আরিচা ঘাটে বিশাল যমুনা নদীর দিকে তাকিয়ে মামুন ভাবলেন, নিয়তি এবার কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? সামনে কী আছে?

অন্ধকার হয়ে এসেছে। আজ আর নদী পার হবার কোনো উপায় নেই। অন্য সময় আরিচার এই ফেরীঘাটে কত ব্যস্ততা থাকে, আজ একেবারে শুনশান, একটাও লঞ্চ নেই, সৈন্যরা যাতে ব্যবহার করতে না পারে সেইজন্য সব কটা ফেরী লঞ্চ ওপারে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকা থেকে অনেকগুলো পরিবার এই ফেরীঘাটে এসে দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ভাবে। কেউ কোনো কথা বলছে না, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত ভয়ে চুপ করে আছে।

একটু পরে কয়েকটি ছেলে এসে বললো, আপনারা ইস্কুল বাড়িতে যান, ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। তাছাড়া আর কী করবেন!

সেই ছেলেরাই সাহায্য করলো মালপত্র বয়ে নিয়ে যেতে। স্কুলের দোতলার একখানা ঘরে আরও দুটি পরিবারের সঙ্গে জায়গা পেলেন মামুনরা। হেনা আর মঞ্জু শুয়ে পড়লো দেয়াল ঘেঁষে, মঞ্জুর ছেলে সুখুকে নিয়ে মামুন আবার বেরুলেন কিছু খাবার কিনে আনার জন্য। পুঁটুলিতে করে বেশ খানিকটা চিড়ে-গুড় নিয়ে এসেছেন মামুন, তা থাক ভবিষ্যতের জন্য, এখানে দুএকটা খাবারের দোকান খোলা রয়েছে।

সুখুর হাত শক্ত করে ধরে আছেন মামুন। ট্রাকে করে আরো লোক আসছে, ফেরী বন্ধ দেখে উদভ্রান্তভাবে ছোটাছুটি করছে অনেকে, এরপর আর ইস্কুল বাড়িতেও জায়গা হবে না। এত লোক রাত্তিরে থাকবে কোথায়? দোকানগুলো থেকেও খাবার শেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত, মামুন ছ’খানা রুটি আর কিছু শুকনো কাবাব জোগাড় করতে পারলেন অতি কষ্টে।

খাবারের দোকানে স্থানীয় একজন স্কুল মাস্টার বিবর্ণমুখে মামুনকে জিজ্ঞেস করলেন, ঢাকায় ঠিক কী হয়েছে বলেন তো! নানাজনের কাছে নানান কথা শুনতেছি। আমার ফেমিলি আছে ঢাকায়, তাগো কোনো খবর পাই নাই।

মামুন শুধু বললেন, ঢাকার খবর ভালো নয়!

তা ছাড়া আর কী বলবেন মামুন। এখনো সব কিছুই যেন এক অবিশ্বাস্য, চরম দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। এ কী সত্যি হতে পারে যে নিজের দেশের সরকার রাস্তায় মিলিটারি নামিয়ে সাধারণ নিরীহ লোকদের পর্যন্ত গুলি করে মারছে? কোনো যুক্তিতেই এটা বিশ্বাস করা যায় না, তবু এটাই ঘটছে। ঢাকার পথে পথে পড়ে আছে নিদোষ মানুষের লাশ।

পচিশে মার্চ রাতে এই ভয়াবহ কাণ্ড শুরু হবার পর মামুন কোনোক্রমে বাড়ি ফিরে তারপর আর তিন চারদিন তিনি পথে বার হননি। তবু তিনি একসময় বুঝতে পারলেন যে ঢাকায় থাকা তাঁর পক্ষে কোনোক্রমেই নিরাপদ নয়। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে আওয়ামী লীগের সদস্যদের খুন করছে, সেই সঙ্গে মারছে সাংবাদিক, অধ্যাপক ও ছাত্রদের। কোনো দেশের আর্মি কামান দেগে প্রেস ক্লাব উড়িয়ে দেয়, এরকম কেউ শুনেছে? বাঙালী পুলিশদের মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সৈন্যদের নিরস্ত্র করে খতম করে দেবারও চেষ্টা করেছে। ইয়াহিয়া খান কি উন্মাদ হয়ে গেল, সমগ্র বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করে দিয়ে সে পাকিস্তান শাসন করবে?

শেখ মুজিবের কোনো সন্ধান নেই। তিনি নিজেই আত্মগোপন করেছেন, না সৈন্যরা তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গেছে, তা কেউ জানে না। কিন্তু জানতে পারা গেছে যে বাঙালীরা শুধু পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে না, দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস তুমুল লড়াই করছে পশ্চিম পাকিস্তানী আর্মির সঙ্গে। চট্টগ্রাম শহর থেকে কিছুটা দূরে কালুরঘাটে রেডিও ট্রান্সমিটিং সেন্টারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র, সেখান থেকে জাতির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমান নামে একজন মেজর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।

গতকাল মামুন দেখলেন তাঁর বন্ধু কবি ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদকে। আর্মি এসে যখন প্রেস ক্লাবের লাল রঙের বিল্ডিংটাতে কামান দাগতে শুরু করে, তখন ফয়েজ ছিলেন ঐ প্রেস ক্লাবের দোতলায়। সাংঘাতিক ভাবে আহত হলেও তিনি সেখান থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা মসজিদে। তিনদিন তিনরাত একটা বাথরুমে লুকিয়ে থেকে কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন সেই ফয়েজ আহমদ মামুনকে বললেন, পালাও, ঢাকা থেকে পালাও, কোনো গ্রামে চলে যাও, ওরা আমাদের শেষ করে দেবে, ‘ইত্তেফাক’-এ যারা এক লাইনও লিখেছে, তাদের কারুকে ওরা ছাড়বে না। মামুন, তুমি আজই সরে যাও ঢাকা থেকে।

ফিরোজা বেগম কয়েকদিন আগে ছোট মেয়েকে নিয়ে টাঙ্গাইলে বাপের বাড়িতে গেছেন, তাঁকে খবর দেবার উপায় নেই। মামুনের পক্ষে টাঙ্গাইলে যাওয়াও নিরাপদ নয়, সেখানেও নিশ্চয়ই তাঁর খোঁজ পড়বে বড় মেয়ে হেনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ার উদ্যোগ করতেই মঞ্জু এসে বললো, সেও তার ছেলেকে নিয়ে মামুনের সঙ্গে যাবে। বাবুল এখন ঢাকা ছেড়ে যেতে রাজি নয়, তবে মামুনের সঙ্গে তার স্ত্রী ও সন্তানকে পাঠাতে তার আপত্তি নেই।

বাবুলের ব্যবহারটা বেশ বিচিত্র। পচিশে মার্চ রাত্তিরে শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চূড়ান্ত মিটিং হবার কথা, কিন্তু তার আগেই প্রেসিডেন্ট সাহেব সন্ধ্যেবেলা চুপিচুপি বিশেষ বিমানে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন করাচীর দিকে। সৈন্যবাহিনীকে হুকুম দিয়ে গেলেন, নিরস্ত্র বাঙালীদের হত্যা করতে। এই দারুণ বিশ্বাসঘাতকতাতেও বাবুল বিচলিত নয়। তার ধারণা, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সব শান্ত হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে সামরিক শাসন পাকিস্তানের পক্ষে অনেক ভালো।

চতুর্দিকে খুন ও অত্যাচারের কাহিনী শুনে মজু ভয় পেয়ে আগেই ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে চাইছিল, কিন্তু বাবুল তাতে কর্ণপাত করে নি। সে বলেছে, এত ভয় কিসের? ঐ তো দ্যাখো না, জাহানারা ইমামরা কি পালিয়েছেন? কামাল কিংবা পল্টনরা তো ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে না। আমাদের বাসায় কোনো অ্যাটাক হবে না।

কিন্তু মামুনের সঙ্গে মঞ্জু গ্রামের দিকে যেতে চায় শুনেই বাবুল হঠাৎ মত বদলে ফেললো। বেশ আগ্রহের সঙ্গেই বললো, তুমি তোমার মামুনমামার সঙ্গে যেতে চাও? তা হলে যাও।

মঞ্জু তার স্বামীকেও সঙ্গে আনবার জন্য খুব সাধাসাধি করেছিল, তবু বাবুলকে টলানো গেল না। শেষ মুহূর্তে মঞ্জু তার হাত ধরে কাতর ভাবে বলেছিল, তুমি সাবধানে থাকবে কথা দাও!

বাবুল হেসে বলেছিল, তোমরা ভালো থেকো!

একখানা গাড়ি জোগাড় করা হয়েছিল এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে। বিকেল চারটে থেকে কারফিউ, সকালে হঠাৎ গুজব শোনা গেল যে মীরপুরের কাছে ব্রীজটা উড়ে গেছে, ওদিক দিয়ে। যাওয়া যাবে না। কিন্তু রেডিওতে ঘোষণা করা হচ্ছে যে মীরপুরের ব্রীজ ঠিক আছে, যানবাহন সব চলছে স্বাভাবিক ভাবে। ঝুঁকি নিয়ে মামুন বেরিয়ে পড়লেন। মীরপুরের কাছে এসে দেখলেন, ব্রীজের পাশে আর্মি ঘোরাঘুরি করছে, ব্রীজটার ক্ষতি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এরমধ্যেই মেরামত করা হয়েছে অনেকটা।

মীরপুর ছাড়িয়ে আমিনবাজারের কাছে আসতেই চোখে পড়লো আর্মি কনভয়। মেশিনগানের লম্বা নলগুলো দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে। মামুন মাথা নীচু করে রইলেন, যেন তাঁর মুখ কেউ দেখতে না পায়। তাঁর অতি প্রিয় ঢাকা শহর ছেড়ে তিনি পালাচ্ছেন চোরের মতন। নয়ারহাটে পৌঁছোতেই শুনতে পেলেন পেছনে গোলাগুলির শব্দ। সেনাবাহিনী আবার কোথাও শুরু করেছে ধ্বংসযজ্ঞ।

কোথায় যে যাবেন মামুন তা এখনও ঠিক করতে পারেননি। একবার ভাবলেন, মানিকগঞ্জে তাঁর এক ছেলেবেলার বন্ধু থাকে, তার বাড়িতে উঠবেন। তারপর আবার ঠিক করলেন, ঢাকা থেকে আরও অনেক দূরে সরে যাওয়াই ভালো, পাবনা কিংবা বগুড়ার দিকে।

আরিচা ঘাটে এসে যে ফেরীর অভাবে এভাবে আটকা পড়তে হবে তা আগে কল্পনা করতে পারেননি। যদি কালকেও ফেরী না চলে? এই বিশাল নদী নৌকোতে পার হওয়া যায় বটে কিন্তু এত মানুষ এসে জমা হয়েছে, নৌকোও পাওয়া যাবে কী? হেনা, মঞ্জু আর সুখুকে সঙ্গে এনে তিনি আরও মুশকিলে পড়েছেন, একলা হলে তাঁর দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না। যে-সব মানুষ উদ্যোগী হয়ে যে-কোনো পরিস্থিতিতে ঝটপট একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলতে পারে, মামুন যে সেই দলে পড়েন না। তিনি ভালো করে মিশতেই পারেন না অচেনা লোকের সঙ্গে।

খাবার নিয়ে ফিরে এসে ইস্কুল বাড়ির দোতলায় উঠতে উঠতে একজন লোককে দেখে মামুনের চেনা চেনা মনে হলো। বেশ হৃষ্টপুষ্ট কালো চেহারা, মোটা গোঁফ, মাথায় অনেক চুল, মামুনকে দেখে সেই মানুষটিও থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, মামুনভাই?

মামুনের তখনই মনে পড়ে গেল, এই মানুষটিকে তিনি ইত্তেফাক অফিসে দেখেছেন একসময়, সম্ভবত রিপোর্টারের কাজ করতো, খুব রসিক লোক, নিজে প্রাণ খুলে হাসতে এবং অন্যদের হাসাতে জানে। এর নাম এম আর আখতার। সবাই ডাকতো মুকুল বলে। মাঝখানে অনেকদিন এর সঙ্গে দেখা হয়নি।

এখন হাস্য-পরিহাসের সময় নয়, প্রত্যেকের ভুরুতেই উদ্বেগ মাখানো, কথাও সব এক। চেনাশুনো কে কে মারা গেছে আর কার কার সন্ধান নেই। দু’চারটি কথার পর মামুন। আখতারকে অনুরোধ করলেন, কাল নৌকোর ব্যবস্থা করতে পারলে আমাদেরও সঙ্গে নেবেন।

আখতার বললেন, অবশ্যই, অবশ্যই! মাঝ রাত্তিরে সবাই যখন শুয়ে পড়েছে, নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে বাতি, কে ঘুমিয়েছে, কে যে জেগে আছে তা বোঝার উপায় নেই, তখন মামুন শুনতে পেলেন একটি নারীকণ্ঠের কান্না। কোনো ভাষা নেই, শুধু একটা টানা শব্দ, সে শব্দ যেন উঠে আসছে হৃদয়ের অতল গভীর থেকে, এমনই একটা তীব্র শোক আছে সেই কান্নার সুরে যা শুনলেই বুকটা মুচড়ে ওঠে।

একটু পরেই মঞ্জু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, মামুনমামা, কে কান্দে?

পাশ থেকে হেনা বললো, এই ঘরে কেউ না।

মামুন বুঝলেন, হেনা আর মঞ্জু জেগেই আছে, আজ রাতে বোধহয় কারুরই ঘুম হবে না। কান্নার শব্দটা এ ঘরের নয় ঠিকই। মামুন উঠে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। সব কটা ঘরেই মানুষজন ভরা, কোনো ঘরেরই দরজা বন্ধ নয়, মামুন একটার পর একটা ঘরে গিয়ে উঁকি মারলেন, কোনো ঘরেই সেই ক্রন্দনরতা নারীকে দেখতে পেলেন না। আরও অনেকে সেই কান্নার শব্দ শুনে উঠে বসেছে।

হঠাৎ মামুনের শরীরটা ঝিমঝিম করে উঠলো। এই কান্না কি অশরীরী? কিংবা সারা দেশ জুড়ে স্বামীহারা, সন্তানহারা, ভাইহারা নারীরা যে কান্নার রোল তুলেছে, এই কান্না তারই প্রতীক। দেশ-জননীই এমন আকুল হয়ে কাঁদছে।

পরদিন ভোরে উঠে ফেরীঘাটে এসে পাওয়া গেল একটা নৌকো। বিকেলের দিকে নৌকো পৌঁছোলো নগরবাড়ি। সেখানে এসে মামুন শুনলেন যে পাবনায় গণ্ডগোল চলছে খুব, সেই তুলনায় বগুড়ার খবর আশাপ্রদ। বগুড়ায় ছাত্ররা মুক্তিবাহিনী গঠন করে বেশ কিছু পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করেছে, বাকি সৈন্যরা পালিয়ে গেছে। বগুড়ায় আপাতত কোনো শত্রুর চিহ্ন নেই। সুতরাং মামুন ঠিক করলেন, পাবনার বদলে তিনি বগুড়ার দিকেই যাবেন।

কিন্তু যাওয়া যাবে কী করে? নগরবাড়িতেই শোনা গেল যে পেট্রল-ডিজেল পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও, বাস চলাচল বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। তা ছাড়া, নানান জায়গায় গ্রামের লোকেরা রাস্তা কেটে রেখেছে, যাতে আর্মির ট্রাক যেতে না পারে। বহুলোক এখন শহর ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে গ্রামের দিকে।

বগুড়ার দিকের একটা বাস পাওয়া গেল ভাগ্যক্রমে। তাতেও অবশ্য যাওয়া গেল না শেষ পর্যন্ত, বাঘাবাড়ির কাছাকাছি এসে দেখা গেল রাস্তা বন্ধ, রাস্তার মধ্যে গাছ কেটে ফেলা রয়েছে, কিছুটা রাস্তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

এবার হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। মামন সঙ্গে মালপত্র বিশেষ কিছু আনেননি, শুধু কয়েকটা কাঁধ ব্যাগ। সুখু বেশ হাঁটতে পারে, তাকে কোলে নিতে গেলেই বরং সে আপত্তি করে। হেনা আর মঞ্জু শহুরে মেয়ে, তাদের হাঁটার অভ্যেস নেই, চৈত্রমাসের গনগনে রোদে তাদের মুখ লাল হয়ে ওঠে।

বাঘাবাড়ির ঘাট পেরুবার পর পাওয়া গেল আর একটি অতি লজঝরে চেহারার বাস। একটি ছোকরা কন্ডাকটর সেই বাসের গা চাপড়ে চাপড়ে বলছে, আসেন, আসেন, পংখীরাজ, পংখীরাজ! লাস্ট ট্রিপ, আর চান্স পাইবেন না!

প্রতি মুহূর্তে থেমে যাবে থেমে যাবে ভাব করেও সেই বাসটা চলতে লাগলো বেশ। এক সময় তাকে বাধ্য হয়ে থামতে হলে অবশ্য, সেটা তার নিজের দোষে নয়। উল্লাপাড়া লেভেল ক্রসিং-এ রাস্তা বন্ধ, একটা মালগাড়ি দিয়ে সেই ক্রসিংটা আটকে দেওয়া হয়েছে। বাস রেল লাইনের ওপারে যেতে পারবে না। বাস থেকে নেমে আবার পদযাত্রা।

আখতার সাহেব করিৎকর্মা মানুষ, তিনি উল্লাপাড়া ডাক বাংলোতে রাত্তিরটা থাকার ব্যবস্থা করে ফেললেন। মামুনরা এই পরিবারটির সঙ্গ নিয়ে কিছুটা সুবিধে ভোগ করছেন। আখতার সাহেবের চেয়ে মামুন বয়সে প্রবীণ, তাছাড়া একটা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এবং জেল খেটেছেন বলে লেখক-সাংবাদিকদের কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র, কিন্তু আখতারের মতন একজন চেনা লোক না পেলে কেউ এই ডামাডোলের মধ্যে তাঁকে পাত্তাই দিত না।

ডাকবাংলোর বেয়ারা-চৌকিদার সব উধাও। খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। হোটেলও নেই এখানে। শোনা গেল যে বাজারের কাছে একটা লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে, সেখানেই একমাত্র খাবার পাওয়া যেতে পারে। অগত্যা যেতে হলো সেখানেই। লঙ্গরখানায় অনেকেই পাত পেড়ে বসে গেছে, দেওয়া হচ্ছে শুধু গরম ভাত আর ডাল। আর কিছু না। আখতার সাহেবের ছেলে মেয়েরা আর সুখু মিয়া সেই ভাত ডাল নিয়ে বসে রইলো, তাদের ধারণা, এরপর কোনো তরকারি বা ভাজাটাজা আসবে। শুধু ডাল আর ভাত যে খাওয়া যায়, তা তারা জানেই না। মামুন দেখলেন, মঞ্জুর চোখ ছলছল করছে। তিনি ফ্যাকাসে ভাবে বললেন, এরপর যে ভাগ্যে আরও কী আছে তা কে জানে!

সেই রাত্রে মামুনের হু হু করে জ্বর এসে গেল। মামুন নিজের ওপর মহা বিরক্ত হয়ে উঠলেন। এই কি জ্বরের সময়? যেতে হবে আরও অনেকটা পথ। তার জ্বরের কথা টের পেয়ে গেলে অন্যরা বিব্রত হবে। কিছুতেই কারুকে জানানো চলবে না। সুখু তাঁর বুক ঘেঁষে শুয়েছে। বাচ্চা ছেলে হলেও সে জ্বরতপ্ত শরীর ছুঁয়ে বুঝতে পারবে ঠিকই, মামুন তাই খানিকটা সরে গেলেন।

বগুড়ায় মহিলা কলেজের সামনে ছাত্রদের সঙ্গে পাকিস্তানী আর্মির জোর লড়াই হয়েছে, শেষ পর্যন্ত খান সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। আঁড়িয়াবাজারের মিলিটারি ক্যাম্পেরও পতন হয়েছে, জয়জয়কার পড়ে গেছে মুক্তিবাহিনীর। উল্লাপাড়াতেই শোনা গেল এই সব কাহিনী। বগুড়া শহরে জলেশ্বরীতলায় মামুনের এক শ্যালকের একটা ওষুধের দোকান আছে, সে যদি শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে না থাকে, তাহলে বগুড়ায় আশ্রয় পাবার কোনো অসুবিধে হবে না।

সারা রাত মামুন জ্বরের ঘোরে ছটফট করলেন, পরদিন সকালেও জ্বর ছাড়লো না। কিন্তু কারোকে জানতে দেওয়া হবে না। তিনি সকলের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে রইলেন।

আর বাস পাবার কোনো আশা নেই, তবে সাইকেল রিক্সা আছে। কিছু দূর অন্তর অন্তর রিক্সা বদল করে যাওয়া যেতে পারে। সুযোগ বুঝে রিক্সাওয়ালারা যাচ্ছেতাই ভাড়া হাঁকছে। না দিয়েই বা উপায় কী!

এই রিক্সা-যাত্রাতেও স্বস্তি নেই। এক মাইল দু মাইল অন্তর অন্তরই রাস্তা কাটা। রিক্সাচালকরা আগেই চুক্তি করে নিয়েছিল যে রাস্তা কাটা থাকলে সওয়ারিদেরই রিক্সা ঘাড়ে করে অন্য ধারে নিয়ে যেতে হবে। মামুনের প্রায় একশো পাঁচ জ্বর, চোখ জ্বালা করছে, ঝাঁ ঝাঁ করছে কান, সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা, তবু তিনি টু শব্দটি করছেন না, যথাসময়ে রিক্সা বইবার জন্য কাঁধ দিচ্ছেন।

চান্দাইকোনা পৌঁছোবার আগে ঠিক ন’বার রিক্সা থেকে নেমে, রিক্সাটাকেই কাঁধে করে পার হতে হলো গর্ত।

চান্দাইকোনায় এসে এই তিনজন রিক্সাচালক আর যেতে রাজি হলো না। এবারে অন্য রিক্সা ধরতে হবে। এখানে একজন লোক হঠাৎ মামুনের সামনে এসে বললো, চেনা চেনা লাগে, আপনে ‘দিন কাল পত্রিকার সম্পাদক সাহেব না?

মামুন মৃদু হেসে বললেন, ছিলাম একসময়ে, এখন যে মালিক, সে-ই সম্পাদক। আমি বেশ কিছুদিন আগেই বিতাড়িত!

লোকটি বললো, আপনিই তো কাগজটা স্টার্ট করেছিলেন। সার, আপনার আটিকেলগুলো আমি সব পড়তাম, বড় ভালো লাগতো। আমার নাম এজাজ আহমদ, বগুড়ায় আমার বুক স্টল ছিল, ঢাকায় গিয়া আপনারে তিন চাইরবার দেখছি।

অতি ভক্তিতে লোকটি নীচু হয়ে মামুনকে কদমবুসি করতে যেতেই মামুন তার হাত ধরে বাধা দিলেন। এজাজ আহমদ চমকে উঠে বললো, এ কী, সার, আপনার হাত এত গরম…

চান্দাইকোনায় এম. আর. আখতার মুকুলের পরিবারের সঙ্গে মামুনদের বিচ্ছেদ হলো। এজাজ আহমদ এরকম অসুস্থ অবস্থায় কিছুতেই মামুনকে যেতে দিল না বগুড়ায়। এক দৈনিক পত্রিকার খ্যাতিমান সম্পাদক এতখানি জ্বর নিয়ে আবার ঘাড়ে করে সাইকেল রিক্সা বইবেন, এই চিন্তাও যেন তার কাছে অসহ্য। চান্দাইকোনায় তার বাড়িতে কয়েকদিন বিশ্রাম নেবার পর সে নিজে মামুনদের বগুড়ায় পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিল।

আখতার সাহেবের স্ত্রী মাহমুদা খানম রেবার সঙ্গে হেনা আর মঞ্জুর খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল এর মধ্যে, এখন ছাড়াছাড়ি হতে সজল হয়ে এলো ওদের চোখ। যেন আর কখনো দেখা হবে না।

এজাজ আহমদের বাড়িটি বেশ সুস্নিগ্ধ শকড় একটা উঠোনকে ঘিরে অনেকগুলি মাটির ঘর, চারপাশে প্রচুর গাছপালা, দু’দিকে দুটি পুকুর। মনোরম কোনো গ্রামের বাড়ি বলতে যে ছবিটি ফুটে ওঠে, ঠিক সেই রকমই বাড়ি। রয়েছে ধানের গোলা ও গোয়াল ঘর। উঠোনে একটা তুলসীমঞ্চ দেখে বোঝা যায় এককালে এটা হিন্দুর বাড়ি ছিল। এজাজ আহমেদের আদি বাড়ি ছিল বালুরঘাট, তার মরহুম পিতা একজন হিন্দুর সঙ্গে বাড়ি এক্সচেঞ্জ করে এদিকে চলে এসেছিলেন পার্টিশানের দু’বছর পরেই।

জ্বরের ঘোরে মামুন অজ্ঞান হয়ে রইলেন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা। একজন বৃদ্ধ এল এম এফ পাশ ডাক্তারকে পাওয়া গেল, তিনি শুধু নাড়ি টিপেই বললেন এ নিঘাৎ টাইফয়েড। বগুড়ায় জলেশ্বরীতলায় লোক পাঠিয়েও মামুনের শ্যালকের কোনো খবর পাওয়া গেল না, ওষুধের দোকান বন্ধ করে তার মালিক কোথায় পালিয়েছে কেউ জানে না। চতুর্দিকে লুঠপাট চলছে, ভয়ে এখন কেউই দোকান খোলে না। এমনকি নুন পর্যন্ত সাংঘাতিক দুর্লভ হয়ে উঠেছে।

প্রায় বিনা ওষুধে ও চিকিৎসায়, শুধু বেঁচে থাকার এক প্রবল তাগিদেই যেন মামুন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন সাতদিনের পর। শুধু নিজের জন্য বেঁচে থাকা নয়, মামুনের আর দীর্ঘজীবনের সাধ নেই, কিন্তু এই অচেনা জায়গায়, এমন দুঃসময়ে তিনি হঠাৎ মারা গেলে হেনা মঞ্জুদের কী হবে? জ্বরের ঘোরেও মামুন সেই চিন্তাই করতেন। হেনা আর মঞ্জু দু’জনেরই মুখ। শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে, চোখের নীচে কালি। জ্বরের ঘোর কাটবার পর হেনা আর মঞ্জুকে দেখে মামুনের মনে হলো, চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়লে মানুষ ও পশুর চোখের দৃষ্টির কোনো তফাত থাকে না।

সম্পূর্ণ অনাত্মীয় ও অচেনা হয়েও এজাজ আহমদের পুরো পরিবার মামুনদের যে সেবা যত্ন করলো তার তুলনা নেই। মানুষের স্নেহ ভালোবাসা যে কোথায় কার জন্য জমা থাকে তার ঠিক নেই। চান্দাইকোনার মতন এক অখ্যাত জায়গায় যেন মামুনের অন্নঋণ ছিল।

জ্বর ছেড়ে যাবার পর মামুন সব খবরাখবর নিলেন। এই ক’দিনেই অবস্থা অনেক বদলে গেছে। পঁচিশে মার্চের প্রথম আক্রমণের ঝোঁকে বাঙালীরা প্রচণ্ড মার খেয়েছিল। কতজন যে প্রাণ হারিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। তারপর ই পি আর এবং ছাত্র-যুব মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে বেশ কয়েকটা জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা মার খেয়েছে, ক্রোধ-উন্মত্ত জনতা তাদের ধরে ধরে ছিন্নভিন্ন করেছে। এখন আবার পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী নতুন শক্তিতে সঙঘবদ্ধ হয়ে পুনর্দখল করে নিচ্ছে একটার পর একটা জায়গা। চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার ই পি আর পশ্চাৎ অপসরণ করেছে। ভারত সীমান্তের দিকে। যে-সব জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি ছিল, আমি এসে ফ্লেম থ্রোয়ার দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে সেইসব গ্রাম। যে-কোনো বাঙালী যুবককে দেখা মাত্র গুলি চালাচ্ছে, বাড়ি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে যুবতী মেয়েদের। সেনাবাহিনীকে ঢালাও প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। লুণ্ঠন ও ধর্ষণের। বাবা-মায়ের সামনে মেয়েকে, স্বামীকে দাঁড় করিয়ে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করার ঘটনা শোনা যাচ্ছে প্রত্যেক দিন। শিশুদের শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে গুলি করছে চার পাঁচজন মিলে, যেন টারগেট প্র্যাকটিস।

এদিকে শুরু হয়েছে এক উৎপাত। গ্রামে গ্রামে লেগে গেছে বাঙালী-অবাঙালী দাঙ্গা। দেশ বিভাগের সময় বিহার থেকে যে-সব মুসলমান এইসব অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল, এই চব্বিশ বছরেও তারা বাঙালীদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেনি, তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সমর্থক। আর্মি তাদের লেলিয়ে দিয়েছে বাঙালীদের বিরুদ্ধে।

মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের অস্ত্র গোলা বারুদ ফুরিয়ে এসেছে এর মধ্যেই, অসীম সাহসে তারা সেনাবাহিনীকে মাঝে মাঝে অ্যামবুশ করতে গিয়ে নিজেরাই মরছে দলে দলে।

এজাজ আহমদ সর্বশেষ খবর নিয়ে এলো, রংপুর, পার্বতীপুর পুনর্দখল করে পাকিস্তানী আর্মি এগিয়ে আসছে হিলির দিকে। হিলির বর্ডার দিয়ে মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা সীমান্তের ওপারে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বলে আর্মি হিলিতে এসে ঐ বডার বন্ধ করে দিতে চায়। তারপর তারা নওগা, বগুড়া ও আশেপাশে চিরুনি অপারেশন শুরু করবে।

এজাজ আহমদ ইতস্তত করে বললো, মামুন ভাই, এই অবস্থায় আপনাদের আর এখানে ধরে রাখতে চাই না। বডার খোলা থাকতে থাকতে আপনে ইন্ডিয়া চলে যান। আপনার সঙ্গে মেয়েরা রয়েছে, ওদের এখানে রাখা একেবারেই নিরাপদ নয়। পশুরা যে কী বীভৎস কাণ্ড করতেছে আপনি কল্পনাই করতে পারবেন না মামুনভাই।

মঞ্জু পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল, সে বললো, মামুনমামা, আমরা ঢাকা ফিরে যেতে পারি না?

এজাজ আহমদ বললো, ঢাকায় ফেরার সব পথ বন্ধ। ঢাকায় গোলমাল আরও বেশী!

মামুন বললেন, ইন্ডিয়ায় যাবো কোন্ ভরসায়? তারা আমাদের আশ্রয় দেবে? আমাদের পাসপোর্ট-ভিসা কিছু নাই।

এজাজ বললো, অনেকেই যাচ্ছে। মামুনভাই, সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। এরপর বড়ার সীল করে দিলে আর কোনো উপায় থাকবে না।

মামুন চেষ্টা করলেন বগুড়ায় এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, কিন্তু তাঁর সন্ধান পেলেন না। সেইদিনই জয়পুরহাটে এক বিরাট দাঙ্গার খবর পাওয়া গেল। চতুর্দিকে রব, আর্মি আসছে, আর্মি আসছে।

এজাজ আহমদ একটা জিপ জোগাড় করে দিল, অনেকটা দিশাহারার মতনই মামুন রওনা দিলেন হিলি সীমান্তের দিকে। মঞ্জু আর হেনাকে দেশের মধ্যে রাখা নিরাপদ নয়, তাদের জন্য আশ্রয় নিতে হবে অন্যদেশে! নাৎসী বাহিনী আক্রমণ করেছিল পোলাণ্ড, সেখানকার লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছে, আর এখানে নিজের দেশেরই সেনাবাহিনী, একই ধর্ম…

ক্ষেতপাল এসে নদী পার হতে হবে, একটা কাঠের ব্রীজ রয়েছে এখানে, তার মাঝখানের অংশটা খোলা। গ্রামবাসীরাই সেটা খুলে রেখেছে। এখানে আবার দেখা পাওয়া গেল এম আর আখতার মুকুলের। মুকুল গ্রামবাসীদের বেঝাচ্ছেন যে তাঁদের সীমান্তে পৌঁছোনো বিশেষ প্রয়োজন, প্রবাসী সরকার গঠন করতে না পারলে এই লড়াই বেশীদিন চালানো যাবে না।

এই পথ দিয়ে সশস্ত্র অবাঙালীরা ঢাকার দিকে যাচ্ছে বলে গ্রামবাসীরা ব্রীজটা খুলে রেখেছিল। মুকুলের বাকপটুতায় মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা ভাঙা অংশটা আনতে গেল।

মুকুল মামুনকে বললেন, মামুনভাই, দোয়া করেন, যাতে আর্মি এসে পড়ার আগেই আমরা বডারে পৌঁছাতে পারি!

তারপর নদী পেরিয়ে, পাঁচবিবি হয়ে একসময় দুটি জিপ এসে থামলো জয়পুরহাট সুগার মিলের সামনে। মুকুল সাহেব আগে থেকে ব্যবস্থা রেখেছিলেন, সেখানেই গেস্ট হাউসে কাটানো হলো রাতটা।

পরদিনই পার্বতীপুর থেকে রেল লাইন ধরে কামান দাগতে দাগতে এগিয়ে এলো পাকিস্তানী বাহিনী। তাদের আগে হিলি পৌঁছোতেই হবে, নইলে আর কোনো উপায় নেই। এদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ছোট বাহিনী প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়ে আছে।

রাত্রির অন্ধকারে বাতি না জ্বেলে যাত্রা করলো দুটো জিপ। মেয়েরা অবিরাম সুরা পাঠ করছে। মামুন স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন, ভয় কিংবা উত্তেজনার চেয়েও দারুণ এক বিমর্ষতায় তিনি আক্রান্ত। চল্লিশের দশকে তাঁর মতন যারা পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য প্রাণপণ করেছিলেন আজ তাঁদেরই এরকম অসহায় অবস্থায় পালিয়ে যেতে হচ্ছে পাকিস্তান ছেড়ে! সে সময় কোথায় ছিল ইয়াহিয়া খান, কোথায় ছিল ভুট্টো সাহেব? আজ তারাই পাকিস্তানের রক্ষক ও ভক্ষক?

হিলি রেল স্টেশানে জিপ দুটো পৌঁছোলো রাত বারোটার পর। রেল লাইনের ওপারেই ভারত। যৌবনে মামুন অন্তত দু’বার এ পথে যাতায়াত করেছেন, কিন্তু তখন ওপারটা বিদেশ ছিল না।

মুকুলের সঙ্গে সিরাজগঞ্জের এস ডি ও শামসুদ্দীন সাহেব এসেছেন, তিনি আগেই জানিয়েছিলেন যে ভারতীয় সীমান্ত প্রক্ষীদের সঙ্গে কথা হয়ে আছে, তারা কারুকে ওপারে যেতে বাধা দিচ্ছে না। রেল লাইনের মাঝখানে এসে শামসুদ্দীন সাহেব থেমে গিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বললেন, আমি এবার যাই!

মুকুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, আপনি আমাদের সঙ্গে ওপারে আসবেন না?

শামসুদ্দীন সাহেব হেসে বললেন, বাঘাবাড়ির চরে আমি পজিশন নিয়ে আমার জোয়ানদের রেখে এসেছি। তারা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। আমি কি এখন যেতে পারি? তাছাড়া আপনারা যাতে শিগগিরই সসম্মানে স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসতে পারেন, তার ব্যবস্থা। করে রাখতে হবে তো!

হঠাৎ মঞ্জু হেঁচকি তুলে কেঁদে উঠতেই মামুন তাঁর মাথায় হাত রাখলেন। বলার কিছু নেই। বছরের পর বছর ভারত সম্পর্কে এমন প্রচার করা হয়েছে যে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ধারণা হয়ে গেছে যে ভারত হলো হিন্দু দুশমনদের দেশ। তারা এখন কী ভাবে আশ্রয় দেবে? যদি অপমান করে, লাথি-ঝাঁটা মারে? কতদিন থাকতে হবে সে দেশে, খরচ চলবে কী ভাবে? মামুনের কাছে মাত্র দু’ হাজার পাকিস্তানী টাকা।

শেষবার মাতৃভূমির দিকে তাকিয়ে সবাই পার হয়ে এলো রেললাইন। একজন ভারতীয় সরকারি কর্মচারী অপেক্ষা করছিলেন এদিকে, তিনি বেশ ভদ্রভাবেই বললেন, আসুন, বেশী চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে! নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত আপনারা, ডাক বাংলোতে শোবার ব্যবস্থা আছে, তার আগে থানায় শুধু নাম-ধাম লিখিয়ে নিতে হবে। আসুন।

রাত একটা। থানা মানে পুলিশ চেক পোস্ট, ছোট্ট একটা ঘর, সেখানে ইলেকট্রিসিটি নেই। একজন জমাদার লম্বা একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বেলে ধরেছে, আর বিরাট এক খাতা খুলে বসে আছে গেঞ্জি গায়ে এক রোগা সিঁড়িঙ্গে থানাদার। এই দলটিকে দেখে তিনি বললেন, লাইনে দাঁড়ান, এক এক করে বলুন নাম, বাপের নাম, সাকিন, পেশা।

লিখতে লিখতে মাঝপথে কলম থামিয়ে সেই রোগা পুলিশটি মুখ তুলে বললেন, ভাইগ্যাই যদি পড়বেন, তা হইলে এই গণ্ডগোলটা বাজাইলেন ক্যান, অ্যাঁ?

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সবাই নীরব।

লোকটি আবার বললেন, এলায় আপনারা যে ভাগতেছেন, আপনাগো মনের অবস্থাটা কী? মানে কিনা, আপনাগো মনটা কেমন হাউ হাউ করতাছে?

লোকটির কর্কশ কণ্ঠের সঙ্গে খানিকটা বিদ্রূপ মেশানো। সদ্য ওপার থেকে এসে মাথাভর্তি বিরাট একটা প্রকাণ্ড অনিশ্চয়তার বোঝা নিয়ে যারা দাঁড়িয়েছে, তারা এই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের উত্তরে কী আর বলতে পারে!

পুলিশটি আবার বললো, বুঝছেন, আমাগো বাড়িও বড়ারের হেই মুড়া, মানে বরিশাল। পঞ্চাশ সনের রায়টে বউ-পোলাপান লইয়া ভাগছি। এলায় বুঝছেন, আপনারা যখন আমাগো খেদাইছিলেন, তখন আমাগো মনড়া এইরকমই করছিল! হে ভগবান, কত কিছু দেখাইলা। এবার তো দেখতাছি, হিন্দু-মুসলমান হগলই ভাগতাছে!

মামুন তাকালেন মুকুলের দিকে। তাঁর মুখখানা যেন পাথরের মতন।

সরকারি গাইড ভদ্রলোকটি এবার বললেন, ওসব কথা ছাড়ুন। একটু তাড়াতাড়ি করুন, রাত অনেক হয়েছে, এদের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা রয়েছে

দু’দিন পর হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন মামুন। স্টেশানের বাইরে এসে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ওপারের কলকাতায় সবে মাত্র ভোর হচ্ছে। সেই কলকাতা, তাঁর ছাত্রজীবন ও যৌবনের কলকাতা! গত চব্বিশ বছরে এই শহর কতখানি বদলেছে কে জানে!মামুন মঞ্জুকে বললেন, এক সময় তুই কলকাতায় আসার জন্য কী কান্নাকাটি করেছিলি, তোর মনে আছে মঞ্জু? দ্যাখ, শেষ পর্যন্ত তার সেই কলকাতাতে আসা হলো!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়