গোলোক স্নিগ্ধভাবে বলিলেন, থাক, দুর্গতি করে আর কাজ নেই—বিয়ে হলে, সংসার ঘাড়ে পড়লে আপনিই সব শুধরে যাবে, তবে শাসনে একটু রাখিস। কালটা বড় ভয়ানক কিনা! অরুণ আসে আর?

জগদ্ধাত্রী ভয়ে মিথ্যা বলিয়া ফেলিলেন, অরুণ? নাঃ—

গোলোক বলিলেন, ভালই। ছোঁড়াটাকে দিসনে আসতে। অনেক রকম কানাকানি শুনতে পাই কিনা।

অরুণকে সন্ধ্যা ছেলেবেলা হইতে দাদা বলিয়া ডাকে। সে বিলাত যাইবার পূর্ব পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সৌহৃর্দ্য ছিল, কিন্তু সে ব্রাহ্মণ বংশের এতটাই নীচের ধাপের যে, এই স্নেহ কখনও কোন কারণেই যে আর কোন আকারে রূপান্তরিত হইয়া উঠিতে পারে, এ সংশয় স্বপ্নেও মায়ের মনে ছায়াপাত করে নাই। কিন্তু কিছুদিন হইতে সন্ধ্যা আচরণে ও কথায়-বার্তায় মাঝে মাঝে এমনই একটা তীব্র জ্বালা আত্মপ্রকাশ করিয়া ফেলিত যে, তাঁহার মুদিত চক্ষেও তাহার আভাস পড়িত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিনিসটা এতখানিই অসম্ভব যে এ লইয়া উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করিতেন না। এখন ইহারই স্পষ্ট ইঙ্গিত অপরের মুখে শুনিয়া সহসা তিনি ধৈর্য রাখিতে পারিলেন না। তিক্তকণ্ঠে বলিয়া ফেলিলেন, শুনলে অনেক জিনিসই শোনা যায় মামা, কিন্তু আমার মেয়ের কথা নিয়ে লোকেরই বা এত মাথাব্যথা কেন?

গোলোক মৃদু হাসিয়া ধীরভাবে বলিলেন, তা সত্যি বাছা। কিন্তু, সময়ে সাবধান না হলে লোকের পোড়ার মুখও যে বন্ধ করা যায় না, জগো।

জগদ্ধাত্রী ইহারও প্রত্যুত্তরে কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু ঠিক এই সময়েই সন্ধ্যার কাণ্ড দেখিয়া তিনি ভয়ে, বিস্ময়ে ও নিদারুণ ক্রোধে নির্বাক হইয়া গেলেন। সন্ধ্যা পুকুর হইতে স্নান করিয়া বাড়ি ঢুকিতেছিল, তাহার কাপড় ভিজা, মাথার চুলের বোঝা হইতে জল ঝরিতেছে, এখনও মুছিবার অবকাশ হয় নাই—এই অবস্থায় পাশ কাটাইয়া সে দ্রুতবেগে নিজের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।

গোলোক কহিলেন, মেয়ের জ্বর বললি নে জগো? সন্ধ্যেবেলায় নেয়ে এল যে?

জগদ্ধাত্রী কেবলমাত্র জবাব দিলেন, কি জানি মামা! কিন্তু মনে মনে তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছিলেন, এ তাঁহারই বিরুদ্ধে অরুণের অপমানের গূঢ় সুকঠোর প্রতিশোধ।

গোলোক কহিলেন, এমন অত্যাচার করলে যে বাড়াবাড়িতে দাঁড়াবে!

জগদ্ধাত্রী কহিলেন, দাঁড়ালেই বা কি করব বল? ও আমার হাতের বাইরে।

গোলোক মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, তা বুঝেছি। আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করি, এ-বাড়ির কর্তাটা কে? তুই, না জামাই, না তোর মেয়ে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়