তাকে বড়োগাছের মতো ছায়া দেয়। কলাই-এর ডাল, ঝিঙে-পপাস্ত আর শুঁকতে বেঁধে খাওয়ায়। আর শীতের রাতে যে, বিরিয়ানি পোলাও আর বটি-কাবাব তৈরি করে অম্বর আতর লাগানো ফলসা রং মালিদার নীচে নিজের শরীরের সব উষ্ণতাটুকু জিইয়ে রেখে অপেক্ষা করে, দুয়ার-দেওয়া ঘরে রাতের খেলার সাথির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হওয়ার জন্যে।

বেশ বলেছিল অগ্নিশিখা।

বিয়েটা একটা চুক্তি। এগ্রিমেন্ট। সব মেয়েই অবশ্য বলে এ-কথা। ছেলে-মেয়ে এসে যাওয়ার পর, তা আর ভাঙা যায় না।

কথাটা ঠিক। অমুও বিশ্বাস করে কথাটা। তবে উইলেরও ‘কোডিসিল’ হয়। উইলও তো একটা চুক্তি। নিজের সঙ্গে নিজের। এগ্রিমেন্টের সংশোধনী হয় পুরোনো দলিলকে না ছিঁড়েও। এ-কথাটা নিজে যতটা বোঝে অন্যকে ততটা বোঝাতে পারে না। বোঝাতে চায় না। জোর করে কাউকে কিছু বোঝানো উচিতও নয়। যে, যতটুকু বোঝে, তার পক্ষে যা-ভালো বলে বোঝে; সেটুকু বোঝাই ভালো। নইলে বোঝা, ভারী বোঝা হয়ে ওঠে।

বেশ মেয়েটি অগ্নিশিখা। বুদ্ধিমতী। কিন্তু সেই-বুদ্ধি প্রকাশের জন্যে, কোনো ছটফটানি নেই। বুদ্ধিমানের চোখে বুদ্ধি চাপা থাকে না। ধরা তাকে পড়তেই হয়।

জমাটি শীত। বাইরে এখন গোলমুড়ি ক্লাবের পাহাড়ের সমান উঁচু ভেতরে বড়ো ক্লাব হাউসের চত্বরে, বড়ো বড়ো গোল আলোর মালায় মনে হচ্ছে যেন, গোয়ালিয়রের রাজপ্রাসাদ। বাড়িটা চমৎকার। বন্দোবস্তও চমৎকার। কিন্তু হলে কী হয়! যে-মানুষদের ভার একে সুষ্ঠুভাবে চালানোর, তাঁরা তাঁদের কর্তব্য করেন না। বেয়ারা থাকে না। বাবুর্চি থাকলেও খারাপ রান্না করে। নিয়মানুবর্তিতা আছে ঘড়ির কাঁটাতেই শুধু। চরিত্রে নেই; উদ্যমে নেই। মানুষ-ই, এক-একটি দেশের চরিত্র, সুস্থতা, স্বাচ্ছল্য নিরূপণ করে।

সেদিন গোপনে এই ক্লাবেই ডিনার খাওয়াল অনেককে। রবি মুখার্জি ও ড. গৌতম দাশগুপ্তকেসস্ত্রীক বলেছিল আসতে। আরও অনেককে। আমাকে তো বলেছিলই। অর্ডার করেছিল চিকেন ফ্রায়েড রাইস, বোনলেস-চিকেন আর কী কী যেন। একজন বার-বেয়ারা মেক-শিফট বার-এ দাঁড়িয়ে হুইস্কি খেয়ে নিজেই আউট হয়ে গেল। খাবার যখন সার্ভ করল তখন, চক্ষুস্থির হয়ে গেল। এমন চিকেন ফ্রায়েড-রাইস আর বোনলেস-চিকেন পৃথিবীর কোনো জায়গাতেই খাইনি। এমনকী আমার সেজোপিসির মতো পৃথিবীর খারাপতম রাঁধুনিও পরমচেষ্টাতেও অমন বিচ্ছিরি রান্না করতে পারতেন না। বেচারা গোপেন। মুখ কালো করে বসেছিল। পুরো নীলডি এবং গোলমুড়ি ক্লাবের ইজ্জত রক্ষার ভার যেন, ওর-ই একার! ও বেচারা কী করবে? সরষের মধ্যেই ভূত ঢুকে গেছে। এই ভূত ছাড়াবার ‘ওঝার দরকার সারাদেশে। কবে যে সে, আসবে! এই পার্টিতেই কল্যাণ আমার হাতে আড়ালে ডেকে একটি কবিতা দিল।

কোথাও কি ছাপাতে বলতে হবে?

না, না। আপনার-ই জন্যে। এমনিই।

কবিতাটি গোলমুড়ি ক্লাবের বারান্দাতে দাঁড়িয়েই পড়ে ফেললাম। অভিভূত হয়ে গেলাম।

কবিতার নাম দিয়েছে ‘ঝড়’—

এখানে ভীষণ খরা, প্রচন্ড গরমে
সকলের ওষ্ঠাগত প্রাণ।
একঘেয়ে গুমোটের চাপে
শত্রু কুকুরেরা স্বরে স্থবিরতা পেল।
নিথর গাছের পাতার মতো
ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাগুলো স্থির হয়ে আছে,
চাইবার কিছু নেই, দেবারও না কিছু–
একঘেয়ে বিষণ্ণতা, দুঃখ নিয়ে দিন।
এমন সময় সে এল, ঝড়ের মতো!
হাওয়ার দাপটে গাছগুলো টলোমলো,
ধুলো ওড়ে, চারিদিক আবছা আঁধার।
শত্রু কুকুরেরা এ ওর, ঘাড়ে পড়ল ঝাঁপিয়ে;
নিস্তব্ধতা ছারখার হল অজস্র চিৎকারে।
তবুও এ-ঝড় চিরস্থায়ী নয়।
যেমন এল আচম্বিতে তেমনি চলে যাবে
অন্য একদিন, অন্য কোনোদিকে হাওয়া দেবে
শুকনো আর ধূসর প্রান্তরে।
শুধু এরপর বৃষ্টি যেন, আসে–
গুমোটের পাতাগুলো ঋতুস্নান সেরে
স্পন্দন এনেছে দ্যাখো ফসিলিত গাছে
শিকড়েরা সব, যার যার গহ্বরে নেমে গেছে।

এই ঝড় কি অমু নিজে? ভেবে, নিজের মনেই খুশি হল খুব। এবং একটু শঙ্কিতও যে, হল না এমনও নয়। ব্যস্ত ডাক্তার অথচ কবি। পুলিশ অথচ ভদ্রলোক। ভাবা যায় না।

ঘুম পাচ্ছে বড়ো। যোগেন আর রিতার বাড়িতে অনেক-ই রাত হয়ে গেল। মালুরা নামিয়ে দিয়ে গেল। খাদ্য, পানীয় দুই-ই বেশি হয়েছে। ভালো ঘুম হবে না। এবং না-হলে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখব।

কিন্তু কাকে?

অগ্নিশিখাদের বাড়ির আউট হাউসের সামনে চড়ে-বেড়ানো লোম-উঠে-যাওয়া লাল মুরগিটাকে? না, ছবির বসবার ঘরে টাঙানো অস্ট্রিয়ার টিরল প্রভিন্স-এর নিসর্গ দৃশ্যকে? নাকি কোনো রক্তমাংসের নারীকে? কাকে?

স্বপ্ন না দেখাই ভালো। কোনোরকম স্বপ্নই। কারণ, মনে থাকে না। সুন্দর স্বপ্নগুলিও মুছে যায়। অথচ ‘স্মৃতি থেকে যায় বুকে অস্পষ্ট ব্যথা হয়ে।

.

০৪. অগ্নিশিখা

ব্রেকফাস্ট শেষ করে বারান্দার চেয়ারে বসে রোদ পোয়াচ্ছি। টেনিসের হার্ডকোর্টের পাশের ঝাউবনে বুলবুলি শিস দিচ্ছে। এমন সময় গবু এল। আমার ডিসট্যান্ট কাজিন।

বউ কোথায়? তৈরি হচ্ছে। একঘণ্টা টাইম দিয়ে এসেছি। যাওয়ার সময় তুলে নেব। যাবি কোথায়?

আজ শনিবার যে! গবু বলল। চলো অমুদা, আজ লাঞ্চ খাব মাঠে, আর ক্রিকেট দেখব।

দারুণ ম্যাচ আজ।

কার সঙ্গে কার খেলা?

ফাদার্স ভার্সাস সানস। লিমিটেড ওভারের খেলা, লাঞ্চ-এ বিরিয়ানি অ্যাণ্ড বিয়ার। তুমি আমার গেষ্ট। অবশ্য আরও অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে।

চলো বেরিয়ে পড়ি। বাজারে গিয়ে পান খাওয়াই তোমাকে। তারপর ওষুধও কিনতে হবে। টেলকো দেখেছ ভালো করে?

আমার দেখার উৎসাহ নেই।

কেন?

অনেক দেখেছি। সব দৃশ্যই মনে হয় আগে দেখা। সব দ্রষ্টব্য।

নতুন কিছু দেখাতে পারিস যা, কখনো দেখিনি? যা-দেখে, অন্য কোনোকিছুর কথা মনে হবে না?

মনে মনে বললাম, কোনো গাছ, ফুল, পাখি বা নারী?

না। ওষুধ তো কিনতে হবে। নাকি? ফোনে বললে যে!

হ্যাঁ।

এত ওষুধ খাও কেন?

এও এক অভ্যেস। চাকরির মতো। বিবাহিত জীবনের মতো।

ভূপেনবাবু কী বলেন জান?

কে ভূপেনবাবু?

আরে ভূপেনবাবু গো! দেজ মেডিকেলের।

ও। তা কী? কী বলেন? কী ব্যাপারে?

যেমন ওষুধ তৈরি করার সময় লিখে দেওয়া হয় ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট আর এক্সপায়ারি ডেট আমাদের যিনি বানিয়েছেন তিনিও ওমনি তারিখ লিখে দিয়েছেন অদৃশ্য কালিতে কপালে। যেদিন যাওয়ার সেদিন যেতেই হবে।

অমু হেসে উঠল। বলল, বেশ বলেছেন। হক কথা।

দু-তিনটি গাড়ি আসার শব্দ হল গোলমুড়ি ক্লাবের গেট পেরিয়ে।

গবু বলল, বাঃ বাঃ। এ যে, দেখছি লেডিস স্পেশ্যাল। তুমি দেখালে অমুদা। মেয়েরা তোমাকে এত পছন্দ করে কেন বলো তো? এই বয়েসেও?

শোন গবেট! শুধুমাত্র মেয়েরাই নয়, মেয়েদের স্বামীরা এবং বাবারাও করে নইলে, তাঁদের অমতে কি আর এঁরা আসতে পারতেন? তবে পছন্দ মেয়েরা আমাকে আদৌ করে না। আমি মেয়েদের পছন্দ করি। বললে কী হবে, তোদের মতো কাঠখোট্টারা তো গান, সাহিত্য, ছবি এসবের কদর করিস না। একদিন যা ছিল কিন্তু আজকের এই গরিব নিগুণ, রোজগারহীন, নিরূপ বৃষকাঠ কবিরও কিছু দাম যে, আছে এত মেয়েদের, স্ত্রীদের, বোনেদের কাছে তা, নিজচোখে দেখে রাখ। পাখিপিসিকে চিঠি লিখিস যে, তাঁর বকা ভাইপো ফাঁকায় নেই। তোর মতো অ্যাকাউন্টেন্ট না-হলে কী হয়। নিজের বউকে আজ দুধেভাতে রাখতে পারি না বটে অন্য অনেকের বউ-মেয়েরা এই পোড়াকাঠ কবিকে অশেষ খাতির-যত্ন করে।

তাইতো দেখছি।

জীবনের ‘হিসাব’ ঠিক-ই মেলে। বুঝলি গবু। একদিকে কম থাকলে অন্যদিকে বেশি হয়। যাকে বিধাতা মেধা দেন না, তাকে সিধে দেন কুলীন ব্রাহ্মণের মতো। যাকে রূপ দেন না, গুণ দেন কিছু। কনসোলেশান প্রাইজ হিসেবে। যাকে অর্থ দেন না, তার ওপরে যশ ছিটিয়ে দেন সামান্য। পূত গঙ্গাজলের-ই মতো। আমাকে ঈর্ষা করিস না। তোর বউদির নিরন্তর গঞ্জনাবাক্য, তাকে সুখে না রাখতে পারার অনুযোগ, অভিযোগ, যদি এইসব ভালো মানুষদের (তারমধ্যে তোর স্ত্রীও পড়েন) অকৃত্রিম স্বার্থহীন ভালোবাসায় সামান্য সময়ের জন্যেও পূর্ণ হয়ে ওঠে তাতে, নিজের চোখ টাটাস না। কবিরা বড়ো দুঃখীরে। সব কবিই। সব গাইয়েই। সব শিল্পীই। দুঃখের সঙ্গে ঘর করারই আর এক নাম শিল্পসৃষ্টির পরিবেশ। এই দুঃখটার রকম, নানা হয়। কারো দুঃখ ভাত-কাপড়ের। কারো দুঃখ অন্যকিছুর। এই অন্যকিছুর রকমও অনেক। তবে দুঃখটা ‘খাঁটি’ হওয়া চাই। দুঃখ খাঁটি না হলে, কবিতা বা ছবিও জাল হতে বাধ্য। কবিদের ‘হো হো’ হাসি আর ক্কচিৎ বেলেল্লাপনার কথাই ফেরে তোদের মুখে মুখে। তার প্রাত্যহিক একাকিত্ব, তার গভীর দুঃখ তাকে যে, প্রতিক্ষণ ক্যান্সারের মতো কুরে কুরে খেয়ে যায় নিঃশব্দে, এটা খুব কম মানুষ-ই বোঝে। আমার মতো একজন মধ্যবয়সি, আর্থিক দিক দিয়ে অসফল, নিরূপ, নিগুণ লোককে ঈর্ষা করলে ঈশ্বর তোকে ক্ষমা করবেন না গবু, একথাও বলে দিলাম।

আর লেকচার দিয়ো না তো। এইজন্যেই আমি এই আর্ট-কালচারের লাইনের লোকগুলোকে অ্যাভয়েড করি। চলো, বললাম রোদে বসে বিয়ার খাই। ভালো লাগল না। শুরু করলে মনুমেন্টের তলার লেকচার। একী। অমুদা! তোমার চোখ ছলছল করছে যে? এ কী ছেলেমানুষি করছ?

অমু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি যে, কবি। তাই। আমি তোর মতো বিচক্ষণ অ্যাকাউন্টেন্ট নই। তাই। তোরা আমাদের বুঝবি না। বুঝবে, ওই যারা আসছে ওই শ্রেয়ারা, শ্ৰমণারা, জয়িতারা।

কেন?

মেয়েদের মনের গড়নটাই অমন। নরম। স্পর্শকাতর। ভালোবাসার কাঙাল। যতই ভালোবাসা থাক-না, এই নিষ্ঠুনের ভান্ডারে। ওরা যেমন, বেগুন বা মাছ কেনার সময় বেছে কেনে, ভালোবাসার বেলাতেও ওরা বাছাবাছি করে। বেগুনে বেগুন-পাতুড়ি হয় বলেই, যে কোনো বেগুনে, পাতুড়ি রাঁধতে রাজি হয় না ওরা। ভালোবাসার স্বীকৃতিও মেয়েরা যেমন করে দিতে জানে, তেমন করে আমরা পারি না। সে, জ্বরগ্রস্ত কপালে হাতের পাতা ছুঁইয়েই হোক কী, কিছু রান্না করে খাইয়েই হোক বা এককলি গান শুনিয়েই থোক। মেয়েরা না থাকলে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, সব ফুল, সব পাখি, সব সৃষ্টি অনাদৃত হয়ে মাটিতে লুটোত। ওদের প্রত্যেকের মধ্যেই একজন সাহিত্য-কলা-সংগীত সমালোচক বাস করেন। যাঁরা শুধু ওঠানো-নামানোর সমালোচনায়, পারদর্শী দুরভিসন্ধিসম্পন্ন সমালোচক, ওরা তেমন।

সমালোচক নয়। সৎ সমালোচক।

কী গো? তোমরা সকলে মিলে এই সকালবেলা চড়াও হলে?

ব্যাপার কী? অমু বলল, ওদের সকলকেই একসঙ্গে।

কালকের পিকনিক-এর কথা মনে করিয়ে দিতে এলাম। আপনার যা-ডিম্যাণ্ড দেখছি এখানে, হয়তো মনেই থাকবে না। ডাইরিতে লিখে রাখুন। দাজুদার অর্ডার।

খুব-ই মনে আছে। যতদিন জামশেদপুরে আসছি ততদিন থেকেই দলমা পাহাড়ে যাওয়ার ইচ্ছে। শুনেছি, সুন্দর বাংলোও আছে ওপরে। পূর্ণিমার আগের দু-তিনদিন যদি কখনো থাকা যেত! বড়দলে নয়। খুব কম লোকের সঙ্গে। গান শুনতাম। আর কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। হয়-না কখনো, না? এ-জীবনে? জীবনের বাকিও তো খুব বেশি নেই।

বড়োবাজে কথা বলেন। জয়িতা ধমকে বলল।

চেষ্টা কেন? কবিতা লেখার?

শ্রেয়া বলল।

চেষ্টাটুকুই তো সার। কবিতা তো আর রসগোল্লা নয় যে, ইচ্ছে করলেই বানিয়ে ফেলা যায়। অনেক অনেক কাগজ ছিঁড়ে, অনেক অনেক শব্দ ও লাইন কেটে তবেই একটি কবিতা হয়। তাও নিটোল কবিতা নয়। নিটোল কবিতা এখনও একটিও লেখা হয়নি পৃথিবীতে। হয়তো কখনো হবে।

সরি অমুদা। জয়িতা আবার বলল, বাংলোর রিজার্ভেশান পাওয়া গেল না। এ-যাত্রা থাকা হবে না, দলমাতে। আপনি ধূমকেতুর মতো এলেন আর চলেও যাবেন। এত শর্ট নোটিশ-এ হয় না। তা ছাড়া, পরপর ছুটি পড়েছে তো। আমরা এমনিই পাহাড়চুড়োয় গিয়ে পিকনিক করব।

তাতেই আমি খুশি।

অমু বলল।

তারপর বলল, আমি তো ধূমকেতুই! তবে ক্ষতিকারক নই। এইটুকুই তফাত।

ছবি বলল, কখনো আগে জানিয়ে এলে…

আগে আমি নিজেই জানতে পাই না। মনের মধ্যের মন কখন যে, কোনদিকে আমাকে টানে, তা জানতে পেলে তো গবুর মতো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট-ই হতাম। ওহহ! তোমাদের সঙ্গে ওর আলাপ-ই করিয়ে দেওয়া হয়নি। আমার পিসতুতো ভাই। লতায়-পাতায়।

আছে। আছে। টেলকো এবং টিনপ্লেটের সবাই সবাইকে চেনে। মানে, বিশেষ করে নীলডিতে যাঁরা থাকেন। মালু বলল। তারপর বলল, পিসতুতো ভাই থাকতে, আপনি ক্লাবে বন্দোবস্ত করতে বললেন যে! আমাদের কারো বাড়িতে তো থাকলেন-ই না!

পিসতুতো ভাই থাকলেও থাকতাম না। কোনো পরিবারের মধ্যে থাকলে স্বাধীনতার অনেকখানিই জমা দিতে হয়। আর স্বাধীন হতেই তো আসা!

একে তো চিনলাম না।

অমু বলল।

ছবি বলল, চেনবার জন্যই তো নিয়ে এলাম। খুব ভালো গান গায়।

রবীন্দ্রসংগীত। ওর নাম মোমা।

আমি আপনাকে চিঠি লিখেছিলাম। আপনার শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ে। আপনি জবাবও দিয়েছিলেন।

মোমা বলল, অমুকে।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে। খুব সুন্দর চিঠি লেখো তুমি। আমার কবিতার চেয়েও ভালো।

ছবি বলল, আপনি গান ভালোবাসেন তাই আমি জোর করেই ধরে আনলাম ওকে। গান শোনাবে। লজ্জা পাচ্ছিল আসতে।

শোনাও।

শোনাব? বলেই, মোমা গান শুরু করল।

অবাক লাগল অমুর। খালি গলায় এককথাতেই গান শুরু করার মতো মেয়ে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ল না। মেয়েদের যত লজ্জা সব গানের বেলাতেই। গানটি আগে শুনেছে বলেও মনে পড়ল না। চমৎকার গলা। খুঁতহীন গায়কি–

সময় কারো যে নাই, ওরা চলে দলে দলে
গান হায় ডুবে যায় কোন কোলাহলে।।
পাষাণে রচিছে কত কীর্তি ওরা সবে বিপুল গরবে,
যায় আর বাঁশি-পানে চায় হাসিছলে।।
বিশ্বের কাজের মাঝে জানি আমি জানি,
তুমি শোনো মোর গানখানি।।
আঁধার মথন করি যবে লও তুলি গ্রহতারাগুলি
শোনো যে নীরবে তব নীলাম্বর তলে।।

বাঃ। কার কাছে শেখো তুমি?

বাড়িতেই শিখি। আমার মাস্টারমশাইয়ের কাছে।

তাঁকে আমার নমস্কার দিয়ে। আর তোমাকেও ধন্যবাদ গান বাছার জন্যে। এই শীতের সকালে যদি, তুমি হঠাৎ কোনো বর্ষার গান গেয়ে বসতে তবে তোমার গলা আর গায়কির কোনো দাম-ই থাকত না। রবীন্দ্রসংগীতে গান ‘নির্বাচন’ও শিক্ষার মধ্যে পড়ে। তাইনা?

মোমা মাথা নাড়ল।

গবু বলল, আমিই অমুদার একমাত্র আত্মীয় জামশেদপুরে। এখানে এসেছে, লোকমুখে শুনেছিলুম। কিন্তু আসার সঙ্গে সঙ্গেই, আপনারা আমার দাদাকে এমন-ই গায়েব করে দিলেন গুপ্তধনের মতো যে, তাকে খুঁজে বের করতেই আমার পাঁচদিন লেগে গেল।

ওরা সকলে হেসে উঠল।

অমু বলল, এমন আত্মীয়কে তোর অস্বীকার-ই করা উচিত। আসলে কী জানিস? যারা আত্মার কাছে থাকে তারাই হল প্রকৃত আত্মীয়। তোর সঙ্গে রক্তসূত্রের আত্মীয়তা। প্রত্যেক মানুষ কচুরিপানার মতো জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে যাদের সঙ্গে, জড়াজড়ি করে থাকে তারাই হয়ে যায় আত্মীয়। আর রক্তর আত্মীয়রা দূরে সরে যায়। এটাই নিয়ম।

আমরা ওঁকে গায়েব করিনি। উনিই গুণ করেছেন আমাদের।

ছবি বলল, পুরোনো কথার জের টেনে।

এই পোড়াকাঠে যে, এমন অসীম ক্ষমতা রাখে আমাদের অমুদা, তা তো আগে জানা ছিল না।

গবু বলল।

অমু হেসে বলল, না দেখলে তো বিশ্বাস করতিস না। তোদের পাড়ার অনুরাধাকে মনে আছে? তাকে নিয়ে কলেজস্ট্রিটের কফিহাউসে কী দামামাই না, বাজত ছেলেদের বুকে বুকে! অনুরাধাকে নিয়ে কলেজের দিনগুলোতে কত কবিতাই লিখেছিলাম। আর সে, বড়োলোকের সুন্দরী মেয়ে বলে আমাকে বিয়ে তো করলই না এমনকী কোনোরকম পাত্তাই দিল না। আজ সে, থাকলে এই কবির মান-সম্মান-দাপট দেখে কেমন আঙুল কামড়াত বল?

সকলেই অমুর কথায় হেসে উঠল।

গবুও কথায় কম যায় না। বলল, তোমাকে বিয়ে করেনি বলে অনুরাধা হয়তো আঙুল কামড়াত কিন্তু তোমাকে বিয়ে করেও তো আমার রানিবউদি কম আঙুল কামড়াচ্ছে না। সে খবর তো আমরা রাখি।

হো হো করে হেসে উঠল অমু। এবং অন্য সকলেও।

অমুর হাসিটা শুধুই হাসি ছিল, না, তাতে কান্নাও মিশেছিল, তা ঠিক বোঝা গেল না।

ছবি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়েছিল অমুর মুখে।

ভালো বলেছিস। অমু বলল। বেচারি রানি। ওর কপালটাই মন্দ। নইলে এমন ছন্নছাড়া কবিকে কেউ ভুলেও বিয়ে করে?

ছন্নছাড়া তো ছিলে না? নিজেই হয়েছ। দুঃখ সেটাই।

অমু লজ্জা পেল অতলোকের সামনে কথাটা গবু বলাতে!

বলল, আর্থিক অবস্থার হের-ফের তো হয়-ই! আজ যে, ছন্নছাড়া, কাল সে আমির, আজ যে আমির, কাল সে ছন্নছাড়া। গবুরে, গবেট; আমার দেবী যে, লক্ষ্মী নন, তিনি যে, সরস্বতী। তাঁর মুখ চেয়েই সব সয়ে নিয়েছি। তা ছাড়া ছন্নছাড়ার সুখের রকমটাও তো নিজচোখেই দেখে গেলি তুই।

গবু বলল, এবার চলো উঠি। বউ তো তৈরি হয়ে বসে থাকবে। আমার বাড়িতে একদিন যাবে তো, নাকি? নইলে আমার বউয়ের কাছে কিন্তু বেইজ্জত হয়ে যাব। ইতিমধ্যেই বলেছে, এত বড়োকবি! উনি তোমার ভাই না ছাই।

বড়োকবি যে, তা জানল কী করে?

বাঃ। বড়ো বড়ো অক্ষরে বিজ্ঞাপনে তোমার নাম বেরোয় যে।

তবে তো নির্ঘাত বড়োকবি! ঠিকই ধরেছে। তা নিশ্চয়ই যাব। কী যেন, নাম তোর বউয়ের? জ্যোৎস্না, না?

থাক। নামটা তাও মনে রেখেছ, এ-কথা শুনলে জ্যোৎস্না খুশি হবে।

এখানে অনেক জ্যোৎস্না আছে।

জয়িতা বলল।

থাকবেই। চাঁদ থাকলেই জ্যোৎস্না থাকবে। এবং অনেক-ই থাকবে। আশ্চর্য হওয়ার তো কিছু নেই।

মালু বলল।

তা চাঁদটা কোথায়?

গবু বলল। অমুদাকে যদি আপনারা চাঁদ বলেন, বলতে হবে আপনাদের চোখের গোলমাল আছে।

শ্ৰমণা বলল, চাঁদ দেখার চোখ সকলের থাকে না। কবিতাও কি সবাই বোঝে? বিশেষ করে আধুনিক কবিতা?

গবুও হিসেবরক্ষক। সহজে ছাড়বার পাত্র মোটেই নয়। সে বলল, কবিতার রস আমিও এক-আধবার চিপে খেয়ে দেখেছি। সেটি সুপানীয়ের মধ্যে আদৌ পড়ে না। বাসকপাতার রসের মতো লাগে অনেকটা। আধুনিক কবিতা পাগল ছাড়া কেউ লেখে না। পাগল ছাড়া কেউ পড়ে না। তবে এ-কথা অবশ্য স্বীকার করব যে, কবির রস কোনোদিনও খেয়ে দেখিনি। তাও আমার এই দাদাটির মতো পোড়া-কাঠ কবির। চেলাকাঠের রস কেমন-ই বা হতে পারে? চিরতা-টিরতার মতোই হবে।

বাঃ। কে বলবে যে, তুই অ্যাকাউন্টেন্ট। তোর তো বেশ রসবোধ আছে রে গবু।

না থাকার কী? রসের একচেটিয়া ইজারা তো টিনপ্লেট কোম্পানি বা জামশেদজি টাটা তোমাকেই একমাত্র দিয়ে যাননি।

গবুর কথায় সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।

তারিখটা কবে? মানে আমার বাড়িতে খাওয়ার তারিখটা? এখুনি ফাইনাল করো। গবু উঠে দাঁড়িয়ে আঙুলে গাড়ির চাবি ঘঘারাতে ঘোরাতে বলল।

সেটা সম্বন্ধে তুই ছবি আর জয়িতার সঙ্গে কথা বলে নে। আমার লোকাল গার্জেন হল ছবি। কিছুটা জয়িতাও। ওরাই বলতে পারবে ব্রেকফাস্ট অথবা আফটারনুন–টি অথবা লাঞ্চ, ডিনার কোন সময়ে আমি ফ্রি! আমি এখানে ভি-ভি-আই-পি। কতজন এ. ডি. সি. দেখছিস না?

তাহলে আপনারাই বলুন। একটু আহতস্বরেই বলল গবু। আমার কিন্তু সত্যিই দেরি হয়ে। যাচ্ছে। আমার স্ত্রীকে এবারে গিয়ে, না নিয়ে এলেই নয়। তারপর অমুদাকে নিয়ে যাব।

কোথায় নিয়ে যাবেন ওঁকে?

মাঠে। ‘ফাদার্স ভার্সাস সানস’ ক্রিকেট ম্যাচে।

সে তো আমরাও যাব। এখনও তো দেরি আছে।

তা আছে। কিন্তু ভেবেছিলাম, দাদাকে একটু টেলকোর টাউনশিপটা দেখাতে নিয়ে যাব।

দেখাবেন কাকে? সেদিন রাতে নির্জনে ডিনার খাওয়ার জন্যে ‘হাডকো’ লেক-এ নিয়ে গেছিলাম আমরা অনেকে মিলে। অমুদা বলেছিলেন, বেশ ফাঁকা জায়গায় জঙ্গলে বসে একটু গল্প করবেন। আমাদের স্বামীদের সঙ্গে একটু গা-গরম করে নিয়ে তারপর ওই হ্রদের পাশেই ডিনার।

ছবি বলল।

তারপর?

তারপর আর কী? আমাদের সকলের তো বটেই, পুরো টেলকোর-ই ইজ্জত উনি মাটি করে দিলেন।

কেন?

বললেন কী জানেন?

ছবি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,

কী?

বললেন, এ কী হিতু! তুমি কিনা শেষে, এই শীতের রাতে একটি কমোডের পাশে নিয়ে এলে আমাকে তোমাদের বিউটি-স্পট হ্রদ দেখাবে বলে! আর এ, কীরকম জঙ্গল। চার-পাঁচ গাছা গাছ লাগানো শুধু।

ওঁর কথা শুনে আমরা সকলে হেসে বাঁচি না। দুঃখও হল। আমাদের হাড়কো’র এমন অসম্মান কেউই করেননি আগে।

গবু বলল, আপনারা বউদি, মেনে নিলেন কেন অমুদার কথা? যা-তা বললেই হল! একবার দিনের বেলা গিয়ে দ্যাখো তো! ক-পাত্র চড়িয়ে ছিলে হাডকো’ দেখার আগে সেটা বল?

ছবি ও অন্যান্যরা গবুর কথা বলার ধরনে একটু যেন, ব্যথিত হল। মনে হল ভাবটা যেন, ভাই হতে পারেন; কিন্তু গুণীর সম্মান দিতে জানেন না।

এবারও অমু কিন্তু জোরে হেসে উঠল। বলল, গুণে মদ যারা খায়, তারা তোর মতো অ্যাকাউন্টেন্ট। কবি নয়।

গবু হেসে উঠল। তারপর পা বাড়িয়ে বলল, আমি তাহলে এগোই।

জয়িতা বলল, হ্যাঁ। ওখানেই দেখা হবে। ওঁকে আমরাই নিয়ে যাব।

গবু, যাব বলেও গেল না। এতজন সুন্দরীর সঙ্গ ছেড়ে কার-ই বা যেতে ইচ্ছে করে?

না। তোমাদের সঙ্গেও আমি যাব না। তোমরা সবসময় এমন খাতিরের চাপে রেখেছ এই অনভ্যস্ত আমাকে যে, আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। সত্যি বলছি। আমি একটু একলা থাকি। একটু হাঁটি বরং গল্ফ লিঙ্কস-এ। তোমরা বরং যাও এখন।

বাঃ। আপনি যাবেন কী করে? চিনবেন কী করে? তা ছাড়া এখানে তো ট্যাক্সি পাবেন না!

শ্রেয়া বলল।

ছবি বলল, তাহলে আপনাকে দুর্বার আর তোড়াই নিয়ে যাবে। যদিও একটু দূরে থাকে ওরা। তবে ক্লাব থেকেই ফোনে বলে দিচ্ছি। ওরা খুশিই হবে।

না। না। কাউকেই নিয়ে যেতে হবে না। আমার এক বন্ধু আসবে একটু পরে। তাকেই বলব খেলার মাঠে নামিয়ে দিতে।

কে বন্ধু?

সালদানা।

কে? মি. সালদানা? তিনি তো আমাদের বস।

চেনো নাকি তুমি?

গবু বলল, উত্তেজিতগলায়। এবারে সত্যিই চলে যেতে হবে।

নিশ্চয়ই চিনি। সালদানা খুব ভালো কবিতা লিখত একসময়। একটি কবিতার প্রথম লাইন এখনও মনে আছে আমায় ‘ওয়াহ, কিন্না আচ্ছা মাওসম হোগা?

আমি কেটে পড়ি মানে মানে। পাঞ্জাবি কবিতা আর বাঙালি কবিতার মাঝে পড়ে প্রাণটা যাক তা, আমি চাই না।

গবু বলল।

কিন্তু কতটা যে, কবিতার ভয়ে আর কতটা যে, সালদানার ভয়ে ও কেটে পড়ল, তা ঠিক বোঝা গেল না।

গবু চলে গেল।

সত্যিই আসবেন সালদানা সাহেব?

ছবি শুধোল।

হ্যাঁ। তাই তো বলেছিল।

তবে আমরা সকলে যাই। আপনি তাহলে ওঁর সঙ্গেই চলে আসবেন। দেরি করবেন না কিন্তু। খেলা কিন্তু শুরু হবে আধঘণ্টা পৌনে একঘণ্টার মধ্যেই। জয়িতা বলল।

প্রথমে গিয়ে হবেটা কী? খেলা জমুক।

বাঃ। সালদানা সাহেব নিজেও তো খেলবেন।

অমু বলল, তাহলে বোধ হয় ও টেইল অ্যাণ্ড-এ ব্যাটিং করবে।

মালু বলল, টস-এ কারা জিতবে আর কারা ব্যাটিং করবে তা জানবেন কী করে?

আরে বাবাদের আর ছেলেদের মধ্যেই তো ম্যাচ। আসলে তো রোদ পোয়ানো। তার আবার অত!

অমু বলল।

তা অবশ্য ঠিক।

ছবি বলল।

তোমরা কেউ কিন্তু সালদানাকে বোলো না আমার কথা।

অমু বলল।

উৎসুক গলায় জ্যোৎস্না শুধোল। কেন?

কারণ আছে।

কী কারণ?

আমি যেদিন চলে যাব, সেদিন বলব।

কীসব হেঁয়ালি করেন, মানে বুঝি না।

ছবি বলল, অনুরাগ আর অনুযোগ মিশিয়ে।

বুঝবে।

আমরা তাহলে সকলেই যাচ্ছি। আপনি দেরি করবেন না কিন্তু।

না। বলে, অমু উঠে দাঁড়াল। এবং ওদের প্রত্যেককেই গাড়ি অবধি এগিয়ে দিল। ওদের গাড়িগুলো লাল কাঁকরে ঝড় তুলে চলে যেতেই অমু ফিরে এসে চেয়ারে বসল। ভাবল, একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলল বোধ হয়। সালদানা সাহেব যে, ওদের বস, সে শুনেছে কাল হিতুর-ইমুখে। কোনোদিনও চেহারাও দেখেনি। আফটার অল ছোট্টজায়গা। বড়োসাহেবকে নিয়ে মিথ্যাচারটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতেও পারে। তা ছাড়া এখন ম্যানেজ-ই বা করবে কী করে? দোষ অবশ্য পুরোটাই অগ্নিশিখার। সে বলেছিল, ঠিক দশটাতে আসবে। আসেনি। আজকে সকলে যে, অমুকে মাঠে নিয়ে যাবে এ-কথা জেনেশুনেও আসেনি। এই অবিবেচনা। শুধুমাত্র অগ্নিশিখার-ই জন্যে সকলকে, সকলের আন্তরিক উষ্ণতাকে সরিয়ে দিয়ে একা হতে হল। এখন যদি না আসে তবে। এই বয়েসে কারো আসার অপেক্ষায় মেট্রো বা লাইট হাউস বা ন্যাশনাল লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে থাকাও পোষায় না।

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই অগ্নিশিখার ছোট্টগাড়িটা ঢুকল ক্লাবের গেটে। গাড়ি-টাড়ি বিশেষ চেনে না অমু। তবে মারুতি চেনে।

অগ্নিশিখা অগ্নিশিখার-ই মতো কমলা পাড়ের শাড়ি পরেছে একটি। শাড়ি-ফাড়ি চেনে না অমু। ও কাছে এলে, দেখল একটি ব্লাউজ পরেছে যে, তার রংও গাঢ় কমলা। দূর থেকে কবুতরের পায়ের মতো গোলাপি বলে ভুল হয়েছিল। চওড়া বারান্দাটা যেন, ঝলমল করে উঠল। অগ্নিশিখার সদ্যস্নাতা সুগন্ধি ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে দিল হাজার হাজার অসময়ের শেফালি ফুল।

অমু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোমার জন্যে অনেকগুলো মিথ্যে বলতে হল অনেককেই।

কাকে কাকে?

কৌতুকের চোখে চেয়ে বলল তোড়া।

অমু লক্ষ করল যে, চোখে কাজল দিয়েছে অগ্নিশিখা। তাতে তার রূপ অপ্রতিরোধ্য হয়েছে আরও।

ছবিকে, জয়িতাকে, মালুকে এবং আমার পিসতুতো ভাই গবুকে এবং আরও অনেককেই।

ওঃ। ভারি তো! মিথ্যে বলার আর এক নাম-ই তো কবিতা। সব কবিরাই মিথ্যেবাদী। ঠিক আছে।

একটু চুপ করে থেকে বলল, মিথ্যে তো আমিও বলে এলাম আমার স্বামীকে। দুর্বার ওয়াজ আ লিটল সাসপিসাস।

রিয়্যালি? হাউ ডাজ ইট ম্যাটার? অ্যাট লিস্ট, নট টু মি!

কিছু মিথ্যা বলা ও সামান্য মিথ্যাচার করা বেঁচে থাকবার জন্যেই জরুরি প্রয়োজন। ন্যূনতম প্রয়োজন। কিছু সত্যি বলতে গিয়ে, যে-অশান্তি ও ঝামেলার ঝড় ওঠে তা, অ্যাভয়েড করাই ভালো।

অমু বলল।

তা ঠিক। তবে এখন ভাবছি, মিথ্যেটা বললাম কেন? বড়ো কোনো পাওয়া, গভীর কোনো সুখের কারণে মিথ্যাচারী হলেও, না-হয় বুঝতাম। আপনার সঙ্গে একটু গল্প করব তার জন্যেই মিথ্যাচারী হতে হল। এইটেই দুঃখের। আমি যদি স্বাবলম্বী হতাম তাহলে নিজেকে এরকম ‘বাঁদি-বাঁদি’ মনে হত না। নিজস্ব সম্বলহীন নারীর কাছে বিয়েটা নিছক-ই একটা এগ্রিমেন্ট নয়; এক ধরনের দাসত্বই।

আমার সঙ্গে গল্প করার সুখবরটা যে, বড়ো কিংবা গভীর নয়, তোমার কাছে এবং আমার কাছেও, তা নিশ্চিতভাবে জানলে কী করে?

তা অবশ্য জানিনি। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে খুবই ভালোবাসে। বিশ্বাসও করে। তাই ছটো লাগে ‘মিথ্যে বলতে। অথচ বিশ্বাস যে-করে, এই বিশ্বাসটা পুরোনো গৃহভৃত্যকে বিশ্বাস করার-ই মতো। যার কাছে আলমারির চাবি, বাড়িঘর সব নিশ্চিন্ত হয়ে ছেড়ে দিয়ে বেরুনো যায়, কারণ সে, কখনো চুরি করবে না যে, এ-কথা জানা আছে। এটা কি বিশ্বাস? বিশ্বাসের মধ্যে তো একধরনের শ্রদ্ধাও মিশ্রিত থাকে। থাকা উচিত অন্তত। এতদিন ভাবতাম, ওর এই বিশ্বাসের শ্রদ্ধাও আছে। আপনি আসার পর দেখছি যে, তা ঠিক নয়। ও, আমাকে স্বাধীনতা দিয়ে দেখছে আমি কী করি তা নিয়ে। পোষাপাখির শিকল খুলে যেমন, মালিক নতুন করে নিশ্চিন্ত হতে চায়, সে দাঁড়ে ফিরে আসে কি না?

ছোটো লাগলে, মিথ্যে বলা উচিত হয়নি। তোমার ফিরে যাওয়াই উচিত।

ফিরে যাব মানে? আমি কি আপনার সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছি? ঘর ছেড়ে?

আমার সঙ্গে পালাবার মতো দুর্মতি যেন, কোনো নারীর-ই না হয়। যে, নিজেই পালাতে পারেনি তার নিজের পরিবেশ, জীবনের ছোট্টপরিসর, তার ধূলিমলিন নৈমিত্তিক নিত্যতার দানা আর জল-ছড়ানো খাঁচা থেকে, তার সঙ্গে পালানোটা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু তুমি মিথ্যে বলে আমার কাছে এলেই বা কেন? আমারও ছোটো লাগছে নিজেকে।

ভাবছি। এখনও নিজেই ঠিক জানি না। জানেন অমুদা, যে-বয়েসে কারো সঙ্গে প্রেমে পড়াটা স্বাভাবিক, সে-বয়েসে প্রেম করার সুযোগ আসেনি। তাই প্রেম জিনিসটা যে, কেমন তা জানতে ভারি ইচ্ছে করে। যে-এস্কিমো ‘সূর্য কখনোই দেখেনি সে, সূর্যের দেশে এসে শেষ বিকেলের সূর্যও হয়তো দেখতে চায়।

প্রেম তো কোনো জিনিস নয়, অগ্নিশিখা। প্রেম এক ধরনের শূন্যতা, যা শুধুই পূর্ণতার আশাটুকু বয়ে নিয়ে আসে। যাকে হাত দিয়ে ছোঁওয়া যায় না, ঠোঁট দিয়ে চুমু খাওয়া যায় না, যাকে মুঠোর মধ্যে ধরা যায় না, তার নাম-ই প্রেম। আকাশের দিকে চেয়ে দ্যাখো। মনে হবে আকাশ নীল। কিন্তু আকাশের সত্যিই তো কোনো রং নেই। মহাশূন্যকেই নীল বলে মনে হয়। তাই-না?

আপনি খুব সুন্দর কথা বলেন। কখনো-কখনো। তেমন কোনো মানুষ পেলে বলতে পারি। এ-কথা আগেও বলেছি। এমন মানুষ, যাকে এসব বলা যায়। সকলকে সব কথা বলা যায় না। বলা উচিত নয়।

আপনি কেন আমাকেই বেছে নিলেন? আমার তোড়া নামকে ছুঁড়ে ফেলে নিজের নামে কেন ডাকলেন? ভারি বিপদে ফেললেন আপনি আমাকে। আমার যে, কেবল-ই ‘অগ্নিশিখা হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে এখন। আপনার দেওয়া নামকে সার্থক করে তোলার জন্যে। দেদীপ্যমান হয়ে ওঠার এক তীব্র বাসনা লক্ষ করছি আমি আমার ভেতরে। আমার সমস্ত শরীর-মনে। নাম বদলে দিলে যে, একজন মানুষও বদলে যায়, তা আমি নিজে এমন করে না, জানলে বিশ্বাসই করতাম না। আমার শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনে, যা আদৌ দাহ্য ছিল না, তাতে হঠাৎ-ই অগ্নিশিখা থেকে ছড়িয়ে-যাওয়া আগুন লেগে গেছে অমুদা। আমি কী করি এখন?

একটু চুপ করে থেকে অগ্নিশিখা বলল, গায়ে আগুন লাগলে মেয়েরা কেন মরে আর ছেলেরা কেন বেঁচে যায় বলুন তো? জানেন আপনি?

না। কেন?

অবাক হয়ে বলল অমু।

মেয়েরা তাদের শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ খুলে ফেলতে পারে না। সংস্কারের বশেই। আর পারে না বলেই, তাদের সারাশরীরে থার্ড-ডিগ্রি বার্ন ছড়িয়ে যায়। প্রেমও একরকমের আগুন। একধরনের অগ্নিশিখা। যা আপনার কাছে নিছক-ই এক খেলা, তাই আমার কাছে মরণ।

যে-প্রেম, মরণ’-এর কথা মনে করায়, তাকে আগুন-লাগা জামাকাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলাই উচিত।

উচিত তো অনেক কিছুই। কিন্তু জীবনে সব উচিতকর্ম তো করা যায় না, করা হয়ে ওঠে না।

তুমি কি দাঁড়িয়েই কথা বলবে?

আপনাকে দেখছি। একটু ভালো করে দেখি। এখুনি আবার কেউ এসে পড়বে। অন্য কোনো নারী। মেয়েরা ভীষণ ঈর্ষাকাতর হয়। মেয়েরা মেয়েদের চোখের ভাষা যেমন করে পড়তে পারে, তা আপনাদের ধারণাই নেই।

কী দেখছ?

দেখছি যে, মানুষের কলম থেকে এমন কবিতা বেরোয়, যে-মানুষ গুছি ভরে বছরের পর বছর সাজিয়ে তোলা তোড়াকে প্রথম দেখাতেই বিস্রস্ত করে দিয়ে, আচম্বিতে অগ্নিশিখা করে তুলতে পারেন তাঁর বহিরঙ্গের আড়ালে কে আছেন? তাঁকে দেখা যায় কি না? চেনা যায় কি না; তাই দেখছি। আপনার নাম হওয়া উচিত ছিল, স্ফুলিঙ্গ।

কবির মধ্যের কবিকে কখনো দেখতে যেয়ো না, চিনতে যেয়ো না অশি। শঙ্খচূড় সাপের গর্ততে হাত দিতে নেই। কিছু দেখা ও চেনার আছে, এ-সংসারে যা, হৃদয় দিয়ে শুধুমাত্র বোধ দিয়েই ছোঁওয়া যায়। ছোঁওয়া উচিত। দূর থেকেই। তাই কোরো।

আপনি কেন এলেন এখানে?

বুঝতে পারছি যে, অনেক-ই কারণে আসাটা আমার অন্যায় হয়েছে। এখন বুঝতে পারছি। এবারে তো এসে পড়েইছি। এটুকু কথা দিতে পারি যে, আর কখনোই আসব না। ভবিষ্যতে আমি কারোর-ই অসুবিধার কারণ হতে চাই না। কারোর-ই না।

তোড়া অমুর সামনের চেয়ারে বসে পড়ে অসহায় হতাশ গলায় বলল, সত্যিই আর আসবেন না?

হয়তো।

তবে এবারেই-বা এলেন কেন? আমার জন্যেই কি আসবেন না আর? দোষী শুধু আমিই?

জানি না, কেন এলাম! জামশেদপুর হঠাৎ আমাকে ডাক দিল। হয়তো তোমার কুর্চিবনের হাতছানি, সোনাঝুরির ‘ঝুরু ঝুরু’; মনটা হঠাৎ-ই বড়ো উচাটন হয়েছিল।

কার জন্যে?

বিশেষ কারো জন্যেই নয়। কখনো-কখনো এমন হয়। অশরীরী আত্মা যেমন করে প্ল্যানচেটে আসে, হঠাৎ আসে। এসে নানা কথা বলে আবার হঠাৎ-ই চলে যায় তেমন-ই, অশরীরী কোনো বোধ, কোন বিশেষ জায়গায় আমাকে ধাওয়া করিয়ে নিয়ে যায়। প্ল্যানচেটের আত্মারই মতো। তার কাজ শুধু ‘পৌঁছেই দেওয়া। তারপর ফিরে যেতে হয় শূন্যমনে, আশাভঙ্গতার গাঢ় ভারী বোধ বুকের মধ্যে নিয়ে। এমন বহুবার-ই হয়েছে আমার। নিজের মনের অশান্তি, ক্ষুন্নিবৃত্তির সামান্যতা-মাপা নিত্য অসম্মান, জীবনযাত্রার গ্লানি, দারিদ্রর কষ্ট, এইসব ভোলবার জন্যে দৌড়ে এসেছি বারে বারে কোথাও-না-কোথাও। নিজের শূন্যতাকে পূর্ণ করবার আশা নিয়ে। অথচ যখন-ই ফিরতি ট্রেনে উঠেছি তখন-ই আবিষ্কার করেছি যে, আমি দীনতর, রক্তাক্ত; জানো, অশি, সুখকে এবং প্রেমকেও প্রেম সুখের-ই এক বিশেষ রকম বলেই বোধ হয়, দৌড়োদৌড়ি করে পাওয়া যায় না কখনোই। ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’র মত স্থির হয়ে বসে থাকলেই সুখ বা প্রেম সব-ই ভোরের পাখির মতো ছটফট করতে করতে তোমার কাছে এসে, পায়ের কাছে বসে। কোলে মুখ ঘষে। শীতের সকালের রোদের মতো স্নিগ্ধ উষ্ণতায় ভরে দেয়, হৃদয়-মনের সব খানা-খন্দ, শীত; যেমন, আমাকে দিয়েছে ভরে এই মুহূর্তে। হয়তো দিয়েছে তোমাকেও। এইমুহূর্তে তোমার মুখোমুখি বসে আছি আমি। প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ হয়ে। আমরা দুজনে ইচ্ছে করলেই আমার ঘরে গিয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে পারি। এমনকী দু-জনেরই আপত্তি না থাকলে চরম আদরও করতে পারি একে অন্যকে। কিন্তু হয়তো সহজে পারি জেনেই, নিজেদের দুজনকেই অনেক কষ্ট দিয়েও তা, না করতে পারাটাই বোধ হয় প্রেম’। তোমাকে ভালো লাগার সবটুকু আনন্দ, তোমাকে যতটুকু কাছে পেয়েছি, তার চেয়ে আরও বেশি কাছে না-পাওয়ার সাধনার-ই মধ্যে। এই-ই প্রেম। অশি, আমার প্রেম, তোমার প্রেম, সকলের প্রেম।

আপনি না এলেই পারতেন অমুদা। দেখুন। আমার সারাশরীর কাঁপছে, এই ঝাউবনের মতো থরথর করে। এইমুহূর্তে আমি এমনকিছু করে ফেলতে পারি, দিয়ে দিতে পারি আপনাকে এক্ষুনি যা, কখনো কাউকে দিতে পারার স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্নও আমি দেখিনি। কোনোদিনও দেখিনি।

তোমার ভয় নেই?

আমার নেই। আপনার আছে?

তোড়া দেখল, এই আপাত অসুন্দর মানুষটার মধ্যে কোথায় যেন, এক গভীর সৌন্দর্য লুকোনো আছে। মাঝে মাঝেই ঝিলিক তোলে তা; বুঝিয়ে দেয়, কেন এত ভালোবাসে মানুষটাকে।

কিছুক্ষণ চুপ করে তোড়ার মুখে চেয়ে থেমে অমু বলল, ভয় নিশ্চয়ই আছে। তবে নিজেকে নয়। তুমি যা আমাকে দিয়েছ আজ সকালে, সেদিন চাঁদের রাতে, নির্জনপথে হাঁটতে হাঁটতে, তার অমর্যাদা যাতে, না-হয় সেই ভাবনাটুকুই ভয়। পাছে তুমি, আমি চলে যাওয়ার পর, একবারও ভাব যে, মানুষটা আমাকে ঠকিয়েই গেল, আমার মুহূর্তের দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে গেল। আমার সেই ভয়। পেছনের দরজা দিয়ে, যে-চোর ঢোকে কোনো নারীর মনের বা শরীরের ঘরে, বা সিঁদ কেটে, সে বুক ফুলিয়ে সামনের দরজা ভেঙে ঢোকা ডাকাতের সম্মান কোনোদিনও পায় না। তোমাকে ভেঙে তোমার একটি টুকরো নিয়ে লোভী কুকুরের মতো পালানোকে আমি ভালোবাসা’ বলি না। সন্ধ্যাতারার মতো, যতদিন বাঁচব, ততদিন দূর থেকে তোমার দিকে এই সুন্দর পৃথিবীর সব স্নিগ্ধতা নিয়ে চেয়ে থাকব। মনে মনে বলব, অগ্নিশিখা ভালো থেকো। তোমার শরীরের সঙ্গে আমার শরীর জড়িয়ে রেখে যতটুকু শুভার্থী হওয়া যায় তোমার, আমি তার চেয়ে তোমার অনেক-ই বড়ো শুভার্থী। আজ বুঝবে না। একদিন বুঝবে। কোনোদিন।

জানেন, ওর কথা মনে পড়ছে খুব-ই। মানে, দুর্বারের কথা। তোড়া বলল। আমি যদি আজ সকালের নির্জনে ওকে মিথ্যে কথা বলে আপনার কাছে, মনে মনেও কিছু প্রত্যাশা করে এসে থাকি, তাও কি অন্যায় নয়, চুক্তিভঙ্গতা নয়?

চারধারে চেয়ে দ্যাখো। আমার মুখে চেয়ে দ্যাখো। এখানে কোনো ঘাতক নেই। বিশ্বাস অথবা শ্লীলতা অথবা ন্যায় সবকিছুই অম্লান অটুট থাকবে এই সকালে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। শুধু তোমার কেন, কোনো মানুষের ঘর ভাঙার-ই ইচ্ছা নেই আমার। তেমন শিক্ষাও নেই। তোমারও নেই। তুমি নিজেকে পুরোপুরি না জেনেই মিথ্যে ভয় পাচ্ছ! আমি অন্যকে ভাঙতে শিখিনি শিশুকাল থেকেই। নিজেকে কী করে ভাঙে, তা নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছি। চিরদিন-ই অন্ধকারকে ভাঙতে গিয়ে ভুল করে আলোই ভেঙেছি বার বার।

কিন্তু আমি তো চাই! আমি জানি, আমি চাই। আমি জানি কেন…

আমিও চাই। হয়তো তোমার চেয়ে অনেক-ই বেশি তীব্রতার সঙ্গে চাই। যা-চাই, যা-পেতে পারি, তা নিই না বলেই, তুমি আমাকে এক ধরনের ভালোবাসা বেসেছ। এবং জানি, আমি চলে যাওয়ার পর আরও বেশি করে বাসবে। তোমার নির্জন অবসরের মুহূর্তগুলির অনেকখানিই ভরে থাকব আমি। থাকবে আমার ভাবনা, আমি জানি। আমার কবিতার বইও। মোমার মতো ভালো গাইতে জানলে তোমায় গানও শুনিয়ে যেতাম। না থেকেও, থেকে যেতে পারতাম তোমার এবং তোমাদের কাছে। আমার গানের মধ্যেও।

ভাগ্যিস জানেন না গান!

কেন? ভাগ্যিস কেন?

জানলে, আপনি না থাকলে, হয়তো অনেক বেশি দুঃখ পেতাম আপনার গান শুনে।

এতই খারাপ গাইতাম? তাই বলছ?

কৌতুকের হাসি হেসে বলল অমু।

অগ্নিশিখাও হেসে ফেলল। অথচ ওর দু-চোখে জল।

বলল, সবসময় ইয়ার্কি করলে ভালো লাগে না।

কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়। দেখি দেখি, মুখ ঘুরিয়ো না, আমার দিকে তাকাও। তোমাকে ভালো করে দেখি একটু। তুমি একটি রিয়্যাল পাগলি।

দুর্বার। বেশ নামটি তোমার স্বামীর। মানুষটিও চমৎকার। স্বগতোক্তির মতো বলল অমু। স্বভাবটির মধ্যেও, ওর নামের সার্থকতা আছে। ওর মুখের মধ্যে চাপা একধরনের নিষ্ঠুরতাও আছে। কখনো কি তা প্রকাশ পায়?

চুপ করে রইল অগ্নিশিখা।

তারপর বলল, দুর্বারের প্রসঙ্গ আসছে কেন? আপনার স্ত্রীর নাম তো রানি! শুনেছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে, একটি সন্তান হয়েছে বলেই কি আমার এবং আপনার জীবন শুধুমাত্র দুর্বার এবং রানিময়ই হতে হবে? ওই বৃত্তর বাইরেও কি, কোনো অস্তিত্ব নেই আমাদের? থাকতে পারে-না?

সাধারণত থাকে না। থাকে না, কারণ এই ‘বৃত্ত’ বিশ্বাসের জন্যে যতটা নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি কারণ এই বৃত্তর বাইরে পা ফেলার সময়, মানসিকতা বা সাহস আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষের-ই থাকে। সকালে দাঁতমাজা বা বিকেলে চা খাওয়ার-ই মতো এই বৃত্তর নাগপাশের অভ্যেস অজানিতে আমাদের পিষ্ট করে ফেলে। কেউ কেউ বাইরে এসে দাঁড়ায়ও কিছুক্ষণ। কোমর ভেঙে যাওয়া সরীসৃপের মতো মাথা তোলে, ল্যাজ দোলায়; কিন্তু চলচ্ছক্তিহীন। পরক্ষণেই ল্যাজে জ্বলন্ত-তারাবাজি বেঁধে দেওয়া কুকুর-কুকুরির-ই মতো ভয়ে দিশেহারা হয়ে পুরোনো, ব্যবহৃত, মলিন বৃত্তর সহজ সুখের নিরাপত্তার ঘেরের মধ্যে তারা সবাই দৌড়ে যায়। স্বাধীনতা ও মুক্তির তাপ সকলের সহ্য হয় না, তা যতই সাময়িক হোক না-কেন। দৌড়ে যদি ফিরতেই হবে তবে বৃত্তর মধ্যেই সহজ সুখ ও নিরুপদ্রব শান্তির দানা খুঁটে খাওয়া, রমণ-সুখী পোষা-কবুতরের মতো নিজের নিজের বৃত্তর মধ্যেই বকবকম করে ঘাড়ের রেশমি পালক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোই ভালো। সকলকেই যে, বৃত্তর বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে তার মানেই বা কী? দাসপ্রথা থেকে, ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানি থেকে আজকের মহান ভারতীয় গণতন্ত্রে এসব-ই তো চুক্তির-ই জিনিস। প্রকৃতার্থে বিদ্রোহী হয়েছে বা হতে পেরেছে ক-জন? বল?

আপনার মতো বাজেকবি দেখিনি। আপনি কি প্রেমের ওপর থিসিস তৈরি করছেন? আমার সামান্য প্রশ্নটাকে বড়োই ঘোলা করে দিলেন আপনি।

তা নয়। বলেইছি তো। এতসব কথা যতখানি তোমাকে শোনাবার জন্যে বললাম, তার চেয়ে অনেক-ই বেশি বলছি নিজেকেই শোনাবার জন্যে। আমার মনের গভীরে অনেক-ই প্রশ্ন আছে। বার বার প্রশ্ন করে নিজেই তার উত্তর দিয়ে প্রাঞ্জলভাবে বোঝার চেষ্টা করি নিজেকেই। ভাবনার গভীরে ‘ডুব’ দিয়ে দেখি, তা মনোমতো হল কি না!

আপনি কি ডুবুরি?

কবিরা তো ডুবুরিই। দিন-রাত, মাস-বছর মনের গভীর অতলান্তে আমাদের স্কুবা ডাইভিং। যখন কোনো কবিকে দ্যাখো, একা বসে সিগারেট খাচ্ছেন তখন, ভেবো-না যে, তিনি আলস্যর প্রতিমূর্তি। গঞ্জনা দিয়ো না তাঁকে, যেমন তাঁর পরিবারের অনেকেই দেন। তাঁর ভেতরে নিরন্তর ভাঙা-গড়ার, ডুব-দেওয়া, চিত-হওয়ার নানারকম অনামা প্রক্রিয়া চলেছেই। কবিদের মতো কঠোর পরিশ্রমী, ওভারটাইম-না-পাওয়া, শ্রমিক-আইনের দায়বদ্ধতাহীন এবং সবরকম প্রাপ্তিহীন শ্রমিক খুব কমই আছেন। কবিরা এদেশে উপহাসের ই পাত্র। কিন্তু কবিদের সবচেয়ে বড়ো উপহাস তাদের নিজেদের প্রতি। তাই তাঁরা কবি।

এতসব বড়ো বড়ো কথা বুঝি না।

বোঝো ঠিক-ই। শুনলে ভয় করে বলে বুঝতে চাও না। নিজের জন্যে ভয়, দুর্বারের জন্যে ভয়, নিজের ছেলের জন্যে ভয়। এবং হয়তো কবিদের ভবিষ্যৎ-এর জন্যেও ভয়। তাও বুঝি।

ওসব কিছু নয়। আমার সময় নেই। আমি আপনার কাছে এসেছি। আপনার-ই কাছে। কবিদের তরফে আপনার দীর্ঘবক্তৃতা শুনতে নয়। তা ছাড়া আর এক্ষুনি ফিরেও যেতে হবে। ওকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে বাড়ি যাব। আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে বলেছে। তারপর ছেলেকে নিয়ে খেলার মাঠে। সময় বড়োকম।

সত্যিই সময় বড়োকম। সকলের-ই। সকালে ছবি, মোমাকে নিয়ে-এসেছিল। সে গাইল রবীন্দ্রনাথের একটি গান। সময় কারো যে নাই। আগে শুনিনি। চমৎকার লাগল। তারপর একটু চুপ করে থেকে অমু বলল, যদি তাড়া থাকে তো যাও।

আর একটু বসি।

কেন? বসবে কেন? তাড়া থাকলে যাও।

আপনাকে ভালো লাগে বলে বসব।

তবে বোসো।

একটা কবিতা শোনাবেন? এখানে কিছু লেখেননি? ভেবেছিলাম, আপনি আর আমি চুপ করে বসে থাকব একটু। কিন্তু এতকথা হল।

দোষ আমার নয়। সকালে এলে না কেন? কত মানুষ যে, এল সকাল থেকে।

লেখেননি কিছু?

না। বাইরে এলে আমি এক লাইনও লিখতে পারি না। তবে কাল রাতে একটি পদ্য লিখেছি।

পদ্য তো কবিতাই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেন।

শক্তি ঠাট্টা করে বলেন। নীরেনদা, শঙ্খদা, সুনীল, শক্তি ওঁরা সত্যিকারের বডোেমাপের কবি। ওইসব ঠাট্টা ওঁদের মুখে মানিয়েও যায়। কিন্তু অমু ঘোষের পদ্য নিছক পদ্যই।

তবু, শোনান-না।

না। আমার পদ্য শোনাব না। কবিতা যখন লেখা শেষ হয় তখন, তাকে খুন করে মর্গে এনে রাখতে হয়। তারপর কাটা-ছেঁড়া, শব-ব্যবচ্ছেদ করে তার জিয়নকাঠি মরণকাঠির হদিশ করে কবির নিজস্ব মন্ত্রবলে কবি প্রাণ দেন আবার সেই কবিতাকে। তারপর-ই তা পড়াবার বা ছাপাবার যোগ্য হয়ে ওঠে।

তবু শোনান। দুই-জীবনের মধ্যবর্তী মর্গের কবিতাই।

তুমি আজ আদৌ কবির অনুরাগিণীর মতো কথা বলছ না। শোনাচ্ছি তোমাকে, তবে আমার কবিতা নয়। লালা মিয়ার শায়েরি থেকে।

তিনি কে?

তিনি কে, তা আমিও জানি না। তবে বইটি পেয়েছিলাম কলেজস্ট্রিটে। কবিতা অবশ্য একে বলে না। তবে আমার পড়তে ভালো লাগে। বলার কথাগুলির সঙ্গে আমার না-বলা কথার খুব মিল আছে বলে। একটু বোসো। ঘর থেকে আনি।

অমু ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর ঝোলাঝুলি হাতড়ে বইটা বের করে পেছন ফিরতেই দেখে অগ্নিশিখা। ঘরের মধ্যে! আগুন! আগুন!

মুখে সে কিছুই বলল না। কোনো কোনো ব্যাপারে মেয়েরা আদৌ মুখর নয়। কিন্তু ওর দু চোখ ভরতি কথা ছিল।

অমু তাকে হাতে ধরে নিয়ে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড় করাল। অগ্নিশিখার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।

বলল, গলা টিপে মারবেন বুঝি?

কথা না বলে অমু অগ্নিশিখার দুটি হাত নিজের দু-টি হাতে নিল। তারপর বলল, চোখ বোজো।

অগ্নিশিখা সমর্পণ করল নিজেকে সমস্ত সম্পূর্ণতায়। কবির কাছে। না, না। কবি নয়; কবিতার কাছে। অমু প্রথমে তার কণ্ঠায়, গলায়, কানের লতিতে এবং তারপর তার দু-চোখে বার বার কিন্তু ধীরস্থির হয়ে চুমু খেল। শেষ চুমু খেল তার স্তনসন্ধিতে। বুকে-মাখা অচেনা পাউডারের গন্ধে, ভুলে যাওয়া পারফিউমের গন্ধে, চুলের তেলের মিষ্টি ভেজা-ভেজা গন্ধের আবেশে অমুর যেন, ঘুম এসে গেল।

অগ্নিশিখার শরীর শিথিল হয়ে যাচ্ছিল। দেওয়ালে ভর দিয়ে সে, শক্ত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়েছিল আস্তে আস্তে। অমু তাকে কোমরের কাছে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে একটি তীব্রগভীর চকিত চুমু খেল তার ঠোঁটে। হঠাৎ কালবৈশাখীর মতো উথাল-পাতাল করে উঠল বড়ো বড়ো নিশ্বাসে তার বুক। পরক্ষণেই দু-হাতে জোরে অমুকে জড়িয়ে ধরল। অমু অগ্নিশিখার উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার সময় দিল। থরথরানি থেমে এল। যেন, বৃষ্টি থামল কাঠটগরের বনে।

অমু বলল, অস্ফুটস্বরে; অগ্নিশিখা!

তোড়া কাঁদছিল।

অমু বলল, চলো, বাইরে গিয়ে বসি।

না। আমি বাইরে যাব না।

অগ্নিশিখা বলল, গাঢ়, নীচু স্বরে। তারপর বলল, পাজি, অসভ্য!

বলেই, দু-হাতের নরম হালকা মুঠি দিয়ে অমুর বুকে করাঘাত করতে লাগল অবিরত। জোরে জোরে।

অমু অগ্নিশিখাকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। অগ্নিশিখার হাত দু-টি থেমে গেল। পরমসোহাগে সে, তার মুখ রাখল অমুর বুকে। অমুর সমস্ত শরীরে একটা বনবেড়াল দাপাদাপি করছিল। পুরুষের কষ্টের রকমটা অন্য। তা বলে, তাদের কষ্টও কিছু কম নয়। কোনো মেয়েই এ-কথাটা বুঝল না কোনোদিন।

অমু বলল, ফিসফিসে গলায়, তুমি ছেলেমানুষ হতে পারো। আমি নই অশি। লক্ষ্মী মেয়ে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

বলেই, দরজা খুলে বারান্দায় এল। দরজা খুলে দেখল, সেই মহিলা বসে আছেন। সে রাতে আলাপ হয়েছিল পার্টিতে। কী যেন, নাম মহিলার। ভুলে গেছে। মিসেস কী যেন, মুখটি মনে আছে, কারণ, ভোলা মুশকিল বলে। আগ্রাসী।

কতক্ষণ?

অমু বলল।

এই একটু আগে।

বলেই বন্ধ দরজার মধ্যে দিয়ে তাঁর এক্স-রে আই দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ভেতরে কি, কেউ আছে?

হ্যাঁ।

কে?

একজন…

মহিলা?

হ্যাঁ।

কী করছেন আপনার ঘরে?

ভদ্রমহিলার স্ক্যাণ্ডালাস গলায় তীব্র রাগ ও বিতৃষ্ণা ঝরে পড়ল।

অমু বলল, কবিতার বই খুঁজছেন।

কবিতার বই? খাটের তলায়? না, খাটের ওপরে?

এই মহিলাকে অমুর প্রথম দর্শনেই ভালো লাগেনি। ওঁর স্বামী জামশেদপুরের (নীলডির নন) মস্ত একজন কেউকেটা লোক। ব্যবসায়ীও হতে পারেন। ঠিক মনে নেই। সচরাচর লক্ষ্মী আর সরস্বতী সহাবস্থান করেন না কোনোখানেই। এখানেও করেননি। মহিলা মস্ত বড়োগাড়ি চড়েন, দামি শাড়ি পরেন, দেখতে অনেকেরই চোখে সুন্দরী। বাড়িতে ডেকে একদিন চাইনিজ খাওয়াবেন অমু এবং অমুর খাতিরে অন্যান্য অনেককে। সেদিন বলছিলেন। সুতরাং, একজন গরিব বাঙালি কবি তাঁকেই সবচেয়ে বেশি পাত্তা দেবেন, এ-বিষয়ে তাঁর নিজের কোনোই সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তোড়াকে কবির সঙ্গে একঘরে আবিষ্কার করাতে তাঁর মেজাজের তখন ঠিক ছিল না।

দরজাটা আস্তে খুলে তোড়া ঘর থেকে বেরোল। ওর শাড়ি বিস্রস্ত, চোখের কাজল লেপটে গেছে। চোখে জল।

উনি তীক্ষ্ণ মেয়েলি চোখে তোড়ার দিকে তাকালেন।

অমু বলল, কই? বই কই?

বোকার মতো তাকাল অগ্নিশিখা! হাতে-নাতে ধরা পড়া বামাল চোরের মতো।

অমু বলল, সেন্টার-টেবিলে রেখে এসেছি। নিয়ে এসো।

মহিলা বললেন, আই থিঙ্ক ইউ নিড আ ওয়াশ টু ব্যাডলি। মুখ-চোখ ধুয়েই আসুন।

তোড়া ঘরে ঢুকে যেতেই মহিলা বললেন, তোড়া-না?

অমু মাথা হেলাল।

শকুনের চোখে সব-ই ধরা পড়ে।

তোড়া বইটা দিয়ে গেল আর একবার এসে। উনি যে, এই অবস্থায় ওকে দেখে গেলেন তার ফলটা ঠিক কীরকম দাঁড়াবে পুরো নীলডি অঞ্চলে, তা বেশ বুঝতে পারছিল তোড়া। বুক ফেটে কান্না আসছিল ওর। ওই পাজি লোকটা!

কবি! অথচ তেমন কিছু ঘটল না। না, কিছুই না। যদি বুঝত যে… দুর্নাম তো সমান-ই হবে।

শুনুন। একটা কবিতা পড়ি।

অমু বলল।

কার লেখা?

লালা মিয়া।

তিনি আবার কে?

মুরশিদাবাদের লালগোলায় বকরির ব্যবসা আছে। কিন্তু পদ্যও লেখেন।

ট্র্যাশ। আমার ‘সময়’ নেই সময় নষ্ট করবার। বড়োকবিদের কোনো কবিতা শোনালে শুনতে পারি। নিদেনপক্ষে আপনার। কিন্তু ঘরে যে, কবিতাটি লিখলেন সেটি সম্বন্ধে কিছু বলুন।

ঘরে কবিতা?

হ্যাঁ। তোড়া তোড়া ফুল দিয়ে…

অমু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, আমার ধারণা ছিল, আপনি কবিতা সত্যিই বোঝেন। এখন দেখছি তরজাই আপনার বিষয়। বা কবিয়ালদের লড়াই।

আই ফিল ইনসালটেড। ওমলেটে বেশি লঙ্কা দিয়ে দেওয়াতে তোড়া বেচারির পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল। ঝালে চিৎকার করতে করতে লাফাচ্ছিল। তাই…।

অমু স্বগতোক্তির মতো সাফাই গাইল।

আই সি। ঝাল খেলে লাফানোই তো স্বাভাবিক।

পদ্যটি কি শুনবেন? সম্ভবত আপনাকে নিয়েই লেখা।

আমাকে নিয়ে মানে?

ভদ্রমহিলা নড়েচড়ে বসলেন।

মানে, লালা মিয়ার কবিতা পড়ে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

পড়ন তাহলে।

এক সেকেণ্ড, অশি, মানে তোড়া আসুক।

তোড়ার নাম অশি নাকি?

না না। তোড়ার নাম অশি হতে যাবে কেন?

মুখ ফসকে?

হ্যাঁ। মুখ ফসকে।

তোড়া এল। মুখের দাগ ধুয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু মুখের ভাব একটুও ধুতে পারেনি।

শুনুন। অমু বলল, শোনেনা তোড়া—

সদ্য আলাপ হল সেদিন
প্রথম চাওয়ায় লাগল ভালো
ম্যায়ফিলেতে অনেক হুরিকিন্তু তুমি একাই আলো।

মানে? কার কথা বলছেন। অমুবাবু আপনি?

আমি কিছুই বলছি না। লালা মিয়া বলছেন।

আই সি। ক্যারি অন প্লিজ।

করিয়ে দিল, এক সে সুজন
মিয়ার সঙ্গে আলাপ তোমার
ভাবেনি সে, বার এক তরেও
মিলবে দু-চোখ হঠাৎ দোঁহার
মিয়ার ইয়ার অনেক-ই দোষ।
মধ্যে তাহার প্রধান এটাই

খুদ জানে না, দুঃখ সেটাই।
শুরু হল ফিসফিসানি
পুটুর-পুটুর ফুলল পেট
হাসলো মিয়া আপন মনেই
নিন্দুকেদের ভেজল ভেট।
এই দুনিয়ায় হঠাৎ যদি,
কাউকে কারো লাগেই ভালো
দেরি না সয়, নারীজাতির
ঠিকরে বেরোয় মনের কালো।
তাইতো আজ-ই বলছে মিয়া
ভয় পেয়ো-না প্রিয় গো মোর
বাসোই ভালো অথবা পাও
দুনিয়া ঠিক-ই তুলবে শোর।
ভালোবাসার সয় না আওয়াজ
শব্দ বিনাই মুকুল ফোটে
মুকুল ফোটে, মুকুল ঝরে
মহক-এ তার বোলতা জোটে।
বোলতা ছিল পয়লা দিনে
আখরি দিনেও থাকবে জেনো।
কথা শোনো নতুন প্রিয়া
গন্ধে মাতো; মুকুল চেনো।

তোড়া চুপ করে চেয়েছিল অমুর মুখের দিকে।

মহিলা বললেন, এটা কি কবিতা হয়েছে নাকি? এ তো অন্ত্যমিল। নো-ওয়াণ্ডার ওই মিয়ার বকরির ব্যবসা।

অমু হেসে বলল, অমন করে বলবেন না। টিভি সিরিয়াল ‘তামস’ নিয়ে সারাদেশে নানা মুনির, নানা মত চলছে এখন। লালা মিয়াকে পাঁঠা বললে দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে জামশেদপুরে। আর জামেশদপুর তো রাওটপ্রোন এলাকাও।

তাহলে পাঁঠাকে পাঁঠা, বলব না?

এরইমধ্যে তোড়া বলল, আমি চলি অমুদা। চলি।

অমু কথা না বাড়িয়ে বলল, যাওয়া নেই। এসো।

বলেই বলল, আমার পিসিমা বলতেন। এমন সুন্দর কথা তো দেশ থেকে উঠেই যাচ্ছে বলতে গেলে। কী বলেন?

অমু এখন একটু নার্ভাস ফিল করছে। নিজের জন্যে নয়। তোড়ার জন্যে। এই মহিলা। সারাশহরে কী না, বলে বেড়াবেন কে জানে!

অগ্নিশিখার সুন্দর কোমল কমলাভ পাপড়িগুলোকে যেন, কোনো প্রমত্ত বাতাস দলে দিয়ে গেছে। অথচ বাতাস আদৌ প্রমত্ত ছিল না। ফুল যখন, দলিত-মথিত হতে চায় তখন, তার নিজের ভেতরেই একটি স্বয়ংক্রিয় মিশ্রণ যন্ত্র কাজ করে নিঃশব্দে। মন্থন যা-হওয়ার, তা এক তরফের অভ্যন্তরীণ কক্ষে কক্ষেই ঘটে যায়। বিশেষ করে মেয়েদের শরীরে, মনে। পুরুষ নিমিত্তমাত্র।

বেচারি তোড়া!

.

পার্ক করানো গাড়ির দিকে আস্তে আস্তে হেঁটে যাওয়া তোড়ার দিকে একবার চেয়ে অমুর বুকের মধ্যে কেমন যেন, করে উঠল। ও বুঝতে পারছে যে, সেই সর্বনাশা বোধের শিকার হতে চলেছে সে, আবারও। বহুদিন পরে। ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘকে ভয় পায়। সমুদ্রের নোনা খোলা হাওয়ায় দূরাগত সাইক্লোনের গন্ধ পাচ্ছে অমু। হাওয়ার সঙ্গে কথা বলছে ঢেউ। তিমি মাছ জলের রং গভীরতর করে জলরেখার কান অবধি উঠে নিশ্বাস নিচ্ছে ফোয়ারা তুলে। বুকের মধ্যে মবিডিক’ আবার জাগছে। বিপদ। খুব বিপদ! এই বিপদ যে, কী ‘সামান্যতা দিয়ে শুরু হয়, তা ভালোই জানে অমু। তাই এক বারান্দা রোদের মধ্যে বসেও ওর শীত করতে লাগল।

প্রেমের মতো অসুখ আর কিছু নেই।

অমুর মা বলতেন প্রায়-ই, তাঁর মৃত্যুর আগে আগে, আমার কানের মধ্যে কী যেন-’শি শি’ শব্দ হয়। কে যেন, বাঁশি বাজায়। জানিস খোকন। এবারে যম ডাকছে। যেতে হবে।

অমুকেও প্রেম ডাকছে। স্পষ্ট শুনেছে তার আওয়াজ। জিম করবেট-এর ‘বনশি’-র ডাক। এবারে মরতে হবে। সমুদ্র ফুঁসছে ভেতরে।

তোড়ার গাড়িটা চলে গেল। অমু মনে মনে বলল, সাবধানে যেয়ে তোড়া। ভালো থেকো।

আমার হাজব্যাণ্ড পাঁচদিনের জন্যে ব্যাংকক যাচ্ছেন। ওড়িশার বর্ডারে আমাদের একটা ছোট্ট কান্ট্রি-হাউস আছে। আপনি কি যেতে পারবেন আমার সঙ্গে? তিনটে দিন। শান্তি, পাখির ডাক, জঙ্গল, বেস্ট অফ ড্রিঙ্কস অ্যাণ্ড ফুডস। সফট বাট ফার্ম বেডস। ইলেকট্রিসিটি নেই। উই উইল হ্যাভ ক্যাণ্ডেললাইট ডিনার। এভরি নাইট।

অমু চোখ ছোটো করে তাকাল মহিলার দিকে। ভাবল কিছুক্ষণ। এরকম প্রস্তাব কলকাতাতেও বহু বহুবার পেয়েছে। তখন শরীর প্রবল ছিল। কাম আর প্রেম যে, আলাদা তা বুঝত না। মুখে কিছু বলল না অমু। কিন্তু তোড়াকে বাঁচাতে হবে। প্রয়োজন হলে নিজে মরেও। ভাবল অমু, জীবনের-ই মতো, মরণেরও ক-রকম হয়! কিন্তু না বলে, চুপ করেই রইল।

উনি ব্যাপারটাকে আরও স্থূল করে বললেন, এবারে। দু-হাত নেড়ে। ইউ ননা! হোয়াট আই মিন? অ্যাপার্ট ফ্রম দ্যাট, পোলট্রি আছে, ডেয়ারি ফার্ম আছে।

আপনার কান্ট্রি-হাউসে কোনো ষাঁড় আছে? ষাঁড়!

হোয়াট আফুল ল্যাঙ্গোয়েজ।

হোয়াট ইজ আ ষাঁড়?

স্টাড-বুল। ফর ব্রিডিং।

না তো। তবে গোরু আছে দুটো। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন? ভেরি সিলি? যাইহোক, আমি ঠিক চারটের সময় এসে আপনাকে তুলে নিয়ে যাব।

কিডন্যাপ করবেন বলছেন?

অলমোস্ট। আই গিভ আ ড্যাম বাই হোয়াট নেম ইউ কল ইট। সো লং উই মেক ইট।

পরক্ষণেই বললেন, আই ফিল সসা হ্যাপি বাট ইট! কেউই বলতে পারে না, আপনি কান্ট্রি-হাউসে তিনটে দিন আমার সঙ্গে থাকলে আমিও কোনোদিন ‘টিরিং-এ অমু ঘোষ’ বলে কোনো বই লিখতে পারব না।

না। তা অবশ্য কেউই বলতে পারে না। তবে মৈত্রেয়ী দেবীর একটি বহুপঠিত ভালো বই যদি আপনার অনুপ্রেরণা হয় তবে বলব সে, অনুপ্রাণিত কর্তব্য আপনার না করাই ভালো। অমু গম্ভীরগলায় বলল।

তারপর বলল, যদি লেখেনও, টিরিং-এ অমু ঘোষ’ কোনো প্রকাশক ছাপবেন না। এবং এককপিও বিক্রি হবে না।

ছাপব আমি নিজে। আর বিক্রি করার দরকার কী? প্রেজেন্ট করব। যাচ্ছেন তো তাহলে?

কেন যাব-না? এমন অফার কেউ ছাড়ে? খাওয়া-দাওয়া, আপনার সঙ্গ; কম্পানি।

উৎফুল্ল হয়ে উনি বললেন, তাহলে আমি উঠি। এখুনি গিয়েই একটি গাড়ি পাঠাতে হবে সব বন্দোবস্ত করবার জন্যে টিরিং-এ।

টিরিং! ভারি মজার নাম তো!

পঞ্চাশোর্ধ্ব মেমসাহেব চোখ দুটি গোল করে বিলোল ভাব হয়েছে ভেবে নিয়ে বললেন, তিড়িং-বিড়িং করার জায়গা হিসেবে ‘টিরিং’ নামটা তো ভালোই। একেবারে বিহার আর ওড়িশার বর্ডারে। একধারে গেলে বাদামপাহাড়, রায়রাঙ্গপুর অন্যদিকে বড়োবিল, বড়োজামদা, রাউরকেল্লা। নট আ সোওল টু ডিস্টার্ব আস দেয়ার। উ-উ-উ-উ ভাবলেও আমার…

এবার চলুন। আমাকে একটু খেলার মাঠে নামিয়ে দেবেন?

হঠাৎ রসভঙ্গ করে বলল অমু।

নিশ্চয়ই। কিন্তু তার আগে চলুন-না, আপনার ঘরটা একটু দেখে আসি আর ইউ। কম্ফর্টেবল হিয়ার?

ফাইন।

চলুন। অমু কথা কেটে বলল।

আপনি তোড়াকে নিয়ে ঘরে কী করছিলেন? প্লিজ, এক্সকিউজ মাই আস্কিং দিস।

সত্যজিৎ রায়ের একটি ছোটোদের বই বেরিয়েছে কিছুদিন আগে। নাম ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম। জানেন কি? ঘোড়ার ডিম বাঁধছিলাম তোড়া করে। তোড়াকে নিয়ে।

হাউ নটি!

বলেই, উনি মুখে ব্রীড়াভঙ্গি ফোঁটাবার জন্যে এমন-ই এক ভাব করলেন যে, অমুর দেখে মনে হল তার দিদিশাশুড়ি কটকের গুড়াখু দিয়ে দাঁত মাজছেন। পারেনও কিছু মহিলা! সত্যি! অসীম তাঁদের ক্ষমতা, জীবনের সমস্তক্ষেত্রেই। এইরকম স্বভাবের সব বর্ষিয়সী মহিলাদের স্বামীদের নিয়ে থিসিস করতে আসবে বলেছিল ডেরিক গবসন। মিজৌরি থেকে। এল না। আসা উচিত ছিল।

উর্দিপরা সোফার গাড়ির দরজা খুলে দিল। উনি ঘন হয়ে বসলেন বিরাট গাড়িতে অমুর পাশে।

অমু বলল, বাই এনি চান্স মি. সালদানাকে কি চেনেন?

চিনি বই কী! আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ তো আছেই। আমার সঙ্গেও আছে। তবে বোঝেন তো, ওঁরা বড়ো বড়ো সাহেব। ওঁদের দয়াতেই আমার স্বামীর ব্যবসাপত্তর; তাই দূরে দূরেই থাকি।

আমার জন্যে একটি কাজ করতে পারবেন?

মোটে একটা? বলুন কী কাজ?

মাঠে নেমেই মি. সালদানার সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেবেন।

নো প্রবলেম। অমু ভাবল, যদি মি. সালদানা এখন ফিল্ডিং বা ব্যাটিং করেন তাহলেই চিত্তির হবে।

সামান্যই পথ। একটু গিয়েই গাড়ি পৌঁছোল মাঠে। শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। বাবা মায়েরা একদিকে আছেন। অন্যদিকে, ছেলে-মেয়েরা বসে। মায়েরা ছেলেদের-ই সাপোর্টার।

গাড়ি থেকে নেমেই ভদ্রমহিলা দৌড়ে গেলেন। অমু ইচ্ছে করে খুঁড়িয়ে খুব-ই আস্তে হাঁটতে লাগল। যাতে মিস্টার সালদানার সঙ্গে আলাপটা সকলের সামনেই না, করতে হয়। তা হলেই তো সকালের বলা ডাহা মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাবে। মিথ্যেটা না বললেই পারত। অগ্নিশিখার জন্যেই বলতে হল। ভবিষ্যতে অগ্নিশিখার জন্যে, আরও অনেক মিথ্যে বলতে হবে। বুঝতে পারছিল ও। মিথ্যের ওই দোষ। একটা বললে তা ঢাকতে আরও দশটা বলতে হয়।

মি. সালদানা হাসিখুশি স্মার্ট ভদ্রলোক। বয়স পঞ্চাশ কী তারও কম হবে। উনি ওই মহিলার সঙ্গে অমুর দিকে এগিয়ে আসতেই সকলকে দেখিয়ে হাত তুলে হাই! বলল, অমু মি. সালদানাকে। সকলেই যাতে জানে যে, যেমন ও বলেছিল, তেমন-ই উনি, ওর পুরোনো বন্ধুই।

কবি-সাহিত্যিক-গায়ক-বাদকের খাতির সর্বত্র। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে। মি. সালদানা অমুর পরিচয় জেনে খাতির করে নিয়ে গিয়ে বসালেন। অন্য অনেকেই পরিচিতদের মতোই এগিয়ে এলেন। নিজেদের জায়গা ছেড়ে উঠে এলেন সবাই ওর কাছে। হীতু, ছবির স্বামী বিয়ার এনে দিল।

অমু বেশ ‘অ্যাট হোম’ হয়ে যেতেই একটু ফাঁকা পেয়েই ও মহিলাকে ডেকে বলল আপনি না বললেন, ওদিকের বন্দোবস্ত করতে যাবেন? ঘিড়িং-এর?

খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহিলার মুখ। বললেন, ঘিড়িং নয়, টিরিং।

হীতু বলল, এই মহিলাকে কোথায় পেলেন? ওঁর সঙ্গেই তো এলেন দেখছি। সালদানা সাহেব তো আপনাকে চিনতে পারলেন না! যখন বললাম আপনার কথা।

চেনেন যে, তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই এখন তোমাদের। ও বরাবরই ওইরকম ভুলোমনা। ছেলেবেলা থেকেই। সব-ই ভুলে যায়। আর এখন তো অনেক-ই দায়দায়িত্ব। এমনিতে পুরোনো সহপাঠীদের কী সকলেই মনে রাখতে পারে? মুখ দেখলেই তখন ফ্ল্যাশব্যাক হয়। তাই-না?

তা ঠিক। হীতু বলল একেবারেই ঠিক বলেছেন! অমুকে বিশ্বাস করে। তা ছাড়া সালদানা সাহেবকে না চিনলে, অমুর মিথ্যে বলবার কোনো সংগত কারণও খুঁজে পেল না। অমু মিথ্যে বলবেই-বা কেন?

‘ফাদার্স ভার্সাস সানস’-এর ক্রিকেট ম্যাচের আম্পায়ারিং দেখে অমুর মাথা ঘুরে গেল। এই ভদ্রলোককে, পাকিস্তানে যখন ইণ্ডিয়া খেলতে যায় তখন, আম্পায়ার করে পাঠালে মন্দ হয় না। ছেলেদের ফিল্ডিং। কিন্তু একটা আউটও আম্পায়ার দিচ্ছেন না। কিছুতেই না। পরিষ্কার এল-বি-ডাব্লু, পরিষ্কার ক্যাচ। কিন্তু হলে কী হয়? সজোরে উনি মাথা, এ পাশ-ওপাশ করে যাচ্ছেন যত আপিল-ই প্রায় কাঁদো কাঁদো ছেলেরা করুক-না-কেন। আম্পায়ারের হাতে বিয়ারের বোতল। আর জবাবে ‘নো। লজ্জা, মান এবং ভয় এই তিনের-ই মাথা চিবিয়ে না খেলে, এরকম দোর্দন্ডপ্রতাপ আম্পায়ার হওয়া যায় না।

খোঁজ নিয়ে জানল অমু। ভদ্রলোক ‘টেলকো হাসপাতালের ডাক্তার। মেডিসিনের নাম্বার ওয়ান। ডা. তাপস সরকার তাঁর নাম। খেলা আর কী দেখবে! খেলা ছেড়ে অমু মনোযোগ দিয়ে আম্পায়ারিং দেখতে লাগল। খেলা তো বহুজায়গাতেই দেখা যায়, এমন আম্পায়ারিং দেখার সুযোগ তো রোজ আসবে না।

তোড়া আর দুর্বার এতক্ষণে এল। তোড়া কাছাকাছি আসতেই অমু বলল, চলো, একটু হাঁটি। সকাল থেকে বসে আছি এক নাগাড়ে। পা ছেড়ে যাবে। তারপর ভিড় থেকে একটু তফাত হতেই অমু বলল, তুমি একটুও ভয় পেয়ো না। ওই ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে সকলেরই ধারণা দেখলাম একইরকম। আমি সকলকে যা-বলব, তা তুমি সাপোর্ট করবে শুধু। তারপর দেখো।

কী। কী বলবেন? কাকে? ভয়ার্ত গলায় শুধোল অগ্নিশিখা।

দ্যাখোই-না, কী বলি!

লাঞ্চব্রেক-এ বিরিয়ানির প্লেট এনে দিল জয়িতা। হীতু আর দুর্বার আরও বিয়ার লাগবে কি না, তা যেচে গেল। গবু আর গবুর বউ, জ্যোৎস্না আগেই এসে কাছে বসেছিল। অন্য জ্যোৎস্নাও ছিল। পৃথা, জয়িতা। আরও অনেকে। জয়িতা তখন শুধোল, ব্যাপারটা কী? আপনি আমাদের সকলকে তাড়িয়ে ওই নোটোরিয়াস মহিলার সঙ্গে এলেন যে, বড়ো! আমাদের বুঝি ভালো লাগছে না আর? উই ফিল ইনসালটেড।

সেকথা নয়। ব্যাপার কী, তা তোড়াকেই জিজ্ঞেস করো।

তোড়ার মুখ কালো হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু পুরোপুরি কালো হওয়ার আগেই অমু বলল, ভদ্রমহিলা মহাঝামেলার সৃষ্টি করেছিলেন। ভাগ্যিস তোড়া ঠিক সেইসময়-ই আমি আছি কী, চলে গেছি তা দেখতে গেছিল বাজার সেরে।

দুর্বার অবাক হয়ে বলল, তোড়াকে; তুমি অমুদার কাছে গেছিলে? কই? বলোনি তো।

তোড়া সপ্রতিভ গলায় বলল, বলবার সময়টা দিলে কোথায় তুমি? তা ছাড়া আমি কি কিণ্ডারগার্টেনের ছাত্রী যে, সবকিছুর জন্যেই তোমার পারমিশান লাগবে?

দুর্বার, তোড়ার উত্মা দেখে অবাক হল। বলল, আঃ–

অমু এবার নতুন করে অবাক হল। প্রত্যেক মেয়েই জন্ম-অভিনেত্রী। তারা ধরা পড়ে যায় শুধু, অন্য মেয়েদের কাছে। কোনো পুরুষের সাধ্যই নেই যে, নারীর অভিনয় করে। স্বামীদের তো নয়-ই! চমৎকার।

তারপর কী হল বলুন! ছবি বলল।

হবে কী আর? ওই মহিলার অথবা আমারও কপালটাই কিছু হওয়ার মতো নয়, আর কী! উনি সবে আমার সঙ্গে একটু নিভৃতে ভালো করে আলাপ করার চেষ্টা আরম্ভ করেছিলেন আর তক্ষুনি তোড়া দরজাতে নক করল এসে। ধুক ধুক করে উঠল বুক। ভেতরে আসতে বলতেই তোড়া ভেতরে এল এবং উনি প্রচন্ড রেগে গেলেন। বাধ্য হয়েই তখন তোড়াকে চলে যেতে বললাম। বেচারি তো অপমানিত হয়ে ঝরঝর করে কেঁদেই ফেলল। দুর্বার কিছুই বোঝোনি তুমি তোড়ার মুখ-চোখ দেখে? স্ত্রীর মুখে একটুও মনোযোগ দিয়ে তাকাও-না কি? ছিঃ।

দ্যাটস রাইট। বুঝেছিলাম, অমুদা ঠিক-ই! কিন্তু ভেবেছিলাম, প্রশ্ন করলে প্রশ্নটা যদি, গোলমেলে হয়ে যায়? আমাকে বলল, বাজার থেকে এল। কিন্তু রাজেন আমার কলিগ, ফোন করেছিল আমাকে। সে বলল, তোড়াকে গোলমুড়ি ক্লাব থেকে একটু আগেই বেরোতে দেখেছে।

বাঃ এত খারাপ-না তুমি! তুমি ওমনি ভাবলে…। অমুদার কাছে গেলেই কী? আমি যখন খুশি যাব।

জয়িতা বলল, আঃ। কথাটাই ঘুরে যাচ্ছে অন্যদিকে।

প্রদ্যুম্ন বলল, আর অমুদা আমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে যা-খুশি করুন। আমাদের আপত্তি নেই বিন্দুমাত্র। আমরাই যে, প্রেমে পড়েছি অমুদার। তোমাদের আর দোষ কী? আমরা সবাই তোমাদের অথোরাইজ করলাম। শুধু দ্যাখো, যেন, অমুদা ওই মহিলার খপ্পরে না পড়েন।

আরে কথাটাই যে, ঘুরে যাচ্ছে। অমুদা, বলবেন তো!

জয়িতা এবার বিরক্ত গলায়ই বলল।

অমু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, কী আর কহিব সখী? বড়োই বিপদে পড়েছি।

কী বিপদ? খেতে খেতে সকলেই অমুকে ঘিরে ধরল।

টিরিং-এর কান্ট্রি-হাউসে তিনদিন থাকতে হবে ওঁর সঙ্গে। ক্যাণ্ডেললাইট ডিনার খেতে হবে। পাখি ডাকবে। আঃ! উই উইল হ্যাভ আ ওয়াণ্ডারফুল টাইম টুগেদার। তোমরা তো হাতের গোড়ার দলমাতেই আমাকে নিয়ে দলে-বলেও রাত কাটাতে পারলে না। এতইচ্ছে ছিল আমার। আর দ্যাখো তো! সাধা লক্ষ্মী কি পায়ে ঠেলা যায়?

সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল। নেভার। নেভার। ওই মহিলার সঙ্গে আপনাকে আমরা একমিনিটও অ্যালাও করব না। ওঁর সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?

কারো সম্বন্ধেই তো কিছু জানি না।

অমু বলল। হেসে।

কিন্তু না গেলে, উনি চটে যাবেন না-তো? চটে গিয়ে, হয়তো বেচারি তোড়াকেই এক হাত নেবেন। যেহেতু অসময়ে গেছিল আমার কাছে, তাই ওঁর রসভঙ্গ হওয়াতে রাগটা তোড়ার ওপরেই বেশি।

তোড়াকে উনি কী করবেন? তোড়াকে আমরা সবাই চিনি। আমরা সবাই আছি-না। তা ছাড়া উনি স্ক্যাণ্ডাল-মংগারিং-এর রানি। সক্কলেই সেটা জানে। এমনিতেই প্রত্যেকের নামে যা-তা বলে বেড়ান। পাঁচ পার্সেন্ট সত্যি পঁচানব্বই পার্সেন্ট মিথ্যা। এই তো মালু! তুই-ই বল?

মালু লজ্জা পেল।

বলল, যাঃ। তোমরা না…একদম ভাল্লাগেনা ওঁর প্রসঙ্গ আমার।

পৃথা বলল, মালুর ছেলের গায়ের রং কালো হয়েছে বলে, উনি তার পিতৃত্ব সম্বন্ধে নানা বাজেকথা বলে বেড়াচ্ছেন।

বুঝতে পারছি। অত্যন্তই বাজে মহিলা।

অমু বলল। কিন্তু, তাহলে আমি কী করব?

অমু অসহায়ের মতো বিরিয়ানির হাড় চিবোতে চিবোতে বলল।

আপনার কিছুই করতে হবে না।

মহিলারা সমস্বরে বললেন। আপনার মতো কবিকে উনি টার্টার সস দিয়ে খেয়ে ফেলতে পারেন এবেলা-ওবেলা।

কিন্তু উনি যে, বিকেল চারটেতে আসবেন। ক্লাব থেকে আমাকে নিয়ে যেতে। কোনো মহিলাকে এমন করে ফেরাতে নেই। ছিঃ।

আসাচ্ছি! সাড়ে চারটেতে মন্দিরার বাড়ি আপনার কড়াইশুটির কচুরির নেমন্তন্ন। দুর্বার আর তোড়া আপনাকে নিয়ে যাবে। আপনার ঘরের চাবিটা যাওয়ার সময়ে আমাদের দিয়ে যাবেন। আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকে চুপ করে বসে থাকব চার-পাঁচজন। তারপর উনি যখন, আসবেন তখন যা-করবার, যা-বলবার আমরাই বলব।

অমু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল। যাক বাবা! বাঁচা গেল।

<

Buddhadeb Guha ।। বুদ্ধদেব গুহ