কৃষ্ণনগরে বিমানবিহারীদের বাড়ির একটি অংশে হঠাৎ আগুন লেগে গেল এক রাত্রে। বিমানবিহারী দু’দিন আগেই সপরিবারে দেশের বাড়িতে এসেছেন। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলেছিল, তিনি এলেই প্রতিবেশীরা অনেকেই দেখা করতে আসে, খাওয়া-দাওয়া হয়। রাত দশটার সময় খানিকটা ঝড় উঠে এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। আগুন লাগার স্বাভাবিক কোনো কারণই নেই, কেউ লাগিয়েছে। গোয়াল ঘর আর হাঁসঘর থেকে রান্নাঘর অনেকটা দূর, কিন্তু তিন জায়গাতেই আগুন ধরেছে একসঙ্গে। সেই আগুন ছড়িয়ে গিয়েছিল বসতবাড়ির পেছন দিকে দোতলা পর্যন্ত।

শেষ রাত্রে হৈ চৈ, হুড়োহুড়ি, হাঁকাহাঁকি, পটোপাড়া থেকে অনেকে ছুটে এসেছিল সাহায্য করতে, পাছ-পুকুর থেকে ঘড়া ঘড়া জল এনে আগুন নেবাবার চেষ্টা চলতে লাগলো। এ সময় মনে হয়েছিল গোটা বাড়িটাই বুঝি ভস্ম হয়ে যাবে।

শেষ পর্যন্ত বসতবাড়ির খুব বেশী ক্ষতি হয়নি, হাঁসগুলো সব মরে গেছে, একটা গরু দারুণ ভাবে ঝলসে গেছে। তার আর্ত চিৎকারে কান পাতা দায়। গরুটাকে বাঁচানো যাবে না, আবার মুমূর্ষ গরুটাকে মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার কথাও কেউ চিন্তা করছে না। একজন ভেটেরিনারি ডাক্তারকে ডাকতে লোক গেছে, সে কখন আসবে তার ঠিক নেই।

বিমানবিহারীর এক জ্ঞাতি দাদা রাজচন্দ্র চুরুট টানতে টানতে বিজ্ঞভাবে বললেন, এ নির্ঘাৎ নকশালদের কাজ। তোমাদের আমি আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম, বিমান!

সদ্য ভোর হয়েছে, গোয়ালঘর রান্নাঘরের খড়ের চালে প্রচুর জল ঢালা হলেও এখনও সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে উঠছে ধোঁয়া। বিমানবিহারীর কাকার ছেলেরা প্রচুর খাটাখাটনি করে চলেছে, অলি আর বুলিও হাত লাগিয়েছে।

সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিমানবিহারী চশমার কাচ মুছলেন।

রাজচন্দ্র কবে তাঁকে নকশালদের সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন, তাঁর মনেই পড়লো না। এক ধরনের মানুষ থাকে যে কোনো ঘটনা ঘটলেই বলে, আমি তো আগেই বলেছিলাম; রাজচন্দ্র সেই দলে।

বিমানবিহারী ভাবলেন, নকশাল ছেলেদের তাঁদের বাড়ির ওপর রাগ থাকবে কেন? তাঁরা। তো জমিদার বা জোতদার নন। তাঁদের পরিবারের কুড়ি বাইশ বিঘে জমি আছে মাত্র। বিমানবিহারী কলকাতায় বইয়ের ব্যবসা করেন। কৃষ্ণনগরের বাড়িটি বিক্রি না করে রেখে দিয়েছেন, এই তাঁর দোষ?

রাজচন্দ্রদাদা নিজে পুরনো কংগ্রেসী এবং তার দুই ছেলেও কংগ্রেসের পাণ্ডা। বিমানবিহারীর কাকার ছেলেরা সি পি এম পার্টির সদস্য। এ শহরের ইস্কুল কলেজের ছাত্ররা নাকি দলে দলে নকশালপন্থী হয়ে গেছে। এখন কংগ্রেস-সি. পি. এম ও নকশাল ছেলেদের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই চলছে নানান জেলায়। প্রতিদিনই কাগজে কয়েকটি তরুণপ্রাণ বিনষ্ট হবার সংবাদ থাকে।

বিমানবিহারীর পুত্র সন্তান নেই, দুটি মেয়ে পড়াশুনো নিয়েই ব্যস্ত, কলেজ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হয়নি। তাঁদের পরিবারটি রাজনৈতিক পরিবার নয়। তবে তাঁরা কাদের আক্রমণের লক্ষ্য?

বছরখানেক আগে বিমানবিহারী কঙ্কালের ছবি আঁকা একটি লাল কালিতে লেখা চিঠি। পেয়েছিলেন। সেই চিঠিতে তাঁর কোনো অপরাধ নির্দেশ করা হয়নি। তাঁকে কোনো ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়াও হয়নি, তাঁকে যে খতমের তালিকায় রাখা হয়েছে, সেই কথাটিই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

চিঠিখানা দেখে বিমানবিহারী যে খুব ভয় পেয়েছিলেন তা নয়, বিভ্রান্তিবোধ করেছিলেন। তিনি আইন ও বিজ্ঞানের গ্রন্থ প্রকাশ করেন, মাঝারি ধরনের ব্যবসা, এতে কৃষক আর শ্রমিক নিপীড়নের কোনো ব্যাপার নেই, তবু তাঁকে হত্যা করা হবে কেন?

চিঠিখানা তিনি পুলিশ কমিশনারকে দেখিয়েছিলেন।

পুলিশ কমিশনার তো হেসেই উঠলেন সে চিঠি দেখে। প্রথমে একটি লাল কলম নিয়ে, পরে সেটি বদলে একটি সবুজকালির কলম নিয়ে তিনি চার জায়গায় দাগ দিয়ে বললেন, এই দ্যাখো, বিমান, তিনটে বানান ভুল। এক জায়গায় কনস্ট্রাকশান ভুল। নকশালরা এ চিঠি লিখতে পারে না। আফটার অল, ভালো ভালো ছাত্রেরা ঐ দলে ভিড়েছে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা আছে, যতই মাথা বিগডোক, তারা লেখাপড়া জানে। তারা এরকম বাজে চিঠি লিখবে না। কতকগুলো লুমপেন এখন নকশালদের নাম করে যা তা করে বেড়াচ্ছে। তুমি এ চিঠিটা ফেলে দিতে পারো; আর তুমি যদি চাও, পুলিশ প্রোটেকশানের ব্যবস্থা করে দিতে পারি তোমার জন্য।

সঙ্গে সঙ্গে সব সময় একজন সেপাই ঘুরবে, এ ব্যাপারে বিমানবিহারীর একেবারে মনঃপূত হয়নি।

কমিশনার আরও বললেন, দেখো, এরপর বোধ হয় তোমার কাছে দু’পাঁচ হাজার টাকা চাঁদার জুলুম করতে আসবে। আমাদের কাছে খবর আছে, এরকম এক্সটরশান চলছে। অনেকে ভয় পেয়ে দিয়ে দেয়। সেরকম কোনো ইন্ডিকেশন পেলেই তুমি টুক করে আমাদের খবর দিয়ে দেবে। এই মুভমেন্টের আয়ু আর বেশি দিন নেই, চায়না ব্যাক আউট করেছে।

বিমানবিহারী জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা রুনু, ছেলেগুলো তো একটা বড় আদর্শ নিয়েই এসেছিল, হয়তো তারা মিস-গাইডেড, কিন্তু ভালো ভালো ছেলে, কিন্তু তাদের যে ধরে ধরে মেরে ফেলা হচ্ছে, এটা কি ঠিক? এটা তোমরা আটকাতে পারো না?

খুন করলে যে শাস্তি পেতে হয়, তা তো একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। এরা যে রাস্তায় ঘাটে যাকে-তাকে খুন করছে, চায়না রাশিয়াতেও তো এরকম ইনডিসক্রিমিনেট কিলিং দিয়ে। রেভোলুশন শুরু হয়নি। আমরাও তো কিছু পড়াশুনো করেছি, নাকি?

ঘরে অন্য লোক ঢুকে পড়তে আর বেশী কথা হয়নি। বিমানবিহারী উঠে পড়েছিলেন। কমিশনার তাকে আশ্বস্ত করার জন্য আবার বলেছিলেন, তুমি চিন্তা করো না। এইসব আজে বাজে চিঠি পেয়ে কয়েকজনের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে শুনেছি, ইচ্ছে করলে কিছুদিন অন্য জায়গায় বেড়িয়ে এসো.-এদের ব্যাপারটা শিগগিরই শেষ হয়ে যাচ্ছে তোমার সেই বন্ধুর ছেলে ভালো আছে তো?

এর দু’তিন দিন বাদেই কুমোরটুলীতে একজন হাইকোর্টের বিচারক খুন হলেন দিনের বেলায়, প্রকাশ্য রাস্তায়!

তখন বিমানবিহারী ভাবলেন, তিনি যে আইনের বই ছাপেন, সেটাই কি তবে দোষের? এদেশে এখনও ব্রিটিশ রচিত আইনই মোটামুটি চলে, তার ওপর ঐ বিপ্লবী ছেলেদের রাগ আছে?

পুলিশ খুনের পর, বিচারক, অধ্যাপক, ভাইস চ্যান্সেলর খুন শুরু হয়ে গেল। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় গিয়ে বিমানবিহারী শুনলেন যে টালায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেও নাকি। পুলিশ পাহারা বসেছে, তারাশঙ্করের নামেও ঐ রকম লাল কালিতে লেখা জঘন্য ভাষায় চিঠি এসেছে।

বিমানবিহারী কল্যাণীর কাছে ঐ লাল চিঠির কথা গোপন রাখতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ কমিশনারের স্ত্রীই তাকে একদিন ফোন করে কথায় কথায় জানিয়ে দেন। কল্যাণী দারুণ ভয় পেয়ে গেলেন, বিমানবিহারী তাঁকে কিছুতেই শান্ত করতে পারলেন না, সপরিবারে তাঁকে চলে যেতে হলো বেনারস।

কুমোরটুলীর ঐ বিচারক খুন হবার পর বিমানবিহারী তাঁর বন্ধু প্রতাপ সম্পর্কেও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। প্রতাপ জেদী মানুষ, কারুর সঙ্গে নরম সরমভাবে কথা বলা তাঁর ধাতে নেই। এখন যা দিনকাল, কালীপুজোর চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেও পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়।

বেনারসে বেশ বড় একটা বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। বিমানবিহারী প্রতাপকেও তাঁর স্ত্রী কন্যাদের নিয়ে বেনারস যাবার জন্য অনেক অনুরোধ করেছিলেন, প্রতাপ রাজি হননি। বিমানবিহারী মমতাকেও গিয়ে ধরেছিলেন, মমতা ম্লান হেসে বলেছিলেন, আপনার বন্ধু একবার না বললে কি তাকে দিয়ে হ্যাঁ করানো যায়, আপনি জানেন না?

বিমানবিহারী সূক্ষ্ম অনুভূতির মানুষ। প্রতাপের অসম্মতির কারণটা তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। দুই পরিবারের আর্থিক অবস্থার অনেক তফাত! বেনারসে এক সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে গেলে বিমানবিহারীই বেশীরভাগ খরচপত্র চালাবেন, সেটাই মেনে নিতে পারবেন না প্রতাপ! তাঁর মালখানগরের বংশগৌরব তাতে নষ্ট হবে! বিপদের সময় মানুষ কি বন্ধুর কাছে আশ্রয় নেয় না? তা হলে আর বন্ধুত্ব কী? প্রতাপের সব কিছুই আলাদা। বিমানবিহারী কিছু টাকা প্রতাপকে ধার হিসাবে দিতে চেয়েছিলেন, প্রতাপ বলেছিলেন, তোমার কাছে আমার ঋণের পাহাড় জমে গেছে, আর বাড়াতে চাই না!

বেনারসে দু’মাস নিরুপদ্রবেই কেটেছিল। কল্যাণী কিছুদিন হাঁপানীতে ভুগছিলেন, তাঁর বেশ স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো। স্থানীয় বাঙালী ক্লাবের দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে গান গেয়ে বেশ নাম হলো। তাঁদের ছোট মেয়ে বুলির। অলি গান শেখা ছেড়ে দিলেও বুলির খুব গানের দিকে আগ্রহ, সে এর মধ্যেই রেডিওর অডিশনে পাশ করেছে।

আগ্রায় বেড়াতে গিয়ে দেখা হলো জাস্টিস স্বরূপ মিত্রের সঙ্গে। তিনিও তিন মাস ধরে আগ্রায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন। এ যেন সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার অবস্থা, বাধ্য হয়ে কলকাতা ছেড়ে বাইরে থাকা! এরকম কতজন যে ঐ রকম লালকালির চিঠি পেয়েছে কে জানে!

স্বরূপ মিত্রের ছেলে প্রবীর থাকে পশ্চিম জার্মানিতে, সে দেখা করতে এসেছে বাবা-মার সঙ্গে। সে তাদের পশ্চিম জার্মানিতে নিয়ে যেতে চায়। প্রবীর খুব চমৎকার ছেলে। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমনি মিষ্টি ব্যবহার। প্রবীর এখনো বিয়ে করেনি শুনেই কল্যাণী দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। এই প্রবীরের সঙ্গে অলির সম্বন্ধ করা গেলে একেবারে রাজযোটক হতো!

জ্যোৎস্নারাতে সবাই মিলে তাজমহল বেড়াতে যাওয়া হলো, প্রবীরের সঙ্গে অনেক গল্প করলো অলি, কিন্তু তারপর আর কিছুই না। বিয়ের প্রস্তাবে সে কান দিতেই চায় না একেবারে। এখনকার তরুণ-তরুণীরা বেশ সাবলীল ভাবে মেলামেশা করে, চায়ের দোকানে গল্প করে, এক সঙ্গে বেড়াতে যায়, তবু যে তাদের কথায় কথায় প্রেম হয় না, এটাই বুঝতে পারে না কল্যাণী। তাঁদের কালে বয়ঃসন্ধির পর থেকেই মেয়েদের বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হতো। প্রায় প্রতিদিনই এই প্রসঙ্গে শুনতে হতো মাসি-পিসি-আত্মীয়স্বজনদের কথা, বিয়েটাই যেন ছিল মেয়েদের জীবনের প্রধান ঘটনা। আর এখন মেয়েরা বিয়ের খুব ভালো সম্বন্ধও উড়িয়ে দেয় এক কথায়।

বিমানবিহারী অলির বিয়ের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখান না। মেয়ে যদি বিয়ে একেবারেই না করে, তাতেও তাঁর আপত্তি নেই, মেয়ে তাঁর ব্যবসা দেখবে। অলি এর মধ্যেই তাঁর প্রকাশনার অনেকটা ভার নিয়েছে।

কলকাতায় ফিরে আসার পর বিমানবিহারী খবর পেলেন যে প্রতাপের ওপর একবার আক্রমণ হয়ে গেছে এর মধ্যে। তাঁরা বেনারস যাবার এক সপ্তাহের মধ্যেই। প্রতাপ চিঠিতে কিছুই জানাননি।

শিয়ালদার কাছেই, প্রতাপ আদালত থেকে বেরুবার পর গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন, সরকার থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে, তিনজন হাকিম এক গাড়িতে যাতায়াত করেন, আর দু’জন। ছিলেন প্রতাপের খানিকটা পেছনে। একটি ছেলে হঠাৎ যেন তাঁর সামনে মাটি খুঁড়ে উঠে একটা ছুরি তুললো। এক সময় ফুটবল খেলতেন প্রতাপ, এখনও তাঁর স্নায়ু শিথিল হয়নি, তিনি হাতের গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগটি সঙ্গে সঙ্গেই তুলে ধরলেন বুকের কাছে, ফলে ছুরিটা তাঁর ডান বাহুতে খানিকটা ঘেঁষে গেল। পরের মুহূর্তেই প্রতাপ সেই ব্যাগটি দিয়ে ছেলেটির মুখে একটা আঘাত করলেন। তারপরই হৈ চৈ উঠে গেল, ছেলেটির আরও দু’জন সঙ্গী ছিল, তারা একটা বোমা ফাটালো, সেটা অবশ্য পালাবার পথ পরিষ্কার করবার জন্য।

ছেলে তিনটিকে ধরা গেল না। কেউ অবশ্য তাদের ধরার জন্য পিছু ধাওয়াও করেনি।

প্রতাপের জামা রক্তে ভিজে গেলেও প্রতাপের আঘাত তেমন গুরুতর না। অন্য হাকিমদের অনুরোধেও তিনি হাসপাতালে যেতে রাজি হননি, সোজা বাড়ি চলে এসেছিলেন, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে নিয়েছিলেন ব্যাণ্ডেজ।

বিমানবিহারীর সঙ্গে দেখা হবার পর প্রতাপ বলেছিলেন, আরে না না, ওরা আমাকে মারতে আসেনি। আমাকে নিশ্চয়ই অন্য কারুর বদলে ভুল করে…। আমাকেই টারগেট করলে কি ওরা এত সহজে ছেড়ে দিত? ওরা তিনজন ছিল, সঙ্গে বোমা ছিল…। আমাকে ওরা মারবে কেন বলো! আমি তো ক্রিমিন্যাল কেস বা পলিটিক্যাল কেস করি না। কোনো নকশাল ছেলেকে শাস্তিও দিইনি…

কী জন্য যে কে কাকে মারছে সেটাই তো বোঝার উপায় নেই, যাদবপুরের ভাইস চ্যান্সেলর যেদিন রিটায়ার করলেন, সেদিনই বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে খুন করার কী যুক্তি থাকতে পারে? সব খুনই কি নকশাল ছেলেরা করছে? এখন তো খুনের কারবারে নেমে পড়েছে অনেকেই। এমনকি কারুর ওপর ব্যক্তিগত রাগ থাকলেও তাকে খুন করে সেটা রাজনৈতিক হত্যা নামে চালিয়ে দেওয়া যায়। এই সব খুন নিয়ে পুলিশও মাথা ঘামায় না, তারা নকশালদের মারতে ব্যস্ত।

বাবলুর বাবা হিসেবে অন্য পার্টির ছেলেদেরও রাগ থাকতে পারে প্রপের ওপর, তারই হয়তো প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সে কথা বিমানবিহারী বললেন না। ছেলের ব্যাপারে প্রতাপ খুবই স্পর্শকাতর। প্রতাপের এখনও দৃঢ় ধারণা শিলিগুড়িতে বাবলু নিজের হাতে কারুকে খুন করেনি, তার কোনো বন্ধু-টন্ধুর দায়িত্ব সে ইচ্ছে করে নিজের কাঁধে নিয়েছে।

প্রতাপকে সাবধানে চলাফেরা করার জন্য উপদেশ দেওয়ার কোনো মানে হয় না। বিমানবিহারী নিজেই বা কী করে সাবধান হবেন?

চোর-ডাকাতদের সম্পর্কে সাবধান হওয়া যায়, যুদ্ধবিগ্রহ শুরু হলে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করা যায়, কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা খুনী হয়ে উঠলে তাদের সম্পর্কে আর কী করে সতর্ক হওয়া যাবে? এরা তো প্রায় নিজেদের বাড়ির ছেলেরই মতন। নানান কাজে, এই বয়েসী ছেলেরা বাড়িতে বা অফিসে অনবরত আসে, তাদের যে-কেউ হঠাৎ একটা ছুরি বা রিভলভার বার করতে পারে। রাস্তাঘাটে যে-কেউ একটা কথা বলার ছুতো করে হঠাৎ মেরে দেয়। এই রকমই তো ঘটছে। সন্ধের পর কোনো কোনো রাস্তায় যাওয়াই নাকি অপরাধ! কাগজে এরকম খবর বেরোয় যে মফস্বলের কোনো ছেলে হয়তো কলকাতায় এসে কোনো আত্মীয়ের বাড়ির ঠিকানা খুঁজছে, তাকে স্পাই সন্দেহ করে খতম করে দেওয়া হলো! পুলিশ থেকে তো ম্যাপ এঁকে ঘোষণা করে দেওয়া হয়নি যে সন্ধের পর কলকাতার কোন্ কোন্ রাস্তায় ঢাকা নিষিদ্ধ!

বিমানবিহারী গাড়িতে চলাফেরা করেন, তাঁর তবু খানিকটা নিরাপত্তা আছে। বাড়ির দরজায় একজন দারোয়ান বসিয়েছেন। কিন্তু প্রতাপ যেন বেপরোয়া। আদালতে যাওয়া-আসার সময়টুকু শুধু তিনি গাড়ি পান, কিন্তু অন্য সময় বাড়িতে বসে থাকার মানুষ তিনি নন। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে বাজারে যান। ছুটিছাটার দিনে বাসে-ট্রামে ঘোরেন। একবার যার ওপর আক্রমণ করে বিফল হয়েছে, পরের বার তাকে পুরোপুরি শেষ করে দেবার জন্য যে আততায়ীরা সুযোগ খুঁজবে, সে সম্পর্কে প্রতাপের কোনো ভূক্ষেপ নেই। যা হয় হোক, এই রকমই যেন তাঁর মনোভাব।

এবারেও কৃষ্ণনগরে আসার আগে,বিমানবিহারী প্রতাপকে সঙ্গে আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মমতার সামান্য শরীর খারাপ, এই অজুহাতে প্রতাপ এড়িয়ে গেছেন। মমতা আলসারে কষ্ট পান, কৃষ্ণনগরের জল ভালো, এখানে কয়েকদিন থাকলে মমতার উপকারই হতো।

কলকাতার রাস্তায় এখন সব সময় ভয়ে ভয়ে চলতে হয়। সারা ভারতেই এখন কলকাতা সম্পর্কে বিষম বদনাম। অফিসের কাজে বা ব্যবসার কাজেও বম্বে ও দিল্লি থেকে কেউ এখন কলকাতায় আসতে চায় না। বিদেশী টুরিস্টরা তো কলকাতার নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে। কৃষ্ণনগরে এসে বিমানবিহারী অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলেন। এটা তাঁর জন্মস্থান, নিজের জায়গা, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে তাঁদের পূর্ব পুরুষের ইতিহাস আছে এই শহরে। তাঁদের এক পূর্ব পুরুষের সঙ্গে কবি রামপ্রসাদের পরিচয় ছিল। রামপ্রসাদের নিজের হাতে লেখা দু’খানি গানের পাণ্ডুলিপি তাঁদের পারিবারিক সম্পদ।

বিমানবিহারী এই শহরের অনেক মানুষকে চেনেন, বছরে তিন চারবার এখানে নিয়মিত আসেন, তাঁর মায়ের নামে এখানে একটি স্থানীয় স্কুলের একাংশে পাকা বাড়ি তুলে দিয়েছেন। জ্ঞাতিদের সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই, তাঁর কাকাদের সঙ্গে সম্পত্তি আপোসে ভাগ করা হয়ে গেছে। কাকা এখন জীবিত নেই কিন্তু তাঁর ছেলেরা তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। এখানে কারা এসে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগালো? আগুনে যত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার জন্য নয়, তাঁর জন্মস্থানে কেউ তাঁকে অবাঞ্ছিত মনে করে, এই ধাক্কাটাই বেশী করে বিমানবিহারীর মনে লেগেছে!

গো-বদ্যি আসবার আগেই থেমে গেল আহত গরুটার আর্তনাদ। যারা আগুন লাগিয়েছে। তারা গোয়ালঘর আর হাঁসঘরের দরজা খুলে দিতে পারতো না? তাহলে অবোলা প্রাণীগুলোকে মরতে হতো না এমন ভাবে। মানুষের ওপরেই তো মানুষের রাগ থাকে। ওদের ওপরে তো নয়?

একটা জিনিসও খোয়া যায়নি, শুধু তিনটে গরু চুরি করে নিলেও অনেক টাকা পেত। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, চোর-ডাকাতদের কাজ নয়, যারা আগুন লাগিয়েছে তাদের উদ্দেশ্য শুধু ধ্বংস করা!

অলি দুকাপ চা নিয়ে এসে বললো, বাবা তোমরা ভেতরে যাও, এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে?

রাজচন্দ্র বললেন, ইস অলি-মা, তোমার মুখখানা যে কালি বন্ন হয়ে গেছে। তুমি আর আঁচের কাছে যেও না!

অলি আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দুঃখী গলায় বললো, বাবা, তিনটে হাঁস মরে গেছে, আর দুটোও বেশীক্ষণ বাঁচবে না। ওগুলো কী হবে?

বিমানবিহারীর বদলে রাজচন্দ্রই বললেন, ফেলে দিতে হবে। মরা হাঁস খেতে নেই। কিংবা দ্যাখো যদি ঐ যারা বাইরে থেকে এসেছে তারা কেউ নেয়!

অলি বললো, আমি খাবার কথা বলিনি। যে-দুটো এখনো বেঁচে আছে, ওদের গায়ে কী বার্নল লাগানো যায়?

বিমানবিহারী কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি বাড়ির বার মহলের দিকে চলে গেলেন। রাজচন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু রাজচন্দ্র কিছুতে তাঁর সঙ্গ ছাড়বেন না। কথা বলা তাঁর নেশা, শেষ রাত্রে তিনি ঘুম ভেঙে উঠে এসেছেন, এখন বিমানবিহারীর ওপর প্রচুর উপদেশ বর্ষণ করে তার ক্ষতিপূরণ করবেন।

বিমানবিহারীর সঙ্গে যেতে যেতে রাজচন্দ্ৰ নিচুগলায় বললেন, তোমার ঐ খুড়তুতো ভাইগুলো-মুখে খুব মিষ্টি ভাব থাকে, ওদের বিশ্বাস করো না, এই আমি বলে দিলাম, কখন যে কুলোপানা চক্কোর তুলবে তার ঠিক নেই!

বিমানবিহারী বললেন, রাজুদা, ছোটকাকার ছেলেদের সঙ্গে আমার তো আর কোনো স্বার্থের সম্পর্ক নেই। তবু দেখুন ওরা নিজেরাই গায়ে পড়ে আমার উপকার করতে এসেছে।

–ওসব লোক-দেখানো ব্যাপার, বুঝলে? ওরাই যে আগুন লাগায়নি, তার কোনো গ্যারান্টি আছে? এটাই ওদের কায়দা বুঝলে, বাঁ হাত বাড়িয়ে তোমাকে সাহায্য করবে, আর ডান হাতে তোমাকে ছুরি মারবে!

রাজচন্দ্র একটু আগেই নকশালদের দায়ী করেছিলেন, এখন আবার বিমানবিহারীর খুড়তুতো ভাইদের নামে দোষ চাপাচ্ছেন। বয়েস হয়েছে, কখন কী বলেন মনে রাখতে পারেন না।

এটাও বিমানবিহারী জানেন যে, কিছু কিছু লোকের ব্যাধি থাকে সব সময় অপরের নামে নিন্দে করা। এই যে রাজচন্দ্র তাঁর খুড়তুতো ভাইদের নামে তাঁকে বিষিয়ে দিতে চাইছেন, এতে ওর নিজের কোনো লাভ নেই। শুধু শুধু ঝগড়া বাঁধিয়েই আনন্দ।

বিমানবিহারী রাজচন্দ্রের কোনো কথায় গুরুত্ব দেন না, কিন্তু বয়েসে বড় বলে ওঁর মুখের ওপর কোনোও কড়া কথা বলতে পারেন না।

রাজচন্দ্রের বয়েস সত্তরের ওপর, শরীরে এখনও বেশ সামর্থ্য আছে। সারা জীবন জীবিকা অর্জনের জন্য কোনো কাজ করেননি, পারিবারিক সম্পত্তিতেই চলে গেছে। কলকাতা থেকে তিনি দামী চুরুট আনান, আরও তাঁর কিছু কিছু শখের জিনিস কলকাতা থেকে আসে। কিন্তু তিনি নিজে কলকাতায় যেতে চান না। কলকাতার জল-হাওয়া তাঁর সহ্য হয় না।

–অলি-মা’র বিয়ে দাও এবার! দুটো পাস তো দিয়েছে। এরপর মেয়ে অরক্ষণীয়া হয়ে যাবে। আমাদের এখানে একটি সুপাত্র আছে, সম্বন্ধ করবো নাকি? ছেলেটি ম্যাজিস্ট্রেট, ভালো বংশ।

–রাজুদা, অলির বিয়ের ব্যাপারটা আপনি অলিকেই জিজ্ঞেস করবেন। তার অমতে তো কিছু হবে না।

বিমানবিহারীর কণ্ঠস্বরে ঈষৎ বিরক্তি ফুটে উঠেছিল, তাই রাজচন্দ্র চুপ করে গেলেন। বাড়িতে আগুন লেগেছে, সেই চিন্তায় বিমানবিহারী নিমগ্ন, এখন কি মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করার সময়?

একটু পরে রাজচন্দ্র আবার সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, বিমান, তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি নাকি একটা খুনে নকশাল ছেলেকে বিলেতে পাঠিয়ে দিয়েছো?

এবার বিমানবিহারী দারুণ চমকে উঠলেন। যে ব্যাপারটি অত্যন্ত গোপন রাখা হয়েছিল, তা কৃষ্ণনগরেও পৌঁছে গেল কী করে? বাতাসে কী খবর ছড়ায়? মাত্র তিন-চার জন ছাড়া বাবলুর ঘটনা আর কারুরই জানবার কথা নয়। অথচ যে রাজচন্দ্র কখনো কলকাতায় যান না, তাঁর কানেও এ খবর এতদিন পরে পৌঁছে গেছে!রাজচন্দ্র আবার বললেন, কে যে কার ওপর এখন বদলা নিচ্ছে তার ঠিক নেই, বুঝলে? নকশালদের মধ্যেও দল ভাগ হয়ে যাচ্ছে শুনছি। তুমি ঐ যে একজনকে দেশের বাইরে পাঠিয়েছো, সেজন্য তোমার ওপর অনেকে রেগে আছে। সাবধান, বিমান, সাবধানে থেকো!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়