আমি কি চোখে ভুল দেখছি?

আলমের গলায় মুগ্ধ বিস্ময়। সে সত্যি সত্যি বিস্মিত। সেজেগুজে তিনজন তার হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। নায়লা শ্যামলা ধরনের মেয়ে–প্রথমদিন তাকে যতটা সুন্দর লাগছিল আজ তারচেয়ে হাজার গুণ সুন্দর লাগছে। প্রথম দিন নায়লার চোখে-মুখে চাপা অস্বস্তি ছিল। আজ সেই অস্বস্তি নেই–ঝলমলে ছটফটে ভাব।

আলম বলল, জামান, আমি কি স্বপ্ন-টপ্ন দেখছি? না কি তোরা সত্যি এসেছিস?

নায়লা বলল, আপনি কি দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকবেন, না আমাদের ভেতরে আসতে দেবেন?

এসো ভাবী, এসো। এখন থেকে আমি কিন্তু পুরোপুরি তুমি বলব–রাগ করলে করবে। কিচ্ছু আসে যায় না।

আচ্ছা বলবেন।

এবং ভাবী বলাও বন্ধ। এখন থেকে শুধুই নায়লা। জামান মনে মনে রাগ করবে। কিন্তু কোন উপায় নেই–রূপবতীকে ভাবী ডাকা যায় না। নায়লা, তোমার বাচ্চাটাকে

আমার কোলে দাও। ও কি আসবে আমার কোলে?

হাত বাড়াতেই বাবু কোলে ঝাপিয়ে পড়ল। যেন সে এর জন্যেই অপেক্ষা করছিল। আলম বলল, জামান শোন, তোকে একটা ভাল উপদেশ দিচ্ছি–বৌকে নিয়ে বাইরে যখন বেড়াতে যাবি তখন বাচ্চা রাখবি সব সময় নিজের কাছে। মারা বাড়িতে সারাক্ষণ বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকে–বাইরে গেলেও বাচ্চা-কাচ্চা তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া খুব অন্যায়। অয়ি, তারা ভেতরে আয়।

নায়লা মুগ্ধ হয়ে হোটেলের সাজসজ্জা দেখছে। সব কিছু কেমন পরিস্কার ঝকঝকে। কোথাও এক কনা ধুলো নেই। কাঠের আসবাবপত্রের দিকে তাকালে মনে হয় এই কিছুক্ষণ আগে পালিশ করা হয়েছে। দেয়ালে সূর্যাস্তের পেইনটিং। এত সুন্দর যে অকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

আলম বলল, নায়লা, তুমি নিশ্চয়ই হোটেলের বাথরুম দেখতে চাও। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি জানি মেয়ে মাত্রই হোটেলের ঘরে ঢুকলে প্রথম উঁকি দেয় বাথরুমে। কি, দেখতে চাও বাথরুম?

হুঁ।

উঁকি দাও। ঐ যে দরজা।

নায়লা লজ্জিত মুখে বাথরুমের দরজা খুলে মুগ্ধ হয়ে গেল। মার্বেলের মেঝে। এক পাশে বাথটাব। বাথটাব ভর্তি টলটলে পানি। সব কিছু ধবধবে শাদা। বাথটাবটা নীল রঙের বলে পানি হয়েছে হালকা নীল।

জামান বলল, সন্ধ্যে সাতটার দিকে আমি একবার ফাইন্যাল গোসল করি। বাথটাবে পানি ভরেছি–এমন সময় তোমরা এলে।

নায়লা নিজের অজান্তেই বলে ফেলল–আমি কখনো বাথটাবে গোসল করিনি। বলেই খুব লজ্জা পেল। এ ধরনের কথা বলা উচিত না। কেন সে বলল?

আলম বলল, নেমে পড়। কোন অসুবিধা নেই।

বাবু পানিতে যাবার জন্যে ছটফট করছে, আলমের কোলে আর থাকতে চাচ্ছে। না। আলম বলল, জামান, তুই তোর বাচ্চার কাপড়-চোপড় খুলে নেংটো করে দে। ব্যাটাকে পানিতে নামিয়ে দেই। দেখি ব্যাটা কি করে।

জামান বলল, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। শুধু শুধু ঠাণ্ডা লাগবে কেন? গরম পানি। এর মধ্যে ঝাপাঝাপি কবে খুব আরাম পাবে! দে ব্যাটাকে ছেড়ে।

বাবুকে পানিতে ছাড়া হয়েছে। কয়েকটা ছবি তোলা হয়েছে। এখন বাথরুমে শুধু নায়লা এবং বাবু। নায়লা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বাবুর হাত ধরে সে বসে আছে। বাবু বাথটাবের ভেতরে, সে বাইরে। তার খুব ইচ্ছা করছে বাবুকে কোলে নিয়ে টলটলে পানিতে বসে থাকতে। আরেকদিন এই কাজটা সে অবশ্যই করবে। গোসলের জন্যে বাড়তি কাপড় নিয়ে আসবে।

বাবু বলল, মাম্মাই পানি।

হুঁ পানি। সুন্দর পানি।

মাম্মাট সুন্দল পানি।

সুন্দল না বাবু, বল সুন্দর। সুন্দর পানি।

সুন্দল পানি।

বাবু দুই হাতে পানি ছিটাচ্ছে। পানি ছিটানোর একটা ছবি যদি নেয়া যেত। আলমকে কি বলবে–বাবুর পানি ছিটানোর একটা ছবি নিন। খাক। আরেক দিন।

জামান খাটের উপর খানিকটা জড়সড় হয়ে বসে আছে। আলম বসেছে খাটের সাইড টেবিলে। আলমের হাতে সিগারেট। আলম বলল, নে, সিগারেট ধরা।

সিগারেট খাব না।

তুই এমন মনমরা হয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ?

ক্লান্ত লাগছে। অফিস থেকে আসলাম।

অফিস থেকে এমন আধমরা হয়ে ফিরতে হয়? অফিসে কি করতে হয়? ইট ভাঙতে হয়?

জামান হাসল।

আলম বলল, তুই ডাক্তার-ফাক্তার দেখা। আমার মনে হয় তোর শরীর খারাপ। শরীর ঠিকই আছে।

তোরা আমার এখানে এসে খুব ভাল করেছিস। আমার মনটা ছিল খারাপ।

তোদের দেখে ভাল লাগছে।

মন খারাপ কেন?

অনেক ঘোরাঘুরি করলাম, বুঝলি–ব্যবসাপাতির খোঁজ-খবর করলাম। কোন ভরসা পাচ্ছি না। সবকিছুই আনস্টেবল। টাকা ইনভেস্ট যে করব, কিসের ভরসায় করব? যেখান থেকে এসেছিলাম আমাকে সেখানেই ফিরে যেতে হবে। আশা করে এসেছিলাম দেশে থাকব। আশা ভঙ্গ হয়েছে।

তোর আশা ভঙ্গ হবে কেন? ব্যবসাপাতি করে অনেকেই তো খাচ্ছে।

ব্যবসাপাতি সব কিছুতে দু নম্বরী। স্ট্রেইট ব্যবসা বলে এখানে কিছু নেই। আমার সাহসের অভাব কোন কালে ছিল না। এখন সাহসের অভাব বোধ করছি।

তুই তাহলে ফিরে যাবি ঠিক করেছিস?

হুঁ। বিয়ে করব। বউ নিয়ে ভাগবো। আমার বৌ খুঁজে পেয়েছিস?

নায়লা খুঁজে বেড়াচ্ছে।

গুড। তাড়াতাড়ি করতে হবে। হোটেলে বসে থাকতে এখন আর ভাল লাগছে না। তোর খিদে হয়েছে? খিদে হলে চল খেতে যাই।

বাসায় গিয়ে খাব।

বাসায় গিয়ে খাবি কেন? বাইরের খাবার খাস না? আমার সঙ্গে ফর্মালিটি করলে ক্ষুর দিয়ে মাথা কামিয়ে দেব।

বাবু শেষ পর্যন্ত পানি থেকে উঠেছে। ঠাণ্ডায় দীর্ঘ সময় থাকার জন্যে তার ঠোঁট নীল হয়ে আছে। সে অল্প অল্প কাঁপছে। নায়লা ভীত গলায় বলল–বাবু কেমন কাঁপছে, ওর জ্বরটর আসবে না তো?

আলম বলল, এত অস্থির হয়ো না নায়ল। বাচ্চাদের শরীর অনেক শক্ত। অল্পতে ওদের কিছু হয় না–চল খেতে যাই। দাও, বাবুকে আমার কোলে দাও।

নায়লা বলল, ও আপনার কোলে যাবে না।

অবশ্যই যাবে। বাবু এসো তো।

বাবু নায়লাকে অবাক করে গুটি গুটি পায়ে অলিমের দিকে এগুতে শুরু করেছে। আলম বলল, শিশুদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারের ক্ষমতা অসাধারণ। অনেক কিছু ওরা বড়দের চেয়ে দ্রুত ধরতে পারে–বাবু ধরে ফেলেছে, এই সুন্দর বাথটাবের মালিক আমি। আবার এই বাথটাবে নামতে হলে আমাকে খুশি রাখতে হব। এই জন্যেই সে আমার দিকে এগুচ্ছে। আমাকে তার খুব যে পছন্দ–তা কিন্তু না। শিশু এবং মহিলা এই দুই শ্রেণী নিজের স্বার্থ সম্পর্কে খুব সজাগ।

 

শেরাটনের ডাইনিং হলে খাবারের ব্যবস্থা। এক পাশে গান হচ্ছে। ফর্সা রোগা একটা ছেলে গলায় গিটার বুলিয়ে কৃত্রিম গলায় গাইছে –

Oh my mimi
Oh my mimi …

গানের সঙ্গে যে ভাবে পা নাচ্ছাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে হাঁটু থেকে তার পা খুলে আসবে। বাবু মুগ্ধ হয়ে পা নাচাননা দেখছে। নায়লা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পাশের টেবিলের দিকে। সেই টেবিলে স্বচ্ছ নেটের পোশাক পরে অফ্রিকান এক তরুণী তার ছেলেবন্ধুর সঙ্গে বসেছে। এই পোশাক পরা এবং না পরার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। নায়লা ভেবে পাচ্ছে না একটা মেয়ে কি করে এমন এক পোশাক পরে এত সহজ ভঙ্গিতে বসে থাকতে পারে। আবার কী সুন্দর হাসছে, গল্প করছে।

আলম হাসতে হাসতে বলল, নায়লা, এমন হা করে তাকিয়ে থেকো না।

আমাদের দেখার জন্যেই তো এই মেয়ে এমন কাপড় পড়েছে। দেখতে অসুবিধা কি।

অসুবিধা নেই, দেখো। নায়লা, তোমার যুক্তি সুন্দর। কথার পিঠে চট করে যুক্তি দেয়া সহজ ব্যাপার না।

নায়লা লজ্জা পেল। টেবিলটার দিকে এখন আর তাকানো যাবে না, কিন্তু নায়লার খুব ইচ্ছা মেয়েটার কাণ্ডকারখানা দেখে! এই মেয়ে কি পারবে এই পোশাকে হোটেলের বাইরে যেতে? মনে হয় না। ঢাকার রাস্তায় বের হলে তার চারদিকে ভিড় জমে যাবে।

বেয়ারারা খাবার আনতে শুরু করেছে। এত খাবার! কে খাবে এত খাবার? কত টাকা বিল হবে একবেলা খাবারের জন্যে? ন্যাপকিনের দু পাশে ঝকঝক করছে চামচ। চামচগুলি কি রূপার? দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে।

আলম বলল, ভাবী, তুমি চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছ কেন? খাওয়া শুরু কর।

নায়লা চমকে উঠল। ভাবী বলে ডাকার জন্যেই চুমকাল। এতক্ষণ নায়লা নায়লা করছিল, হঠাৎ ভাবী। সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল নায়লা ডাকেই। মানুষ কত সহজেই না অভ্যস্ত হয়।

ভাবী, আমার বিয়ের জন্যে কন্যা দেখতে শুরু করেছ?

এতক্ষণ তে নায়লা নায়লী ডাকছিলেন হঠাৎ ভাবী ডাকা শুরু করলেন কেন?

ভাবী সম্পর্কটা আমি ভুলে যাইনি। এটা বোঝাবার জন্যেই ভাবী ডাকা। মাঝে মধ্যে ডাকব। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব এখনো জবাব দাও নি–মেয়ে দেখেছ?

হুঁ, একজন দেখেছি।

নাম কি?

অরুনা।

নাম মন্দ না। দেখতে কেমন?

খুব সুন্দর।

গায়ের রঙ?

ধবধবে শাদা রঙ।

চোখের মনির রঙ কি কালো না কটা?

এত খুঁটিয়ে তো দেখিনি।

উচ্চতা?

লম্বায় আমার মতই।

ওজন? কোমরের মাপ?

নায়লা তাকিয়ে আছে। আলম বলল, শোন নায়লা, তুমি যা করবে তা হচ্ছে–একটা গজফিতা নিয়ে ঐ মেয়ের কাছে যাবে। হাইট মাপবে, কোমর মাপবে . . . ওজনটা জানবে। পার্সোনাল হেবিটস নোট করবে। অসুখ-বিসুখ কি আছে তাও জানা দরকার। যে ডাক্তারের কাছে এই মেয়ে সচরাচর যায় তাকে জিজ্ঞেস করবে …

আচ্ছা আপনি পাগলের মত এইসব কি বলছেন?

মোটেই পাগলের মত কিছু বলছি না। প্রাকটিক্যাল মানুষের মত কথা বলছি। টরেন্টোতে একটা ছেলে ছিল–বসিরুল হক নাম। দেশ থেকে বিয়ে করে বৌ নিয়ে এল। ডানাকাটা পরী বলতে যা বোঝায়, তাই। মনে হয় সদ্য ডানা কাটা হয়েছে। কাটার দাগ এখনো মিলায়নি। রূপের কম্পিটিশনে এই মেয়ে হয় মিস বাংলাদেশ হবে কিংবা রানার্স আপ হবে। যাই হোক, রূপবতীকে বিয়ে করে বসিরুল হক যে বিপদে পড়ল তার কোন তুলনা নেই। হেন রোগ নেই যা এই মেয়ের নেই। হাঁপানি আছে, বুক ধড়ফড় আছে, হিস্টিরিয়া আছে, ব্লাড প্রেসারের সমস্যা আছে। সামান্য ডায়াবেটিসও আছে। কিছু দিন আগে শুনলাম হার্টের সমস্যাও ধরা পড়েছে–ড্রপ বিট হয়, ..

নায়লা শব্দ করে হেসে উঠল। আশেপাশের টেবিলের সবাই তাকাচ্ছে। নায়লা হাসি থামাতে পারছে না।

বাবুও মার সঙ্গে হাসছে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে–বলল, মাম্মাট বাকরু।

বাকুরু হচ্ছে ভয়াবহ ধরনের সিগন্যাল। বাকরু মানে সে বাথরুমে যাবে এবং কড় কাজটি করবে।

নায়লা হাসি থামিয়ে শুকনো মুখে জামানের দিকে তাকাল। জামান বিড় বিড় করে বলল, সমস্যা হয়ে গেলো তো।

অলিম বলল, সমস্যা কি, বাবু বাথরুম করবে?

বাথরুম বন্ধ হয়ে যাওয়াটা সমস্যা। বাথরুম করতে চাওয়াটা সমস্যা না। জামান, তুই যা, ছেলেকে বাথরুম করিয়ে আন।

নায়লা বলল, ও পারবে না। আমি যাচ্ছি।

উঁহু, বাইরে এসে মায়েরা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত হবে না। নিয়ম নেই–আমি যাচ্ছি।

না না, আপনি পারবেন না।

অবশ্যই পারব। একটা শিশুকে বাথরুম করানো এমন কোন টেকনিক্যাল কাজ না যে আমি পারব না। তার আগে আমাকে দু মাসের ট্রেনিং নিতে হবে। তোমরা দুজন চালিয়ে যাও, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাদের সঙ্গে জয়েন করব। বাবু এসো!

বাবু সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়াল। নায়লার খুব লজ্জা লাগছে, বাইরের একজন মানুষ তার ছেলেকে বাথরুম করাবে, এটা কেমন কথা? মায়লা অস্বস্তি নিয়ে জামানের দিকে তাকাল। জামান স্টেজে লম্বা গিটারিস্টের গান শুনছে। মনে হচ্ছে খুব মন দিয়ে শুনছে। নায়লা বলল, খাবারগুলি তো তেমন ভাল লাগছে না। কোনটাতেই মনে হয়। লবণ হয়নি।

জামান বলল, রুচির ব্যাপার আছে। আমরা তো এইসব খেয়ে অভ্যস্ত না, এই জন্যে আমাদের কাছে ভাল লাগছে না। আমরা খাই ভাজি, ভর্তা, শুটকি, ছোট মাছ …।

নায়লা বলল, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছ না কেন? স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছি কেন?

ছেলেটার নাচানাচি দেখছি। যে ভাবে ঠ্যাং বাকাচ্ছে, মনে হয় ওর একটা হাঁটু না, দুটা হাঁটু।

নায়লা জামানের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে উঠল। জামান খুব শুকনো মুখে সিরিয়াস ভঙ্গিতে রসিকতা করে। হঠাৎ হঠাৎ করে বলেই শুনতে এত মজা লাগে। নায়লা হাসছে–জামান গম্ভীর মুখে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে তার স্ত্রীকে চেনে না।

 

রাত দশটা বেজে গেছে। জামান ভেবেছিল একটা বেবীটেক্সী নিয়ে চলে যাবে। আলম তাতে রাজি না। সে রেন্ট-এ-কার আনতে পাঠিয়েছে।

জামান বলল, সুন্দর চাদনী রাত আছে। গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণ শহরে ঘুরে তারপর বাসায় চলে যা। তোর হাই তোলা দেখে মনে হচ্ছে–নিশুতি রাত।

বাবুর মেজাজ এখন খারাপ। সে ঘন ঘন বলছে–মাম্মাট কোলা দুদু। অর্থাৎ তাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে হবে। লজ্জায় নায়লা মরে যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝতে পারছে কি-না কে জানে। বুঝতে পারলে বলে বসবে–বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবে, এতে এত লজ্জা কিসের? খাওয়াও। ভদ্রলোকের মুখে কিছু আটকায় না।

বাবু ঘ্যান ঘ্যান করছেই—মাম্মাট কোলা দুদু। মাম্মাট কোলা দুদু।

আলম বলল, মাম্মাট কোলা দুদু বাক্যটার মানে কি?

নায়লা বলল, ওর ঘুম পাচ্ছে। ঘুম পেলে এরকম বলে।

আলম বলল, জামান, তুই ওকে কোলে নিয়ে বারান্দা বরাবর খানিকটা হাঁটাহাঁটি কর। ও ঘুমিয়ে পড়ুক। সামান্য একটা গাড়ি আনতে এত দেরি করছে কেন কে জানে।

জামান ছেলেকে নিয়ে হোটেলের লবীর শেষ মাথায় চলে গেল। আলম এবং নায়লা শুধু দাড়িয়ে। আমি তাকিয়ে আছে নায়লার দিকে। হঠাৎ নায়লার কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগল। তার মনে হচ্ছে–কিছু একটা হয়েছে। চারপাশের পরিবেশ পাল্টে গেছে বা অন্য কিছু। এ রকম মনে হবার কারণ কি? নায়লার বুক ধরফড় করছে। পিপাসা বোধ হচ্ছে।

আলম সিগারেট ধরাল। লম্বা একটা টান দিয়ে বলল, নায়লা। তুমি আমার দিকে তাকাও তো।

নায়লা তাকাল।

আলম বলল, একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা তোমাকে বলা দরকার।

কি সমস্যা?

সমস্যা নিয়ে আলোচনা না করাই ভাল ছিল। কিছু কিছু সমস্যা আছে যা নিয়ে আলোচনা করতে নেই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে …

সমস্যাটা কি বলুন।

তুমি কিছু ধরতে পারছ না?

না।

আমার মনে হয় তুমি ধরতে পারছ। তুমি কোন বোকা মেয়ে নও। বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার ধারণা অসম্ভব বুদ্ধিমতী।

আমার সম্পর্কে আপনি ভুল ধারণা করেছেন। আমি মোটেই বুদ্ধিমতী না?

আলম আধ-খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে দু হাত প্যান্টে ঘসতে ঘসতে স্পষ্ট গলায় বলল, কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্যে আমি প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক কষ্টে তাকে যখন প্রায় ভুলেছি তখন তোমার সূঙ্গে দেখা। জামান কি কখনো তোমাকে বলেছে যে তুমি দেখতে হুবহু সেই মেয়েটির মত? হাসলে ঐ মেয়েটির বা গাকে টোল পড়ত। তোমারও পড়ে। এই যে তুমি আমার জন্যে মেয়ে দেখে বেড়াচ্ছি, এটা অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমার নিয়তি কি জান? আমার নিয়তি হচ্ছে এক একবার প্রেমে পড়ব। কিন্তু প্রেমিকাকে কাছে পাব না। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ভুল হয়েছে। আমি আমি … আচ্ছা বাদ দাও।

আলম আরেকটা সিগারেট ধরে কাশতে লাগল। গাড়ি চলে এসেছে। ছোট গাড়ি পায়নি, বার সীটের মাইক্রোবাস। আলম এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা কলল। জামান ছেলেকে কোলে নিয়ে স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাবু ঘুমিয়ে পড়েছে। আলম বলল, ড্রাইভারকে বলেছি তোদের নিয়ে খানিকক্ষণ ঘুরে তারপর বাসায় যাবে। আর শোন, ভাড়া আমি দিয়ে দিয়েছি। যা, গড়িতে ওঠ।

জামান বলল, তুইও আয় আমাদের সঙ্গে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসবি।

না।

নায়লা যন্ত্রের মত গাড়িতে উঠেছে। জানালার পাশে বসেছে। তার চোখ গাড়ির মেঝেতে নিবদ্ধ। সে একারও চোখ তুলে কোন দিকে তাকাচ্ছে না। বাইরে শীতল হাওয়া কিন্তু তার গরম লাগছে। খুব পানি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। বরফের কুচি মেশানো ঠাণ্ডা পানি।

ঘুমন্ত বাবুকে কোলে নিয়ে জামাল সিড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছে। নায়লা বলল, লিফটে উঠ। এক-আধবার লিফটে উঠলে কিছু যায় আসে না।

জামান বলল, না না, ঠিক হবে না। তুমি ওঠ। লিফটে ওঠ। আমি সিঁড়ি দিয়ে থেমে থেমে ওঠব। অসুবিধা হবে না।

জামান সিঁড়ি ভেঙে ওঠছে। নায়লা লিফটের বোতাম টিপে লিফটের জন্যে অপেক্ষা করছে। বাবুকে জামানের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া উচিত ছিল। কেন সে নেয়নি? সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। তার ঘুম পাচ্ছে, প্রচণ্ড ঘুম। মনে হচ্ছে সে লিফটে উঠেই ঘুমিয়ে পড়বে।

তার ঘুমুতে গেল রাত এগারোটার দিকে। নায়লা বাইরের কাপড় বদলায়নি। নতুন শাড়ি পরেই হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। মশারিও খাটানো হয়নি। সে ক্লান্ত গলায় বলল, মশারি খাঁটিয়ে বাতিটা নিভিয়ে দেবে?

তুমি কাপড় বদলাবে না?

না।

জামান মশারি খাটাল। বাবুকে ঘুমের মধ্যেই বাথরুম করিয়ে আনল। বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে এলো। খাটের দু প্রান্তে দুঞ্জন, মাঝখানে বাবু।

খুব প্রচণ্ড ধুমের কিছু সমস্যা আছে। প্রচণ্ড ঘুম নিয়ে বিছানায় যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম কেটে যায়। তখন আর ঘুম আসতে চায় না। নায়লার কি তাই হয়েছে? জামান বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম কেটে গেছে। মাথায় চাপা যন্ত্রণা নিয়ে সে শুয়ে আছে। এই যন্ত্রণা দূর হবার নয়। ঠাণ্ডা করে নিচে মাখা দিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হয়ত মাথার যন্ত্রণাটা কমত।

নায়লা বিছানায় উঠে বসল। ঘুম আসবে না, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর আর শুয়ে থাকা যায় না। জামান, বাবু দুজনেই ঘুমুচ্ছে। অন্ধকারে তাদের দেখা যাচ্ছে না–কিন্তু তারা যে আরাম করে নিঃশ্বাস ফেলছে এই শব্দ কানে আসছে …।

নায়লা অন্ধকারে পা টিপে দরজা খুলে ছাদে চলে এল।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ