সারাদিন শশীকান্ত চুপচাপ শুয়ে রইল সেই ঘরে।

 রাতে অনেকটা সাহসসঞ্চয় করে ফেলল সে।

রতন খাবার নিয়ে আসতেই সে বলে উঠল, আমি রুটি খাই না। ভাত নেই?

 রতন বলল, এবাড়িতে রাত্রিতে ভাত হয় না।

শশীকান্ত তাতেও দমে না গিয়ে বলল, বেশ। কিন্তু ও কয়খানি রুটিতে আমার পেট ভরবে না। আরও রুটি লাগবে।

খাবারের প্লেট নামিয়ে রেখে রতন ফিরে গেল। ফিরে এল আরও প্রায় দশ-বারোখানা রুটি নিয়ে।

ব্যাঙ্গের সুরে সে জিজ্ঞেস করল, এতে হবে?

শশীকান্ত ঘাড় নাড়ল।

তারপর মুখ তুলে, খাতিরকরা গলায় জিজ্ঞেস করল–দাদার নাম কী?

 খুবই অবজ্ঞার সুরে সে বলল, রতনকুমার দাস।

উৎসাহিত হয়ে শশীকান্ত বলল, আপনিও দাস। আমিও দাস। আমার নাম শশীকান্ত দাস। কুষ্টিয়ায় বাড়ি।

এতেও বরফ গলল না। আর কোনো উত্তর না দিয়ে রতন চলে গেল। যেন সে বুঝিয়ে দিতে চায়, তার দাস আর শশীকান্তর দাস এক নয়। বাংলাদেশের লোক। তাই ধরনধারণ এরকম।

প্রায় এইরকম ভাবেই সাতটা দিন কাটল।

নির্জনতায় অতিষ্ঠ হয়ে সপ্ততম রাত্রিতে মরিয়া হয়ে গিয়ে শশীকান্ত ধরল গান। বেশ উঁচু গলায়। সেই গানটা, শহরে ষোলোজন বোম্বেটে

তখন উজ্জয়িনীর ঘরে রেকর্ড প্লেয়ারে বাজছে ইংরেজি বাজনা!

অষ্টম দিন দুপুরে দমদম এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছোলেন জ্ঞানব্রত।

আগে থেকে খবর দেওয়া আছে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে বাইরে। সঙ্গে একটা ছোটো ব্যাগ ছাড়া মালপত্রের ঝঞ্ঝাট নেই।

জ্ঞানব্রত দ্রুত বেরিয়ে আসছেন বাইরে, হঠাৎ একটি সুন্দরী তরুণী মেয়ে কোথা থেকে তাঁর পথ আটকে দাঁড়াল।

এক গাল হেসে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আমায় চিনতে পারছেন?

মুখে একটানা ভ্রমণের ক্লান্তি, হাতে একটা ভারী ব্রিফকেস, জ্ঞানব্রত চাইছিলেন কোনোক্রমে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে গলার টাই ও জামার বোতাম খুলে ফেলতে।

সামনে মেয়েটিকে দেখে তাকে থমকে দাঁড়াতেই হল।

মেয়েটি সারামুখে ঝলমলে হাসি ফুটিয়ে বলল, নিশ্চয়ই আমাকে ভুলে গেছেন? আমি কে বলুন তো?

এই কয়েকটা দিন বাইরে বাইরে ঘুরে সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষজনের মধ্যে থাকতে হয়েছে। জ্ঞানব্রত বাংলাতে কথা বলারও কোনো সুযোগ পাননি। হঠাৎ কলকাতার পা দেবার পরমুহূর্তেই কেউ এ-রকম পরীক্ষায় ফেললে তিনি পারবেন কেন।

মেয়েটিকে চেনা লাগছে ঠিকই।

 জ্ঞানব্রত দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন। মেয়েটি বেশ রূপসী, সঙ্গে কেউ নেই, এয়ারপোর্টে একা, তবে কি কোনো এয়ার হোস্টেস?

কিন্তু এয়ার হোস্টেসদের পোশাকের মধ্যে কীরকম যেন নৈর্ব্যক্তিক ব্যাপার থাকে সেটা দেখলে বোঝা যায়। এর পোশাক সেরকম নয়। বেশ একটা চড়া লাল রঙের শাড়ি পরে আছে।

মেয়েটি জ্ঞানব্রতর চোখে চোখ রেখে প্রতীক্ষা করছে বলে তিনি বললেন, হ্যাঁ চিনতে পারব না কেন?

আমার নাম বলুন তো?

নামটা তো মনে নেই বটেই, এমনকী কোথায় যে দেখেছেন মেয়েটিকে, তাও মনে করতে পারছেন না জ্ঞানব্রত।

এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? এই তো মাত্র দশ-বারো দিন আগে দেখা হয়েছিল।

কোথায়?

ক্যালকাটা ক্লাবে। আপনার এক বন্ধু আলাপ করিয়ে দিলেন, কতক্ষণ আপনার টেবিলে বসলাম।

এলা?

যাক, চিনতে পেরেছেন তাহলে।

জ্ঞানব্রত বুঝতে পারলেন, কেন মেয়েটিকে তিনি ঠিক গেস করতে পারছিলেন না। এ রকম একটি সুশ্রী মেয়েকে মাত্র কয়েকদিন আগেই দেখে তাঁর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু সে-দিন মেয়েটি জিন খেয়ে নেশা করেছিল বলে তার চোখ দু-টি ছিল কাচের মতন। আর প্রায় সর্বক্ষণই দেখেছিলেন বসে থাকা অবস্থায়। আজ একে দেখছেন একেবারে ভিন্ন পরিবেশে। বিভিন্নরকম চুল বাঁধবার কায়দাতে মেয়েদের মুখ অনেকখানি বদলে যায়।

জানেন, আজ ট্যাক্সি স্ট্রাইক?

বিমানযাত্রীদের কাছে এ সংবাদ বেশ একটা বড়ো সমস্যা বটে, কিন্তু জ্ঞানব্রতের মনে কোনো দাগ কাটল না। কলকাতা শহরে তাঁর ট্যাক্সি চড়ার কোনো অবকাশ হয় না। তাঁর জন্য নিশ্চয়ই গাড়ি অপেক্ষা করছে বাইরে।

তুমি কোথাও যাচ্ছ, না আসছ?

এলা আবার হেসে ফেলল। তারপর ছেলেমানুষদের মতন দুষ্টুমির সুরে বলল, আমি কোথাও যাচ্ছিও না, আসছিও না।

জ্ঞানব্রত ব্রিফকেসটা ডান হাত থেকে বাঁ-হাতে নিলেন।

আমি একজনকে পৌঁছে দিতে এসেছিলাম।

ও।

আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো হল। চলুন একটু কফি খাবেন? সেদিন আপনি আমাকে অনেক খাইয়ে ছিলেন, আজ আমি আপনাকে খাওয়াব।

একটু ইতস্তত করে জ্ঞানব্রত বললেন, ঠিক কফি খাবার ইচ্ছে এখন আমার নেই, বাড়ি ফেরার একটু তাড়া আছে, ওটা না হয় আর একদিন হবে।

আপনার গাড়ি আছে নিশ্চয়ই? আমি কিন্তু লিফট নেব।

 খুব ভালো কথা।

আসবার সময় কী কান্ড! আমার এক দিদি আজ আগরতলায় গেল। সঙ্গে অনেক মালপত্র, এদিকে ট্যাক্সি বন্ধ…শেষপর্যন্ত অনেক কষ্টে একটা শেয়ারের গাড়িতে…

টার্মিনালের বাইরে এসে জ্ঞানব্রত স্থির হয়ে দাঁড়ালেন এক জায়গায়। গাড়ি তাঁকে খুঁজতে হবে না। গাড়ির ড্রাইভারই তাঁকে খুঁজে বের করবে।

কোথায় আপনার গাড়ি? কত নম্বর?

ব্যস্ত হবার কিছু নেই, গাড়ি আসবে এখানে।

জানেন, আপনি আমার একটা দারুণ উপকার করেছেন?

জ্ঞানব্রত রীতিমতন অবাক হয়ে বললেন, আমি! আমি আপনার কী উপকার করেছি? মাত্র একদিন দেখা।

চলুন, গাড়িতে যেতে যেতে বলছি।

 ঠিক এই সময় একজন কেউ ডাকলেন, জ্ঞানদা! জ্ঞানদা!

জ্ঞানব্রত মুখ ফিরিয়ে দেখলেন বাবুল আমেদ হন্তদন্ত হয়ে আসছে এই দিকে। দু-হাতে দু টি সুটকেস।

বাবুল আমেদ মোটাসোটা, হাসিখুশি মানুষ। কার্ডবোর্ড বক্সের বেশ বড়ো ব্যবসা আছে। বেঙ্গল চেম্বার্স অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট। জ্ঞানব্রতর চেয়ে দু-তিন বছর বড়োই হবেন, কিন্তু ইনি প্রায় সবাইকেই দাদা বলে ডাকেন।

আরে দাদা, কী ঝামেলায় পড়েছি। আমার ফেরার কথা ছিল গতকাল। সে ফ্লাইট মিস করেছি, তারপর আর খবরও দিতে পারিনি, সেইজন্য আমার গাড়ি আসেনি। এদিকে আবার ট্যাক্সি স্ট্রাইক। আপনার কী অবস্থা?

জ্ঞানব্রত বললেন, চলুন, আপনাকে আমি নামিয়ে দিচ্ছি।

এলার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছায়া পড়ল। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সে পছন্দ করছে না।

 জ্ঞানব্রতর কোম্পানির গাড়ি তখনই চলে এল সামনে। ড্রাইভার নেমে সেলাম করতেই জ্ঞানব্রত বললেন, পেছনের হুড খুলে দাও, এই সাহেবের সুটকেস যাবে।

এলা বলল, আমি সামনে বসি।

বাবুল আমেদ বললেন, না, না, আপনি সামনে বসবেন কেন? আমি বসব। আমার সামনে বসাই অভ্যেস।

গাড়ি চলতে শুরু করার পরই বাবুল আমেদ ব্যবসাপত্রের কথা শুরু করে দিলেন। দাদা, আপনি স্টেট ট্রেডিং-এর মালহোত্রাকে চেনেন; এবার দিল্লিতে গিয়ে দেখলাম!…

জ্ঞানব্রত হুঁ-হুঁ দিয়ে যেতে লাগলেন।

হঠাৎ কথা থামিয়ে বাবুল আমেদ বললেন, রোককে। ড্রাইভার সাহেব, এখানে একটু রুখে দিন তো।

কী হল?

এই সামনের দোকান থেকে একটু কোল্ড ড্রিংকস নেব। অনেকক্ষণ ধরে তেষ্টা পেয়েছে। হঠাৎ কীরকম গরমটা পড়ে গেল দেখলেন?

গাড়ি থামতে পাশের দোকানে চার বোতল কোল্ড ড্রিংকসের অর্ডার দিলেন বাবুল আমেদ, অর্থাৎ ড্রাইভারের জন্যও একটা। পেছনের সিটে দু-টি বোতল বাড়িয়ে দিয়ে তিনি জ্ঞানব্রতকে বললেন, দাদা এ আপনার মেয়ে তো? এতক্ষণ চিনতেই পারিনি, সেই অনেকদিন আগে একবার দেখেছিলাম, ফ্রক পরার বয়েস তখন

এ-রকম ভুল করার জন্য বাবুল আমেদকে দোষ দেওয়া যায় না।

এলা তো জ্ঞানব্রতর মেয়েরই প্রায় সমবয়েসি। তা ছাড়া অনাত্মীয়া যুবতী মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে ঘোরার সুনাম জ্ঞানব্রতর নেই ব্যবসায়ী-মহলে।

এলা মুখটা ফিরিয়ে থাকে।

জ্ঞানব্রত একটু বিব্রতভাবে বললেন, না, না, আমার মেয়ে না। মেয়ের বান্ধবী, এয়ারপোর্টে হঠাৎ দেখা হল।

জ্ঞানব্রতকে সামান্য মিথ্যে কথা বলতে হল। এলা তাঁর মেয়ের সঙ্গে এক বছর এক কলেজে পড়েছে বটে, কিন্তু তার মেয়ের বান্ধবী নয়। উজ্জয়িনী এলার নাম শুনে ভালো করে চিনতেই পারেনি। বয়েসের তুলনায় এলা অনেক বড়ো হয়ে গেছে।

আবার গাড়ি চলতে শুরু করার পর বাবুল আমেদ আবার ফিরে গেলেন ব্যবসার কথাবার্তায়। এলা কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না।

বাবুল আমেদ নামলেন মৌলালীতে।

তারপর এলা গম্ভীরভাবে বলল, আমাকে এসপ্ল্যানেডে ছেড়ে দিলেই হবে।

তোমার বাড়ি কোথায়?

অনেক দূরে, বেহালার কাছে।

বেহালা অনেক দূরে তো বটেই তা ছাড়া একেবারে অন্য রাস্তায়।

 জ্ঞানব্রত অতিশয় ভদ্র, মাঝপথে কোনো মহিলাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি পৌঁছে পোশাক বদলাবার জন্য তাঁর মনটা ছটফট করছে।

এখন রাত সাড়ে নটা। একবার তিনি ভাবলেন, তিনি আগে বাড়ি গিয়ে তারপর ড্রাইভারকে বলবেন, বেহালায় এই মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে। তাঁর বাড়ির সামনে গাড়িতে এলা বসে থাকবে…।

জ্ঞানব্রতকে দ্বিধা করতে দেখে এলা বলল, আমাকে এই সামনে এসপ্লানেডে নামিয়ে দেবেন, আমার কোনো অসুবিধে নেই আপনার সঙ্গে দেখা না হলে তো আমি মিনি বাসেই ফিরতাম।

জ্ঞানব্রত জোর দিয়ে বললেন, না, সে প্রশ্নই ওঠে না। আমি তোমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসব। কতক্ষণ আর লাগবে।

আমার বাড়ি পর্যন্ত গেলে আপনাকে একবার নামতে হবে। কথা দিন।

এখন, এত রাত্রে?

ক-টা আর বাজে?

অন্তত দশটা বেজে যাবে।

তাতে আর কী হয়েছে। এক কাপ চা খেয়ে যাবেন শুধু।

আমি সন্ধ্যের পর চা-কফি আর কিছু খাই না।

এবার গলা নীচু করে, মুচকি হেসে এলা বলল, হুইস্কি অবশ্য খাওয়াতে পারব না বাড়িতে।

জ্ঞানব্রত নিয়মিত মদ্যপান করেন না। কখনো কখনো একটু একটু। এ মেয়েটি কি তাঁকে নেশাখোর ভেবেছে নাকি? পঞ্চাশ বছর বয়েস পেরিয়ে যাবার পর ক-জন লোকই-বা রাত দশটার সময় চা খায়?

এসপ্ল্যানেড আসবার পর জ্ঞানব্রত ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন বেহালার দিকে যাওয়ার জন্য। তারপর তিনি অন্যমনস্কভাবে চুপ করে গেলেন।

আপনি আমার ওপর রেগে গেলেন?

আরে? রাগ করব কেন?

কোনো কথা বলছেন না আমার সঙ্গে?

জ্ঞানব্রত ভাবলেন, এ মেয়েটা কি পাগল নাকি? হঠাৎ তিনি রাগ করতে যাবেন কেন ওর ওপরে? তা ছাড়া কোনো কিছু বলবার না থাকলেও কথা বলে যেতে হবে? এমনিতেই কম কথা বলা তাঁর স্বভাব।

আপনার কৌতূহল খুব কম, তাই না?

কেন? সেটা কী করে বোঝা গেল।

আপনি আমায় এয়ারপোর্টে দেখেও প্রথমে জিজ্ঞেস করেননি কার সঙ্গে সেখানে গেছি। তারপর এই যে আপনাকে বললাম, একবার আমার বাড়িতে নামতে হবে, তখনও জিজ্ঞেস করলেন না, বাড়িতে কে কে আছে?

জ্ঞানব্রত বুঝতে পারলেন, এবার মেয়েটি ঠিকই ধরেছে। এটা বোধ হয় সুজাতার প্রভাব। সুজাতা কখনো কারুর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করে না। নারী জাতির মধ্যে সুজাতার মতন এমন কম কৌতূহলপরায়ণা খুবই দুর্লভ।

তিনি হেসে বললেন, একটা ব্যাপারে অবশ্য আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে, তুমি তখন বললে, আমি তোমার উপকার করেছি সেটা কী উপকার?

আপনি রেডিয়োর স্টেশন ডিরেক্টার পিসি বড়ুয়ার সঙ্গে আমার আলাপ করে দিয়েছিলেন, মনে আছে?

হুঁ।

উনি আমায় গানের প্রোগ্রাম দিয়েছিলেন। আগে আমি অনেকবার চেষ্টা করেও পাইনি। এবার যে পেলাম সে তো আপনার জন্যই।

এজন্য আমি তো কোনো চেষ্টা করিনি। যাই হোক। যদি তোমার উপকার হয়ে থাকে, আর তাতে আমার কোনো যোগাযোগ থাকে, তাতে আমার খুশি হবারই কথা।

সামনের মাসেই আমার প্রোগ্রাম।

বা:!

আপনারা বেশ মেকানিক্যাল। যখন-তখন বাঃ বলতে পারেন। এলার গলায় রাগের ঝাঁঝের পরিচয় পেয়ে জ্ঞানব্রত একটু সচকিত হলেন। তিনি কোনো ভুল করে ফেলেছেন?

এখানে, বা:! বলা বেমানান?

নিশ্চয়ই বেমানান। আমি কেন গান করি, সে-সম্পর্কে আপনার একটু কৌতূহল নেই, তবুও বললেন বা:।

রেডিয়োতে প্রত্যেকদিন কত ছেলে-মেয়েই তো গান গায়। তা ছাড়া জ্ঞানব্রত অতি কদাচিত রেডিয়ো শোনেন। সুতরাং রেডিয়োতে কে, কবে, কী গান গাইবে, সে-ব্যাপারে জ্ঞানব্রতর কৌতূহল বা আগ্রহ থাকবে কেন? কিন্তু যে জীবনে প্রথম রেডিয়োতে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছে, তার কাছে এটা নিশ্চয়ই খুবই উত্তেজনার ব্যাপার।

না। না। শুনতে হবে। একদিন শুনব তোমার গান।

 দেখি, সে দিনটা কবে আসে।

 খুব শিগগিরই একদিন..

একটা মুশকিল হয়েছে কী জানেন, আমি নজরুল-অতুলপ্রসাদ গাই, কিন্তু বড়সাহেব বললেন, পল্লিগীতিতে স্কোপ বেশি। ওই প্রোগ্রামে ভালো আর্টিস্ট পাওয়া যায় না। সেইজন্য আমায় একটা করে পল্লিগীতির অনুষ্ঠানও করে যেতে হবে। আমি ফোক সঙ কোনোদিন তেমন শিখিনি… এখন শিখতে যেতে হবে কারুর কাছে।

এতক্ষণে শশীকান্তর কথা মনে পড়ল জ্ঞানব্রতর। তিনি একজন গায়ককে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছেন। সে ছেলেটা কী করছে কে জানে? সে কি সুজাতা-উজ্জয়িনীদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে?

আমি একজন পল্লিগীতির গায়ককে চিনি। ভালো গায়। জানি না, সে তোমার শেখাতে পারবে কিনা।

কে? কে? কী নাম?

একদিন আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।

এলা তার ডান হাতটা সিটের ওপর দিয়ে বাড়িয়ে জ্ঞানব্রতর একটা হাতের ওপর রাখল। জ্ঞানব্রত প্রায় শিহরিত হলেন। এ কী করছে মেয়েটা? সামনে ড্রাইভার রয়েছে। এরকমভাবে তো প্রেমিক-প্রেমিকারা হাতের ওপর হাত রাখে। মেয়েটা তাঁর সঙ্গে এ-রকম ব্যবহার করছে কেন?

জ্ঞানব্রত নিজের হাতটা সরিয়ে নিতেও পারলেন না। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আড়ষ্টভাবে বসে রইলেন।

বেহালায় বাড়ির সামনে পৌঁছে এলা আর বিশেষ জোর করল না। জ্ঞানব্রত দু-বার না বলতেই সে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। আজ নামতে হবে না। কিন্তু বাড়ি তো চিনে গেলেন, অন্য কোনোদিন আসবেন তো?

-হ্যাঁ, আসব। গান শোনা আর চা পাওনা রইল।

অদ্ভুত রহস্যময়ভাবে জ্ঞানব্রতর দিকে হেসে এলা খুব আস্তে আস্তে বলল, আমি জানি, আপনি ঠিক আসবেন।

বাড়ি ফেরার পর সুজাতা জিজ্ঞেস করল, এত দেরি হল? প্লেন লেট ছিল?

না, আজ ট্যাক্সি স্ট্রাইক। দু-জনকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এলুম।

ভালো করে স্নান করে পাজামা ও পাঞ্জাবি পরার পর জ্ঞানব্রত খুব স্বস্তির সঙ্গে বললেন, আঃ।

আজ তাঁর ভালো ঘুম হবে। নিজের বাড়িতে, নিজের বালিশটিতে মাথা দিয়ে ঘুমোনোর মতন আরাম আর নেই।

খাওয়ার টেবিলের কাছে এসে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িটা বড় চুপচাপ লাগছে। খুকু কোথায়?

ও নাইট শো-তে সিনেমায় গেছে। বুলুমাসিদের সঙ্গে। আর একটু বাদেই ফিরবে।

তুমি গেলে না সিনেমায়?

আমি কি সব সিনেমা দেখি? তা ছাড়া তুমি আজ আসবে।

সেই ছেলেটি কোথায়? সে খেয়েছে?

সুজাতা এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে টেবিলের ওপর দু-হাত রেখে মুখখানা নীচু করে রইল।

উত্তর না পেয়ে বিস্মিত হলেন জ্ঞানব্রত। চেয়ারে না বসে তিনি এগিয়ে গেলেন গেস্ট রুমের দিকে।

সে-ঘরটির দরজাটা বন্ধ। জ্ঞানব্রত একটু ঠেলতেই খুলে গেল। ঘর ফাঁকা।

এ কী? সেই ছেলেটি কোথায়? শশীকান্ত? সুজাতা খুব ধীর স্বরে বলল, সে আজ সকালে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। সারাদিনে আর ফেরেনি।

স্ত্রীকে দু-একটি প্রশ্ন করেই থেমে গেলেন জ্ঞানব্রত।

 বাড়িতে তিনি একজন অতিথি রেখে গিয়েছিলেন। তারপর কয়েক দিন কলকাতার বাইরে থেকে ঘুরে এসে দেখলেন সেই অতিথি নেই। কোথায় গেছে কেউ জানে না। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় অতিথির প্রতি অযত্ন, অবহেলা, অত্যন্ত ঔদাসীন্য দেখানো হয়েছিল নিশ্চয়।

কিন্তু এই ব্যাপার নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদ এমনকী উঁচুগলায় কথা বলাও জ্ঞানব্রতর স্বভাব নয়। তাঁর সব কিছুই মনে মনে।

শশীকান্ত কোথায় যেতে পারে? তার তো কোনো যাবার জায়গা নেই। সে মেস ছেড়ে চলে এসেছে, সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না, কারণ সেখানে একজন রুমমেট তাকে তাড়িয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত ছিল। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে? যোধপুর পার্কে বাড়ি খুঁজে পাওয়া শক্ত, অনেকেই বলে। পুলিশে ফোন করা কি উচিত হবে? শশীকান্ত একজন শক্তসমর্থ চেহারার পুরুষ-মানুষ, সে বাড়ি ফেরেনি বলে থানায় খবর দিলে যদি সেখানকার লোকেরা হাসাহাসি করে?

পোশাক বদলে জ্ঞানব্রত দু-টি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লেন। সুজাতা বাথরুমে। উজ্জয়িনীর ঘরে রেকর্ড প্লেয়ারে একটা উগ্র বিদেশি সুর বাজছে। জ্ঞানব্রত একদিন দেখেছিলেন, উজ্জয়িনী ঘরের মধ্যে একা একাই নাচে। তখন বড় সুন্দর দেখায় ওকে, চোখ দুটো মোহের আবেশে বুজে আসা, হাতের আঙুলগুলো যেন মোমে গড়া। ঠোঁটের ভঙ্গিতে অদ্ভুত সারল্য। কিছু দিন ধরে মেয়ের কথা ভাবলেই এলার কথা মনে পড়ে। ওরা প্রায় একই বয়সি। কিন্তু দু-জনে কত আলাদা।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে রাত-পোশাক পরা সুজাতা নিজের খাটে শুয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কিন্তু আজ আর ডিটেকটিভ উপন্যাস খুলল না।

তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?

জ্ঞানব্রত চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। চক্ষু বোজা। বুকের উপর আড়াআড়ি দুটি হাত রাখা। আজ আর ঘুমের আরাধনা করতে হবে না, ট্যাবলেট তার কাজ ঠিক সময়মতন করবেই। এর সঙ্গেই হাত-পা একটু ঝিমঝিম করছে।

না, তুমি কিছু বলবে?

আমাদের যে এক সঙ্গে বাইরে কোথাও যাবার কথা বলেছিলে? যাবে না?

হ্যাঁ। যাওয়া যেতে পারে। কোথায় যাবে, ঠিক করেছ?

 পুরী।

পুরী গত বছরই তো গিয়েছিলুম।

গতবার তো সারাক্ষণই বৃষ্টি হল..সমুদ্র আমার ভালো লাগে..

ঠিক আছে। কালই হোটেল বুক করবার ব্যবস্থা করব। নিজের খাট থেকে উঠে এসে সুজাতা বলল, একটু সরো তোমার পাশে আমি শোব।

আজ বই পড়বে না?

 কেন, তোমার পাশে শুলে আপত্তি আছে?

জ্ঞানব্রত হাত বাড়িয়ে সুজাতার কোমর ধরে নিজের কাছে টেনে নিলেন। মনে মনে অনুশোচনা হল। কেন ঘুমের ট্যাবলেট খেতে গেলেন আজ। আসল ব্যাপারটা হবার আগে সুজাতা অনেকক্ষণ আদর পছন্দ করে। যদি তার মধ্যে ঘুম এসে যায়!

জ্ঞানব্রতর মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে সুজাতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি আমার উপরে রাগ করেছ?

কেন, রাগ করব কেন?

..ওই যে গায়কটি, শশীকান্ত…ও বাড়ি ফেরেনি, তুমি ভাবছ ওকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি…

…না, না, সে-কথা বলব কেন?

 … লোকটি তো কথাই বলতে চায় না, এত লাজুক, আমি দু-এক বার চেষ্টা করেছি..তুমি শখ করে ওকে বাড়িতে ডেকে এনেছ, ওর যাতে কোনো অযত্ন না হয় সে-কথা আমি কাজের লোকেদের বলেছিলাম।

না, না, তুমি তো যথেষ্ট করবেই, আমি জানি।

তোমার শরীর কি ভালো নেই, কিছুদিন ধরেই দেখছি, তুমি অন্যমনস্ক?

শরীর তো ঠিকই আছে। অন্যমনস্ক থাকি বুঝি?

 তুমি বড়ো বেশি পরিশ্রম করছ আজকাল।

সুজাতার ঊরু কি মসৃণ, তলপেটে ভাঁজ পড়েনি, বুক দু-টি এখনও সুগোল। বোঝাই যায় না, তার অত বড়ো মেয়ে আছে। আজ জ্ঞানব্রতকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি এখনও সক্ষম পুরুষ-মানুষ। কিছুতেই ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না।

মধ্যপথে বিকট শব্দে টেলিফোন বেজে উঠল! বেডরুমের টেলিফোনের কানেকশন রাত এগারোটার পর অফ করা থাকে। সুজাতা নিজেই এটা করে। আজ সে ভুলে গেছে। আজই। বেশি রাতের টেলিফোনের আওয়াজে কেমন একটা গা ছম ছম করা ভয় আছে। জ্ঞানব্রতর নির্দেশ আছে অফিসের হাজার জরুরি কাজ থাকলেও কেউ যেন তাঁকে রাত এগারোটার পর বিরক্ত না করে। কিন্তু যদি ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগে?

স্বামী আর স্ত্রী দুজনেই একটুক্ষণ নিস্পন্দ হয়ে শুনল আওয়াজটা। তারপর সুজাতা বলল, আমি ধরব? জ্ঞানব্রত বললেন, না, আমি ধরছি।

প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। জড়িত গলায় কে যেন হিন্দিতে কী জানতে চাইছে।

 জ্ঞানব্রত কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, হ্যালো, হু ইজ স্পিকিং? হুম ডু য়ু ওয়ান্ট?

রং নাম্বার।

জ্ঞানব্রতর ইচ্ছে হল টেলিফোন যন্ত্রটা আছড়ে ভেঙে ফেলতে। তার বদলে তিনি তার ধরে এক টান দিয়ে প্লাগটা খুলে ফেললেন। সুজাতা ততক্ষণে উঠে বসেছে। জ্ঞানব্রত ফিরে আসতেই বলল, আজ আর থাক।

জ্ঞানব্রত আপত্তি করলেন না। তিনি জানেন, একটু কোনোরকম ব্যাঘাত ঘটলেই সুজাতার মুড অফ হয়ে যায়।

এরপর শুতে-না-শুতেই ঘুমিয়ে পড়লেন জ্ঞানব্রত। যেন ট্যাবলেটের ঘুম তাঁর জন্য জানলার বাইরে অপেক্ষা করছিল।

পরদিন সকাল বেলা জানা গেল শশীকান্ত বাড়ির গেটের বাইরের সিঁড়িতে বসে ঘুমোচ্ছে।

 জ্ঞানব্রত নিজেই যথেষ্ট ভোরে ওঠেন কিন্তু তাঁর আগেই রঘু দেখতে পেয়েছে। খবর পেয়ে জ্ঞানব্রত সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই শশীকান্ত ধড়মড় করে জেগে উঠে চোখ কচলাতে লাগল।

কী ব্যাপার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলে?

 আমি হারাই নাই স্যার, আমারে যারা পৌঁছাতে এসেছিল…

তারা কারা?

ব্যাণ্ডেলে গেছিলাম স্যার, একটা ফাংশান ছিল। আসরে গাইতে দিল রাত এগারোটার পর। দুইখানা গানের পর পাবলিক বলল, আরও চাই–আরও চাই। গাইলাম আরও তিনখানা।

বাঃ। ভালো কথা। ব্যাণ্ডেলে ফাংশান করতে গিয়েছিলে সেকথা এবাড়িতে কাউকে বলে যাওনি কেন?

দুপুরে রেডিয়ো স্টেশনে গেলাম। সেখানে বিমানদা বললেন, ব্যাণ্ডেলে একটা ফাংশান আছে, যাবে? মুম্বাইয়ের একজন আর্টিস্ট আসে নাই। ওরা সেইজন্য তিন-চারজন একস্ট্রা লোকাল আর্টিষ্ট চেয়েছে। যাবে তো এক্ষুনি চলো, এক-শো টাকা পাবে। স্যার, এক-শো টাকা রেট তো আমারে আগে কেউ দেয় নাই, তাই রাজি হয়ে গেলাম। পাবলিক খুব সাপোর্ট দিচ্ছে স্যার, আমারে থামতেই দেয় না। ওই গানটা গাইলাম, ষোলো জন বোম্বেটে…

ঠিক আছে। বাড়ির ভেতরে এসো, হাত-মুখ ধুয়ে নাও।

আপনি রাগ করেছেন, স্যার?

না। আমাকে স্যার বলে ডেকো না।

কী বলব?

ইয়ে, শুধু দাদা বলতে পার।

এরপর শশীকান্তের জন্য অন্য ব্যবস্থা হল। দো-তলার সুসজ্জিত গেস্টরুমটির বদলে তাকে পাঠানো হল এক-তলার সাদামাটা একটি ঘরে। সেখানে সে বেশি স্বস্তি পাবে। ঘরটা বাড়ির পেছন দিকে। ইচ্ছে করলে সেখানে সে তার গানের রেওয়াজও করতে পারে। তাতে ওপর তলার লোকেদের কোনো ব্যাঘাত হবে না। তার খাবারও পাঠিয়ে দেওয়া হবে নীচে।

এসব সুজাতারই ব্যবস্থাপনা।

খাবার টেবিলে বসে জ্ঞানব্রত বললেন, তাহলে শনিবারেই পুরীর হোটেল বুক করছি। শচীনকে বলে দিচ্ছি, আজই টিকিট কেটে ফেলবে। ভুবনেশ্বর পর্যন্ত প্লেনে যাবে, না ট্রেনে?

সুজাতা বলল, ট্রেনেই ভালো। এক রাত্রিরই তো ব্যাপার। ওখানে গাড়ি পাওয়া যাবে তো?

হ্যাঁ, টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি ভাড়া করতে হবে।

খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় ঘুম-চোখে উশকোখুশকো চুলে এসে হাজির হল উজ্জয়িনী। টেবিলে বসেই বলল, আমার দুধটা দিয়ে দাও আমি আজ তাড়াতাড়ি বেরোব।

সুজাতা বলল, খুশি, এই শনিবার আমরা পুরী যাচ্ছি।

উজ্জয়িনী যেন আকাশ থেকে পড়ল। সারামুখে বিস্ময় ছড়িয়ে বলল, পুরী? এখন? তোমাদের কী মাথা খারাপ?

কেন?

 গত বছর মনে নেই? সর্বক্ষণ বৃষ্টি।

 তা বলে কি এবারেও বৃষ্টি হবে?

নিশ্চয়ই হবে। দেখছ না, এখানে এরই মধ্যে দু-একদিন বৃষ্টি হয়ে গেল।

তা হোক না। বৃষ্টির মধ্যেও সমুদ্র দেখতে কত ভালো লাগে। ইচ্ছে হলে আমরা পুরীর বদলে কোনারকে গিয়েও থাকতে পারি।

তোমাদের ভালো লাগে তোমরা যাও।

তুমি যাবে না?

 ইমপসিবল! আমি কলকাতা ছেড়ে কিছুতেই যেতে পারব না।

কেন তোর এমনকী কাজকর্ম আছে শুনি!

এই শনিবার দিন পারমিতার জন্মদিনের পার্টি। আমরা অনেক মজা করব, কত দিন আগে থেকে ঠিক করে রেখেছি।

ঠিক আছে, আমরা তা হলে শনিবারের বদলে রোববার যাব।

রোববার থেকে আমাদের নাটকের রিহার্সাল। আমরা মিড সামার নাইটস ড্রিম করছি।

তাহলে আমরা যাব, তুই যাবি না?

তোমরা কি আমায় জিজ্ঞেস করে যাওয়া ঠিক করেছ? আমার সুবিধে-অসুবিধে কিছু আছে কি না, তা একবারও ভেবে দেখবে না?

জ্ঞানব্রত চুপ করে আছেন। মেয়ে বড়ো হয়েছে, তার একটা নিজস্ব মতামত তো থাকবেই। বাবা-মা যখন যেখানে যেতে বলবে তাতে রাজি হবে কেন?

উজ্জয়িনীর ওপর জোর করেও কোনো লাভ নেই। দারুণ জেদি মেয়ে।

মা ও মেয়েতে আরও কিছুক্ষণ উত্তর-প্রত্যুত্তর চলবার পর জ্ঞানব্রত বাধা দিয়ে বললেন, থাক ও যদি যেতে না চায়, ও থাক।

তা বলে বাড়িতে ও একা থাকবে?

 উজ্জয়িনী এবার ফোঁস করে উঠে বললেন, হোয়াই ডু য়ু মিন একা? আমি কি একা থাকলে ভূতের ভয় পাব?

শেষপর্যন্ত ঠিক হল উজ্জয়িনী একাই থাকবে। পুরীতে যাবে শুধু স্বামী-স্ত্রী। জ্ঞানব্রতর ক্ষীণ আসা ছিল, যদি সুজাতা পুরো ব্যাপারটাই ক্যানসেল করে দেয়। কেন না, পুরীতে এখন বেড়াতে যাবার খুব ইচ্ছে তাঁরও নেই। কিন্তু সুজাতা যাবার জন্য বদ্ধপরিকর।

অফিসে গিয়েই হোটেলের বুকিং এবং টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেললেন জ্ঞানব্রত। তারপর কাজে ডুবে গেলেন।

নিজে কিছুদিন তিনি কলকাতার বাইরে ছিলেন, আবার বাইরে যাচ্ছেন, মাঝখানে অনেকগুলো কাজ সেরে রাখতে হবে।

দু-দিন বাদে শেষ বিকেলে একটা টেলিফোন পেলেন জ্ঞানব্রত।

আমি এলা বলছি। নাম শুনে চিনতে পারছেন তো?

হ্যাঁ।

আপনি আজ খুব ব্যস্ত?

হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ব্যস্তই বলা যায়।

তা হলে আমি যাব না? আমার ইচ্ছে ছিল আপনার কাছে গিয়ে নেমন্তন্ন করার। টেলিফোনেই বলব?

মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞানব্রত চিন্তা করলেন, কীসের নেমন্তন্ন? বিয়ের? এরই মধ্যে মেয়েটি বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে! আশ্চর্য!

হ্যাঁ বলুন, মানে, ইয়ে বলো…

 কাল সন্ধেবেলা আপনি ফ্রি আছেন তো? না থাকলেও আপনাকে সময় করতেই হবে।

কী ব্যাপার?

আমার এখানে একটা ছোট্ট ঘরোয়া গান-বাজনার আসর কালকে। আপনার আসা চাই। আমি কিন্তু কোনোরকম আপত্তি শুনব না। আসতে হবেই।

জ্ঞানব্রত একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। ব্যাপারটা তার ভালো লাগছে না। এই মেয়েটি যেন তাকে ক্রমশই জড়িয়ে ফেলতে চাইছে। সামান্য একটা ছোট্ট ঘরে থাকে মেয়েটি, সেখানে গান-বাজনার আসর? এই মেয়েটির সব কিছুই যেন অদ্ভুত।

আপনি কিছু বলছেন না যে, হ্যালো! হ্যালো!

আমার পক্ষে তো কাল যাওয়া সম্ভব নয়। একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

সন্ধ্যেবেলাতেও কাজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট? হি হি হি! কতক্ষণ লাগবে? আপনি একটু দেরি করে আসুন, কোনো অসুবিধাই নেই।

একটু নয়, অনেক দেরি হবে।

 কতক্ষণ, ন-টা দশটা! তার পরেও অন্তত আসুন একটুক্ষণের জন্য!

দশটার পরেও একটি কুমারী মেয়ে তার বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ করছে। জ্ঞানব্রত এসব জীবনে একেবারেই অভ্যস্ত নয়।

তিনি কণ্ঠস্বর গম্ভীর করে বললেন, না, আমার পক্ষে কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। দুঃখিত।

 আর কিছু শোনার আগেই তিনি রিসিভার রেখে দিলেন।

এই মেয়েটিকে আর একটুও প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। একে একেবারে মুছে ফেলতে হবে মন থেকে।

কাজ শেষ করার পর যথারীতি বাড়ি ফিরে তিনি একটু চাঞ্চল্য বোধ করলেন। আবার কি ব্লাড প্রেশার বেড়েছে? তাঁর এক বন্ধু তাঁর চিকিৎসক। তাঁর কাছে একবার যাবেন নাকি?

সারাদিন প্যাঁচপেঁচে গরম গেছে। বাথরুমে ঢুকতে গিয়েও তিনি ঘেমে গেলেন। ইচ্ছে করছে সাঁতার কাটতে। ডাক্তারও বলেছিলেন অবগাহন স্নানে ব্লাড প্রেশারের উপকার হয়।

গাড়ি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়ে চলে এলেন ক্যালকাটা সুইমিং ক্লাবে। একসময় এখানে তিনি নিয়মিতই আসতেন। হার্টের গন্ডগোলটার পর আর আসা হয় না।

আজ ইচ্ছে করছে দু-এক বোতল বিয়ার পান করতে। এই গরমে ভালো লাগবে। কিংবা অনেকখানি বরফ দিয়ে গিমলেট। কিন্তু জ্ঞানব্রত সে ইচ্ছেটা দমন করলেন। তাঁর এক বন্ধু বোম্বাইতে তিন পেগ জিন খেয়ে সাঁতার কাটতে নেমেছিল। সুইমিং পুলের মধ্যেই তার হার্ট অ্যাটাক হয়, চিকিৎসারও সুযোগ পায়নি।

নীল রঙের পরিষ্কার জল। তলার দিকটা বেশ ঠাণ্ডা। অন্য যারা সাঁতার কাটছে তারা প্রায় সবাই সাহেব-মেম। ভারতীয়রা এই ক্লাবের সভ্য হয় বটে। কিন্তু প্রায় কেউ জলে নামে না, জলের ধারে টেবিল নিয়ে বসে মদ খায় আর আড়চোখে অর্ধনগ্ন মেমদের দেখে।

আপন মনে সাঁতার কাটতে কাটতে জ্ঞানব্রতর হঠাৎ ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি সাঁতার শিখেছেন গ্রামের পুকুরে। কুষ্টিয়ার কুমারখালি গ্রামে। মামা বাড়িতে তাঁর সেজোমামা ন-বছরবয়স্ক জ্ঞানব্রতকে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন পুকুরের মধ্যে। আঁকুপাঁকু করতে করতে ডুবে যাবার ঠিক আগে সেজোমামা এসে ধরে ফেলতেন। এইভাবে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে সাঁতার শেখা হয়ে যায়।

এসব মনে পড়েনি তো এতদিন! ক্যালকাটা ক্লাবের সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে এসে এর আগে কোনোদিন তাঁর গ্রামের পুকুরের কথা মনে পড়েনি। শশীকান্তর সঙ্গে দেখা হবার পর থেকেই…। কিন্তু এর মধ্যে একদিনও তো শশীকান্তর সঙ্গে গল্প করা হল না, কিংবা শোনা হল না তার গান।

খানিকক্ষণ সাঁতার কেটে ক্লান্ত হয়ে জ্ঞানব্রত ওপরে উঠে বসলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার নামবেন। জল খুব ভালো লাগছে আজ।

হঠাৎ পুলের ডান পাশের দিকে চোখ চলে গেল তাঁর, একজন নারীর বাহু ধরে এগিয়ে আসছে একজন দীর্ঘ চেহারার পুরুষ। রেডিয়োর সেই পি সি বড়ুয়া আর এলা। ওরা কোনো খালি টেবিল খুঁজছে।

জ্ঞানব্রত চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অন্য দিকে।

সুইমিং পুলের রেলিং ধরে আস্তে আস্তে উঠে এলেন জ্ঞানব্রত। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

এলা কিংবা বড়ুয়া তাকে দেখতে পায়নি। জলের ধারে একটা টেবিলে বসে কী একটা কথায় যেন ওরা দু-জনেই হাসছে।

জ্ঞানব্রত চলে গেলেন পোশাক বদলাবার ঘরে। আগে গা-মাথা মুছলেন ভালো করে। তারপর দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। নিজের মুখটা এত অচেনা লাগছে কেন? কেন তিনি একটু একটু কাঁপছেন? তাঁর ঈর্ষা হয়েছে? এই জিনিসটা তো তাঁর কোনোদিন ছিল না। এলাকে তো তিনি এড়িয়ে যেতেই চেয়েছিলেন।

পোশাক পরে নিয়ে বাইরে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তার এখন চলে যাওয়া উচিত। ওরা গল্প করছে করুক। এর মধ্যে তিনি নানান লোকের কাছে শুনেছেন যে, ওই বড়ুয়ার খুব মেয়ে বাতিক আছে। কোনো সুন্দরী মেয়ে পেলে ছাড়ে না।

তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু একটা প্রবল চুম্বক যেন তাঁকে টানছে পেছন থেকে। খুব ইচ্ছে করছে আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখতে তবু তিনি শক্তভাবে হাঁটতে লাগলেন। তার পিঠে কার ছোঁয়া লাগতেই তিনি চমকে উঠে বললেন, কে?

আপনি আমাদের দেখতে পেয়েও চলে যাচ্ছেন যে?

এলার মুখখানিতে কী চমৎকার সুস্বাস্থ্যের তাজা ভাব। কলঙ্কহীন মসৃণ, নিষ্পাপ মুখ। জ্ঞানব্রত যেন একটি বৃষ্টিভেজা সদ্য ফোটা ফুল দেখছেন। তিনি কোনো কথা বললেন না।

আপনি চলে যাচ্ছেন যে?

জ্ঞানব্রত ভাবলেন, এই মেয়েটি প্রায় তাঁর নিজের মেয়ের বয়সি। কিন্তু উজ্জয়িনীর তুলনায় কত বেশি অভিজ্ঞ। মুখখানা যত নিষ্পাপ দেখায় মোটেই তত নিষ্পাপ নয়। যার-তার সঙ্গে প্রকাশ্য জায়গায় মদ খেতে যায়। গায়িকা হিসেবে নাম কেনার জন্য পি সি বড়ুয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। পুরুষমানুষদের দিকে এমনভাবে তাকায় যাতে সরলতার সঙ্গে মিশে থাকে লাস্য। ক্যালকাটা ক্লাবে প্রথম আলাপের দিন জ্ঞানব্রতর দিকেও এলা এইভাবে তাকিয়েছিল।

অথবা, এসব দোষের নয়। জ্ঞানব্রত পুরোনোপন্থী? ব্যবসার জগতে তিনি এমনভাবে জড়িয়ে আছেন যে, পৃথিবী কতটা বদলে গেছে, তা তিনি জানেন না?

অনেক কিছু বদলালেও ভালোবাসা, লোভ, দুঃখ, ঈর্ষা এসব বদলায় না। জ্ঞানব্রতর বুকের মধ্যে যে একটা জ্বালা জ্বালা ভাব, সেটা ঈর্ষা ছাড়া আর কী।

তিনি ঠাণ্ডাভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর?

এলা বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে একটু বসবেন না?

আমি একটু সাঁতার কাটতে এসেছিলুম।

 একটু বসুন। এক্ষুনি চলে যাবেন!

হ্যাঁ, যেতে হবে।

আপনি আমায় দেখলেই এড়িয়ে যেতে চান কেন বলুন তো?

ইয়ে…তোমার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে যাওয়ার কি কোনো কথা ছিল? সুতরাং এড়িয়ে যাবার প্রশ্ন ওঠে কী করে? চলি।

আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না, এবার বেশ গট গট করে বেরিয়ে গেলেন জ্ঞানব্রত। এলাকে প্রত্যাখ্যান করতে পেরে তিনি বেশ তৃপ্তি পেয়েছেন।

একটু আগে তাঁর মনে হচ্ছিল, এলা মেয়েটি তাকে ঠকিয়েছে। তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ নিয়ে পি সি বড়ুয়ার সঙ্গে ভাব জমিয়েছে, সুইমিং ক্লাবে লাঞ্চ খেতে এসেছে। এবার তিনি বুঝিয়ে দিলেন, এ-রকম কোনো মেয়ের সঙ্গে বাজে খরচ করার মতন সময় তাঁর নেই।

কিন্তু একটু পরেই তাঁর মনের ভাব বদলে গেল আবার।

সুইমিং ক্লাবে প্রথমে বড়ুয়ার সঙ্গে এলাকে দেখে তাঁর ঈর্ষা হয়েছিল, এটা অস্বীকার করতে পারেন না। তারপর এলা তাঁকে ডাকতে এলে তিনি ওদের সঙ্গে বসতে রাজি হননি। এতে তিনি তৃপ্তি পেয়েছিলেন। তা হলে এখন আবার কষ্ট হচ্ছে কেন? অফিসে কোনো কাজে মন বসছে না। একটু আগে একজন সাপ্লায়ার এসে কী বলে গেল তা তিনি ভালো করে শোনেনইনি।

এলাকে তিনি অপমান করেছেন। এ-রকম তো তাঁর স্বভাব নয়। কারুর সঙ্গেই তিনি রূঢ় ব্যবহার করেন না। বিশেষত একটি যুবতী মেয়ের সঙ্গে এ-রকম কেন হল?

সন্ধ্যের পর তার ড্রাইভার ছুটি চাইল। দেশ থেকে তার কোনো আত্মীয় আসবে। তাকে আনতে হাওড়া স্টেশন যেতে হবে। সাহেবকে বাড়ি পৌঁছে দেবার পর বাকি সন্ধ্যেটা ছুটি চায়।

অফিস থেকে ড্রাইভারকে ছেড়ে দিলেন জ্ঞানব্রত। অনেকদিন পর তিনি নিজে আজ গাড়ি চালাবেন। বুকে ব্যথা হবার পর থেকে ডাক্তারের উপদেশে তিনি গাড়ি চালানো বন্ধ করেছিলেন।

এ কী, এ তিনি কোথায় যাচ্ছেন? নিজের ব্যবহারেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন জ্ঞানব্রত। মনের কোন গভীর জায়গায় এইসব ইচ্ছে লুকিয়ে থাকে? এদিকে এলার বাড়ি। এলা একদিন খুব অনুরোধ করছিল তার বাড়িতে কিছুক্ষণ বসবার জন্য।

প্রথম আলাপে এলা বলেছিল, সে ওয়ার্কিং গার্লস হোস্টেলে থাকে। তারপর সে আলাদা ফ্ল্যাটের কথা উল্লেখ করেছিল। এলা তো চাকরি করে না। এসব খরচ সে চালায় কী করে? না, না, মেয়েটিকে কোনোক্রমেই নষ্ট হতে দেওয়া চলে না। তাঁর মেয়ে উজ্জয়িনী যদি একটা সুন্দর সুস্থ জীবন পায় তা হলে এলাই-বা পাবে না কেন?

এলার ঘরে গানের আওয়াজ আসছে। যদি ওখানে বড়ুয়া বসে থাকে? বড়ুয়ার মতলব ভালো না, এলাকে সাবধান করে দিতে হবে। বড়ুয়াকেও বুঝিয়ে দিতে হবে যে, যেকোনো মেয়ের সঙ্গেই সে এরকম ব্যবহার করতে পারবে না।

দরজা খুলে এলা অবাক হয়ে গেল।

না, আর কেউ নেই, এলা একা একাই বসে গানের রেওয়াজ করছিল। এটা এলার দিদির ফ্ল্যাট। দিদি-জামাইবাবু বাইরে গেছেন বলে এলা কেয়ার টেকার।

জ্ঞানব্রত ভেবেছিলেন অনেক কিছু বলবেন এলাকে। তিনি শুধু বললেন, এসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলুম।

মোটেই না, শুধু ভাবছি আমার এত সৌভাগ্যের কারণটা কী?

তুমি গান গাইছিলে, তাই গাও, আমি শুনি।

আপনি একদিন কী একটা ফোক সঙ-এর কথা বলছিলেন আমি কিন্তু ফোক সঙ জানি না।

তুমি যা জানো, তাই গাও।

হারমোনিয়াম নিয়ে এলা নিঃসংকোচে গান ধরল। রবীন্দ্রসংগীত– মধুর তোমার শেষ যে পাই–।

এ গানটা জ্ঞানব্রত অনেকবার শুনেছেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল, রবীন্দ্রসংগীত সব পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু এই গানটা তো আবার নতুন করে ভালো লাগল। এলার গলাটা সেরকম আহামরি কিছু না হলেও সুশ্রাব্য। চর্চা করলে ও একদিন নাম করতে পারবে।

বাঃ, বেশ ভালো হয়েছে।

আমি আপনার প্রশংসায় বিশ্বাস করি না। আপনি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন।

না, না।

আমি ঠিক বুঝেছি। আপনি সেই ফোক সঙটার কথাই ভাবছিলেন নিশ্চয়ই। কী সেই গানটা?

শহরে ষোলো জন বোম্বেটে করিয়ে পাগলপারা…। লালন ফকিরের গান।

এই গানটার বিশেষত্ব কী?

সেরকম কিছুই না। আমি যে গান-বাজনার খুব একটা ভক্ত, তাও না। তবু, রেডিয়োতে একদিন ওই গানটা শুনে আমি যেন কীরকম হয়ে গেলাম। আসলে আমার একটা হারিয়ে যাওয়া বাল্যকাল আছে। কয়েকটা বছরের কথা আমার কিছুই মনে পড়ে না। এই গানটা শুনে একটু একটু মনে পড়ল–কুষ্টিয়ায় থাকবার সময়ে একজন ফকিরের মুখে আমি এই গানটা শুনতাম…আমার দাদামশায়ের কাছে আসতেন সে-ফকির…। মনে হয় যেন একটু একটু করে সব মনে পড়বে এবার…। অবশ্য এত সব মনে পড়া ভালো নয়।

কেন ভালো নয়?

মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ইদানীং, জীবনটা যদি আবার নতুন করে শুরু করা যেত।

এ-রকম চিন্তা আপনার মাথায় কে ঢোকালো? আপনি একজন সাকসেসফুল মানুষ, কোনোদিকেই অভাব নেই।

তবু তো মনে হয়।

আপনার বাড়িতে একজন গায়ককে এনে রেখেছেন, তাই না?

 হ্যাঁ…তুমি কী করে জানলে?

এলা এবার চোখ টিপে দুষ্টু মেয়ের মতন হাসল। তারপর বলল, জানি… খবর রাখতে হয়…আমি আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি।

আমার তো কোনো গোপন কথা নেই।

সেই গায়কের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিন না। আমি তা হলে কয়েকটা ফোক সঙ শিখে নিতে পারি। আপনি যখন ওইসব গান এত ভালোবাসেন।

হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে উঠে জ্ঞানব্রত বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেব। শোনো আমি সে কথাটাই তোমাকে বলতে এসেছি। তুমি আজেবাজে লোকেদের সঙ্গে ঘুরো না। তুমি মন দিয়ে গান শেখো। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। আমি যদি মাসে মাসে তোমাকে ধরো হাজার দেড়েক টাকা দিই, তাতে তোমার খরচ চলে যাবে?

অর্থাৎ আপনি আমাকে রক্ষিতা রাখতে চান?

কথাটা ঠিক একটা বুলেটের মতোই জ্ঞানব্রতর বুকে লাগল। ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাঁর মুখ।

তুমি, তুমি আমাকে এইরকম কথা বললে।

আপনার কথার কি এ-রকম মানে হয় না? আপনি শুধু শুধু আমাকে প্রত্যেক মাসে অত টাকা দেবেন কেন?

মানুষ কি মানুষকে সাহায্য করে না?

এদেশে কি গরিব গায়কের অভাব আছে? আপনি আমায় সাহায্য করতে চাইছেন… আমি একটা মেয়ে বলেই তো? তা ছাড়া বউদি কী ভাববেন?

বউদি?

আপনার স্ত্রী…তিনি যদি জানতে পারেন যে আমার মতন এক মেয়েকে আপনি প্রত্যেক মাসে এতগুলো টাকা দিচ্ছেন, তা হলে তিনি, ওই আমি যা বললুম, ঠিক সেই কথাই ভাববেন।

একটা বিমর্ষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্ঞানব্রত বললেন, আমার ভুল হয়েছে। আমায় ক্ষমা করো।

 তিনি উঠে দাঁড়াতেই এলা তাঁর কাছে এসে বলল, আপনার মুখ দেখলেই বোঝা যায়, আপনি মানুষটা খুবই ভালো। সত্যিকারের ভালো।

আমি তোমায় অপমান করতে চাইনি।

যেন জ্ঞানব্রতই বয়সে অনেক ছোটো এইভাবে এলা গায়ে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বলল, তা আমি ঠিকই বুঝেছি! আপনি মনে দুঃখ পেলেন নাকি?

জ্ঞানব্রত আর কিছু না বলে এলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আপনি যা ভাবছেন, আমার অবস্থা ততটা খারাপ নয়। আমার টাকাপয়সার কিছু ব্যবস্থা আছে। আমার বাবা রেখে গেছেন! তবে যে যেমন মনে করে, মেয়েদের একটা বয়স হলেই বিয়ে করে সংসার করা উচিত, সেইটাই সুখী জীবন, আমি কিন্তু তা মনে করি না। আমি গান-বাজনা নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। যার সঙ্গে ইচ্ছে হবে মিলব, ইচ্ছে না হলে মিলব না।

আমি যাই?

কেন? হঠাৎ উঠে পড়লেন যে।

জ্ঞানব্রতর একটা হাত নিয়ে এলা নিজের গালে ছুঁইয়ে বলল, বুঝেছি আমার ও কথাটার জন্য আপনি আঘাত পেয়েছেন। আমি কিন্তু মজা করে বলেছি।

মজা? কোনো মেয়ে নিজের সম্পর্কে এ-রকম একটা শব্দ প্রয়োগ করে মজা করতে পারে? জ্ঞানব্রতর সব কিছুই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।

এরপর তিনি যা করলেন, সেরকম কিছু করবার কথা একটু আগেও তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

এলা এত কাছে, তার শরীরের উষ্ণতা, তার সান্নিধ্যের ঘ্রাণ যেন জ্ঞানব্রতকে অন্য সব কিছু ভুলিয়ে দিল। তিনি দু-হাতে জড়িয়ে ধরলেন এলাকে।

এলা একটুও আপত্তি করল না। পাখি যেমন তার বাসায় গিয়ে বসে সেইরকমভাবে এলা জ্ঞানব্রতর বুকে আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত রইল।

জ্ঞানব্রত যেন অন্য মানুষ। তিনি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, তোমায় একটু আদর করি?

এলা উঁচু করল তার মুখটা। জ্ঞানব্রত তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই এলা বার করল তার জিভ। অর্থাৎ চুম্বনটা যেন দায়সারা কিংবা সংক্ষিপ্ত না হয়।

সেই সময়টাতেও জ্ঞানব্ৰত ওকথা চিন্তা না করে পারলেন না যে তাঁর মেয়ে উজ্জয়িনীকেও এ-রকম একজন বয়স্ক লোক জড়িয়ে ধরে চুম খেতে পারে। উজ্জয়িনীও কি এলার মতন এত সব জানে! পি সি বড়ুয়াকে তিনি মনে মনে নিন্দে করেছিলেন, বড়ুয়া সুযোগসন্ধানী। কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলেই…। তিনিও কি নিরালায় সুযোগ নিয়ে এলাকে…

তক্ষুনি জ্ঞানব্রত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। তাঁর মুখ লাল হয়ে গেছে।

এরপর দু-দিন মন থেকে সমস্ত অন্যরকম চিন্তা বাদ দিয়ে জ্ঞানব্রত শুধু কোম্পানির কাজে মেতে রইলেন। যেন তিনি নিজেকে শাস্তি দিতে চান।

কিন্তু তাঁর পুরী যাওয়া হল না।

তাঁর কারখানায় দুটি ইউনিয়ন। এর মধ্যে যে ইউনিয়নটি বেশি শক্তিশালী, তারা হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন ধর্মঘটের নোটিশ দিল। এ-সময় জ্ঞানব্রতর বাইরে যাওয়া চলে না। অবস্থা এখনও হাতের বাইরে চলে যায়নি। আপোশ-আলোচনায় মিটিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

সুজাতা তৈরি হয়েই আছে। তাকে নিরাশ করা যায় না। জ্ঞানব্রত নিজেই প্রস্তাব দিলেন, সুজাতা একাই চলে যাক। হোটেল তো বুক করাই আছে, কোনো অসুবিধে হবে না। যদি কয়েকদিনের মধ্যে মিটে যায়, তাহলে জ্ঞানব্রত চলে যাবেন।

সুজাতা বলল, তাই যাই। দীপ্তি ফোন করেছিল, ওরাও ওই শনিবারে পুরী যাচ্ছে। ওই একই হোটেলে উঠবে।

দীপ্তির স্বামী মনীশ তালুকদার সুজাতাকে ছেলেবেলা থেকে চেনে। জ্ঞানব্রত পরে জানতে পেরেছিলেন যে বিলেতে ওই মনীশ ছিল সুজাতার এক নম্বর প্রেমিক! অবশ্য তখন মনীশ ছিল মৌমাছি স্বভাবের, বিয়ের দিকে মন ছিল না। এই নিয়ে জ্ঞানব্রত কতবার মৃদু ঠাট্টা করেছেন সুজাতাকে।

বেশ তো, ভালোই হবে তা হলে। ওদের সঙ্গে তুমি বেড়াতে-টেড়াতে পারবে।

সুজাতা চলে যাবার দু-দিন বাদে এলা টেলিফোন করে জানাল, আপনি তো আলাপ করিয়ে দিলেন না। আমি কিন্তু নিজেই আলাপ করে নিয়েছি শশীকান্ত দাসের সঙ্গে।

জ্ঞানব্রত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় আলাপ হল?

রেডিয়ো স্টেশনে। চমৎকার মানুষ। এত সরল আর অনেক গানের স্টক।

হুঁ।

উনি কলকাতা শহরের কিছুই চেনেন না। কাল আমি ওকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরটা দেখিয়ে আনলুম।

ও!

আমি কিন্তু ওই শহরে ষোলো জন বোম্বেটে গানটার প্রথম কয়েক লাইন এর মধ্যে তুলে নিয়েছি।

আচ্ছা!

জ্ঞানব্রত ভেবেছিলেন এলার সঙ্গে তিনি কোনোদিন দেখা করবেন না। কিন্তু টেলিফোনটা ছাড়বার পরই তাঁর মনে হল, কই এলা তো একবারও বলল না, আবার কবে দেখা হবে, কিংবা আমাদের বাড়িতে আসবেন!

একই সঙ্গে কাজের ব্যস্ততা আর অন্যমনস্কতা। কাজ তো করতেই হবে, অথচ প্রত্যেক দিন জ্ঞানব্রতর মনে পড়েছে এলার কথা। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে এলার বাড়িতে। মেয়েটা কি তাঁকে জাদু করেছে? এতগুলো বছরে জ্ঞানব্রতর কখনো পদস্খলন হয়নি, আর এখন ওই একটি মেয়ের জন্য! সুজাতার কাছে কি তিনি অপরাধ করেছেন!

পুরীতে দীপ্তির চোখে ধুলো দিয়ে মনীশ কি সুজাতার সঙ্গে গোপনে ঘনিষ্ঠতা করত চাইবে না? এ সুযোগ কি মনীশ ছাড়বে? দীপ্তির চেহারাটা হঠাৎ বুড়িয়ে গেছে, সেই তুলনায় সুজাতার শরীরের বাঁধুনি এখনও কত সুন্দর।

সুজাতা কি আগেই জানত যে মনীশরা এই সময় পুরীতে যাবে! সেইজন্যই ওর পুরীতে যাওয়ার এত উৎসাহ?

শশীকান্তর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন দেখা হয়নি জ্ঞানব্রতর। একই বাড়িতে থাকলেও সুযোগ হয় না। দেখা হল রাস্তায়।

জ্ঞানব্রত কারখানায় যাচ্ছিলেন। পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল একটা ট্যাক্সি। সেই ট্যাক্সিতে এলা আর শশীকান্ত। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, শশীকান্তের চুল পরিপাটি ভাবে আঁচড়ানো, এলার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। সেই হাসি আর চোখের দৃষ্টি অন্যরকম। জ্ঞানব্রত পরিষ্কার দেখতে পেলেন শশীকান্তের চোখে-মুখে এলার জাদু।

তাঁর বুকের মধ্যে ধুক ধুক শব্দ হতে লাগল। কঠিন হল চোয়াল। শশীকান্ত তাঁর আশ্রিত, সামান্য একটা গ্রাম্য লোক, তার এতটা বাড়াবাড়ি! কোথায় যাচ্ছে এখন? এই দিকেই এলার বাড়ি। শশীকান্তের উচিত ছিল না একবার জ্ঞানব্রতর কাছ থেকে অনুমতি নেবার?

ট্যাক্সিটা এখনও চোখের আড়ালে যায়নি, জ্ঞানব্রত তাঁর ড্রাইভারকে বললেন, সোজা চলো।

যেমন ভাবেই হোক এলাকে রক্ষা করতে হবে। যার-তার সঙ্গে এমন ভাবে এলার মেলামেশা কোনোক্রমেই চলতে পারে না। এলার ফাঁকা ফ্ল্যাটে এইসময় শশীকান্তকে নিয়ে যাচ্ছে কেন? গান শেখার জন্য–এই দুপুর বেলা? শশীকান্ত গ্রামের লোক। এলার মতন মেয়েদের সঙ্গে ওর মেলামেশার অভ্যেস নেই, মাথা ঠিক রাখতে পারবে না।

একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, এবার কোন দিকে?

একমুহূর্তের জন্য যেন জ্ঞানব্রতর রক্ত চলাচল থেমে গেল। কোন দিকে কথাটা যেন একেবারে নাড়িয়ে দিল তাঁর চৈতন্য। এ তিনি কী করছেন? এলাকে শাসন করতে গেলে যদি আবার সে একটা মর্মভেদী কথা ছুঁড়ে দেয়? সেদিন এলা বলেছিল, সে স্বাধীন থাকতে চায়। যার সঙ্গে খুশি তার সঙ্গে মিশবে…। এলা তো তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি নয়। কারখানায় ইউনিয়নের সঙ্গে তাঁর একটা গুরুতর বৈঠকে বসবার কথা এখন, আর তিনি ছুটছেন একটা মেয়ের পেছনে।

পুরীতে মনীশ যদি সুজাতাকে…। মনীশ ঠিক নিভৃত সুযোগ নেবে, ও এখনও রীতিমতন প্লেবয় ধরনের। বিভিন্ন পার্টিতে তিনি দেখেছেন মনীশ পরস্ত্রীদের পিঠে হাত রাখে। কিন্তু সুজাতা কি রাজি হবে? তিনি যদি গোপনে এলার বাড়িতে গিয়ে তাকে চুমু খেতে পারেন তাহলে সুজাতাই বা কেন…উজ্জয়িনী কাল রাত এগারোটার সময় বাড়ি ফিরেছে। এত রাত পর্যন্ত ও কোথায় থাকে, কার সঙ্গে মেশে। জ্ঞানব্রতরই মতন অন্য কোনো লোক যদি উজ্জয়িনীর মতন একটা অল্প বয়সি মেয়ের মন জয় করতে চায়?

জ্ঞানব্রত একবার ভাবলেন। সবকিছু ছেড়েছুড়ে এলাকে নিয়ে নতুনভাবে আবার জীবন শুরু করলে হয় না?

তারপরেই ভাবলেন, না, না। ওই ষোলো জন বোম্বেটেকে সবকিছু লুটেপুটে নিতে দেওয়া হবে না। আটকাতে হবে। মাথা ঠিক রাখতে হবে।

তিনি কড়া গলায় ড্রাইভারকে বললেন, কোন দিকে আবার? রোজ যেদিকে যাই সেদিকে যাব!

জীবনের পঞ্চাশটা বছর পেরিয়ে এসেছেন জ্ঞানব্রত। তাঁর সব রাস্তা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর অন্য কোনো দিকে ফেরা যাবে না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়