ওসমান সাহেবের খাতির-যত্নের চোটে কয়েক দিনের মধ্যেই ওদের ওজন বেড়ে যাবার উপক্রম। প্রত্যেক দিন দু’বেলা এত মশলা দেওয়া খাবার খাওয়ারও তো অভ্যেস নেই কারওর।

আজ চলে এসেছে নিজেদের নতুন বাড়িতে।

বাড়িটি দো-তলা, মোট সাতখানা ঘর। সামনে-পেছনে বারান্দা। বাগানও আছে। এ-বাড়ি ওসমান সাহেব কিনেছিলেন এক সাহেবের কাছ থেকে। এক সময় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা এই ধরনের নিরিবিলি পাহাড়ি জায়গায় বাড়ি বানিয়ে কাটাত শেষ জীবন। হঠাৎ এক সময় তাদের অস্ট্রেলিয়া যাবার সুযোগ খুলে যায়। তখন জলের দরে এখানকার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে।

বাড়িটার অনেক অংশ এখনও মেরামত করা বাকি আছে, তবে একটা ঘর একেবারে তৈরি। নতুন রঙ করাও হয়েছে। সারা দিন ঘুরে ঘুরে অতনু ও রবি কিছু কিছু ফার্নিচার ও খাট-বিছানা কিনেছে। এই ঘরটা কোম্পানির ডিরেক্টরদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।

দক্ষিণ দিকের জানলা খুললেই পাহাড়টা দেখা যায়। ট্রেনের যাওয়া-আসাও চোখে পড়ে, শব্দ শোনা যায় না। দূর থেকে ট্রেন দেখলে এখনও বাচ্চা বয়েসের মত ভাল লাগে।

অতনু কোনও রকম আচার-অনুষ্ঠানে বিশ্বাস না করলেও চন্দনা বিশেষ করে বলে দিয়েছে, একটা কিছু গৃহপ্রবেশের পুজো-টুজো করতেই হবে। বিশেষত ভূতের বাড়ি। চন্দনার নিজেরই আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এই শনিবারই তাকে যেতে হয়েছে বার্লিনে, তার দিদির মেয়ের বিয়ে। ওরা টিকিট পাঠিয়ে দিযেছে।

দুপুরে এক জন পুরুত এসে ঘণ্টা-ফণ্টা নেড়ে কী-সব মন্ত্র পড়ে গেছে। দক্ষিণা নিয়েছে একশো পঁচিশ টাকা। সস্তাই বলতে হবে, কলকাতার পুরুতরা অনেক বেশি নেয়।

এখানে অনেক জিনিসই এখনও কিছুটা সস্তাই আছে। বাজার ঘুরে দেখেছে অতনু। তরকারি শাকসবজি যেমন টাটকা, তেমনই কম দাম। পাঁঠার মাংসের দামও দশ টাকা কম কলকাতার চেয়ে। তবে মাছটা ভাল পাওয়া যায় না। কাছাকাছি বড় নদী নেই। এটা একটা খুঁত। বাঙালিরা যেখানেই যায়, মাছ খেতে চায়। অবশ্য এখনকার বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মাছ পছন্দ করে না। এখানে মাংস-মুরগি সস্তা, এটাই ভাল করে পাবলিসিটি করে দিতে হবে।

সন্ধের সময় ওসমান সাহেব মালপত্র সমেত ওদের পৌঁছে দিতে এলেন। বিকেলবেলায় ওঁর বাড়িতে স্থানীয় দারোগার সঙ্গে নেমন্তন্ন ছিল। দারোগার নাম বিনয়, পাহাড়ের অধিবাসী। পুলিশ টুলিশের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভাল।

ওসমান সাহেব আজ রাতে এখানে আসবেন, থাকবেন না, তাঁর বাড়িতে আজ মেহমান আসবে। তবে আজ রাতের খাবারও আসবে তার বাড়ি থেকে, এখানে রান্নার ব্যবস্থা করা যায়নি। ফোটানো জল সঙ্গে আনা হয়েছে পাঁচ বোতল। অতনু নতুন জায়গার জল বিশ্বাস করে খেতে পারে না। যদিও আগেকার দিনে বলা হত, এমন জায়গায় এসে জল খেলে তাড়াতাড়ি সব কিছুহজম হয়ে যায়, খিদে বাড়ে। এখন অতনুর পেটের চরিত্র বদলে গেছে।

বিদায় বলবার আগে ওসমান সাহেব বললেন, সব ঠিক আছে? কোনও অসুবিধা হবে না আশা করি।

না না, আপনার ব্যবস্থাপনার কোনও ত্রুটি নেই। কী করে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব।

এ আর এমন কী। মানুষের সঙ্গে শুধু কাজকর্মের সম্পর্ক ছাড়াও তো বন্ধুত্ব হতে পারে। বাই দ্য ওয়ে, এখানে চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই, খুব পিসফুল জায়গা…তবে আপনাদের ভূত-টুতের ভয় নেই তো?

রবি অতনুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, আমার এই নাস্তিক বন্ধুটি ভূত বা ভগবান, কোনওটিতেই বিশ্বাস করেনা।

ওসমান সাহেব একটু হকচকিয়ে বললেন, এই দু’টার মধ্যে মিল কোথায় তা তো বুঝলাম না।

রবি বলল, ভূত বা ভগবান, দুটোকেই কখনও দেখা যায় না। অদৃশ্য। সেজন্যই অবিশ্বাস।

ওসমান বললেন, ভগবানকে চোখে দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু ভূত তো কেউ কেউ দেখেছে।

এবার অতনু জিজ্ঞেস করল, আপনি দেখেছেন? নিজের চোখে?

না, মানে, আমি কখনও দেখিনি, কিন্তু কেউ কেউ খুব রিলায়েবল –।

কেউ দেখেনি। ভূত কেউ নিজের চোখে দেখে না, অন্য কেউ দেখেছে, সেই উদাহরণ দেয়। অন্য কেউই আসলে দেখে না। যদি কেউ বলে, হ্যাঁ আমি দেখেছি, তাহলে বলতে হবে সে একটা ডাহা মিথ্যুক। কিছুটা হ্যালুসিনেশানে ভোগে। তার অসুখ আছে। এ নিয়ে অনেক গল্প ছড়ায়। কিন্তু কেউ দেখে না। আপনি বুঝতে পারছেন না, ওসমান সাহেব, এক জন মৃত মানুষকে যদি আবার দেখা যায়, তাহলে তো ফিজিক্সের থিয়োরিটাই মিথ্যে হয়ে যাবে।

রবি বলল, ভূত বিশ্বাস না করলেও অনেকে ভূতের ভয় পায়।

অতনু বলল, দ্যাটস রাইট। সেটা মন্দ নয়। দড়াম করে একটা দরজা খুলে গেল, ফিসফিসানি শোনা গেল বাতাসে, সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ মাঝ রাতে, এ-সব শুনলে বুকটা ধক করে উঠবে, বেশ রোমাঞ্চ হবে, সেটা উপভোগ করা যাবে। অবিশ্বাস যদি দৃঢ় হয় তাহলে তো আগেই জানা থাকবে যে-কোনও অশরীরীর পক্ষেই মানুষের কোনও ক্ষতি করা সম্ভব না। মানুষকে ছুঁতেই পারবে না।

ওসমান বললেন, আপনার মশাই সত্যিই মনের জোর আছে। আমিও ঠিক বিশ্বাস করি না, কিন্তু একলা বাড়িতে থাকতে পারি না। ঠিক আছে, গুড নাইট।

অতনুও বলল, গুড নাইট। খোদা হাফেজ।

ফিরে দাঁড়িয়ে ওসমান হেসে বললেন, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, তবে খোদা হাফেজ বললেন কেন?

অতনু বলল, ওটা তো একটা বিদায় সম্বোধন। এ-সব তো কেউ মানে বুঝে বলে না। সামাজিকতা হিসেবে বলাই যায়। আমরা তো মেরি ক্রিসমাসও বলি।

ওসমান বললেন, আচ্ছা তবে খোদা হাফেজ। নটা-সাড়েনটায় আমার লোক এসে খাবার দিয়ে যাবে। তারপর দরজা-টরজা বন্ধ করে দেবেন।

ওসমান চলে যাবার পর অতনু বলল, উফ।

রবি জিজ্ঞেস করল, উফ করলি কেন? ভদ্রলোক ভাল মানুষ, এত উপকার করছেন। তুই কি তবু বিরক্ত হচ্ছিলি নাকি?

না, তা নয়। ভদ্রলোক সত্যিই ভাল মানুষ। বিরক্ত হবার কোনও কারণ নেই। তবু কি জানিস, সর্বক্ষণ এক জন অন্য লোক কাছে থাকলে নিজেদের মধ্যে হার্ট-টু-হার্ট কথা বলা যায় না। খিস্তি খেউড় করা যায় না।

মেয়েছেলে নিয়ে আলোচনাও করা যায় না। এক জন মেয়ে উপস্থিত থাকলেও এরকম হয়।

আমি কোনও মেয়ে উপস্থিত থাকলে আগেই জিজ্ঞেস করি, অ্যাডাল্ট তো? সব ধরনের কথা হজম করতে পারবে তো? তারপর প্রাণ খুলে যা খুশি তাই বলি!

তোর বউয়ের সামনে তো বলতে পারিস না। চন্দনা খুব কড়া ধাতের মেয়ে।

আঃ, তুই সব সময় আমার বউকে টেনে আনিস কেন? মাল-ফাল খাবি না? ঢাল না গেলাসে।

দু’টি গেলাসে হুইস্কি ঢালল রবি। এখানে সোডা পাওয়া যায় না, শুধু জল দেখতে হবে।

গেলাস তুলে অতনু বলল, চিয়ার্স।

রবি বলল, বাংলাদেশে বলে, উল্লাস!

ফরাসিরা বলে, আ ভতর শান্তে। মানে জানিস?

জানতে চাই না। চুমুক দিয়েই আমার প্রথম কী মনে হল জানিস? তুই যে চ্যালেঞ্জ করেছিলি, শকুন্তলার সঙ্গে ঠিক আলাপ করবি। কই, পারলি?

অতনু একটুক্ষণ চুপ করে রইল।

এর মধ্যে সে আরও তিনবার গিয়েছিল বেদান্ত আশ্রমে। এক দিন সকালে ও দু’বার বিকেলে। পুজো-টুজো ছাড়াও ওখানে নানা রকম সেবামূলক কাজকর্ম হয়। অনেকটা রামকৃষ্ণ মিশনের মতো। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গ্রামের মানুষরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করায়। ব্লাড টেস্টেরও ব্যবস্থা আছে। পোশাক বিতরণ হয়, একটা ইস্কুল বাড়িও তৈরি হচ্ছে। গাড়ি-চড়া বাবুরা এ-সব কাজ পরিদর্শনে আসে, বোঝা যায়, বাইরে থেকে আসে অনেক টাকা। বিদেশি সাহায্যও থাকতে পারে।

এই তিনবারের মধ্যে একবার মাত্র দূর থেকে সেই মেয়েটিকে এক ঝলক দেখেছে অতনু। অন্য দু’বার দেখাই হয়নি, কথা বলার সুযোগের তো প্রশ্নই ওঠে না।

সিগারেটে টান দিয়ে অতনু বলল, আমি যেটা জেদ ধরি, সহজে ছাড়ি না। আর ক’টা দিন থাকতে পারলে ডেফিনিটলি আলাপ করে নিতে পারতাম। কিন্তু চন্দনা এখন বার্লিনে, আমি বেশি দিন এখানে থাকলে ব্যবসাটা দেখবে কে? তাই আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে। আবার শিগগিরই আসব। তখন আর একবার।

রবি বলল, ধরা যাক মেয়েটির সঙ্গে তোর দেখা হল। তুই প্রথমেই কী কী বলবি?

বলব, তুমি কী সুন্দর!

কোন ভাষায় বলবি!

তার মানে?

যদি বাংলায় বলিস, আর মেয়েটি যদি বাঙালি না হয়? কিছুই বুঝবে না। অমন গায়ের রঙ কি বাঙালি মেয়েদের হয়?

তুমি কী সুন্দর, এটা একটা ইউনিভার্সাল ল্যাঙ্গুয়েজ। সবাই বুঝবে।

মোটেই না। ওড়িয়া, অসমিয়া এমনকী বিহারি হলেও বাংলা বুঝতে পারবে, কিন্তু যদি কাশ্মীরি হয়? এক বর্ণও বুঝবে না। ওকে দেখতে অনেকটা কাশ্মীরি মেয়েদেরই মতো।

এখানে কাজ করছে, নিশ্চয়ই বাংলা শিখে নিয়েছে।

মনে হয় লেখাপড়া জানে। সেফ সাইডে থাকার জন্য প্রথম সেনটেনসটা ইংরেজিতে বলাই ভাল। কিন্তু কথা হচ্ছে, তুমি কী সুন্দর’ শুনলে অধিকাংশ মেয়েই খুশি হয়। কিন্তু যে-মেয়ে সংসার ছেড়ে এসেছে, সে-ও কি খুশি হবে? বরং বিরক্ত হতে পারে। রূপের সঙ্গে জড়িত থাকে কামনা-বাসনা, সে-সব ছেড়েই তো ও সন্ন্যাসিনী হয়েছে।

আমি এর পরেই তো জিজ্ঞেস করব, তুমি এই ভরা যৌবনে সংসার ছেড়ে এসেছ কেন? আসলে সেইটুকু কৌতূহল মেটানোই তো আমার উদ্দেশ্য।

তুই প্রথম আলাপে জিজ্ঞেস করলেই সে গড় গড় করে বলে দেবে? সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা তাদের আগের জীবন নিয়ে কোনও কথাই বলতে চায় না, সেই জন্য তারা নামও বদলে ফেলে। অতনু, তোর চেহারা-টেহারা ভাল, এমনি মেয়েরা তোকে দেখলে খানিকটা চুম্বক মেরে যায়, কিন্তু মনের জোরে যে সংসার ছেড়েছে, সে তোকে বিশেষ পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না।

দেখ রবি, তুই প্রথম থেকে আমাকে ডিসকারেজ করতে চাইছিস! আমার সঙ্গে যদি একবার আলাপ হয়, ঠিক ওর পেটের কথা বার করে ফেলব।

আমার কী ভয় হয় জানিস, ওর সঙ্গে ওই ধরনের কথা বললে তোকে হয়তো অপমানিত হতে হবে।

যাক গে, বাদ দে, ও-সব কথা এখন বাদ দে। আমাদের এই গেস্টহাউসটার নাম কী হবে? তোকে ভাবতে বলেছিলাম না?

ভেবেছি। আমার মনে হয়, কোনও শৌখিন নাম দেবার বদলে খুব সহজ, সাধারণ নাম, যেমন মহুলডেরা ভ্যাকেশান লজ, এই রকমই ভাল। মহুলডেরা নামটা কলকাতার লোকেদের কাছে পরিচিত নয়। বেশ একটা এক্সটিক ভাব আছে।

ইংরেজি নাম!

বাংলা নাম দিলে লোকে ভাববে সস্তার জায়গা। আর সস্তা মানেই মিস ম্যানেজমেন্ট। তোকে ধরতে হবে আবার মিডল ক্লাস ক্লায়েন্টস। অবাঙালিরাও আসতে পারে।

প্রথমে তো ঠিক করেছি, কয়েক মাস থাকবে ঘর ভাড়া পার ডে দুশো টাকা। সাধারণ মধ্যবিত্তরাও আসতে পারবে। মাস ছয়েক পরে অবশ্য ভাড়া বাড়বে। খুব গরমের সময়, লিন সিজন, তখন আবার রেট কমাতেও হতে পারে।

ইলেকট্রিসিটি এসে গেছে, গোটা তিনেক ঘর এয়ারকন্ডিশান করে দিতে পারিস। তাতে লোকে আরামে পাঁচশো-সাতশো টাকা দেবে।

তুই যখনই আসবি, তোর জন্য ফ্রি। তুই এই ঘরটায় থাকবি।

আমি একা আসব? এখানে কেউ একা আসবে না, সবাই মেয়ে-টেয়ে নিয়েই আসবে।

তুই বুঝি সারা জীবনে আর কোনও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করবি না? তুই তো দেখছি সন্ন্যাসীর মতো বখে যাচ্ছিস রে রবি।

না, আমি সন্ন্যাসী হতে পারব না। কারণ আমি মদ খাই, সিগারেট খাই। মেয়েদের কাছে না ঘেঁষলেও মেয়েদের কথা তো চিন্তা করি অবশ্যই।

আচ্ছা, সাধু-সন্ন্যাসী, ফকির-দরবেশ এরা কি সত্যিই মেয়েদের কথা চিন্তা করেনা? এরা লিবিডো দমন করে কী করে?

সেটা ওদের অবস্থায় না পৌঁছলে আমরা বুঝতে পারব না। হয়তো সাধনা-টাধনা করলে মনের জোর অনেক বেড়ে যায়।

কিছু কিছু সো কলড সাধু তো মেয়েদের নিয়ে বেলেল্লাও করে। মাঝে মাঝে কাগজে বেরোয়।

তারা সো-কল্‌ড সাধু। খাঁটি নয়। তাদের কয়েক জনের জন্য সবাইকে ছোট করে দেখা ঠিক নয়। অনেকে নিশ্চয়ই সাধনার উচ্চমার্গেও ওঠে।

আমি তো মনে করি, কর্মই সাধনা।

এই সব কথাবার্তার মধ্যে মদ্যপানও চলছে। বোতল অর্ধেক খালি। অতনু একবার ঘড়ি দেখল। মাত্র সাড়ে আটটা বাজে।

হঠাৎ এক সময় শোনা গেল সিঁড়িতে কয়েকটি পায়ের শব্দ। ফিশফাশ কথা। দোতলার কাছে এসে সব থেমে গেল। আবার চুপচাপ।

অতনু রবির দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। প্রথমে মনে হয়েছিল, বাইরে থেকে কেউ দেখা করতে আসছে। তারপর শব্দ থেমে গেল কেন? এই কি ভূতের ব্যাপার? ফিজিকসের থিয়োরি মিথ্যে হয়ে যাবে?

রবি বলল, আমি বাইরেটা দেখে আসছি।

সে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ভেজানো দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল। সেখানে দাঁড়ানো তিন জন যুবক। না, ফিজিক্সের থিয়োরি মিথ্যে হয়নি, এরা সত্যিকারের মানুষ।

তিন জনই প্যান্ট-শার্ট পরা, মাঝারি চেহারা, বয়েস পঁচিশ থেকে পঁয়তিরিশের মধ্যে। মাঝখানের যুবকটি একটু বেশি লম্বা, চোখে চশমা, মাথার ঝাকড়া চুলে কখনও চিরুনি ব্যবহার করে বলে মনে হয় না।

সে তীব্র গলায় বলল, আপনারা কে? এখানে কী করছেন?

ভুরু কুঁচকে অতনু বলল, সে-প্রশ্ন তো আমরাই করব। আপনারা কে? এখানে কেন এসেছেন?

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিন।

রবি জানে, অতনু বদমেজাজি, কারওর খারাপ ব্যবহার দেখলে পট করে একটা অশ্লীল গাল দিয়ে ফেলতে পারে।

সে হাত তুলে বন্ধুকে নিবৃত্ত করে শান্ত গলায় বলল, আমরা এই বাড়ির মালিক, আমরা এখানে থাকব, সেটাই তো স্বাভাবিক।

আমাদের বাড়ি মানে?

আমরা এই বাড়িটা কিনেছি। আজই দখল নিয়েছি।

কিনেছেন? এই অঞ্চলে সমস্ত বিক্রি নিষেধ, তা জানেন না?

নিষেধ? গভর্নমেন্টের সার্কুলার আছে? সে-রকম তো কিছু শুনিনি।

গভর্নমেন্টের নয়, আমাদের সার্কুলার। ওই ওসমান ব্যাটা বুঝি চুপি চুপি আপনাদের এই বাড়িটা গছিয়েছে? ব্যাটা মহা ধড়িবাজ ক্যাপিটালিস্ট।

চুপি চুপি কেন হবে? রীতি মতো দরদাম করে, আমরা উকিল দিয়ে বাড়ির টাইটেল সার্চ করিয়েছি, কোর্টে রেজিস্ট্রি হবে।

সে-সব কিছু হবে না! এ বাড়িতে আমরা রাতে থাকি।

এবার অতনু বলে উঠল, সেই জন্যই বুঝি ভূতের গল্প রটানো হয়েছে?

লম্বা লোকটির এক জন সঙ্গী বলল, শাট আপ!

রবি নিরীহ ভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনারা এ অঞ্চলের সব বাড়ি বিক্রি না করার সার্কুলার দিয়েছেন কেন জানতে পারি? যদি কেউ অভাবে পড়ে বেচতে চায়?

লম্বা লোকটি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আপনারা এই বাড়িটা কিনতে চাইছেন কেন? এখানে এসে পাকাপাকি বসবাস করবেন? নিশ্চয়ই না। এটা বাগানবাড়ি বানাতে চান?

রবি বলল, ঠিক তা নয়। আমাদের একটা ট্রাভেল এজেন্সি আছে। এ বাড়িটাকে আমরা একটা গেস্টহাউস বানাব। শহর থেকে লোকেরা আসবে।

অতনু বলল, বাইরের লোকেরা এখানে আসবে, তারা জিনিসপত্র কিনবে, টাকা খরচ করবে, তাতে এখানকার স্থানীয় লোকেদেরই তো উপকার হবে।

আ-হা-হা-হা! স্থানীয় লোকদের উপকারের চিন্তায় যেন আপনাদের ঘুম নেই! আপনারা গেস্টহাউস করছেন নিজেদের ব্যবসার জন্য। শহর থেকে লোকেরা এখানে ফুর্তি করতে আসবে। নিজের বউ ছাড়া অন্য মেয়ে নিয়ে আসবে। মদ খাবে।

লম্বা লোকটির এক জন সঙ্গী বলল, মধুদা, এরা দু’জনেও তো বসে বসে মদ প্যাঁদাচ্ছে।

অতনু বলল, মদ্যপান সম্পর্কে আপনাদের খুব আপত্তি দেখছি। আপনারা খান না বুঝি? এখানকার সব আদিবাসীরাই তো মদ খায় রোজ। হাঁড়িয়া মহুয়া। আপনারা বুঝি বিপ্লবী? কার্ল মার্কস কিংবা লেনিন মদ খেতেন কি না খোঁজ নিয়েছেন? ও-সব দেশে তো সবাই ভদকা খায়।

অন্য লোকটি বলল, শাট আপ।

এবার অতনুও গর্জে উঠল, ইউ শাট আপ। অ্যান্ড গেট আউট ফ্রম মাই প্রপার্টি। লম্বা লোকটি পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করে গুলি চালাল তিনবার। দুটো গুলি অতনুর গায়ে লাগল, সে ঢলে পড়ে গেল।

.

০৪.

অতনুর জ্ঞান ফিরল প্রায় দু’দিন পরে। তা-ও অ্যানেসথেশিয়ার ঘোর রয়েছে খানিকটা। চোখ মেলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে এ-দিক ওদিক দেখে জিজ্ঞেস করল, এ জায়গাটা কোথায়?

গলায় স্টেথেসকোপ ঝোলানো এক জন ডাক্তার, তাঁর পাশে দুটি তরুণী। তাদের মধ্যে একজন সেই পরমা সুন্দরী, যার সঙ্গে পরিচয় করার জন্য অতনু ব্যাকুল হয়েছিল। কিন্তু এখন অতনু তাকে চিনতে পারল না। শরীর অসুস্থ থাকলে ও সব মনে পড়ে না।

ডাক্তাররা মৃদু স্বরে বলল, আপনি আমাদের আশ্রমের হাসপাতালে। ইউ আর কমপ্লিটলি সেইফ নাও!

অতনু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আমি হাসপাতালে কেন? আমার কী হয়েছে? অ্যাকসিডেন্ট?

আপনার মনে নেই, কী হয়েছিল?

নো, আই ডোন্ট রিমেমবার এনিথিং। আমি হাসপাতালে…। আমার কি একটা পা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে?

না না, পা ঠিক আছে। আপনার দুটো গুলি লেগেছে, দুটোই সাকসেসফুলি রিমুভ করা গেছে। একটা গুলি লেগেছিল হার্টের ঠিক তিন ইঞ্চি নিচে, ওটা ফেটাল হতে পারত। অন্যটা কাঁধে।

অতনু ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, আমার দুটো হাত কোথায়? ঠিক আছে?

ডাক্তার বলল, হাতও ঠিক আছে।

কোথায়? আমার হাত কোথায় দেখান?

একটা হাত তো দেখানো যাবে না, বুকের সঙ্গে ব্যান্ডেজ বাঁধা। অন্য হাতটা আপনি অনায়াসে তুলতে পারবেন।

অতনু আপন মনে বলল, পা ঠিক আছে, হাত ঠিক আছে, তাহলে আমি এখানে শুয়ে আছি কেন?

ডাক্তার হেসে বললেন, একটু তো শুয়ে থাকতেই হবে। কয়েক দিন বিশ্রাম দরকার।

অতনু চোখ বুজল।

একটু পরে ডাক্তার ও একটি তরুণী বেরিয়ে গেল। অন্য তরুণীটি একটা টুলে বসে রইল তার শিয়রের কাছে।

অতনু তাকে অগ্রাহ্য করে পাশ ফিরল অন্য দিকে।

প্রায় ছ’ঘণ্টা পরে সে আবার চোখ খুলল। এখন ডাক্তারটি নেই, রয়েছে দুটি মেয়ে।

এক জন বলল, এবারে একটু খেয়ে নিন, সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি।

অতনু জিজ্ঞেস করল, কী খাব? খিদে তো পায়নি।

অন্য জন বলল, খিদে না পেলেও একটু খেয়ে দেখুন। যতটা পারেন। আজ লিকুইড, কালকেই ভাত পাবেন।

একটা পোর্সলিনের বাটি থেকে চামচে করে তুলে অতনুকে কিছু একটা তরল খাদ্য খাওয়াতে লাগল মেয়েটি।

অতনু মুখ কুঁচকে বলল, একটুও ঝাল নেই। লঙ্কা দেয়নি কেন?

মেয়ে দুটিই হাসল। হাসপাতালের রোগীকে ঝাল খাবার দেবার কথা কেউ কখনও শোনেনি। সব হাসপাতালের খাবারের স্বাদ এক।

বার বার আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়ছে অতনু, মেয়েটি বেশ শক্ত করে তাকে ধরে আছে। একবার সে অন্য জনকে বলল, জলের গেলাসটা দে তো দীধিতি!

অতনু শুনল, একটি মেয়ে অন্য মেয়েটিকে ডিডিটি বলে ডাকছে। ডিডিটি কারওর নাম হয়? হাসপাতালে ডিডিটি কাজে লাগে।

যাকে ওই নামে ডাকা হল, সে সেই খুব ফরসা রূপসীটি। কিন্তু তার রূপের প্রতি এখন কোনও আকর্ষণ নেই অতনুর, শুধু নামটা শুনে তার খটকা লেগেছে।

একবার সে বলেই ফেলল, কী নাম বললে ওর? ডিডিটি?

দুজনেই হাসল।

এক জন বলল, প্রথমে ওর নাম শুনে সবাই অন্য একটা কিছু ভাবে। আমার নাম অনুপমা, ওর নাম দীধিতি। দী-ধি-তি।

অতনু বলল, এটা কি বাংলা?

হ্যাঁ, বাংলাই বলতে পারেন। সংস্কৃত থেকে এসেছে।

মানে কী?

এবারে যার নাম, সে-ই খুব নম্র গলায় বলল, দীপ্তি, রশ্মি।

কখনও শুনিনি।

আর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সে খানিকটা বিরক্তিব সঙ্গে বলল, আঃ, আর খেতে ইচ্ছে করছেনা, কেন জোর করছ! আমার ঘুম পাচ্ছে!

আবার সে জেগে উঠল, মধ্যরাতে।

ঘরের এক কোণে টেবল ল্যাম্প জ্বলছে, সেখানে টুলে বসে বই পড়ছে একটি মেয়ে। অনুপমা না দীধিতি, কোন জন, তা সে চিনতে পারল না। নাম দুটোও মনে নেই। অনেক কিছুই তার মনে নেই।

চোট লেগেছে তার শরীরে, কিন্তু তার মাথার মধ্যেও খানিকটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে।

তাকে নড়াচড়া করতে দেখে মেয়েটি উঠে এসে জিজ্ঞেস করল, আপনার কিছু কষ্ট হচ্ছে? জল খাবেন?

অতনু বলল, না।

মেয়েটি বলল, এখন সাড়ে বারোটা বাজে, আপনার ব্লাড প্রেশারটা একবার চেক করব?

অতনু কোনও উত্তর দিল না।

মেয়েটি অতনুর অক্ষত হাতটিতে পট্টি জড়াতে লাগল।

নির্জন ঘর, এত কাছাকাছি একটা তরুণী মেয়ে, তার নিশ্বাসও গায়ে লাগছে, তবু ভোগবাদী অতনুর শরীরে কোনও সাড়া নেই।

একটু পরে সে জিজ্ঞেস করল, আমার নাম কি অতনু হালদার? তুমি জানো?

মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, কার্ডে তাই লেখা আছে।

আমি কি কারওর সঙ্গে মারামারি করেছিলাম?

তা জানি না। রিপোর্ট লেখা আছে, আপনার গায়ে গুলি লেগেছে দুটো। পুলিশ এসেছিল আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন, তাই জাগাইনি। কাল সকালে আবার আসবে।

পুলিশ তো চোর-ডাকাতদের ধরতে আসে, আমি কি তাই?

ধরতে আসবে না। ঘটনাটা কী ঘটেছিল, জানতে আসবে।

আমি যে কিছুই জানি না।

আপনার সঙ্গে এক বন্ধু ছিল, তারও গুলি লেগেছে।

সঙ্গে সঙ্গে রবির কথা তার মনে পড়ল। আঁতকে উঠে সে বলল, রবি রবি, তার কী হয়েছে? সে মরে গেছে?

না, গুলি লেগেছে তাঁর পায়ে।

অন্য পা-টাও খোঁড়া হয়ে গেছে?

না। সে পা-টাতেই গুলি লেগেছে। মানে একই পায়ে। উনি নিচের একটি ঘরে আছে।

তুমি কে? তুমি কি নার্স?

কিছুটা ট্রেনিং নিয়েছি। আমাদের এখানে এক জনই মাত্র ট্রেইন্ড নার্স আছে। দরকার হলে আমরা দু’জন কাজ চালিয়ে দিই।

আমি একবার উঠব। বাইরে যাব।

আপনার এখনও বিছানা থেকে নামা নিষেধ। সেই জন্যই তো আমি এখানে রয়েছি। আপনার কী দরকার বলুন!

আঃ, কী মুশকিল, আমাকে একবার বাইরে যেতে হবে।

না, যেতে হবে না। শুয়ে থাকুন, আমি ব্যবস্থা করছি।

সে একটা বেডপ্যান বার করল খাটের তলা থেকে। অতনুর গা থেকে চাদরটা সরিয়ে নিল। নিম্নাঙ্গে শুধু একটা কাপড় জড়ানো। সেটাও সরিয়ে বেডপ্যান রাখল দুই উরুর মাঝখানে।

তারপর সেই অনিন্দ্যসুন্দর রমণী অতনুর পুরুষাঙ্গ ছুঁয়ে সেটিকে ঠিক জায়গায় স্থাপন করল।

শেষ হয়ে গেলে অতনু বলল, আঃ! এবার আমি ঘুমোই?

তাকে শুইয়ে দিয়ে আবার গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে দিল দীধিতি।

পরদিন সকালে অতনু অনেকটা স্বাভাবিক। তবু আজও তার বিছানা থেকে নামা নিষেধ। ব্লাড প্রেশার অনেক নেমে গেছে।

বিছানাতেই বালিশে হেলান দিয়ে বসে নিজে নিজে দাঁত মাজল অতনু। ঘরে এখন দুটি মেয়ে উপস্থিত। দু’জনেরই সে নাম ভুলে গেছে, কাল রাতে কে তাকে পাহারা দিয়েছে, তা-ও মনে নেই।

একটু পরে সে ঘরে ঢুকলেন ডাক্তার। সহাস্য মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন মিস্টার হালদার?

মানুষের স্মৃতি দুর্বল হয়ে গেলেও ব্যথাবোধ ঠিকই থাকে। সে বলল, এই দিকটায় বেশ ব্যথা।

ডাক্তার বললেন, কমে যাবে। আপনার রিমার্কেবল তাড়াতাড়ি উন্নতি হচ্ছে। আর দুদিনের মধ্যে আপনি ফিট হয়ে যাবেন।

আমার সব সময় এত ঘুম পায় কেন?

আপনাকে কিছুটা সিডেটিভ দেওয়া হচ্ছে। ব্যথা কমাবার সেটাই তো উপায়। ঘুমোনোও তো ভালই।

ডাক্তার মেয়ে দু’টির সঙ্গে কী-সব আলোচনা করতে লাগলেন।

একটু পরে শোনা গেল ঘণ্টাধ্বনি।

অতনু জিজ্ঞেস করল, ও কীসের আওয়াজ?

দীধিতি বলল, আমাদের আশ্রমে পুজো শুরু হয়েছে।

আশ্রম? কীসের আশ্রম?

বেদান্ত সংঘের আশ্রম। আপনি তো আগে এসেছেন এখানে।

আগে এসেছি? কই না তো। আমি কোনও আশ্রমের কথা জানি না।

হ্যাঁ আপনি এসেছেন। এক দিন সকালে..আমি আপনাকে দেখেছি। আপনার মনে নেই?

না। আমি কবে আশ্রম দেখলাম?

তখনই রবিকে ধরে ধরে নিয়ে এল একজন সঙ্গী। রবির সারা শরীরে অন্য কোনও চিহ্ন নেই, শুধু তার এক পায়ে প্লাস্টার।

রবি বলল, কেমন আছিস অতনু?

অতনু বলল, হু! কেমন আছি? কে জানে! তোর গায়েও গুলি লেগেছে?

রবি কাছে এগিয়ে বলল, হ্যাঁ, লেগেছে, পায়ে।

আগের রাতে যা শুনেছে, তা মনে নেই অতনুর। সে বলল, তোর দুটো পা-ই গেল? তুই হাঁটবি কী করে?

রবি বলল, সৌভাগ্যের বিষয়, আমার খারাপ পা-টাতেই গুলি লেগেছে। আমি তখন টেরই পাইনি, আমি তখন তোর জন্য…আমি তো জ্ঞান হারাইনি, তোকে দেখে এত ভয় হচ্ছিল, গল গল করে রক্ত বেরোচ্ছে। ওরা চলে যাবার পরই আমি ছুটে বাইরে গেলাম।

ওরা মানে কারা?

টাকা-পয়সা কিছু নেয়নি। কোনও পলিটিক্যাল পার্টির ক্যাডার। তোর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হতেই গুলি চালিয়ে দিল।

আমরা তো গুলি করিনি।

আমরা গুলি করব কী করে! আমাদের সঙ্গে কি বন্দুক পিস্তল কিছু ছিল? আমরা তো ভাবতেই পারিনি, অমন ভাবে বাড়ির মধ্যে ঢুকে–অতনুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে রবি আড়চোখে দেখছে দীধিতিকে। এই সেই আশ্রমকন্যা শকুন্তলা। কাছ থেকে দেখে মনে হচ্ছে, এর জন্য কোনও কোনও পুরুষ তো পাগল হতেই পারে। শেষ পর্যন্ত হলে, অন্য রকম অবস্থায়, অতনুর কথাটা মিলে গেল, আলাপ হল এর সঙ্গেই।

কিন্তু অতনু যে মেয়েটির কথা একেবারেই ভুলে গেছে, তা সে জানে না।

পুলিশ আসবার পর সব কিছু উত্তর দিতে হল রবিকেই। অতনুর উত্তর অসংলগ্ন। সে মন দিয়ে শুনতে লাগল রবির কথা, যেন একটা অচেনা কাহিনি। এখানে একটা বাড়ি কেনা হয়েছে? কেন? বাড়ি দিয়ে কী হবে? আততায়ীদের তো ধরা যায়নি, তারা পালিয়ে গেছে গভীর জঙ্গলে। পুলিশ খুঁজছে। ওসমান সাহেব কারওকেই চেনেন না বলেছেন। কে ওসমান?

বিকেলের দিকেও ডাক্তারটি দেখতে এলেন আবার।

অতনুর কথাবার্তা যে অসংলগ্ন, তা জেনেও গুরুত্ব দিলেন না তিনি। তিনি শল্য চিকিৎসক, তাঁর অপারেশন সার্থক হয়েছে, এতেই তিনি তৃপ্ত। মনস্তত্ত্ব নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না। আকস্মিক শকে এ-রকম হতেও পারে, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

আজ রাতেও অতনুকে একবার বেডপ্যান নিতে হল। আজ অবশ্য দীধিতি নয়, অন্য মেয়েটি রয়েছে পাহারায়।

পরদিন, সারা দিন দীধিতিকে দেখাই গেল না।

অনুপমা আর এক জন পুরুষ সঙ্গী মিলে একবার অতনুকে খাট থেকে নামিয়ে হাঁটাতে হল কয়েক পা। হাঁটতে তার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। পায়ে জোর আছে, ঘুম ঘুম ভাবটাও কেটে গেছে। এখনও অবশ্য সে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসবার অনুমতি পায়নি।

আজ এক জন পরিপূর্ণ পোশাক পরা নার্স এল শেষ বিকেলে। এই আশ্রমের যিনি গুরুমা, তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর কাছেই এই ট্রেইন্ড নার্সটিকে সর্বক্ষণ থাকতে হয়। এক ফাঁকে এসে সে অভিজ্ঞ হাতে অতনুর সারা শরীর নগ্ন করে গরম জলে স্পঞ্জ করে দিল। বুকের ব্যান্ডেজটাও খুলে দেখা গেল, তার রক্ত বেরোচ্ছে না। ক্ষত সেরে এসেছে অনেকটা।

অতনু জিজ্ঞেস করল, আমি কবে এখান থেকে ছাড়া পাব?

নার্সটি অধিকাংশ কথাই ইংরেজিতে বলে। সে বলল, হোপফুলি ইন অ্যানাদার থ্রি ডেইজ। তারপর ইউ উইল বি ফ্রি।

অতনু জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

নার্সটি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আপনি কোথায় যাবেন, হাউ কুড আই পসিবলি নো? আপনার নিজের বাড়িতে যাবেন।

অতনু জিজ্ঞেস করল, আমার নিজের বাড়িটা কোথায়? আমি যদি মরে যেতাম তাহলে কি আমার নিজের কোনও বাড়ি থাকত?

নার্সটি দুকাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আই হ্যাভ নো অ্যানসার।

সন্ধের দিকে অতনুর এমনই মন খারাপ হয়ে গেল যে রবি দেখা করতে এলেও সে ভাল করে কথা বলল না।

অনুপমা তাকে একটু গলা ভাত আর মুরগির স্টু খাওয়াতে নিয়ে এল, সে মুখ সরিয়ে নিল একটু পরেই।

তাকে ধমক দিয়ে বলল, আমাকে একটা সিগারেট দিতে পারো না?

অনুপমা বলল, হাসপাতালে তো সিগারেট পাবেনই না। এখান থেকে বেরিয়েও আর সিগারেট খাবেন না।

মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল অতনু। রাতে কে তার ঘরে রইল, তা সে লক্ষ্যও করল না। কোনও সাহায্যও চাইল না, যদিও ঘুম ভেঙে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

রবির কাছ থেকে কাহিনিটা শোনার পর এখন সে মাঝে মাঝেই দেখতে পাচ্ছে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এক জন লম্বা চেহারার লোক রিভলবার থেকে গুলি করছে তার দিকে। দৃশ্যটা চোখে ভেসে ওঠা মাত্র তার মনে হচ্ছে, সে মরে যাচ্ছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর।

দীধিতি আবার এল পরদিন সন্ধের পর।

তার দিকে কয়েক পলক এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে সে রীতিমতো প্রখর গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি দুদিন আসোনি কেন?

দীধিতি বলল, আমি যে দু’দিন আসিনি, তা আপনি খেয়াল করেছেন?

রূপের মতোই মেয়েটির গলার আওয়াজও খুব মিষ্টি। ভদ্রতা আর বিনয়ের ভাবও আছে।

আবার সে বলল, আমাদের গুরুমা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমি তার কাছে ছিলাম। একটু আগে তিনি কলকাতায় ফিরে গেলেন।

তুমি আমাকে একটু ধরবে? একবার বাথরুমে যাব।

আজ না, কাল থেকে। এখন কিছু লাগবে?

ঠিক আছে, এক্ষুনি না। তুমি আগের দিন যে আমাকে ওই ব্যাপারে সাহায্য করলে, তখন কিছু বোধ করিনি। এখন একটু একটু লজ্জা করছে। আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, তুমি যে রোগীদের জন্য ওই সব করো, তোমার ঘেন্না করে না?

না, ঘেন্না করে না। এ তো মানুষের সেবা। আর মানুষের সেবা মানেই ঈশ্বরের সেবা।

ঈশ্বর কে? তোমাদের এখানকার কোনও বড়বাবু?

কী বলছেন আপনি! ঈশ্বর তো সব মানুষেরই।

আমার নয়। আমার কোনও ঈশ্বর-টিশ্বর নেই। শোনো, আমি অতনু হালদার, আমি বিচ্ছিরি ধরনের নাস্তিক। আমার বন্ধুরা আমাকে বলে শয়তান, কালাপাহাড়। কিন্তু আমি একটা একজাম্পল সেট করছি। ছোটবেলা থেকেই আমি কোনও ধর্ম মানি না, ভগবান মানি না। কোনও দিন প্রার্থনা টার্থনা করিনি। তবু, আমি দেখাতে চাই, এইভাবেও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। ধর্ম নিয়ে মাতামাতি না করেও মানুষ আনন্দের সঙ্গে বাঁচতে পারে।

আপনি হয়তো ঠিকই বলছেন। তবে আপনি যে-জীবনযাপনের কথা বলছেন, তার সঙ্গে যদি এই সৃষ্টির বিস্ময়, কোনও গভীর অনুভূতি, যিনি এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি করেছেন, তার কাছে পৌঁছনোর পথ খোঁজা, এই সবকরলে নিশ্চিত জীবনযাপনের আনন্দ আরও অনেক বিশুদ্ধ হত। মনটাকে সব গ্লানি থেকে মুক্ত করা যেত।

মাথা নেড়ে অতনু বলল, না। আমি অনেক ধর্ম আশ্রিত, ভক্তি আশ্রিত মানুষ দেখেছি, তাদের কোয়ালিটি অফ লাইফ মোটেই আমার চেয়ে ভাল না। দেখেছি, তাদের লোভ আছে, ঈর্ষা আছে, মিথ্যে কথা বলে। কিন্তু আমি মিথ্যে বলি না, আমি কোনও মানুষের ক্ষতি করি না। পারলে যথাসম্ভব অন্যের উপকার করি। আমি ধর্মের বইগুলো ঘেঁটে দেখেছি। সব ক’টা ধর্মই বেশ কাঁচা ধরনের ছেলে-ভুলোনো রূপকথা। কোনও শিক্ষিত, সিভিলাইজড, অ্যাডাল্ট লোকের কাছে ধর্মের কোনও প্রয়োজনীয়তাই নেই।

একসঙ্গে এতগুলি কথা বলে হাঁপাতে লাগল অতনু। এখন মাঝে মাঝে ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটাও নেই।

দীধিতি মৃদু গলায় বলল, আপনার এই যে নাস্তিকতার তীব্রতা, তারও একটা গুণ আছে। নিশ্চয়ই দেখবেন, এইভাবে মুক্তি দিতে দিতে আপনি হঠাৎ একদিন বিশ্বাসের দরজায় পৌঁছে গেছেন। তখন আপনার বিশ্বাসও এই রকমই তীব্র হবে।

অতনু হেসে বলল, সেই রকম দিন কখনও আসবে না। এলেও তুমি তা জানতে পারবে না।

দীধিতি বলল, এখন একবার ব্লাডপ্রেশারটা দেখে নিই? এখনও প্রেশারটা ফ্লাকচুয়েট করছে।

অতনুর বাহুতে পট্টি বাঁধতে লাগল দীধিতি। অতনু জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনও ডাকনাম নেই?

ছিল একটা। সেটা বলতে এখন আমার লজ্জা করে।

কী শুনি, শুনি। তোমার নামটা বড্ড খটোমটো।

পরি।

বাঃ! এটা তো বেশ মানানসই নাম! তবে আমার একটা ভুল হয়ে গেছে। প্রথম থেকে তোমাকে তুমি বলছি। তখন তো ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আপনি বলাই উচিত ছিল, যদিও আমি বয়েসে বড়, তবু এখন থেকে আপনিই বলব।

দীধিতি হেসে বলল, একবার যখন তুমি বলেই ফেলেছেন, আর কী করা যাবে। আর আপনি করার দরকার নেই।

তাহলে তুমিও কি আমাকে নাম ধরে তুমি বলতে পারবে?

আমরা তো কারওর নাম ধরি না। সব পুরুষকেই বলি প্রভু!

প্রভু? নারীবাদীরা শুনতে পেলে তোমাদের পিণ্ডি চটকাবে। প্রভু মানে তো মালিক, আর তোমরা তাহলে দাসী?

দাসী হতে আমাদের আপত্তি নেই। সব পুরুষই তো পরম ব্রহ্মের অংশ, সেই হিসেবে তাদের সেবা করা।

পুরুষরা পরম ব্রহ্মের অংশ, আর মেয়েরা কি বাণের জলে ভেসে এসেছে? এ-সব ধর্মীয় ন্যাকাপনা শুনলেই আমার রাগ হয়। তোমরা মেয়েরা যে এত ধর্মকর্ম করো, তোমরা জানো না যে সব ধর্মেই মেয়েদের ছোট করে দেখা হয়েছে? সব ধর্মই পুরুষতান্ত্রিক। যে-সব ধর্মে ঈশ্বর নিরাকার, তারাও সর্বনামে বলে হি অর্থাৎ নিরাকার হলেও পুরুষ। ইট তো বলে না। নিরাকারের তো নিউট্রাল জেন্ডার হওয়া উচিত।

আমি আমার নিজের ধর্ম মানি। আপনি অত উত্তেজিত হবেন না, প্রেশার নিচ্ছি। ভুল হয়ে যাচ্ছে, আবার নিচ্ছি।

অতনু সত্যিই উত্তেজিত হয়েছে। শুধু মস্তিষ্কে নয়, শরীরেও। সে টের পাচ্ছে, কেউটে সাপের ফণার মতো আস্তে আস্তে উঁচু হচ্ছে তার পুরুষাঙ্গ। বেশ কয়েক দিন পরে এই প্রথম।

তার খুব কাছেই এই রমণীর শরীর। সাধারণ লাল পাড়, সাদা শাড়ি পরা, কোনও রকম প্রসাধন কিংবা অলঙ্কার নেই, তবু অপুর্ব রূপের বিভা। ওর নামের অর্থ দীপ্তি। সত্যি যে দীপ্তি, টের পাওয়া যায়।

ওর হাতে ব্যান্ডেজ, অন্য হাতে এখন পট্টি বাঁধা। তবু একবার ওকে স্পর্শ করার জন্য অতনুর মনটা আকুলি-বিকুলি করতে লাগল।

প্রেশার দেখা শেষ হয়েছে, পরির কপালে চিন্তার রেখা। পট্টিটা খুলে নেওয়া মাত্র অতনু ওর মাথায় হাত রাখল।

আয়ত চোখ দুটি অতনুর মুখে ন্যস্ত করে পরি জিজ্ঞেস করল, এ কী করছেন?

অতনু বলল, তুমি এত সুন্দর তাই তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখছি।

সব মানুষই সুন্দর। যে দেখছে, তার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অনেকটা নির্ভর করে।

তা জানি। তবু রূপের একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। সব স্ট্যান্ডার্ডেই তুমি ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট।

ও-সব বলবেন না। মানুষের চেহারা, রূপ, এই সবই অবাস্তব। মানুষের মনটাই তো আসল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, হৃদয়ের কথা কহিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ…।

হৃদয়ের কথা আসল তো বটেই। কিন্তু শরীরও তুচ্ছ করা যায় না। আমি যদি তোমাকে একটু ছুঁতে চাই, সেটা কি অন্যায়?

ন্যায়-অন্যায়ের কথা আলাদা। প্রশ্ন হচ্ছে কী উদ্দেশ্যে ছোঁওয়া! আমি কামনা বাসনা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে নিয়েছি। সেই জন্যই আপনাকে ছুঁতে তো আমার কোনও অসুবিধে হয় না।

আমি অবশ্য বাসনাবদ্ধ জীব। আজই প্রথম তোমাকে আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

হাতটা সে মাথা থেকে সরিয়ে এনে পরির নবনীত-তুল্য গালে রাখল।

করুণ গলায় পরি বলল, ও-রকম করবেন না প্লিজ!

নিজেকে সে সরিয়ে নিল একটু দূরে অতনুর হাতের সীমার বাইরে।

অতনু বলল, তোমার মুখে-চোখে একটা পবিত্রতার ভাব আছে। হয়তো আমার এ ধরনের ব্যবহার ঠিক নয়। তোমার সঙ্গে কথা বলতেও ভাল লাগে, ঠিক আছে, কিন্তু আমাকে যে একবার উঠতেই হবে।

কেন?

একবার বাথরুমে যাওয়া খুব দরকার।

আজ নয়। প্রেশারের যা অবস্থা, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারেন, আমি বেডপ্যান দিচ্ছি।

না না। আজ আমি তোমার কাছ থেকে বেডপ্যান নিতে পারব না। আমি যেতে পারব বাথরুমে।

আমি বেডপ্যান দিলে কী হয়েছে, আগেও তো দিয়েছি।

আজ আমার লজ্জা করছে। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে যাব। মাথা ঘুরবে না।

চুপটি করে শুয়ে থাকুন। এতে লজ্জার কী আছে!

সে বেডপ্যানটা বের করে আনল। অতনুর গা থেকে কম্বল আর নিম্নাঙ্গের কাপড়টা সরিয়ে ফেলতেই দেখতে পেল এক উত্থিত, দৃঢ় দণ্ড। কয়েক মুহূর্ত মাত্র সেদিকে তাকিয়ে রইল পরি, লজ্জারুণ হয়ে গেল মুখ।

তারপর দ্বিধা না করে বেডপ্যানটি যথাস্থানে স্থাপন করে সেই দণ্ডটি ছুঁল।

চোখ বন্ধ করে রইল অতনু।

কাজ হয়ে যাবার পর বেডপ্যানটি নিয়ে বেরিয়ে গেল পরি। আর ফিরে এল না।

রাত্তিরেও ঘরে এল না কেউ।

পরদিন সকালে এল অন্য মেয়েটি। সারা দিনেও সে আর এ ঘরমুখো হল না। অতনু তার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছে বটে, কিন্তু আগের দিন সন্ধেবেলা ঠিক কী হয়েছিল, তা এর মধ্যেই অস্পষ্ট হয়ে গেছে তার স্মৃতিতে।

আজ আবার তার কথাবার্তা অসংলগ্ন।

ডাক্তার দেখতে এসে বললেন, আর একটা দিন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরেই অতনুর ছুটি। প্রেশারটা স্টেডি না হলে তাকে ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি আছে। ওষুধ বদলে দেওয়া হয়েছে, আশা করি এবার ঠিক হয়ে যাবে।

অতনু ভাবল, ছুটি? তার মানে কী? এরপর সে কোথায় যাবে? এই নরম বিছানায় শুয়ে থাকাটাই তার ছুটি নয়?

কলকাতার বাড়ি, নিজের স্ত্রী, সংসার, ব্যবসার কথা তার মনে পড়ছে না।

ওসমান সাহেব এলেন দেখা করতে।

অতনুর মনে হল, এই লোকটিকে কোথায় যেন আগে দেখেছে। মুখটা চেনা চেনা, নাম মনে পড়ছেনা। কী একটা যেন বাড়ির কথা বলছে, তার বাড়ি?

রবিকে ঠিকই মনে আছে। সে রবিকে বলল, একটা সিগারেট খাওয়াতে পারিস না?

তার উত্তরে রবি বলল, এখানে এরা চিকিৎসার জন্য পয়সা নেয় না। কিন্তু কিছু ডোনেশান দেওয়া উচিত। তোর ব্যাগে হাজার পাঁচেক ছিল, আর পাঁচ হাজার আমি ওসমান সাহেবের কাছ থেকে ধার নিচ্ছি। ঠিক আছে?

ঘরে যখন কেউ নেই, সে আস্তে আস্তে নামল খাট থেকে।

বুকের বড় ব্যান্ডেজটা খুলে দিয়ে ছোটো করে ব্যান্ডেজ বেঁঝেছে। শুধু শ্লিং বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে একটা হাত।

পা টিপে টিপে সে গেল বাথরুমের দিকে। মাথাটা টলটল করছে ঠিকই। দেয়াল ধরে ধরে গিয়ে সেসংলগ্ন বাথরুমের দরজা খুলল।

অন্যের সাহায্য ছাড়াই সে বাথরুম ব্যবহার করতে পারছে। এটাই তো সুস্থতার লক্ষণ। কিন্তু মাথাটা পরিষ্কার হচ্ছে না কিছুতেই। এখান থেকে বেরিয়ে সে কোথায় যাবে, কিছুতেই মনে করতে পারছে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক জন আচমকা রিভলবার বার করে গুলি চালাল। এ-রকম সরাসরি গুলি খেয়ে কেউ বাঁচে? সে বেঁচে আছে। তারপর?

মাথাটা ঝাঁকিয়ে সে তারপরে কী হবে, সেটা বোঝার চেষ্টা করে।

নিজে নিজেই সে ফিরে এল বিছানায়।

দুপুরের খাবার নিয়ে আসে যে-মেয়েটি, সে পরি নয়, তার নাম অতনুর মনে নেই। এ মেয়েটিও মোটই অসুন্দর নয়। কিন্তু একে দেখে অতনুর কোনও চিত্তবিকার হয় না।

সে খাবারের সঙ্গে নিয়ে এসেছে খবরের কাগজ। জিজ্ঞেস করল, আপনি কোনও বই-টই পড়বেন? আমাদের লাইব্রেরি আছে। এনে দিতে পারি।

ছোটবেলা থেকেই অতনু প্রচুর বই পড়ে। বাংলা ও ইংরেজি। কিন্তু কোন বই আনতে বলবে? এক জনও লেখকের নাম মনে নেই।

সে খবরের কাগজটার ওপর চাপড় মেরে ইঙ্গিতে জানাল, এটাই যথেষ্ট।

আজ তাকে ভাত, ডাল ও পনিরের তরকারি দেওয়া হয়েছে। সে নিজেই চামচে করে দিব্যি খেতে লাগল। মেয়েটি বলল, এই তো বেশ খিদে হয়েছে, এবার আপনি চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। ছুটির সময় হেঁটেই নামতে পারবেন সিঁড়ি দিয়ে।

অতনু বলল, ছুটি? আমি যদি এখান থেকে আর না যাই?

মেয়েটি হেসে বলল, বা বেশ তো। থাকুন না। আমাদের বুঝি পছন্দ হয়েছে আপনার? থাকুন, আমাদের আশ্রমের কাজ করবেন। কিন্তু আপনার স্ত্রী কি রাজি হবেন?

আমার স্ত্রী?

শুনলাম তো আপনার স্ত্রী এখন জার্মানিতে আছেন। খবর পেয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। আপনি ভাল আছেন, তাই তাকে বারণ করা হয়েছে। আপনি তো বেশি কথাই বলতে চান না, কিন্তু রবিবাবু আমাদের সঙ্গে অনেক গান করেন।

অতনু নিজের ওপরেই বিরক্ত হয়ে উঠল। তার এক জন স্ত্রী আছে, অথচ তার মুখ মনে করতে পারছে না। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? না পাগলদের মনে কি এই প্রশ্ন জাগে?

খবরের কাগজ পড়তে তার একটুও মন লাগল না। সবই যেন অবান্তর।

তার চেয়ে ঘুম ভাল। অনেকক্ষণ ঘুমোবার পর সে জাগল ঘণ্টার আওয়াজে। আশ্রমের মন্দিরে আরতি হচ্ছে। সকাল ও সন্ধেবেলা দু’বার। অতনু কোনও দিন কোনও মন্দিরে আরতির সময় উপস্থিত থাকেনি। এখন বাধ্য হয়ে শুনতে হল ঘণ্টাধ্বনি ও বৃন্দগান। যাদের হৃদয়ে ভক্তিভাব নেই, তাদের মনে হয় ওই গানের সুর একঘেয়ে। প্রত্যেকদিন ওই একই গান শুনে দেবতাদেরও খুশি হওয়ার কথা নয়।

আরতি শেষ হবার পর এক জন সেবক এসে প্রত্যেক ঘরে প্রসাদ দিয়ে যায়। আতপচাল দিয়ে মাখা, বাতাসা আর একটা নারকেল নাড়ু। অন্য দিন অতনু কিছুই খায় না। আজকে নারকেল নাড়ুটা মুখে দিল।

নাড়ুটাতে সে মা-মা গন্ধ পেল। মা প্রায়ই নাডু বানাতেন, অতনু ভালবাসত খুব। মাকে তার মনে পড়ল, মা যেন বহু দূরের মানুষ। মুখখানা ঝাপসা।

এক জন ঘরে ঢুকে বলল, অন্ধকার কেন, আলো জ্বালেনি?

আলো জ্বেলে দিল দীধিতি। তাকে দেখেই তার সম্পর্কে সব কিছু মনে পড়ে গেল অতনুর। আগের দিনের কথাও। দু’দিন ও আসেনি বলে তার মনে অভিমানও জমেছে।

সে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?

তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অতনু বলল, তুমি যে আজ এলে বড়? তোমার তো আর আসার কথা নয়?

কেন, আসার কথা নয় কেন?

আগের দিন তুমি আমার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে চলে গিয়েছিলে!

হ্যাঁ, কেউ আমাকে ডেকেছিল। আজ এলাম, আপনি তো চলে যাবেন দু-এক দিনের মধ্যে, আর যদি দেখা না হয়। তাই বিদায় নিতে এলাম। আশ্রমের কাজে আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়।

সত্যি কথা বলো তো পরি, সে-দিন তুমি আমার ব্যবহারে ভয় পেয়েছিলে?

একটু ভয় পেয়েছিলাম, তা সত্যি।

তবু আবার এলে?

কাল সারা দিন ভাবলাম, এই ভয় পাওয়াটা আমার দুর্বলতা। এটাকে জয় করতে না পারলে তো কোনও কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়।

কেমন ভয়কে জয় করেছ দেখি? কাছে এসো। তোমার হাতটা আমাকে ধরতে দাও।

খাটের কাছে এসে, ঠোঁট টিপে হেসে সে বলল, আপনি ধরবেন, না আমি আপনার হাত ধরব। আপনার পাল্‌স বিট চেক করব।

ওসব এখন থাক। তোমাকে দেখে আমার বুক কাঁপছে। সম্পূর্ণ আশ্রমবিরোধী এক চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছে। তোমাকে এখন একটু আদর করলে কি তোমার ধর্মনাশ হবে? ধর্ম কি এত ঠুনকো।

আমার ধর্মনাশের কথা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু ও-সব করে আপনার কী হবে?

আমার ডেফিনিটলি শারীরিক সুখ হবে। পৌরুষের তৃপ্তি হবে। আচ্ছা তুমি যে রোগীদের ঘরে অনেকক্ষণ একলা থাকো, এমনকী রাত্তিরেও থাকো, এর আগে অন্য কেউ তোমাকে ছুঁতে চায়নি? কেউ জোর করেনি?

অতনুর হাতের ওপর নিজের হাত রেখে পরি বলল, চেয়েছে, তার পরেই তারা হতাশ হয়েছে। তার মানে? হতাশ হয়েছে কেন?

কারণ আমার শরীরটা যে ঠাণ্ডা বরফের মতো। আমি যে কামনা-বাসনা মুছে ফেলেছি একেবারে। এ শরীর আর মানুষের জন্য নয়। শুধু আমার আরাধ্য দেবতার জন্য। আপনি মীরাবাইয়ের কথা শোনেননি? তাঁর সঙ্গে নিজের তুলনা করছি না। তিনি মহীয়সী, কিন্তু আমিও তাঁর পথেই চলেছি।

বাজে কথা বলো না। মীরাবাইয়ের কথা আমি জানি না। কিন্তু প্রত্যেক শরীরেরই একটা যৌবন ধর্ম থাকে। বায়োলজিক্যাল নিয়মেই সে শরীর জাগ্রত হয়। তোমরা সেটা যতই চাপা দেবার চেষ্টা করো, কিন্তু প্রকৃতি তো তার দাবি জানাবেই। প্রকৃতি চায় মিলন।

প্রকৃতিকেও অস্বীকার করা যায়। বিশ্বাস করুন, যায়। আমার গুরুমা কোনও দিন পুরুষসঙ্গ করেননি। অথচ ভাল পরিবারে ওঁর জন্ম। উনি তো পেরেছেন।

ওনার কি মেন্সট্রুয়েশান হত? তোমার হয়? এটাই তো প্রকৃতির ইঙ্গিত। তোমরা জোর করে সেটা আটকাবার চেষ্টা করলে, সেটা খুবই কৃত্রিম ব্যাপার। তার মধ্যে সত্যের গভীরতা কিছু নেই।

আপনি এমন কথা বলেন! আপনার মতো এমন একশো ভাগ নাস্তিক আমি আগে কখনও দেখিনি। আমাদের চেনাজানা বৃত্তের মধ্যে এমন মানুষ আসে না। বাপরে বাপ, কী তীব্রভাবে আপনি সব মূল্যবোধ অস্বীকার করেন! এক হিসেবে, আপনি অসাধারণ।

তার কারণ, তোমরা একটা ছোট বৃত্তের মধ্যে থাকো। নিজেদের গুটিয়ে রাখো। কতকগুলো আপ্তবাক্য মেনে চলো, যুক্তিবোধ দিয়ে বিচার করো না। আমি অসাধারণ কিছু নই, আমি সাধারণ মানুষ। শুধু আমি অন্য কারওর নির্দেশ ধার করি না, শুধু নিজের বিবেকের নির্দেশে চলি। আমি সামাজিক রীতিনীতি মানি না। তবে আমারও নিজস্ব একটা নীতি আছে, এমনকী বলতে পারো, আমিও একটা ধর্ম মানি। তার নাম মানবধর্ম।

আমরা সবাই তো সেই মানবধর্মই মানি। হয়তো আমাদের পথ আলাদা।

না, তোমরা মানবধর্ম মানো না। মুক্ত চিন্তা ছাড়া মানবধর্ম হয় না। সে-ধর্ম মানতে গেলে শারীরিক সুখ, পার্থিব উপভোগ, এ-সব বাদ দেবার কোনও প্রশ্ন নেই। যেমন আমি মনে করি, এক জন নারী ও পুরুষের যদি পারস্পরিক সম্মতি থাকে, তাহলে তাদের মিলনও পবিত্র। আমি কোনও দিন কোনও মেয়ের ওপর জোর করিনি, করবও না। সেই জন্যই আমি তোমাকে এখন জিজ্ঞেস করছি, আমি তোমার হাতটা আমার হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঘষি, তাতে তোমার আপত্তি আছে?

তাতে কী হবে?

দেখতে চাই, তোমার হাতে উত্তাপ আসে কি না। এখন বেশ কিছুক্ষণ এ ঘরে আসবে না কেউ।

না, প্লিজ, ও-সবের দরকার নেই।

একটা সামান্য এক্সপেরিমেন্টে তোমার ভয়? তুমি বললে, তোমার শরীর হিমশীতল হয়ে গেছে। আমি মিলিয়ে দেখব, সেটা সত্যি কি না। তুমি ভয় পাবে কেন?

না, আমি ভয় পাই না।

পরির কুসুম-কোমল হাতখানিতে অতনু নিজের হাতটা ঘষতে লাগল। বেশিক্ষণ নয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই হাতে এল তাপ। এই তাপ লুকিয়েছিল তার শরীরেই, এখন আত্মপ্রকাশ না করে পারল না।

শুধু তাই-ই নয়, পরির দু-গালে লাগল রাঙা ছোপ, স্ফীত হল ওষ্ঠাধর। কপালে খুব সূক্ষ্ম ঘামের বিন্দু।

অতনু বলল, দেখেছ প্রকৃতির দাবি কত জোরালো?

ধরা গলায় পরি বলল, আমি এখন যাই।

অতনু ঘাড় হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ যেতে পারো।

পরি এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

অতনু বলল, এখান থেকে বেরিয়েই কারওর সামনে যেয়ো না। কিছুক্ষণ একা থেকো। এখন তোমার মুখচোখ দেখলে যে-কেউ চমকে উঠবে, হয়তো ভাববে, কেউ তোমার ওপর অত্যাচার করেছে।

দৌড়ে আবার খাটের কাছে ফিরে এসে কান্নাভরা গলায় পরি বলল, এ আপনি আমার কী করলেন? আমার সারা শরীর কাঁপছে।

তার থুতনিটা তুলে ধরে অতনু বলল, আমি মাটির মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন যে তোমাকে আরও কত সুন্দর দেখাচ্ছে, তা তুমি জানো না।

থুতনিটা ছেড়ে দিয়ে অতনু খাট থেকে নামার চেষ্টা করল। পরি জিজ্ঞেস করলেন, ও কী করছেন? নামছেন কেন?

অতনু বলল, দরজার ছিটকিনিটা বন্ধ করে দিচ্ছি। আমাকে যখন তুমি পরিষ্কার-টরিষ্কার করে দাও, তখনও তো দরজা বন্ধই থাকে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়