ব্যাগ থেকে গ্লাভস বের করে পরে নিল সুদীপ।

এখন হঠাৎই যেন সব শব্দ মরে গেছে আচমকা। ঘন অন্ধকারে শুধু পাম্পের কাচের ঘরের আলো টিমটিম করছে। দ্বিতীয় গ্লাভসটা কল্যাণকে দিয়ে সে আর একটু সময় অপেক্ষা করল। না, ভেতর থেকে কোন মানুষ চটপট বেরিয়ে আসবে বলে মনে হয় না। যে লোকটা গাড়ি চালিয়ে এল সে নেহাতই মাসমাইনের ড্রাইভার! মালিক থাকে ডায়মন্ডহারবারে। ভাল ব্যবসা তার। অতএব কোন নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। ওরা সেদিনই দেখে গিয়েছিল গাড়ির কাচ ওদের সুবিধে দেবে। বাইরে থেকে ভেতরটা বোঝা যায় না। অবশ্য এই গাড়িটাকেই যে পাবে এমন নাও হতে পারত। কিন্তু সম্ভাবনাটা কাজে লেগে যাচ্ছে। সে কল্যাণকে বলল, আমি গিয়ে স্টিয়ারিং-এ বসছি। তুই ঘুরে গিয়ে পাম্পের দরজায় শেকলটা তুলে দিয়ে ছুটে আসবি।

কল্যাণের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল, যদি চাবিটা নিয়ে গিয়ে থাকে? মাঙ্কি ক্যাপ দুটো বের করব?

সুদীপ মাথা নাড়ল, না, নিয়ে যায়নি। কারণ ও যখন নামল তখন ভঙ্গি দেখলে বুঝতে পারতাম। তাছাড়া বেঢপ জায়গায় রেখেছে গাড়িটা, নিশ্চয়ই পরে পার্ক করবে বলে ভেবেছে। যা হোক, যদি চাবি

থাকে তখন ক্যাপ বের করলে চলবে। দাঁড়া, একটা গাড়ি আসছে। ওটা চলে যাক।

কল্যাণ ঘাড় নেড়ে ঘুরিয়ে দেখল আর একটা গাড়ি আসছে। ধীরে ধীরে গতি কমাচ্ছে সেটা। এবার খুব অস্বস্তি শুরু হল কল্যাণের। আনন্দরা নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে গাছটার তলায়। ওদের যদি কিছু হয় তাহলে সে সুদীপের সঙ্গে সরে এল গাছটার আড়ালে। গাড়িটা ছুটে গেল না। গতি কমিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে হর্ন বাজাল। দুবার বাজাতেই একটু আগে আসা গাড়ির ড্রাইভার দরজার এসে দাঁড়াল, কি খবর?

নতুন গাড়ির ড্রাইভার সিটে বসেই উত্তর দিল, খুব মাল টানছ দোস্ত! আমাকে এখন শালা কলকাতায় ছুটতে হবে। শোন, সাহেব বলেছে কাল ঠিক ছটায় গাড়ি নিয়ে যেতে।

ছটায়? সাহেব কোথায় আছে?

প্যারাডাইসে। কলকাতা থেকে মেহমান এসেছে। জব্বর ফুর্তি। গাড়ি আজ ডায়মন্ডহারবারে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। ভোরবেলায় চলে যেও। কথা শেষ করে লোকটা গাড়ি ঘুরিয়ে কলকাতার দিকে চলে গেল।

দরজায় দাঁড়ানো ড্রাইভারটা একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে পেছন ফিরল, দিল শালা ফুর্তিটা জবাই করে! উনি প্যারাডাইসে মজা মারবেন আর আমাকে এখানে রাত জাগতে হবে! বিরক্ত লোকটা ফিরে গেল নিজের গ্লাসের কাছে। ওকে বা কাউকে আর দেখা যাচ্ছিল না। আবার অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে চরাচর। সুদীপ আরও মিনিটখানেক অপেক্ষা করল। তারপর কল্যাণকে ইঙ্গিত করে বেরিয়ে এল আড়াল ছেড়ে। নিঃশব্দে সে গাড়ির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। চাবিটা রয়েছে লটকান। সে কল্যাণকে ইশারা করে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজাটা খুলল। তারপর নিচু হয়ে সিটে বসে ওপাশের দরজাটা খুলে দিল।

কল্যাণের বুকের মধ্যে এখন হাতুড়ির শব্দ। দুটো পা প্রায় নিঃসাড়। সে চোখের কোণে সুদীপের দিকে তাকাল। গাড়ির আদল ছাড়া কিছুই নজরে এল না। আর দেরি করা উচিত হবে না এমন বোধ হওয়ামাত্র সে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ছুটে এল দরজার কাছে। ভেতরের মানুষগুলো জমিয়ে মদ্যপান করছে। দরজার দিকে মুখ করে আছে একজন। সে বিস্মিত হওয়ার আগেই দুটো পাল্লা শব্দ করে বন্ধ করে শেকলে হাত দিল। উত্তেজনায় শেকলটা হাত থেকে গলে গেল প্রথমটায়, কাঁপুনি সত্ত্বেও দ্বিতীয়বারে সেটা হস্তগত করে হুকে আটকে দিতে পারল কল্যাণ। আর তখনই চিৎকার উঠল, আই, কে রে? কল্যাণ ততক্ষণে গাড়ির কাছে চলে এসেছে।

ইঞ্জিন চালু করে সুদীপ চিৎকার করল, উঠে আয়।

কোনরকমে সামনের আসনে বসে দরজা বন্ধ করতেই কল্যাণ টের পেল ওর শরীরে কোন সাড়া নেই। ওপাশের দরজায় যে ঘন ঘন শব্দ হচ্ছে, ঘরের ভেতরের চিৎকার কাচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসছে, সুদীপ গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে বড় রাস্তায় চলে এসেছে—এসবই ঘটে গেল অথচ টের পেল না যেন সে। ঘাম জড়ানো শরীরে শীতল অনুভূতি। একটা ছাড়া গরুকে কাটাতে সুদীপ গালাগাল করতে কল্যাণ চেতনায় ফিরল। পকেট থেকে রুমাল বের করে সুদীপের দিকে আধা অন্ধকারে তাকিয়ে বেশ লজ্জিত হল। সে কি সত্যি এতটা নার্ভাস! কই, সুদীপকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না কিছু ব্যতিক্রম ঘটেছে। কল্যাণ মুখ ফিরিয়ে দেখল। পেট্রল পাম্প অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে। কোন মানুষের সাড়া নেই পিছনে। দুপাশে কিছু চা-সিগারেটের দোকান এল। সেখানেও কোন সন্দেহ নেই। যখন সে দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন লোকটার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। দরজা বন্ধ করা মাত্র চিৎকারটা উঠেছিল। সে দাঁড়িয়ে ছিল অন্ধকারে, লোকটা কি তাকে স্পষ্ট দেখেছিল? পুলিস জিজ্ঞাসা করলে হুবহু বর্ণনা দিতে পারবে? নিজের মনেই প্রশ্নগুলো নিয়ে উত্তাল হচ্ছিল কল্যাণ। সে বুঝতে পারছিল ওই আলোয় চকিতে দেখা কোন মুখ কেউ মনে রাখতে পারে না। কিন্তু যদি লোকটার স্মৃতি অসাধারণ হয়? অস্বস্তির কাটাটা কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। এইসময় সে শিস শুনতে পেল। কোন চেনা গান নয়, অথচ বেশ খুশীর শিস দিচ্ছে সুদীপ গাড়ি চালাতে চালাতে। হেডলাইটের আলোয় সামনের পথ আলোকিত। পাম্প থেকে বেরিয়ে আসার পর ও একটাও কথা বলেনি। নিজেকে শক্ত করতে চাইছিল কল্যাণ। সুদীপ যদি নার্ভাস না হয় তবে সে কেন হবে? নড়েচড়ে বসল কল্যাণ। এইসময় সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, মালগুলো আলাদা করে রাখা আছে? আর একবার চেক করে নেয়।

সব ঠিক আছে। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলতে চেষ্টা করলে কল্যাণ। তারপর আবার পিছন দিকে তাকাল। অন্ধকারে কোন আলো চোখে পড়ছে না।

সুদীপ হাসল, ও নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। ওরা যখন ঘর থেকে ছাড়া পাবে তখন আমরা নাগালের বাইরে। মনে হচ্ছে প্রথম কাজটায় কোন বাধা পাব না। মর্নিং শোজ দ্য ডে।

কল্যাণ কোন জবাব দিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল সুদীপ বড্ড বেশি স্মার্ট, এইটেই যেন শেষ পর্যন্ত ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।

রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেইখানে এসে বাঁ দিকে চেপে গাড়িটা দাঁড় করাল সুদীপ। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে বনেটটা খুলল। এখন যে কোন গাড়ি এই পথে গেলে ভাববে নির্ঘাৎ ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে। আর তখনই আনন্দর গলা শুনতে পেল সে, সব ঠিক আছে?

হ্যাঁ। কল্যাণ জবাব দিল।

তুই পেছনের সিটে চলে আয়।

কল্যাণের দরজা খোলার শব্দ হল। কলকাতার দিক থেকে একটা ট্রাক আসছে। সুদীপ আরও ঝুঁকে পড়ল ইঞ্জিনের ওপর। না, কোনভাবেই মুখ দেখানো কাম্য নয়। আজকাল পথেঘাটে গাড়ি খারাপ হয়ে আছে দেখলে সাধারণ কোন ড্রাইভার পাড়াতে চায় না। ট্রাকটা বেরিয়ে যেতে স্বস্তি হল। বনেট নামিয়ে ড্রাইভারের সিটে ফিরে এল সুদীপ। পেছনের সিট থেকে আনন্দ বলল, তোদের ব্যাগে সব জিনিস আছে। আর দেরি করিস না, ভেতরে ঢোকার পর তোরা ঘন্টা চারেক সময় পাবি। তোরা লিগ্যাল পেয়ার নস, এটা মনে রাখবি। তোর ঘড়িতে কটা বাজে সুদীপ?

ইঞ্জিন চালু করে সুদীপ বলল, দশটা পাঁচ। লেটস গো। তারপর সে জয়িতার দিকে তাকাল। যেটুকু আলো ছিটকে আসছে তাতে জয়িতার মুখ স্পষ্ট না দেখা গেলেও বেশ রহস্যময়ী মনে হচ্ছে তাকে। জয়িতা বসেছে তার বাঁ দিকে। সে ঠাট্টার গলায় জিজ্ঞাসা করল, কিরে, সেন্ট মাখিসনি? তুই একটা হোপলেস! সেন্ট ফেন্ট না মাখলে প্রেম প্রেম ভাব আসে?

জয়িতা মাথা ঝাঁকাল, একটা সিগারেট দে তো।

পেছন থেকে আনন্দ বলল, না, সিগারেট খাবি না। ওটা দারোয়ানগুলো মনে রাখবে। আর তোরা নিজেদের তুই-তুই করে অ্যাড্রেস করবি না। এসব কাজে যারা আসে তারা তুইতোকারি করে না।

তুইতোকারি প্রেমে অচল, বুঝলি জয়ী, আমার কপালে কি মাল জুটল বল। সহানুভূতি জানা ভাই। তোকেও মেয়ে আই মিন প্রেমিকা ভাবতে হচ্ছে! জিভে শব্দ তুলল সুদীপ গাড়ি চালাতে চালাতে।

মাথা ঝাঁকাল জয়িতা, সেম টু ইউ।

আনন্দ বলল, অনেক হয়েছে, এবার রসিকতা বন্ধ কর। প্যারাডাইস দেখা যাচ্ছে।

ডোন্ট গেট এক্সাইটেড ম্যান। আমি ঠিক আছি। জয়িতা মাই হনি, তুমি ঠিক আছ?

একটা ঘুঁষি মারব সুদীপ, ন্যাকামি করিস না।

সুদীপ গাড়ির গতি কমাল। সমস্ত চরাচর অন্ধকারে ড়ুবে আছে। শুধু স্বপ্নের জাহাজের মত প্যারাডাইস আলোয় ভাসছে। ধীরে ধীরে ও বন্ধ গেটের সামনে গাড়ি নিয়ে হর্ন বাজাল দুবার। একটু বাদেই সেই দারোয়ানদের একজন সামান্য ফাঁক করল গেটের কপাট, আট বাজে বন্ধ হো যাতা হ্যায় সাব।

সুদীপ জানলায় মুখ এনে বলল, টেলিফোনসে বাত হুয়া থা হামারা।

চাপা গলায় জয়িতা বলল, জিভ দিয়ে চটকায় আহা রে, কি হিন্দী!

লোকটা এবার জিজ্ঞাসা করল, কেতনা আদমি হ্যায়?

সিরিফ দো জন।

কাঁহাসে আ রহা হ্যায়?

কলকাত্তা।

এবার লোকটা দরজা খুলল। সুদীপ গাড়িটা ঢোকাতেই লোকটা চাপা গলায় বলল, ললাটনেকা টাইমমে মুঝে ইয়াদ রাখিয়ে সাব। সুদীপ হাসল। তারপর দেখল সাদা নুড়ি বিছানো পথ চলে গেছে ভেতরে। ডানদিকে বেশ কয়েকটা গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। দরজায় আগল তুলে লোকটা বলল, সাব, ডাইনামে গাড়ি রাখিয়ে।

আর একটু এগিয়ে সুদীপ গাড়িটা একটু মুখ বেঁকিয়ে পার্ক করল। যেন প্রয়োজনেই ইঞ্জিন চালু করে ছুটে যেতে পারে সদর গেটের দিকে। সে জয়িতাকে ইশারা করল। তারপর দুটো ব্যাগ দুজনে নিয়ে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। সুদীপ যখন দরজায় চাবি দিচ্ছিল তখন জয়িতা চারপাশে তাকাল। এপাশে সুন্দর লন আর কিছু ফুলের গাছ। ঝকঝকে আলো চারপাশে। এবার আরও তিনজন যুনিফর্ম পরা দারোয়ানকে দেখতে পেল সে। অর্থাৎ মোট চারজন এই জায়গার পাহারায় আছে। হঠাৎ কোমরে হাতের স্পর্শ পেল জয়িতা। সে ছিটকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সুদীপ বলল, নো। কিছু মনে করিস না, ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে তো! এইসব জায়গায় যারা ফুর্তি করতে আসে তারা এইভাবেই হাঁটে। সুদীপের কাঁধের কাছে প্রায় তার কাধ।

জয়িতা বলল, আলগা করে রাখ, আমার সুড়সুড়ি লাগছে।

কয়েক পা হাঁটতেই একটা দারোয়ান তাদের দেখে দাঁত বার করে হাসল। ওরা কি ধান্দায় এসেছে সেটা বুঝে যেন সে গলিত হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে একটা দিক দেখিয়ে লোকটা উচ্চারণ করল, অফিস উধার।

মগ্ন ভঙ্গিতে নুড়ির ওপর পা ফেলে খানিকটা এগোতেই সুদীপ একটা ছোট্ট বাড়ি দেখতে পেল। গাছগাছলার মধ্যে আলো জ্বেলে কাউন্টার সমেত অফিসঘর করা হয়েছে। কমপ্লিট সুট পরা একটা লোক ডটপেন হাতে নিয়ে কাউন্টারের ওপারে দাঁড়িয়েছিল। কাউন্টারে ছোট্ট বোর্ডে লেখা রিসেপশন। লোকটি ওদের দেখে উষ্ণ হাসি হাসল, গুড ইভনিং স্যার। ওয়েলকাম টু প্যারাডাইস। বাট আই অ্যাম অ্যাফ্রেড ইউ আর লিটল বিট লেট।

বেটার লেট দ্যান নেভার। আই মেড এ কল। জয়িতার কোমর থেকে হাত সরিয়ে সুদীপ পকেট থেকে দামী সিগারেটের প্যাকেটটা খুলে এগিয়ে ধরে ইঙ্গিত করল।

লোকটা মাথা নাড়ল, নো, থ্যাঙ্কস। হোয়াটস ইওর গুড নেম প্লিজ?

এম রয়। সুদীপ সতর্ক ভঙ্গিতে গ্লাভসটার দিকে তাকাল। এটা থাক হাতে, অনেকেই তো পরে। লোকটা একটা প্যাড টেনে নিয়ে নজর বোলাচ্ছিল। জয়িতা তখন কতকগুলো নোটিশের দিকে তাকাচ্ছিল। এই করে যতটা সম্ভব লোকটার চোখ এড়ানো যায়! নোটিশ বোর্ডে নিয়মকানুন লেখা রয়েছে। দিবা-ভ্রমণের জন্যে ভ্রমণার্থীদের পঁচিশ টাকা দিতে হবে। তারা সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত উদ্যানে থাকতে পারবেন, আধুনিক কুঁড়েঘর ব্যবহার করতে পারবেন কিন্তু সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ। কাউকে বিরক্ত করা চলবে না, মদ্যপান অবৈধ। রেস্তোরাঁ থেকেই খাবার কিনতে হবে। উদ্যানে রাত্রিবাসের জন্যে এ সি এবং নন এ সি কটেজে সব রকম আধুনিক ব্যবস্থা আছে। প্রতি রাত্রির জন্যে শীততাপনিয়ন্ত্রিত কটেজের ভাড়া আড়াইশো থেকে চারশো টাকা। একমাত্র এই শ্রেণীর অতিথিরাই সাঁতারের পুল ব্যবহার করতে পারবেন। সাধারণত উদ্যানে মদ খাওয়া অবৈধ হলেও কটেজের ঘরে বাইরের মানুষকে বিরক্ত না করে সেটা খাওয়ায় আপত্তি নেই। তবে যে কোন মুহূর্তেই উদ্যান কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা থাকবে কাউকে বহিষ্কার করার।

জয়িতা আরও হুমকি দেওয়া উপদেশাবলী পড়ল। এই সময় সুদীপ খাতায় সই করছিল। এম রায় লেখবার সময় তার নিজেরই হাসি পেল। তিনশো টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে লোকটি বলল, আপনাদের রাত শুভ হোক।

ধন্যবাদ। আচ্ছা আমরা কি একটু বাগানটা ঘুরে দেখতে পারি? খুব গল্প শুনেছি এই বাগানের। কাল ভোরেই চলে যাব তাই আর সুযোগ হবে না হয়তো। সুদীপ হাসল।

দুঃখিত স্যার। রাত্রে আটটার পর কারও বাগানে থাকা নিষেধ।

সুদীপ একটা কুড়ি টাকার নোট কাউন্টারে রাখল, দেখুন না চেষ্টা করে।

চকিতে নোটটা সরিয়ে নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে লোকটা বলল, আধ ঘণ্টার বেশি থাকবেন না। বস আসবেন এগারোটার পরে। তার মধ্যে কটেজে ফিরে যাবেন।

ধন্যবাদ।

লোকটা বেল বাজাতেই অন্ধকার কুঁড়ে স্বাস্থ্যবান একটা বেয়ারার উদয় হল। রিসেপশনিস্ট তার দিকে একটা চাবি এগিয়ে দিয়ে বলল, কটেজ নাম্বার টুয়েলভ। সাহেবরা কিছুক্ষণ বাগানে থাকবেন, হাবিবকে বলে দিও।

সুদীপ খুব সহজ ভঙ্গিতে জয়িতার পাশে এসে দাঁড়াল, হনি, লেটস গো। বলে একহাতের বেড়ে জয়িতাকে টেনে কাছে এনে বেয়ারাকে অনুসরণ করল।

জয়িতা ফিস ফিস করে বলল, ইটস টু মাচ সুদীপ!

সুদীপ সেই গলায় জানাল, এইটেই স্বাভাবিক পাঁচু।

এই আলোকিত বাড়িটাই প্রবেশপথ। কারণ দুদিকে চারটে ঘরের মাঝখানে প্যাসেজ, সেটা গিয়ে পড়েছে বাগানে। ওপাশে কোথাও জেনারেটার চলছে। তার আওয়াজ চেপে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও সক্রিয়। সুদীপ এবং জয়িতা বাগানাটার দিকে তাকাল। মাঝে মাঝে ছোট লন, সাজানো ফুলের গাছের মধ্যে দিয়ে বাধানো পথ চলে গেছে। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে রাখা আলো অন্ধকারকে পাতলা করে জ্যোৎস্নার আভাস এনে দিয়েছে। এখন বাগানে কেউ নেই। বেয়ারাটা ফুলের গন্ধে ড়ুবিয়ে তাদের নিয়ে এল পেছনদিকে। পর পর কটেজগুলো রহস্যময় আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুদীপ বেয়ারাটাকে জিজ্ঞাসা করল, এইগুলো?

না স্যার। এসি কটেজ ওপাশে।

নন-এসি কটেজের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় নারী-পুরুষের সম্মিলিত হাসির শব্দ কানে এল। স্টিরিওতে বাজনা বাজছে আর তার সঙ্গে নেশায় জড়ানো হুল্লোড়। সুদীপ বেয়ারাটার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল, আজকে তোমাদের গেস্ট কি রকম?

বেয়ারা মাথা নাড়ল, আর দুটো কটেজ খালি আছে। হেভি ডিম্যান্ড। নিশ্চিন্তে ফুর্তি করার ব্যবস্থা আর কোথায় পাবেন?

ঠিক। তুমি এখানে অনেকদিন আছ?

না স্যার। আগে সার্কুলার রোডের একটা হোটেলে কাজ করতাম।

একটা রঙিন কটেজের সামনে এসে দরজায় চাবি ঢোকাল বেয়ারাটা। ভেতরে ঢুকে আলো জ্বেলে এ সি চালু করল। জয়িতা মুগ্ধ হয়ে গেল। এই অজ পাড়াগাঁয়ে এমন আধুনিক ব্যবস্থা সম্ভব? বেয়ারা বলল, আপনারা যদি রাত্রে খাবার চান বলে দিন।

সুদীপ মাথা নাড়ল, না, আমরা খেয়ে এসেছি।

বেয়ারা জিজ্ঞাসা করল, ড্রিঙ্কস? আমাদের নিয়ম হল ঘরে বসে ড্রিঙ্ক করা চলবে কিন্তু সেটা এখান থেকেই নিতে হবে। কি আনব স্যার?

সুদীপ জয়িতার দিকে তাকাল। জয়িতা সোফায় বসে পড়েছে। সে বেয়ারাটাকে নিচু গলায় বলল, মুশকিল হল মেমসাহেব ড্রিঙ্ক করেন না। একা একা খেতে আমার খুব খারাপ লাগে।

বেয়ারা হাসল, নো প্রব্লেম স্যার। আমাদের ককটেল রুমে গিয়ে খেয়ে আসতে পারেন।

ককটেল রুম! সেটা কোথায়?

ঠিক এই কটেজগুলোর পেছনে। ওখানে যাওয়ার সময় চাবিটা নিয়ে যাবেন।

অনেক ধন্যবাদ। সকালে যাওয়ার আগে তোমার দেখা পাব নিশ্চয়ই!

হ্যাঁ স্যার। আমাদের তো চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি। আপনারা কি এই রাত্রে বাগানে যাবেন?

হ্যাঁ, একটু দেখব।

ঠিক আছে, আমি হাবিবকে বলে দিচ্ছি স্যার। সঙ্গে চাবিটা রাখবেন। ওতে কটেজ নাম্বার আছে।

হাবিব কে?

হেড গার্ড। গুডনাইট স্যার। দাঁত বের করে জয়িতার দিকে হাসি ছড়িয়ে লোকটা চলে গেল।

এখন চারধার নিঃশব্দ নয়। নারীপুরুষের হুল্লোড়-ধ্বনি ছিটকে ছিটকে আসছে। সুদীপ চটপটে গলায় বলল, জয়ী, উঠে পড়।

জয়িতা উঠে দাঁড়াল, শাড়িতে আমাকে খুব বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে, না?

উঁহু! ডিলিসিয়াস!

ভদ্রভাবে কথা বল্ সুদীপ। আই উইল নট টলারেট দিস।

জাস্ট এ মিনিট, আমি লু থেকে আসছি। সুদীপ পাশের দরজা খুলে টয়লেটে চলে গেল। জয়িতার মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল। সুদীপটার কথাবার্তা একটু লাগামছাড়াই। মনে কোনও পাপ নেই। কিন্তু এভাবে কখনও একটা ঘরে রাত্রে ওর সঙ্গে থাকেনি। শাড়িটার জন্য অস্বাচ্ছন্দ-বোধ শুরু হল জয়িতার। ভীষণ রকম মেয়ে মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। শরীরের গঠন অনুযায়ী সে মেয়ে নিশ্চয়ই কিন্তু মেয়েলিপনা তাকে কখনই কবজা করেনি। নিজের শরীর সম্পর্কেও সে সচেতন ছিল না। তিন বন্ধুর চোখে কোনদিন সেরকম ছায়া দ্যাখেনি সে। বরং ওরা স্বচ্ছন্দে কলেজের লবঙ্গলতিকাদের সম্পর্কে রসালো আলোচনা করেছে তার সামনে। ন্যাকা মেয়েগুলোর সমালোচনার সময়ে জয়িতাও গলা মিলিয়েছে ওদের সঙ্গে। নিজেকে আলাদা করে ভাবার কোন কারণ ঘটেনি। কিন্তু আনন্দর মায়ের সঙ্গে সময় কাটানোর পর থেকেই একটা অস্বস্তি এটোর মত লেগে আছে মনে। সুদীপ যখন গাড়িতে তুলে নিয়ে রসিকতা আরম্ভ করল তখন থেকেই সেটা বেড়ে যাচ্ছে। প্রেম ফ্রেম সে জীবনে করেনি। করার কথা মাথায় আসেনি। আনন্দ আজকের প্রোগাম জানানোর পর তার হাসি পেয়েছিল। আউট অফ অল পার্সেন সুদীপের সঙ্গে তাকে প্রেমের অভিনয় করতে হবে। মজাও লেগেছিল। কিন্তু এখানে আসার পর সুদীপ এমন ভাব করছে যে, সে যেন একটি রক্তমাংসের খাদ্যবস্তু।

টয়লেট থেকে বেরিয়ে এসে সুদীপ টেবিল থেকে চাবি নিল, ফাইভ স্টার হোটেলের সঙ্গে পাল্লা দেবে, বুঝলি? বাথরুমে দি সোপ অফ বিউটিফুল ওমেন রয়েছে?

মানে? জয়িতার চোয়াল শক্ত হল।

ক্যামে হোয়াইট। ক্যানাডার তৈরি। ভাব ব্যাপারটা।–তোর কি হল?

কিছু না।

চল, ওদের বস আসবার আগেই পাক দিয়ে আসি।

জয়িতা সুদীপের দিকে তাকাল। খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ওকে। সেকি ভুল বুঝেছে? জয়িতা উঠল। দরজায় চাবি দিতে গিয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ব্যাগগুলো এখানে রেখে যাওয়া কি সেফ হবে? ড়ুপ্লিকেট কী থাকতে পারে!

জয়িতা বলল, ব্যাগ নিয়ে বাগানে ঘুরলে তো ওরা সন্দেহ করবে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওরা চারপাশে তাকাল। সন্দেহজনক কিছুই নজরে পড়ছে না। সুদীপ বলল, চল, আমার হাত ধর।

জয়িতা চোখের তলায় তাকাল, হাত ধরতে হবে কেন?

প্রেম প্রেম ভাব আনতে হবে না? সবাই আমাকে কেমন স্যার স্যার বলছে দেখেছিস। আমার বয়সটা যেন কোন ফ্যাক্টারই নয়। সেক্স নিয়ে যারা ব্যবসা করে তারাও কেমন অন্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে।

সুদীপ কথা শেষ করা মাত্রই ওপাশের কটেজের দরজা খুলে গেল। একটি মেয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল বারান্দায়, না আমাকে যেতে দিন, এরকম কথা ছিল না। আমি এখানে কিছুতেই থাকব না।

সেইসময় দরজায় একটি প্রৌঢ় এসে দাঁড়াল, ওসব বুজরুকি ছাড়। টাকা দিয়েছি যখন তখন যা বলব তাই করতে হবে। ভেতরে এসো বলছি, নইলে হাবিবকে ডাকব।

আপনার পায়ে পড়ি। তিনজন থাকবেন তা ওরা বলেনি আমাকে।

আমি তো একজনের টাকা দিচ্ছি না। এসো ঘরে, মিলি মিসি করি কাজ, নাকি হাবিবকে ডাকব? মেয়েটি মাথা ঝাঁকাল। তারপর পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে নিজেই দরজা বন্ধ করল।

সুদীপের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ওর দৃষ্টি বন্ধ দরজার ওপর। জয়িতা নিচু গলায় বলল, বি ইজি। ছোট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়িস না। চলে আয়।

সুদীপ নিঃশ্বাস ফেলল শব্দ করে, ইচ্ছে করছে মুণ্ডুগুলো ছিঁড়ে ফেলি। টাকা দিয়ে মেয়েটাকে কিনে নিয়েছে। আশেপাশের গ্রামের কোন গরিব মেয়ে হয়তো!

সুদীপের হাত ধরে জয়িতা বাগানে চলে এল, সব কটেজে নিশ্চয়ই একই নাটক হচ্ছে, না?

বাগানটা বেশ বড়। অন্তত এই মুহূর্তে ওরা শেষ দেখতে পাচ্ছে না। একদিকে যেমন সাজানোলন, যত্নে গড়া ফুলের বিছানা তেমনি অন্যদিকে ঘনজঙ্গলের আদল তৈরির চেষ্টা হয়েছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে ডে-হাট। চারটে খুঁটির ওপর খড়ের ছাউনি, নিচে ত্রিপল পাতা, ইলেকট্রিক লাইন আছে। এখন এইগুলো ফাঁকা। বুনো গন্ধ বের হচ্ছে সব গাছেদের শরীর থেকে। সুদীপ জরিপ করে নিল। পুরো এলাকাটা তিনটে ভাগে বিভক্ত। রিসেপশন এবং গাড়ির পার্কিং সামনের দিকে। মাঝখানে বাগান, জঙ্গল, জেনারেটর রুম এবং নন-এসি কটেজ। তৃতীয় ভাগে এসি কটেজ, সাঁতারের পুল এবং ককটেল রুম, যার কথা বেয়ারাটা বলল। এসি কটেজ থেকে দৌড়ে রিসেপশনের কাছে পৌঁছাতে তার মিনিট দুয়েক লাগবে কিন্তু জয়িতার দেরি হবে। ও নিচু গলায় বলল, আমার কোমরে হাত রাখ। জেনারেটারটা দেখে আসি। জয়িতা এবার আপত্তি করল না। ওরা যেন বেড়াতে বেরিয়েছে এমন ভঙ্গিতে বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল। মাঝে মাঝে জঙ্গলের গায়ে ঝুলিয়ে রাখা ইলেকট্রিক বালবের আলো তাদের গায়ে পড়ছিল বটে কিন্তু তারা কোন পাহারাদার দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ সুদীপ খড়ের ছাউনির তলায় ত্রিপলের নিচে গিয়ে বলল, মিনিট দশেক এখানে শুয়ে থাক। কেউ আমাদের লক্ষ্য করছে কিনা বোঝ যাবে। তুই বোস, তোর কোলে মাথা রেখে শুচ্ছি।

কোন দরকার আছে? কাউকে কাছাকাছি দেখছি না। জয়িতা মৃদু আপত্তি জানাল।

হাতে সময় আছে যখন তখন একটু রিল্যাক্স করা যাক।

জয়িতা হাঁটু মুড়ে বসল। সুদীপ পা ছড়িয়ে দিয়ে তার কোলে মাথা রেখে বলল, একটু গন্ধ-ফন্ধ মেখে এলে পারতিস।

তোর তাতে কি? তোকে যা করতে বলা হয়েছে তাই কর!

করছি তো। এইসময় প্রেমিকারা ঠিক কি কি করে বল তো? মানে তাদের কি কি বিজনেস থাকে? হাতটাত নিশ্চয়ই ধরে। গানও গায় চাঁদের দিকে তাকিয়ে। তুই একটা গান গা জয়ী। ঘুম ঘুম চাদ মার্কা গান। সুদীপ চোখ বন্ধ করল।

ট্র্যাস! কতক্ষণ শুয়ে থাকবি? তোর কোমরের ওপরের শক্ত মতন জিনিসটা একটু সরা তো, আমার পায়ে লাগছে। জয়িতা কথাটা বলে নিজেই সরিয়ে দেওয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে আবার সরিয়ে নিল। রিভলভারটা সরাতে চাইলেও সরানো যাবে না এখন। সে চোখ বন্ধ করল। তারপর মনটাকে শান্ত করার জন্যেই গুনগুন করল, ওয়ান্না বি স্টার্টিং সামথিং।

সুদীপ মাথা নাড়ল, চমৎকার। বাংলা গান ট্রাস আর মাইকেল জ্যাকসন—

নট দ্যাট। ওকে থামিয়ে দিল জয়িতা, ইট ডিপেন্ডস অন মুড।

আপনারা কে?

ঠিক এইসময় অন্ধকার ফুঁড়ে একটি বিশাল শরীর সামনে এসে দাঁড়াল। সুদীপ কোন জবাব দিল না। জয়িতা বলল, আমরা এখানে রাত কাটাতে এসেছি।

ভাল করেছেন। কিন্তু এতরাত্রে বাগানে থাকা নিষেধ। উঠুন।

কেন? আমরা তো কারও ক্ষতি করছি না। জাস্ট বসে আছি এখানে।

বসা শোওয়া সব নিজের কটেজে গিয়ে করবেন। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল লোকটা।

এবার সুদীপ উঠে বসল। তারপর পকেট থেকে চাবিটা বের করে এগিয়ে ধরল, আমাদের আধঘণ্টার জন্যে বাগানে থাকার অনুমুতি দিয়েছেন রিসেপসনিস্ট।

চাবিটা হাতে নিয়ে সেই আধ-অন্ধকারে উলটে-পালটে দেখল লোকটা। সুদীপ বলল, আমরা আধঘণ্টার মধ্যেই চলে যাব হাবিববাবু।

লোকটা হাঁ করে তাকাল। তারপর চাবিটা ফিরিয়ে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বাবু হয়ে বসল সুদীপ, কি বলেছিলাম একটু আগে? দিস প্লেস ইজ ওয়েল-প্রটেক্টেড। কিন্তু আজ রাত্রে ঠিক কতগুলো পাহারাদার আছে তা বোঝা যাচ্ছে না।

জয়িতা বলল, হাবিববাবু তো ছাড়পত্র দিয়েছেন। চল একটু ঘুরে দেখি।

সুদীপ জয়িতার হাত ধরে উঠল। ওরা যেদিকে হাবিব চলে গিয়েছিল সেইদিকে পা বাড়াল। না, ধারে কাছে কেউ নেই। এবং তখনই কুকুরের ডাক এবং শিস শুনতে পেল ওরা। জয়িতা সুদীপের হাতে চাপ দিতেই সে মুখ ফিরিয়ে দেখল দূরের একটা প্যাসেজ দিয়ে কেউ হাঁটছে। তার হাতের চেনে চারটে কুকুর বাঁধা। ওরা লোকটাকে যেন টেনে নিয়ে চলেছে। সুদীপ বলল, যাক, নেহাতই অ্যালসেশিয়ান! তাহলে এখানে কুকুরও আছে। লেটস গো। ওরা হাঁটতে হাঁটতে জেনারেটারের শব্দ ধরে এগিয়ে গেল কাছাকাছি। এখানে গাছের আড়াল বেশি। জেনারেটার রাখা হয়েছে একান্তে একটি ঘরে। তার দরজা খোলা, আলো জ্বলছে ভেতরে। দরজায় টুল পেতে একটি পাহারাদার বসে আছে চুপচাপ। ধারে কাছে আর কেউ নেই। সুদীপ লক্ষ্য করল ঘরটির পেছনে একটা জানলা আছে। জানলাটাও খোলা।

ওরা আবার লনে ফিরে এল। সুদীপ বোতাম টিপে ঘড়ির আলো জ্বেলে সময় দেখল। তারপর বলল, প্রচুর সময় আছে। চল ঘরে যাই।

ফেরার পথে ওরা দুজন পাহারাদারের দেখা পেল। গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি মানুষ সুনির্বাচিত। ওদের দেখে চারটে কুকুর একসঙ্গে ডেকে উঠল। সুদীপ জয়িতার কোমরে হাত রেখে নিবিড়ভাবে হেঁটে এল নন-এসি কটেজগুলোর সামনে দিয়ে। এবার সেখানেও একজনকে নজরে পড়ল। যাওয়ার সময় লোকটিকে দেখতে পায়নি। এখনও ঘরে ঘরে বাজনা বাজছে, হল্লোড় চলছে। নিজের কটেজে ঢুকে জয়িতা বিছানায় শরীর এলিয়ে বলল, এবার শাড়ি চেঞ্জ করি?

আর একটু বাদে। সুদীপ সোফায় বসে সিগারেট ধরালো।

জয়িতা হাত বাড়াল, আমাকে একটা দে।

সুদীপ মাথা নাড়ল, বাঙালি মেয়ের সিগারেট খেতে নেই।

জয়িতা চেঁচাল, সুদীপ!

সুদীপ প্যাকেটটা ছুঁড়ল, নিজেরে পায়ে দাঁড়াতে শেখ তো। অন্যের প্যাকেট দেখলেই সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে, না? শোন, হাবিবকে নিয়ে আমরা বাগানে পাঁচজনকে দেখতে পেলাম। দিজ গাইজ আর রিয়েল টাফ। কিন্তু এদের সঙ্গে আমস আছে কিনা সেটা বোঝা গেল না। আমাদের প্ল্যানটা মনে আছে তো?

সিগারেট ধরিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে জয়িতা বলল, আছে।

মনে হচ্ছে কোন অসুবিধা হবে না। তুই তো বেশ মেজাজে শুয়ে আছিস, আনন্দ আর কল্যাণের কথা ভাব? পেছনের সিটের নিচে কিভাবে বসে আছে ওরা!

এসবই খেলার অঙ্গ ব্রাদার। নির্বিকার মুখে ধোওয়া ছাড়ল জয়িতা।

তোকে মাঝে মাঝে খুব নিষ্ঠুর মনে হয়।

তাই?

ভগবান তোকে মেয়েলি কোন গুণ দেয়নি।

দিলে কি তোর সঙ্গে প্রেম করতাম?

সুদীপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই স্পিকারটা দেখতে পেল। তার নিচেই সুইচ। সে উঠে ওটা অন করতেই বাজনা শুরু হল। দারুণ গরম বাজনা। সুদীপ জিভে শব্দ করল, বাঃ, এই হল ব্যবস্থা। আমার খুব নাচতে ইচ্ছে করছে! ওয়ার্ম আপ করাই?

পারিস তুই! এখন নাচের কথা ভাবছিস? জয়িতা উঠে দাঁড়াল। তারপর ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো বের করে আলাদা করল। দুজনের কাছে দুটো ভাগ থাকবে। সীতা রায় যখন টের পাবে তাদের কিছু হারিয়েছে তখন বেশ দেরি হয়ে যাবে। পাঁচভরি সোনার হার চুরি করার সময় অবশ্য একটা অপরাধবোধ কাজ করেছিল জয়িতার মনে। কিন্তু এখন সেটা মরে গেছে অজান্তেই।

নিজের জিনিসগুলো কাছে রেখে সে সুদীপকে বলল, এখন কি করবি?

সুদীপ বলল, একবার ককটেল রুমে যাব। মনে হচ্ছে জায়গাটা ইন্টারেস্টিং হবে। ঠিক দেড়ঘণ্টা পরে আমরা কাজ শুরু করব। তুই ততক্ষণ রেস্ট নে। এখান থেকে বেরিয়ে একটু পরে জেনারেটাবের কাছে পৌঁছাবি। যদি লোকটাকে অ্যাভয়েভ না করতে পারিস তাহলে জানলাটাকে ব্যবহাব করবি। তারপর দৌড়ে যাবি রিসেপশনের দিকে। অন্ধকার হয়ে গেলেই আমি যা করার কবব। গুড লাক! আমি এগোচ্ছি।

জয়িতা ডাকল, সুদীপ?

সুদীপ ঘুরে দাঁড়াল, কি?

জয়িতা মাথা নাড়ল, না, থাক।

কি বলবি বল্ না?

আমি তোর সঙ্গে যাব? একা থাকতে ইচ্ছে করছে না।

সুদীপ কিছু চিন্তা করল। তারপর হেসে বলল, ভয় পাচ্ছিস?

না, ভয় নয়। জাস্ট একা থাকতে চাইছি না। জানি না কি হবে আজকে, কিন্তু কিছুক্ষণ তো একসঙ্গে থাকি। জয়িতা স্পষ্ট চোখে তাকাল।

ও কে! চল্।

ওরা দুজন প্রস্তুত হয়েই ঘর থেকে বের হল। এবার উলটোদিকে যাত্রা। সেখান থেকে উল্লাস ছিটকে আসছে বাতাসে। ওরা একটি আলোকিত দরজা দেখতে পেল। কাছাকাছি যেতেই একটি সুবেশ মানুষ এগিয়ে এসে হাত বাড়াল। সুদীপ তাকে কটেজের চাবিটা দেখাতেই লোকটি ঝুঁকে হেসে বলল, গুড ইভনিং স্যার। ইউ আর ওয়েলকাম ইন দিস প্যারাডাইস।

ককটেল রুমের দরজা খুলে ঢুকন্স ওরা।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার