বোধিসত্ত্ব একটি দু’কামরার ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন বরানগরে। প্রত্যেক দিন তিনি ভিড়ের বাসে চেপে কটন স্ট্রিটে একটি বিল্ডিং কন্ট্রাক্টরের ফার্মে হিসাবরক্ষকের কাজ করতে যান। এই কাজটি তাকে জোগাড় করে দিয়েছে বিকাশ। বোধিসত্ত্বের দুর্ধর্ষ অঙ্ক জ্ঞান দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কঠিনতম গণিতের সমস্যা তিনি কয়েক লহমায় সমাধান করে দেন।

এর জন্য অবশ্য বোধিসত্ত্বের কোনও আলাদা কৃতিত্ব নেই। তিনি সব কিছুই বলেন স্মৃতি থেকে।

ওয়েলফেয়ারের ইউনিট নাম্বার ফাইভে তিনি মাস চারেক ছিলেন। শেষে প্রায় তার কারণেই সেখানে একটি দাঙ্গা বেধে যায় এক দিন। অনাবৃষ্টির জন্য এবার বাঁকুড়ায় ফসল কিছুই হয়নি। কংসাবতী প্রজেক্টের কাজ চলছে তো চলছেই, সেখান থেকে কবে যে সেচের জল আসবে তার কোনও ঠিক নেই। এমনিতেই বাঁকুড়া খরা-পীড়িত এলাকা, এবার অতি খরায় চারদিকে হাহাকার পড়ে গেল। এর মধ্যে একমাত্র সৌভাগ্যবান ডুমুবগাছি গ্রাম। এখানে আছে ডিপ টিউবওয়েল আর দশখানি ডিজেল পাম্প। আশেপাশের গ্রামের রোদে দগ্ধ জমির মাঝখানে ডুমুরগাছি যেন একটা সবুজ দ্বীপ। এ ছাড়া ওয়েলফেয়ার-এর কেন্দ্রীয় অফিস থেকে এসেছে একশো টন গম, যা থাকবে মজুত ভাণ্ডারে। ওয়েলফেয়ার-এর পোষ্য এই গ্রামটি যেন কোনওক্রমেই আদর্শ জীনযাত্রার মান থেকে বিচ্যুতি না হয়।

ফলে ওয়েলফেয়ার ইউনিট নাম্বার ফাইভের বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ভিড় করে থাকে কাঙালিরা। তারা অন্য গ্রামের লোক। দিন দিন এদের সংখ্যা বাড়ছে। এদের সামলাবার জন্য, দৈনিক এক-একটি কনস্টেবলকে বত্রিশ টাকা ভাড়ায় বারো জন কনস্টেবলকে আনানো হয়েছিল বাঁকুড়া শহর থেকে।

হঠাৎ বোধিসত্ত্ব এক দিন স্টোরের দরজা হাট করে খুলে দিয়ে সেই কাঙালিদের ডেকে এনে বললেন, এসো, তোমরা এসো।

লোকগুলো হুড়মুড় করে ছুটে এসে বোধিসত্ত্বকে মাটিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে, লুটপাট শুরু করে দিল।

বিকাশ এসে ব্যাকুল ভাবে বলল, এ কী করলেন দাদা? আপনার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? এ-ভাবে ক’জনকে আপনি বাঁচাতে পারবেন?

বোধিসত্ত্ব আস্তে আস্তে উত্তর দিয়েছিলেন, জানি না। আমার হঠাৎ এ রকম মনে হল।

 বিকাশ বলেছিল, সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের হিসেব বানচাল হয়ে যাবে।

বোধিসত্ত্ব বলেছিলেন, আমাদের হিসেব কি সঠিক? অন্য অনেক মানুষের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে কিছু লোককে বাঁচানো?

ইউনিট নাম্বার ফাইভের স্থানীয় পরিচালক সুখেন্দু বসু এই কারণে কুমার সিংহকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হলেন। সাহেবরা কেউ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। সুতরাং বোধিসত্ত্বের হয়ে কোনও রকম আপিল করা চলল না। তার ফলে বোধিসত্ত্বের আবার নবজন্ম হল।

বোধিসত্ত্বের এখনকার অফিসটি একটি অত্যন্ত পুরনো বাড়ির ছ’তলার ওপর। এককালে যুদ্ধের সময় মাঠের মধ্যে সৈন্যদের তাবু থাকত খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে, এই বাড়িটিতেও সে-রকম ঘেঁষাঘেঁষি করে অসংখ্য অফিস। একটা ঝরঝরে লিফট চলে ঘ্যাড় ঘ্যাড় করে, তার ভেতরে যে লিফটম্যান, সে সব সময় ঝিমোয়। দেয়ালের কোণে কোণে পানের পিকের দাগ।

কুড়ি বাই পনেরো ফিটের একটি ঘরে এই অফিস, এরই মধ্যে বসে এগারো জন নারী-পুরুষ কর্মচারী। এ ছাড়া বাথরুম সাইজের একটি ঘরে বসেন মালিক। ইনি বাঙালি। কিন্তু যদিও এঁর পদবি ছিল রায়, কিন্তু কিছুকাল আগে এফিডেবিট করে সেটি রাও করে নিয়েছেন। যাতে এব অবাঙালি গ্রাহকরাও স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারে। প্রতি দিন দুপুরে বিয়ার পান করে ইনি একটি নোয়াপাতি ভুঁড়ি বানিয়েছেন এবং কথাবার্তার মাঝে মাঝে ‘আরে ভাই ইস মে কেযা হ্যায়’, এই ধরনের হিন্দি উৎপ্রেক্ষা ছিটিয়ে দেন। ইনি বিকাশের আপন মামা। জীবনে অতি সার্থক।

ঘরের এক কোণে একটি টেবিলে বোধিসত্ত্বের আসন। তার কাছে নানা রকম বিল আর ভাউচার আসে, তিনি জাবেদা খাতায় সব কিছু টুকে হিসেব বাখেন। এই ভূমিকায় তিনি একদম বেমানান। সাধারণত নিকেলের চশমা-পরা কোলকুঁজো বুড়োরাই এই ধরনের অফিস অ্যাকাউন্টান্ট হন। কিন্তু সেই তুলনায় বোধিসত্ত্ব এক জন সবল, সুপুরুষ চেহারার যুবক। অবশ্য তিনি ধুতি আর পাঞ্জাবি পরেন, যা তার বয়সের যুবকরা কেউ পবে না। পেশাদার অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সঙ্গে তার একটাই মিল আছে, তিনি কম কথা বলেন।

এগারো জনের মধ্যে দু’জন মেয়ে। এর মধ্যে এক জনের নাম মিসেস সেন। সে যেহেতু মালিকের পি.এ., তাই কেউ তার প্রথম নাম ধরে ডাকে না। এর শরীরটি বড় বিচিত্র, রোগা রোগা হাত-পা, মুখখানি অস্পষ্ট, পেনসিলে আঁকা ছবির মতো চোখ-নাক, কিন্তু এর দুই বুক আর নিতম্ব বেখাপ্পা রকমের পৃথুলা। হাঁটাচলার সময় ওই সব স্থান কাপে। মিসেস সেন বড়ই ছটফটে, বেশিক্ষণ সুস্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না চেয়ারে। ঘন ঘন মালিকের ঘরে যায়, যখন তখন একটা দেয়াল আলমারি খোলে এবং অন্য কর্মচারীদেব টেবিলের সামনে এসে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে অর্ধেক নগ্ন স্তন দেখিয়ে কথা বলে। সকলেই জানে, এই মিসেস সেন মালিকের সন্ধ্যা-সঙ্গিনী, এর মধ্যে কোনও লুকোছাপা নেই, কোনও লজ্জার ব্যাপার নেই। মিসেস সেন স্বামীহীনা, দু’টি বাচ্চা আছে। এর হাসিখুশি স্বভাবের জন্যই অফিসের অন্য কর্মীরা এর নৈতিক চরিত্র নিয়ে কোনও কটাক্ষ করে না।

বোধিসত্ত্ব মাঝে মাঝে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন এই মেয়েটির দিকে। বিকাশ আর পূর্ণিমা তাদের ভেতরকার যে-সম্পর্কটির জন্য দ্বিধাকম্পিত বা লজ্জিত ছিল, এখানে বিকাশের মামা আর মিসেস সেন সেই ব্যাপারটাই সগৌরবে চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনও গ্লানি নেই। পূর্ণিমাদির মতো মিসেস সেনকেও যদি হঠাৎ এক দিন সাপে কামড়ায়, তাহলে কি উনিও পাপের ভয় পাবেন? বোধহয় না। তাছাড়া কলকাতা শহরে কোনও সাপ নেই, এখানকার ভয়ও অন্য রকম।

অনান্য কর্মচারীদের মধ্যে কয়েক জন ড্রাফটসম্যান আর কয়েক জনের কাজ টেন্ডার ধরার জন্য দৌড়োদৌড়ি ও চিঠিপত্র লেখালেখি। এদের মধ্যে একটি আছে, তার নাম প্রীতি সান্যাল। সে আবার স্তব্ধতার প্রতিমূর্তি। দশটার সময় এসে সেই যে নিজের চেয়ারে বসে, পাঁচটার মধ্যে ওঠে মাত্র একবার, বাথরুমে যাবার জন্য। তার সঙ্গে থাকে টিফিনের কৌটো এবং লাইব্রেরির উপন্যাস। যখন কাজ থাকে না, তখন বই খুলে রাখে টেবিলের ওপর। তার পাশে যে-লোকটি বসে তার নাম ধনঞ্জয়, সে প্রায়ই আড়চোখে তাকিয়ে থাকে প্রীতি সান্যালের দিকে।

কাটা দরজা ঠেলে নামিয়ে রেখে ধনঞ্জয় বলে ওঠে, এই এসে গেছে শেখ আবদুল্লা। দে, চা দে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে বোধিসত্ত্বের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, দাদা, চা খাবেন?

বোধিসত্ত্ব সম্মতি জানালেন। এই ক’দিনেই তিনি জেনে গেছেন, এখানে একটি অলিখিত নিয়ম আছে। সারা দিনে তিনবার চা নিয়ে আসে আবদুল্লা নামের ছেলেটি। এই গোটা বাড়িটার বিভিন্ন অফিসে সে চা দেয়। এই অফিসটিতে এক জন কেউ এক-একবার সকলকে চা খাওয়ায়। প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে নিজের চায়ের দাম না দিয়ে এক-একবার এক-এক জন সকলের দাম দিয়ে দেয়। ব্যাপারটা দেখায় ভাল।

চায়ের সময় কিছুক্ষণ কর্ম-বিরতি।

ধনঞ্জন বলল, আজ অফিসে আসবার সময় যা একটা কাণ্ড দেখলাম। লেক মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি মিনিবাস ধরব বলে, হঠাৎ একটা ছেলে ছুটে বেরিয়ে এল বাজারের মধ্য থেকে, এই আমাদের শেখ আবদুল্লার বয়সিই হবে ছেলেটা, তার পেছন পেছন ধর ধর চিৎকার করে তাড়া করে এল কয়েকটা লোক। ছেলেটা চুরি করে পালাচ্ছিল নিশ্চয়ই, লোকগুলো তাকে ঠিক ধরে ফেলল। ধরতে পারত না, ফুটপাথে যে-ফলওয়ালারা বসে, তাদের মধ্যে এক জন ল্যাং মেরে ফেলে দিল ছেলেটাকে। তারপর শুরু হল মার, কত লোক যে এইটুকু একটা ছেলেকে মারার জন্য ছুটে গেল, দু’তিন জনের হাতে ইট।

মিসেস সেন বল, থাক থাক, ধনঞ্জয়বাবু আর বলবেন না! আজকাল যা তা কাণ্ড হয়! মেরে ফেলল ছেলেটাকে?

ধনঞ্জন বলল, শুনুন না, একটা মজা আছে। ছেলেটাকে বোধহয় মেরেই ফেলত। কিন্তু আমাদের লেক মার্কেট এরিয়ায় একটা বিখ্যাত ষাঁড় আছে জানেন তো? ইয়া তাগড়া চেহারা! পাহাড়ের মতো। সেই ষাঁড়টা কী বুঝল কে জানে, ক্ষেপে গিয়ে সেই ভিড়ের মধ্যে…।

কয়েক জন হেসে উঠল। ধনঞ্জন হাসতে হাসতে বলল, না দেখলে বিশ্বাস করবেন না, একটা ষাঁড় এসে ওলোট পালোট করে দিল সব কিছু। যারা ছেলেটাকে পেটাচ্ছিল, তারা হুড়মুড় করে দৌড় দিল, আর ছেলেটাও সেই ফাঁকে হাওয়া, একদম ট্রাম লাইন পেরিয়ে কালীঘাটের দিকে।

দরজার পাশের টেবিল থেকে রাজেনবাবুবললেন, ধর্মের ষাঁড় তাহলে একটা ধর্মের কাজ করেছে। ছেলেটাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ছেলেটার ভাগ্য বলতে হবে। কাগজে দেখেছেন, কারনানি ম্যানসনে একটা বাচ্চা ছেলে গাড়ির ওয়াইপার চুরি করছিল, ক’জন লোক তাকে ধরে এমন মেরেছে যে ছেলেটা মরেই গেছে, পুলিশ কেস হচ্ছে। ভেবে দেখুন, সামান্য ওয়াইপার, কতই-বাদাম, পাঁচ-সাত টাকা, সেই জন্য গাড়িব মালিকরা একটা ছেলেকে মেরেই ফেলল? প্রাণের এই তো দাম আজকাল।

রাজেনবাবুর পাশের টেবিল থেকে ছোকরা তরুণ বলল, যাই বলুন দাদা, ছিঁচকে চোরদের ওপর এক-এক সময় বড় রাগ হয়। আমাদের পাড়ার বস্তির ছেলেরা রাস্তার হাইড্রাষ্টের ঢাকনাগুলো পর্যন্ত চুরি করে নিয়ে যায়। পুরনো লোহার দরে বেচে। ভেবে দেখুন কাণ্ডটা, যদি অসাবধানে কারুর এই হাইড্রান্টে পা পড়ে যায়, আর প্রাণে বাঁচবে? আমি রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরি, প্রায়ই লোভশেভিং থাকে, হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে হাঁটতে হয়। এক দিন দেখি আমার মা নিজে একটা টর্চ নিয়ে বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। সে-দিন বাড়ি ফিরতে আমার রাত এগারোটা হয়েছিল। আমাদের সদর দরজার কাছেই রাস্তার নর্দমার ঢাকনাটা চোরে নিয়ে গেছে। ওই চোরটাকে যদি আমি ধরতে পারতাম, তাহলে তার মাথাটা তক্ষুণি ফাটিয়ে দিতাম না!

বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, কলকাতা শহরে সাপ নেই, তবু পথ চলবার বিপদ কিছু কম নয়।

অরুণের পাশে বসে দীপঙ্কর। সে সিগারেট টানতে টানতে গম্ভীর ভাবে বলল, আপনার বাড়ির পাশে বস্তি থাকে কেন, সেকথা ভেবে দেখেছেন? যে সমাজ বস্তি আর বড় বাড়ি পাশাপাশি থাকতে দেয়, সেখানে তো এ-রকম ঘটনা ঘটবেই! না খেয়ে মরার চেয়ে বরং তারা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে মার খেয়ে মরবে। সে-ও অনেক ভাল।

রাজেনবাবু বললেন, আরে মশাই, বস্তি উঠে গেলে ঝি-চাকররা থাকবে কোথায়? তারাও যদি আপনার-আমার মতো ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে, তাহলে তখন কি তারা পরের বাড়িতে এসে বাসন মাজতে চাইবে, না রাস্তার নোংরা সাফ করতে রাজি হবে?

দীপঙ্কর বলল, কেন, সোসালিস্ট দেশগুলোতে বুঝি কেউ নর্দমা পরিষ্কার করে না কিংবা রাস্তা সাফ করে না? পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে ওই সব দেশের বড় লক্ষণ। কিন্তু সেখানে কেউ বস্তিতে থাকে না।

ধনঞ্জন বলল, যাই বলল ভাই দীপঙ্কর, সকলেই যে-দেশে সমান সুযোগ পায়, সেখানে কেউ কেন স্বেচ্ছায় মেথর হতে যাবে, সে ব্যাপারটা আমি বুঝি না।

অরুণ বলল, আমাদের বস্তিটা সি.এম.ডি.এ.-এর প্ল্যানের মধ্যে পড়েছিল। বস্তি উন্নয়ন হবে, কত বড়বড় লোকজন এল। বস্তির মধ্যে পাকা রাস্তা, স্যানিটারি বাথরুম, দশটা ঘরঅন্তর-অন্তর টিউবওয়েল, কত কী শুনেছিলাম। এখন দেখি কয়েকটা ভাঙা টিউবওয়েল কাত হয়ে পড়ে আছে, এখনও বস্তির বাচ্চারা রাস্তার ওপর বসে হাগে। কন্ট্রাক্টররা সব চুরি করে মেরে দিয়েছে।

দীপঙ্কর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তারা ধরা পড়ে না, মারও খায় না।

এই যে চুঁচড়োর ও-পারে এত বড় ডাকাতিটা হয়ে গেল, ডাকাতরা সবার চোখের সামনে দিয়ে পালাল।

এ আর কী! দিল্লিতে স্টেট ব্যাঙ্ক না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে যে কয়েক মিনিটে ষাট লাখ টাকা গাপ হয়ে গেল, নাগরওয়ালা কে মনে আছে? কেউ ধরা পড়ল সে ব্যাপারে?

চ্যাঁ চ্যাঁ করে ঘন্টা বাজল মালিকের ঘর থেকে। দু’বার আওয়াজ মানে মিসেস সেনের ডাক। এক রকম জমাট আলোচনা ছেড়ে চলে যেতে হল মিসেস সেনকে। প্রীতি সান্যালের চোখ উপন্যাসের পাতায় নিবদ্ধ।

এবার দীপঙ্কর গলা নিচু করে কথা শুরু করল। মালিকের ঘটি বাতানুকূল। এ-ঘরের শব্দ ও-ঘরে যায় না। তবু মালিকের প্রতি সম্মানের জন্য এই ফিসফিসানি।

দীপঙ্কর বলল, অত দূরে যাবার দরকার কী? আমাদের এই অফিসে চুরির কারবার চলছে না? লাখ লাখ টাকা দু’নম্বরি হয়ে যাচ্ছে।

সবাই কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব। এই মৌনতা যেন সম্মতির লক্ষণ।

দীপঙ্কর আবার বলল, এই কুমারবাবুকেই জিজ্ঞেস করুন না, ওঁর তো সব জানবার কথা।

 বোধিসত্ত্ব একটু চকিত হয়ে উঠলেন। তিনি তো কিছু জানেন না।

 দীপঙ্কর বলল, ক্যামাক স্ট্রিটে আমরা যে-ব্যাঙ্কের বাড়িটা বানালাম, তার অন্য আইটেমের কথা ছেড়ে দিন, শুধু প্লেন গ্রিলের কথাই ধরুন। প্লেন গ্রিলের স্কোয়ারফুট কত করে ধরা হয়েছে? বলুন, আপনি তো জানেন।

বোধিসত্ত্ববললেন, বাইশ টাকা।

তবে? বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওই গ্রিলের স্কোয়ারফুট তেরো টাকার এক পয়সা বেশি নয়। তাহলে হিসেব করুন অত বড় বাড়িতে চল্লিশ হাজার স্কোয়ারফুট গ্রিলে কত টাকা চুরি হল? ভাবছেন পার্টি জানে না আসল রেট? ঠিক জানে। ওদের এস্টাব্লিশমেন্ট ডিপার্টমেন্টের দু’জন অফিসার এর থেকে পনেরো পার্সেন্ট করে পকেটে ভরে নিয়েছে। এখানে তো সর্বক্ষণই এই চুরির খেলা চলছে। নতুন এসেছেন তো, কদিন বাদেই সব বুঝে যাবেন।

বোধিসত্ত্ব নিরীহ মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার যখন জানেন, এই অফিসে চুরি হয়, তবুও আপনারা এখানে কাজ করছেন কেন?

ধনঞ্জন রাগত মুখে নীরব হয়ে রইল। অরুণ বলল, কী করব দাদা, পেট। সবই পেটের জন্য। চেষ্টা করলেও তো অন্য কোথাও চাকরি পাবনা। আর, সব জায়গাতেই তো এই একই অবস্থা।

ক্যাঁচ করে শব্দ হল, মালিকের ঘর থেকে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন মিসেস সেন। দুই স্তনের ঠির মাঝখান দিয়ে সরু করে পাকানো আঁচলটা সুবিন্যস্ত করে সে জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?

এবার আবার কাজ। এই আবদুল্লা, চায়ের পয়সা নিয়ে যা!

বোধিসত্ত্বের মনে হল, এই ঘরটি যেন একটি মঞ্চ। এখানকার কুশীলবরা যে-যার ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে। তিনি নিজেও।

আর এক দিনের সংলাপের নমুনা–

শুক্রবার বিকেলে রাজেনবাবু বললেন, ভাই, কাল আমার আসতে একটু দেরি হবে। ধনঞ্জন, লক্ষ্মী ভাইটি, তিলজলা প্রোজেক্টের এস্টিমেটটা খানিকটা তৈরি করে রেখো। আমি বাবোটার মধ্যে এসে পড়ব আশা করছি।

কোথায় যাবেন?

আরে ভাই, এক ঝামেলা। কানপুর থেকে আমার এক পিসি এসেছেন। তিনি যাবেন কালীঘাটে মায়ের পুজো দিতে। অনেক দিন থেকে মানত করে রেখেছেন। আমাকেই নিয়ে যেতে হবে সঙ্গে।

মিসেস সেন বলল, ইস, আগে জানলে আমিও যেতাম আপনার সঙ্গে। অনেক দিন যাইনি। কিন্তু কাল যে আমাকে দশটার সময় আসতেই হবে, মি. রাও বলে রেখেছেন।

অরুণ বলল, রাজেনদা, কাল শনিবার, কাল আপনি যাচ্ছেন?

কালকের দিনটা ভাল। পিসিমা পাঁজি দেখেছেন।

 কাল তো তাহলে আপনি আর অফিসে আসতেই পারবেন না! শনিবার কী ভিড় হয় জানেন না!

ওই ঠেলেঠুলে ঢুকে পড়ব কোনও রকমে।

অসম্ভব! আমাদের পাড়া, আমি ভাল রকম জানি। শনিবার দিন মানুষের মাথা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। বারোটা কেন, কাল আপনি তিনটের আগে কিছুতেই পারবেন না অফিসে আসতে।

আরে ভাই, যেতেই হবে, পিসিমা ধরেছেন। আমিও একবার পেন্নাম ঠুকে আসব।

সাউথে তিরুপতির মন্দিরে একটা নতুন সিস্টেম করেছে। জানেন তো, ওখানে কী সাংঘাতিক ভিড় হয়। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ-ছ’ঘণ্টার আগে দর্শন হয় না। কিন্তু এখন পঁচিশ টাকা টিকিটের একটা আলাদা লাইন হয়েছে। সেই লাইনে দাঁড়ালে দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে দর্শন হয়ে যায়। খুব কাছ থেকে, ভাল ভাবে।

ধনঞ্জয় হো হো করে হেসে উঠল।

অরুণ তার দিকে ফিরে একটু তোষামুদে গলায় বলল, আজকাল সব ঠাকুর-দেবতাই তো ক্যাপিটালিস্ট। এক-একটি মন্দিরের কত ইনকাম আপনি জানেন?

মিসেস সেন বলল, তিরুপতির মন্দিরে বহু লোককে ফ্রি খাবার দেওয়া হয়, আপনি জানেন?

 প্রীতি সান্যাল উপন্যাসের পাতা ওলটাল।

ধনঞ্জয় বলল, শুনুন, একটা মজার ঘটনা বলি। আমাদের বাড়িওয়ালা আর গিন্নি, দু’জনেরই বাতের অসুখ। গিন্নিরই বেশি। কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, টোটকা — নানা রকম চিকিৎসাই হয়ে গেছে। রাত কি কখনও সারে? গত মাসে ওরা চলে গেলেন বাঙ্গালোরের কাছে সাঁইবাবার আশ্রমে। কদিন হল ফিরে এসেছেন। গিন্নির রাত সেরে গেছে, আর…।

এই তো, আপনারা বিশ্বাস করেন না।

শুনুন না, গিন্নির সেরেছে, কিন্তু কত্তার সারেনি। তাই নিয়ে কত্তা-গিন্নিতে খুব রাগারাগি, কত্তা এত খরচাপত্তর করে গেলেন অত দূরে, অথচ তার নিজের কিছুই হল না।

তার মানে কত্তাটি অবিশ্বাসী! মনের মধ্যে বিশ্বাস না থাকলে– ।

আরে, সবটা বলতে দিন না আমাকে। ওখানে জানেন তো, ভক্তরা সবাই বসে থাকে, বাবা মাঝে মাঝে বেরিয়ে দর্শন দেন, সকলের সঙ্গে তিনি কথা বলেন না। হঠাৎ হঠাৎ এক-এক জনকে বেছে নিয়ে তিনি কাছে ডাকেন, সেই রকমই এক দিন গিন্নিকে ডাকলেন। তার পরেও কয়েক দিন কত্তা গিয়ে বসে রইলেন, তার আর ডাক পড়ল না। বাবার দেওয়া ওষুধ খেয়ে গিন্নির সেরে গেল, কিন্তু সেই একই ওষুধ খেয়েও কিন্তু কত্তার সারল না। রোগ কিন্তু একই। আর গিন্নিরও যে সেরেছে বলছেন, তা-ও কত দিনের জন্য কে জানে! বাতের ব্যথা কখন হয়, কখন কম থাকে, তার কোনও ঠিক আছে? মেয়েদের হাজার রকম বাতিক।

ধনঞ্জয়বাবু, আপনার সবকিছুতে অবিশ্বাস।

শুনুন, আসল কথাটা এখনও বলিনি। গিন্নির বাতের ব্যথা যদি সেরে যায় তো ভালই। আমরা ঠিক মতো জল পাব। বাতের ব্যথার জন্য প্রায়ই তিনি পাম্প চালাতে ভুলে যান। আমাদের বাড়িওয়ালা গিন্নি ফিরে আসার পর থেকে সব সময় বাঙ্গালোরের সাঁইবাবার গল্প করছেন। নিজের চোখে তিনি দেখেছেন অলৌকিক কাণ্ড। তিনি এমন রোমহর্ষক গল্প-শুরু করেছেন যে, আমার মা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন সেই সব শুনে। মা-ও একবার যেতে চান সেখানে, আমার মায়ের বহু পুরনো হাঁপানি। সে এক বিপদ হয়েছে আমাদের বাড়িতে। মাকে যত বোঝাচ্ছি– ।

আপনার মাকে বলুন, হাঁপানির খুব ভাল ওষুধ দেন সোদপুরের পাগলাবাবা। শতকরা একশো জনের সারে। অত দূরে যাবার দরকার কী, বাঙালিদের মধ্যেও অনেক বড় বড় সাধক রয়েছেন।

ধনঞ্জয়বাবু, আপনার আসল কথাটা কী?

বাঙ্গালোরের বাবা আমাদের বাড়িওয়ালা গিন্নিকে একটা জিনিস উপহার দিয়েছেন। খালি হাতটা হাওয়ার মধ্যে মুঠো করলেন, অমনি সেই জিনিসটা এসে গেল। বাড়িওয়ালা গিন্নির নিজের চোখে দেখা, সুতরাং অবিশ্বাস করার উপায় নেই। আমাদের পি. সি. সরকারের ছেলে হাওয়া থেকে ডজন খানেক পায়রা ধরে ফেলতে পারে। সে যাক গে! জিনিসটা আমি দেখেছি। ঝিনুকের তৈরি একটা লকেটে। বেশ সুন্দর। সেটা সব সময় শরীরে ধারণ করে থাকতে হবে। ওতে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, কোনও অসুখ-বিসুখ হবে না। বেশ, ভাল কথা। কিন্তু সেই দিনই, ওই বাবা বোষের এক জন নাম করা ফিলিম স্টারকে, ভরতকুমার না ভারতভূষণ কী যেন নাম, ওদের নাম-টাম ঠিক আমার মনে থাকে না, তাকে দিয়েছেন একটা সোনার লকেট! এখন কথা হচ্ছে, কোনও সাধক মহাপুরুষ যদি অলৌকিক উপায়ে হাওয়া থেকে যে-কোনও জিনিস তৈরিই করতে পারেন, তাহলে বড়লোক ভক্তকে কেন দেন দামি জিনিস, আর গরিবকে দেন সস্তা জিনিস? বরং উলটোটাই হওয়া উচিত নয়? বোম্বের ফিলিম স্টারের তুলনায় আমার বাড়িওয়ালা গিন্নি সাধারণ লোক, তাই পেল ঝিনুকের লকেট। আর গরিবরা পায় শুধু ছাই!

অন্য কেউ কিছু বলবার আগেই মিসেস সেন বললেন, এটাও বুঝলেন না, এর উত্তর তো খুব সহজ! গরিবকে যদি সোনার লকেট দেন, সে হয়তো কোনও দিন লোভের মাথায় কিংবা অভাবের জ্বালায় সেটা বিক্রি করে ফেলতে পারে। সাধুমহাত্মার দেওয়া জিনিস কি বিক্রি করার জন্য? বোম্বাইয়ের ফিল্মস্টার কোনওদিন সোনার লকেট বিক্রি করতে যাবেনা। উদ্দেশ্যটা হচ্ছে এই।

বোধিসত্ত্ব চুপ কবে শুনছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, না।

 মিসেস সেন জিজ্ঞেস করলেন, কী বললেন কুমারবাবু?

বোধিসত্ত্ব পেনসিল দিয়ে কাগজে দাগ কাটতে কাটতে বললেন, আমি তো অঙ্ক কষি। আপনার কথাটা অঙ্কে ঠিক মিলল না।

কেন?

বোধিসত্ত্ব ধীর কণ্ঠে বললেন, যদি বিক্রি করে দেবার সম্ভাবনাটাই একমাত্র কারণ হয়, তাহলে সকলকেই ঝিনুকের লকেট দেওয়া উচিত। গরিব ও বড়লোক, কেউই ঝিনুকের লকেট বিক্রি করতে যাবে না কখনও। এমনকী হরিতকীর লকেট দিলেও একই কাজ হবার কথা।

ধনঞ্জয় টেবিল চাপড়ে উঠে বলল, ঠিক বলেছেন! আসল কথা হল বড়লোক বা ফিল্মস্টাররা তো সোনার লকেট ছাড়া অন্য কিছু পরবেনা। ঝিনুক বা হরীতকী হেলাফেলা করে ফেলে রাখবে! পুরো জিনিসটাই ধাপ্পা।

মিসেস সেন বলল, ধনঞ্জয়বাবু, আপনার পার্টির অনেক লোককেও আমি পুজো দিতে দেখেছি।

রাজেনবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আবার এর মধ্যে পলিটিক্স টেনে আনা কেন? তাহলে ভাই ধনঞ্জয়, কালকে এস্টিমেটটা একটু দেখে রেখো।

অরুণ বলল, রাজেনদা, আপনি এক কাজ করুন। আপনি কাল ন’টা নাগাদ আমার বাড়িতে চলে আসুন আপনার পিসিমাকে নিয়ে। কালীঘাট মন্দিরের সেবাইতদের মধ্যে কয়েক জনের সঙ্গে আমার চেনা আছে। আমার নিজের পাড়া। আমি তাদের বলে দেব, আপনাকে ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবে, ভাল করে পুজো-টুজো করিয়ে দেব।

মিসেস সেন বলল, অরুণবাবু, আমাকে এক দিন নিয়ে যাবেন? বলবেন। যে-কোনও দিন!

অফিসের পর যাওয়া যায় না?

 কেন যাবেনা?

তাহলে এক দিন এখান থেকেই এক সঙ্গে বেরুব, রাও সাহেবকেও বলব, উনি যদি রাজি হন, তাহলে ওঁর গাড়িটা পাওয়া যাবে, একেবারে মায়ের গা ছুঁইয়ে দিতে হবে কিন্তু, আমি কোনও দিন বেশি কাছে যাইনি।

সেবাইতদের বলে দিলে কোনও অসুবিধেই হবে না।

ধনঞ্জয় বলল, আমরা টেন্ডার লাগাবার জন্য যেমন দালাল ধরি, তেমনি কালী ঠাকুরের কাছে যাবার জন্যও ব্যাকডোর পলিসি আছে। দালাল ধরে গেলে কালী ঠাকুরের কাছ থেকে বেশি পুণ্য পাওয়া যাবে।

এবার মিসেস সেন মালিকের পি.এ. সুলভ গম্ভীর ভঙ্গি করে বলল, দেখুন ধনঞ্জয়বাবু, ঠাকুর দেবতা নিয়ে এ-রকম বিশ্রীভাবে কথা বলা আমি ঠিক পছন্দ করি না।

আর কথা নয়, এবার কাজ। এই আরদুল, চায়ের পয়সা নিয়ে যা।

.

০৮.

 বোধিসত্ত্বের বাড়িটি একটি সরু গলির মধ্যে। কাঁচা রাস্তা। জল কাদা বাঁচিয়ে একটা লোহার কড়াইয়ের কারখানার পাশ দিয়ে এসে একটা সাদা রঙের তিনতলা বাড়ি। বোধিসত্ত্ব থাকেন একেবারে ওপরে। গোটা বাড়িতে মোট পাঁচটি ভাড়াটে পরিবার, তবে তিন তলায় বোধিসত্ত্ব একা। তিন তলার আর সবই ভাল, শুধু বাথরুমের কলে কখনও জল আসেনা। স্নান করার জন্য বোধিসত্ত্বকে যেতে হয় একতলার বারোয়ারি বাথরুমে।

সন্ধের পর বাড়ি ফিরে বোধিসত্ত্ব একেবার স্নান সেরে নেন। অফিস থেকে বাসে চেপে অনেকখানি রাস্তা আসতে হয়। গরমে, ঘামে শরীরটা বড় অপবিত্র হয়ে যায়। প্রায় কোনও দিনই বসবার জায়গা পাওয়া যায় না, বাসের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বোধিসত্ত্বর সব চেয়ে খারাপ লাগে মানুষের স্পর্শ। লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গায়ের ওপর। কারুর ঘর্মাক্ত হাত লেগে যায়। এক এক সময় অসহ্য বোধ হয়। তার পরই তিনি ভাবেন, এত লোক যদি এই জিনিসটা মেনে নিতে পারে, তিনিইবা পারবেন না কেন?

এই সমস্যার তিনি একটা সমাধান করে নিয়েছেন। অফিস থেকে ফেরার সময় পুরো পথটা তিনি হেঁটে আসেন। খালি পায় নয় অবশ্য, এখন তিনি রবারের চটি পরতে শিখেছেন।

স্নান সেরে নিয়ে বোধিসত্ত্ব বেরিয়ে পড়েন আবার। টবিন রোডের ওপর একটি হোটেলে তিনি খাবার খান। তারপর হাঁটতে শুরু করেন যে-দিকে খুশি। এক-এক দিন চলে যান দক্ষিণেশ্বর বা দমদম পর্যন্ত।

পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে একটা ব্যাপারই বোধিসত্ত্বর কাছে প্রকট হয়ে ওঠে। তিনি বুঝতে পারেন, এই শহরের মূল সুর হচ্ছে ঝগড়া। একটু দিনও যায় না, যে-দিন তিনি কোনও ঝগড়ার দৃশ্য দেখেন না। ট্রামে বাসে যখন-তখন ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। যে-কোনও রাস্তার মোড়ে হঠাৎ একটা ঝগড়ার বিস্ফোরণ হয়। কোনও দোকানের সামনে আচমকাই দু’জন লোক জোরে জোরে কথা বলা শুরু করে, অমনি আশপাশ থেকে কিছু লোক ছুটে এসে সেখানে ভিড় জমায়।

বোধিসত্ত্ব লক্ষ্য করে দেখেন, ঝগড়ার সময় মুখমুখি দুই পক্ষের মুখ লালচে হয়ে আসে, ফুলে ওঠে গলার শিরা, চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে, কণ্ঠস্বর উঠে যায় সপ্তমে। কখনও হাত দুটো হয়ে যায় মুষ্টিবদ্ধ, অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ঝগড়াকারী একটু একটু দোলে, একবার সামনে একবার পিছনে, যেন দুটি বিপরীত শক্তি তাকে টানছে দু’দিক থেকে। এদের কাছে কিন্তু কোনও অস্ত্র থাকে না। এই নগরীতে অস্ত্রের দোকান নেই বললেই চলে। এটাও একটা বিস্ময়কর ব্যাপার।

সাধারণত রোগা লোকরাই বেশি ঝগড়াপ্রবণ। তাদেরই কণ্ঠস্বর বেশি জোরালো, তাদেরই মুখ বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে। এরা পৃথিবীতে অপেক্ষাকৃত কম জায়গা নিয়ে আছে বলেই কি এদের রাগ বেশি? একদিন তিনি দেখেছিলেন, ট্রামের কামরায় এক জন খুব রোগা পাতলা লোক, এমন গর্জন করছিল, যেন তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল আগুনের হলকা, আর তাতেই বাকি সব যাত্রী কোণঠাসা।

কী নিয়ে যে ঝগড়াটা বাঁধে, বোধিসত্ত্ব অনেক সময়ই বুঝতে পারেন না। তিনি এমনও দেখেছেন যে, ভিড়ের মধ্যে একজন লোক বলল, একটু সরে দাঁড়ান না। আর একজন বলল, আপনি সরতে পারছেন না। প্রথমজন বলল, আপনার চোখ নেই, দেখতে পাচ্ছেন না, আমি কীভাবে…। অন্য জন বলল, আমার নাহয় চোখ নেই, আপনার মাথায় ঘিলু আছে তো? তাহলে বুঝতে পারতেন যে আমি…। ব্যাস, এর পরও ক্রমশ কণ্ঠস্বর চড়তে লাগল।

যে বাড়িতে তিনি থাকেন, সেখানেও তিনি ঝগড়া শুনতে পান নিয়মিত। একতলা ও দোতলার চার ভাড়াটে পরিবারের মধ্যে তিনটি দল আছে বলে মনে হয়। সবাই সবার সঙ্গে ঝগড়া করেনা, প্রায় সময়ই এক জনের বিরুদ্ধে দুটি পক্ষ থাকে। তবে কখন যে কে কার বিরুদ্ধে যায়, তা তিনি বুঝতে পারেন না। মোটামুটি চারটি পরিবারের সম্পর্কেই কিছু খবর তিনি পেয়ে গেছেন ওই ঝগড়ার সূত্র থেকেই। এক জন শিক্ষক, সঙ্গে তার বেকার ভাই। এক জন কেরানি, তিন ছেলে মেয়ে। এক জন দোকানদার, এঁর স্ত্রী নিঃসন্তান, এক শ্যালিকা এখানে থেকে কলেজে পড়ে। অন্য পরিবারটি একটু বিচিত্র, ভদ্রমহিলা যান চাকরি করতে, স্বামীটি সারা দিন থাকেন বাড়িতে এবং গান করেন সবসময়। এঁদের দুই ছেলে-মেয়েই থাকে মামার বাড়িতে। এই গায়কের চাকরিরতা স্ত্রীর জিহ্বাই সব চেয়ে বেশি খরসান।

ঝগড়ার উপলক্ষ জল, আলো, সিঁড়ি। কে কার নাম আড়ালে কী বলেছে। কিংবা হয়তো এর কোনওটাই আসল কারণ নয়। এরা প্রত্যেকেই নিজের ওপরে সব সময় বিরক্ত হয়ে আছে। এই দুর্লভ মানব-জীবন, তবু কেন এত অনর্থক ভাবে বেঁচে থাকা।

এই নগরীতে আছে মুষ্টিমেয় ধনী, কিছু ধনীদের উচ্ছিষ্টভোজী মধ্যবিত্ত আর অসংখ্য গরিব। এখানে আছে পুলিশ। তারা ধনীদের দাবোয়ানগিরি করে, মধ্যবিত্তদের গ্রাহ্যই করে না, গরিবদের বেয়াদপির শাস্তি দেয়।

এই নগরীতে আছে মন্দির, গির্জা। তার মধ্যে গির্জাগুলিই দেখতে বেশি সুন্দর এবং পরিচ্ছন্নতার আদর্শ। এরা সচ্ছল লোকদের পাপ-পুণ্যের ইজারা নিয়ে আছে। আর যে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় শোয়, তাদের কোনও পাপ-পুণ্য নেই। যারা ভীরু, যারা দুর্বল, যারা অপরাধী, তারা যায় ধর্মস্থানে আর যারা সবল ও স্বাধিকারপ্রমত্ত তারা যায় কারাগারে।

পথে পথে টো-টো করে ঘোরবার জন্য বোধিসত্ত্ব কয়েক বার সশস্ত্র ঝগড়ার সম্মুখীন হয়েছেন। হঠাৎ লোকে চতুর্দিকে ছুটতে শুরু করে। বাঁশ বা লোহার রড নিয়ে তাড়া করে যায় একদল লোক। অথবা পানের দোকান থেকে সোডার বোতল উড়তে থাকে হাওয়ায়, অথবা বিকট শব্দে দু-একটি পটকা ফাটে। বোধিসত্ত্ব সেইসময় চুপ করে থেমে থাকেন। প্রায় শিশুরই মতো, তার মৃত্যুভয় জাগেনি এখনও। ব্যক্তিগত বিপদের আশঙ্কা তার মনে আসে না। এ পর্যন্ত তার গায়ে অবশ্য কোনও আঘাতও লাগেনি। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন, এক জন লোককে তিন-চার জন মিলে মারধর করছে। এক জন অসহায় প্রৌঢ়কে ধাক্কা মেরে ফেলে চলে যায় যুবকের দল। অল্প বয়সি একটি মেয়েকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় দুরন্ত গাড়ি। রেল লাইনের পাশে কারা ধরাধরি করে এনে ফেলে যায় একটি মৃতদেহ।

বোধিসত্ত্ব শুধু চুপ করে দেখেন, আর কিছুনা।

এক দিন তার মনে খটকা লাগল। এ পর্যন্ত তিনি সব কিছুরই দর্শক, তিনি নিজে কোনও কিছুতেই অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু এ তো সম্পূর্ণ জীবন নয়। পাগলা হাতি দেখে সবাই পালায়। কেউ কেউ দুয়ার এঁটে চিন্তা করে, হাতি কেন পাগল হয়। কিংবা অন্যের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে, কীভাবে পৃথিবী থেকে হাতির পাগলামি রোগ চিরতরে নির্মূল করা যাবে। কিন্তু কারুকে না কারুকে তো এগিয়ে এসে বাস্তবে পাগলা হাতিটিকে রুখবারও চেষ্টা করতে হবে।

তিনি একদিন এগিয়ে গেলেন।

ঘুঘুডাঙা রেল লাইনের পাশে চার জন লোক মিলে এক জন লোককে ছুরি মারছিল। রাত তখন পৌনে বারোটা। এই ধরনের মারামারির খবর দু’তিন বাদে ছাপা হয় সংবাদপত্রে। এই খবর পড়ে ভদ্রলোকেরা খুশি হয়। গুণ্ডারা মারামারি করে মরছে, মরুক, ভালই তো। এইভাবে যত জন গুণ্ডা কমে! আসলে কিন্তু কমে না! এক একটি গুণ্ডার রক্ত থেকে অন্তত তিন জন গুণ্ডা জন্মায়। নিহত গুণ্ডার ভাই, দাদা, মামা, কাকা বা বন্ধুদের মধ্যে কেউ প্রতিশোধ নেবার জন্য গুণ্ডা হয়ে ওঠে। তারাও ছুরি সংগ্রহ করে। পাঁচ হাজার বছর ধরে এইভাবে গুণ্ডর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

সবেমাত্র একবার ছুরি মারা হয়েছে, এমন সময় অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে বোধিসত্ত্ব ছুরিকাধারীর হাত চেপে ধরলেন। ধীর শান্ত গলায় বললেন, ওকে মেরো না, ও তোমার শত্রু নয়!

ওরা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। বাকি তিন জন চট করে পিছিয়ে গেল খানিকটা। বোধিসত্ত্বের দীর্ঘ শরীর। গৌরবর্ণ মুখ ও শান্ত কণ্ঠস্বরের জন্য ওরা ব্যাপারটি ঠিক ধরতে পারল না। বরং প্রথম আততায়ী ভয়ই পেয়ে গেল খানিকটা। সে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল।

বোধিসত্ত্ব আবার বলল, ওকে মারছ কেন? ও তো তোমাদের শত্রু নয়!

 বাকি তিন জন এর মধ্যে দেখে নিয়েছে যে, এই উটকো লোকটির হাতে কোনও অস্ত্র নেই। এবার তারা খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, তুই কে রে শালা?

এক জন একটু সতর্ক ভাবে বলল, এ শালা প্লেন ড্রেসে আর. পি. এফ. নয় তো?

বোধিসত্ত্ব বললেন, আমি তোমাদেরই মতো এক জন মানুষ। কেন শুধু শুধু মারছ একে?

নির্বোধ আদর্শবাদীর মতো শোনাল বোধিসত্ত্বর এই কথা। যেন অতি কাঁচা কোনও নাটকের নায়ক। বুদ্ধ, যিশু, মহম্মদ, শ্রীচৈতন্য বোধহয় এই ভাষাতেই কথা বলতেন। কিংবা তাবা এই পরিবেশে আসতেন না।

এ-রকম কথা শুনেও ওদের মধ্যে এক জন কৈফিয়তের সুরে বলল, ও কী করেছে জানো? এই হারামি আমাদের বখরা একলা ঝেড়ে দিয়েছে। একবার না, তিন-তিনবার। নিমকহারাম, শয়তানের বাচ্চা।

বোধিসত্ত্ব বললেন, ওর এবং তোমাদের সকলের শত্রু এক!

 যার হাতে ছুরি ছিল, সে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। বাকি এক জনও ছুরি বার করে বলল, ধুর শালা! জ্ঞান দিতে এসেছিস? তোর জ্ঞানের ইয়ে মারি!

দু’জনে এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল বোধিসত্ত্বের ওপরে। তিনি বলশালী, কিন্তু মারামারির নিয়ম জানেন না। বাধা দেবার চেষ্টা করেও পারলেন না, প্রথম ছুরিটা লাগল ঘাড়ে, দ্বিতীয়টা ঊরুতে।

হয়তো বুদ্ধ, যিশু, মহম্মদ, শ্রীচৈতন্যের মতো আরও অনেক আদর্শবাদী এই রকম পরিবেশ এসে ওই রূপ ভাবগর্ভ কথা বলতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বেঁচে যেতে পারেননি কিংবা উপযুক্ত শিষ্য বা জীবনী-লেখক পাননি বলে বিখ্যাত হতে পারেননি।

সেইসময় খানিকদূরে কয়েকবার ঘন ঘন হুইসল বেজে না উঠলে বোধিসত্ত্বের ইহলীলা সেখানেই শেষ হত। কিন্তু গুণ্ডা চার জন আর ঝুঁকি না নিয়ে পালাল।

হুইসল-এর শব্দ তাদেরই তাড়া করে গেল, এ-দিকে এল না। বোধিসত্ত্ব একটুক্ষণ পড়ে রইলেন রেল লাইনের ধারের খোয়ার ওপর। কিন্তু তার আঘাত খুব গুরুতর নয়। তিনি উঠে বসলেন আস্তে আস্তে। আহত জায়গা দুটি থেকে রক্ত বেরুচ্ছে ভলকে ভলকে। তবুতর হাঁটার শক্তি আছে।

যে-লোকটিকে ওরা প্রথম ছুরি মেরেছিল, সে পড়ে আছে উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে। ছুরি লেগেছে তার পেটে। বোধিসত্ত্ব লোকটিকে দুহাত দিয়ে তুলে নিলেন। লোকটি গোঙাচ্ছে। এখানে পড়ে থাকলে সে ট্রেনে কাটা পড়েই মারা যেত।

খানিকক্ষণ লোকটিকে বয়ে এনে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য বোধিসত্ত্ব তাকে একবার মাটিতে নামালেন। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠল, দাদা, আমাকে পুলিশে দেবেন না। আপনার পায়ে পড়ছি দাদা।

যে-আক্রান্ত, সে-ও পুলিশের ভয় পায়? বোধিসত্ত্বওকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাবেনই বা কেন?

কিন্তু তিনি ওকে কোনও সান্ত্বনা দেবার সুযোগই পেলেন না। ছুরির ঘায়ে লোকটার পেট হাঁ হয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই উঠে দাঁড়িয়ে পেটটা চেপে ধরে সে ছুটে পালাল। খুব সম্ভব অন্ধকারের মধ্যে সে আর কোথাও মুখ থুবড়ে পড়বে এবং মরবে।

বোধিসত্ত্ব খানিকটা খোঁজাখুঁজি করলেন, কিন্তু তাকে আর পেলেন না। সে যেন মিলিয়ে গেছে। একটা কালভার্টের ওপর বসে পড়লেন তিনি। তার শরীরও রক্তাক্ত ও অবসন্ন। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল অঙ্গুলিমালের কথা।

মহাদস্যু অঙ্গুলিমাল এমন নিষ্ঠুর দয়ামায়াহীন নরঘাতী ছিল যে, কোশল দেশের রাজা পর্যন্ত তার ভয়ে তটস্থ ছিল। যাকে কাছে পায়, তাকেই হত্যা করে সে নিহতদের হাতের আঙুল কেটে মালা করে গলায় ধারণ করত। ভগবান বুদ্ধ একাকি গেলেন সেই দস্যু-কান্তারে। যে-পথে পঞ্চাশ লোকও এক সঙ্গে যেতে ভয় পায়, সেই পথে তিনি একা। অঙ্গুলিমাল অস্ত্র নিয়ে ছুলে এল সেই নিরীহ শ্রমণকে হত্যা করতে। কিন্তু সে পারেনি।

অঙ্গুলিমাল ছুটতে গিয়েও দেখল, সে একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে, আর ভগবান বুদ্ধ হেঁটে চলেছেন। এত চেষ্টা করেও অঙ্গুলিমাল এগোতে পারছেন না। সে চিৎকার করে বলল, হে শ্রমণ, তুমি স্থির হও।

ভগবান বুদ্ধ উত্তর দিলেন, আমি স্থির আছি, তুমি স্থির হও।

অঙ্গুলিমাল বলল, মিথ্যুক! তুমি শ্রমণ হয়েও মিথ্যে কথা বলছ? আমি চলতে পারছি না, আর তুমি হাঁটছ, অথচ বলছ তুমিই স্থির, আমি অস্থির।

গৌতম বললেন, আমি সর্ব জীবের প্রতি দণ্ড ত্যাগ করে সর্বকালের জন্য স্থির হয়েছি। তুমি অসংযত, তাই তুমি অস্থির।

সেই অঙ্গুলিমাল দস্যু প্রব্রজ্যা নিয়ে এই জীবনেই অর্হৎ হয়ে গেলেন।

বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, আমি ওদের যে কথাগুলি বললাম, ওরা কেউ কারুর শত্রু নয়, ওদের সকলেরই শত্রু এক, সে-কথা কি সত্য নয়? সেই সত্য কেন ওদের মধ্যে প্রবিষ্ট হল না? কিংবা তিনি নিজে যথেষ্ট স্থির হতে পারেননি বলেই রোধ করা গেল না ওদের গতি?

অঙ্গুলিমালের কাহিনির এই গতি রোধ করার ব্যাপারটা চিন্তা করেই তিনি অনেকক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে বসে রইলেন।

দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তিনি অনেকটা সার্থক হলেন। ব্যাপারটা ঘটল তার বাড়িতে।

একতলায় বারোয়ারি বাথরুমে একটি ছোট চৌবাচ্চা। এ বাড়িতে জলের অভাব লেগেই আছে। যে-যখন বাথরুমে ঢুকে পড়তে পারে সেই চৌবাচ্চার জল ইচ্ছেমতো খরচ করে যায়। এ ছাড়া উঠোনের রকে আছে আলাদা আলাদা বালতি। যে-যার জল ধরে রাখে। আবার কেউ কেউ কখনও গোপনে ব্যবহার করে ফেলে।

সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন, দু’পক্ষে তুমুল ঝগড়া চলছে। উপলক্ষ, এক বালতি জল।

তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন ঝগড়া। জলের প্রসঙ্গে একটুক্ষণের মধ্যেই উবে বাষ্প হয়ে গিয়ে নানা প্রসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল। স্কুল-শিক্ষকের স্ত্রী দিল গায়কের স্ত্রীর চরিত্রে অপবাদ। গায়কের স্ত্রী স্কুল-শিক্ষকের ভাইকে বলল মাতাল।

বোধিসত্ত্ব দু’টি বালতি নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। লোহার কড়াইয়ের কারখানার সামনে একটি টিউবওয়েল আছে। তিনি সেখান থেকে দু’বালতি জল ভরে এনে বিবদমান দুই পক্ষের সামনে বালতি দু’টি রেখে হাসি মুখে বললেন, এই নিন।

সকলেই হঠাৎ থেমে গেল।

শিক্ষকের স্ত্রী বলল, এ কী, আপনি জল আনতে গেলেন কেন?

গায়কের স্ত্রী বলল, আপনাকে আমার বালতিতে হাত দিতে কে বলেছে?

বোধিসত্ত্ব বললেন, আসলে প্রয়োজন তো জলের!

 হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে কে আনতে বলেছে?

তিনি আবার বললেন, এক জন কেউ আনলেই হল। আসল প্রয়োজন তো জলের।

গায়কের স্ত্রী জিভে ধার দিয়ে বলল, ঠিক আছে, বুঝলাম। কিন্তু আপনি রোজ রোজ জল এনে দেবেন?

বোধিসত্ত্ব বললেন, নিশ্চয়ই। আপনি আদেশ করলে আমি রোজ জল এনে দেব।

শিক্ষকের স্ত্রী হঠাৎ তার দেওরকে বকুনি দিয়ে বললেন, ছি ছি, ভদ্রলোক নিজে জল টেনে আনলেন, কেন, তুমি নিজে আনতে পারো না দু-বালতি জল!

শিক্ষকের স্ত্রী এবং গায়কের স্ত্রী পরস্পরের দিকে আর একবার অগ্নিবর্ষী চোখে তাকাল। কিন্তু আর মুখ খুলল না। এখন নীরব প্রশ্ন, কে আগে বাথরুমে যাবে। শিক্ষকের স্ত্রী হার স্বীকার করে ফিরে গেল নিজের ঘরে।

বোধিসত্ত্ব একবার ভেবেছিলেন যে, ওদেরও বলবেন, আপনার ঝগড়া করছেন কেন, আপনারা কেউই কারুর শত্রু নন তো, দুজনেরই শত্রু আসলে এক।

কিন্তু ঠিক উপযুক্ত সময় আসেনি ভেবে তিনি আর কিছু বললেন না। উঠে এলেন সিঁড়ি দিয়ে।

দো-তলার বারান্দায় লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়েছিল দোকানদারটি, সে বোধিসত্ত্বের দিকে মুচকি হেসে বলল, আপনি তো মশাই বেশ মজার লোক। থামিয়ে দিলেন? বেশ জমে উঠেছিল ব্যাপারটা! মেয়েছেলেদের মুখে খিস্তি শুনতে আমার দারুণ লাগে!

ঘরের ভেতর থেকে তার স্ত্রী বলল, অ্যাই, কী হচ্ছে? নিজের তো কোনও মুরোদ নেই।

বোধিসত্ত্ব উঠে এলেন ছাদে।

এক-একদিন গভীর রাত্রে তিনি ছাদের আলসে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। লোহার কড়াইয়ের কারখানায় রাত্রিবেলাও কাজ হয়। এখান থেকে দেখা যায় ওদের ফার্নেসের লকলকে আগুনের শিখা। এখন বাতাসে শীতের ছোঁওয়া, তাই দূর থেকেও ওই আগুন দেখতে ভাল লাগে। বাকি চারদিক অন্ধকার, হঠাৎ কোথাও শোনা যায় একটি শিশুর কান্না। পুলিশ সেপাইয়ের হাঁটার মন্থর লৌহ শব্দ। এক-এক দিন বেশি রাত্রে একতলার গায়কটি গান গেয়ে ওঠেন ‘মৈয়া মোরী মৈ, নহি মাখন খাঁয়ো’ লোকটির গলা বড় দুঃখীর মতো। একটু পরেই পাশের ঘর থেকে কেউ বলে ওঠে, আস্তে! রাত্তিরে একটু ঘুমোনোও যাবে না।

এই নিয়ে জীবন। এই জীবনের গায়ে একটা আলগা মায়া লেগে আছে। বোধিসত্ত্ব এই মায়াটিকে দণ্ডিত করতে পারছেন না, বরং ক্রমেই যেন তিনি এতে বেশি জড়িয়ে পড়ছেন।

ঠিক ধ্যানীর মতো নয়, অনেকটা কবির মতোই মাঝে মাঝে তিনি সন্ধের পর বসে থাকেন গঙ্গার ধারে। প্রবহমান নদীর দৃশ্যর মধ্যে একটা চিরন্তনতা আছে। এই জায়গাটিতে বসে থাকতে তার ভাল লাগে। তার মনটা শুন্য হয়ে যায়। তিনি কিছু চিন্তা করেন না, শুধু স্থির ভাবে চেয়ে থাকেন।

বেশি রাত করে বাড়ি ফিরলে আজকাল শিক্ষকের বেকার ভাইটি খুব আপত্তি করতে শুরু করেছে। সদর দরজার ঠিক পাশেই তার ঘর। দেরি করে কেউ ফিরলে তাকেই দরজা খুলতে হয়। আবার দরজা বন্ধ না রাখলে চোর ঢুকে পড়ার ভয়। এক দিন সে বোধিসত্ত্বকে বলেছিল, ও মশাই, এ বাড়িতে আপনার কেউ চাকর আছে যে, রাত একটায় দরজা খুলে দেবে?

বোধিসত্ত্ব বিনীত ভাবে বলেছিলেন, আপনি দরজা খুলে দেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

বেকার ভাই সব সময় রেগে থাকে। রাগের যে কোনও কারণ নেই, তা-ও নয়। সেআরও কর্কশ ভাবে বলেছিল, ও-সব ছেঁদো কথা ছাড়ুন। কৃতজ্ঞ! আপনি রাত একটায় ফুর্তি মেরে আসবেন, আর আমি ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলব?

বোধিসত্ত্ব বলেছিলেন, আপনার এ উপকারের বিনিময়ে আমি কিছু করতে চাই।

 যেমন?

আমি আপনার জামাকাপড় কেচে দেব।

মাইরি?

আমি প্রত্যেক দিন আপনার জামাকাপড় কেচে দেব!

ওসব ন্যাকা কথা মেয়েছেলেদের কাছে বলবেন। আমার কাছে ও-সব মাজাকি করতে আসবেন না। সাড়ে এগারোটার পর এক মিনিট হয়ে গেলে আমি আর দরজা খুলে রাখব না বলে রাখছি।

বোধিসত্ত্ব ওই ছেলেটিকে বশ করতে পারেননি। এরপর তার কখনও রাত্রে গঙ্গার ধারে এসে বসবার ইচ্ছে হলে তিনি আর সারা রাত বাড়িই ফেরেন না।

সেই রকম এক রাত্রে গঙ্গার ধারে বসে ছিলেন, কত রাত তার ঠিক নেই, হঠাৎ এক সময় তিনি দেখলেন একটি মেয়ে একা এসে দাঁড়াল জলের কিনারায়। তার শরীরে একটা কালো রঙের শাড়ি। একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সে হঠাৎ এক ঝটকায় খুলে ফেলল শাড়িটা। বোধিসত্ত্ব চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

তার পরই একটা আওয়াজে তিনি মুখ ফেরালেন আবার। মেয়েটি সেখানে নেই, সে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি আর এক মুহূর্তও দ্বিধা করলেন না, তিনিও লাফ দিলেন জলে।

মেয়েটিকে ধরে ফেলতে তার দেরি হল না। কিন্তু ডুবন্ত অবস্থায় মেয়েটি সাঁড়াশির মতো দুই হাতে তার গলা টিপে ধরার চেষ্টা করল। বোধিসত্ত্ব তার হাত দুটি মুচড়ে ধরে কোনওক্রমে সাঁতারে নিয়ে এলেন পাড়ে। গঙ্গায় এই সময় বেশ স্রোত, কাজটি তার পক্ষেও বিশেষ সোজা হল না। ওপরে উঠে মেয়েটিকে শুইয়ে দিয়ে তিনি হাঁপাতে লাগলেন।

মেয়েটি বেশি জল খায়নি। জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেনি। একটুক্ষণ সে নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে রইল, তারপর উঠে বসে সে হঠাৎ বোধিসত্ত্বের গালে এক চড় মেরে বলল, তুমি আমাকে কেন বাঁচালে? কেন?

বোধিসত্ত্ব কোনও উত্তর দিলেন না। মেয়েটি যেন পাগলের মতো হয়ে গেল। সে বোধিসত্ত্বের দুই গালে চড় মারতে লাগল অনবরত। তার চোখের ওপর লাগছে, নাকে লাগছে। মার এড়াবার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

আকাশে হেমন্ত রাতের জ্যোৎস্না। সেই আলোয় মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি চমকে উঠলেন। একে তিনি আগে কোথায় দেখেছেন। মুখখানা বেশ চেনা। বাঁকুড়া শহরে একটি অচল গাড়ি থেকে নেমে যে-মেয়েটি তাকে হুকুমের সুরে বলেছিল, এই, একটা রিকশা ডেকে দাও, এ কি সেই মেয়ে? অথবা কংসাবতী প্রকল্পের লছমিয়া নামের যে-মেয়েটি বলেছিল, কুঁয়ার সিং, এই গরমের পর বরসাত আসবে, তারপর আসবে পুজা কা টাইম, তারপর শীত, তবু আমার মরদ আসবেনা– এ কি সেই লছমিয়া? অথবা, একে তিনি আরও আগে দেখেছেন, অনেক আগে অনেক বার?

মেয়েটির উদ্যত ডান হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের বাঁ-হাত বাড়িয়ে দিলেন।

 সেই মুহূর্তে বোধিসত্ত্ব ঠিক করলেন, তিনি সংসারধর্মে প্রবেশ করবেন!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়