আদিম অন্ধকারে অর্জুন (২০১৩)
অর্জুন সমগ্র ৬ – সমরেশ মজুমদার

কুলদীপ সিং-এর সঙ্গে অর্জুনের পরিচয় হয়েছিল একটু অদ্ভুতভাবে। গয়েরকাটা হয়ে নাথুয়াতে যাচ্ছিল সে তার বাইকে চেপে। নাথুয়া থেকে চিঠি লিখেছিলেন দিবাকরবাবু। জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলে পড়ার সময় যেসব শিক্ষক খুব ছাত্রপ্রিয় ছিলেন দিবাকরবাবু তাঁদের একজন। বিয়ে-থা করেননি। স্কুলের পাশেই একটা ঘর ভাড়া করে একাই থাকতেন। অর্জুন ওঁকে কখনও গম্ভীর মুখে দেখেনি। অবসর নেওয়ার পর তিনি কোথায় চলে গিয়েছেন সেই খবর জানা ছিল না। তার অনেক আগেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছিল সে। এই দিবাকরবাবুর চিঠি এসেছিল তার নামে, স্কুলের ঠিকানায়। স্কুলের দারোয়ান সেটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। চিঠিতে দিবাকরবাবু লিখেছেন, এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছোবে কি না জানি না। তোমার কথা বিভিন্ন পত্রিকায় পড়ি। সবাইকে যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা বড় চাকুরে হতেই হবে, তার কী মানে আছে? তুমি তো তার থেকে বহু যোজন দূরের পেশা বেছে নিয়েছ। তাই মনে হল, তোমাকে দরকার। ধরে নাও, ছাই নিয়ে বসে আছি, তুমি যদি তা থেকে অমূল্যরতন পেতে পারো তা হলে তার কৃতিত্ব তোমার। গয়েরকাটা হয়ে খুঁটিমারির জঙ্গল পেরিয়ে নাথুয়াতে এসে নাম বললেই যে-কেউ আমার আস্তানা দেখিয়ে দেবে। আমি বিখ্যাত ডায়না নদীর পাশেই থাকি। আশীর্বাদ নিয়ো।

ফরসা, বেশ রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটির চিঠি পড়ে অর্জুন বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল পরের সকালে। জলপাইগুড়ি থেকে তিস্তা ব্রিজ হয়ে গয়েরকাটায় পৌঁছোতে লেগেছিল একঘণ্টা। চৌমাথার চায়ের দোকানে ওমলেট আর চা খেতে খেতে কানে এল একটা বিশাল হাতির দল আশ্রয় নিয়েছে ওই খুঁটিমারি জঙ্গলে। মাঝে মাঝেই, রাত বাড়লেই তারা ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বনবিভাগের লোকজন পটকা ফাটিয়ে তাদের ভয় পাইয়ে জঙ্গলে ঢুকিয়ে দিলেও মানুষ মশাল জ্বালিয়ে টিনে শব্দ তুলে রাত জাগছে।

চায়ের দাম দেওয়ার সময় অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, নাথুয়ার রাস্তা দিয়ে সবাই যাতায়াত করছে?

কমে গেছে। দিনের আলো ফুরোবার আগেই বাস বন্ধ হয়ে যায়। শুনেছি কয়েকটা হাতি নাকি ঘাপটি মেরে রাস্তার পাশের জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকে। ওদিকে যাবেন নাকি? দোকানদার জিজ্ঞাসা করল।

যাই, হাতি দেখে আসি। অর্জুন বাইকের দিকে এগোল। চায়ের দোকানের মন্তব্য ভেসে এল, হাতি দেখবে! রক্ত গরম তো, ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি।

কথাটার মানে কী দাঁড়াল বলরামদা? কেউ প্রশ্ন করল।

অর্জুন বেরিয়ে এল বাইকে চেপে। লোকে ফাঁদ পেতে ঘুঘু ধরে। তা হলে কথাটা বলা হয় কেন? যে ঘুঘু দেখবে তাকে ফঁদ দেখতে হবে কেন? ধরা যাক, অন্য কেউ ফাঁদ পেতেছিল ঘুঘুর জন্য, সেই ফাঁদে পড়লে মানুষের তো আটকে পড়া অসম্ভব।

বাঁদিকে গয়েরকাটার স্কুল, কিছু ঘরবাড়ি। তারপর লোকালয় শেষ।

দু’পাশে চায়ের বাগান। সেটা শেষ হলে ডানদিকে একটা বড় পার্ক এবং রিসর্ট। কিন্তু সেখানে কোনও মানুষ দেখতে পেল না অর্জুন। তারপর মেছুয়াপুল পেরিয়ে খুঁটিমারির জঙ্গলে ঢুকল সে। সরু পিচের রাস্তা জঙ্গল চিরে চলে গিয়েছে নাথুয়ার দিকে। ঝিঁঝি ডাকছে একটানা। মাঝে মাঝে পাখির ডাক। রাস্তাটা পরিষ্কার। মানুষ দূরের কথা, কোনও গাড়ি বা বাইকও নেই।

রাস্তাটা সামান্য বাঁক নিতেই বাইক থামাল অর্জুন। দুই-আড়াইশো গজ দুরে দুটো হাতি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা শুড় দিয়ে যা তুলতে চাইছে সেটা যে একটা চার চাকার লরি তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। লরিটা উলটে রয়েছে। ছোট হাতি শুড় দিয়ে চাকা ঘোরাবার মজা পাচ্ছে। যেতে হলে ওদের পাশ দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু হাতি দুটো ওখান থেকে সরে না গেলে মৃত্যু অবধারিত।

তবে দুটো হাতি দলছাড়া হয়ে বেশিক্ষণ থাকবে না। নিশ্চয়ই দল কাছাকাছি রয়েছে। এখান থেকে গয়েরকাটায় ফিরে গিয়ে কোনও লাভ নেই। তার মনে হল হাতি দুটো যদি তাকে ধরতে দৌড়ে আসে তা হলে বাইকের গতির সঙ্গে পারবে না। অন্তত ষাট-সত্তর গজের ব্যবধান থাকলে কিছুতেই নয়। সে বাইক নিয়ে এগিয়ে গেল আরও দেড়শো গজ। এখন হাতিদুটো তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভঙ্গিতে সতর্কতা। আচমকা ওরা এগোতে থাকল অর্জুনের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে এক জায়গায় দাঁড়িয়েই প্রচণ্ড জোরে ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়াল। সেই সঙ্গে বাইকের তীব্র হর্ন।

হাতি দুটো দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ছোট হাতিটা দুদ্দাড় করে বাঁদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল। বড় হাতিটা ওর যাওয়াটা দেখল কিন্তু নড়ল না। অর্জুন আরও একটু সাহসী হয়ে দশ গজ এগোল। হাতি তেড়ে এলেই সে বাইক ঘুরিয়ে গয়েরকাটার দিকে ছুটবে। হাতিটা মাথার উপর শুড় তুলতেই আবার ইঞ্জিনের শব্দ বাড়াল। অর্জুন দেখল হাতিটা শুড় নামিয়ে খুব শান্ত ভঙ্গিতে ছোট হাতি যেদিকে গিয়েছিল, সেদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

এখন রাস্তা শুনশান। সোজা যাওয়ার সময় ওই হাতি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ধরতে পারবে না। অর্জুন ধীরে ধীরে এগোল বাইকে চেপে। লরির কাছে আসতেই সে শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা আসছে লরির পেটের ভিতর থেকে। উলটে থাকা লরির ভিতরে থেকে কেউ আওয়াজ করছে। নিশ্চয়ই কেউ আটকে রয়েছে ওখানে। কিন্তু এখানে বাইক থেকে নামা বিপজ্জনক। তবু চলে যেতে পারল না। সে বাইক থামিয়ে চারপাশে তাকাল। না, কোথাও জঙ্গলের গাছ নড়ছে না। সে বাইক থেকে নেমে দ্রুত লরিটার পাশে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভিতরে কেউ আছেন?

সঙ্গে সঙ্গে জবাব ভেসে এল, হাঁ হাঁ, হাম হ্যায়।

মিনিট পাঁচেকের চেষ্টায় একটা বিশাল সর্দারজিকে লরির ভিতর থেকে টেনে বের করল অর্জুন। লোকটার সর্বাঙ্গ থেকে রক্ত ঝরছে। বাইরে বেরিয়ে হাউহাউ কান্নায় ভেঙে পড়ল সর্দারজি। আপনি আমাকে জীবন দিলেন বাবুজি, ওরা আমাকে ঠিক মেরে ফেলত।

অর্জুন দ্রুত চারপাশে তাকাল। লরির নীচে একটানালা থাকায় লোকটা বেঁচে গেল। সে দ্রুত বাইকে উঠে বলল, আপনি পিছনে বসতে পারবেন?

লেংচে লেংচে সর্দারজি কোনওরকমে ব্যাক সিটে উঠে বসল। লোকটার মাথার পাশ থেকে রক্ত ঝরছে। অর্জুন বলল, সাবধানে বসুন। তারপর বাইক চালু করে স্পিড বাড়াল। কিন্তু মাইল খানেক গিয়ে আবার গতি কমিয়ে দাঁড়াতে হল অর্জুনকে। বিশাল চেহারার চারটে বাইসন ডানদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তার উপর দাঁড়াল। পিছনে বসা সর্দারজি কাতর গলায় বলল, মর গিয়া, হাতির থেকে ডেঞ্জারাস এরা।

চুপ করুন। ধমকাল অর্জুন।

ঠিক হ্যায়।

বাইসনগুলো চলে গেলে আবার বাইক চালাল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বাজার এলাকায় পৌঁছে গেল ওরা। দু’পাশের গ্রামে প্রচুর মানুষ থাকেন বলে বোঝা যাচ্ছে। একটা ওষুধের দোকান চোখে পড়তেই অর্জুন বলল, নেমে যান। ওখানে নিশ্চয় ডাক্তার আছেন। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করানো দরকার।

আপ ভি চলিয়ে বাবু।

বাইক দাঁড় করিয়ে অর্জুন বলল, আমি ডাক্তার নই যে আপনার কোনও উপকারে লাগব। তা ছাড়া আমাকে এখনই নাথুয়াতে যেতে হবে।

আপনি নাথুয়ামে থাকেন? সর্দারজি বাইক থেকে নামল।

না। ওখানে আমার স্কুলের মাস্টারমশাই আছেন! আমি জলপাইগুড়িতে থাকি। যান। অর্জুন বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল।

এই লোকটা খুবই ভাগ্যবান। ড্রাইভারের কেবিনে ও একাই ছিল। কী করে দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল তা জিজ্ঞাসা করার সময় পাওয়া যায়নি। লোকটার অবস্থা কথা বলার মতো ছিল না। তবে লরিতে অন্য কোনও লোক থাকলে সর্দারজি অবশ্যই তার কথা বলত।

*

দিবাকরবাবুকে খুঁজতেই হল না। নাথুয়াতে পৌঁছে ওঁর নাম বলতেই কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এলেন, মাস্টারমশাইয়ের কাছে যাবেন? সোজা চলে যান। নদীর ধার দিয়ে কিছুটা গেলেই একটা কাঠের বাড়ি দেখতে পাবেন। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হবে না, ওই বাড়ির পাশের বাগানে মাস্টারমশাই এখন ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। গেলেই দেখতে পাবেন।

তাই দেখল অর্জুন। গোটা ছয়েক ছেলেমেয়েকে নোট দিচ্ছেন মাস্টারমশাই। এখন তার চোখ বন্ধ, ছাত্রছাত্রীরা লিখে নিচ্ছে। ওঁর এই ভঙ্গি অর্জুনের খুব চেনা। ক্লাসে নোট দেওয়ার সময় মাস্টারমশাইয়ের ভঙ্গি এইরকমই থাকত।

অর্জুন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। পড়ানো হয়ে যাক, তারপর কাছে যাবে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে মাস্টারমশাই আরও রোগা হয়ে গিয়েছেন। চুল সম্পূর্ণ সাদা হয়েছে। মিনিট দশেক বাইকের উপর বসে থাকল অর্জুন। উলটোদিকে নদীর বুকে এখন শুকনো নুড়ি-পাথর। দূরে একটি শীর্ণ জলের ধারা। এই চওড়া নদীর ওপাশে জঙ্গল এবং পাহাড়। অর্জুন অনুমান করল ওটা ভুটান। বর্ষার সময় নিশ্চয়ই ভয়ংকর হয়ে ওঠে নদী। মাস্টারমশাই যে কাঠের বাড়িতে আছেন, সেটা কয়েকটা খুঁটির উপরে কিন্তু জল নিশ্চয়ই নদী ছেড়ে কাঠের সিঁড়ি পর্যন্ত উঠে যায়। তবে জায়গা খুব সুন্দর, চারধারে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। চাকরিজীবন জলপাইগুড়ি শহরে কাটিয়ে এই নির্জনে কেন চলে এলেন দিবাকর স্যার? আর এসে সেই চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে বাক্যটিকে সত্যি প্রমাণ করছেন?

একটু পরে পড়ানো শেষ হল। ছেলেমেয়েরা বাগান থেকে বেরিয়ে গঞ্জের দিকে যখন হাঁটতে লাগল তখন অর্জুন দেখল মাস্টারমশাই ফুলের গাছ থেকে শুকনো পাতা পরিষ্কার করছেন।

বাইক থেকে নেমে সোজা বাগানে ঢুকে প্রণাম করতেই মাস্টারমশাই ঘুরে দাঁড়ালেন, কে? কে তুই? তারপরেই তাঁর মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল, আরে! অর্জুন! তুমি কখন এলে! বাঃ, বেশ বড়সড় চেহারা হয়ে গেছে তোমার।

আপনি আমাকে অনেক বছর পর দেখলেন স্যার।

তা বটে। বাইকটার দিকে তাকালেন তিনি, ওকী! তুমি বাইকে চেপে এলে নাকি! সর্বনাশ। পথে কোনও বিপদ হয়নি তো?

বিপদ হবে কেন? অর্জুন অবাক হওয়ার ভান করল।

এই যে খুঁটিমারার জঙ্গল যা পার হয়ে তুমি এলে, বাস ছাড়া লোকে যাতায়াত করে না। তাও দিনে দিনে। বুনো হাতিতে ভরে গেছে। ওদের মধ্যে কিছু হাতি ভয়ংকর বদমায়েশি করছে। কয়েকজনকে মেরেও ফেলেছে তারা। ইস। তোমাকে আমার সাবধান করে দেওয়া উচিত ছিল। চিঠি পেয়ে তুমি কিছু লিখলে নিশ্চয়ই খবরটা দিতাম। এই বাইকে আসবে আর আসতে সময় নেবে না তা ভাবিনি। চলো, ভেতরে চলো। অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে কাঠের সিঁড়ির দিকে এগোলেন মাস্টারমশাই। এই স্পর্শ বেশ ভাল লাগল অর্জুনের।

দোতলায় দুটি ঘর। চিলতে বারান্দা। সেখানে দুটি চেয়ার পাতা আছে। তার একটায় বসলেন মাস্টারমশাই অন্যটিতে অর্জুনকে বসতে ইশারা করলেন।

এখন উপর থেকে বিশাল জলশূন্য নদীটাকে দেখে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, বর্ষার সময় জলে ভরে যায় না?

সেটাই তো স্বাভাবিক। মাস্টারমশাই বললেন।

জায়গাটা খুব সুন্দর।

তাই তো এখানে আছি। অনেক কাল শহরে থেকে মন বলল, চলো, বাকি জীবনটা প্রকৃতির মধ্যে থাকি, চলে এলাম এখানে। চুপচাপ বসে থাকি না ছেলেমেয়েগুলো আসে, ওদের পড়াতেও ভাল লাগে। আজ ছুটির দিন বলে ওদের এই সময় দেখতে পেলে, নইলে ওরা আসে ভোর ছটায়। আটটায় ফিরে যায়। হঠাৎ খেয়াল হল মাস্টারমশাইয়ের, আমি শুধু কথাই বলছি, তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো। আমি আজকাল নিরামিষ খাই, তোমার অসুবিধা হবে না তো?

স্যার। এখন পৃথিবীর ষাট ভাগ মানুষ নিরামিষ খায়। যেসব প্রাণী মাংস খায় তাদের সংখ্যা খুব কমে গেছে, অনেকেই বিলুপ্ত। অর্জুন বলল, কিন্তু

আমার খাওয়া নিয়ে আপনি ব্যস্ত হবেন না।

মোটেই ব্যস্ত হচ্ছি না। আমার একটি রাইস কুকার আছে। তাতে চাল আলু আর কাপড়ে ডাল বেঁধে জল দিয়ে বসিয়ে দিলে মিনিট কুড়ির মধ্যে চমৎকার খাবার তৈরি হয়ে যায়। খাওয়ার সময় একটু ঘি অথবা মাখন মাখলে তো কথাই নেই। রাইস কুকারে দু’জনের রান্না দিব্যি হয়ে যায়। বসো তুমি। মাস্টারমশাই ভিতরে যেতে যেতে আবার দাঁড়ালেন, তুমি এই মেনুতে কী ধরনের ভাত পছন্দ করো? ঝরঝরে না একটু নরম?

হেসে ফেলল অর্জুন, আপনার যা পছন্দ–।

*

মিনিট দশেক পরে ফিরে এলেন মাস্টারমশাই, তুমি স্নান করবে?

না স্যার। করে এসেছি।

খুব ভাল লাগছে। অনেকদিন বাদে দোকলা খাব।

আপনি তো স্বেচ্ছায় এই জীবন বেছে নিয়েছেন।

ঠিক। তবে মাঝে মাঝে অন্যরকম হলে ভাল লাগে, এটাও তো ঠিক।

এখানে বন্যজন্তুরা আসে না?

মাঝে মাঝে আসে। ওই উলটোদিকের ভূটানের পাহাড় জঙ্গল থেকে নেমে ওদিকের নদীর জল খায়। জ্যোৎস্নারাত্রে ওদের এতদূর থেকে দেখেও চিনতে অসুবিধা হয় না। আচ্ছা অর্জুন, তুমি তো কৌতূহল দেখাচ্ছ না?

কী ব্যাপারে স্যার?

আমি লিখেছিলাম, ছাই নিয়ে বসে আছি, তুমি তার মধ্যে থেকে যদি অমূল্যরতন খুঁজে বের করতে পারো তা হলে তার কৃতিত্ব তোমার। তা তুমি ও ব্যাপারে তো কথা বলছ না!

স্যার, অমূল্যরতন কী তা তো জানি না, তবে চিঠি পড়ে আপনাকে দেখার আগ্রহ হয়েছিল বলেই চলে এসেছি। অর্জুন বলল।

মাস্টারমশাই মাথা ঝাঁকালেন। তারপর বললেন,নদীর ওপাশে যে জঙ্গলটা দেখতে পাচ্ছ, কেমন কালচে অন্ধকারে মাখামাখি হয়ে আছে, ওটা যদিও ভূটানের সম্পত্তি, ভারতের এলাকার বাইরে, কিন্তু যেতে ভিসা লাগে না। ইদানীং ভুটানের পুলিশ ভারতীয়দের কাছ থেকে পরিচয়পত্র দেখতে চায়। কিন্তু সেটা তো অনেকেই দেখাতে পারে, তবু এদিকের মানুষকে ওদিকে যেতে সচরাচর দেখা যায় না।

কেন?

প্রথম কথা ওদিকের জঙ্গল খুব ঘন, অনেক জায়গায় সূর্যের আলো, মাটি দূরের কথা, গাছের মাঝামাঝি পৌঁছোয় না বিশাল পাতার আড়াল থাকায়। তার উপর কাঁটালতার আধিক্য আছে। সবচেয়ে বড় কারণ ওখানে প্রচুর পরিমাণে বন্যজন্তু আনাগোনা করে। বর্ষাকালে তো যাওয়ার কথা ভাবাই যায় না, শীতকালেও চোরাশিকারিরা সাহসী হয় না। তারা ভারতীয় অভয়ারণ্যেই নিরাপদে অভিযান চালায়। মাস্টারমশাই বললেন।

সে কী? আজও সেটা সম্ভব? অর্জুন অবাক হল।

তুমি খবরের কাগজ পড়ো না নাকি? কয়েকদিন আগে চাপড়ামারির জঙ্গলে একটা হাতিকে মেরে তার দাঁত উপড়ে নিয়ে গিয়েছে বলে খবর ছাপা হয়েছিল। আমি এখানে আসার পর ভুটানের জঙ্গলে সেরকম ঘটনা ঘটেছে বলে কানে আসেনি। মাস্টারমশাই বললেন।

অর্জুন বুঝতে পারছিল না মাস্টারমশাই তাকে ভুটানের জঙ্গল-পাহাড়ের কথা বলছেন কেন। তার তো ওখানে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা নেই। সে দেখল মাস্টারমশাই ঘড়ি দেখলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, খেয়ে নেওয়া যাক। রাইস কুকারটা যে টাইমে চালু করা হয় তা শেষ হলে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। ঠান্ডা হলে খেতে ভাল লাগবে না।

*

সাদামাটা খাবার কিন্তু খেতে ভালই লাগল অর্জুনের। খাওয়া শেষ হলে হঠাৎ অনেকটা মেঘ চলে এল আকাশে। চারদিক ছায়া ছায়া হয়ে গেল। বসার ঘরে আরাম করে বসে মাস্টারমশাই বললেন, বছর তিনেক আগের কথা। সময়টা নভেম্বরের শেষ। এই অঞ্চলের শীতটাকে ডেকে নিয়ে এল কয়েকদিনের একটানা বৃষ্টি। নদীর জল আচমকা বেড়ে গেল। পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই নদীর চেহারা বদলে যায়। দু’পাশে জলের স্রোত বইলেও মাঝখানের চর সবে ডুবেছে। এইসময় গৃহবন্দি হয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। ভাবলাম, চুটিয়ে বই পড়ব। কিন্তু তারও উপায় থাকল না, দ্বিতীয় দিনেই বিদ্যুৎ চলে গেল। ঝড়জল হলেই এই অঞ্চলে ওটা স্বাভাবিক ঘটনা। অতএব ভূতের মতো বসে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। বলে হাসলেন মাস্টারমশাই, আচ্ছা অর্জুন, ভূত কি চুপচাপ বসে থাকে? নইলে কথাটা চালু হল কী করে? যাক গে, সারাদিন ঘন ছায়া, বৃষ্টি, আর বিকেল না হতেই অন্ধকার। কিন্তু অসময়ের বৃষ্টি বলে ভরসা ছিল, জল এই বাড়ি পর্যন্ত উঠে আসবে না। ইলেকট্রিক নেই, রাইস কুকার অচল বলে ভাবলাম চিড়ে আর দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব। তখন রাত আটটা বাজে। ঘনঘন বাজ পড়ছে। আকাশের অনেকটাই চিরে ফেলছে বিদ্যুৎ। তারপর এক মুহূর্তের জন্যে নদীটাকে স্পষ্ট করে আবার অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। এইসময় আর্তনাদটা কানে এল। মৃত্যুর মুখে পৌঁছে যাওয়া মানুষ আতঙ্কে ওই চিৎকার করতে পারে। টর্চ নিয়ে বারান্দায় এসে নীচে আলো ফেলতেই দেখলাম নদীর পাড়ে একটা শরীর মাটিতে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। মনে হচ্ছিল মানুষটার হাত নড়ছে।

এই মানুষ কোত্থেকে এল বুঝতে পারলাম না। টর্চের আলোয় ওকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না বৃষ্টির কারণে। কিন্তু ওইভাবে পড়ে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই যে মরে যাবে তাতে সন্দেহ ছিল না।

কী করব আমি? ভাবতেই শরীরে কীরকম শক্তি তৈরি হল। মানুষটা আমার বাড়ির সামনে পড়ে থেকে মরে যাবে আর আমি নিরাপদে শুয়ে থাকব, এটা হতে পারে না। টর্চ সিঁড়ির কাছে জ্বালিয়ে রেখে নীচে নেমে গেলাম। তারপর লোকটার কাছে পৌঁছোবার আগে ভিজে চুপসে কঁপতে লাগলাম ঠান্ডায়। লোকটা আমারই মতো রোগা, মুখে দাড়ির জঙ্গল, পরনে হাফপ্যান্ট আর ময়লাটে শার্ট, বাঁ কাধ থেকে একটা স্ট্র্যাপ ডান কোমরে নেমে এসেছে চামড়ার ব্যাগের মুখে। লোকটাকে কঁকালাম, ডাকলাম কিন্তু কোনও হুঁশ নেই ওর। বিদ্যুৎ চমকালে পৃথিবী যখন সাদা তখন মনে হচ্ছিল লোকটা এইমাত্র মরে যাবে। শেষপর্যন্ত আমি ওকে কোনওমতে নিয়ে এলাম বাগানের ভিতর, ওকে সিঁড়ির কাছে রেখে কিছুক্ষণ হাঁফালাম। যথেষ্ট রোগা শরীর তবু ওকে উপরে তুলতে হিমসিম খেয়ে গিয়েছিলাম। এই ঘরে একটা মাদুর পেতে ওকে শুইয়ে দিলাম। ভেজা জামা-প্যান্ট খুলে একটা কাপড় জড়িয়ে দিলাম শরীরে। হারিকেনের আলোয় দেখলাম ওর হাত-পা এবং কাঁধ থেকে রক্ত ঝরছে। আমার ফার্স্ট এইড বক্স এনে সেগুলোকে ম্যানেজ করার। চেষ্টা করলাম। নাথুয়াতে ডাক্তার আছেন। কিন্তু দুর্যোগের রাতে তাদের কাছে পৌঁছোতেই পারব না। আমার কাছে কিছু হোমিওপ্যাথির ওষুধ ছিল। চোট পেয়ে রক্তপাত হয়েছে দেখে ওর মুখে আর্নিকার গুলি দিতেই সেটা জিভ দিয়ে টেনে নিল। কিছুক্ষণ উঃ, আঃ করে শেষপর্যন্ত চোখ বন্ধ করল। নাড়ি টিপে দেখলাম সেটা বন্ধ হয়নি।

রাতে আর খাইনি। মাঝে মাঝেই এই ঘরে এসে দেখে যাচ্ছিলাম। লোকটা একইভাবে পড়ে আছে। ভোর তিনটের সময় চোখ খুলল। পরিষ্কার গলায় বলল, আমি এখন কোথায়! কাউকে প্রশ্ন নয়, নিজের মনেই বলা।

আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। একাই থাকি। আপনি আমার ঘরে। আপনার কোনও চিন্তা নেই। ঘুমিয়ে পড়ুন। কথাগুলো শুনে চোখ বন্ধ করল সে।

সকাল আটটার পর ঘুম ভাঙলে উঠে বসার চেষ্টা করল। অত বেলাতেও সূর্য ওঠেনি। অন্তত আলো দেখা যায়নি। বৃষ্টি সমানে পড়ছে। নদীর মাঝখানে এখন প্রায় কোমর জল।

কপালে হাত দিয়ে বুঝলাম লোকটার বেশ জ্বর। এখন আর হোমিওপ্যাথি ওষুধে কাজ হবে বলে মনে হল না। ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওই হাওয়া আর বৃষ্টিতে কিছুদূর গিয়ে বুঝলাম যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি ভিজে ডাক্তারের কাছে পৌঁছোলেও তিনি ওইভাবে আসবেন কেন? ফিরে এলাম। লোকটা বসে ছিল একইভাবে। চা করলাম, সঙ্গে বিস্কুট। তারপর একটা ক্রোসিন ট্যাবলেট লোকটাকে খাইয়ে দিলাম চা-বিস্কুটের সঙ্গে। খেয়ে সে বাথরুম যেতে চাইল। অর্থাৎ এখন অনেকটা সচেতন হয়েছে। কিন্তু বাথরুম থেকে ফিরে আবার শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল লোকটা।

বেলা বারোটা নাগাদ আমি যখন ভাবছি স্টোভেই ভাতেভাত বসিয়ে দেব তখন লোকটার ঘুম ভাঙল। জিজ্ঞাসা করলাম, জ্বর কেমন?

সে মাথা নাড়ল। অবশ্য তার অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না।

লোকটা উঠে বসতেই জিজ্ঞাসা করলাম, কী নাম আপনার?

স্টিফেন। স্টিফেন অ্যালফোর্ড। আমি বাঙালি।

এই বৃষ্টির মধ্যে এখানে কীভাবে এলেন?

প্রাণ বাঁচাতে নদী পার হয়ে এসেছি। খুব দুর্বল কণ্ঠস্বর লোকটার।

আপনি ভুটানের জঙ্গল থেকে এসেছেন? আমি অবাক।

মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বলল সে।

আপনার বাড়ি কোথায়?

থিম্পুতে আমার জন্ম। আমার মা ভুটানি আর বাবা বাঙালি। দুজনেই খ্রিস্টান। পনেরো বছর বয়সে ওরা একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। আমার এখন চল্লিশ বছর বয়স।

কিন্তু থিম্পু তো এখান থেকে অনেক, অনেক দূরে।

আমি এই এলাকায় গত দশ বছর আছি। ওই নদী থেকে দু’দিনের পথ গেলে একটা গ্রাম আছে। গ্রামটার নাম টুংচি। ওখানেই থাকতাম। আঃ। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আমি শুয়ে পড়ি। স্টিফেন অ্যালফোর্ড আবার শুয়ে পড়ল।

বিকেলের আগেই বৃষ্টি ধরতেই আমি নাথুয়ার সবচেয়ে ভাল ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এলাম। স্টিফেন অ্যালফোর্ড তখনও ঘুমোচ্ছে। তাকে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, আমি ভাল বোধ করছি না। ওকে এখনই জলপাইগুড়ির হাসপাতালে নিয়ে যান। মনে হচ্ছে ওর একটা মাইন্ড হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া এই যে ক্ষত হয়েছে, তা কোনও জন্তুর দাঁতের আঘাতেই হওয়া সম্ভব। কোথায় পেলেন ওকে?

পুরো ঘটনাটা বললাম ওঁকে। ডাক্তার বললেন, ভুটানের নাগরিক হলে আর একটা সমস্যা হবে। থানায় জানানো দরকার। ও বিদেশি। কিন্তু এইরকম আবহাওয়ায় আর এখন যাওয়ার দরকার নেই। এইসময় জলপাইগুড়িতে নিয়ে যাওয়ার গাড়িও পাবেন না। কাল সকালে প্রথমে থানায় যাবেন। ওরা সামচিতে ভুটান সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে।

সামচি কোথায়?

বেশি দূরে নয়। গয়েরকাটা থেকে বানারহাট হয়ে যেতে বড়জোর ঘণ্টাখানেক লাগবে। ওটাই ভুটানের সবচেয়ে কাছের শহর। আমি একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে যাচ্ছি। আর দুটো ট্যাবলেট, একটা এখন খাওয়াবেন, অন্যটা রাতে। ডাক্তার তার কাজ শেষ করে চলে গেলেন।

রাতে স্টিফেন আর একবার বাথরুমে গেল। দেখলাম পায়ে জোর এসেছে। ফিরে এসে আবার বসে পড়ল।

জিজ্ঞাসা করলাম, আমি রুটি বানাতে পারি না বলে ভাত ভাই। খাবেন? মুখে যতই দাড়ির জঙ্গল থাক, স্টিফেন হাসল, হয়তো আমার জন্য ঈশ্বর একটু করুণা রেখেছিলেন, তাই আপনার কাছে আশ্রয় পেয়েছি। দেখুন, আমি খুবই অসুস্থ। জানি না ক’দিন বাঁচব।

আপনাকে কালই ভুটান সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। এখানকার পুলিশকে বললেই তারা সাহায্য করবে। ওরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে আপনি নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবেন।

স্টিফেন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল, আপনি দেখছি আমাকে মেরে ফেলতে চান। ভুটান গভর্নমেন্টের কয়েকজন পুলিশ অফিসার আমাকে বছর খানেক ধরে খুঁজছে। যার কাছেই পাঠানো হোক, ওরা খবর পেয়ে যাবে।

কেন খুঁজছে? আপনার অপরাধ কী? জিজ্ঞাসা করলাম।

একটা ম্যাপের জন্যে। যেটা পেলে ওরা–। থেমে গেল স্টিফেন। তারপর বলল, আমি শুয়ে পড়ি।

সকালে থানায় গেলাম। পুলিশকে সব বললাম। সঙ্গে ডাক্তারবাবুও ছিলেন। লোকাল পুলিশ জলপাইগুড়ির এসপি-কে খবর পাঠাল।

ফিরে এসে দেখলাম স্টিফেনের শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ হয়েছে। কিছুই খেতে চাইছে না। দুপুরবেলায় বলল, তার ব্যাগটা যেন আমি যত্ন করে রেখে দিই। কখনওই হাতছাড়া না করি। আমি ব্যাগটাকে রেখে দিলাম।

তিনটে নাগাদ ভুটানের গাড়ি এল। স্টিফেন তখন বেশ কাহিল। বললাম, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে লোক এসেছে।

তার ঠোঁটে হাসি ফুটল, তা হলে বেঁচে যেতে পারি। যদি বেঁচে ফিরে আসি তা হলে ব্যাগটা ফেরত নেব।

নিয়ে যাওয়ার আগে স্টিফেন কীভাবে আমার কাছে এল তা ভুটানিরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিল। ব্যাগটা আমি যত্ন করে তুলে রেখে দিলাম। ভুটানি অফিসার জিজ্ঞাসা করেনি স্টিফেনের সঙ্গে জিনিসপত্র আছে কিনা তাই উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।

সাতদিন পরে লোকাল থানা থেকে ওসি এলেন। খবর এসেছে স্টিফেন মারা গিয়েছে। দ্বিতীয়বারের আঘাত ওর হার্ট সহ্য করতে পারেনি। ভুটান পুলিশ জানতে চেয়েছে স্টিফেনের সঙ্গে কোনও মালপত্র ছিল কি না, থাকলে ওরা সেটা ফেরত চায়।

একবার মনে হল ব্যাগটা ফেরত দিয়ে দিই। তারপর স্টিফেনের ম্লান মুখ মনে পড়ে গেল। তার শেষ ইচ্ছে ছিল ওর ব্যাগটা যেন আমি কাউকে না দিই। জীবনে সবসময় চেষ্টা করেছি মিথ্যে না বলার। কিন্তু একজন মৃত মানুষের জন্যে অসত্য বললাম, না, সে কিছুই নিয়ে আসেনি। সঙ্গে থাকলে তা নদীর জলে ভেসে যাওয়াই স্বাভাবিক।

ক্রমশ স্টিফেনকে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝেই দু’-একজন ভুটানিকে এদিকে দেখা যাচ্ছিল। ভারতবর্ষে ভুটানিদের যাওয়া-আসার কোনও আইনি বাধা নেই। কিন্তু নাথুয়ার মতো জায়গায় কখনওই তাদের দেখা যায়নি। সে সময় আমি একটি পথের কুকুরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। দু’বেলা খাওয়ার বদলে যে বাড়িটাকে নিজের করে নিয়েছিল। আমার অনুমতি ছাড়া কেউ বাড়িতে ঢুকতে পেত না। কিন্তু ছাত্রদের সে কিছু বলত না। কিন্তু একরাত্রে সে যেন পাগল হয়ে গেল। বুঝলাম কেউ আমার বাড়িতে ঢুকেছে। তারপর কুকুরটার আর্ত চিৎকার শুনতে পেয়ে টর্চ নিয়ে দৌড়ে যেতে দেখলাম একটা লোক ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কুকুরটার গলায় ছুরি বসিয়ে দিয়েছে লোকটা। শরীরে প্রাণ নেই। ভোর হতেই থানায় গেলাম। মরার আগে লোকটার পায়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল কুকুর। রক্ত পড়েছিল রাস্তায়। পুলিশ লোকটাকে ধরতে পেরেছিল। কিন্তু ওর মুখ থেকে একটাও কথা বের করতে পারেনি। লোকটা হিন্দিও জানে না। ভুটান গভর্নমেন্টের হাতে তাকে তুলে দেওয়া হয়েছিল। মাস্টারমশাই থামলেন। অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাড়িতে ভুটানি লোকটা কুকুর আছে জানা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে এসেছিল, তার মানে স্টিফেনের ব্যাগটা ওদের কাছে বেশ মূল্যবান বলে মনে হচ্ছে।

এ ছাড়া চুরি করার মতো কিছু তো এই বাড়িতে নেই। কুকুরের কামড়ে লোকটা ভয়ংকর আহত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু কথা বলার অবস্থায় ছিল। তবু মুখ খোলেনি। তখন আমার কৌতূহল হল। আমি স্টিফেনের ব্যাগটা খুললাম। দুটো জামা, একটা প্যান্ট ছাড়া মাঝারি সাইজের চামড়ার চেন টানা ব্যাগ দেখতে পেলাম। সেটা খুলতেই একটা লাল রঙের ডায়েরি, কলম আর অতি বিবর্ণ ম্যাপ পেয়ে গেলাম। ডায়েরি ইংরেজিতে লেখা। হাতের লেখা ভাল। কিন্তু কোনও বাক্যেই ক্রিয়াপদ নেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল ঘুরিয়ে কিছু বলতে চেয়েছে। যেমন লং ওয়ে ইন সান’স ওয়ে। প্রথমে মানেই বুঝতে পারিনি। একদিন পরে মনে হল স্টিফেন লিখতে চেয়েছে সূর্যের পথে বহুদূরে যেতে হবে। তারপরেই খেয়াল হল, সূর্যের পথ তো পুব থেকে পশ্চিমে। অর্থাৎ স্টিফেন যেখানে ছিল সেখান থেকে অনেক দূরের পশ্চিমে যেতে হবে। কেন যাবে, গিয়ে কী পাওয়া যাবে তা ডায়েরিতে লেখা নেই। শেষ লাইনটা হল, ইফ আই নো মোর, প্রে ফর এ অনেস্ট ম্যান। আমি মরে গেলে একজন সৎ মানুষের জন্যে প্রার্থনা করছি। কেন? এই ডায়েরি আর ম্যাপটা সেই সৎ মানুষ নিয়ে কী করবে? আমি আর ঝুঁকি না নিয়ে চামড়ার ব্যাগ, বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে এই বাড়ির এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখলাম যে কারও পক্ষে তার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হবে না।

অর্জুন বলল, মনে হচ্ছে স্টিফেন কোনও কিছুর সন্ধানে ছিল!

হ্যাঁ। তাই তো তোমাকে লিখেছি, ছাই নিয়ে বসে আছি, তুমি যদি তা থেকে অমূল্যরতন খুঁজে বের করতে পারো তা হলে কৃতিত্ব তোমার। এতদিন ধরে তুমি অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছ, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাও।

মাস্টারমশাই অর্জুনকে নিয়ে বাগানে নেমে এলেন। ফুলগাছগুলোর শেষে একটা মাঝারি উচ্চতার কাঁঠালগাছ দাঁড়িয়ে আছে। প্রচুর পাতা তার ডালে ডালে। মাস্টারমশাই বললেন, গাছটার ওপরের দিকে একটা বড় গর্ত আছে। ব্যাগটাকে প্লাস্টিকে মুড়ে ওই গর্তে রেখেছি। দ্যাখো তো, হাত যায় কিনা।

অর্জুন মুখ তুলে গর্তটাকে দেখল। ডালপাতার আড়াল থাকায় গাছের একেবারে গায়ে না এলে গর্তটাকে চোখেই পড়বে না। বাগানের ভেতর থেকে দুটো ইট নিয়ে এসে কী মনে হতে পড়ে থাকা একটা শুকনো ডাল তুলে নিয়ে ইটের ওপর উঠতেই গর্তের অনেকটা কাছকাছি চলে এল। মাস্টারমশাই বললেন, যখন রেখেছিলম তখন গর্ত অনেক নীচে ছিল। গাছটা বেশ লম্বা হয়ে গেছে।

অর্জুন সরু ডালটা গর্তের মধ্যে ঢোকাবার চেষ্টা করল যাতে খুঁচিয়ে ব্যাগটার অংশ বাইরে বের করে নিয়ে আসতে পারে। দ্বিতীয়বার খোঁচাতেই হিস হিস শব্দ কানে এল। তারপর গর্ত থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে একটা সাপ ফণা তুলে তার মুখ দোলাল। অর্জুন দ্রুত সরে এসেছিল পেছনে। মাস্টারমশাই বললেন, একী! ইনি কবে থেকে ওখানে আশ্রয় নিয়েছেন?

কুচকুচে কালো সাপ সড়সড় করে নেমে পড়ল ফণা গুটিয়ে। তারপর দ্রুত চলে গেল বাগানের ভেতর দিয়ে সীমানার বাইরে।

এই ব্যাটা কেউটে। আমার বাগানে কেউটে আছে তা আমিই জানতাম না। কিন্তু তুমি কি এরকম কিছু অনুমান করেছিলে বলে সরু ডালটা ঢুকিয়েছিলে?

না স্যার। হঠাৎ মনে হল হাত না ঢুকিয়ে কাঠি ঢুকিয়ে দেখি। কেন মনে হল তা জানি না।

একেই বলে নিজের অজান্তে বিপদ আশঙ্কা করে সতর্ক হওয়া। তুমি হাত ঢোকালে যে কী হত আমি ভাবতেই পারছি না। ওটা ভয়ংকর বিষধর সাপ। যাক, বাগানে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াতে হবে। তুমি আর হাত ঢুকিয়ো না, ওটার জোড়া ভেতরে আছে কি না কে জানে।

অর্জুন আবার সরু ডালটা ভেতরে ঢোকাল। খানিকক্ষণ খোঁচাখুঁচি করার পর বড় ব্যাগটার স্ট্র্যাপ বাইরে বেরিয়ে এল। সেটা ধরে টেনে নীচে নামিয়ে আনল অর্জুন।

মাস্টারমশাই বললেন, ওটা খোলো, ভেতরে চামড়ার ব্যাগ দেখতে পাবে।

দশ ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি চামড়ার ব্যাগের চেন খুলে একটা ছোট লাল রঙের ডায়েরি এবং একটা খাম বের করল অর্জুন।

মাস্টারমশাই বললেন, বড় ব্যাগটাকে গর্তেই ঢুকিয়ে রেখে ওটা নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে এসো।

.

দোতলার বসার ঘরে বসে ডায়েরিতে চোখ রাখল অর্জুন। ঠিকই, কোনও বাক্যেই ক্রিয়াপদ নেই। বাক্যগুলো পড়লে মনে হয় অন্য কোনও অর্থ আছে। মাঝে মাঝে রোমানে অচেনা শব্দ লিখেছে স্টিফেন। সেটা কোন ভাষার শব্দ তা অর্জুন জানে না। খাম থেকে খুব পুরনো ভাঁজ করা কাগজ বের করে। সন্তর্পণে খুলল সে। ভাঁজগুলো প্রায় ছিঁড়ে এসেছে। অবশ্যই এটা ম্যাপ। পাহাড়, জঙ্গল, নদী, আঁকা রয়েছে যা ভেদ করে রেখা চলে গেছে। রেখা শুরু হয়েছে যেখান থেকে সেখানে ইংরেজিতে ছোট্ট করে লেখা টুংচি। মাঝে মাঝে ভূটানি নাম রয়েছে যেগুলো অবশ্যই কোনও জায়গার নাম। অর্জুন কাগজ ভাঁজ করে খামে ঢুকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, স্যর। আপনি যদি অনুমতি দেন তা হলে আমি এই ডায়েরি আর ম্যাপ নিয়ে গিয়ে রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু যেহেতু আমি ভুটানি জানি না তাই শেষপর্যন্ত…। কথা শেষ না করে ঠোঁট কামড়াল অর্জুন।

মাস্টারমশাই মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। কিন্তু কোনও ভুটানিকে এসব দেখিয়ে না। খবরটা চাপা নাও থাকতে পারে। তুমি নিয়ে যাও, চেষ্টা করো। যদি উদ্ধার করতে না পারে তা হলে ফিরিয়ে দিয়ো।

ব্যাগটাকে হাতে নিয়ে অর্জুন উঠে দাঁড়াল, তা হলে যাই স্যার।

অ্যাঁ। এইসময় যাবে কেন? বিকেল হল বলে। বিকেলের পরে ওই রাস্তায় কেউ যায় না। তুমি বিপদে পড়ে যাবে। রাতটা এখানেই থেকে যাও। মাস্টারমশাই আপত্তি জানালেন।

বাড়িতে বলেছি ফিরে আসব। তাড়াতাড়ি চালালে সন্ধের আগেই গয়েরকাটা পৌঁছে যাব। আপনি চিন্তা করবেন না। মাস্টারমশাইকে প্রণাম করে অর্জুন বেরিয়ে এল। ব্যাগটাকে শার্টের তলায়, প্যান্টের ভেতর খুঁজে দিল সে।

গতি বাড়াচ্ছিল অর্জুন। নাথুয়া বাজার ছাড়িয়ে লোকালয় পেছনে ফেলে সে যখন এগোচ্ছে তখন ওপাশ থেকে গাড়ি, বাস বেশ দ্রুতগতিতে নাথুয়ায় চলে আসছে। আকাশের দিকে তাকাল অর্জুন। বেলা থাকতে থাকতে খুঁটিমারির জঙ্গল পেরিয়ে যেতে অসুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না। এখন দু’পাশে চাষের জমি, আগাছার বন। জঙ্গল শুরু হবে খানিক বাদে। কিন্তু তার আগে অর্জুন পৌঁছে গেল সেই জনপদে যেখানে সে সর্দারজিকে নামিয়ে দিয়েছিল চিকিৎসার জন্যে। সর্দারজি নিশ্চয়ই একটু সুস্থ হয়ে লোক জোগাড় করে তার লরি উদ্ধার করে ফিরে গেছে। আর একটু এগোতেই ছোটখাটো জটলা দেখতে পেল। একটা টেম্পোকে ঘিরে কথা বলছে কয়েকজন লোক এবং তাদের মধ্যে সর্দারজিকে দেখতে পেয়ে বাইক থামাল অর্জুন। লোকটা সেই তখন থেকে এখানেই থেকে গেছে।

অর্জুনকে দেখতে পেয়েই সর্দারজি ছুটে এল মর গিয়া। বলছি ডাবল টাকা দেব কিন্তু ডরপুক যেতে রাজি হচ্ছে না।

টেম্পোতে হেলান দিয়ে যে লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল সে বলল, প্রাণটা তো আমার। টাকার জন্যে সেটা দিতে পারি না। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে, ব্যস, আর ফিরে আসতে পারব না।

সর্দারজি বলল, কিয়া বলেগা বাবু। তখন থেকে দশজনকে রিকোয়েস্ট করেছি কেউ গাড়ি নিয়ে যেতে চাইছে না। এই যে কুলিগুলো, এদের রাজি করিয়েছি। আমার লরিটাকে রাস্তায় তুলে দেবে। পাঁচজন হাজার টাকা ডিম্যান্ড করল, তাই দেব, কিন্তু এরা তো হেঁটে ওখানে যেতে পারবে না। একদম মর গিয়া।

অর্জুন বলল, আপনার উচিত ছিল বাস ধরে নিজের জায়গায় চলে যাওয়া। সেখান থেকে লোকজন জোগাড় করে আর একটা লরিতে স্পটে এসে ওটাকে তোলা। আজ আর হবে না, বাস ধরে বাড়িতে চলে যান, রাত্রে আপনার লরিকে কেউ টাচ করবে না। কাল সকালে এসে নিয়ে যাবেন।

কৌতূহলীদের একজন বলল, লাস্ট বাস বেরিয়ে গেছে। যাবে কী করে?

সর্দারজি চেঁচিয়ে উঠল, আই বাপ! মর গিয়া। আমাকে বাঁচান বাবু। আপনার পেছনে উঠে বসি?

অগত্যা মাথা নাড়ল অর্জুন।

*

ওজন বেড়ে যাওয়ায় বাইকের গতি কমে গেছে। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনার শরীর কেমন আছে?

ডাক্তার বলছিল পা ভাঙতে পারত, ভাঙেনি, বহুত পেইন হচ্ছে। সর্দারজি বলল, কাল সকালে ঠিক হয়ে যাবে।

ওরা জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। পিচের রাস্তায় এখন আলতো ছায়া। দু’পাশের গভীর জঙ্গল কালচে হয়ে আসছে। ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে কান ঝালাপালা করে দেওয়া পাখিদের চিৎকার আর বাঁদরদের ডাল ধরে বাঁদরামি সমানে চলছে। সর্দারজি তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বসে আছে। লোকটা কথা বলছে না। অর্জুন সতর্ক হয়ে বাইক চালাচ্ছিল।

ক্রমশ অর্জুনের মনে হচ্ছিল, সর্দারজির জন্যে না দাঁড়ালে স্বচ্ছন্দে এই জায়গাটা পেরিয়ে যেতে পারত। কিছুক্ষণ পরে রাস্তা বাঁক নিতেই অর্জুন তার বাইক থামিয়ে দিল। পেছন থেকে সর্দারজি জিজ্ঞাসা করল, কিয়া হুয়া?

তাকিয়ে দেখুন। অর্জুন বলল।

ব্যাক সিটে বসেই সর্দারজি মুখ বাড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, মর গিয়া। মেরা লরি খাড়া হো গিয়া?

সোজা হয়নি, পাশ ফিরেছে। বলতে বলতে চারপাশে তাকাল অর্জুন। একেবারে উলটে থাকা লরির নীচ থেকে সর্দারজিকে টেনে বের করে এনেছিল সে। তখন ওর চাকাগুলো আকাশমুখী ছিল। এখন লরি কাত হয়ে আছে। কী করে সম্ভব?

অর্জুন বাইক চালু করল। একেবারে কাছে এসে সর্দারজি চেঁচাতে লাগল, রোখিয়ে বাবু। থোড়াসে ধাক্কা দিজিয়ে, লরি খাড়া হো যায়েগা। বাবু, হামরা সাথ হাত মেলাইয়ে।

কাছাকাছি কোনও জন্তু চোখে পড়ছে না। কিন্তু এখানে পাখির চিৎকার নেই, শুধু একটানা ঝিঁঝি ডেকে চলেছে। অর্জুন বাইক থামাল।

মিনিট তিনেক ধরে দু’জনের চেষ্টাতেও লরিটাকে সোজা করা গেল না। অর্জুন দেখল যেদিকে গেলে লরি সোজা হতে পারে সেদিকে একটা বড় কাঠের গুঁড়ি লরির নীচে ঢুকে আছে। ওটাকে কেটে না সরালে লরি সোজা করা যাবে না। সে বলল, চলিয়ে।

মেরা লরি। কাতর গলায় বলল সর্দারজি। তারপর চিৎকার করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে অবোধ্য ভাষায় নিজের রাগ প্রকাশ করতে লাগল। বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না অর্জুন। হিন্দি বা পাঞ্জাবি যে নয় তা সে বুঝতে পারছিল। অর্জুন বাইকের কাছে ফিরে গিয়ে গলা তুলে ডাকল, চলে আসুন।

বিড়বিড় করতে করতে বাইকে উঠল সর্দারজি।

গয়েরকাটায় পৌঁছোনোর পথে কোনও অসুবিধে হল না। এখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। চৌমাথার দোকানগুলোতে আলো জ্বলছে। বাইক দাঁড় করিয়ে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?

চামুর্চি। সর্দারজি বলল, এখান থেকে গাড়ি পেয়ে যাব।

আপনি ওখানে কতদিন আছেন?

বাবুজি, ওখানেই জন্মেছি আমি। আমি কুলদীপ, গ্যারেজ চালাই।

আমি জলপাইগুড়িতে থাকি। আমার নাম অর্জুন। আচ্ছা, আপনি তখন জঙ্গলে রেগে গিয়ে কী ভাষায় কথা বলছিলেন?

ও হো। হেসে ফেলল কুলদীপ, বাবুজি, চামুর্চি হল ভুটানের বর্ডার। ওপাশেই সামচি। ছেলেবেলা থেকেই আমরা নিজের ভাষার সঙ্গে হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি বলতে যেমন পারি, তেমনই ভুটানিও পড়তে, লিখতে পারি। রাগ হলে, দুঃখ হলে আমার মুখ থেকে ভুটানি বেরিয়ে পড়ে।

অর্জুন কুলদীপকে ভাল করে দেখল। চেহারা বিশাল হলেও মানুষটার মধ্যে এক ধরনের সারল্য রয়েছে তা কথা বললেই বোঝা যায়। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মোবাইল নম্বর বলবেন?

নো বাবুজি, আমি মোবাইল রাখি না। মোবাইল থাকলেই বউ বারবার ফোন করে আমাকে পাগল করে দেবে। আপনি আমার ল্যান্ড লাইনের নাম্বার নিতে পারেন। কুলদীপ নাম্বার দিল।

.

রাত্রে বিছানায় শুয়েও ঘুম আসছিল না অর্জুনের। জীবনে যা ঘটে তার সবকিছুর ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করা যায় না। যাকে কাকতালীয় বলে মনে হয়, তা কি একেবারেই অস্বাভাবিক? নইলে তার তো গর্তে হাত ঢুকিয়ে ব্যাগটাকে বের করার কথা, সে হাত ঢোকাল না কেন? ঢোকালে কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যু অবধারিত ছিল। মাস্টারমশাই যে ডায়েরি আর ম্যাপ দিলেন তার অনেকটাই সে বুঝতে পারেনি ভাষার কারণে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, ওটা ভুটানি ভাষা হলে কোনও ভুটানিকে না দেখানোই উচিত হবে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই কুলদীপকে সে যে ভাষায় গালাগাল দিতে শুনল, তা ভুটানি জানতে পেরে মনে হয়েছিল এমনটা কী করে হয়? এটাও কি এক ধরনের কাকতালীয়?

ঘুম আসছিল না। আলো জ্বেলে ডায়েরিটা বের করল অর্জুন। ক্রিয়াপদ নেই কেন? বক্তব্যকে রহস্যময় করার চেষ্টা? একটু একটু করে দু’পাতা পড়ে যখন মনে হচ্ছিল কিছুটা বোঝা যাচ্ছে তখনই ভুটানি শব্দে ধাক্কা খেল সে।

.

তিনদিন ধরে চেষ্টা করেও না ডায়েরি না ম্যাপের অর্থ বোধগম্য হচ্ছিল না অর্জুনের। প্রচণ্ড অস্বস্তি, যেন দাঁতের যন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকার মতো অনুভূতি হচ্ছিল। এইসময় কুলদীপের কথা মনে পড়ল। একটুও দ্বিধা না করে লোকটার ল্যান্ডলাইনের নাম্বারে ফোন করল সে।

রিসিভার তুলে একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, হাঁ জি।

কুলদীপ আছে?

কৌন?

আমার নাম অর্জুন।

আরে বাপ। আপনি ফোন করেছেন। বহুৎ বহুৎ ধন্যবাদ আপনাকে। বাবুজি, আপনি আমার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আরে এ কুলদীপ, জলদি আও, জলদি।

তারপরেই কুলদীপের গলা কানে এল, হা বাবুজি, বলুন।

কুলদীপ, আপনার সাহায্য আমার দরকার।

এ কী বলছেন বাবুজি। একবার হুকুম করুন।

আমি আপনার কাছে যাচ্ছি। জলপাইগুড়ি থেকে চামুর্চি যেতে খুব বেশি হলে দেড়-পৌনে দুই ঘণ্টা লাগবে। গ্যারাজে থাকবেন। অর্জুন বলল, একটা কথা, আপনি তো পরিষ্কার বাংলা বলেন। তা হলে হিন্দি বলার দরকার কী? ওটা তো আপনার মাতৃভাষা নয়। তাই না?

পাঞ্জাবির মুখে হিন্দি শুনতে চায় সবাই। ঠিক আছে দাদা, আপনার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলব। কুলদীপ বলল।

*

চামুৰ্চিতে পৌঁছোতে একটু দেরি হয়ে গেল। জলপাইগুড়ি থেকে রওনা হয়ে বানারহাট পর্যন্ত অভ্যস্ত গতিতে বাইক চালিয়েছিল অর্জুন কিন্তু রিয়াবাড়ি চা-বাগানের মুখের পিচের রাস্তায় শয়ে শয়ে কর্মী বিক্ষোভ দেখাচ্ছে রাস্তা বন্ধ করে। বাস-ট্রাম দূরের কথা, সাইকেল আরোহীকেও ছাড় দিচ্ছে না তারা। অর্জুন খোঁজ নিয়ে জানল বিক্ষোভের কারণ হল হাতি। এতকাল হাতি এসে খেতের ধান বা বাগানের কলা খেয়ে যেত। তার জন্যে প্রচুর অভিযোগ বাগানের ম্যানেজারের কাছে করেছে মানুষ। বনবিভাগকেও বারংবার জানানো হয়েছিল কিন্তু হাতিদের জব্দ করেনি ওরা। গত রাতে হাতিরা কুলিলাইনে ঢুকে এক বৃদ্ধকে আছাড় মেরেছে, ঘর ভেঙেছে। ম্যানেজার বা বনবিভাগ যদি এর বিহিত না করে তা হলে তারা রাস্তা অবরোধ করে রাখবে।

অর্জুন দেখল পুলিশের লোকজন লোকগুলোকে খুব বোঝাবার চেষ্টা করছে কিন্তু তারা বুঝতে চাইছে না। রাস্তার অবরোধে না সরলে চামুৰ্চিতে যাওয়া যাবে না। এইসময় একটা হইচই শুরু হল। একটু আগের চিৎকারের থেকে এই হইচইয়ের চরিত্র আলাদা। অর্জুন দেখল অবরোধকারীরা পিলপিল করে চা-বাগানের রাস্তায় ছুটে যাচ্ছে। তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে পুলিশদেরও রাস্তায় দেখা গেল না। মুখ ঘুরিয়ে অর্জুন কারণটা বুঝতে পারল। প্রায় ষাট সত্তর গজ দূরে, রাস্তার উলটোদিকের চা-বাগানে বিশাল চেহারার হাতি এসে দাঁড়িয়েছে। তার পঁহ্যাঁত বেশ বড়, দৃষ্টি এদিকে। কিন্তু সে একা নয়, তা দেখতে সময় লাগল না। পিচের রাস্তায় তখন অর্জুন ছাড়া কেউ নেই। আতঙ্কিত মানুষরা চিৎকার করে তাকে রাস্তা ছেড়ে চলে আসতে বলছে। অর্জুন দেখল বড় হাতিটা এবার এদিকে আসার জন্যে পা ফেলছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বাইক চালু করেই গতি বাড়াল। পুলিশ যা পারেনি, হাতি সেই সমস্যার সমাধান করে দিল।

.

কুলদীপকে চামুর্চির মানুষ ভালই চেনে। নাম বলতে মোড়ের মাথায় আড়ামারা লোকগুলো হইহই করে ওর গ্যারাজ দেখিয়ে দিল। মাঝারি সাইজের গ্যারাজ হলেও ভিতরে বাইরে অনেকগুলো গাড়ির কাজ চলছে। অর্জুন লক্ষ করল, বেশিরভাগ গাড়ির নাম্বার প্লেটে ভুটানের নাম্বার। বাইক থেকে নামামাত্র কুলদীপ বেরিয়ে এল হাসিমুখে, আসুন, আসুন, কী সৌভাগ্য আমাদের। বলে চিৎকার করল, বাবা! আসুন।

গ্যারাজের ভেতর থেকে যে বৃদ্ধ পাঞ্জাবি বেরিয়ে এলেন মাথার উপর হাতজোড় করে, তিনি যে যৌবনে বেশ শক্তিশালী ছিলেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কুলদীপের বাবা বললেন, আপনি আমার ছেলের জান বাঁচিয়েছেন, আমরা আপনার কাছে চিরদিন ঋণী হয়ে থাকলাম।

অর্জুন এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধকে প্রণাম করতে চাইলে তিনি সেটা নিতে রাজি হচ্ছিলেন না। অর্জুন বলল, আপনি আমার বাবার মতো। কুলদীপকে আমি বাঁচাইনি। ওর ভাগ্য বাঁচিয়েছে। কিন্তু ওর লরি নিয়ে আসার ব্যবস্থা কি হয়েছে?

কুলদীপের বাবা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। সকাল হতেই একটা ট্রাকে লোক চলে গেছে নিয়ে আসার জন্যে। বসুন বাবু, কী খাবেন বলুন।

অর্জুন বলল, চাচা, এখন কিছু খাব না। কুলদীপের সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা বলার আছে, সেটা আগে বলে নিই, তারপর–।

কুলদীপ মাথা নাড়ল, আপনি কি ঘরে বসবেন?

এখান থেকে সামচি কতদূরে?

বেশি টাইম লাগবে না। বলেই সংশোধন করল, বেশি সময় লাগবে না।

তা হলে চলুন, ওখানেই যাই। জায়গাটা দেখে আসা যাবে। অর্জুন বলল।

অর্জুনের বাইকে বসল কুলদীপ। কয়েক মিনিটের মধ্যে ছোটখাটো পাহাড় দেখতে পেল ওরা। একদিকে ভ্যালি, নদী। তারপর ভারত সীমান্ত শেষ, ভুটানের শুরু। তার চেকপোস্টে গিয়ে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে এল কুলদীপ। অর্জুন বুঝল চেকপোস্টের ভুটানি কর্মীরা কুলদীপকে চেনে। হেসে কথা বলল ওরা।

বাঁদিকে সামচি বাজারকে রেখে পাহাড়ি শহরটাকে চক্কর দিল ওরা। কুলদীপ চিনিয়ে দিচ্ছিল কোনওটা ফুট ফ্যাক্টরি, কোনওটা মদের কারখানা। অর্জুন লক্ষ করছিল ভুটানি মহিলারা তাদের পোশাক পরে রাস্তায় হাঁটছেন। একটা লোহার বেড়া দেওয়া কম্পাউন্ডের শেষে সুন্দর কয়েকটা বাড়ি, মিলিটারির পোশাক পরা বন্দুক হাতে পাহারাদারদের দেখিয়ে কুলদীপ বলল, এটা হল ভুটান সরকারের অফিস। ভুটানের ভিতরে কোনও কাজ করতে হলে এখান থেকে অনুমতি নিতে হয়। একবার একটা কলকাতার সিনেমা পার্টি বাংলা সিনেমার শুটিং করতে অনুমতি চেয়েছিল। ওই বাড়ি থেকে তাদের বলেছিল প্রতিদিনের জন্যে তিন লক্ষ টাকা জমা দিলে ভুটানের মাটিতে শুটিং করতে দেবে। ওরা এখান থেকে ফিরে গিয়েছিল।

সামচি বাজারের একটা সুন্দর রেস্টুরেন্টে বসে মোমোর অর্ডার দিল । কুলদীপ। তারপর বলল, বলুন।

অর্জুন খুব সংক্ষেপে মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া ডায়েরি এবং ম্যাপের কথা ওকে বলল। স্টিফেন অ্যালফোর্ডের বলা কথাগুলো সে কুলদীপকে শোনাল। তারপর সঙ্গের ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে বলল, যেহেতু এই ডায়েরির অনেক কথাই ভুটানি শব্দে লেখা তাই আমি মানে বুঝতে পারছি না। মাস্টারমশাই বলেছেন এই ডায়েরি যেন কোনও ভুটানিকে না দেখাই। ডায়েরি যে খুব মূল্যবান তার প্রমাণ হল এটা চুরি করার চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ কেউ বা কারা এটা পেলে খুব লাভবান হবে বলে আবার চেষ্টা করবে পাওয়ার জন্যে। আর যারা চাইছে তারা ভুটানের মানুষ বলেই মাস্টারমশাইয়ের ধারণা। আপনি বলেছিলেন ভুটানি ভাষা জানেন। ভুটানি গাড়ি আপনার গ্যারাজে সারানো হয়। চেকপোস্টেও দেখলাম এখানে। আপনি অপরিচিত নন। আপনি আমাকে এই ডায়েরির ভাষা উদ্ধার করতে কি সাহায্য করবেন?

কুলদীপ বলল, এ আপনি কী বলছেন দাদা। আপনাকে সাহায্য করা এখন আমার ধর্ম। কিন্তু এখানে নয়। মোমো খেয়ে কোনও নির্জন জায়গায় চলুন। দেখুন, রেস্টুরেন্টে কয়েকজন ভূটানি বসে আছে।

মোমো এবং চা খেয়ে ওরা বাইকে চেপে নেমে এল নদীর খানিকটা উপরে। সেখানে বড় বড় পাথর আদিকাল থেকে রয়েছে। তার উপর বসলে পাহাড়ি নদীটাকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। তাদের এখানে বসে থাকতে দেখলে যে কেউ ভাববে তারা প্রকৃতি উপভোগ করছে। কুলদীপ বলল, দিন।

অর্জুন ডায়েরি বের করে কুলদীপকে দিল। একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে কুলদীপ বলল, আমি একটা করে লাইন পড়ে সেটা হিন্দিতে অনুবাদ করে বলব?

ঠিক আছে। অর্জুন মাথা নাড়ল।

কুলদীপ শুরু করল। একটা লাইন মনে মনে পড়ে তার অনুবাদ বলতে লাগল সামান্য সময়ের ব্যবধানে। আমি স্টিফেন অ্যালফোর্ড। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আমার দক্ষতার কারণে ভাল মাইনের চাকরি দিয়েছিল একটা রোড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আমি জন্মেছিলাম থিম্পুতে। আমার মা ভুটানি, বাবা বাঙালি। পড়াশোনা করেছিলাম কানপুরে। পনেরো বছর আগে এই চাকরির জন্যে থিম্পু থেকে অনেক দূরে ভুটানের এই প্রান্তে চলে আসি। সে সময় এদিকে তেমন রাস্তা ছিল না। পাহাড়ি এলাকায় ছিল গভীর জঙ্গল। জন্তু-জানোয়ারের ভয়ে বিকেলের মধ্যেই আমরা ক্যাম্পে ঢুকে যেতাম। সেখানে বন্দুকধারী পাহারা দিত দিনরাত। হাতি তাড়াবার পটকা ফাটানো হত মাঝে মাঝে। জঙ্গলের মধ্যে সবচেয়ে কাছের গ্রামের নাম টুংচি। সেখানে জনা ষাটেক মানুষ বাস করত সেসময়। আমরা থাকতাম তাবুতে। কুলিদের জন্য তিনটে তাবু, আমার জন্যে একটা সমস্যা ছিল খাবার নিয়ে। সপ্তাহে একদিন রেশন আসত। চাল, ডাল আলু ছাড়া আর কিছু পাওয়া যেত না বলে কুলিরা পাখি শিকার করত। কোনওদিন খরগোশ পেলে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। হঠাৎ ক্যাম্পের সবাই বিশ্রী জ্বরে আক্রান্ত হল। ম্যালেরিয়া নয়, শরীরে মাঝারি উত্তাপ আর হাতে-পায়ে মারাত্মক ব্যথা। দু’দিন পরেই কুলিরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেল। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। কুলিদের মতো আমি ক্যাম্প ছেড়ে যেতে পারছি না আবার হেড অফিসে খবর দিতেও পারছি না। যদিও যিশুর কৃপায় আমি ওই অসুখে আক্রান্ত হইনি। ওই সময় হাতির দল ক্যাম্পে হানা দিল। তখন বিকেল। পাহারাদার নেই। তাই বন্দুক চালিয়ে হাতি তাড়ানো যাবে না। বাধ্য হয়ে আমি উলটোদিকে পালালাম। জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে থেকে দেখলাম, হাতিরা টেন্টগুলোকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে স্টোরে যে চাল, ডাল, আলু ছিল তা খেয়ে ফেলল। আমি পালালাম। রাত নামছে দ্রুত। যেতে যেতে বুঝলাম শরীর খারাপ লাগছে। যখন টুংচি গ্রামের কাছে পৌঁছেছি তখন বুঝলাম আর হাঁটা সম্ভব নয়। জ্বর এবং ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে। কুলিদের অসুখটা একটু দেরিতে আমাকে ধরল। আমি মাটিতে বসে পড়লাম।

যখন জ্ঞান হল তখন দেখলাম একটা বাঁশের মাচায় শুয়ে আছি। ঘরের কোণে কাঠ জ্বলছে। তার আগুনে যেটুকু দেখা যায় তাতে দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে দেখতে পেলাম। ওরা ভুটানি। নিজেদের ভাষায় আমাকে নিয়ে কথা বলছিল। আমি শুনলাম, গ্রামের কয়েকজন লোক ওদের জানিয়ে গেছে আমাকে ওখানে রাখা যাবে না। রাখলে ওই জ্বরে গ্রামের সবাই মারা যাবে। কেন ওই বুড়োবুড়ি গ্রামের প্রান্ত থেকে আমাকে তুলে ঘরে নিয়ে এল তার কৈফিয়ত চেয়েছিল লোকগুলো। বুড়ো, বুড়িকে বলছিল, একজন অসুস্থ লোককে জঙ্গলের ধারে খোলা আকাশের নীচে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়? ভোরবেলায় দেখা যেত হায়েনা নেকড়েরা খেয়ে গেছে। এই অবধি শুনে আমি চোখ বন্ধ করলাম। ঘুমের গভীরে তলিয়ে যেতে দেরি হল না।

যিশুর আশীর্বাদে আমার জ্বর চলে গেল, একটু সুস্থ হলাম তিনদিন পরে। দেখলাম, যে বুড়ো বুড়ি আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। এই গ্রাম ভুটানের ভিতরে কিন্তু সরকারি সাহায্য এখানে পৌঁছোয় না। ঘন জঙ্গল এবং উঁচু পাহাড় চারদিকে ঘিরে থাকায় শহরে যাওয়ার কোনও পথ নেই। কিন্তু এরা খুব ভাল শিকার করতে পারে। বিশেষ করে হাতির বাচ্চা ধরতে এরা খুব পটু। প্রতি বছর শীতের শেষে এদের একটি দল জঙ্গল ভেদ করে চলে যায় ভারতবর্ষে, হাতি ধরে দিতে। তিনমাস থেকে ওরা ওই কাজের বিনিময়ে ভাল টাকা পায়। অবশ্য সেটা করতে গিয়ে কেউ কেউ প্রাণও হারায়। বর্ষার আগে জামাকাপড় থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে গাধার পিঠে চাপিয়ে যখন গ্রামে ফিরে আসে তখন যেন উৎসব শুরু হয়ে যায়। আসার আগে সামনের বছর কার কাজ করতে যাবে তার অর্ডার পেয়ে যায়। সম্ভবত, ভারতবর্ষে এদের মতো হাতি ধরায় পটু লোকজন নেই। থাকলে বোধহয় তাদের অনেক বেশি পারিশ্রমিক দিতে হয়।

এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ শাক-সবজি সেদ্ধ খেয়ে বেঁচে থাকে। বছরে একবার মকাই হয়। এ ছাড়া বন্যজন্তু শিকার করলে তার মাংস জোটে। আমি কয়েকটা বনমুরগি ধরতে পেরে তাদের খাঁচায় বন্দি করলাম। সবাই মাংস খেতে চাইলে আপত্তি জানিয়ে বললাম, পরের বছর খাওয়া হবে। অদ্ভুত ব্যাপার, ওদের মুরগিগুলো ডিম দিল। সেই ডিম থেকে বাচ্চা বের হলে আমি একটা বড়সড় পোলট্রি তৈরি করে ফেললাম। যা ডিম রোজ পাওয়া যেত তার অর্ধেক গ্রামের লোকদের খেতে দিতাম। বাকিগুলো থেকে বাচ্চা বের করাতাম। এই গ্রামের মানুষদের মনে আমার সম্পর্কে যে ধারণা ছিল তা ক্রমশ কমে আসছিল।

প্রায়ই ভাবতাম ওই গ্রাম থেকে শহরে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু একা ওই গভীর জঙ্গল ভেদ করে যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আমরা যে রাস্তা তৈরির কাজে এসেছিলাম সেটা আর চালু হয়নি। হলে মাইল পাঁচেক দূর থেকেও ডিনামাইট ফাটানোর শব্দ কানে আসত। আমি যে হারিয়ে গেছি, আমার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি জেনেও কোম্পানির লোকজন কোনও তল্লাশি করেনি বুঝে খুব খারাপ লাগত। একবার ভাবলাম যারা ভারতবর্ষে হাতি শিকার করতে যায় তাদের দলে ঢুকে পড়ি। ওদের মুখে অসম এবং ডুয়ার্সের কথা শুনেছি। সেখানে পৌঁছে গেলে আমি স্বচ্ছন্দে থিম্পুতে পৌঁছে যেতে পারব। আমার সঙ্গে কিছু টাকা আছে যা এখানে কোনও কাজেই লাগছে না। লোকগুলো এও জানাল, ডুয়ার্সে ভুটানি টাকায় লেনদেন হয়।

কিন্তু আমার যাওয়া হল না। যাওয়ার কারণ ওই বুড়োবুড়ি। একদিন, যখন কোনও মানুষ কাছাকাছি নেই, তখন বুড়ি বুড়োকে বারংবার অনুরোধ করছিল আমাকে সব কথা খুলে বলতে। বুড়ো প্রথমদিকে রাজি হচ্ছিল না। দূরে বসে এইসব শুনে আমি বুড়িকে বললাম, ওর যখন আপত্তি আছে তখন কেন তুমি এত অনুরোধ করছ।

ওরা চুপ করে গেল। তখনও কিন্তু আমি জানি না, কী বিষয়ে ওরা কথা বলছিল।

কিছুক্ষণ পরে বুড়ো আমাকে কাছে ডেকে বলল, আমি আপত্তি করছি তোমার কথা ভেবে। তুমি তো ভগবান বুদ্ধের উপাসক নও। তোমার ধর্ম বিদেশের। বিধর্মীর প্রাণ কি ভগবান বুদ্ধের সাহায্য পাবে? আমি জানি না।

আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি খ্রিস্টান বটে কিন্তু যিশু ছাড়া আমি ভগবান বুদ্ধ, মহাবীর, রামচন্দ্র এবং আল্লাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। যতক্ষণ আমি কোনও পাপ না করছি ততক্ষণ ওঁরা সবাই আমাকে সাহায্য করবেন বলে বিশ্বাস করি।

এই কথা শুনে বুড়ো খুশি হলেন। তখন তিনি লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারেন না, মাজা ভেঙে গেছে। বুড়ি বলল, তুমি সব কথা ওকে খুলে বলো।

বুড়ো আঙুল তুলে দূরের পাহাড়ের শৃঙ্গ দেখাল, ওই যে ওই শৃঙ্গের ঠিক নীচে একটি গুহা আছে। সেই গুহাতে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু লুকিয়ে রাখা আছে। যার একটা পেলেই রাজা হওয়া যাবে। আমার ঠাকুরদার বাবার কাছে একটা কাগজ ছিল। সেটা বাবা আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। ওই কাগজে লেখা আছে কীভাবে ওই গুহায় পৌঁছোনো যাবে। বাবার মুখে শুনেছি অনেকেই ওই গুহায় পৌঁছোবার চেষ্টা করেও পারেনি। বেশিরভাগই মারা গিয়েছে, কারণ তাদের হাতে এই কাগজটা পড়েনি। আমার ঠাকুরদার বাবা যেতে চেষ্টা করে কিন্তু মাঝপথেই পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে তার পা ভেঙে যায়। বুড়ো অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস নিয়ে বলল, আমাদের বয়স হয়েছে। এখন চোখ বন্ধ করলেই মৃত্যুকে দেখতে পাই। আমরা চলে গেলে লোকে এই কাগজটার কথা জানতেই পারবে না। ফলে কোনওদিন কেউ গুহার ভিতরে পৌঁছোতে পারবে না। কাগজটা তোমাকে দিতে চাই। কিন্তু ওই গুহা পাহারা দেয় যেসব প্রেতাত্মারা তারা কোনও বিধর্মীকে ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তোমার কাজকর্ম দেখে মনে হয়েছে, তুমি মানুষ হিসাবে খুব ভাল। দেখো চেষ্টা করে। কিন্তু আর একটা কথা। এরকম একটা কাগজ যে আছে, তা কেউ কেউ জানে। একসময় নাকি কাগজ খোঁজার জন্য খুব মরিয়া হয়েছিল তারা। শুনেছি তারা দূর শহরের ক্ষমতাবান মানুষ। তাই এই কাগজটার কথা অত্যন্ত গোপন রাখবে। এই গ্রামের কোনও কোনও বুড়ো খবরটা শুনেছে। কিন্তু তারা জানে না কাগজটা আমার ঘরেই রয়েছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি শুনেছেন এখান থেকে শেষ কবে ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছে?

শেষ গিয়েছিল বাবার সময়ে।

আপনার বাবা গিয়েছিলেন?

না। পা ভেঙে যাওয়ার পর ঠাকুরদার বাবাকে লোকজন ফিরিয়ে এনেছিল ঘরে। হাড় থেকে মাংস রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। খুব কষ্ট হয়েছিল মরার আগে। তিনি যাওয়ার আগে আদেশ দেন, ওঁর পরিবারের কেউ যেন ওই গুহার সন্ধানে না যায়। গেলে বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বলেছিলেন, ওই কাগজটার কথা ভুলে যেতে। এই কারণেই তার পরে আর কেউ যেতে সাহস পায়নি। বুড়ো বুড়িকে একটা বেতের ঝুড়ি নিয়ে আসতে বলল। সেটা নিয়ে এলে বুড়ো তার ভিতর থেকে অনেকগুলো ভাঁজ খুলে সুতো খসে আসা কাপড়ের ভিতর থেকে একটা পাকানো কাগজ বের করে আমার হাতে তুলে দিল। দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভগবান বুদ্ধকে স্মরণ করল।

আমি হতচকিত। এইরকম একটা ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাই করিনি। আমার পকেটে তখন মাত্র কয়েকটা ভুটানি টাকা। রয়েছি গভীর জঙ্গলে, আত্মীয়স্বজন বন্ধু এবং সভ্যতার বাইরে। আমার প্রবল ইচ্ছে এখান থেকে কোনওভাবে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার। এই সময়ে কাগজটা নিয়ে আমি কী করতে পারি? ওটা খুলে দেখলাম। যেহেতু পাকিয়ে রাখা হয়েছে, ভাঁজ পড়েনি, তাই অতিপুরনো কাগজ হওয়া সত্ত্বেও সেটা বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়নি। তাকাতেই বুঝতে পারলাম ওটা একটা ম্যাপ। ম্যাপের নীচটা, মানে যেখান থেকে পথের শুরু সেখানে তিনটি ঝরনা এসে মিলে একটা হয়ে নীচে নেমে গেছে। কীভাবে, কোন পথ ধরে যেতে হবে, তা রেখা দিয়ে বোঝানো হয়েছে। নামগুলো যে ভুটানি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই নামকরণ করল কে? এদিকে তো মানুষের বাস নেই। বুড়োকে বললাম, আপনি আমাকে যে দায়িত্ব দিলেন তা নিশ্চয়ই পালন করব। কিন্তু ওই গুহা থেকে আমার না ফেরা পর্যন্ত আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে।

বুড়ো ম্লান হাসল। মনে হল, ভাবছে, আমিই তো ফিরব না, তাই দেখার সুযোগ পাব না যে বুড়ো বেঁচে আছে কি না।

শেষপর্যন্ত ফিরে যাওয়ার চিন্তা আপাতত মন থেকে বাতিল করলাম। শূন্যহাতে ফিরে না গিয়ে দেখাই যাক না গুহা থেকে দু’হাত ভরে নিয়ে যেতে পারি কিনা।

কিন্তু ওই পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি উঠে যাওয়া সোজা কথা নয়। কতদিন লাগবে, পথে কী কী বিপদ হতে পারে, খাবার কী পাওয়া যাবে তার খোঁজ খবর পাওয়ারও তো কোনও সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ওই তিন ঝরনার মিলনস্থল খুঁজে বের না করতে পারলে উপরে ওঠার জন্যে ম্যাপটা কোনও কাজে আসবে না। তা ছাড়া আমি যে গুহাটার উদ্দেশে যাচ্ছি তা গ্রামের কাউকে জানানো চলবে না। ফলে কাউকে আমি সঙ্গী হিসাবে পাচ্ছি না।

বুড়োকে এইসব কথা বললাম। সেই সকালে একটা বড় খরগোশ শিকার করেছিলাম আমি। বুড়ি তা আগুনে ঝলসে নুন লঙ্কা মিশিয়ে দিলে বুড়ো খানিকটা খেয়ে খুব ভাল মেজাজে ছিল। আমার কথা শুনে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক, ঠিক। তোমাকে নদীর মতো হতে হবে।

কীরকম?

নদী যখন প্রথমবার উপর থেকে নীচে নামে, তখন তার সামনে কোনও পথ থাকে না। তাকে পথ তৈরি করতে করতে নামতে হয়। তোমার বেলায় তার উলটো। তোমাকে পথ তৈরি করতে করতে উপরে উঠতে হবে। কিছু শুকনো ফল আছে, তাই নিয়ে যাও। আর খেয়াল রেখো, কাছাকাছি যেন ঝরনা থাকে, তা হলে জলের অভাব হবে না। বলে বুড়ো বুড়িকে বলল, ওকে বাবার ভোজালিটা দিয়ে দাও।

দু’দিন পরে যখন অন্ধকার পাতলা হয়ে গেছে অথচ সূর্য ওঠেনি তখন বুড়োবুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পেছনের জঙ্গলে ঢুকলাম। তখনও গ্রামের মানুষ গভীর ঘুমে মগ্ন। আমার যাওয়াটা কারও নজরে পড়ল না।

.

এই অবধি পড়ে মুখ তুলে তাকাল কুলদীপ। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, টায়ার্ড লাগছে?

না, না। খুব ইন্টারেস্টিং। মনে হচ্ছে গল্পের বই পড়ছি। কুলদীপ বলল।

বেশ। তারপর কী হল?

কুলদীপ হাসল, এই ডায়েরি আপনি কোথায় পেলেন?

কেন?

এরপরে তো কিছু নেই। একদম সাদা পাতা। দেখুন।

অর্জুন দেখল। ডায়েরির লেখা হঠাৎ শেষ হয়ে গিয়েছে। স্টিফেন অ্যালফোর্ড গুহার সন্ধানে জঙ্গলে ঢোকার পরে হয়তো একবারই কয়েকটা লাইন লিখেছিল কিন্তু তারপরে আর লেখেনি। লোকটা কতদূরে গিয়েছিল তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে নিশ্চয়ই ওই গুহার দেখা পায়নি। কিন্তু সেই তিন ঝরনার সন্ধান সে পেয়েছিল?

অর্জুন মাথা নাড়ল, খানিকটা হতাশ হয়ে। তারপর বলল, যে এই অবধি লিখেছে সে খুব অসুস্থ এবং আহত অবস্থায় নাথুয়াতে এসে আমার মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। বলেছিল তাকে ভুটান পুলিশের কিছু লোক এই ম্যাপটার জন্যে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে জঙ্গলে পালিয়ে পালিয়ে থেকে আর না পেরে যখন উদভ্রান্ত হয়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিতে আসছিল তখন হয়তো কোনও বন্যজন্তুর আক্রমণে আহত হয়। এই সময় তার মৃদু হার্ট অ্যাটাকও হয়ে যায়। কোনওমতে সে নদী পেরিয়ে এসে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সেই স্টিফেন অ্যালফোর্ড মাস্টারমশাইকে এই ডায়েরি আর ম্যাপ দিয়ে অনুরোধ করে কাউকে না দিতে। খবর পেয়ে ভুটানের পুলিশ তাকে তাদের দেশে নিয়ে হাসপাতালে ভরতি করলেও শেষপর্যন্ত প্রাণরক্ষা হয়নি। মাস্টারমশাই আমাকে লিখেছিলেন, ছাই নিয়ে বসে আছি, তুমি যদি তা থেকে অমূল্যরতন পেতে পারো তা হলে তার কৃতিত্ব তোমার।

কুলদীপ অর্জুনের কথা শুনতে শুনতে মাথা নেড়ে যাচ্ছিল। এবার বলল, বহুৎ ইন্টারেস্টিং।

অর্জুন বলল, আপনি পড়ে না দিলে আমি এই ডায়েরিতে লেখা কথাগুলো বুঝতেই পারতাম না।

কুলদীপ হাত নাড়ল এমনভাবে যার অর্থ সে এমন কিছু করেনি। বলল, এখন আপনি কী করবেন?

বুঝতে পারছি না। অর্জুন বলল।

ডায়েরি ফেরত দিয়ে কুলদীপ বলল, আমার খুব ইচ্ছে করছে ওই গুহাটাকে খুঁজে বের করতে। দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হবে।

অর্জুন একটু ভাবল। তারপর বলল, ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। প্রথমত, জায়গাটা আমাদের কাছে বিদেশ। স্টিফেন অ্যালফোর্ডের কথা সত্যি হলে ভুটানের পুলিশ এই ম্যাপ খুঁজছে গুহাতে পৌঁছোবার জন্যে। ওরা নিশ্চয়ই চাইবে না বিদেশিরা ওদের আগে সেখানে পৌঁছাক।

কুলদীপ মাথা নাড়ল, ওরা জানতেই পারবে না। ডায়েরিতে লেখা আছে, জায়গাটা শহর থেকে অনেক দূরে, সভ্যতার প্রায় বাইরে। পুলিশ নিশ্চয়ই সেখানে থানা তৈরি করে বসে নেই। তা ছাড়া দাদা, আমার মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটা ভুটান সরকার জানে না। কয়েকজন পুলিশ অফিসার লোভে পড়ে ম্যাপটা হাতাতে চাইছে। তাদের এড়িয়ে গেলেই তো হবে।

কিন্তু ভুটান তো আমাদের কাছে বিদেশ। অর্জুন বলল।

তা হোক। ভুটানে যেতে আমাদের ভিসা দুরের কথা, কোনও অনুমতিরও দরকার হয় না। কুলদীপ বলল।

ঠিক আছে, ভেবে দেখি। অর্জুন বলল।

.

অনেক ভেবে অর্জুন যখন এইরকম অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা নেওয়া যুক্তিসংগত মনে করছে না ঠিক তখনই মেজরের ফোন এল দিল্লি থেকে। তিনি দিন তিনেক আগে নিউ ইয়র্ক থেকে দিল্লিতে এসেছেন ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফি পত্রিকার আমন্ত্রণে। সেখানে তার কনফারেন্স আজ শেষ হচ্ছে। এত দূরে যখন এসেছেন তখন জলপাইগুড়িতে না গেলে মনখারাপ হবে। তিনি জানতে চাইলেন, অমল সোম এখন জলপাইগুড়িতে আছেন কি না। অর্জুন জানাল, অমল সোম এখন দেরাদুনে আছেন। কিন্তু হাবু তার বাড়ি চমৎকার গুছিয়ে রেখেছে। মেজর এলে তার পুরনো ঘরেই থাকতে পারবেন।

মেজর এলেন। অর্জুন দেখল বয়স বাড়লেও মানুষটার উৎসাহের বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি। দাড়ি আর একটু সাদা হয়েছে, এই যা। দু’হাত দু’দিকে বাড়িয়ে বললেন, হাই ইয়ংম্যান। নতুন কোনও কেস হাতে আছে?

এই মুহূর্তে নেই। অর্জুন হাসল, দু’মাস আগে শেষ কাজ করেছি। একটা আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারীদের শেষপর্যন্ত ধরা গিয়েছে।

ওঃ। আমি ভাবলাম দিন কয়েক এখানে থেকে তোমার সঙ্গে একটা কিছু নিয়ে মন গরম করে ফিরে যাব। মেজর একটু হতাশ।

কথা হচ্ছিল অমল সোমের বাড়ির বারান্দায় বসে। হঠাৎ একটা বিশাল চেহারার কাঠবিড়ালি লাফিয়ে নামল বাড়ির বাগানে। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন মেজর, মাই গড, এই ভুটানি কাঠবিড়ালি এখানে কী করে এল? লুক, ওর মাথা শরীরে কালো ছাপ কিন্তু লেজটা সাদা।

এটা ভুটানি কাঠবিড়ালি? অর্জুন অবাক।

হ্যাঁ। সেন্ট পার্সেন্ট ভুটানি। ইন্ডিয়ানগুলো সাইজে ছোট হয় এবং লোমের রংও কালো সাদা হয় না। ইন্টারেস্টিং।

মেজরের মুখে ভুটান শব্দটি শোনামাত্র স্টিফেন অ্যালফোর্ডের কথা মনে পড়ল অর্জুনের। সে ধীরে ধীরে মেজরকে বলতেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, করেছ কী? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

কেন? অর্জুন অবাক।

তুমি কি কল্পনা করতে পারছ না এই এক্সপিডিশন কীরকম হবে? লোকটা লেখেনি সেই গুহায় কী আছে? লিখেছে যা আছে তার সামান্য অংশ পেলে একজন রাজা হয়ে যেতে পারে! রাজা হোক বা না হোক, ওই ম্যাপ ধরে জায়গাটায় পৌঁছোনোর কথা ভাবলেই আমার শরীরের সমস্ত রোম খাড়া হয়ে উঠছে। লেটস গো।

কিন্তু অনেক সমস্যা রয়েছে।

সমস্যা না থাকলে আনন্দ হবে কী করে? রান্নায় নুন এবং লঙ্কা না থাকলে কি স্বাদ হয়? মেজর খিঁচিয়ে উঠলেন।

ভুটানি পুলিশ যদি অপছন্দ করে? যদিও যেতে কোনও অনুমতির দরকার হয় না, তবু ওরা বিপদে ফেলতে পারে।

তুমি কি ওদের ঘরের দরজায় নক করে বলবে আমরা গুহা আবিষ্কার করতে যাচ্ছি?

বেশ। আমরা ঠিক কতদিনে গুহায় পৌঁছোব এবং ফিরে আসব তা জানি না। এর জন্যে রসদ, তবু দরকার। সঙ্গে পোর্টার নিতে হবে। যতদূর মনে হচ্ছে এলাকাটায় সভ্যতা পৌঁছোয়নি। তাই বন্য জন্তুদের আক্রমণের কথাও ভাবতে হবে। বুঝতেই পারছেন, এর জন্যে অনেক টাকা দরকার হবে।

মেজর খানিকটা সময় দাড়িতে হাত বোলালেন। তারপর বুকপকেট থেকে পানীয়ের পাত্র বের করে গলায় ঢেলে বললেন, তোমার কী মনে হয় ছোকরা? আমি মরে গেছি? চোখ বড় করলেন মেজর।

এ কথা কি আমি মনে করেছি? অর্জুন হেসে ফেলল।

দাঁড়াও। পকেট থেকে মোবাইল বের করে মেজর গোটা তিনেক ফোন করলেন। রাজধানী এক্সপ্রেসের গতিতে ইংরেজিতে অভিযানের কথা বললেন। শেষ করে ফোন বন্ধ রেখে বললেন, লেটস গো।

কোথায়? অর্জুন অবাক।

কী কী কিনতে হবে তার লিস্ট করো। আমি এবার অন্য ভূমিকায়।

কী ভূমিকায়?

ফটোগ্রাফারের। সঙ্গে দামি ক্যামেরাটা ভাগ্যিস এনেছিলাম। পুরো অভিযানের ছবি আমাকে তুলতে হবে। নিউ ইয়র্কের একটি ভ্রমণ পত্রিকা সব খরচ দেবে। অতএব মধ্যম পাণ্ডব, বিলম্বের আর দেরি কোরো না। উঠে দাঁড়িয়ে দু’বার লাফিয়ে নিলেন মেজর। যেন এখনই তাঁর বিপুল দেহ সচল করবেন।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার