দুপুরের খাওয়ার পর ফরিদ টানা ঘুম দেয়। বাংলাদেশের জল হাওয়ার জন্যে এই ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন বলে তার ধারণা। এতে মেজাজের উগ্ৰ ভাবটা কমে যায়–স্বভাব মধু হয়। ফরিদের ধারণা জাতি হিসেবে বাঙালি যে ঝগড়াটে হয়ে যাচ্ছে তার কারণ এই জাতি দুপুরে ঠিক মত ঘুমুতে পারছে না।

তার ঘুম ভাঙল বিকেল চারটায়। চোখ মেলে অবাক হয়ে দেখল। সাত-আট বছরের একটি ফুটফুটে ছেলে এবং চার-পাঁচ বছরের পরীর মত একটি মেয়ে পা তুলে তার খাটে বসে আছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শিশুদের ফরিদ কখনো পছন্দ করে না। শিশু মানেই যন্ত্রণা। ফরিদের ভুরু কুঞ্চিত। সে গম্ভীর গলায় বলল, তোমরা কে?

ছেলেটি তার চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, আমরা মানুষ।

এখানে কি চাও?

কিছু চাই না।

ছোট মেয়েটি বলল, আপনি আমাদের ধমক দিচ্ছেন কেন? ধমক দিলে আমরা ভয় পাই না।

নাম কি তোমার?

আমার নাম নিশা, ওর নাম টগর। ও আমার ভাই।

আপনার নাম কি?

এতো দেখি বড় যন্ত্রণা হলো।

আমাদের নাম জিজ্ঞেস করেছেন আমরা বললাম, এখন আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি আপনি বলবেন না কেন?

আমার নাম ফরিদ।

আপনাকে কি বলে ডাকব?

কিছু ডাকতে হবে না।

বড়দের কিছু ডাকতে হয়, চাচা, মামা, খালু এইসব।

বললাম তো কিছু ডাকতে হবে না।

নাম ধরে ডাকব?

আরো বড় যন্ত্রণা করছে তো। নামো বিছানা থেকে। নামো।

টগর এবং নিশা গম্ভীর মুখে নামল। ঘর থেকে বের হল কিন্তু পুরোপুরি চলে গেল না, পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে রইল। মাঝে মাঝে পর্দা সরিয়ে মুখ দেখায় এবং জীব বের করে ভেংচি কাটে আবার মুখ সরিয়ে নেয়। রাগে ফরিদের সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। এত সাহস এই দুই বিছুর! এল কোথেকে এইগুলো? খুব সহজে এগুলোর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এরা তার হাড় ভাজা ভাজা করে দেবে। সে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে। শিশুদের সঙ্গে তার এক ধরনের বৈরী সম্পর্ক আছে। শিশুরা তাকে নানান ভাবে যন্ত্রণা দেয়।

ফরিদ ডাকল, কাদের কাদের।

অবিকল ফরিদের মতে করে টগর বলল, কাদের-কাদের।

ফরিদ চেঁচিয়ে বলল, এই বিছু দুটাকে ঘাড় ধরে বের করে দে তো কাদের।

ছোট মেয়েটি ফরিদের মত করে বলল, এই বিছু দুটাকে ঘার ধরে বের করে দেতো।

ফরিদ প্ৰচণ্ড ক্ষোভের সঙ্গে বলল, উফ!

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি বলল–উফ!

টগর, এবং নিশা এখন যে খেলাটা খেলছে। তার নাম নকল খেলা। এই খেলা হচ্ছে মানুষকে রাগিয়ে দেবার খেলা। যাকে রাগিয়ে দেয়া দরকার তার সঙ্গে এই খেলা খেলতে হয়। সে যা বলে তা বলতে হয়। অবশ্যি বড়দের সঙ্গে এই খেলা খেলতে নেই। তবে টগর এবং নিশা দুজনেরই মনে হচ্ছে এই মানুষটা বড় হলে তার মধ্যে শিশু সুলভ একটা ব্যাপার আছে। তার সঙ্গে এই খেলা অবশ্যই খেলা যায়।

ফরিদ বিছানায় উঠে বসল। চাপা গলায় বলল, শিশুরা শোন, আমি কিন্তু প্ৰচণ্ড রেগে যাচ্ছি।

নিশা বলল, শিশুরা শোন, আমি কিন্তু প্ৰচণ্ড রেগে যাচ্ছি।

ফরিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। টগর অবিকল তার মত ভঙ্গিতে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বোনকে নিয়ে চলে গেল। দুই বিছু চলে গেছে দেখেও ফরিদের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তার কেবল মনে হচ্ছে এক্ষুনি এই দুইজন ফিরে আসবে।

রাতে রহিমার মা কাঁদো কাঁদো গলায় মিনুকে বলল, আম্মা বড় বিপদে পড়েছি।

মিনু বললেন, কি বিপদ?

নতুন ভাড়াইট্যার পুলা আর মইয়া দুইটা বড় যন্ত্রণা করে।

কি যন্ত্রণা করে?

আমি যে কথাটা কই হেরাও হেই কথাটা কয়। ভেংগায় আম্মা।

বলতে বলতে রহিমা মা কেঁদে ফেলল। মিনু অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, ছোট দুটা বাচ্চা কি করেছে এতে একেবারে কেঁদে ফেলতে হবে? বাচ্চারা এরকম করেই। সামান্য ব্যাপার নিয়ে আমার কাছে আসবে না।

টগর এবং নিশা যা করছে তাকে ঠিক সামান্য বলে উড়িয়ে দেবার পথ নেই। তারা বারান্দায় রাখা সোবাহান সাহেবের গড়গড়ায় তামাক টেনেছে। গেট বেয়ে দেয়ালের মাথায় চড়ে সেখান থেকে লাফিয়ে নিচে নেমেছে। মিনুর পানের বাটা থেকে জর্দা দিয়ে পান খেয়ে বমি করে ঘর ভাসিয়েছে। খাবার ঘরের সবগুলো চেয়ার একত্র করে রেলগাড়ি রেলগাড়ি খেলা খেলেছে। মিনু ধমক দিতে গিয়েও দিতে পারে নি। বরং মায়ায় তার মন ভরে গেছে। এই বয়সে বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বেড়ানো বেশ শক্ত তবু তিনি দীর্ঘসময় নিশাকে কোলে নিয়ে বেড়ালেন। নিশা দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে রইল। টগর বলল, তুমি আমাকে কখন কোলে নেবে? আমার ওজন বেশি না, নিশার চেয়ে মাত্ৰ পাঁচ পাউন্ড বেশি।

এরকম বাচ্চাদের উপরে কি কেউ রাগ করতে পারে?

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ