ইস্টিশন
ভূমিকা

জোছনার ফুল নামে একটা টিভি নাটক বানাব, তার জন্যে সেট ফেলেছি গাজীপুরে। জঙ্গলের ভেতর রেল স্টেশনের সেট। চমৎকার সেট তৈরী হল। মেকি রেল লাইন, রেল লাইনে শোলার পাথর। হার্ডবোর্ডের মালগাড়ীর ওয়াগান। এক জোছনা রাতে আমি সেট দেখতে গেলাম জঙ্গলের ভেতর। কি সুন্দর নির্জন রেল স্টেশন! মোটেও মেকি মনে হচ্ছে না। আমি রেল লাইন ধরে অনেক্ষণ হাঁটলাম। তারপর স্টেশনের প্লাটফর্মে চুপচাপ বসে রইলাম। রেল স্টেশনে আমি একা। দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। একসময় আমার গা কেন জানি। ছমছম করতে লাগল। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথার ভেতর নির্জন গ্রামের রেল স্টেশনের গল্প ঢুকে গেল। এই হল ইস্টিশন লেখার ইতিহাস।

হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশ পল্লী, গাজীপুর।
২৮-০৮-৯৯

————

০১.

আমার বড় ভাই দ্বিতীয় বারের মতো স্কুল ফাইন্যাল ফেল করে খুবই রেগে গেল। সাধারণ রাগ না, ভয়ংকর রাগ। কাছে গেলে ফোঁসফোঁস শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। বাবা আমাকে ডেকে বললেন, কয়েক দিন ওকে ঘাঁটাবি না। দূরেদূরে থাকবি। দ্বিতীয়বার ফেলটা সব সময় মারাত্মক। তিনবার ফেল করে ফেললে আবার সব স্বাভাবিক। ফেলটা তখন ডাল ভাতের মতো হয়ে যায়। যারা এমনিতেই রাগী স্বভাবের তিনবার ফেল করার পর তাদের মধ্যেও মোলায়েম ভাব চলে আসে। গলার স্বরও মেয়েলি হয়ে যায়। তিনবার ফেলের এটাই আসল মজা।

বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, যা রঞ্জুর হাতে দিয়ে আয়। এই সময় হাতে টাকা পয়সা থাকলে মনটা শান্ত থাকে। মন শান্ত থাকা এখন বাঞ্ছনীয়। মন শান্ত না থাকলে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারে।

আমি বাবার সঙ্গে ইস্টিশনঘর পর্যন্ত যাচ্ছি। ছুটির দিনে বাবাকে ইস্টিশনঘর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া আমার অনেক দিনের অভ্যাস। আগে তার আঙ্গুল ধরে ধরে যেতাম। এখন আঙ্গুল ধরতে লজ্জা লাগে। আঙ্গুল না ধরলেও তাঁর পাশাপাশি গা ঘেঁসা চাই। বাবার গা ঘেঁসে হাঁটলে তাঁর শরীরের ঘামের। গন্ধ পাওয়া যায়। বাবার ঘামের এই গন্ধটা খুবই মজার। বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস। ফেলে বললেন, রঞ্জুর জন্যে বড়ই চিন্তাযুক্ত। উল্টাপাল্টা কিছু না করলেই হয়।

আমি বললাম, উল্টাপাল্টা কী করবে?

ধর ফাঁস নিয়ে ফেলল। তিন গজ নাইলনের দড়ি কিনে শিমুল গাছের ডালে ঝুলে পড়ল। তিন গজ এক নম্বুরি নাইলনের দড়ির দাম পনেরো টাকা। পনেরো টাকা যোগাড় করা কঠিন কিছু না। মেট্রিকের রেজাল্টের পর খুব কম হলেও দেড় দুইশ ছেলে ঝুলে পড়ে। গাছে ঝুলল, পুট করে জিব বের হয়ে পড়ল–সব শেষ।

কী সর্বনাশ!

সর্বনাশ বলে সর্বনাশ। গাছে—মাছে সর্বনাশ। স্কুলে আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল বিধু। ভালো নাম বিধায়ক আমরা ডাকতাম বিন্দু বিধু। বিন্দুর মতো ছোট খাট বলেই বিন্দু বিধু। ইংরেজীতে BB, হিন্দু তো এই জন্যে পড়াশোনায় মারাত্মক টাইপ। হিন্দুরা পেয়াজ খায় না বলে পড়াশোনায় ভাল হয়। স্কুলে বরাবর ফার্স্ট হত। এই বিধু মেট্রিকে ফেল হয়ে গেল।

তুমি পাশ করলে?

প্রথম চান্সে পারি নি। আমাদের সময় প্রথম চান্সে কেউই পারত না। বিন্দু বিধু যে বার ফেল করল সেবার আমিও ফেল। সেকেন্ড চান্সে কেটে বের হয়ে গেলাম। আমার কথা বাদ দে বিধুর কথা শোন। ও যখন দেখল পত্রিকায় রোল নাম্বার নেই–তখন গরুর গলার দড়ি খুলে নিয়ে কাঁঠাল গাছে ঝুলে পড়ল। তখন নাইলনের দড়ি ছিল না। গরুর গলার গোবর মাখা দড়িই ভরসা। বিশ্রী অবস্থা। জিব বের হয়ে আছে। ধুতি লুঙ্গির মতো প্যাঁচ দিয়ে পরেছিল সেই ধুতি খুলে পড়ে গেছে। ইয়েটা দেখা যাচ্ছে। ফাঁস নিয়ে মরা মানুষের ইয়ে আবার খুবই লম্বা হয়ে যায়। একটা নেংটা মানুষ দড়িতে ঝুলছে। কেউ যে গিয়ে ধুতি পরিয়ে দেবে সেই উপায় নেই। পুলিশ আসার আগে কিছুই করা যাবে না। যে এই কাজ করবে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবে। হাজতে ঢুকিয়ে রুলের ডলা দেবে। ফাঁসির মরা কখনো দেখেছিস?

না।

খবর্দার দেখবি না। রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ ভাত খেতে পারবি না।

বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। সিগারেট খাবার সময় বাবা কোনো কথা বলেন না। খুবই উদাস হয়ে থাকেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি খুবই দুঃখী একজন মানুষ। বাস্তবে তিনি মোটেই দুঃখী মানুষ না, হাসি খুশি মানুষ। তাঁকে আমি কখনো রাগতে দেখি নি, উঁচু। গলায় কথা বলতে শুনি নি। মা যখন বাবার সঙ্গে রাগারাগি করেন, বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে মার কথা শুনেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় মার প্রতিটি কথায় তিনি মজা পাচ্ছেন। মার রাগ যখন শেষ সীমায় চলে যায় তখন বাবা বলেন, সুরমা তোমার প্রতিটি কথাই কারেক্ট। আমি তোমার সঙ্গে এগ্রি করছি। সেন্ট পারসেন্ট এগ্রি। এখন তুমি আমাকে যা করতে বলবে, আমি করব। পায়ে

ধরতে বললে ধরব। নো প্রবলেম। স্ত্রী যদি স্বামীর পায়ে ধরতে পারে। স্বামীও পারে। এতে কোনো পাপ হয় না। স্বামী স্ত্রীর একে অন্যের পায়ে ধরা জায়েজ আছে।

বাবার এ ধরণের কথায় হঠাৎ মার মধ্যে একটা বিস্ফোরণের মতো হয়। তিনি হাতের কাছে যা পান ছুঁড়ে মারতে শুরু করেন। বাবাকে তখন খুবই অসহায় লাগে। যত অসহায়ই লাগুক এই সময় বাবার আশেপাশে থাকা খুবই বিপজ্জনক বলে আমি কখনো থাকি না। থাকি না বলেই জানি না, ঝড়টা কী ভাবে কাটে। কী ভাবে বাবা মার মধ্যে মিলমিশ হয়। শুধু এক সময় দেখা যায়। বাবা ভেতরের বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে পান খাচ্ছেন। মা আঙুলের ডগায় করে বাবার জন্যে চুন নিয়ে এসেছেন। বাবা মার আঙুল থেকে নিজের আঙুলে চুন নিয়ে আয়েশ করে জিবের ডগায় লাগাচ্ছেন। আঙুল থেকে আঙুলে চুন নেয়া খুবই অলক্ষুণে। এতে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। শুধু স্বামী স্ত্রীর বেলায় সুলক্ষণ। স্বামী-স্ত্রীর বেলাতেই শুধু আঙুল থকে আঙুলে চুন নিলে সুসম্পর্ক হয়।

বাবা বারান্দায় মোড়ায় বসে পান খাচ্ছেন আর মা আঙুলে চুন নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখতে বড় ভালো লাগে।

আচ্ছা এখন আমাদের পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমার বাবার নাম আজহার উদ্দিন। তিনি নান্দাইল রোড স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। বয়স পঞ্চাশের ওপর। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো বলে, দাঁতগুলি ধবধবে শাদা দেখায়। মনে হয় দাঁতে লাইট ফিট করা। অন্ধকারে জ্বলে। বাবা যেমন রোগা তেমন লম্বা। বাবার বন্ধুরা তাঁকে আজহার উদ্দিন ডাকে না, ডাকে তালগাছ উদ্দিন। এতে বাবা খুবই মজা পান। কেউ তাঁকে তালগাছ উদ্দিন ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে আরেকটু লম্বা হন। জোকারি করতে বাবার খুব ভালো লাগে।

আমার মার নাম সুরমা। সিলেটের এক নদীর নামে তাঁর নাম। বাবা মাঝে মাঝে আদর করে তাঁকে কুশিয়ারা ডাকেন। কুশিয়ারাও সিলেটের আরেক নদী। কুশিয়ারা নদীটা ছোট হলেও সুরমার চেয়েও নাকি সুন্দর, টলটলা পানি। নদীর তলার বালি পাথর সব দেখা যায়। মা বয়সে বাবার চেয়ে অনেক ছোট। তাঁর বয়স খুব সম্ভব পঁয়ত্রিশের মতো। সব সময় তিনি কোনো-না-কোনো অসুখে ভুগেন। যখন তাঁর কোনো অসুখবিসুখ থাকে না তখন তাঁর আধাকপালী মাথা ব্যথা হয়। এই সময় ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে তাঁকে শুয়ে থাকা লাগে। কোনো রকম শব্দ করাও তখন নিষিদ্ধ। কেউ তখন শব্দ করে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারবে না, এমন অবস্থা।

মার আধকপালী অসুখে বোধ হয় কোনো সমস্যা আছে। কারণ এই। অসুখটা যখন হয় তাঁর চেহারা তখন অন্য রকম হয়ে যায়। কী রকম অদ্ভুত করে তিনি সবার দিকে তাকান। মাঝে মাঝে এমনও হয় তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। একদিন মার এ রকম মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। আমি না জেনে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছি। অবাক হয়ে দেখি গরমের মধ্যে তিনি কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে আছেন। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–এই ছেলে এই, তোমার নাম কী? এইখানে কী চাও? যাও বাসায় যাও। দুপুর বেলা কেউ অন্যের বাড়িতে বসে থাকে, তোমার লজ্জা নাই?

আমি মার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, মা আমাকে চিনতে পারছ না। আমি টগর।

মা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর তাকানো দেখেই বুঝলাম তিনি আমাকে মোটেও চিনতে পারেন নি। মা বললেন, টগর তোর নাম? আমার সঙ্গে ফাজলামি? আমি তোর মুরুব্বি না? এই বলেই তিনি চক্ষের নিমিষে বালিশের নিচে রাখা সুপারি কাটার ছরতা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। ছরতা লেগে আমার মাথা কেটে গেল। এরপর আর কখনো আধকপালী মাথা ব্যথা উঠার সময় আমি মার ঘরে ঢুকি না।

আমার স্কুলের বন্ধুদের অনেকের ধারণা মার মাথা খারাপ। তাঁকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। এটা ঠিক না। মাকে কখনো তালাবন্ধ করে রাখা হয় না। মার যখন মাথা ব্যথা থাকে না তখন তিনি সবার সাথে মজা করেন। সবচে বেশি মজা করেন রঞ্জু ভাইয়ার সঙ্গে। মা রঞ্জু ভাইয়াকে যতটা পছন্দ করেন রঞ্জু ভাইয়া মাকে তারচে তিনগুন বেশি পছন্দ করে। মার মাথা ব্যথা অসুখ হলে–রঞ্জু ভাইয়া স্কুলে যাবে না। মার ঘরের বন্ধ দরজার আশেপাশে। ঘুর ঘুর করবে। ঘরের ভেতর থেকে খুট করে কোনো শব্দ হলেই রঞ্জু ভাইয়া বলবে–মা তোমার কিছু লাগবে? বাইরে থেকে কথা বললেও রঞ্জু ভাইয়াও অসুখের সময় মার ঘরে ঢুকবে না। আমার মতো সেও মার ঘরে ঢুকতে ভয় পায়।

মার অসুখবিসুখ এবং আধকপালী রোগে ঘরের কাজ কর্মের কোনো অসুবিধা হয় না। বাবার দূর সম্পর্কের এক বোন (রহিমা ফুপু) সব কাজ করেন। এই মহিলা আশ্চর্য ধরণের মহিলা। খুবই রূপবতী। তাঁকে দেখলে মনে। হয় তিনি সব সময় সেজেগুজে আছেন। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, শাড়িটা সুন্দর করে পরা। তাঁকে কখনো কাজ করতে দেখা যায় না, অথচ ঘরের প্রতিটি কাজ তিনি করেন। তাঁর একটা মাত্র মেয়ে কুসুম। মেয়েকে নিয়ে তিনি আমাদের সংসারে থাকেন কারণ তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রহিমা খালার মেয়েটা তাঁর মার মতোই সুন্দর। তবে চেহারা কেমন যেন ভোঁতা ভোঁতা। তার পরেও কুসুম আপুকে দেখতে খুবই ভালো লাগে। আমার সব সময় ইচ্ছা করে তার আশেপাশে থাকতে। কুসুম আপু খুবই অহংকারী। সহজ ভাবে সে তাকাতেই পারে না। সব সময় বিরক্ত চোখে তাকায়। আমি কোনো কারণে তার কাছে গেলে সে ভুরু কুচকে বলবে, এই টগর! তুই সব সময় মেয়েদের আশেপাশে ঘুরঘুর করিস কেন? মেয়েদের গায়ের গন্ধ নাকে না গেলে ভাল লাগে না? এখনই এই অবস্থা? ফাজিল কোথাকার। গন্ধ নেবার সময় হোক, তখন গন্ধ নিবি। যা সামনে থেকে।

কুসুম আপু ক্লাস টেনে পড়ে। আগামী বছর সে এস. এস. সি. দেবে। তবে রঞ্জু ভাইয়ের মতো ফেল করবে না। এক চান্সেই পাশ করবে। কুসুম আপু ছাত্রী খুবই ভালো। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। ক্লাস এইটেও বৃত্তি পেয়েছে।

আমরা থাকি রেল কোয়ার্টারে। ইস্টিশন ঘরের কাছেই লাল ইটের পাকা দালান। কোয়ার্টারটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। জায়গায় জায়গায় সেই দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে এবং সেই সব ভাঙ্গা জায়গায় আপনা আপনি লেবু গাছ গজিয়েছে। প্রকান্ড সব গাছ। খুব ফুল ফোটে, কখনো লেবু হয় না। গাছের মধ্যেও নারী পুরুষ আছে। আমাদের লেবু গাছ গুলোর মধ্যে একটা ছাড়া সবই নাকি পুরুষ। যে নারী গাছটা আছে সেটাতেও লেবু হচ্ছে না। বাবার ধারণা, পুরুষ গাছের সঙ্গে থেকে-থেকে মেয়ে গাছটার মধ্যেও পুরুষালী ভাব চলে আসছে। আমাদের। রেল কোয়ার্টারে প্রতি বর্ষায় ঘরে সাপ ঢোকে। বাস্তু সাপ বলেই কখনো মারা হয় না। তবে বাবা চিন্তিত হয়ে কার্বলিক এসিড কিনে এনে ঘরে ছড়িয়ে দেন। বাবার আবার খুবই সাপের ভয়। রেল কোয়ার্টারে তিনটা মোটে ঘর। একটাতে থাকেন মা-বাবা। একটায় রহিমা ফুপু আর কুসুম আপু। আর একটা হল বৈঠক খানা। সেখানে বড় চৌকি পাতা আছে। এই চৌকিতে থাকি আমরা দুই ভাই। রেল কোয়ার্টারের ভেতরের বারান্দার একটা অংশ বাঁশের দরমা দিয়ে ঢেকে ঘরের মতো করা হয়েছে। প্রায়ই বাবাকে সেখানে থাকতে হয়। কারণ মার আধাকপালী মাথাব্যথা উঠলে তিনি কাউকে সহ্য করতে পারেন না। তখন তিনি একা থাকেন। আমার ধারণা তখন বাবাও মাকে আমাদের মতো ভয় পান।

বারান্দায় বাবার ঘরটা খারাপ না। খুব বাতাস আসে। শুধু বর্ষা বাদলার দিনে সমস্যা হয়, বৃষ্টির পানি ঢোকে। বাবা বালিশ হাতে খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে আমাদের ঘরে ঘুমুতে আসেন। ভাইয়ার মেজাজ যেদিন ভালো থাকে সেদিন বাবা আমাদের সঙ্গে ঘুমুতে পারেন। ভাইয়ার মেজাজ খারাপ থাকলে সে রাগী রাগী গলায় বলে, এতটুকু একটা খাটে তিনজন মানুষ ঘুমাব কীভাবে? আমরা কি বামুন?

বাবা মিনমিনে গলায় বলেন, আমি রোগা মানুষ এক হাত জায়গা হলেই হবে। দড়ির মতো পড়ে থাকব। তোরা বুঝতেও পারবি না।

গরমের মধ্যে চাপাচাপি করে ঘুমাতে পারব না।

গরম কই দেখলি? ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাথা-শীত পড়ে গেছে।

কাঁথা-শীত পড়লে তুমি কাঁথা গায়ে দিয়ে থাক। আমার গরম লাগছে।

বাবা আর কথা বাড়ান না। ছাতা হাতে ইস্টিশনঘরে ঘুমাতে যান। ইস্টিশনঘরে সিন্দুকের মতো বড় একটা বাক্স আছে। সেই সিন্দুকের ওপর পাটি পাতা আছে। বাবাকে মাঝে মধ্যেই সেই সিন্দুকের বিছানায় ঘুমুতে যেতে হয়। ইস্টিশন ঘরটা খারাপ না, শুধু ঘর ভর্তি মাকড়শা। সব সময় দেখা যাবে তিন চারটা বড় বড় মাকড়শা পেটে ডিম নিয়ে ঘুরছে। বাবার ধারণা ইস্টিশন ঘরটা মাকড়শাদের মাতৃসদন। গর্ভবতী সব মাকড়শা ইস্টিশন ঘরে সন্তান খালাস করার জন্যে চলে আসে। আমি মাকড়শা ভয় পাই বলে কখনো বাবার সঙ্গে ইস্টিশন ঘরে ঘুমুতে যাই না।

সবার কথা বলতে গিয়ে আমি দেখি নিজের কথাই বলতে ভুলে গেছি। আমার নাম টগর। আমার জন্মের সময় বাবা ছিলেন বারহাট্টা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। আমাদের রেল কোয়ার্টারে দুটা টগর গাছ ছিল। দুটা গাছেই প্রচুর টগর ফুল ফুটতো। টগর ফুল দেখেই বোধ হয় বাবা আমার নাম রেখেছিলেন টগর। ফুলের নামে ছেলেদের নাম রাখলে তারা মেয়েলি স্বভাবের হয়। সামান্য কিছুতেই পুত পুত করে কাঁদে। কথাটা খুব ঠিক, আমিও কাঁদি। এবার আমি ক্লাস সিক্সে উঠেছি। রেজাল্ট আউটের দিন আমাদের ক্লাস টিচার বদরুল স্যার আমাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভেরি ব্রিলিয়ান্ট। অংকে। একশতে একশ পেয়েছে। এক নম্বর কাটা যায় নাই।

হেডস্যার হাই তুলতে তুলতে বললেন, ও।

বদরুল স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হেড স্যারকে কদমবুসি করে দোয়া নে। গাবগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? দোয়া নিবি না?

আমি কদমবুসি করলাম। হেডস্যার বিরস গলায় বললেন, মন দিয়ে।

লেখাপড়া করবি। Knowledge is power মনে থাকে যেন। Knowledge বানান কর দেখি।

আমি নলেজ বানান করলাম। হেডস্যার বললেন, রাস্তাঘাটে যদি কোনো দিন দেখি হাতে বিড়ি সিগারেট তাহলে কিন্তু টান দিয়ে কান ছিড়ে ফেলব। ছেড়া কান পার্সেল করে মক্কা শরীফে পাঠিয়ে দেব। যা এখন।

বদরুল স্যার আমাকে নিয়ে বের হয়ে এলেন। তিনি অবিশ্যি আমাকে ছেড়ে দিলেন না। নিয়ে গেলেন এসিসটেন্ট হেড স্যারের ঘরে। ঠিক আগের মতো গলায় বললেন, ভেরি ব্রিলিয়ান্ট অংকে একশতে একশ পেয়েছে। এক নম্বরও কাটা যায় নাই। চৌবাচ্চার অংকটা কেউ রাইট করতে পারে নাই। সে রাইট করেছে।

এসিসটেন্ট হ্যাডস্যার হাই তুলতে তুলতে বললেন, কার ছেলে?

স্টেশন মাস্টার সাহেবের ছেলে। যে সেকেন্ড হয়েছে তার সাথে এই ছেলের একশ আঠারো নম্বরের ডিফারেন্স।

এসিসটেন্ট হেড মাস্টার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, মুসলমানের ছেলে–জাত সাপ হয়ে জন্মায়। কিছুদিন পরেই হয়ে যায় ঢোঁরা সাপ। বিষের কারবার নাই। শুধুই ডােরাকাটা। শুধুই ফোঁসফোঁস। দেখবেন এক চান্সে এস এস সি পাস করবে না। অংকে একশ পেয়েছে বললেন না? গোল্লা খাবে সেই অংকে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে লিখে রাখেন। অনেক তো দেখলাম।

বদরুল স্যার এসিসটেন্ট হেডস্যারের কথায় মন খারাপ করলেন। তবে দমলেন না। আমাকে নিয়ে গেলেন টিচার্স কমন রুমে। তখন কী জন্যে জানি

আমার চোখে পানি আসি পানি আসি ভাব হল। ফুলের নাম রাখার এই সমস্যা, কারণ ছাড়াই চোখে পানি আসবে। বদরুল স্যার থমথমে গলায় বললেন, ছাগলের মতো কাঁদছিস কেন? খবর্দার কাঁদবি না। বেটাছেলেদের জীবনে একবার মাত্র কাঁদার পারমিশন আছে। Only once. সেই একবারটা একেক জনের জন্যে একেক রকম। কান্না বন্ধ কর। চোখ মুছ।

তিনি পকেট থেকে একটা এক টাকার নোট বের করে বললেন, যা বাদাম কিনে খা। আর শোন বাড়িতে গিয়ে বাবা মা সবাইকে কদমবুসি করে দোয়া নিবি। মুরুব্বিদের দোয়া হল লাইফ জ্যাকেটের মতো। লাইফ জ্যাকেট ছাড়া সমুদ্র পার হওয়া যায় না। দুনিয়াটা হল সমুদ্র। আমি তোর অংক খাতা দেখে খুবই খুশি হয়েছি। আজকে আছরের নামাজের সময় তোর জন্যে খাস দিলে দোয়া করবো। আছর ওয়াক্তের দোয়া কোনোসময় বিফল হয় না। কারন আছর ওয়াক্তে ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন এবং আছর ওয়াক্তেই কেয়ামত হবে।

বদরুল স্যারকে আমি খুব পছন্দ করি। শুধু আমি একা না, স্কুলের সব। ছাত্র পছন্দ করে। অথচ তিনিই এই স্কুলের সবচে রাগী স্যার। তিনি অনেক ধরনের ধমক দিতে পারেন। তাঁর সবচে কঠিন ধমকের নাম–পিসাব ধমক। এই ধমক যে খায় সে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। আবার এমনও ইতিহাস আছে যাকে পিসাব ধমক দিয়েছেন তার কিছু হয় নি কিন্তু তার পাশে বসা ছাত্রের কারবার হয়ে গেছে।

বদরুল স্যারেরও আমার মার মতো সমস্যা আছে। স্কুলের বাইরে কোনো ছাত্রকে তিনি চিনতে পারেন না। সালাম দিলে মাথা ঝুকিয়ে সালাম নেন মুখের দিকে তাকান। বিড়বিড় করেন কিন্তু চিনতে পারেন না। একবার আমি রাস্তায় স্যারকে সালাম দিলাম। স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন–ওয়ালাইকুম সালাম। জি আমি ভালো আছি।

 

আমার প্যান্টের পকেটে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট। পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমি নোটটা ধরে আছি এবং খুঁজে বেড়াচ্ছি ভাইয়াকে। তাকে খুঁজে পাওয়া। তেমন কঠিন না। বেশির ভাগ সময় ভাইয়া ইস্টিশনের চায়ের স্টলে বসে। থাকে। তবে কখনো চা খায় না। চা নাকি তার কাছে মিষ্টি গরম পানির মতো লাগে। পয়সা খরচ করে গরম পানি খাওয়ার দরকার কী? পানি যত ঠাণ্ডা তত। মজা।

কিছুদিন আগেও ইস্টিশনে দুটা চায়ের স্টল ছিল মুসলিম টি স্টল এবং হিন্দু টি স্টল। এখন হিন্দু টি স্টলটা উঠে গেছে। মুসলিম টি স্টলও উঠি উঠি। করছে, কাস্টমার নাই। ইস্টিশনের বাইরে নতুন এক চায়ের দোকান হয়েছে–নিউ স্টার রেস্টুরেন্ট। এরা সন্ধ্যার পর হ্যাজাক বাতি জ্বালায়। হিন্দি গান বাজায়। নিউ স্টার রেস্টুরেন্টের মালিক কেন্দুয়া থেকে জিলাপির এক কারিগর এনেছে। বিকালে সেই কারিগর জিলাপি বানায়। এর মধ্যেই জিলাপির নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে–ধলা সামছুর জিলাপি। সামছু জিলাপি কারিগরের নাম। তার গায়ের রঙ ধবধবে সাদা বলেই সবাই ডাকে ধলা সামছু।

ধলা সামছু সন্ধ্যার পর গোসল করে একটা পাঞ্জাবি পরে রেস্টুরেন্টের বাইরে বেঞ্চির ওপর বসে থাকেন। তাকে তখন কলেজের প্রফেসরের মতো লাগে। ধলা সামছুর কথা বলা রোগ আছে। উনি কথা না বলে থাকতে পারেন না। আমি একদিন সন্ধ্যার পর দুটাকার জিলাপি কিনতে গেলাম। উনি বললেন, তুমি কে গো? নাম কী? নামটা সুন্দর করে বল বাপধন। সুন্দর করে নাম বলতে পারা একটা মোহাব্বত।

টগর।

উত্তম নাম। জিলাপি কিনবা?

হুঁ।

দুই টেকার জিলাপি?

হুঁ।

দুই টেকায় চাইরটা পাইবা। পঞ্চাশ পয়সা কইরা পিস। বাড়িতে মানুষ কয়জন? চাইর পিসে হইব? নিজের দোকান হইলে তোমারে পাঁচ পিস দিতাম। কিন্তু অন্যের দোকান–আমি হইলাম হুকুমের চাকর। আমি নিজে যদি জিলাপি খাইতে চাই আমারে পয়সা দিয়া কিনন লাগব। বুঝলা বিষয়টা?

বুঝেছি।

জিলাপি খাইতে হয় গরম গরম। ঠাণ্ডা জিলাপির কোনো মজা নাই। দুইটা জিনিস খাইতে হয় গরম এক জিলাপি, দুই চা। ঠাণ্ডা জিলাপি আর ঠাণ্ডা চা। দুইই বিষ–এইটা মনে রাখবা। গরম জিলাপি এক কেজি খাইতে পার, কিচ্ছু হবে না। ঠাণ্ডা জিলাপি দশটা খাইবা সাথে সাথে পাতলা পায়খানা। টাট্টিঘরে যাইতে হবে দিনে পাঁচবার।

আমার বাবার ধারণা—সুখি মানুষরা বেশি কথা বলে। বাবা মাঝে মধ্যে। জ্ঞানী- জ্ঞানী কথা বলেন। জ্ঞানী কথা বলার সময় তিনি আমাকে ডাক নামে ডাকেন না—ভালো নামে ডাকেন। টগর না ডেকে ডাকেন মোতাহার। আমার ভালো নাম মোতাহার উদ্দিন।

বুঝলি মোতাহার। একটা মানুষ সুখী না দুঃখী চট করে বলে ফেলা যায়। ভালোমতো তাকে দেখবি। যদি দেখিস বেশি কথা বলছে তাহলেই বুঝবি সে সুখী মানুষ। আর যদি দেখিস কথাবার্তা কম বলছে তাহলেই বুঝবি—মনের মধ্যে অনেক দুঃখ। সবচে বেশি কথা বলে কারা? পাগলরা। সারাক্ষণই এরা কথা বলে। আশেপাশে মানুষ থাকলে কথা বলে। আশেপাশে কেউ না থাকলে নিজের মনেই বিড়বিড় করে। এই দুনিয়ার সবচে সুখী মানুষ কারা? পাগলরা। একবার কষ্ট করে পাগল হয়ে যেতে পারলে খুবই মজা। আর কোনো দুঃখ নাই। শুধুই সুখ। এইসব ভেবেই পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে।

বাবার জ্ঞানের কথা বেশির ভাগই আমার কাছে মনে হয় ভুল। কারণ ধলা সামছু একজন দুঃখী মানুষ। তার বৌ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু বেশি দূর যায় নাই। রোয়াইলবাজারে খারাপ ঘরে জায়গা নিয়েছে। তার ভিজিট দশ টাকা। এইসব বড়দের ব্যাপার। তবে ছোটরাও সবাই জানে। বৌটার নাম সোহাগী। আমি তাকে দেখি নি—শুনেছি ছোটখাট। হাস্যমুখী। অনেক ঢং-ঢং নাকি জানে। গীতও নাকি গায়। তার কাছে যে যায় সেই খুশি হয়ে আসে। যে একবার গেছে সে পরে আরো পাঁচবার যায়। আমার খুব ইচ্ছা দূর থেকে। একদিন তাকে দেখে আসব। দূর থেকে দেখলে তো আর ভিজিট লাগবে না।

ভাইয়া চায়ের দোকানে ছিল না। সে ইস্টিশনের শিমুল গাছের গুঁড়িতে বসে সাইকেলের চেইন ঠিক করছিল। ভাইয়ার চেহারা কিছুদিন আগেও খুব সুন্দর ছিল। এখন দাড়ি গোঁফ গজিয়ে বিশ্রী হয়ে গেছে। কেমন গুন্ডা-গুন্ডা ভাব এসে গেছে। গরম লাগে বলে চুল ছোট ছোট করে কাটে। চুল কাটলে সব পুরুষ মানুষকে প্রথম দুদিন বান্দরের মতো লাগে তারপর ঠিক হয়ে যায়। শুধু ভাইয়ার বেলায় দেখলাম চুল কাটার দশ পনেরো দিন পরেও তার চেহারা থেকে বান্দর ভাব দূর হয় না বরং বেড়ে যায়। কিছুদিন আগেও তার দাঁতগুলি মুখের ভেতর ছিল—এখন মনে হয় মুখ ঠেলে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে। ভাইয়ার চুল যখন লম্বা থাকে তখন দাঁতগুলি থাকে মুখের ভেতর। চুল ছোট হলেই দাঁত মুখ থেকে বের হয়ে আসে। এটা একটা বিরাট রহস্য।

ভাইয়া সাইকেল থেকে চোখ না তুলে বলল, দৌড় দিয়ে একটা তেনা নিয়ে আয়। ঝড়ের মতো যাবি। সাইক্লোনের মতো ফিরে আসবি।

আমি দৌড় দিলাম না। পকেট থেকে টাকাটা বের করতে করতে বললাম, বাবা এই টাকাটা তোমাকে দিয়েছে।

ভাইয়া টাকার দিকে না তাকিয়ে বলল, তোকে যে বললাম এক দৌড় দিয়ে তেনা নিয়ে আসতে এটা কানে যায় নাই। সাইকেলটা তুলে মাথায় একটা আছাড় দিব?

টাকাটা নাও, আমি তেনা নিয়ে আসি।

টাকা রেল লাইনে ফেলে দে। ঘুষখোর বাপের টাকার ধার রঞ্জু ধারে না।

আমি টাকাটা পকেটে নিয়ে তেনা আনতে রওনা হলাম। আমি নিশ্চিত তেনা নিয়ে এসে দেখব ভাইয়ার রাগ পড়ে গেছে। ভাইয়ার রাগ আষাঢ় মাসের রোদের মতো। এই আছে এই নাই।

বাবার ধারণা পৃথিবীতে দুধরণের মানুষ আছে—নদী মানুষ আর পুকুর মানুষ। নদীর পানি যেমন বয়ে চলে যায়। নদী মানুষের রাগও বয়ে চলে যায়। যে নদী মানুষের স্রোত বেশি তার রাগ তত তাড়াতাড়ি কমে। পুকুর মানুষের। রাগ কমে না। ভাইয়া হল খরস্রোতা নদী। এই রাগ উঠে গেছে, এই নাই। আর। বাবা হল দিঘি। কিছুতেই রাগ উঠবে না। ভাইয়ার জায়গায় যদি বাবা হত— আর যদি বাবা বলতেন—যা দৌড় দিয়ে একটা তেনা নিয়ে আয়। তার উত্তরে আমি যদি বলতাম, পারব না। তাহলে বাবা বলতেন, না পারলে নাই। সবাই সবকিছু পারে না। তুই হাসি মুখে আমার সামনে বসে থাক এতেই আমি খুশি। মানুষের হাসি মুখের দাম—তিন লাখ টাকা। আর মানুষের বেজার মুখের দাম তিন পয়সা।।

তেনা নিয়ে এসে দেখি ভাইয়া পাকা মিস্ত্রির মতো সাইকেলের দুটা চাকাই খুলে ফেলেছে। তাকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। দেখে মনেই হয় না আজ সকালেই তার ফেল হবার খবর এসেছে।

ভাইয়া তেনা হাতে নিতে নিতে বলল, বাসার অবস্থা কী?

অবস্থা ভালো।

আমার ফেল করার কথা শুনে মা কী বলল?

কিছু বলে নাই।

কিছুই বলে নাই?

না। মার আধকপালী উঠেছে এই জন্যে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে।

কুসুম কী বলেছে?

কিছু বলে নাই।

কিছুই না? উঁহুঁ।

ফেলের খবর শুনে তার মুখটা কি বেজার বেজার হয়ে গেল না হাসি খুশি হয়ে গেল?

বেজার বেজার হয়েছে।

ঠিক তো?

হুঁ ঠিক।

কুসুমকে দেখে কি মনে হয়েছে খবরটা সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।

হুঁ।

হুঁ আবার কী? ঠিক করে বল। কথা বলতে ট্যাক্স লাগে যে হুঁ হাঁ। করছিস। কুসুমের মুখ দেখে কী মনে হয়েছে পরিষ্কার করে বল।

মনে হয় বড়ই দুঃখ পেয়েছে।

মুখ দেখে কী করে বুঝলি দুঃখ পেয়েছে। কেউ দুঃখ পেলে কি কপালে লেখা উঠে—দুঃখ! লেখা উঠে না। মানুষের মুখ দেখে কিছুই বোঝার উপায় নাই। মানুষ খুবই জটিল জিনিস। এরচে যন্ত্র ভালো। যন্ত্র দেখলে বোঝা যায় যন্ত্র ঠিক আছে না, নষ্ট। এখন বল দেখি একটা মানুষ আর একটা সাইকেল এই দুই এর মধ্যে কোনটা ভালো?

সাইকেল।

গুড। হয়েছে। এখন যা ফজলুকে ডেকে নিয়ে আয়। রোদটা অবিশ্যি চড়া উঠেছে। এক কাজ কর সার্টটা খুলে কলের পানিতে ভিজিয়ে মাথার উপর দিয়ে চলে যা। রোদ টের পাবি না, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় চলে যাবি। পারবি না?

পারব। উনাকে কী বলব?

আসতে বলবি। আজ মনের সাধ মিটিয়ে ঝপাং খেলা খেলব। এক কাজ কর ফজলুর কাছে যাবার আগে কুসুমকে বলে যা সে ঝপাং খেলা দেখতে। চেয়েছিল আজ ইচ্ছা করলে দেখতে পারবে।

আচ্ছা।

ঝপাং খেলাটা খুবই ভয়ংকর। ভয়ংকর বলেই খুব মজার। এই খেলার নিয়ম হল মাগরা নদীর উপর রেলের ব্রীজে চলে যেতে হয়। ব্রিজের উপর রেল লাইনে চুপচাপ বসে থাকতে হয়। সাড়ে চারটার সময় ঢাকা মেইল আসে। ড্রাইভার রেল লাইনের উপর মানুষ বসে থাকতে দেখে দূর থেকে হুইসাল বাজাতে থাকে। ইঞ্জিন কাছাকাছি চলে এলে ঝপাং করে ঝাঁপ দিয়ে মাগরা নদীতে পড়ে যেতে হয়। ইঞ্জিন কতটা দূর থাকতে ঝাঁপ দেয়া হয়েছে এর উপর নির্ভর করে খেলার হারজিৎ। এখন পর্যন্ত ফজলু ভাইকে কেউ হারাতে পারে নি। ফজলু ভাই লাফ দেয় ইঞ্জিন ব্রিজে উঠার পর। অন্য সবাই ইঞ্জিন অনেক দূরে থাকতেই ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে যায়।

আমার খুব ইচ্ছা একদিন ঝপাং খেলাটা খেলি। ক্লাস টেনে উঠার আগে এই খেলা খেলা যায় না। তাছাড়া প্রথমবার এই খেলা খেলতে যাওয়াও খুবই বিপজ্জনক। বাঁকের ভেতর হঠাৎ ট্রেন বের হয়ে আসে। সেটা দেখে হাত পা না কি জমে যায়। ঝাঁপ দেয়ার কথা মনে থাকে না। তখন ধাক্কা দিয়ে পানিতে। ফেলে দিতে হয়। তবে একবার এই খেলা খেলে ফেললে ভয় কেটে যায়। তখন বার বারই এই খেলা খেলার ইচ্ছা করে।

ঝপাং খেলা খেলতে হয় দিনে। রাতে এই খেলা কখনো খেলা হয় না— কারণ রাতের বেলা নাকি এগারো বারো বছরের একটা ছেলেকে রেল লাইনে বসে থাকতে দেখা যায়। অনেকেই দেখেছে। ছেলেটা ধবধবে ফর্সা। মাথার চুল কোঁকড়ানো। সে থাকে খালি গায়। পরনে শুধু একটা প্যান্ট। ট্রেন আসার ঠিক আগে আগে হেড লাইটের আলোয় ছেলেটাকে দেখা যায়। সে আপন মনে পাথর নিয়ে খেলে। ট্রেন যে ঝড়ের মতো ছুটে আসছে এদিকে সে ফিরেও তাকায় না। ট্রেনটা যখন ঠিক তার গায়ের উপর এসে পড়ে তখনই সে শুধু উঠে দাঁড়ায়। ট্রেন তার গায়ের উপর দিয়ে চলে যায়। তারপর আর তাকে দেখা যায় না।

ছেলেটার গল্প সবাই জানে। অনেকেই বিশ্বাস করে অনেকে করে না। যেমন আমার বাবা বিশ্বাস করেন। কারণ যে কোনো উদ্ভট গল্প তিনি বিশ্বাস করেন। তাঁর কাছে অসম্ভব বলে কোনো ব্যাপার নেই। এই ছেলেটার ব্যাপারে বাবার বক্তব্য হল–এটা সত্যি হতে পারে। খেলতে খেলতে পুলের উপর চলে গিয়েছিল। সেখানে ট্রেনে কাটা পড়েছে। তারপর থেকে আত্মাটা ঐখানে রয়ে গেছে। তার যে মৃত্যু হয়েছে এইটাই বেচারা জানে না। রোজ হাশর পর্যন্ত বেচারা এইখানে থাকবে। রোজহাশরের দিন আল্লাহপাক তাকে বলবেন—এই ছেলে যা বেহেশতে গিয়ে ঢুকে পড়। সঙ্গে বাবা মাকে নিতে চাইলে নিয়ে নে। ট্রেন লাইনে অনেক হাঁটাহাঁটি করেছিস আর না। এখন বেহেশতে হাঁটাহাঁটি কর। বেহেশতের ফল ফ্রুট খা। গেলমানদের সঙ্গে মজা করে মারবেল খেল।

কুসুম আপু এইসব গল্প একেবারেই বিশ্বাস করে না। সে প্রায়ই বলে, একবার আমাকে নিয়ে যাস তো। সারারাত পুলের নিচে বসে থেকে ছেলেটাকে দেখব। এ-রকম সত্যি যদি কেউ থাকে হাত ধরে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসব।

সে আসবে তোমার সঙ্গে?

 

অবশ্যই আসবে। মানুষ যেমন আদর বুঝে। ভূত প্রেতও বুঝে। ওকে ঘরে এনে আমি পালবো। একটা ভূত পালার আমার অনেক দিনের শখ।

আমার সাহস খুব কম তারপরেও ঠিক করে রেখেছি। কোনো এক রাতে কুসুম আপুকে নিয়ে মগরা ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে থাকবো। রাত দুটার দিকে যেতে হবে। চিটাগং মেইল রাত দুটার সময় আসে। এই ট্রেনের সার্চ লাইটের আলো এক মেইল দূর থেকে দেখা যায়। সার্চ লাইটের আলোয় ছেলেটাকে দেখা যাবে।

আমার মাথার উপর ভেজা গামছা। আমি যাচ্ছি ফজলু ভাই-এর খোঁজে। ফজলু ভাই রঞ্জু ভাইয়ার প্রাণের দোস্ত। তিনিও এবার এস. এস. সি. পরীক্ষা দিয়েছেন। রঞ্জু ভাইয়া পাস করতে না পারলেও ফজলু ভাইয়া করেছেন। সেকেন্ড ডিভিশন এবং জেনারেল অংকে লেটার। অংক পরীক্ষার দিন খুব ভালো নকল সাপ্লাই হওয়ায় এই লাভটা তার হয়েছে। যারা ফেল করেছে। তারাও অংকে লেটার পেয়েছে।

নিউ স্টার রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। রেস্টুরেন্ট খালি। বেঞ্চের উপর ধলা সামছু শুয়ে আছেন। আমাকে দেখেই উঠে বসে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডাকলেন—এই ছেলে এই তুমি রঞ্জুর ভাই না?

আমি মাথা নাড়লাম।

মেট্রিকে তোমার ভাই ফেল করেছে শুনলাম। বড়ই আফসোস। নকলের তো ভালো সুবিধা ছিল, ফেল করল কেন জান?

জি না জানি না।

চৈত্র মাস। ভেজা কাপড় মাথায় দিয়া হাঁটা ঠিক না। মগজে ঠাণ্ডা বসে যায়। ভেজা কপড়টা নামাও। আমার কাছে ছাতি আছে নিয়া যাও। পরে ফিরায়ে। দিও। এই ছেলে এই…

ধলা সামছু ব্যাকুল হয়ে আমাকে ডাকছেন, আমি হাঁটতে শুরু করেছি। গরম বাতাস চোখে মুখে লাগছে। চামড়া চিড়বিড় করছে। মনে হচ্ছে মুখের উপর দিয়ে একদল পিঁপড়া হাঁটছে। সব কটা পিঁপড়ার মুখে ডিম। এরা ডিম নামিয়ে বিশ্রাম করে। গরম বাতাসের ঝাপ্টা এলেই ডিম মুখে নিয়ে দৌড়তে শুরু করে। পিঁপড়ার পা গুলি ঠাণ্ডা কিন্তু ডিমগুলো কুসুম কুসুম গরম।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ