ঝুম বৃষ্টি পড়ছে।

মজনু চুলায় কেতলি চাপিয়ে বিরক্ত মুখে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টি মানেই যন্ত্রণা। চা বেশি লাগবে। দুবারের জায়গায় তিনবার কেতলি বসাতে হবে। তিনবারের মত চা পাতা নেই। চা পাতা আনতে যেতে হবে। রিহার্সেলের সময় বাইরে সেতে তার ভাল লাগে না। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত না দেখলে মজা কোথায়? তা ছাড়া বৃষ্টির সময় সবাই আসেও না। রিহার্সেল ঠিকমত হয় না। আগে আগে শেষ হয়ে যায়। রিহার্সেল বাদ দিয়ে গোল হয়ে বসে গল্পগুজব করে। আগে কাজ, পরে গল্পগুজব। এ জিনিসটা এরা বোঝে না। ছাগলের দল।

কেতলিতে চায়ের পাতা ফেলে মজনু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে লাস্ট সিনটা আজও হবে না। লাস্ট সিনটাই সবচে। মারাত্মক! প্ৰায় দিনই এই সিন হচ্ছে না। আজমল সাহেব আসে না। তার নাকি মায়ের অসুখ। লাস্ট সিনে মেইন একটর হচ্ছে আজমল হুঁদা। মনজ্বর মতে আজমল সাব হচ্ছে এই টিমের দুই নম্বর একটর। এক নম্বর আসিফ সাব। এই দুই জন না থাকলে টিম কানা। তবে নতুন মেয়ে পুষ্প মন্দ না। লীনা। আপার কাছাকাছি। কিংবা কে জানে লীনা। আপার চেয়েও বোধ হয় ভাল। তবে লীনা। আপা ডায়লগ দেবার সময় শুরুর সব কথাতেই কি সুন্দর করে হাসে, এই মেয়ে সেটা করে না। এই মেয়ে একটু বেশি গম্ভীর। এই গাম্ভীৰ্যটাও ভাল লাগে। হাসিটাও ভাল লাগে। কে জানে কোনটা বেশি ভাল।

মজনু ভেতরে উঁকি দিল। উঁকি দেবার মূল কারণ আজমল হুঁদা এসেছে কি না তা দেখা।

না আসেনি।

তার মায়ের অসুখ বোধ হয় আরো বেড়েছে। এইসব বুড়া-বুড়ি মা বাবা নিয়ে বড়ো যন্ত্রণা। কাজের কাজ কিছু করে না, অসুখ বাঁধিয়ে অন্য সবের কাজের ক্ষতি করে। মনজ্বর খুবই মন খারাপ হল। এর মধ্যেও যা একটা ব্যাপার তা হচ্ছে অনেক’দিন পর লীনা। আপা এসেছে। একদম কোণার দিকের একটা চেয়ারে একা একা বসে আছে। স্টেজের উপরে আসিফ এবং পুষ্প। আসিফ নিচু গলায় পুষ্পকে কি যেন বলছে, পুষ্প মন দিয়ে শুনছে। লীনা এক দৃষ্টিতে ঐ দিকে তাকিয়ে আছে।

মজনু লীনার সামনে এসে বলল, কেমন আছেন আফা?

ভাল। তুই কেমন আছিস রে মজনু?

জি ভাল।

লীনা হাসি মুখে বলল, পুষ্প কেমন পার্ট করছে রে মজনু? তোর তো আবার সব কিছুতেই নম্বর দেয়া। পুষ্প কত নম্বর?

তিন নম্বরে আছে আফা।

দু নম্বর কে আছে?

আজমল সাব।

তাই নাকি?

জি। কাজটা অনুচিত হইছে আফা। আজমল সাবের মত লোকরে ছোড একটা পাট দিছে।

ছোট হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ রোল। তার ওপর ভর করেই তো নাটক দাঁড়িয়ে আছে।

কথাডা ঠিক।

মজনুর বড়ো ভাল লাগে। লীনা আপা তার সাথে হেলাফেলা করে কথা বলে না। তার কথা শুনে অন্যদের মত হেসে ফেলে বলে না–যা ভাগ। কি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল কেন আজমল সাবের পার্ট এত ছোট। জিনিস থাকলে ছোট পাট দিয়েও আসার মাত করা যায়।

আজমল সাব যতক্ষণ স্টেজে থাকে ততক্ষণ শরীর রক্ত গরম হয়ে থাকে। মনে হয় কি শালার দুনিয়া। লাথি মারি দুনিয়ায়।

লীনা বলল, আজ আমাকে একটু চা দিস তো মজনু। চা খেতে ইচ্ছা করছে।

আনতাছি আফা। হুঁনলাম বিদেশে যাইতেছেন?

ইন্ডিয়া যাচ্ছি, দূরে কোথাও না। তুই কার কাছে শুনলি?

বলাবলি করতেছিল। কবে যাইতেছেন। আফা?

পরশু। পরশু রাত নটার ফ্লাইটে। তোর জন্যে কি কিছু আনতে হবে?

না আফা।

আনন্দে মজনুর চোখে পানি এসেই যেত, যদি না প্রণব বাবু চেঁচিয়ে বলতেন, গাধা, চা কই? এক ঘণ্টা আগে চা দিতে বলেছি। মজনু চা আনতে গেল। চা বানাতে বানাতেই শুনল সেকেন্ড সিন হচ্ছে। সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছে। প্রতিটি ডায়ালগ তার মুখস্থ। অনেকেই যেমন গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গায়, মজনুও অভিনেতার সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় করে। তার বড়ো ভাল লাগে। এই মুহূর্তে কে করছে লেখকের ভূমিকা। তার মনে হচ্ছে সে খুব ভাল করছে। মনটা তার খানিকটা খারাপও লাগছে। এত চমৎকার অভিনয়, অথচ কেউ দেখতে পারছে না। অন্তত একজন যদি দেখত।

মজনুর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হল। মোটর সাইকেল ভট ভাট করতে করতে আজমল চলে এসেছে। লাস্ট সিনটা আজ তাহলে হবে। ঘুম ভেঙে আজ সে কার মুখ দেখেছিল কে জানে। বিউটি সেলুনের ছেলেটার মুখ বোধ হয়। ঐ ছেলেটার মুখ দেখলে তার দিনটা খুব ভাল যায়।

আজমল লীনার পাশের চেয়ারে এসে বসেছেন। সে সিটি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক। তার বিশাল চেহারা, বিশাল গোঁফ দেখে ঠিক অনুমান করা যায় না। বড়ো-সড় চেহারার মানুষগুলির গলার স্বর সাধারণত খুব কোমল হয়। আজমলের বেলায় তা হয়নি। সে কথা বললে হল কাঁপে।

লীনা বলল, আপনার মার শরীর এখন কেমন?

আজমল বলল, ভাল, মানে খুব না, খানিকটা ভাল। হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি। হাঁটুতে কি একটা অপারেশন নাকি হবে।

কবে হবে?

জানি না কবে। বউ দৌড়াদৌড়ি করছে, সে-ই জানে?

স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে আজমল ভ্রূ কুঞ্চিত করল। লীনা হাসি মুখে বলল, ভাবীর সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে?

হুঁ।

এবার কি নিয়ে ঝগড়া করলেন?

তার ধারণা আমি কোনো কিছুই দেখি না। শুধু নাটক নিয়ে থাকি।

ধারণা কি ভুল?

অবশ্যই ভুল। নিয়মিত ক্লাস করি। প্রাইভেট টিউশনি করি, প্রতিদিন সকালে বাজার করি। এরচে বেশি কোন পুরুষটা কি করে? ঝগড়া করার জন্যে অজুহাত দরকার, এটা হচ্ছে একটা অজুহাত। ঐ যে সিংহ-ছাগল ছানার গল্প। সিংহ বলল, ব্যাটা তুই জল ঘোলা করছিস কেন?…

লীনা বলল, আপনি মনে হচ্ছে ভাবীর ওপর খুব রেগেছেন।

রাগব না? অফকোর্স রাগব।— ভাবী, এটাই কি নতুন মেয়ে নাকি? বাহ, অভিনয় তো খুব ভাল করছে। একসেলেন্ট–নাম কি?

পুষ্প।

মনটা খারাপ হয়ে গেল ভাবী।

কেন?

এই মেয়েকে বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না। টেলিভিশন ছোঁ মেরে নিয়ে নেবে, তারপর আসবে ফিল্মের লোকজন। আর তা যদি নাও আসে মেয়েটির অভিনয় দেখে কোনো একজন ছেলে তার প্রেমে পড়বে। বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পর ঐ ছেলে আর মেয়েটিকে অভিনয় করতে দেবে না। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল ভাবী। খুবই খারাপ। মেয়েটার কি নাম বললেন?

পুষ্প।

আমি নিজেই তো মনে হচ্ছে প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। মাই গড়, দারুণ মেয়ে তো!

লীনা খিলখিল করে হেসে ফেলল। স্টেজ থেকে বিরক্ত চোখে আসিফ তাকাচ্ছে। লীনা হাসি বন্ধ করার জন্যে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বারান্দায় চলে গেল। তার এই জাতীয় হাসোহাসির মূল কারণ হচ্ছে যখনই গ্রুপে কোনো নতুন মেয়ে আসে, আজমল সবাইকে বলে বেড়ায় যে এই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছে।

 

আসিফ লীনাকে নিয়ে রিকশা করে ফিরছে। জলিল সাহেব একটা পিক-আপ নিয়ে এসেছিল। তিনি লিফট দিতে চাইলেন। আসিফ রাজি হল না। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়ে বাড়ি ফেরার নাকি আলাদা একটা মজা আছে।

বৃষ্টি অবশ্য থেমে গেছে। তবে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বিজলি চমকাচ্ছে। ব্যাঙ ডাকছে। ঢাকা শহরে এখনো ব্যাঙ আছে। এবং বৃষ্টি দেখলে এরা ফুলিয়ে ডাকে–এটাই একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। লীনা বলল, ব্যাঙ ডাকছে, শুনছ?

হ্যাঁ শুনছি।

গ্ৰাম গ্ৰাম লাগছে না?

কিছুটা।

এত বড় শহর হয়েও ঢাকার মধ্যে ব্যাপারটা রয়েই গেল!

হ্যাঁ। আজিমপুরের কাছে যারা থাকে। তারা শেয়ালের ডাকও শোনে। ঐ দিকটায় এখনো শেয়াল আছে।

খানাখন্দ ভরা রাস্তা। রিকশা খুব ঝাকুনি দিচ্ছে। আসিফ ডান হাত দিয়ে লীনাকে জড়িয়ে ধরল। লীনার গা একটু যেন কেঁপে উঠল। সে নিজে এতে খানিকটা অবাকও হল। এত দিন পরেও আসিফ তার গায়ে হাত রাখলে গা কেঁপে ওঠে। মনটা তরল ও দ্রবীভূত হয়ে যায়। কোথেকে যেন উড়ে আসে খানিকটা বিষন্নতা।

আসিফ বলল, শীত লাগছে লীনা?

না।

পুষ্পের অভিনয় কেমন দেখলে?

ভাল, খুব ভাল। কল্পনা করা যায় না। এমন ভাল।

আসলেই তাই।

লীনা খানিক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ও যে কেন এত ভাল অভিনয় করছে তা কি তুমি জান?

আসিফ গম্ভীর গলায় বলল, জানি।

বল তো কেন?

ধাঁধা।

হ্যাঁ, ধাঁধা। বলতে পারলে তোমার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে।

কি পুরস্কার?

লীনা ইংরেজিতে বলল, ঝড়-বৃষ্টির রাতে যে ধরনের পুরস্কারে পুরুষরা সবচে বেশি আনন্দিত হয়। সেই পুরস্কার।

আসিফ সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে সহজ গলায় বলল, মেয়েটা খুব ভাল অভিনয় করছে, কারণ সে আমার প্রেমে পড়ে গেছে। ধাঁধার জবাব কি ঠিক হয়েছে লীনা?

লীনা বেশ খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল, হ্যাঁ ঠিক হয়েছে। ব্যাপারটা তুমি কখন টের পেলে?

প্রথম দিনেই টের পেলাম। অভিনয়ের এক পর্যায়ে তার হাত ধরতে হয়। হাত ধরেছি, হঠাৎ দেখি থারথার করে তার আঙুলগুলি কাঁপছে।

ভয় থেকেও কাঁপতে পারে। নার্ভাসনেস থেকেও পারে।

তা পারে। তবে এতদিন হয়ে গেল অভিনয় করছে, এখনো তার হাত ধরলে এরকম হয়।

লীনা চুপ করে রইল। আসিফ হেসে বলল, একই ব্যাপার। কিন্তু তোমার বেলায়ও ঘটে। হাত ধরলে তুমিও কেঁপে ওঠ। তুমি নিজে বোধ হয় তা জানো না। নাকি জান?

লীনা গাঢ় স্বরে বলল, জানি।

লীনা আসিফকে কথা শেষ করতে দিল না। কথার মাঝখানেই বলল, আজিমপুরের দিকে সত্যি সত্যি শেয়াল ডাকে নাকি? এক’দিন শেয়ালের ডাক শোনার জন্যে যেতে হয়। অনেক’দিন শোনা হয়নি।

তুমি ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে আস, তারপর এক’দিন যাব।

আসিফ বা হাতে লীনার হাত মুঠো করে ধরল। লীনার আঙুল কেঁপে উঠল। আসিফ লীনার দিকে না তাকিয়েই তরল গলায় হাসল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ