অমরনাথের মৃত্যুর আশঙ্কায় এবং মৃত্যুর ঠিক পরে অঞ্জলি যেরকম আচরণ করছিল তা কাজ মিটে যাওয়ার পর পাল্টে গেল। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্ৰচণ্ড অসহায়তাবোধ থেকে সে যেন কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিল। আর এর পুরো ঝাঁঝাঁটা গিয়ে পড়েছিল দীপার ওপরে। মায়ের এমন আচরণে প্রভাবিত হয়েছিল ছেলেরা। অবশ্য তারা আর মুখের ওপর কিছু বলছিল না। কিন্তু অবহেলা করতে তাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধে হচ্ছিল না।

অমরনাথের কাজ মিটে যাওয়ার পর দেখা গেল অঞ্জলি নিজেকে দারুণভাবে গুটিয়ে নিয়েছে। বেশী কথা বলার বদলে অদ্ভুত এক গভীর্যে নিজেকে আড়াল করে ফেলল সে। বুধুয়া, অমরনাথের মৃত্যুর খবর পেয়ে আবার এ বাড়িতে চলে এসেছিল, তাকে ডেকে বলে দিল, আমার এমন পয়সা নেই যে তোর মাইনে দেব। তুই এখানে সময় নষ্ট করিস না।

অতএর বুধুয়া আবার ফিরে গেল লাইনে।

তিরিশ বছর আগে চা-বাগান আর তার লাগোয়া বাজার, কাঠের মিল নিয়েই ছিল জনবসতি। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই সেটা বেড়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে বাজারের এলাকাটা। আঙরাভাসা নদীর ধার দিয়ে কলোনি তৈরী হচ্ছিল। এক সকালে দুই ছেলেকে নিয়ে অঞ্জলি বীরপাড়ার রাস্তায় সে-রকম একটা জমি দেখে এল। হাজার চাবেকের মধ্যে সাত কাঠা জমি পাওয়া যাচ্ছে আসাম রোড থেকে এক মিনিটেব দূরত্বে। এখনও কাঠ শাস্তা এখানে। জমি কিনে দু-তিন ঘরের বাড়ি তৈরী করে নিলে আর রাস্তায্য গিয়ে দাঁডাতে হবে না। মাথার ওপরে একটা ছাদ থাকলে কে কি খাচ্ছে তা নিয়ে লোকে মাথা ঘামাৰ্ণে না; কথাটা শুনে মনোরমা অবাক হলেন, সেকি। ওদিকে তো শ্মশান।

এখন তো শ্মশানেই বাস কাবাব সময় এসেছে আমাদেব।

মনোরমা অঞ্জলির দিকে অবাক হয়ে তাকালেন, সাহেব তো এ বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেনি!

আজ বলছে না! আগামীকাল যে বলবে না। এমন তো কথা নেই। আর মানুষের কথায় আমি বিশ্বাস ক্রি না। দু বছর ধরে অপেক্ষ, করার মত বোকামি আমি করার না।

ওখানে ফাঁকা মাঠ, মানুষজন নেই—

এখন নেই, হতে কতক্ষণ। যেমন অবস্থা তেমন ভাবেই থাকতে হবে।

বড়মা।

বলুন।

তুমি আমার কথা কিছু ভেবেছ?

আপনার কথা? মানে বুঝলাম না।

আমি বুঝতে পারছি না। আমার কি করা উচিত?

আপনি এ কথা আপনার ছেলে থাকলে বলতে পারতেন। আমার যা অবস্থা হবে আপনারও তা না হবার কোণ কারণ নেই।

মনোরম আর কথা বাড়াননি। অমরনাথ চলে যাওয়ার পরে আঞ্জলি সম্পর্কে তার ব্যবহারেও পরিবর্তন এসেছে। এখন তিনি ওকে অত্যন্ত সমীহ করে কথা বলেন। একদিন যে অল্পবয়সী মেয়েকে বাড়ির বউ করে এনেছিলেন সে-ই এখন এখন কর্ত্রী হয়ে গিয়েছে। বৈধব্যের পরে যে কাঠিন্য অঞ্জলি অর্জন করেছে নিজের জীবনে তার সঙ্গে কোন পবিচয়। তাঁর কখনও ঘটেনি। দীপারও মনে হয় মনোরমা পাল্টে গিয়েছেন। অধিকারণবোধ থেকে যে আচরণে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন তা রাতারাতি উধাও।

অঞ্জলির এই ব্যবহার দীপাকে মন স্থির করতে সাহায্য করলে। প্ৰতি মুহুর্তে এ ব্যাডিতে নিজেকে অবাঞ্ছিত লাগছে। অঞ্জলি তার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছে না। অন্যান্য কোয়ার্টার্স থেকে মহিলারা এসে দীপার চাকরির কথা তুললে প্রকাশ্যে বলতে পারছে, বিধবা মেয়ের উপার্জনে জীবন যাপন করার কোন বাসনা তার নেই। অঞ্জলির স্বভাব থেকে সবরকম নরম বোধই যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। কলেজ খুললে দীপা কলকাতায় চলে গেলে যেন স্বস্তির আরহাওয়া ফিরে আসলে এমন মনে হচ্ছিল ক্রমশ।

অতএব, এ-জন্মের মত এ-বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হতে চলেছে আগামীকাল। সকালবেলায় সে রওনা হবে জলপাইগুড়ি শহাব থেকে ট্রেন ধরতে। এই ভাল হল। এখন একমাত্ৰ মনোরমা ছাড এ-ব্যাডির কোন মানুষ তাকে আর টানছে না। কিন্তু প্ৰকৃতি তাকে টানছে। এই চা-বাগান, দেবদারু গাছ, চাঁপা ফুলের মাঠ, আসাম রোড—আর কোনদিন হয়তো সে এদের কাছে ফিরে আসবে না। হঠাৎ দীপার মনে হল এখনও তার মনে এদের সম্পর্কে স্মৃতি বেঁচে আছে বলেই এরা তাকে টানছে। কিন্তু এই টান তেমন সক্রিয় নয় যেমনটা ছিল সে যখন এখানেই দিনব্যাত কাটাতো। হয়তো বছর গেলে, স্মৃতিব ওপর অন্য স্মৃতি জমা তুলে একদিন আসবে যখন কোন টানই সে বোধ কবরে না। সবরকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই কথাটা প্ৰযোজ্য। এবার প্ৰথম দিন এসে আমরিনাথের পাশে বসে থেকে যে অনুভূতি হয়েছিল। আজ ত এর মধ্যে কিছুটা ফিকে হয়ে কি যায়নি V এমন জীবনের গল্প সে অনেক পড়েছে, যেখানে মানুষ সম্পূর্ণ একা হয়ে পৃথিবীর সমস্ত বাধাব সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। তাহলে সে পারবে না কেন?

রাত্রে মনোরমার পাশে শুয়ে কিন্তু তার মন কেমন করতে লাগল। মনোরমার চোখেও আজ ঘুম নেই। কেবলই উসখুশ করছেন। হঠাৎ দীপা চাপা স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ঠাকুমা, আমি চিঠি লিখলে তুমি জবাব দেবে তো?

মনোরমা নিশ্বাস ফেললেন, যদ্দিন খাম পোস্টকার্ড কেনার সামর্থ থাকবে তদ্দিন দেব।

দীপা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আমি চাকরি করলে তোমাকে যদি নিয়ে যেতে চাই তুমি আমার কাছে গিয়ে থাকবে তো?

আচমকা মনোরমা ডুকরে উঠলেন, তুই আমাকে নিয়ে যাস, যত তাড়াতাড়ি পারিস নিয়ে যাস। আমার আর এখানে থাকতে একদম ইচ্ছে করছে না। দীপা পাশ ফিরে মনোরমাকে জড়িয়ে ধরল দুহাতে। তার হাতের বাঁধনে মনোরমা থরথর করে কাঁপছিলেন।

অনেক অনেক সময় চলে গেলে একমাত্র কুলি লাইনের মাদলের আওয়াজ ছাড়া পৃথিবী যখন নিস্তব্ধ তখন মনোরমা উঠলেন। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোকটাকে বাড়িয়ে মিটসেফের মত আলমাতিটাকে খুললেন। দীপা উঠে বসেছিল। সামান্য খোঁজাখুঁজি করে মনোরমা একটা খাতা বের করলেন, এইটা তোর বাবার। কলকাতার হাসপাতালে শেষদিকে যখন ভাল হয়ে উঠেছিল তখন লিখিত। এখানে এসে একদিন আমাকে বলল, তোমার কাছে রেখে দাও। কেন বলেছিল তখন বুঝতে পারিনি। তুই রাখ, তোর কাছে রেখে দে।

দীপা হাত বাড়িয়ে বাঁধানো ছোট খাতাটা নিল। মনোরমা ফিরে এলেন বিছানায়, এককালে তোর বাবা খুব পড়তে ভাল বাসতো। অনেক পত্রিকা কিনত। আনন্দবাজার, দীপালী, সচিত্র ভারত। বিয়ের আগে গল্প লেখার চেষ্টা করত। মনোরমা নিঃশ্বাস ফেললেন।

দীপা জিজ্ঞাসা করল, কি লেখা আছে এতে?

পড়ে দেখিস। মনোরমা পাশ ফিরে শুনেল।

মা জানেন খাতার কথা?

মনোরমা জবাব দিল না। হ্যারিকেনটাকে মাথার পাশে একটা টুলের ওপর তুলে দীপা খাতার পাতা ওল্টালো। অমরনাথের হাতের লেখা প্রায় ছাপার মত। কিন্তু এখানে যেন সামান্য কাঁপুনি এসেছে অক্ষরগুলোয়। প্রথম পাতায় লেখা, করুণাধারা কোথায়? কবির কাছে যা সহজে আসে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে? কেন? বাকি পাতাটা একদম সাদা। দ্বিতীয় পাতায় লেখা, মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এলাম। কিন্তু মনে এবং শরীরে মরণের গন্ধ লেগে গেছে। হাজার ওষুধেও সেই গন্ধ মুছবে বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে তাই নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, আমি কেন বেঁচে আছি? উত্তর পাই না। বেঁচে থাকার জন্যেই বেঁচে থাকা-এ আর এখন ভাল লাগে না।

তৃতীয় পাতায় নজর দিল দীপা, অকালে বিয়ে দিয়ে মেয়েটার যতটা সর্বনাশ করেছিলাম, ওর জন্যে টাকা নিয়ে নিজের সর্বনাশ ততটাই করলাম বলে একসময় মনে হয়েছিল। স্নেহের মানুষের কাছে অশ্রদ্ধা পাওয়া তো চরম সর্বনাশ। এই হয়, মানুষ করতে যায় এক ভেবে, হয়ে যায় উল্টো। কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে মেয়ে নিজের জীবনকে গড়ে নিতে পারবে। ওর মধ্যে একটা তেজ আছে যা আমার ছিল না। অঞ্জলির সঙ্গেও ওর কোন মিল নেই। অঞ্জলি সংসার ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। বরং মাঝে মাঝে মনে হয় মায়ের সঙ্গে ওর কিছু মিল আছে। বুকে দুঃখের আগুন যাদের নিরস্তর তাদের তো মিল থাকাই স্বাভাবিক।

সকালে বেরুবার, আগে মনোরমাই জোর করে খাওয়ালেন দীপাকে। অঞ্জলি বসেছিল বাইরের ঘরে। তাকে প্ৰণাম করল দীপা, বলল, আসছি।

অঞ্জলি কথা না বলে ঘাড় নাড়ল। এক পলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে বেরিসে এল দীপা। বন্ড ভাই বারান্দায় ছিল, দিদিকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল মনোরমা তাকে জিনিসগুলো রাস্তায় বয়ে নিয়ে যেতে বললে দীপা বাধা দিল, আমি একাই পারব। সারাটা পথ তো আমাকেই বইতে হবে ঠাকুমা।

আসাম রোড পর্যন্ত মনোরমা সঙ্গে এলেন। দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে জায়গাটাকে শেষবাব দেখে নিল। মনোরমা বললেন সাবধানে থাকিস। শবাঁ বের প্ৰতি যত্ন নিস।

হ্যাঁ।

তোকে খুব বড় হতে হবে। মনোরমার গলায় যেন অমরনাথের আকৃতি।

হুঁ।

কখনও কোন প্রলোভনে ভুলিস না। তোর বন্যাস কম। যাচাই না করে কোন পথে পা বাড়াস না। বাবার কথা সবসময় মনে বাখবি।

তোমার কথা? দীপা মুখ ফেরাল।

থতমত হয়ে গেলেন মনোরমা, আমার কি আছে বলে। সাবাজীবন ধরে পারেল দি যাম; বেঁচে আছি। মনে কোন সাধ এলেও মুখ ফুটে চাইতে পাবিনি। আমি তো তেfব জলো ও কিছুই করতে পারিনি। বরং এক সময় খুব কষ্ট দিয়েছি। মনোরমা এই সব কথা বলছিলেন অদ্ভুত একটা সুরে। তাতে কান্না ছিল এবং দীপার মন খুব খারাপ কলে দিল। এই সময় জলপাইগুড়ির বাস এল। নির্জন রাস্তায্য হাত দেখালেই এই কািটব বাস দাঁড়িয়ে যায়। বাসটাকে হাত দেখাতে হল না। আজ। মালপত্র কণ্ডাক্টর তুলে নিল। সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেতরে উঠতে না উঠতেই বাস গডাতে আরম্ভ করল। বসার জন্যে সিটি খুঁজে নেওয়াব আগে দীপা নিচু হয়ে মনোরমাকে দেখতে চাইল। এক ঝলক, জানলার একটা ফ্রেমের মধ্যে মনোরমার মুখ। ডান হাতে আঁচল তুলে দাঁতে চেপে ধরেছেন। সেই মুখ মিলিয়ে গিয়ে দেবদারু আর পাইনের গাছগুলো ছুটে আসতে লাগল জানলায়। দীপার চোখ ঝাপসা। আর সেই রূপসা চোখের ভেতর মনোরমার ওই ভঙ্গীটি চিরকালের জন্যে গাঁথা হয়ে গেল।

কণ্ডাক্টার তাকে সিট দেখিয়ে দেওয়ার পর নিজেকে সেখানে ছেড়ে দিল দীপা। এখন বাসের সমস্ত মানুষ তাকে লক্ষ্য করছে কিন্তু সে ভ্রূক্ষেপ করল না। সিটে বসে নিজের মুখ দুহাতে ঢেকে শক্তি খুঁজতে চাইল প্ৰাণপণে। সে জানে বাস তার চেনা চৌহদী ছাড়িয়ে চলেছে। চোখ থেকে হাত সরালেই সেটা দেখতে হবে। কিন্তু আজ একদম দেখতে ইচ্ছে করছিল না। তার মন জুড়ে এখন মনোরমা, এক নিঃসঙ্গিনী বুদ্ধার মুখ।

কিছুদিন আগেও বুক কেঁপে উঠত, পাঁজরে ব্যথা হত। এত বড় পৃথিবীতে সে একদম একা। অসুস্থ হলেও কেউ এসে পাশে দাঁড়াবে না। বস্তুত, কলকাতা শহরে অসুস্থ না হলে তেমন করে একাকিত্ব বোঝা যায় না। আত্মীয় স্বজনহীন তার মত মেয়ে নিশ্চয়ই একা পৃথিবীতে বেঁচে আছে। রোজ খবরের কাগজ খুললেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের গল্প পড়তে হয়। সেই গল্পে অল্পবয়সী মেয়ে আছে যারা জীবনের কাছে ধর্ষিতা। পালিয়ে আসার পথে মা বাবা ভাই বোন জমি এবং সতীত্বকে হারিযে এসেছে। আসতে বাধ্য হয়েছে। এসে এখানকার শরণার্থী ক্যাম্পে আরও অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে। এদের কথা ভাবলেই মনে সাহস আসে। নিজেকে অনেক স্বাধীন মনে হয়। কিন্তু একটা শব্দেব অর্থ তার মাথায় কিছুতেই পরিষ্কার হয় না। মায়া এবং মায়ার মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছে। তাঁদের ধারণা অনেকটা একরকমও। আবার গ্লোরিয়া সম্পূর্ণ উল্টো ধারণা পোষণ করে। শব্দটা হল সতীত্ব। সতী মানে সাধবী, পতিব্ৰতা, সচরিত্রা। আর সতীত্ব হল পতিব্ৰতা, সতী স্ত্রীর ধর্ম। যে মেয়ে সৎ চবিত্রেব তাকে যদি কোন লোভাব দল গায়ের জোরে ধর্ষণ করে তাহলে সে অসহায় অবস্থায় আত্মসমপণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু ওই কাজের জানো তার সতীত্ব চলে যাবে কেন? সে নিজে তো অসৎ নয়। দ্বিতীয়ত, পতিব্ৰতা নারী অথবা স্বামীব প্রতি আনুগত্য যদি সতীত্বে ব্যাখ্যা হয় তাহলে বলতে হবে বস্তুটি হল এক ধরনের প্রশ্নহীন আত্মনিবেদন। পতিদেবতার কাছে আত্মসমপণ। সেটা করতে আপত্তি নেই যদি পতিদেবতাও একই রকম ভূমিকা গ্ৰহণ করেন। কিন্তু যদি শব্দটাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, দুই নারী পুরুষ পরস্পবের প্রতি ভালবাসায় নিবিজ্ঞ হয়ে থাকে মন এবং শরীর নিয়ে—, দীপা মাথা নাড়ে, না, এটাও ঠিক হল না। এই শরীর এবং মন তার—যাকে আমার এক জন্মের ভালবাসা দিয়েছি। এটাই বোধ হয় সতীত্বের ব্যাখ্যা হওয়া উচিত। অসীম এসব শুনে দীপার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এসব নিয়ে এত ভাবো কেন?

দীপা বলল, বাঃ, কিছু কিছু শব্দ বা ভাবনা আদিকাল থেকে চলে এসেছে যা মেয়েদের আচরণকে বেডি পরিয়ে রেখেছে। পুরুষদের স্বার্থে তা যে কি ফালতু সেটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার।

সতীত্ব শব্দটি তাহলে ফালতু?

নিশ্চয়ই যদি সেটা পুরুষদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার না কিবা হয়! দশজন মহিলার ওপর বলাৎকার করলে কি কেউ বলে ওই পুরুষটাব সতীত্ব চলে গেছে?

তা বলে না। কিন্তু লম্পট বলতে দ্বিধা করে না।

সেরকম শব্দ তে মেয়েদের সম্পর্কে বলা হয়। দুশ্চবিত্ৰা। কিন্তু মেয়েদের সম্পর্কে সতীত্ব ব্যবহার করা হয় খুব নিচু ভাবনা নিয়ে। সেক্স জড়িযে থাকে তাতে।

একটি মেয়ে দশটি ছেলেকে নাচাচ্ছে, ঘুরছে, ঘর ভাঙছে, কিন্তু কাউকে শরীর পর্যন্ত পৌঁছাতে দিচ্ছে না। সেই মেয়ের যখন বিয়ে হল তখন স্বামীই একমাত্র পুরুষ যাব সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক হল। এই মেয়েটিকে কি সতী বলবো?

অসীম স্বীকার করল, সমাজ তাই বলবে।

দীপা শব্দ করে হাসছিল। শ্যামবাজার থেকে সাকুলার রোড ধরে ওরা হেঁটে আসছিল। তখন বিকেল শেষ হয়েছে। খান্না সিনেমার সামনে টিকিট প্রার্থীদের ভিড়। অনেকে মাথা ঘুরিয়ে সেই হাসির শব্দে তাকাল। দীপা সেটা উপেক্ষা করল। কিন্তু অসীমকে একটু আডষ্ট দেখাল। গ্রে স্ট্রিটের মোড় ছাডাতে বা দিকের ফুটপাথে বেশ কিছু স্বৈরিণীকে দেখা গেল যে যার মত সেজে খদের ধরার জন্যে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছে। অসীম মনে মনে প্রার্থনা করছিল দীপার দৃষ্টি যেন ওদিকে না পড়ে। জায়গাটা পেরিয়ে এসে যেই সে স্বস্তিব নিঃশ্বাস ফেলতে, যাচ্ছে তখনই দীপা বলল, আচ্ছা, ধর, ওই যে মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের একজন প্ৰথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত একই ভঙ্গীতে দাঁড়ায়, কেউ চাইলে তাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায়, গল্প করে, গান শোনায়, খায়দায় কিন্তু তার বেশী এগোতে দেয় না। শাবীবের ব্যাপারে সে অত্যন্ত সচেতন। কোন পুরুষ আজ পর্যন্ত তাকে ব্যবহার করতে পারেনি। তুমি কি এই মেয়েটিকে সতী বলবে? তার তথাকথিত সতীত্ব কিন্তু সম্পূৰ্ণ অক্ষুন্ন বয়েছে।

অসীম মাথা নাড়ল, না। তা বলা যাবে না।

বেশ। যদি উল্টো হয়। একটি মেয়ে তার প্রিয়জনের জন্যে জীবন দিতে দ্বিধা করে না, সমস্তরকম ঝড় থেকে প্ৰিয় মানুষকে আগলে রাখে। কিন্তু শরীর সম্পর্কে সে বড়ই উদাসীন এবং সেটাকে ধর্তব্যেব মধ্যে ভাবে না। তাহলে তাকে কি সতী বলবো?

অসীম হেসে ফেলল, বলা যাবে কি?

দীপার খুব রাগ হয়ে গেল। হোস্টেল পর্যন্ত এল চুপচাপ। ওর কথা বলতেই ইচ্ছে করছিল না। মুখ দেখে অসীমও সেটা বুঝতে পেরেছিল। গেট থেকে ফেরার আগে জিজ্ঞাসা করল, কাল তাহলে যাচ্ছ?

কোথায়?

বাঃ, আমাদের বাড়িতে। ভুলে গেলে?

সে কি? মা তোমায় দেখতে চেয়েছেন।

কিন্তু তার আগে তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

আচ্ছা, সতীত্ব অসতীত্ব নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোবা কি দরকার?

কাল কলেজের পর কথা বলব। দীপা দাঁড়াল না। এবং অনেক পরে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল তার। ওভাবে রেগে যাওয়ার কোন মানে হয়? কিন্তু অসীম যদি প্ৰতিবাদ করত, যদি তর্ক চালাতো তাহলে তার ভাল লাগত। যুক্তিহীন অস্বীকার থেকেই তার মেজাজ গরম হয়েছিল। তাহলেও তার নিজেকে সংযত রাখা উচিত ছিল। অসীম ভাল ছেলে। এখন আর ব্যাপারটা চাপা নেই। কলেজের অনেক ছেলেমেয়ে এই নিয়ে কানাকানি করেছে। একসঙ্গে, রাস্তায় হাঁটা কখনও কফি হাউসে গিয়ে বসা আর অনর্গল কথা বলে যাওয়া–এসবে মানুষের চোখ এখনও তেমন অভ্যস্ত নয়। গল্প তো হবেই। জলপাইগুড়ি শহর হলে হয়তো কলেজ থেকেই চাপ আসতো, পোস্টার পড়ত দেওয়ালে। কিন্তু কলকাতার বাগবাজারে বৃষ্টি হলে শ্যামবাজারে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু অসীম এখন তার বড় কাছের মানুষ। এই পৃথিবীতে সে একা এমন বোধ আর তীব্র হয়ে বুকের হাড়ে কাঁপুনি ধরায় না।

মাঝরাত্রে হোস্টেলের গেটে খুব গোলমাল হল। চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল দীপার। ঘরে সে একাই ছিল। গ্লোরিয়া সাত সকালে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়েছে। জানলায় গিয়ে দাঁড়াতে দারোয়ানের গলা পেল। যে গেট খুলতে বলছে তাকে দাবোয়ান ধমকাচ্ছে। এত রাত্রে গেট খোলা সম্ভব নয়। শেষপর্যন্ত সুপার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে! দারোয়ান তার কাছে নালিশ করল। বহিরাগতের সঙ্গে কথা বলে সৃপাব দারোয়ানকে গেট খুলতে আদেশ দিলেন। সাদা পোশাকের একজন পুলিশ অফিসার ভেতরে ঢুকে নিজের পরিচয় দিলেন। সুপারকে জিজ্ঞাসা করলেন,  গ্লোরিয়া নামে একটি আফ্রিকান নিগ্রো মেয়ে এখানে কি থাকত?

হ্যাঁ। কেন বলুন তো?

আপনি সুপারিনটেনডেন্ট?

হ্যাঁ।

তাহলে আপনাকে একবার আসতে হবে। ওকে খুন করা হয়েছে। খুন? চমকে উঠলেন সুপার। আর জানলায্য দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠল দীপা। পুলিশ অফিসার বললেন, বর্ধমান পুলিশ ওর ডেডবডি পেয়েছে। বাস রাস্তার ধারে ক্ষেতেব ওপর পড়েছিল। ব্যাগে যেসব কাগজপত্ৰ পায় তা থেকেই আমাদের জানিয়েছে। ডেডবডি এখনও আছে বর্ধমানে।

আমাকে কি সেখানে যেতে হবে?

হ্যাঁ।

তাহলে আমার প্ৰিন্সিপালের সঙ্গে আগে কথা বলা দরকার। তাছাড়া মেয়েটি জাম্বিযাব নাগরিক। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

মেয়েটি ওরকম জায়গায় গেল কি করে? বলুন তো ৮ অফিসার জানতে চাইলেন।

আমি বুঝতে পারছি না।

কি আশ্চর্য। হোস্টেলের একটা মেয়ে যে বাইরে আছে সেই খবর রাখেন না?

তা রাখব না কেন? ও তো আমার অনুমতি নিয়ে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিল।

কার সঙ্গে?

তা আমি জানি না।

অফিসার একটু ভাবলেন, মুশকিল হল মেয়েটি ভাবতবর্ষের নাগরিক নয়। এ নিয়ে অনেক ঝামেলা হবে। দিল্লী থেকে প্রশ্ন করবে। কাল সকালে এই খবর চিফ মিনিস্টারের কানে পৌঁছাবে। সাধ করে কি মাঝরাতে আপনাদের ঘুম ভাঙাতে এলাম। মেয়েটি কোন ঘরে থাকত?

ওপরে।

চলুন। ঘরটাকে বন্ধ করে যেতে হবে। ওর জিনিসপত্রে কেউ যেন হাত না দেয়! এনকুয়ারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওইরকম থাকবে।

কিন্তু ওর রুমমেট আছে ওঘরে।

জাম্বিয়ান?

না বাঙালি।

ওকে অন্য ঘরে শিফট করান। চলুন আমার সঙ্গে।

জানলা থেকে সরে এল দীপা। গ্লোরিয়ার বিছানা জিনিসপত্র ঘরের একটা দিকে ছড়ানো। অথচ মেয়েটি আর বেঁচে নেই। কাল রাত্রে গ্লোরিয়া বলেছিল, শরীর নিয়ে আমি মোটেই ভাবি না, মানুষের হৃদয়ই আমার কাছে বেশী মূল্যবান। দুহাতে মুখ ঢেকে দীপা যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে তখন সুপার পুলিশ অফিসারকে নিয়ে দরজায় এলেন। দরজা বন্ধ ছিল। ওপারে ঔদের কথাবার্তা এবং কড়া নাড়ার শব্দ হল। দীপা দরজা খুলতেই সুপার বললেন, শোন, গ্লোরিয়ার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। পুলিশ এই ঘর সিল করে দিতে চাইছে। তুমি আপাতত আমার গেস্ট রুমে চলে এস জিনিসপত্র নিয়ে। দীপা মাথা নাড়ল। হোস্টেলের কাজের লোকদের তুলে দীপার জিনিসপত্র ঘর বদল করা হল। এবার পুলিশ অফিসার ঘরে তালা লাগিয়ে সেটা সিল করে দিলেন। এখন সমস্ত মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। গ্লোরিয়ার মৃত্যুসংবাদ শোনামাত্ৰ সবাই স্তব্ধ। গ্লোরিয়াব বান্ধবী দুই জাম্বিয়ান ছাত্রীকে নিয়ে পুলিশ চলে গেল থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে। হঠাৎ দীপার মনে পড়ল ভালবাসাহীন জীবন অর্থহীন, এমন কথা গ্লোরিয়া বলেছিল প্ৰেমে আঘাত পেয়ে। কিন্তু তারপর অনেকদিন চলে গিয়েছে। গতকালও তো মেয়েটা ছিল হাসিখুশি। ঘুম এল না, বাকি রাতটায় চুপচাপ জেগে থাকল দীপা পাথরের মত। মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে। অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।

পরের দিন খবরের কাগজে ঘটনাটা ছাপা হল। বর্ধমানের কাছে একটা গ্রামের পাশে জাম্বিয়ার মেয়েটির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। সম্পূর্ণ নগ্ন ছিল সে। যদিও তার পোশাক, ব্যাগ প্রায় অটুট অবস্থায় মৃতদেহের কাছেই পড়েছিল। মেয়েটি জাম্বিয়া থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিল। তাকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছিল। মেয়েটি বাধা দিতে আততায়ী বা তাকে হত্যা করে। এমন একটি জায়গায় মেয়েটি কি করে পৌঁছাল তা বিস্ময়ের। গ্রামবাসীরা বলছে বিকেল নাগাদ মেয়েটি তিনটে ছেলের সঙ্গে নামে। বিদেশিনী বলে স্থানীয় লোকদের কৌতূহল ছিল। কিন্তু তারা গ্রামান্তরে চলে যায়। সেই তিনজনই সম্ভাব্য হত্যাকারী ধরে নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। সকালবেলোয় হোস্টেলে এই খবরে তোলপাড় হয়ে গেল। যদি বলাৎকারই হয় তাহলে ওর পোশাক পাশে অটুট অবস্থায় পড়ে থাকবে কি করে?

কলেজ ছুটি হয়ে গেল। দীপা কলেজে যায়নি। সাড়ে বারোটাব সময় বাধা এল হোস্টেলে। এসে দীপার পাশে চুপ করে বসল। দীপা বলল, আমি ভাবতে পারছি না বে। কালও সকালে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল।

রাধা বলল, ব্যাটাছেলেগুলা এইরকমই। একদম বাচ্চা আর একেবারে থুখুডা বুডা ছাড়া ওদের বিশ্বাস করা যায় না।

দীপা মাথা নাড়ল, তা হবে কেন? তোমার আমার দাদা কাকা ভাইকে এই দলে ফেলা যায় কি?

যখন আমার দাদা কাকা ভাই তখন ঠিক আছে। কিন্তু অন্য মেয়ের সঙ্গে তো একই সম্পর্ক না। পাকিস্তান থেকে আসার সময় যে-সব পশু মেয়েদের ইজত জোর করে নিয়েছে তারাত তো কোন মেয়ের দাদা কাকা ভাই। বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল রাধাকে। দীপা জবাব দিল না। হঠাৎ রাধা বলল, আর দোষ দিবই বা কাকে? আজ কলেজে এসে শুনি ছুটি হয়ে গেছে। ওর জন্যে। বাড়ি চলে যেতে হবে বলে কয়েকটা মেয়ের কি দুঃখ। একজন বলল, নিগ্রোরা খুব সেক্সি হয়। তাই ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একজন দুজন হলে ওর কিছু হত না। তুমি ভাব দীপা, মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা এরা বলে গেল?

দীপার মনে পড়ে গেল, তুমি অসীমকে দেখেছি?

হ্যাঁ। গেটে দাঁড়িয়েছিল।

তোমাকে কিছু বলেছে?

না তো! কেন?

নাঃ, এমনি।

আধঘণ্টা থেকে রাধা চলে গেলে দীপা পোশাক পাল্টালো। আজ সকাল থেকেই খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছেটা একেবারে চলে গিয়েছে। মাথা এবং শরীরে একটা ভারী অনুভূতি যেন ঝুলে রয়েছে একভাবে। কিছু ভাল লাগছে না, কিছু না।

কলকাতায় নভেম্বরে শীত নামে না। কিন্তু বাতাসে টান এসে যায়। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে এই দুপুরবেলাতেও সেরকম বাতাসের স্পর্শ পেল দীপা, পেয়ে আরাম লাগল। কলেজের দিকে হাঁটছিল সে। এখন অসীমের সেখানে থাকার কথা নয়। ছুটি হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। অসীম কোথায় থাকতে পারে এমন স্পষ্ট ধারণা তার নেই। অথচ সকাল থেকে ওর কথা একবারও মনে আসেনি। অসীম কলেজে অপেক্ষা করবে। ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়ে সব এলোমেলো করে দিল। অথচ দীপার ক্রমশ মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে অসীমের দেখা পাওয়া তার খুব দরকার। কেন, কি জন্যে, তা জানা নেই, ওর পাশে একটু হাঁটলেই মনের ভার দ্রুত কমে যাবে এমন একটা বোধ হচ্ছিল। আচ্ছা, অসীম যদি গতকাল গ্লোরিয়ার সঙ্গে গ্রামের নির্জনে থাকত। তাহলে একই কাণ্ড করতে পারত? বাধা তো অনাত্মীয় ছেলের চবিত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। হেসে ফেলল দীপা। উদ্ভট ভাবনা। অসীম কখনও এমন কাজ করতে পারে না।

কলেজের গেট বন্ধ, সামনে কেউ নেই। কসমসেব সামনে কিছু ছেলে আড্ডা মারছে। দীপা চুপচাপ পেরিয়ে এল। অসীমকে কোথায় পাওয়া যায় ৮ খুব আফসোস হচ্ছিল তার। ঠিক সময়ে কলেজে গেলেই সে ওর দেখা পেত। এতবড় শহরে অসীমকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। হেদুয়ার মুখে ফিরে এসে দীপা যখন অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখনই পেছন থেকে গলা ভেসে এল, কফি খাবে?

চমকে ফিরে তাকাতেই অসীম হাসল।

দীপা বিস্ময় এবং খুশিতে একাকার হল, তুমি?

দাঁড়িয়েছিলাম।

এতক্ষণ? দীপা কি বলবে স্থির করতে পারছিল না, তারপর মনে হতেই বলল, যাঃ, হতেই পারে না। একটু আগে আমি এখান দিয়ে কলেজে গিয়েছি।

দেখেছি। মিটিমিটি হাসছিল অসীম।

দেখেছ? আর তুমি আমাকে ডাকোনি? হা হয়ে গেল দীপা।

দেখছিলাম তুমি আমাকে খুঁজেছ কিনা?

কি দেখলে?

মুখটা যখন কালো হয়ে গেল তখন বুঝলাম যা বোঝার।

তুমি তো খুব নিষ্ঠুর।

আর তুমি? এতক্ষণ ধরে কেউ দাঁড়াবে যখন আন্দীে আসবে কিনা তার ঠিক নেই। কলেজ তো অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছে।

তাহলে তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?

আমার মন বলছিল তুমি আসবেই।

দীপার মনে হচ্ছিল তার শরীর একটু হালকা হয়ে গেল। সে বলল, জানো, কাল রাত্রে যখন গ্লোরিয়ার খবর পেলাম তখন আমার সব সাদা হয়ে গিয়েছিল। ওরকম একটা মেয়ে দুম করে মরে গেল? মানুষ এত নৃশংস হয়?

আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি দীপা।

মেয়েটার সঙ্গে আমার কোন মিল নেই, প্রথম প্রথম ওর অনেক আচরণ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না, পৃথিবীর দুটো আলাদা দেশের মানুষের আচরণ তো উল্টো হবেই। কিন্তু ওর কথাবার্তায় আমি একসময় বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল এদেশের মেয়েরা অনেক বাড়তি অভ্যাস অকারণে বয়ে নিয়ে চলেছে। এদেশের মেয়েরা কেন করব। এই প্রশ্নটা এখনও করতেই শেখেনি।

সেকি। তুমি তো জ্ঞানদোনন্দিনী ঠাকুরের ভক্ত। তিনি তো সত্তর আশি বছর আগে দারুণ দারুণ কাণ্ড করেছেন।

করেছেন। কিন্তু সেটা এদেশের মেয়েকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি, উনি তাঁর পরের প্রজন্মের ছেলেদের প্রশংসা পেয়েছেন। ছেলেরা যেন একটু অনুকম্পা দেখিয়ে বলে, উঃ, কি তেজী মেয়ে ছিলেন।

অসীম জবাব দিল না। কসমসের সামনে থেকে রকবাজদের জমায়েতটা এবার এগিয়ে আসছে ট্রাম লাইনের দিকে। উল্টো ফুটপাত থেকেই ওরা সিটি দিতে পারে, মন্তব্য ছুডাতে পারে। সে বলল, এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটা যাক। তুমি খাওয়া-দাওয়া করেছ?

হাঁটা শুরু করে দীপা বলল, না। ভাল লাগছিল না।

সে কি! চল, কিছু খাবে। এই ট্রামটায় ওঠো।

ট্রামে? কোথায়?

চলই না।

ওরা ট্রামে উঠল। দুপুরের এইসময়ে ট্রামে বেশী যাত্রী নেই। লেডিস সিটি ছেড়ে দীপা এগিয়ে গিয়ে বসতেই এক প্রৌঢ় বললেন,  পেছনে লেডিস সিটি খালি।

দীপা মুখ ঘুরিয়ে বলল, তাতে কি? এটার গায়ে কি জেন্টস সিটি লেখা আছে।

লোকটি থাতমত হয়ে মুখ ফেরাল। অসীম দীপার। পাশে বসে বলল, চমৎকার।

এত বাজে কথা গায়ে পড়ে বলতে ভালও লাগে লোকের। দীপা বলল।

চল, কফিহাউসে গিয়ে কিছু খেয়ে সময় কাটিয়ে আমাদের বাড়িতে যাবে। ও হো আজ যা তোমার মনের অবস্থা তাতে মায়ের সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে?

দীপা মাথা নাড়ল, না। আমি আগে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

আমার সঙ্গে? অসীম অবাক।

দীপা নিচু গলায় জবাব দিল, আমার জীবন সম্পর্কে কিছুই জানো না তুমি?

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার