ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

যতক্ষণ বজরাখানা দেখা গেল, সদানন্দ গীত বন্ধ করিয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিল, তাহার পর বাটীতে আসিয়া শয়ন করিল। আজ তাহার মনটা ভাল ছিল না, নিদ্রাও ভাল হইল না। প্রাতঃকালে শুভদার নিকট আসিয়া বলিল, আমার এখানে খেলে হয় না?

শুভদা শুষ্কমুখে বলিল, কেন হবে না?

আমি তাই মনে করছি; আমার কেউ নেই, দু’বেলা এখানেই দুটি খাব।

শুভদা ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিল, বেশ ত।

পিসিমার শ্বশুরবাড়িতে তাঁর কতক জমিজমা আছে, সেগুলা আমিই পাইয়াছি, দু-একদিনের মধ্যেই সেখানে যাইয়া আমাকে সব দেখিয়া-শুনিয়া লইতে হইবে।

শুভদা বলিল, তা ত নিশ্চয়, না হলে কে আর দেখিবে?

তাই মনে করিতেছি যে, আমার ধানের গোলাটা এখানেই রাখিব, না হইলে চুরি যাইতে পারে।

শুভদা ভিতরের কথা বুঝিল না। বলিল, এতদিন ত চুরি যায়নি।

না যাউক, কিন্তু এখন ত যাইতে পারে?

শুভদা চুপ করিয়া রহিল।

ইহার দুই-একদিনের মধ্যেই সদানন্দর ধানের গোলা, কলাইয়ের মরাই, আলুর বোঝা, নারিকেলের ডাঁই, গুড়ের জালা সমস্ত একে একে সরিয়া আসিয়া মুখুজ্যে-পরিবারে স্থান গ্রহণ করিল।

দেখিয়া-শুনিয়া শুভদা বলিল, সদানন্দ, লোকে কি বলিবে?

সদানন্দ হাসিয়া উত্তর দিল, জিনিস আমার, লোকের নহে। আমি এইখানে খাই, এইখানে থাকি, আমার জিনিসপত্রও এইখানে থাকিবে।

বাস্তবিক পাড়ার পাঁচজনও পাঁচরকম কথা কহিতে লাগিল; কেহ বলিল, হারাণের বৌ সদাপাগলাকে জাদু করিয়াছে; কেহ কহিল, সদানন্দ একেবারে পাগল হইয়া গিয়াছে; কেহ বা এমন কথাও রটাইল যে, ছলনার সহিত সদার বিবাহ হইতেছে। সদানন্দ একথা শুনিয়া মনে মনে হাসিল; যে সম্মুখে একথা উত্থাপন করিল তাহাকে হাসিমুখে একটা রামপ্রসাদী গান শুনাইয়া দিল, কাহাকে বা রসিকতা করিয়া বলিল, আমি মরিলে তোমার নামে দুবিঘা জমি লিখিয়া দিয়া যাইব, কাহাকে বা ঈষৎ গম্ভীরভাবে বলিল, পাগলা মানুষে পাগলামি করে সেজন্য তোমরা ভাবিও না। ক্রমশঃ লোকে মুখ বন্ধ করিতে লাগিল, তবে যাহারা ঈর্ষাপরতন্ত্র তাহারা মনে মনে জ্বলিতে লাগিল। ভবতারণ গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় একথা শুনিয়া সদানন্দকে ডাকিয়া বিশেষ করিয়া উপদেশ দিয়া দিলেন।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়