জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের চিঠি নিয়ে মাকে পাবনা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে। সঙ্গে বাবা যেতে পারছেন না, তার ছুটি নেই। আব্দুর রহমান চাচার হাতে ইস্টিশন ফেলে রেখে তিনি যেতে পারেন না। ভাইয়াও যেতে পারছে না। তার নতুন চাকরি, এখনই ছুটি নিলে চাকরি নট হয়ে যাবে। তাছাড়া তাদের অফিসে এক বিদেশিনী এসেছেন। এনজিওর কাজ-কর্ম কেমন হচ্ছে তা তিনি ঘুরে দেখবেন। ভাইয়ার এখন প্রধান দায়িত্ব সেই মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরা। ভাইয়া এই কাজ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করছে। তার মুখে কয়েকদিন ধরেই এই মহিলার কথা ছাড়া অন্য কোন কথা নেই। ভদ্রমহিলার নাম এলেন। সবাই ডাকে মিস এলেন। থুড়থুড়ি বুড়ি হয়ে যাবার পরও বিয়ে করেন নি বলেই মিস এলেন। ভদ্রমহিলাকে আমি দেখেছি। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিস দেয়া। মাথায় লাল রঙের টুপি। হাঁটার সময় হাতে বেতের একটা লাঠি আছে। বুড়ো মানুষেরা যে কারণে লাঠি ব্যবহার করে উনি সেই কারণে করেন না। লাঠিটা তার শোভা।

প্রতিদিনই এই বুড়ির গল্প না বললে ভাইয়ার মনে হয় অস্থির লাগে। আমি সব গল্পই আগ্রহ করে শুনি। বুড়ি মিস এলেনের গল্প শুনতেও আমার ভালো লাগে।

বুঝলি টগর। বুড়ির স্বাস্থ্য দেখে বোঝার উপায় আছে যে চার মাইল কাদা মাখা রাস্তা সে জোর কদমে হাঁটতে পারে? আমি একেবারে থান্ডার হয়ে গেছি। হাসে আর ফুস ফুস করে সিগারেট খায়। খুবই লজ্জার কথা—একদিন আবার আমাকে সাধল। আমি মিথ্যা করে বললাম– ডােন্ট স্মােক।

তোমাকে মনে হয় খুব পছন্দ করে।

পছন্দ তো করেই। এটা নিয়ে হয়েছে সমস্যা, বাংলাদেশের কারবার। কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। অফিসে যেই টের পেয়ে গেল মিস এলেন আমাকে পছন্দ করেন। ওমি দলাদলি। ছগির বলে অফিসে খানকির পুলা আছে। আমার বদলে মিস এলেনের ডিউটি তাকে করতে দিল।

সে কী।

কোনো লাভ হয় নি। মিস এলেন পরিষ্কার বলে দিলেন—রন্টু কুটায়? রন্টু। বিদেশীদের জিব্ব্যা ভারী থাকে এরা কঠিন বাংলা শব্দ বলতে পারে না। আমাকে ডাকে রন্টু।

বাংলা জানেন?

ভালো বাংলা জানে। মাঝে মাঝে উনার বাংলা শুনে আমি থান্ডার হয়ে যাই। ঐ দিন কি হয়েছে শোন—এক বাড়িতে গিয়েছি। বাড়ির ভেতর থেকে এক লোক বের হয়ে বলল, বুইড়া মাগী কী চায়? মিস এলেন তার কথা শুনে শান্ত গলায় বললেন—মহিলাকে মাগী বলিবে না। মাগী গালাগালি ভালো নহে। ইহা অশোভন গালাগালি।

উনি তো দেখি ভালো বাংলা শিখেছেন।

বিদেশী তো। এরা ইশারাতেই সব ধরে ফেলে। আমরা ডালে ডালে চললে ওরা চলে পাতায় পাতায়। আমরা পাতায় পাতায় চললে ওরা চলে শিরায় শিরায়।

তোমার কাজে উনি খুব খুশি?

ওদের খুশি-অখুশি বোঝা মুশকিল। খুশি হলেও এরা কিছু বলবে না, আবার অখুশি হলেও কিছু বলবে না। তবে আমাকে যে অত্যন্ত স্নেহ করে এটা বোঝা যায়।

কীভাবে বুঝলে? তোমাকে কিছু বলেছেন?

আমাকে নিয়ে একটা ছড়া বানায়ে ফেলেছে—বুঝলি না।

কী ছড়া?

সাইকেল নিয়ে বের হই–টুনটুন করে ঘন্টা বাজাই সেটা নিয়ে ছড়া

সাইকেল টিং টিং
রন্টু পাগলা শিং
হা হা লাফটার
রন্টু বিগ স্টার।

মার চলে যাবার দিন ভাইয়া থাকতে পারল না। মিস এলেনকে নিয়ে তার। মুলাদী গ্রামে প্রোগ্রাম। সেই গ্রামে পনেরো জনকে সেনিটারি পায়খানা দেয়া হবে। গর্ত করে রিং স্ল্যাভ বসানো হবে। একজন বয়াতীকে আনা হয়েছে সে তার দলবল নিয়ে স্যানিটারি পায়খানার উপকারিতা নিয়ে গান করবে। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করা হবে। বিরাট ব্যবস্থা। স্যানিটারি পায়খানার গানের একটা ক্যাসেট ভাইয়া নিয়ে এসেছে। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজিয়ে সেই গান আমরা শুনেছি। ভাইয়া চোখ বড় বড় করে বললবাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে এই গান আমরা ছড়িয়ে দেব। একটা হুলুস্থুলুস পড়ে যাবে। ভাইয়া হুলুস্থুল বলতে পারে না। বলে হুলুস্থুলুস। বুঝলি টগর, লোকের মুখে মুখে গান ফিরবে। আমাদের কর্ম পদ্ধতি মারাত্মক। গানের মাধ্যমে শিক্ষা। ভাইয়া এমন ভাবে কথা বলে যেন গানটা সে নিজেই গেয়েছে। এবং এই গান গ্রামে গঞ্জে ছড়ানোর ব্যবস্থাও সে নিজেই করেছে। ভাইয়া নিজেও গোসল। করার সময় গানটা গায়। তার গলা খারাপ না, শুনতে ভালোই লাগে–

শুনেন শুনেন দশজনাতে শুনেন দিয়া মন
উন্নত পায়খানার কথা করিব বর্ণন।
আহা পায়খানারে। আহা পায়খানা রে।।
দশফুট গর্ত হবে কোনো চিন্তা নাই
তার উপরে স্লাভ বসিবে বলে দিয়া যাই
স্লাভের উপর রিং বসিবে বলি পরিষ্কার
উন্নত পায়খানা হলে চিন্তা নাইকো আর
আহা পায়খানারে। আহা পায়খানারে।।

 

মাকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে নিতে এসেছেন মায়ের দুই ভাই। দুই। জনই বয়সে মার ছোট। কিন্তু কেমন বুড়োটে দেখাচ্ছে। একজনের চুল দাড়ি পেকে শাদা। তার বোধ হয় হাঁপানি রোগও আছে। আসার পর থেকে হাঁপাচ্ছেন। মার সঙ্গে দুজনই খুব স্বাভাবিক গলায় কথা বলছেন। যেন মার। কোনো অসুখবিসুখ নেই। তিনি সুস্থ মানুষ। আমি এই দুই মামাকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। কিন্তু তারা আমার সঙ্গেও এমন ভাবে কথা বললেন যেন প্রায়ই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। দুই মামার একজনের নাম হারুন। তার চেহারা সুখি সুখি। তিনি মনে হয় কথা বলতেও পছন্দ করেন। সবার সঙ্গে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলছেন। তিনি পান খেতে খেতে মাকে বললেন–আপনার সুখের সংসার দেখে চক্ষু জুড়ায়ে গেছে বুবু। আপনার বড় ছেলের সঙ্গে এখনো দেখা হয় নাই। ছোটজনকে দেখে চক্ষু জুড়ায়ে গেছে। দুলাভাই এর কাছে শুনলাম বড়জন এনজিওতে চাকরি করে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ্ পাকের খাস রহমত ছাড়া এটা সম্ভব না।

মা মনে হয় মামার কথা কিছুই বুঝলেন না। লম্বা ঘোমটা টেনে ফিস ফিস করে বললেন—আপনাদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে?

হারুন মামা উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আমাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে মোটেই চিন্তা করবেন না বুবু। আসার পর থাইকা খাওয়া খাদ্যের উপর আছি। আপনার শরীরটা খারাপ হয়েছে শুনে অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত। তবে ইনশাল্লা সুচিকিৎসা হবে। সুস্থ হওনের পর বুবু আপনাকে দেশের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্যে নিয়া যাব। খুবই গরিবি হালতে আছি আপনার কষ্ট হবে। বাপের বাড়ির কষ্ট অবশ্য গায়ে লাগে না। দুলাভাই এর সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপ হয়েছে। দুলাভাই মত দিয়েছেন। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।

মা আবারো ফিস ফিস করে বললেন আপনাদের খাওয়াদাওয়া হয়েছে।

মার কথাবার্তার কোনো ঠিক ঠিকানা না থাকলেও তিনি তাঁর দুই ভাইকে দেখার পর থেকেই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছেন। চিৎকার হই চই নেই। ঘোমটা দিয়ে বসে আছেন। বাবা যখন বললেন—বৌ যাও কয়েকটা দিন বেড়ায়ে আস। মা সঙ্গে-সঙ্গে সুবোধ বালিকার মতো ঘাড় নাড়লেন। এবং ফিক করে হেসে ফেললেন।

রহিমা ফুপু মার সব কাপড় চোপড় গুছিয়ে দিয়েছেন। মার সুটকেসে বাবা কিছু টাকাও দিয়ে দিয়েছেন। টাকা, চিঠি লেখার পােস্ট কার্ড। বল পয়েন্ট কলম।

বৌ মনে করে চিঠি লিখবে। তোমার লিখতে ইচ্ছা না করলে, হাসপাতালে ডাক্তার আছে, নার্স আছে। তাদেরকে বললেই চিঠি লিখে দিবে। পােস্ট কার্ডে ঠিকানা লেখাও আছে।

জি আচ্ছা।

খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করবা। অষুধ পত্র খাবার ব্যাপারে অনিয়ম করবা না।

জি আচ্ছা।

সময় সুযোগ হলেই তোমাকে দেখতে যাব। প্রতি মাসেই কেউ-না-কেউ যাবে। কোনোবার আমি, কোনোবার যাবে রঞ্জু।

জি আচ্ছা।

ট্রেন বিকেলে। দুপুরের পর থেকে মাকে খুব খুশি-খুশি লাগতে লাগল। তিনি কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না, কিন্তু সবার দিকেই হাসি মুখে তাকাচ্ছেন। তাঁর চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি সবাইকে চিনতে পারছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম, মা আমাকে চিনেছ?

মা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমি বললাম, বলতো আমি কে?

মা বললেন, তুই টগর।

তোমার মাথার যন্ত্রণা কি কমে গেছে?

হ্যাঁ।

তুমি কোথায় যাচ্ছ জান?

পদ্মনগর।

তুমি পদ্মনগর যাচ্ছ না মা, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা তোমার চিকিৎসা করবে। তুমি ভালো হয়ে ফিরে আসবে।

আচ্ছা।

আমি মার গা ঘেঁসে বসে রইলাম। খুব কাছে বসলাম যেন ইচ্ছা করলেই মা আমার গায়ে হাত রাখতে পারেন। মা তা করলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন, তবে মাঝে মধ্যেই কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। তাঁর ঠোঁটে ফিক ফিক হাসি লেগেই রইল।

দুপুরে খেতে বসে দুই মামার ভেতর কী নিয়ে যেন লেগে গেল। চাপা গলায় একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছেন, কটমট করে তাকাচ্ছেন। ভয়ংকর কিছু হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু তার ফাঁকে খাওয়াদাওয়া ঠিকই করছেন। এক ভাই আবার আরেক ভাইকে সাধাসাধিও করছেন—মাছ নিবা আরেক পিস?

আমি কৌতূহলী হয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম, মামা কী হয়েছে? হারুন মামা মধুর ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বললেন, কিছু না বাপধন। সংসারী আলাপ। সংসারী আলাপে একটু আধটু হিট হয়। এইটা কিছু না।

সংসারী আলাপের রহস্য কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেল। হারুন মামা খাওয়া শেষ করে পান মুখে দিতে দিতে বাবাকে বললেন, দুলাভাই বুবুর যাতায়াত এবং চিকিৎসার খরচা আপনে বড় ভাই এর হাতে দিয়েছেন। এইটা ঠিক না। আমরা দুই জনে বুবুরে নিয়া যাইতেছি। খরচা সমান দুই ভাগ কইরা দুইজনের হাতে দেন।

বাবা বললেন, একজনের কাছে দিলেই তো হয়।

হারুন মামা বললেন, হয় না। সংসার অত সহজ না। বড় ভাই এর কাছ থাইক্যা দুইটা টাকা বাইর করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বাকি আপনার বিবেচনা। আমি আমার ব্যবসা বাণিজ্য সব ফালাইয়া রওনা হইছি আর টেকা বগলে নিয়া বইস্যা আছে আরেকজন। এই রকম হইলে তো আমার যাওয়া। সম্ভব না। আমারে বিদায় দেন।

এইসব কী বলছ?

আমি পরিষ্কার মানুষ। আমার পরিষ্কার কথা। খরচার টেকা দুই ভাগ হবে। সমান সমান ভাগ। যদি তা হয় আমি আছি। যদি না হয়—থুক্কু।

বোনের জীবন মরণ সমস্যা আর তুমি বলে ফেললে–থুক্কু।

হারুন মামা আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে বললেন, আমি পরিষ্কার মানুষ। পরিষ্কার কথা বললাম। এখন জামানা খারাপ। পরিষ্কার কথা কারোর ভালো লাগে না।

বাবা এই ঝামেলা কীভাবে মেটালেন আমি জানি না। দেখা গেল দুই ভাইই অত্যন্ত আনন্দিত মুখে বোনকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। হারুন মামা ট্রেনের জানালা থেকে গলা বের করে বললেন। দুলাভাই লিশ্চিন্ত থাকেন। আমরা দুই ভাই থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না বাকি আল্লাহপাকের মর্জি।

ট্রেনে উঠে মার আনন্দ খুব বাড়ল। তাঁর মুখে পান। একটু পর-পর তিনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে পানের পিক ফেলছেন, এবং ছোট বাচ্চাদের মতো হাসছেন।

মাকে বিদায় দিতে আমরা সবাই ইস্টিশনে এসেছি। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন কুঁজো হয়ে। দুপুরের পর থেকে তাঁর পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে। আজকের ব্যথাটা মনে হয় তীব্র। কারণ তাঁর মুখ কালো হয়ে গেছে। তিনি একটু পর পর হাতঘড়িতে সময় দেখছেন। ব্যথা উঠলেই তিনি ঘড়ি দেখেন। বাবার পাশে রহমান চাচা দাঁড়িয়ে আছেন। রহমান চাচা বাবার কানে-কানে কি যেন বলছেন। বাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ছেন। রহিমা ফুপু একটু দূরে একা দাঁড়িয়ে আছেন। সব সময় তার মাথায় ঘোমটা থাকে। আজ তার মাথায় ঘোমটা নেই। আমি দাঁড়িয়ে আছি কুসুম আপুর পাশে। কুসুম আপুর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। কুসুম আপু এত কাঁদছে কেন আমি বুঝতে পারছি না। মার সঙ্গে তার কখনোই কোনো খাতির ছিল না। মা যখন সুস্থ থাকেন তখনও কুসুম আপুর সঙ্গে কথা বলতেন না। বরং তাকে দেখলে মার ভুরু সামান্য কুঁচকে যেত। চোখের দৃষ্টি কঠিন হয়ে যেত।

ভাইয়ার ইস্টিশনে আসার কথা না। বুড়ি মিস এলেনের সঙ্গে তার প্রোগ্রাম। কিন্তু ভাইয়া ঝড়ের বেগে সাইকেল চালিয়ে উপস্থিত হল। মনে হয় সে অনেক দূর থেকে এসেছে আর শার্ট ঘামে ভেজা। চোখ লাল। বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

ভাইয়াকে দেখে বাবা অসম্ভব খুশি হলেন। মনে হল হঠাৎ তাঁর পেটের ব্যথাটা কমে গেছে। তিনি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন, বাবা যাও। মাকে কসমবুসি করে আস। ট্রেন এখন ছেড়ে যাবে। এম্নিতেই দুই মিনিট বেশি রেখেছি।

ভাইয়া নড়ল না। সাইকেল ধরে হাঁপাতে লাগল। বাবা রহমান চাচার হাত থেকে সবুজ ফ্ল্যাগ নিয়ে উড়িয়ে দিলেন। ট্রেন চলতে শুরু করল। মার দৃষ্টি এতক্ষণ এলোমেলো ছিল, ট্রেন চলতে শুরু করা মাত্র তিনি কেমন যেন অস্থির হয়ে গেলেন। অবাক হয়ে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। মনে হল কী ঘটছে তিনি বুঝতে পারছেন না।

আমরা সবাই ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসছি শুধু বাবা সবুজ ফ্ল্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ফ্ল্যাগ নাড়াচ্ছেন। ভাইয়া হঠাৎ বলল, টগর সাইকেলটা ধরত।

আমি সাইকেল ধরলাম। ভাইয়া ছুটে গিয়ে চলন্ত ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। যে জানালা দিয়ে মুখ বের করে মা আমাদের দেখছিলেন সেই জানালা দিয়ে সেও মুখ বের করল। মা হাত নাড়াচ্ছে, মার সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়াও হাত নাড়াচ্ছে।

বাবা প্লাটফর্মে বসে পড়েছেন। পেটের ব্যাথাটা আজ মনে হয় খুবই বেড়েছে। রহমান চাচা বাবার হাত ধরে আছেন। বাবা খুব কাঁদছেন। আমি কাছে যেতেই বাবা আমাকে ইশারা করলেন পাশে বসতে। আমি বসলাম। বাবা। ফিসফিস করে বললেন, রঞ্জু যে কাজটা করেছে তার জন্যে আল্লাহপাক তার উপর খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। আল্লাহপাকের সন্তোষ লাভ করা ভাগ্যের ব্যাপার। আমার বড় পুত্র বড়ই ভাগ্যবান।

বাবা খুবই কাঁদছেন। আমি বললাম, তোমার পেটে ব্যথা কি খুব বেশি? বাবা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, হ্যাঁ, ব্যাথাটা বাড়তেছে। মনে হচ্ছে পেটে। কয়লার চুলা বসায়ে কেউ রান্না করতেছে।।

রাতে বাবার ব্যথা খুবই বাড়ল। তিনি ছটফট করতে লাগলেন। রহমান। চাচা ডাক্তারকে খবর দিয়ে আনলেন। ডাক্তার সাহেব চোখ মুখ কুঁচকে বললেন, সদর হাসপাতালে নেয়া উচিৎ। এ্যাপেনডিক্স বাস্ট করলে এমন হয়, আবার ধরেন আলসারও হতে পারে। পাকস্থলী ফুটা হয়ে গেছে।

কুসুম আপু বলল, আপনার হাতে কোনো চিকিৎসা নাই?

ডাক্তার সাহেব বললেন, ঘুম চিকিৎসা আছে। ঘুম পাড়ায়ে দিতে পারি। ঘুম ভাঙলে আবার ব্যথা শুরু হবে।

দিন আপাতত ঘুম পাড়িয়ে দিন।

ডাক্তার সাহেব চারটা ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে গলা অস্বাভাবিক নিচু করে বললেন, আমার আসল সন্দেহ ক্যানসার। পুরাতন ব্যাধির কথা বললেন। তো–পুরাতন ব্যাধি একটাই ক্যানসার। হ্যাজ নো আনসার। হয়ে গেলে উপায় নাই। ডাক্তার কবিরাজ গুলে খাইয়ে দিলেও কোনো লাভ নাই। ডাক্তার কবিরাজ হজম হয়ে যাবে ক্যানসারের কিছু হবে না।

আজ সারাদিন জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের কোনো খোঁজ ছিল না। তাঁর কাছে আবারো ইন্সপেকশন টিম এসেছে। ক্রেন চালক জামশেদ দলবল নিয়ে ইন্সপেকশন টিমের সঙ্গে এসেছে। শুধু তাই না এবার দলের সাথে সত্যিকার বিদেশী ইঞ্জিনিয়ারও একজন এসেছেন। মগরা ব্রিজের রিপেয়ারের কাজ চীন সরকারের সাহায্যে হচ্ছে বলেই একজন চীনাম্যান এসেছেন। চীনাম্যানের নাম—আনতাং বা এই রকম কিছু। ব্রিজের রিপেয়ার কাজ যতদিনই চলবে ততদিনই তিনি এখানে থাকবেন।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার চীনাম্যানকে নিয়ে রাতে আমাদের বাসায় খেতে এলেন। বাবার অবস্থা দেখে দুজনই হতভম্ব। বাবা এই অসুস্থ অবস্থায়ও বিনয়ে গলে গিয়ে বারবার বলতে লাগলেন—ভেরি হ্যাপী। মাই হ্যাপীনেস নোজ নো। বাউন্ড। প্লীজ হ্যাভ রাইস৷ উই আর পুওর বেঙ্গলি। অনলী রাইস এন্ড কারি। নাথিং এলস।

চীনাম্যান বোধ হয় ইংরেজি জানে না। বাবার প্রতিটি কথায় হাসিমুখে হ্যাঁ। সূচক মাথা ঝাঁকাল। তারপর চা-টা কিছুই না খেয়ে চলে গেল।

বাবার পেট ব্যথা বাড়তেই থাকল। ডাক্তারের দেয়া ঘুমের অষুধে কিছু হল। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার আবারো ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনতে পাঠালেন। তিনি ফিরলেন ডাক্তার না নিয়েই। ডাক্তার সাহেব উত্তর পাংশায় কলে গিয়েছেন। রাতে ফিরবেন না। রহমান চাচা ডাক্তার নিয়ে না ফিরলেও ভালো খবর নিয়ে ফিরলেন। মেট্রিকের রেজাল্ট হয়েছে। কুসুম আপু পাশ করেছে।

কুসুম আপু বলল, পাশ তো অনেক রকম। আমি কী রকম পাশ করলাম?

রহমান চাচা বললেন, সেটা মা আমি জানি না। পাশ করছ এইটা জানি। পাশ করছ এর জন্যেই আল্লার দরবারে শোকর গুজার কর। তোমার ভাই রঞ্জু ফেল হয়েছিল। সে ছেলে হইয়াও কিন্তু পাশ দিতে পারে নাই। তার বুদ্ধিও কোনো অংশে কম না। বরং অত্যধিক বেশি। ছোট থেকে তারে আমি দেখেছি এই অঞ্চলে এমন কোনো ছেলে ছিল না যে তার সাথে মারবেল খেলায় পারে। দুইটা মার্বেল একটার গায়ে একটা লাইগ্যা আছে এর মধ্যেও তুমি যদি বল পশ্চিমেরটারে মার। হে পশ্চিমেরটারে মারব।

কুসুম আপু বিরক্ত হয়ে বলল, আমি যে পাশ করেছি এইটাই আপনাকে। কে বলল?

কেউ বলে নাই। আমি গাঁজাখোর মানুষ। আগবাড়াইয়া কে আমারে খবর দিব?

তাহলে জানলেন কীভাবে?

বাজারে আলোচনা।

কী অদ্ভুত কথা। আমি পাশ করেছি না ফেল করেছি এটা নিয়ে বাজারে আলোচনা হবে কেন?

সেইটা তো আম্মাজি আমি জানি না। আলোচনা হইতেছে শুনছি। বিশ্বাস করা-না-করা আপনের বিবেচনা। আমি গাঁজাখোর। গাঁজাখোর যে কথাই কয় মনে হয় মিথ্যা। এইটা হইল গাঁজাখোরের কপাল। মদখোরের কপাল আবার। ভালো। মদখোর যাই কয় সবেই ভাবে সত্য কথা বলতেছে।

রহমান চাচা সত্যি কথাই বলেছিল। কুসুম আপু পাশ করেছে এবং তার পাশ নিয়ে বাজারে আলোচনা হচ্ছে। কুসুম আপু খুব সাধারণ পাশ করে নি। ঢাকা বোর্ডে ছেলে মেয়ে সবার মধ্যে ফোর্থ হয়েছে। লেটার পেয়েছে ছয়টা। বিন্ধুবাসিনী স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব তার স্কুলের সব শিক্ষকদের নিয়ে রাত নটার সময় চলে এলেন। তিনি আরো আগেই আসতেন স্যাকরার দোকানে গোল্ডমেডাল বানাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। গোল্ড মেডালটা হেডমাস্টার সাহেব নিজ খরচায় দিচ্ছেন। তার মায়ের নামে মেডালের নাম মোসাম্মত মনোয়ারা খাতুন স্বর্ণপদক। এই স্বর্ণপদক। এই স্বর্ণপদক শুধুমাত্র বিন্দুবাসিনী স্কুলের মেয়েদের জন্যে প্রযোজ্য। এই স্কুলের কোনো মেয়ে যদি বোর্ডে দশজনের মধ্যে থাকতে পারে তবেই সে এই পদক পাবে।

বাবার পেটে ব্যথা সেরে গেল। তিনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার যে ব্যস্ততা দেখালেন তাও দেখার মতো। এত বড় সুসংবাদ নিয়ে লোকজন আসছে তাদের শুধু মুখে দেয়া যায় না। তিনি আমাকে নিয়ে মিষ্টি আনতে গেলেন। শুধু মিষ্টি না, চা পাতা, চিনি এবং চায়ের দুধও কেনা হল। এবং জাপানি ইঞ্জিনিয়ার নিজেই চা বানাতে রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন। রহিমা ফুপু একবার শুধু বলেছিলেন—ছিঃ ছিঃ আপনি কেন? জাপানি ইঞ্জিনিয়ার গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি শুধু দেখুন। চা আম ভালোই বানাতে পারি। একা। একা দীর্ঘদিন চা বানিয়ে এমন এক্সপার্ট হয়েছি। হা হা হা। জাপানে আমি একবার কম্পিটিশনে চা বানিয়ে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম।

শ্রীলংকার এক ছেলে, আমি, পাকিস্তানের একজন, ইন্ডিয়ার মাদ্রাজের একজন, আরেকজন জাপানি মেয়ে এই পাচজনের মধ্যে কম্পিটিশন। যার চা সবচে ভালো হবে সে পাবে এক হাজার ইয়েন। জাজ ছিলেন ব্রিটিশ এক ভদ্রলোক। এক হাজার ইয়েন আমিই পেয়েছিলাম।

অন্য সময় জাপানি ইঞ্জিনিয়ার মিনিটে মিনিটে কুসুম আপুর খোঁজ করেন। আজ তা করছেন না। মহানন্দে চা বানাচ্ছেন। আমি তার হেল্পার। আজ আমার সঙ্গেই গল্প করছেন। আগ্রহ নিয়েই গল্প করছেন। গল্পের বিষয়বস্তু অবশ্য কুসুম আপু।

বুঝলে টগর, তোমার বোন যখন ব্রিজের উপর থেকে ঝাঁপ দিল তখনি আমি বুঝেছি এই মেয়ে সাধারণ মেয়ে না। এ মেয়ে হল মাকিউকি টাইপ। মাকিউকি কি তাতো জান না। মাকিউকি হল যারা প্রতিভা জনিত কারণে একসেন্ট্রিক। মাকিউকি একটা জাপানি শব্দ। ভালো কথা একসেন্ট্রিক শব্দের মানে জান? একসেন্ট্রিক ইংরেজি শব্দ—এর মানে বায়ুগ্রস্ত। ঠিক পাগল না, আবার ঠিক সুস্থও না। ছোটদের সঙ্গে গল্প করার এই হল সমস্যা। প্রতিটি স্টেপ ব্যাখ্যা করে করে এগুতে হয়। গল্পের মূল ফ্লো যায় নষ্ট হয়ে। আমি কি ঠিক করেছি জান? আমি ঠিক করেছি কুসুমকে ম্যাথমেটিক্স পড়াব। ম্যাথ বিষয়ে সবার মধ্যে অকারণ ভীতি কাজ করে। ভালো ছেলেমেয়েরা আবার অন্যদের কাছে শুনে কম্পিউটার সায়েন্স এস্ট্রোফিজিক্স এইসব পড়তে চায়। সায়েন্সের মূল বিষয় হল ম্যাথ।

জি।

যদিও ম্যাথ কিন্তু বিজ্ঞান না। এই ভুলটা সবাই করে। ম্যাথ বললেই মনে করে সায়েন্স। ম্যাথ হল বিজ্ঞানকে বোঝার একটা টুল। টুল মানে জান?

জি না। টুল মানে যন্ত্রপাতি।

ও।

কুসুমের সঙ্গে কথা বলতে হবে, দেখি সে রাজি হয় কিনা। অবশ্য আমি যা বলব তাতেই সে রাজি হবে।

না, রাজি হবে না। উল্টো হবে। কুসুম আপু যা বলবে তাতেই আপনি রাজি হবেন।

কেন?

কারণ কুসুম আপুর শরীরে একটা বিশেষ চিহ্ন আছে। এই চিহ্ন যার শরীরে থাকে সব পুরুষ তার কথা শুনে।

তোমাকে কে বলেছে?

কুসুম আপু।

চিহ্নটা কী?

চিহ্নটা কী আপনাকে বলা যাবে না।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বোধ হয় সারারাত গল্প করার পরিকল্পনা ছিল। তিনি তা করতে পারলেন না। সাইট থেকে তাকে নেবার জন্যে লোক। এসেছে। চীনাম্যানের সঙ্গে ক্রেইনের ড্রাইভার জমশেদের কী নাকি গন্ডগোল হয়েছে। সিরিয়াস ঝামেলা হচ্ছে। তিনি না গেলেই না।

এত বড় একটা পাশ করার পরেও কুসুম আপু খুব স্বাভাবিক। যেন তার কিছুই হয় নি। রহিমা ফুপু বললেন, কিরে মেডেলটা খুলে রাখলি কেন। গলায় দে।

কুসুম আপু বলল, আমি কি বিড়াল যে গলায় ঘন্টা বেঁধে ঘুরব।

এটা সোনার মেডেল এটা ঘন্টা নাকি?

 

কুসুম আপু আমাকে ঘুম থেকে তুলল। ফিস ফিস করে বলল, আজ একটা আনন্দের ঘটনা ঘটেছে সেই উপলক্ষে তোকে আমি আমার চিহ্নটা দেখাব। কি দেখতে চাস? ভ্যাবদার মতো বসে থাকবি না। দেখতে চাইলে মাথা নাড়।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

কুসুম আপু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আজ না আরেক দিন।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ