সন্ধে হতে না হতেই ঠান্ডা বেড়ে যেতে লাগল হু হু করে। একই তাবুর মধ্যে মেজর, কুলদীপ এবং অর্জুন স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিল। একটু আগে তারা ডবল ডিমের ওমলেট আর গরম কফি খেয়েছে।

কুলদীপ বলল, কাল রাতে এত ঠান্ডা পাইনি।

অর্জুন মাথা নাড়ল, কারণ ওই উঁচু পাহাড়টা আড়াল করে ছিল।

মেজর পকেট থেকে তার ধাতব পাত্র বের করে মুখ খুলে খানিকটা তরল পদার্থ গলায় ঢাললেন। আঃ। স্বাদটাই পালটে গিয়েছে।

অর্জুন বলল, ভাল না খারাপ?

খারাপ? দূর! অবশ্যই ভাল। তোমরা তো এই রসে বঞ্চিত, তাই ঠিক বুঝবে না। আচ্ছা, গ্রামের যে দু’জন মানুষ ফিরে গিয়েছিল একজনকে সাপ মেরে ফেলেছে বলে, সেটা কোন জায়গা থেকে?

কুলদীপ বলল, ওরা নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গের খবর পায়নি। বোধহয় পাহাড় ডিঙিয়েছিল। স্টিফেন লিখেছেন, যে বৃদ্ধের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁর ঠাকুরদার বাবা পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিলেন। বোধহয় ওই পাহাড়টাই।

অর্জুন বলল, আমরা শেষপর্যন্ত ঝরনা পেয়েছি। নিশ্চয়ই আগামীকাল সঙ্গমে পৌঁছে যাব। সেখানে গেলেই ম্যাপের রাস্তা ধরতে পারব।

মেজর বললেন, ওদের বলো তাড়াতাড়ি ডিনার খাওয়াতে। এই ঠান্ডায় জেগে থাকার দরকার নেই। ভোর ভোর উঠতে হবে।

অর্জুন সোয়েটার পরেছিল। এবার মাথায় টুপি চাপিয়ে মাফলার গলায় জড়িয়ে একটি লাঠি নিয়ে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এসে বলল, একটা পাক দিয়ে আসি।

যাও। মেজর বললেন, কিন্তু লাঠির মুখ থেকে আমার সম্পত্তিটা খুলে দিয়ে যাও।

অর্জুন হেসে ফেলল। রুমাল এবং পাইপ ফেরত দিয়ে বলল, এগুলো ব্যবহার করার আগে ভাববেন সাপের ছোবলের সঙ্গে সঙ্গে বিষও এর গায়ে। লেগেছিল।

মেজর রুমাল ফেলে দিয়ে পাইপটাকে বারংবার মোছার চেষ্টা করলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে নিজের রুকস্যাক থেকে ডেটলের শিশি বের করে পাইপের গায়ে তরল পদার্থ ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ইটস গুড।

অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এসেই একটু কেঁপে গেল। তাঁবুর ভিতরের ঠান্ডার চেয়ে বাইরে অনেক বেশি। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চারধারে। ঝরনার জলের শব্দ হচ্ছে কিন্তু জল দেখা যাচ্ছে না। ওপাশের তিনটি তাবুর দুটো থেকে আলো। বেরিয়ে আসছে সামান্য। অর্জুন মালবাহকদের তাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হল অন্ধকারে কিছু নড়ে উঠল। এতক্ষণ সে টর্চ জালায়নি ইচ্ছে করেই। এবার টর্চ জ্বালতেই মনে হল অত্যন্ত দ্রুত কিছু লাফ দিয়ে গাছের আড়ালে চলে গেল। সে আর একটু এগিয়েও টর্চের আলোয় কাউকে ধরতে পারল না। এই প্রাণী হনুমান নয়। এর আকৃতি অনেক বড়। অন্ধকারে ওকে পরিষ্কার বোঝ সম্ভব নয় কিন্তু মনে হচ্ছিল প্রাণীটি বেশ শক্তিশালী। মানুষের মতোই তার উচ্চতা। অন্ধকারে প্রাণীটির বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না তা বোঝা গেল। এই প্রাণী এই এলাকায় একা বাস করে তা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। আক্রান্ত হলে ওদের মোকাবিলা করার জন্যে কোনও অস্ত্র সঙ্গে নেই। বিদেশি রাষ্ট্রে অস্ত্র নিয়ে ঢোকা খুব বিপজ্জনক। ধরা পড়লে বহু বছরের জেল হবেই। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি থাকা দরকার।

অর্জুন মালবাহকদের তাবুর ভিতর ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, রান্নার কত দেরি?

মালবাহকদের প্রধান বলল, আর দশ মিনিট। আপনাদের জন্যে রুটি, আলুর তরকারি আর ডিমের তরকারি।

সে কী! একটু আগেই তো ওমলেট খাওয়ালে। যাক গে, তোমাদের হরিণের মাংস ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ সাহেব।

শোনো, দু’জন আমার সঙ্গে বেরিয়ে এসো। কম্বল জড়িয়ে এসো। খুব ঠান্ডা।

দু’জন বাইরে এলে অর্জুন তাদের টর্চের আলোয় যতটা সম্ভব বেশি শুকনো গাছের ডাল, পাতা সংগ্রহ করতে বলল। চারধারে ওসব যথেষ্ট পরিমাণে পড়ে ছিল। অর্জুন দুটো স্তূপ বানাতে বলল, একটা মালবাহকদের তাঁবুর সামনে, দ্বিতীয়টা তাদের তাবুর পাশে।

অর্জুন বলল, খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে দুটো স্তূপে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। মনে হয় ঘণ্টাখানেক জ্বলবে। আর তোমাদের চারজন পালা করে দুই ঘণ্টা করে জেগে থাকবে। আমরা একদম অজানা জায়গায় আছি, তাই সাবধান হওয়া উচিত।

রাত্রের খাওয়া শেষ হলে মালবাহকেরা আগুন জ্বেলে দিল স্তূপে।

মেজর পাইপ ধরিয়ে বললেন, তোমরা শুয়ে পড়ো। আমি প্রথম তিনঘণ্টা জেগে পাহারা দিচ্ছি। পাইপ খেলে আমার ঘুম আসে না।

কুলদীপ জিজ্ঞাসা করল, এই ঠান্ডায় কেউ হামলা করতে আসবে বলে মনে হয় না।

অর্জুন ইতস্তত করল। সে যে প্রাণীটিকে দেখেছে তার কথা মালবাহকদের বলেনি কারণ ওরা ভয় পেয়ে যাবে। এখন এদের বলে কী লাভ হবে? যদি ওটাকে আবার দেখা যায় তখন না হয় বলা যাবে। সে বলল, না কুলদীপ, সাবধানের কোনও মার নেই।

মাঝরাতে কুলদীপ, ভোরের আগে অর্জুন জেগেছিল। রাতপাখির চিৎকার ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি।

.

ঘণ্টা দেড়েক হাঁটার পর যখন সূর্য দিগন্ত ছেড়ে কিছুটা আকাশে তখনই ওরা তিন ঝরনার মিলনস্থলে পৌঁছোল। প্রচণ্ড বেগে দুটো জলের ধারা যেখানে আছড়ে পড়ছে সেখানে খুব শ্লথভঙ্গিতে তৃতীয় জলের ধারা মিশছে। প্রথম দুটোর তুলনায় তার শক্তি অনেক কম। মেজর বললেন, এইখানে শরীর। হালকা করে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলে কেমন হয় অর্জুন?

এত তাড়াতাড়ি? অর্জুনের প্রস্তাবটা পছন্দ হল না।

কুলদীপ বলল, আমরা এখানে বসে আলোচনা করে নিতে পারি ম্যাপটাকে সামনে রেখে। তার মধ্যে খাওয়া হয়ে যেতে পারে।

অতএব মালবাহকদের ব্রেকফাস্টের নির্দেশ দিল অর্জুন। তারপর তার পার্স থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করল। স্টিফেনের ম্যাপটার একটা কপি সে তৈরি করে এনেছিল, দ্বিতীয় কপিটা মেজরের হিপপকেটে আছে। মালপত্র খোয়া গেলেও যাতে ওটা না হারিয়ে যায় তাই এই ব্যবস্থা।

একটা বড় চওড়া পাথরের উপর ওরা বসল। সামনে তিনটে ঝরনার জল একত্রিত হয়ে নীচে বয়ে যাচ্ছে। অর্জুন দেখল দু’জন মালবাহক একটা চওড়া কাপড় নিয়ে জলে নেমে দুটো দিকে নীচে চেপে ধরে থাকল। কুলদীপ জিজ্ঞাসা করল, ওরা কী করছে?

অর্জুন বলল, বোধহয় মাছ ধরতে চাইছে।

ম্যাপ বের করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে চারপাশে নজর বোলাল। তিনটে জলের ধারার পশ্চিমদিকে একটা বাইসনের মাথার মতো পাথর থাকা উচিত এখানে। সে পশ্চিমদিকে তাকিয়ে তেমন কিছুই দেখতে পেল না। পাথর আছে বটে কিন্তু কোনওটাকেই বাইসনের মাথার মতো মনে হচ্ছে না। ম্যাপ বলছে ওই মাথার পিছন দিক দিয়ে কিছুদূর হাঁটলে জোড়া শালগাছ দেখা যাবে।

এই সময় মালবাহকদের উল্লসিত চিৎকার শোনা গেল। দু’জন দু’দিক থেকে চওড়া এবং লম্বা কাপড়টাকে জলের উপর তুলে ধরেছে এবং তার মাঝখানে অনেকগুলো মাছ লাফাচ্ছে। দ্রুত পাড়ে উঠে এল ওরা। তারপর অর্জুনদের কাছে এসে মাছগুলো দেখাল। অর্জুন চিনল। এই মাছগুলোকে উত্তরবঙ্গে ঝিলা বলা হয়। তবে ঝিলার থেকে একটু বড়। একটা লোক গুনে বলল, আঠারোটা মাছ। মেজর খুশিমুখে বললেন, দুপুরে জমিয়ে খাওয়া যাবে।

মাছ নিয়ে ওরা সঙ্গীদের কাছে চলে গেলে সমস্যার কথা বলল অর্জুন। এখানে একটা বড় পাথর থাকার কথা যেটা দেখতে বাইসনের মাথার মতো। কিন্তু সেরকম কিছু দেখছি না।

মেজর তার কপি বের করলেন। কারেক্ট। তা হলে কি আমরা ভুল জায়গায় এসেছি!

কুলদীপ মাথা নাড়ল, এইরকম তিনটে ঝরনা এক হয়ে যাওয়া যখন পেয়ে গেছি তখন–! সে পশ্চিমদিকে তাকাল, চলুন, ওদিকে দেখে আসি।

অর্জুন মেজরকে বলল, আপনি বিশ্রাম করুন। আমরা ঘুরে আসছি।

শেষ পর্যন্ত একটা পাথর পাওয়া গেল যার আকৃতি পশুর মাথার মতো দেখতে। কিন্তু সেটার চারপাশে গাছের পাতার আড়াল ছিল বলে চোখে পড়েনি অর্জুনের। যখন ম্যাপটা তৈরি হয়েছিল তখন এর চারপাশে গাছ গজায়নি। বহু বছরে সেটা হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। পাথরটার পিছন দিকে কোনও পথ নেই। কুলদীপকে ধন্যবাদ দিল অর্জুন। সে বলল, আপনি এদিকে খুঁজতে এলে পেয়ে যেতেন। এ আর কী!

প্রাতঃকৃত্য সেরে ওরা ভেবেছিল স্নান করে নেবে। কিন্তু জলে হাত দিয়ে বোঝা গেল শরীর ওই ঠান্ডা নিতে পারবে না। মেজর বেশ আফশোসের গলায় বললেন, আজ এই ঠান্ডায় ঝরনার জলে স্নান করতে চাইছি না, অথচ, বুঝলে কুলদীপ, তিরিশ বছর আগে আলাস্কায় দিব্যি সাঁতার কেটেছি।

কুলদীপ মোহিত হয়ে গেল। অর্জুন লক্ষ করছিল মেজর তার অতীতের কীর্তির কথা কুলদীপের দিকে তাকিয়ে বলছেন।

ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা রওনা হল। বাইসনমুখো পাথরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মেজর চট করে তার গায়ে চকের দাগ আঁকলেন। বললেন, মার্ক রাখলাম। একটু একটু করে উপরে উঠতে হচ্ছে। ঝরনার শব্দ মিলিয়ে গেল। অর্জুন চোখ রাখছিল চারধারে। মেজর পিছন থেকে বললেন, যমজ শালগাছ কখনও দেখেছ অর্জুন?

না। অর্জুন বলল, খুব ইন্টারেস্টিং।

মালবাহকেরা গতি বাড়িয়ে ওদের ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেল। মেজর বললেন, ওদের বলো, দ্রুত হাঁটলেই আগে পৌঁছোনো যায় না।

অর্জুন কিছু বলল না। তার নজর তখন বিশাল গাছটার দিকে। সে ধীরে ধীরে জঙ্গল সরিয়ে গাছটার নীচে পৌঁছে চিৎকার করল, পেয়েছি। পেয়েছি।

দূর থেকে বোঝার কোনও উপায় নেই। মাটি থেকেই দুটো গাছ গায়ে গায়ে উপরে উঠে ডালপালা ছড়িয়েছে। প্রায় কুড়ি ফুট ওদের শরীর জোড়া। গাছটা শালগাছ।

মেজর বললেন, ঈশ্বরের আজব সৃষ্টি।

ম্যাপ বলছে জঙ্গল ভেদ করে এগিয়ে যেতে হবে। সেটা কতক্ষণের তা লেখা নেই। রেখাটা ধরে এগিয়ে যাওয়ার পরে জঙ্গল শেষ হল। সামনে সামান্য উঁচু পাহাড়। অর্জুনের মনে হল উচ্চতা বড়জোর চারটে স্বাভাবিক মানুষের। পাহাড়টা বাঁ দিক থেকে ডানদিক আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনওদিকেই কোনও পথ নেই।

অর্জুন বলল, পাহাড়ে উঠতে হবে।

মেজর বললেন, নো প্রবলেম। কিন্তু ওরা অত মালপত্র নিয়ে উঠবে কী করে? অসম্ভব ব্যাপার। আমরা কতদূরে এসেছি?

মাত্র কুড়ি ভাগ। এখনও আশি ভাগ বাকি। অর্জুন বলল।

কুলদীপ মালবাহকদের সঙ্গে আলোচনা করার পর ওরা দড়ি দিয়ে মালপত্র বেঁধে নিল। তারপর সেগুলোকে পাহাড়ের নীচে রেখে দিয়ে খাঁজে খাঁজে পা ফেলে বেশ তরতরিয়ে উপরে উঠে গেল। তারপর দড়ির প্রান্ত ধরে চারজনে মিলে একে একে বোঝাগুলো উপরে টেনে তুলে নিল। মেজর বললেন, বাঃ। বেশ বুদ্ধিমান দেখছি।

অর্জুন বলল, আপনি আগে উঠুন।

আমি আগে কেন? তোমরা যাও। মেজর মাথা নাড়লেন।

আমরা পিছনে থাকলে প্রয়োজন হলে আপনাকে সাহায্য করতে পারব।

অ। ওদের বলো দড়িটা উপরে কিছুতে বেঁধে নীচে নামিয়ে দিতে। চিরকাল রোপ ক্লাইম্বিং করে এসেছি তো–! মেজর রুকস্যাক খুললেন।

দড়ি ধরে মেজরের পাহাড়ে ওঠার দৃশ্য দেখতে দেখতে হাসি চাপল অর্জুন। কুলদীপ বলল, যাই বলুন, এই বয়সে ওঁর এনার্জি অনেকের থেকে বেশি।

পাহাড়ের উপর উঠে আবার হাঁটা শুরু হল। এবার পাকদণ্ডীর পথ। মেজর বললেন, অদ্ভুত দেশ। কোনও মানুষ তো দেখা যাচ্ছে না, পাহারাতেও কেউ নেই।

অর্জুন বলল, ভাগ্যিস নেই, তাই আমরা সহজে যেতে পারছি।

মেজর একবার লাঞ্চের কথা বলেছিলেন কিন্তু অর্জুন না শোনার ভান করে হেঁটেছিল। দুপুরে মাথার উপরে আওয়াজ শুরু হতেই মেজর বললেন, হেলিকপ্টার বলে মনে হচ্ছে। এদিকে হেলিকপ্টার কেন?

দ্রুত সবাইকে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে উবু হয়ে বসতে বলল অর্জুন। সবাই যখন জঙ্গলের আড়ালে তখন হেলিকপ্টারটাকে দেখা গেল। বেশ নীচ দিয়ে উড়ে এল ধীর গতিতে, মাথার কাছাকাছি এলে স্পষ্ট দেখতে পেল অর্জুন। একজন লোক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে নিয়ে ঝুঁকে নীচের দিকে চেয়ে আছে। তিনবার পাক খেয়ে বোধহয় একটু হতাশ বা নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল হেলিকপ্টার। একসময় তার আওয়াজ মিলিয়ে গেল।

মেজর বললেন, মনে হচ্ছে ওরা কিছু খুঁজছে। কী খুঁজছে?

অর্জুন বলল, আমাদের কথা জানার কোনও সম্ভাবনা নেই। আর জানলেও কেন এসেছি, তা বুঝতে পারবে না। কোনও ভারতীয় ভুটানে এলে তাকে অস্ত্র হাতে নিশ্চয়ই খুঁজবে না ওরা। কিছু একটা হয়েছে।

কুলদীপ বলল, স্টিফেন সাহেব যাদের ভয়ে পালিয়ে নাথুয়াতে পৌঁছেছিলেন তারা সন্ধান পায়নি তো? তারাই হয়তো যা হোক কিছু বানিয়ে ভুটান সরকারকে বলেছে।

কল্পনা করে লাভ নেই। লক্ষ করুন হেলিকপ্টার এই পর্যন্ত এসে পাক খেয়ে ফিরে গেছে, আরও ওদিকে যায়নি। আমরা ওদিকে এগিয়ে যাই। অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

.

বিকেলের একটু আগে একটা সরু ঝরনার পাশে ক্যাম্প খাটাল ওরা। ঝরনাটা পাহাড় থেকে নেমে আসছে। এখনও পর্যন্ত ম্যাপ অনুসরণ করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। এরকম চললে কাল বিকেলেই গুহার কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।

মেজর হাঁকলেন, জলদি জলদি ভাত আর মাছের ঝাল। তবে তার আগে একটা কফি চাই ভাই।

কফি খেতে খেতে পাইপ ধরালেন মেজর। এদিকে বন্যপ্রাণী নেই নাকি!

অর্জুন বলল, না থাকাটা অস্বাভাবিক।

তা হলে তাদের দেখা পাচ্ছি না কেন? মেজর ধোঁয়া ছাড়লেন।

কুলদীপ মালবাহকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এসে বলল, ওরা খুব ভয় পেয়ে গেছে?

অর্জুন সোয়েটারের উপর আর একটা জ্যাকেট চড়াচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

ওদের একজন নাকি অদ্ভুত চেহারার কাউকে দেখেছে যার শরীর কালো লোমে ঢাকা। কিছু বোঝার আগেই সেটা এক লাফে উধাও হয়ে গিয়েছে। কুলদীপ জানাল।

কালো হনুমান? মেজর জিজ্ঞাসা করল।

লোকটা বলছে লম্বায় সেটা মানুষের মতন।

মানুষের মতন! এখানে তা হলে পাহাড়ি উপজাতির কিছু মানুষ আছে। খুব প্রাচীন উপজাতির একটা হবে। কৌতূহলী হয়ে দেখতে এসেছে। সাধারণত এরা খুব ভিতু হয়। ওদের দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই তা বুঝিয়ে বলেছ? মেজর জিজ্ঞাসা করলেন।

একটা কথা বলি। অর্জুন বলল, কাল রাতেও আমি ওরকম কিছু দেখেছি। দেখে ওদের আগুন জ্বালতে বলি। আর আগুন জ্বালার পর ওরা ক্যাম্পের দিকে আসেনি তা তো বোঝাই গিয়েছে। কিন্তু এখান থেকে গত রাতের ক্যাম্প আমাদের কাছে দূরের হলেও ওদের কাছে যে নয় তা আমার কাছে স্পষ্ট।

সে কী! তুমি তো কাল রাতে কিছু বলোনি। মেজর তাকালেন।

আমি ভেবেছিলাম বোঝার ভুল।

কুলদীপ বলল, তা হলে ওরা গত রাত থেকে আমাদের ফলো করছে? আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। অর্জুন তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল।

চারধার চুপচাপ। এদিকে পাখিরাও বোধহয় আসতে পছন্দ করে না। গুঁড়ি মেরে অন্ধকার উঠে আসছে ওপাশের খাদের গহ্বর থেকে। মালবাহকদের কাছে গিয়ে ভরসা দিল অর্জুন। তারপর সবাই মিলে শুকনো ডাল, মরা পাতার সঙ্গে মরা গাছের গুঁড়ি কেটে টুকরো করে তাঁবুগুলোর সামনে জড়ো করল। কালকের থেকে আজকের পরিমাণ অনেক বেশি।

তৃপ্তি করে খেল ওরা ঝিলা মাছের ঝাল আর ভাত। মেজর বললেন, অসম্ভব ভাল স্বাদ। ইন্টারন্যাশনাল ফিশ ফেস্টিভ্যালে নিয়ে গেলে আলোড়ন উঠত।

কুলদীপ বলল, চামুর্চির বাজারে প্রায়ই এই মাছ ওঠে, তবে সাইজে ছোট।

জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে আজ। সন্ধে নামতেই আগুনগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সেই আলোয় চারদিক যেমন আলোকিত হয়ে উঠেছে, তেমনই রাজ্যের পোকামাকড় ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার মধ্যে। কুলদীপ বলল, ওই আগুনের পাশে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে গিয়ে শুলে খুব আরাম হত।

কথাটা বাকি দু’জন শুনেও কোনও মন্তব্য করল না।

ভোররাতে মালবাহকদের চিৎকার শুনে অর্জুন দ্রুত স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে এল। ভোরের পর্বে তারই জেগে থাকার কথা। বাকি দু’জন তখন গভীর ঘুমে। জ্যাকেট পরে টুপি মাথায় দিয়ে অর্জুন বেরিয়ে এল তবু থেকেটচ আর লাঠি হাতে নিয়ে। আলো নিভে গিয়েছে। মালবাহকেরা তাদের তাঁবুর ভিতর থেকে চিৎকার করে চলেছে। অর্জুন তাবুর বাইরে গিয়ে চেঁচিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই চিৎকার থামল। কম্বল মুড়ি দিয়ে তিনজন বেরিয়ে এল বাইরে। টর্চের আলোয় ওদের দেখে অর্জুন বুঝতে পারল প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে ওরা। তিনজনে একসঙ্গে কথা বলছিল, তাদের অনেক চেষ্টায় শান্ত করে অর্জুন একজনকে কথা বলতে বলল। প্রধান যা বলল তা এইরকম–

ওদের দলের সবচেয়ে যে ছোট সে কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠে ওদের ঘুম ভাঙিয়ে বলে তার খুব পায়খানা পেয়েছে। একটা বড় মগে জল নিয়ে ওই ঠান্ডায় যখন সে তাবুর বাইরে চলে গেল তখন ওরা হাসাহাসি করল এই বলে গত রাতে ওই ছেলে সবচেয়ে বেশি ভাত খেয়েছিল। কিন্তু মিনিট দশেক পরেও যখন ছেলেটা ফিরে এল না, তখন ওরা চেঁচিয়ে নাম ধরে ডেকেছিল। কিন্তু সাড়া না পেয়ে ওটা টর্চ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে কোথাও দেখতে পায়নি। পায়খানার জন্য সে নিশ্চয়ই বহুদূরে যাবে না। তাই ওরা খুব ভয় পাচ্ছে। ছেলেটার নিশ্চয়ই কোনও বিপদ হয়েছে।

তখনও ভোরের আলো ফুটতে দেরি আছে। চিৎকার শুনে কুলদীপও বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। টর্চ নিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করল ওরা। প্রায় একশো গজ দূরে একটা বুনো ঝোঁপের গায়ে লাল কম্বল দেখে কাঁদতে লাগল মালবাহকেরা। ওই কম্বল ছেলেটির।

আলো ফুটল।

মালবাহকদের প্রধান জানিয়ে দিল তাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে না পেলে ওরা আর এক পা-ও এগোবে না। এখানে আর একটা দিন অপেক্ষা করে ওরা ফিরে যাবে। কুলদীপ অনেক বোঝাল কিন্তু কাজ হল না।

মেজর অনেকক্ষণ ধরে খালি পেটে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিলেন। আজ সকালে মালবাহকদের চা তৈরি করে দেওয়ার কথাও বলা যাচ্ছে না। শেষপর্যন্ত তিনি মুখ খুললেন, অর্জুন, তুমি তো জেগে ছিলে, কোনও জন্তুর আওয়াজ কি পেয়েছিলে?

অর্জুন মাথা নাড়ল, না। নিঃশব্দে নিয়ে গিয়েছে লোকটাকে।

কে নিল? মেজর হঠাৎ খেপে গেলেন, আই মাস্ট কিল হিম। কে নিল?

ওরা সকলে বের হল। ঘণ্টা তিনেক তল্লাশি করেও কোনও হদিশ পাওয়া গেল না। হঠাৎ অর্জুনের মনে পড়ে গেল। সে সবাইকে এক জায়গায় করে যে যেমন পারে থালাবাসন নিয়ে চিৎকার এবং আওয়াজ করতে বলল। মেজর রেগে গেলেন, হোয়াট ননসেন্স। আওয়াজ করলে লোকটাকে ফেরত পাওয়া যাবে?

এমনিতেই তো পাওয়া যাচ্ছে না, করে দেখুন না। অর্জুন বলল। চিৎকার এবং আওয়াজ পাশের পাহাড়ের দিকে মুখ করে শুরু হল। মিনিট দুয়েক পরে পাহাড়ের নীচের দিকের গাছগুলো নড়তে লাগল। তারপর মনে হল কয়েকজন হুটোপুটি করে আরও উপরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।

মেজর অবাক হয়ে বললেন, মাই গড! ওগুলো কী?

অর্জুন সবাইকে নিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল সমান শব্দ এবং চিৎকার করতে করতে। যত তারা উপরে উঠছিল তত লক্ষ করছিল আর কোনও গাছের পাতা নড়ছে না। যারা পালিয়েছে তাদের ক্ষিপ্রতা অসাধারণ।

মিনিট দশেক পাহাড়ে ওঠার পর একজন মালবাহক চেঁচিয়ে উঠে দ্রুত একটা বড় পাথরের দিকে চলে যেতেই সবাই তাকে অনুসরণ করল।

উপুড় হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা। দুটো হাত দু’দিকে ছড়ানো। ওকে নাম ধরে ডাকছিল মালবাহকেরা, মেজর হাঁটুমুড়ে পাশে বসে নাড়ি দেখলেন, গলার উপরে আঙুল চেপে ধরলেন, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, ওকে সাবধানে ক্যাম্পে নিয়ে চলো।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী অবস্থা?

এখনও বেঁচে আছে। কুইক। মেজর চিৎকার করলেন।

.

অদ্ভুত ব্যাপার, ছেলেটির শরীরে কোনও ক্ষত নেই, রক্ত ঝরছেনা। শ্বাস পড়ছে কিন্তু জ্ঞান নেই। মালবাহকেরা ওর মুখে মাথায় ভেজা গামছা বুলিয়ে দিচ্ছিল। এইসময় ওদের একজন তিনকাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এল থালায় করে। মেজর। বললেন, আহা, এখন আবার চা কেন? বলে কাপ তুলে নিলেন।

ছেলেটার জ্ঞান ফিরল এগারোটা নাগাদ। নিষেধ করা সত্ত্বেও সে উঠে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। বোঝা যাচ্ছিল প্রচণ্ড শক পেয়েছে সে। কথা বলতে চেষ্টা করে কঁপছিল। মেজর তার রুকস্যাক থেকে একটা ট্যাবলেট বের করে এনে ওকে খাইয়ে দিতে বললেন। ঘণ্টা তিনেক ঘুমোতে পারবে এবং ওষুধের কল্যাণে ওর শরীর স্থিতিশীল হবে।

ওকে এই অবস্থায় যেমন নিয়ে যাওয়া যায় না, তেমনই একা ফেলে রাখাও সম্ভব নয়। কুলদীপ এবং মেজরের সঙ্গে আলোচনায় বসল অর্জুন।

কুলদীপ বলল, আপনার কি বিশ্বাস ওই লোমশ প্রাণীগুলো ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল? কিন্তু কেন? দেখে তো মনে হচ্ছে ওর শারীরিক ক্ষতি করেনি!

অর্জুন বলল, অন্য কোনও হিংস্র প্রাণী হলে শরীর অক্ষত থাকত না। এতক্ষণে অর্ধেকটাই খেয়ে ফেলত। এই লোমশ প্রাণীগুলো নিশ্চয়ই মাংসাশী নয়।

তুমি ভুলে যাচ্ছ অর্জুন, কুলদীপ খবর এনেছিল ওই গ্রাম থেকে যে ওদের দু’জনকে ওই ধরনের প্রাণী তুলে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি যখন, তখন কেন ধরে নেওয়া হবে ওরাই দু’জনকে ভক্ষণ করেছে? আবার যে মাংসাশী নয় তাও প্রমাণিত হচ্ছে না। তবে ওদের সঙ্গে এদের পার্থক্য থাকতে পারে। মেজর পাইপ ধরালেন।

একটা পার্থক্য স্পষ্ট। গ্রামে যারা এসেছিল তারা জঙ্গলের ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে এসেছিল। আর গতরাতে এরা এসেছিল নিঃশব্দে। অর্জুন বলল।

এরা মানে কতজন? মেজর তাকালেন।

সেটা বলব কী করে! কেউ তো দেখিনি! অর্জুন বলল, আমার মনে হচ্ছে এই জায়গা ছেড়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত। অথচ পরিস্থিতি যা–।

ওর সুস্থ হয়ে উঠতে আরও দুটো দিন লাগবে। মেজর বললেন, অবশ্য যদি মন থেকে ভয়টা দূর হয়ে যায়।

আরও দুটো দিন এখানে অপেক্ষা করব আমরা? কুলদীপ কথা বলল, ওরা এখানেই থাকুক। আমরা যদি এগিয়ে গিয়ে পথটা ভাল করে দেখে নিই।

দেখে কি আবার ফিরে এখানে আসবেন রাত কাটাতে? অর্জুন মাথা নাড়ল, সেটা সম্ভব নয়। ছেলেটার সঙ্গে ওদের প্রধান এখানে থেকে যাক। বাকি দু’জন যতটা পারে ততটাই মালপত্র নিয়ে আমাদের সঙ্গে চলুক। কুলদীপ ওদের বুঝিয়ে বলুন।

কুলদীপ গেল কথা বলতে। মেজর বললেন, দুপুর হয়ে গেল। আমাদের টিন ফুডের স্টক থেকে কয়েকটা বের করে নিয়ে এসো। লাঞ্চটা করে ফেলি।

মালবাহকদের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কথা বলার পর কুলদীপ ফিরে এল গম্ভীর মুখে। বলল, দাদা, প্রথমে ওরা আর এগিয়ে যেতে চাইছিল না। ছেলেটা সুস্থ হলেই ফিরে যাবে বলছিল। অনেক বোঝানোর পর দু’জন রাজি হল যেতে, ছেলেটার সঙ্গে তৃতীয়জন এখানে থেকে যাবে। কিন্তু একটা শর্তে।

মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, এক্সট্রা টাকা চাইছে?

না। বলছে ওই দু’জনের সঙ্গে আমাদের একজনকে থাকতে হবে নইলে ওরা ভরসা পাবে না। কী করা যায় বলুন।

মেজর বললেন, দরকার নেই, আমরা তিনজনেই এগিয়ে যাই। ম্যাপ বলছে এখান থেকে মাইল পাঁচেক যাওয়ার পর যে পাহাড়টায় কোনও গাছ নেই সেখানেই গুহাটা রয়েছে। তা হলে ওই পাহাড়ের কাছে গিয়ে রাত কাটিয়ে ভোরে আমরা গুহার খোঁজে যেতে পারি। নো প্রবলেম।

রাতটা কাটাবেন কোথায়?তাঁবুর বাইরে স্লিপিং ব্যাগে শুলেও আর সকালে উঠতে পারবেন না। তা ছাড়া গুহাটাকে যে একদিনেই খুঁজে পাব তারও তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। ওদের সাহায্য অবশ্যই দরকার। অর্জুন বলল।

কুলদীপ বলল, আমি বলছি, আপনারা এগিয়ে যান। আমি ওই দু’জনের সঙ্গে থাকি। যে দু’জন যাবে তারা শুধু তাঁবু, খাবার আর সামান্য সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে যাবে। ঠিক আছে?

মনঃপুত হচ্ছিল না অর্জুনের। কুলদীপ সঙ্গে থাকলে অনেক সুবিধা হত। কিন্তু মেজরকে তো বলা যাচ্ছে না, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।

অর্জুনের ভাবনা অনুমান করে কুলদীপ বলল, আপনি চিন্তা করবেন না দাদা। আমি ওদের রাজি করিয়ে কালই আপনাদের কাছে চলে আসতে পারি।

তা হলে খুব ভাল হয় কুলদীপ। কিন্তু এখানে তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। ওরা এবার আক্রমণ করতে পারে। যত পারো শুকনো কাঠ, পাতা, ডাল জোগাড় করে তাবুর চারপাশে রাখা যাতে আগুনটা সারারাত

জ্বলে। ওরা আগুন নিভে না গেলে এদিকে আসবে না। অর্জুন বলল।

চিন্তা করবেন না। এবার এলে ওদের লাশ দেখতে পাবেন ফেরার পথে। কুলদীপ চলে গেল ব্যবস্থা করতে।

মেজর বললেন, ছেলেটি বেশ ভাল।

.

কুলদীপের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা রওনা হল। যে দু’জন মালবাহক সঙ্গে যাচ্ছে, তাদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, বাধ্য হয়ে তারা হাঁটছে। একটু একটু করে পাহাড়ে উঠছিল ওরা এঁকেবেঁকে। কোনও পথ নেই। অর্জুন মাঝে মাঝে ম্যাপে চোখ বোলাচ্ছিল। ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছিল জঙ্গল। আচমকা একদঙ্গল হনুমান তাদের দেখে চিৎকার শুরু করে দিল। গাছের ডাল ভেঙে একজন ওদের দিকে ছুঁড়ে মারতেই মেজর তার উদ্দেশে গালাগাল শুরু করলেন গলা ফাটিয়ে। কিন্তু তার উচ্চারিত একটি শব্দও অর্জুন বুঝতে পারছিল না। তিনি থামলে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী ভাষায় ওদের বকলেন?

পুলু। এই ভাষাটা পৃথিবীর সব হনুমান বোঝে। গম্ভীর গলায় বললেন মেজর। অর্জুন কথা বাড়াল না।

মাইল দুয়েক হাঁটার পর মেজর ঘোষণা করলেন তিনি আচমকা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। অর্জুন মেনে নিল। আলো ফুরোতে বেশি দেরি নেই। তার উপর জোর হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় কনকনে ঠান্ডা। পাহাড়ের গায়ে তাবু ফেলা হল যাতে হাওয়াটাকে আটকানো যায়। আজ তাবুর সংখ্যা দুটো। ওপাশে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে আসা জলের ধারা থাকায় মালবাহক দু’জনের সুবিধা হল রান্না শুরু করতে। অর্জুন একটু খুঁজতেই মরা গাছ পেয়ে গেল। হয়তো ঝড়ে উপড়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগে। পাতা ঝরে গেছে। দু’জন মালবাহকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই গাছ কেটে টুকরো করতে করতে অন্ধকার নামল। যে পরিমাণ কাঠ আনল, তা সারারাত ধরে জ্বলবে। ভাত ডাল আর টিনফিশ খেয়ে মেজর স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পাইপ ধরালেন। যতদূর বুঝছি, আমরা ঠিক পথে এগোচ্ছি। বাকি তিন কিলোমিটার কাল দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাব। তারপর লাঞ্চ।

অর্জুন বলল, আমার মনে হয় লাঞ্চের জন্য না থেমে কালই গুহার সন্ধানে গেলে ভাল হয়। খুঁজতেও তো সময় লাগবে।

ম্যাপে দেখেছ? তিনপাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে যেতে হবে। লাইনটা শেষ হয়েছে দাঁড়ানো মমির মতো পাথরে। ঠিক আছে, ওই তিন পাহাড়েই ক্যাম্প করা যাবে। পরের ভোরে গুহাতে পা ফেলব। ওয়েল, অর্জুন, তুমি কী এক্সপেক্ট করছ?

কী ব্যাপারে?

উঃ। মেজর বিরক্ত হলেন, ওই গুহার ভিতরে গিয়ে কী দেখবে?

সেটা গিয়েই দেখতে পাব। আমি কিছু ভাবছি না।

কিন্তু ওই স্টিফেন ব্যাটা লিখে গেছে ওখানে সবসময় প্রেতাত্মারা পাহারা দিচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু যার একটা পেলেই রাজা হওয়া যায়। আমি অবশ্যই প্রেত ফ্রেতে বিশ্বাস করি না। ওসব ভয় দেখানোর জন্যে। কিন্তু ওই রত্নের খনি গুহাতে কে রাখল? নিশ্চয়ই তিনি আর একজন কিং সলোমন?

ভুটানে মুসলমানরা কখনওই রাজত্ব করেনি। যিনি রেখেছিলেন তিনি নিশ্চয়ই একজন ভুটানি। কিন্তু এত জায়গা থাকতে ভদ্রলোক এরকম দুর্গম জায়গায় একটা গুহার মধ্যে ধনরত্ন রাখতে যাবেন কেন? অর্জুন বলল।

তার মানে তুমি ওখানে কিছু আশা করছ না?

আপনাকে তো বললাম, গেলেই দেখা যাবে।

আশ্চর্য! তা হলে এত কষ্ট করে এলে কেন?

একটা রূপকথার খোঁজে। স্টিফেন সাহেব বলেছেন, আরও কেউ কেউ এই গুহার সন্ধান করছে। নাথুয়াতে স্যরের বাড়িতে তারাই বোধহয় হামলা করেছিল। আমি জানি না হেলিকপ্টারে তল্লাশি তারাই চালিয়েছে কি না। যারাই ওসব করুক, তাদের ধারণা গুহার ভেতর অমূল্য সম্পদ লুকানো আছে। যদি কিছু না থাকে তা হলে ফিরে গিয়ে সে কথা বললে অনেকেই আর লোভের ফঁদে পড়বে না। সেটাও একটা লাভ। আর আপনি ফিরে গিয়ে নিউ ইয়র্কের একটা ভ্রমণ পত্রিকায় এসব কথা লেখার সুযোগ পাবেন। কিন্তু আপনার তো ফটো তোলার কথা ছিল। তুলছেন না তো? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

তুমি আমার টুপিটাকে ভাল করে দেখোনি। আঙুল তুলে কপালের উপরে টুপির সামনের গোল বৃত্তটাকে দেখালেন মেজর, এটা শুধু ডিজাইন নয়। মাঝখানে ক্যামেরার লেন্স আছে। টুপির ভিতরে মিনি ক্যামেরা। এর মধ্যে গোটা দশেক রোল ভরতি হয়ে গিয়েছে। সিক্রেট ক্যামেরা। হা হা হা।

.

রাতটা নির্বিঘ্নে কাটল। প্রথম রাত জেগেছিলেন মেজর। সাড়ে বারোটা নাগাদ অর্জুনকে ডেকে তুলে চোখ বুজেছিলেন। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে দুটো হাত দু’দিকে ছড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ফিং কিসকুস।

অর্জুন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মানে কী?

পৃথিবীর ভাল হোক। এস্কিমোদের প্রাচীন শব্দ। মেজর উঠে দাঁড়ালেন। ডবল ডিমের ওমলেট আর চা খেয়ে আবার হাঁটা শুরু। অনেকটা চড়াই ভাঙার পর উতরাইও কম নয়। ক্রমশ গাছ বা বুনো ঝোঁপ শেষ হয়ে ন্যাড়া পাথর আর শুকনো পাহাড়ে চলে এল ওরা। দুপুর দুটো নাগাদ সেই তিন পাহাড়ের চুড়ো দেখতে পাওয়া গেল। সেই পাহাড়ের গায়ে পৌঁছোতেই সাড়ে তিনটে বাজল। তখনই দুরের আকাশে আওয়াজ উঠল। অর্জুন সবাইকে নিয়ে একটা বড় পাথরের আড়ালে চলে এল। মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, কী মনে হচ্ছে।

এই রুটে যদি নিয়মিত দেখা যেত তা হলে অনেকবার তাদের দেখতে পেতাম। নিশ্চয়ই হেলিকপ্টার। বলতে না বলতেই চক্কর মারতে দেখা গেল হেলিকপ্টারকে। তারপর নিচু হয়ে খানিকটা উড়ে আবার ফিরে গেল সেটা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অর্জুন বলল, নাঃ, আজ রাতে এখানেই ক্যাম্প করা যাক।

থ্যাঙ্ক ইউ। কানে যেন মধু দিলে আমার।

এবারও পাহাড়ের খাঁজ ঘেঁষে তাঁবু ফেলা হল। মুশকিলে পড়ল অর্জুন। কাছাকাছি কোথাও গাছ দূরের কথা, বুনো ঝোঁপও নেই যে তা জড়ো করে আগুন জ্বালাবে। সে গম্ভীর গলায় বলল, আজকের রাতটা জেগেই কাটাতে হবে।

কারণ কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। চারধার শুনশান, কোনও প্রাণী নেই, এমনকী পাখিও। ওই লোমওয়ালা জন্তুগুলো নিশ্চয়ই এতদূরে চলে আসে না। একমাত্র মানুষ আর পাখি ছাড়া কেউ নিজেদের এলাকার বাইরে যায় না। ঠান্ডা বাড়ছে খুব, ব্যাগের ভিতর আরামসে ঘুমিয়ে পড়ো। মেজর পকেট থেকে তরল পদার্থের ধাতব শিশি বের করে খানিকটা গলায় ঢাললেন, আঃ, আরাম হল। খাবে নাকি?

মাথা নাড়ল অর্জুন। না। সে মেজরের সঙ্গে একমত হচ্ছিল না।

সঙ্গে যা যা শীতবস্ত্র এনেছিল তার সবক’টা শরীরে চাপানো সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল হাড়ের ভিতর ঠান্ডা ঢুকছে। জড়তা কাটাতে সে হ্যাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াতেই অপূর্ব দৃশ্যটি দেখতে পেল। পশ্চিম আকাশে যেন রঙের হোলি খেলা চলছে। সোনালি আলোর সঙ্গে রুপো মিশে স্বপ্নের চেয়ে অভাবনীয় একটি ছবি তৈরি হচ্ছে, ভাঙছে, আবার অন্য ছবি হয়ে যাচ্ছে। তীব্র ঠান্ডা বাতাস সত্ত্বেও অর্জুনের মনে হচ্ছিল, এখানে এসে ধন্য হয়ে গেল।

সন্ধের মুখেই রাতের খাবার খাওয়া হয়ে গেল। অর্জুন মালবাহক দু’জনকে বলল, কোনও অবস্থাতেই তাবুর বাইরে যাবে না। আজ আমরা আগুন জ্বালতে পারছি না তাই আরও সাবধানে থাকতে হবে সবাইকে। কাল তোমাদের ছুটি। তাই আজ বেশি না ঘুমালেও চলবে।

ঘণ্টাখানেক পরে হাওয়ার তেজ আরও বাড়লে মালবাহকদের চিৎকার কানে এল। অর্জুন চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? সে তাবুর বাইরে মুখ বাড়াল।

মালবাহকেরা তাবুর সামনে এসে কাতর গলায় বলল ওই তাবুতেও তাদের ভয় করছে। মনে হচ্ছে তাঁবুর দড়ি যে-কোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে পড়বে। আজকের রাতটা যদি অর্জুনদের তাবুর এককোণে থাকতে দেওয়া হয়, তা হলে ওরা খুশি হবে। অর্জুন তাঁবুর ভিতরে তাকাল। দু’জনের পক্ষে তাবুটা ঠিকঠাক কিন্তু আরও বাকি দু’জন ঢুকলে নড়াচড়ায় অসুবিধা হবে। কিন্তু না বলতে পারল না অর্জুন।

ওরা ভিতরে ঢুকে পড়ল কয়েকটা কম্বল নিয়ে। তাবুর কোণে প্রায় গুটিসুটি মেরে ওগুলো জড়িয়ে বসে পড়ল। মেজর চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন। তাঁবুর ভিতরে হারিকেন জ্বলছে। অর্জুন তাঁবুর ঢোকার জায়গা ভাল করে বন্ধ করল। তারপর নিজের স্লিপিং ব্যাগে ফিরে গিয়ে মেজরকে জিজ্ঞাসা করল, আলো নিভিয়ে দেব?

পাগল। অন্ধকারে ওদের শরীরে পা ফেলে দিতে বলছ? মেজর বললেন।

ওরা খুব ভয় পেয়েছে।

ঠিক আছে। ওদের জিজ্ঞাসা করো ড্রিঙ্ক করবে কি না। দু’টোক দিতে পারি। মেজর বলমাত্র অদ্ভুত একটা আওয়াজ কানে এল। যেন অনেকগুলো শঙ্খ একসঙ্গে বাজছে। মেজর উঠে বসলেন, হোয়াটস দ্যাট?

বুঝতে পারছি না। প্রাকৃতিক কোনও শব্দ নয়। কিন্তু এখানে মানুষ কোথায়?

অর্জুন। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, স্টিফেন লিখেছে ওই গুহা যেসব প্রেতাত্মা পাহারা দেয় তারা বিধর্মীদের অপছন্দ করে। তুমি বা আমি বৌদ্ধ নই। আমরা যে এখানে এসেছি তা– মেজর আচমকা থেমে গেলেন। আওয়াজটা বেশ জোরে শোনা গেল। সেটা থামতেই অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি ভাবছেন ওই আওয়াজটা প্রেতাত্মারা করছে? তা হলে তো তারা আছে। তাই না?

না, আমি সে কথা বলছি না। আমি এখনও প্রেতাত্মা আছে বলে মানি না। কিন্তু আর কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। মেজর বললেন।

চলুন, দেখে আসি। অর্জুন সোজা হল।

ওকে। আমি রাজি আছি। কিন্তু মেজর কথাগুলো বলামাত্র বৃষ্টি শুরু হল। টপটপ আওয়াজ হচ্ছে তাবুর উপরে। হাওয়ায় তাবু কঁপতে শুরু করায় হারিকেনের আলো দুলছে। মেজর দ্রুত দু’টোঁক তরল পদার্থ গলায় ঢাললেন। আর তখনই বৃষ্টির শক্তি বেড়ে গেল। মাঝে মাঝে কাছাকাছি সশব্দে বাজ পড়ছে। বিদ্যুৎ যে চমকাচ্ছে তা তাঁবুর আড়াল সত্ত্বেও ওরা টের পাচ্ছিল।

অর্জুন তাঁবুর উপরের দিকে তাকাল। জল আছড়ে পড়ছে তাঁবুর গায়ে। মাঝে মাঝে জোরালো বাতাসের চাপে তাঁবুর দড়ি মচমচ করছে। যদি ছিঁড়ে যায় তাবু উড়ে যাবে। এই ঠান্ডায় জলে ভিজলে মৃত্যু অনিবার্য। মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, ছিঁড়বে না তো! ওহে, তুমলোগ ঠিক সে বাঁধা হ্যায় তো?

অর্জুন হেসে ফেলল, ঠিক করেই বেঁধেছে, ছিড়লে কিছু করার নেই।

সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল খুব কাছে। মেজর বললেন, ওটা এই তাঁবুর উপর পড়লেই আমরা এতক্ষণে ছাই হয়ে যেতাম। সেই ছাইয়ের উপর বৃষ্টির জল পড়লে গলে গড়িয়ে যেতাম খাদে। কেউ হাজার খুঁজলেও ট্রেস পেত না।

অর্জুন মেজরের কথায় কান দিচ্ছিল না। মাঝে মাঝে হাওয়ার জোর এমন বাড়ছিল যে মনে হচ্ছিল যে-কোনও মুহূর্তে দড়ি না ছিঁড়ে যাক, তাঁবুটাই ফেটে যাবে। মালবাহকদের দিকে তাকাল। অতি অল্প জায়গা নিয়ে ওরা দু’জন কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। সামান্য ক’টা টাকার জন্যে ওরা এইভাবে ঝুঁকি নেয়। বাঁচার জন্যে মানুষকে কত কষ্ট করতে হয়।

শেষপর্যন্ত তাঁবুর উপর থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে লাগল ভিতরে। ওরা স্লিপিং ব্যাগ জায়গাটা থেকে সরিয়ে নিল। হঠাৎ পাহাড়টা বেশ কেঁপে উঠল বলে মনে হল। সেইসঙ্গে ঝড় উত্তাল হতেই হারিকেনের আলো দপ করে নিভে গিয়ে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার তাঁবুর ভিতর ছড়িয়ে দিল।

মেজর চিৎকার করলেন, হোয়াট ননসেন্স।

অর্জুন চাপা গলায় বলল, প্রবাদ আছে, সর্বনাশ একা আসে না।

আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না অর্জুন। মেজর চেঁচালেন।

শুনতে পাচ্ছি। আস্তে বলুন।

অ। অন্ধকারে স্কেলটা চড়া হয়ে গিয়েছিল। এখন কী করবে?

কিছুই করার নেই। এই বৃষ্টিতে বাইরে বের হলে এখান থেকে ফেরা হবে না।

দ্যাটস রাইট। মেজর যেন মিইয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে মেজর আবার মুখ খুললেন, যদিও আমি একদম বিশ্বাস করি না কিন্তু এ কথা তো সত্যি আমরা বৌদ্ধ নই।

তা তো ঠিক। অর্জুন অন্ধকারেই মেজরের দিকে মুখ ফেরাল।

না। স্টিফেন লিখেছে যে ওই গুহায় যেসব প্রেতাত্মা পাহারা দিচ্ছে তারা বিধর্মীদের সহ্য করতে পারে না। তাই তো?

ঠিক।

তা তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই স্টিফেন ঠিক লিখেছে, তা হলে ওইসব প্রতাত্মারা কি শুধু গুহার ভিতর আটকে থাকে না কি বাইরে এসে এই পাহাড়টাকেও পাহারা দেয়?

সে কথা অবশ্য স্টিফেন সাহেব লিখে জানাননি। অর্জুন হাসল, আপনার কি মনে হচ্ছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ওই প্রেতাত্মারাই করাচ্ছে?

আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। কিন্তু যদি স্টিফেন এই সময় আমাদের সঙ্গে থাকত, তা হলে সে ওই কথাই বলত। মেজর শ্বাস ফেললেন।

.

কিন্তু চমৎকার একটা ভোর এল কয়েকঘণ্টা পরে। এক ফোঁটাও মেঘ নেই আকাশে। সোনালি রোদে সুন্দর দেখাচ্ছে পাহাড়টাকে। চা-জলখাবার খেয়ে মালবাহকদের সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে অর্জুন মেজরকে নিয়ে রওনা। হল তিনপাহাড়ের মাঝখান দিয়ে, ম্যাপের নির্দেশমতো। পিঠের রুকস্যাকে নিয়ে নিল জল, টিনফুড আর দুটো ছোট ছোট মশাল। হাতে লাঠি। টর্চ।

এদিকে শুধু পাথর ছড়ানো। তাদের আকৃতিও বেশ বড়। একটা পাথরের উপর ওঠার পর নামার জায়গা খুঁজে নিয়ে পরের পাথরের উপরে উঠতে হচ্ছিল। খানিকক্ষণ ওই কসরত করার পরে মেজর কাহিল হয়ে পড়লেন। অর্জুন বলল, একটু জিরিয়ে নিন।

আমি অবশ্য জিরোবার পক্ষপাতী নই, কিন্তু শরীরটা বিট্রে করছে আজ। মেজর পাথরের উপর বসে পাইপ ধরালে অর্জুন বলল, ওটা এইসময় খাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? আরও বেদম হয়ে পড়বেন।

প্রতিবাদ করতে গিয়েও করলেন না মেজর। পাইপের আগুন নেভালেন।

অর্জুন খুশি হল। বলল, ম্যাপ কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে গেছে।

অর্থাৎ যে ওটা তৈরি করেছিল, সে এরপরে আর যায়নি। কেন?

বুঝতে পারছি না। হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু আমরা গুহাটাকে খুঁজে বের করব কী করে?

ওই পাহাড় অবধি চলুন। যতগুলো গুহা আছে, সবগুলোতেই টু নেরে দেখব। কিন্তু এখনই অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। বিকেলের মধ্যে ফিরতে হবে আমাদের। আবার যদি ঝড়বৃষ্টি হয়–! অর্জুন বলল।

ঝড়ের কথা বাদ দাও। অন্ধকারে তো এই পাথর ডিঙিয়ে যাওয়া যাবে না। মেজর বললেন, চলো, যাওয়া যাক।

দুপুর বারোটা নাগাদ ওরা পাহাড়ের নীচে পৌঁছোতে পারল। বোতলের জল গলায় ঢাললেন মেজর। সেটা অর্জুনের হাতে দিয়ে বললেন, এবার!

আপনি বাঁদিকে যান, আমি ডানদিকে। গুহার মতো কিছু দেখতে পেলে চেঁচিয়ে ডাকবেন। অর্জুন ডানদিকের পাথর টপকে হাঁটতে লাগল।

মিনিট পনেরো পরে তার মনে হল মেজর চিৎকার করছেন। সে দুটো হাত মুখের দু’পাশে নিয়ে এসে যতটা সম্ভব জোরে জানান দিল। তারপর মেজরকে খোঁজার জন্য এগিয়ে গেল। পাহাড়টার যে জায়গাটা ইংরেজি ইউ-এর মতো হয়ে রয়েছে তার সানের পাথরে মেজর বসে ছিলেন। অর্জুনকে দেখে বললেন, পণ্ডশ্রম। নো গুহা। এদিকে কোনও গুহাই নেই।

ওঃ। আপনার গলা পেয়ে ভেবেছিলাম একটা কিছু খুঁজে পেয়েছেন। অর্জুন বলল।

মেজর হাসলেন। গুহা না পাই আর একটা জিনিস পেয়েছি। ওই ওদিকে তাকিয়ে দেখো।

মেজরের আঙুল লক্ষ করে অর্জুন দেখল পাথরের পাশে একটা বড়সড় খয়েরি রঙের খরগোশ পড়ে রয়েছে।

মেজর বললেন, বোধহয় চোখে দেখতে পেত না।

মানে?

পাথরের উপর বসে ছিল। আমায় দেখেও পালাচ্ছে না দেখে আমি একটা বড় পাথর তুলে মারতেই মরে পড়ে গেল। একসময় আমার হাতের টিপ দুর্দান্ত ছিল। বুঝলে? যাক গে, ঝলসে নিলে চমৎকার লাঞ্চ হয়ে যাবে। মেজরের কথা শুনতে শুনতে পাহাড়ের ইউ আকৃতির দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট হয়ে গেল অর্জুনের। নীচের দিকে যেন একটা গর্তের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। একটা মাঝারি আকৃতির পাথর সামনে থাকায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মেজর দেখলেন অর্জুন খরগোশের দিকে না গিয়ে পাহাড়ের খাঁজের দিকে যাচ্ছে। তিনি গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ওদিকে যাচ্ছ কেন? অর্জুন হাত তুলল, মুখে কিছু বলল না।

হ্যাঁ, পাথরের আড়ালে ওটা গর্তই। হাতের লাঠি ভেতরে ঢোকাল অর্জুন। পাথরে লাঠির ডগা বাধা পেলেও ভেতরে ঢুকছে। অর্জুন শুয়ে পড়ল। তারপর হাত এবং লাঠির সাহায্যে ছোট ঘোট পাথর সরিয়ে ধীরে ধীরে শরীরটাকে ভিতরে নিয়ে যেতে লাগল। সামনে গভীর অন্ধকার কিন্তু আর পাথরের বাধা নেই। পিছন থেকে মেজরের গলা ভেসে এল, এ তো মাটির উপর সাঁতরে যেতে হচ্ছে হে।

প্রায় আধঘণ্টা শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার পর ঝাপসা আলো চোখে পড়ল। একটু বাঁক ঘুরতেই দেখল গর্তটা বড় হয়েছে। উবু হওয়া যায়। সেইভাবে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর দেখল জায়গাটার মাথার উপর পাহাড়ের আড়াল নেই। সূর্যের আলো বেঁকেচুরেই যেন চলে এসেছে সেখানে। একটা টেনিস কোর্টের মতো জায়গাটার চারধারে ভাল করে দেখল অর্জুন। তখনই বাদুড়জাতীয় পাখিগুলোকে পাথরের আড়ালে ঝুলতে দেখতে পেল। ওখানে আলো পড়েনি, ছায়ায় মাখামাখি। ততক্ষণে মেজর এসে দাঁড়িয়েছেন, অন্তত আটত্রিশ জায়গায় হয় ছড়ে গিয়েছে, নয় কেটেছে। তা যাক। জায়গাটা তো বেশ রহস্যময় হে।

অর্জুন এগিয়ে গেল যেদিকে বাদুড়গুলো ঝুলছিল। তাকে দেখেই বোধহয় একটা বড় পাথরের উপর দিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল ওরা। অর্জুন দেখল পাহাড় আর পাথরের মধ্যে কয়েক ইঞ্চি ফাঁক আছে। সে মেজরকে বলল, শরীরে যত জোর আছে এক করে পাথরটাকে সরাতে হবে। আসুন।

ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন এইট্টি ফোর আমি ইউএসএর ওয়েট লিফটার হিসাবে ওলিম্পিকে সিলেক্টেড হয়েছিলাম। পেটখারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে পার্টিসিপেট করতে পারিনি। সেসময় যদি বলতে তা হলে একাই সরিয়ে দিতাম পাথরটাকে। ওকে। হাত লাগাও। ওয়ান, টু, থ্রি–। 

দু’জনের মিলিত শক্তিতে পাথরটা ঈষৎ নড়ল মাত্র। মেজর চেঁচালেন, একবারে না পারিলে ঠেলো শতবার।

মিনিট দশেকের চেষ্টায় পাথরটাকে নীচে গড়িয়ে ফেলা গেল। আর তখনই সুড়ঙ্গের মুখটা ওদের সামনে। অর্জুন বলল, সাবধানে এগোবেন।

অর্জুন একটু এগিয়ে টর্চ বের করে আলো ফেলল। স্যাঁতসেঁতে নোংরা সুড়ঙ্গপথটা বেশি লম্বা নয়। একটা বিশাল হলঘরের মতো জায়গা। সেখানে তাদের দেখামাত্র ঝুলন্ত বাদুড়গুলো তীব্র প্রতিবাদ করতে করতে উড়তে শুরু করল। লাঠির আঘাতে কয়েকটাকে মেরে ফেলতেই বাদুড়গুলো দ্রুত পাথরের খাঁজে খাঁজে চলে গেল। ঠিক তখনই মেজর চিৎকার করে উঠলেন। অর্জুন দেখতে পেল ওদের। তিনটে কালো লোমওয়ালা প্রাণী উলটোদিকের চাতাল মতো জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেটুকু আলো উপর থেকে চুঁইয়ে নীচে পড়ছিল, তাতেই বোঝা গেল ওরা তাদের দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রাণীগুলো লম্বায় প্রায় মানুষের মতো কিন্তু লোমভরতি মাথা বেশ ছোট। চোখ গোল। গরিলার সঙ্গে খানিকটা মিল থাকলেও ওরা কখনওই গরিলা নয়। কিন্তু ওরা কোনও শব্দ করছে না। তিনজনেই হাতে তুলে নিয়েছে বড় বড় পাথর। অর্জুনের সন্দেহ হল না, সে এদের একজনকে দেখেছে নিশ্চয় ঝরনার পাশে, এরাই একজন মালবাহককে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

আক্রান্ত হবে জেনেই টর্চের আলো ওদের মুখের উপর ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে পাথর ফেলে দু’হাতে মুখ ঢাকল ওরা। মেজর চিৎকার করলেন, অ্যাই হতচ্ছাড়া, চিচিঙ্গে, বদমায়েশ গরিলার ভাগনে। মারতে চাস আমাদের? এত বড় আস্পর্ধা? গলা ফাটিয়ে বলা শব্দগুলো ইকো হতেই অর্জুনের কানের পরদায় অসুবিধা হল। সেই আওয়াজে যেন ভয় পেল লোমশ প্রাণীগুলো। অর্জুনের মনে পড়ল, নীচেও দেখা গিয়েছিল ওরা আগুন আর জোর আওয়াজকে ভয় পায়। পিঠের রুকস্যাক থেকে একটা ছোট মশাল বের করল সে। মেজরের সংগ্রহ করা অতি আধুনিক মশাল। শিলিগুড়িতে মাত্র দুটো পাওয়া গিয়েছিল। একবার ধরালে অন্তত আধঘণ্টা জ্বলে। অর্জুন মশাল জ্বালতেই ভরদুপুর হয়ে গেল জায়গাটা। ততক্ষণে প্রাণীগুলো যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেছে। অর্জুন বলল, যতটা পারেন চিৎকার করুন। আমার পিছন পিছন আসুন।

দু’জনে চিৎকার করতে করতে প্রাণীগুলোর পালাবার পথ ধরে মশালের আলো সামনে রেখে এগোতেই দেখতে পেল দৃশ্যটা। অন্তত পনেরো-ষোলোটা পুরুষ এবং নারী লোমশ প্রাণী ঘিরে রেখেছে একটা পেল্লাই সাইজের কাঠের সিন্দুক। ভয় পাওয়া সত্ত্বেও ওরা সেখান থেকে সরছে না। উলটে দাঁত খিঁচিয়ে তাদের ভয় দেখাচ্ছে।

চাপা গলায় মেজর বললেন, ওই তো, ওই তো! ওর ভিতরেই আছে সেই সম্পদ যার কথা লিখে গেছে স্টিফেন। আঃ, একটা পিস্তল থাকলে ব্যাটাদের সরিয়ে দেওয়া যেত। এখন কী করবে? মারপিট করে পারবে?

মেজর গলা নামিয়ে কথা বলতেই ওই দল থেকে কয়েকজন সন্তর্পণে এগোতে শুরু করেছিল। তাই দেখে মেজর আবার চিৎকার করলেন, আরে! এই উল্লুক, এই মর্কট, তোদের সাহস দেখছি খুব বেড়ে গেছে…। সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীগুলো দ্রুত ফিরে গেল বাক্সটার কাছে।

আর তখনই দুম দুম আওয়াজ কানে এল। কাছাকাছি কোথাও সেই আওয়াজটা শুরু হয়ে বেড়ে চলেছে। অর্জুন দেখল প্রাণীগুলোও সেই আওয়াজে ভয়ংকর ভয় পেয়ে গেছে। তারপর প্রায় ঝড়ের মতো ওরা ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল বাক্স ছেড়ে। তখনই পায়ের তলার পাথর কেঁপে উঠল।

মেজর দ্রুত বাক্সটার কাছে পৌঁছে দুই হাতে ওর ঢাকনা খুলতে চেষ্টা করলেন। অর্জুন বুঝতে পারল শব্দটা খুব কাছে এসে গেছে। সে এগিয়ে গিয়ে মেজরকে টানল, বাঁচতে হলে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে হবে। চলুন।

কিন্তু যার জন্যে এলাম–।

মেজর আপত্তি জানালেন।

ওটা খোলার পর আর বেঁচে থাকবেন না। আসুন। অর্জুন ছুটল যেদিক দিয়ে প্রাণীগুলো পালিয়েছিল। মেজর একটু ইতস্তত করলেও শেষপর্যন্ত ওই দুমদুম আওয়াজে ভয় পেয়ে অর্জুনকে অনুসরণ করলেন।

সেই প্রাণীগুলোকে দেখতে পেল না অর্জুন কিন্তু পাহাড়ের উপরের এই পথটা নীচ থেকে দেখা যায় না বলেই তাদের সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকতে হয়েছিল। মেজর হাঁফাতে হাঁফাতে উপরে উঠতেই নীচে ভয়ংকর শব্দ হল। আচমকা একটা জলের ঝটকা নীচ থেকে ছিটকে উঠল উপরে। অর্জুন চেঁচাল, চলুন, এখান থেকে শিগগির নীচে চলুন।

এত কম সময়ে ওরা স্বাভাবিক অবস্থায় নীচে নামতে পারত না। একটা বড় পাথরের উপরে উঠে ওরা দেখল পাহাড়ে ভূমিকম্প হচ্ছে। তারপর যে সুড়ঙ্গ দিয়ে ওরা প্রথমে ঢুকেছিল সে সুড়ঙ্গ পথে প্রবল স্রোতে জল বেরিয়ে আসতে লাগল। স্রোতের চাপে সুড়ঙ্গটা বড় হয়ে গেছে। পাহাড়ের এই অংশ কঁপছে। যে পাথরের উপর অর্জুনরা আশ্রয় নিয়েছিল তার দু’পাশ দিয়ে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে নীচের দিকে। তারপর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল পাহাড়ের এদিকটা। মেজর চিৎকার করলেন, লাভা, লাভা বের হচ্ছে অর্জুন।

অসম্ভব। এখানে আগ্নেয়গিরি আছে বলে শুনিনি।

পৃথিবীর পেটভরতি লাভা আছে, যে-কোনও জায়গা দিয়ে তা বেরিয়ে আসতে পারে। ওই দেখো, জলের স্রোত থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এসব থেমে। গেলে ফিরে গিয়ে বাক্সটাকে খুলব সেই চান্স আর পেলাম না।

আপনার কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে ওই লাভার স্রোতে আমরাও ছাই হয়ে যাব। কিন্তু আমি ভাবছি ওরা কোথায় গেল। অর্জুন চারপাশে তাকাল।

ওই উজবুকগুলো?

উজবুক কি না জানি না। তবে ওরাই ওই বাক্স যুগ যুগ ধরে পাহারা দিত। ওদেরই প্রেতাত্মা বলে কল্পনা করা হত। নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ওরা কথা বলে না। হয়তো বলতে পারে না। কোথায় গেল ওরা?

আচ্ছা, এতদিন তো বেশ ছিল, আজই দুমদাম শব্দ করে পাহাড় ভেঙে জল বেরুবার কী দরকার ছিল। প্রকৃতিও শত্রুতা করল?

মেজর তাকালেন।

ভুলটা আমারই। অর্জুন বলল, ওই লোমশ প্রাণীগুলো চিৎকার শুনলে ভয় পায় বলে আমরা চেঁচিয়েছিলাম। চিৎকারের মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছিল যে তার প্রতিধ্বনিতে নিশ্চয়ই চিড় ধরেছিল পাহাড়ের ভিতর জমে থাকা আদিম জলাধারে। একবার চিড় ধরলেই জল তার রাস্তা তৈরি করে ফেলে। দুমদুম আওয়াজটা হচ্ছিল জল এবং পাহাড়ের সংঘাতের জন্য।

ধীরে ধীরে জলের স্রোত কমে এল। বহু বছর ধরে একমাত্র বৃষ্টির জল পেয়েছে ওই পাথুরে জমি। আজ তার উপর দিয়ে দুরন্ত স্রোত বয়ে নীচের খাদের দিকে চলে গেল। অর্জুন দেখল মেজর আফশোসে মাথা নাড়ছেন। বাক্সটা নিশ্চয়ই পাহাড়চাপা হয়ে রয়েছে। যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া ওই পাহাড় সরানো সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে অত পাহাড়ের চাপে বাক্স গুঁড়িয়ে গিয়েছে। হয়তো সেই গুঁড়োগুলো জলের তোড়ে ভেসে গেছে। এখন ওই। দিকটা মৃত্যুগহ্বর হয়ে রয়েছে। যাওয়ার কোনও উপায় নেই।

.

ওরা যখন কোনওরকমে তিনপাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে এল তখন শুনতে পেল, উল্লাসের আওয়াজ। একটু এগোতেই দেখতে পেল কুলদীপকে। ছুটে এসে দু’জনকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে কুলদীপ বলল, ওঃ, খুব ভয় পেয়েছিলাম। যা আওয়াজ আর তারপর যেভাবে জল ছুটে এল তাতে মনে হচ্ছিল–

আমরা আর বেঁচে নেই। মেজর বাক্যটি শেষ করলেন। তারপর একটা বড় শ্বাস ফেলে মেজর বললেন, সব শেষ হয়ে গেল হে। যে জন্যে এসেছিলাম, তা হাতছাড়া হয়ে গেল। অথচ চোখের সামনে দেখেছিলাম কাঠের বাক্সটাকে। ওই বেল্লিক লোমওয়ালাগুলোর ওখানে পাহারা দেওয়ার কী দরকার ছিল, তা হলে আমি চেঁচাতাম না। না চেঁচালে পাহাড়ে চিড় ধরত না।

অর্জুন বলল, আমিও তো চেঁচিয়েছি, না চেঁচালে–।

রাখো। একবার আমি স্যাটান আইল্যান্ডের ধারে দাঁড়িয়ে এমন চেঁচিয়েছিলাম যে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি নড়ে উঠেছিল। পুলিশ দশ ডলার ফাইন করেছিল আমাকে। মেজর বললেন।

আপনি কখন এলেন? কুলদীপকে জিজ্ঞাসা করল অর্জুন।

দুপুরবেলায়। ছেলেটা একটু সুস্থ হতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে এসেছি। কুলদীপ বলল, চলুন বিশ্রাম করবেন।

আজ চারটে তাবু টাঙানো হয়েছে। তাঁবুর ভিতর ঢুকে মেজর শুয়ে পড়লেন। অর্জুন কুলদীপকে সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলছিল। এইসময় মালবাহকদের প্রধান এসে দাঁড়াল, স্যার।

কুলদীপ মাথা নাড়ল, ক্যা?

ইয়ে চিজ পানি হঠ যানে কা বাদ আভি মিলা।

লোকটা একটা সোনালি টুকরো কুলদীপের হাতে দিল। মেজর উঠে বসলেন, দেখি। কুলদীপ তার হাতে ওটা তুলে দিলে তিনি চোখের সামনে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলেন। সলিড সোনার টুকরো। গায়ে অবোধ্য ভাষায় কিছু লেখা ছিল। নিশ্চয়ই বাক্স ভেঙে জলের স্রোতে ভেসে এসেছে। এটা একটা টুকরো, অন্তত তিরিশ-চল্লিশ গ্রাম সলিড সোনা। কী করবে?

অর্জুন বলল, বাক্স খুলতে না পেরে আফশোস করছিলেন, আপনি নিন।

না অর্জুন। পুরোটা থাকলে নেওয়ার কথা ভাবতাম, টুকরো চাই না। তুমি এটাকে রাখো। মেজর অর্জুনকে ওটা দিলে সে কুলদীপকে বলল, আমার কথায় আপনি এসেছিলেন। আপনি ভুটানি না জানলে আমরা আসতে পারতাম না। তাই আপনি রাখুন।

কুলদীপ মাথা নাড়ল, আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে যারা এটা কুড়িয়ে পেয়েছে তাদের দিলে কেমন হয়?

অর্জুন আর মেজর খুশি হয়ে মাথা নাড়লে স্বর্ণখণ্ডটি প্রধানকে দেওয়া হল।

.

দু’সপ্তাহ পরে নিউ ইয়র্ক থেকে মেজরের উত্তেজিত গলা টেলিফোনে ভেসে এল, ওহে মধ্যম পাণ্ডব, বাক্সটা খুলতে পারিনি বলে আর আফশোস নেই। আমার ক্যামেরায় যেসব ছবি উঠেছে তার প্রিন্ট লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি করতে পারি। ওই লোমশ বেল্লিকগুলোর ছবি দেখে খুব মায়া হচ্ছে হে! আমার এক বন্ধু বললেন, ওরা পৃথিবীর শেষ বনমানুষ। তারপরেই মানুষ জন্ম নিয়েছিল। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার