মগরা ব্রিজের দুপাশে তাঁবু পড়েছে। শাদা রঙের তাঁবু। রেলের ইঞ্জিনিয়ার এসেছেন, সঙ্গে অনেক লোকজন। মালগাড়িতে করে রোজই কিছু না কিছু আসছে। সবচে বেশি আসছে বালির বস্তা। চটের ব্যাগ ভর্তি বালির বস্তায় ছোটখাট পাহাড়ের মতো হয়ে গেছে। মাটি কাটার একটা ক্রেন এসেছে। হলুদ রঙের এই ক্রেনটা যখন চলে তখন শকুনের বাচ্চার কান্নার মত শব্দ উঠে। ক্রেন যে চালায় সে মোটাসোটা থলথলে ধরণের মানুষ। তার চোখ সব সময় বন্ধ থাকে। মনে হয় সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই ক্রেন চালায়। তাকে সারাক্ষণ বকা শুনতে হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাকে বকেন।

এই জমশেদ, এই জম্বু, ঘুমাচ্ছ নাকি? চোখ বন্ধ করে কি করছ? হ্যালো, হ্যালো।

জমশেদ নামের লোকটা চোখ মেলে ফিক করে হেসে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব রাগে কাঁপতে থাকেন। গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে বলেন, তোমার নামে আমি হেড অফিসে রিপাের্ট করব। তুমি চাকরি কী করে কর আমি দেখব। চোখ বন্ধ করে ফাজলামি?

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের নাম—কামরুল ইসলাম। তার বয়স নিশ্চয়ই বেশি। কিন্তু মাঝে মাঝেই তাকে কলেজের ছেলেদের মতো দেখায়। ভদ্রলোকের গায়ের রঙ শ্যামলা। চেহারা খুবই সুন্দর। শাদা রঙ মনে হয় তার খুব পছন্দ। বেশির ভাগ সময় তার পরনে থাকে শাদা প্যান্ট এবং শাদা গেঞ্জি। মাথায় বারান্দাওয়ালা শাদা টুপিও তার ছিল। প্রথম দিনেই বাতাসে সেই টুপি, তার মাথা থেকে উড়ে গিয়ে মগরা নদীতে পড়ল। তিনি অতি ব্যস্ত হয়ে বললেন, টুপিটা রেসকিউ করার ব্যবস্থা কর। কুইক কুইক!

কেউ নড়ল না।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, আমার এটা খুব শখের টুপি। জাপান থেকে কেনা। আমি সাঁতার জানি না। জানলে নিজেই তুলতাম কেউ তুলে দিন বখশিশ পাবেন। ভালো বখশিশ দিব।

বখশিশের ঘোষণাতেও কাজ দিল না। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব অসহায়ভাবে টুপির দিকে তাকিয়ে ছটফট করছেন। উপস্থিত দর্শকদের এই দৃশ্য দেখতেই বেশি ভালো লাগছে। টুপি তুলে ফেললে তো আর এমন মজার দৃশ্য দেখা যাবে না। টুপিটা ব্রিজের মাঝখানের স্প্যানের সঙ্গে লেগে ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে। টুপিটাও মজা পাচ্ছে। ড়ুবতে গিয়েও ড়ুবছে না।

একশ টাকা বখশিশ। একশ টাকা। আমার খুব শখের টুপি। ওয়ান হান্ড্রেড রুপিস।

একশ টাকা ঘোষণা দেবার পর রহমান এন্ড ব্রাদার্স আইস ফেক্টরির এক কুলিকে লুঙ্গি মালকোচা করে এগুতে দেখা গেল। দর্শকরা সবাই তাতে খুব মজা পেল। হাত তালি দিতে শুরু করল। একজন চিৎকার করে বলল—সাবাস। মজনু। সাবাস।

মজনু পানিতে নেমে পড়ল মহাবিপদে। প্রবল স্রোত তাকে কাবু করে ফেলছে, সে টুপি পর্যন্ত যেতে পারছে না। তাকে ভাটির দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পাড়ে উঠে সে আবারো শুরু করে। দর্শকরা নানান উপদেশ দেয়, উজান থেকে শুরু কর। ভাটি থেকে সাঁতার দিয়ে যাবি কীভাবে? গাধা নাকি। শরীরে শক্তি নাই? এই তুই ভাত খাস নাই? এক হাত দিয়ে লুঙ্গিটা ধররে গাধা। তোর কালা পুটকি দেখা যায়। হি হি হি।

টুপি উদ্ধার হল না। হাঁপাতে হাঁপাতে মজনু যখন স্প্যানের কাছে উপস্থিত হয়েছে তখন টুপি ড়ুবে গেছে। তারপরেও ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মজনুকে একশ টাকা বখশিশ দিলেন। মজনু টাকা হাতে নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসতে লাগল।

জাপানি টুপির কারণে প্রথম দিনেই ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলাম সাহেবের নাম হয়ে গেল জাপানি ইঞ্জিনিয়ার। আমরা খুব আগ্রহের সঙ্গে জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কর্মকান্ড লক্ষ করতে লাগলাম।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কর্মকান্ড অবিশ্যি লক্ষ করার মতোই। তিনি দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার রেলের স্লীপারে পা রেখে দৌড়ান। দৌড়ের সময়। সাপের শীস দেবার মতো শব্দ করেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে আগে ব্রিজের মাঝখানের স্প্যানে পা ঝুলিয়ে বসে গান করেন। তিনি একটা গানই বোধহয় জানেন—আমি অধম জেনেও তো কিছু কম করে মোরে দাও নি। তখন তার পাশে টকটকে লাল রঙের একটা ফ্লাক্স থাকে। গানের ফাঁকে ফাঁকে ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে চুক চুক করে খান। এবং অবাক হয়ে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার দৃষ্টি বেশির ভাগ সময় থাকে যেখানে টুপি ড়ুবে গিয়েছিল সেইখানে।

বাবা একদিন দাওয়াত করে ভদ্রলোককে আমাদের বাসায় নিয়ে এলেন। রহিমা ফুপু অনেক পদ রান্না করলেন। কলার থােড় ভাজি, ঢেড়স ভর্তা, সরিষা ভর্তা, আলু দিয়ে মুরগি, মাছের ঝোল, টেংরা মাছের টক। কাচা মরিচ দিয়ে হিদল ভর্তা। বাবা হাত কচলাতে কচলাতে বললেন- নিজ গুনে ক্ষমা করবেন স্যার। দরিদ্র আয়োজন। আমার স্ত্রীর শরীরটা খারাপ। সে কিছু করতে পারে নি। তার শরীর ভালো থাকলে….।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার অবাক হয়ে বললেন—দরিদ্র আয়োজন মানে? এর নাম দরিদ্র আয়োজন? দরিদ্র আয়োজন কাকে বলে যদি দেখতে চান—আমার খাবার একদিন খেয়ে যাবেন। স্রেফ ভাত আর ডিম সিদ্ধ। সেই ভাতও কোনোদিন হচ্ছে জাউ, কোনোদিন লোহার মতো শক্ত।

স্যার আপনার যখনই ইচ্ছা করবে আমার বাড়িতে খেয়ে যাবেন। এটা আপনার নিজের বাড়ি বলে বিবেচনা করবেন। আমার রিকোয়েস্ট।

রোজ এসে আপনার বাড়িতে খেয়ে যাব?

জি স্যার। রিজিকের মালিক আল্লাহপাক। আল্লাহপাক যদি আমার বাড়িতে আপনার রিজিক ঠিক করে রাখে তাহলে এখানেই খাবেন। আমি বড় খুশি হব স্যার। ভেরি হ্যাপী হব।

বাবা বিশিষ্ট মেহমানদের সামনে কথায় বার্তায় ইংরেজি বলতে পছন্দ করেন এবং হাত কচলাতে থাকেন। তখন তাঁর চেহারার মধ্যেই চাকর চাকর ভাব চলে আসে। তিনি যে বিনয়ের বাড়াবাড়ি করছেন এটা সবার চোখে পড়ে শুধু তাঁর চোখে পড়ে না।

বাবার ভাগ্য খারাপ তিনি সামনে বসিয়ে মেহমান খাওয়াতে পারলেন না। তাকে ইস্টিশন চলে যেতে হবে। আঠারবাড়ি স্টেশনে মালগাড়ি লাইন থেকে পড়ে গেছে। তাকে স্টেশনে থেকে আঠারবাড়ি স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।

মেহমানদারির দায়িত্ব পড়ল কুসুম আপুর উপর। মেহমানদারি মানে ভাত শেষ হবার আগেই প্লেটে ভাত দিয়ে দেয়া। তরকারি নিয়ে সাধাসাধি। মেহমান না বলে দুহাতের দশ আঙুল মেলে প্লেট ঢাকবেন। সেই আঙুলের ফাঁক দিয়ে তরকারি দিয়ে দিতে হবে। পাতে তরকারি চলে যাবে কিন্তু আঙুল ভিজবে না। এই জাতীয় কাজ কুসুম আপু কখনো করে না, আজ দেখি খুব উৎসাহ নিয়ে। করছে। বয়স্ক মহিলাদের মতো বলছে—একবার দিতে হয় না, দুবার দিতে হয়। হাত সরান আমি দুবার দেব। হাত না সরালে আমি আপনার হাতে তরকারি ঢেলে দেব।

ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে হাত সরাতে সরাতে বললেন, একবার দিলে কী হয়?

কুসুম আপু বলল, একবার দিলে আদরের বৌ মরে যায়।

সে কি আমি তো জানি একবার দিলে খালে পড়ে।

বৌ মরা আর খালে পড়া একই জিনিস।

আমার তো বৌ নেই, বৌ মরার প্রশ্ন আসছে না।

এখন নেই পরেতো হবে। সেই বৌ মরে যাবে। অবিশ্যি বৌ যদি আদরের হয়। অনাদরের বৌ হলে মরবে না। আপনাকে যন্ত্রণা দেবে।

ভদ্রলোককে দেখেই বুঝেছি কুসুম আপুর কথাবার্তায় তিনি চমকে গেছেন। আমরা কুসুম আপুর অদ্ভুত কথাবার্তায় চমকাই না, শুনে শুনে অভ্যস্ত। ভদ্রলোক তো আর শুনেন নি। তাছাড়া কুসুম আপুকে দেখাচ্ছিল পরীর মতো। মেট্রিক পরীক্ষা উপলক্ষে বাবা যে শাড়িটা দিয়েছেন আপু সেই শাড়ি পরেছে। কপালে টিপ দিয়েছে। আমাদের বাড়িতে কপালে টিপ দেয়া খুবই খারাপ ব্যাপার বলে গণ্য করা হয়। টিপ দেয়া আর সিঁদুর দেয়া একই। এতে হিন্দুয়ানী করা হয়। বিয়ের পর দেয়া যায় তবে বিয়ের আগে দিলে স্বামী পর নারীতে আসক্ত হয়। মুসলমান মেয়ের হিন্দুয়ানী করার এই হল শাস্তি। কুসুম আপু পরেছে, কারণ সে নিয়ম কানুন মানে না।

আপুকে শাড়িতে খুবই মানিয়েছে। সবুজ শাড়ির সঙ্গে লাল টিপটাতেও মানিয়েছে। আমি তাকে কত ছোট থেকে দেখছি এই আমিই চোখ ফেরাতে পারছি না। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বাইরের মানুষ সে তো মুগ্ধ হবেই। তাছাড়া কুসুম আপুর শরীরে আছে বিশেষ একটা চিহ্ন। এই চিহ্ন থাকলে পুরুষ মানুষ তার আশেপাশে এলেই ফণা নামিয়ে ফেলবে। সাপের মতো সব পুরুষ মানুষেরও ফণা আছে। খুব বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া পুরুষ মানুষ ফণা নামাতে পারে না। (এটা আমার কথা না। কুসুম আপুর কথা।)।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার ভাত খেতে খেতেই ফণা নামিয়ে ফণাবিহীন সাধারণ সাপ হয়ে গেলেন, তার চেহারার মধ্যে গদগদ ভাব চলে এল। মুখের চামড়া হঠাৎ তেলতেলে হয়ে গেল। তিনি হড়বড় করে কুসুম আপুর সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে লাগলেন। একটা কথার সঙ্গে অন্য একটা কথার কোনো মিল নেই। তিনি কী বলছেন নিজেও বোধ হয় জানেন না।

কুসুম তুমি কি গল্পের বই পড়। আমি প্রচুর গল্পের বই নিয়ে এসেছি। সময় যখন কাটে না বই পড়ি। অবিশ্যি সবই ইংরেজি থ্রিলার। তুমি ইংরেজি বই পড়তে পার না? অভ্যাস করলেই পারবে। একটা ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারি নিয়ে বসতে হবে। যে সব শব্দের অর্থ বুঝতে পার না—চট করে ডিকশনারি খুলে দেখে নেবে। এতে একটা ক্ষতি আছে আর একটা লাভ। ক্ষতি হচ্ছে পড়াটা স্লো হয়ে যাবে। আর লাভ হচ্ছে ওয়ার্ড পাওয়ার বাড়বে। কুসুম, ডিকশনারি নিয়ে মজার একটা জোক মনে পড়েছে। খুবই মজার-হা হা হা। জোকটা শোন—পাগলা গারদের এক রোগী। তার খুবই বই পড়ার নেশা। যে বই তাকে দেয়া হয় সেই বইই চট করে পড়ে ফেলে। আরো বই চায়। পাগলা গারদের লাইব্রেরিয়ান তাকে বই দিতে দিতে ক্লান্ত। সব বই সে পড়ে ফেলেছে। অথচ রোগী বই চায়। লাইব্রেরিয়ান তখন করল কি তাকে মোটা ডিকশনারিটা দিয়ে দিল। ও আচ্ছা গল্পটায় সামান্য ভুল করলাম, ডিকশনারি না লাইব্রেরিয়ান তাকে দিয়ে দিল আটশ পৃষ্ঠার টেলিফোন ডিরেক্টরি। টেলিফোন ডিরেক্টরি কি তুমি জানতো? টেলিফোন ডিরেক্টরিতে এলফাবেটিকেলি টেলিফোন গ্রাহকদের নাম লেখা থাকে আর টেলিফোন নাম্বার লেখা থাকে। যাই হোক লাইব্রেরিয়ান টেলিফোন ডিরেক্টরি দিয়ে মহা খুশি। পাগল পরদিনই বলতে পারবে না, বই পড়ে শেষ করে ফেলেছি। ঘটনা হল কি পাগলটা পরদিনই টেলিফোন ডিরেক্টরি ফেরত দিয়ে বলল, স্যার পড়ে ফেলেছি আরেকটা বই দেন। লাইব্রেরিয়ান অবাক হয়ে বলল, বইটা কেমন লাগল? পাগল বলল, উপন্যাসটা খারাপ না, তবে স্যার চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি। মনে রাখতে গিয়ে কষ্ট হয়েছে। হা হা হা। জোকটা কেমন কুসুম?

কুসুম আপু জবাব দেবে কী সে এমন হাসতে লাগল যে হেঁচকি উঠে গেল। দমবন্ধ হয়ে যাবার মতো হল। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার খুবই ব্যস্ত হয়ে গেলেন, পানি খাও তো কুসুম। পানি খাও। তোমাকে তো আর কখনো জোক বলা যাবে না। কী সর্বনাশ। এমন করে কেউ হাসে?

দুপুরে খেয়েই কামরুল সাহেব চলে যাবেন এমন কথা ছিল–তার ভয়ংকর জরুরি কাজ। কিন্তু তিনি সব কাজ ফেলে সন্ধ্যা পর্যন্ত রয়ে গেলেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি অনর্গল কথা বললেন। সবই জাপানের গল্প। তিনি জাপানে গিয়ে জাপানের সী ফুড রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছেন। কোনো খাবার দাবারের নাম জানেন না, শেষে চেহারা দেখে পছন্দ করে একটা খাবার খেলেন। খেতে বেশ ভালো সামান্য টক-টক। তিনি খুবই আগ্রহ করে খেলেন শেষে জানা গেল সেটা ছিল সামুদ্রিক সাপ।

কুসুম আপু চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনি সাপ খেলেন?

হ্যাঁ খেলাম। জেনেশুনে তো খাই নি। না জেনে খেয়েছি। তবে পরে অবিশ্যি জেনে শুনে খেয়েছি।

আপনি জেনেশুনে সাপ খেয়েছেন?

হুঁ খেয়েছি। কী করব অন্য কোনো খাবার খেতে পারি না। শেষের দিকে সী ফুড রেস্টুরেন্টে গেলেই সাপের ঝোলের অর্ডার দিতাম।

আমার তো শুনেই বমি এসে যাচ্ছে।

বমি আসার কী আছে। রান্না করা সাপ খাচ্ছি। কাঁচা তো খাচ্ছি না।

কুসুম আপু গাল ফুলিয়ে বলল, আপনি আর সাপ খাবেন না। কোনোদিন না।

ভদ্রলোক আনন্দের হাসি হাসতে হসতে বললেন, আরে তোমাকে নিয়ে তো ভাল ঝামেলা হল। সাপ আর মাছের মধ্যে বেশি কম তো কিছু নেই। বাইন। মাছ খাও না? বাইন মাছ খেতে পারলে সাপ খেতে সমস্যা কী?

কুসুম আপু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, না, সাপ খেতে পারবেন না। আপনি কথা দিন আর সাপ খাবেন না।

উনি হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বললেন, আচ্ছা যাও খাব না।

বলেই তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন, যেন সাপ খেতে না পারার দুঃখে তিনি খুবই কাতর হয়েছেন। তার মন পড়ে আছে সাপের ঝোলে।

সন্ধ্যার আগে আগে জাপানি ইঞ্জিনিয়ার তাঁবুর দিকে রওনা হলেন। আমার ধারণা আমরা কেউ যদি একবার বলতাম—রাতের খাওয়া খেয়ে যান, তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যেতেন। ভদ্রলোক আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। তার কাছে নাকি কিছু ম্যাগাজিন আছে। ম্যাগাজিনগুলো দিয়ে দেবেন। কুসুম আপু পড়বে।।

রেল লাইনের স্লীপারে পা রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে তিনি যাচ্ছেন। সাপের শীসের মতো শব্দ করছেন। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি খুবই মজা পাচ্ছেন। যেতে যেতে আমার সঙ্গেও কিছু কথা হল। আমাদের এই অঞ্চলে দেখার মতো কি আছে। এখানে কবে হাট বসে। হাটে কী পাওয়া যায়।

কথা বলার জন্যে কথা বলা।

ভদ্রলোক আমাকে তাঁবুর বাইরে রেখে নিজে তাঁবুতে ঢুকে গেলেন। আমার খুব শখ ছিল তাঁবুর ভেতরটা দেখার। উঁকি ঝুঁকি মেরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাঁবুর মুখে পর্দা দেয়া। বেশ ভারী পর্দা। বাতাস হচ্ছে, কিন্তু বাতাসে পর্দা কাঁপছে না। তাঁবুর ভেতর থেকে অষুধ অষুধ গন্ধ আসছে।

তিনি বের হলেন টিনের একটা কৌটা নিয়ে। হড়বড় করে বললেন, ম্যাগাজিন গুলি খুঁজে পাচ্ছি না। রাতে খুঁজে রাখব। খোকা তুমি কাল একবার এসে নিয়ে যেতে পারবে না?

আমি বললাম, পারব।

তিনি বললেন, না থাক তোমার আসতে হবে না। বাচ্চা মানুষ একা একা এত দূর আসবে। আমিই কাউকে দিয়ে পাঠাব। কিংবা নিজেও আসতে পারি। বিকেলে এসে এক কাপ চা খেয়ে গেলাম ম্যাগাজিনগুলিও দিয়ে গেলাম। আইডিয়াটা কেমন?

ভালো।

বেশ তাহলে তুমি যাও। ধর এই কৌটাটা নিয়ে যাও। রোস্টেড পিনাট। চীনা বাদাম। তোমার আপাকে দিও। আর এই চিঠিটাও দিও। ম্যাগাজিনগুলো। যে খুঁজে পাই নি সেটা লিখে দিয়েছি। বেচারিকে বলে এসেছিলাম ম্যাগাজিন পাঠাব। সে হয়তো আশা করে আছে। কোনো জিনিসের জন্য আশা করে। থাকলে সেই জিনিস না পাওয়া গেলে খুবই কষ্ট হয়। আর শোন আমি যে কাল। আসব এটাও বলার দরকার নেই। কারণ নাও আসতে পারি। কাজের চাপ খুব বেশি।

জি আচ্ছা।

অন্ধকার হয়ে গেছে একা একা যেতে পারবে তো?

পারবো।

দাঁড়াও তোমাকে একটা টর্চ লাইট দিয়ে দেই।

তিনি আবার তাঁবুর ভেতর ঢুকে গেলেন। টর্চ লাইট সম্ভবত খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাঁবু থেকে মুখ শুকনো করে বের হলেন হাতে সবুজ রঙের অদ্ভুত এক টর্চ।

খোকা শশান টর্চটা আমাকে ফেরৎ দিতে হবে। আমার শখের জিনিস। হারায় না যেন।

আমার টর্চ লাগবে না।

অবিশ্যি লাগার কথা না। এখনো আলো আছে। তাহলে টর্চটা বরং থাকুক। হারিয়ে ফেললে গেল। এইসব জিনিস বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। বরং এক কাজ করি আমি তোমাকে এগিয়ে দেই।

আমি যেতে পারব।

আচ্ছা যাও। ভয়ের কিছু নাই। আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকব।

ভদ্রলোক রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে রইলেন।

বাদামের টিন দেখে কুসুম আপুর কোনো ভাবান্তর হল না। বিরক্ত গলায় বলল, তুই নিয়ে যা। বাদাম আমি খাই না।

তোমাকে একটা চিঠিও দিয়েছে।

চিঠি কেন আবার। পড়ে শোনা চিঠিতে কী লেখা।

আমি চিঠি পড়ে শুনালাম।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের চিঠিটায় লেখা—

কুসুম।

Miss Flower,

ম্যাগাজিনগুলো খুঁজে পাচ্ছি না। পাওয়া মাত্র পাঠাব। তোমার সঙ্গে গল্প করে খুবই ভালো লেগেছে। আবারো একদিন গল্প করার জন্যে যাব। তবে কাজের প্রচন্ড ব্যস্ততা।

ইতি

কা. ইসলাম।

কুসুম আপু হাই তুলতে তুলতে বলল, একদিন গল্প করার জন্য আসবে। লিখেছে? সে ইচ্ছা করলেই গল্প করতে পারবে? আমার ইচ্ছা করতে হবে না? কাঃ ইসলাম আবার কী? সরাসরি কাক ইসলাম লিখলেই হত। চেহারা তো কাকের মতোই।

তুমি রাগ করছ কেন?

আমি রাগ করছি না। বিরক্ত হচ্ছি। দেখিস এই লোক খুবই বিরক্ত করবে। মাছি স্বভাবের কিছু মানুষ আছে যাদের প্রধান কাজ অন্যদের বিরক্ত করা। সারাক্ষণ ভ্যানভ্যান করবে। গায়ে বসতে চাইবে। এই ধরণের মানুষ আমার দুই চোখের বিষ।

ও।

লিখেছে না কোনো একদিন গল্প করার জন্য আসবে? তুই দেখিস লোকটা গল্প করার জন্য আজ রাতেই আসবে।

আজ রাতে আসবে না। কাল বিকালে আসতে পারে। চা খাবে আর ম্যাগাজিন দিয়ে যাবে।

দেখিস আজ রাতেই আসবে। যদি আসে আর আমার খোঁজ করে তাহলে বলবি আমার জ্বর। মিথ্যা বলাও হবে না। আমার সত্যিই জ্বর।

ও।

ও কিরে গাধা। কেউ যদি বলে আমার জ্বর তাহলে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে হয় তার জ্বর কিনা। এটা ভদ্রতা।

আমি গায়ে হাত দিয়ে দেখি কুসুম আপুর সত্যি সত্যি জ্বর। বেশ জ্বর। অথচ সে দিব্যি জ্বর নিয়েই চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে লিখছে। কুসুম আপুর খুব সুন্দর বাঁধানো একটা খাতা আছে। এই খাতাটা খুব ছোট বেলায় তার বাবা তাকে দিয়েছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ কুসুম আপু এই খাতা বের করে কী সব লেখে।

কুসুম আপুর বুকের বিশেষ চিহ্নটা যেমন আমার দেখতে ইচ্ছা করে। খাতাটাও পড়তে ইচ্ছা করে। বুকের চিহ্ন কোনো একদিন দেখলেও হয়তো দেখা যাবে। কিন্তু খাতা কোনোদিন পড়া যাবে না। এটা অসম্ভব ব্যাপার।

শ্রাবণ মাসের নিয়ম হল সারা দিন রোদ থাকবে রাতে শুরু হবে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির নাম ঘুম বৃষ্টি। আব্দুর রহমান চাচার ধারণা আল্লাহ্ পাক চোরদের জন্যে

এই ঘুম বৃষ্টির ব্যবস্থা করেন। গৃহস্থ আল্লাহ্ পাককে যত ডাকে, চোররা ডাকে তার চেয়ে বেশি। আল্লাহ্ পাক যেহেতু রহমানুর রহিম, চোরদের কথাও তাঁকে শুনতে হয়। এই জন্যেই ঘুম বৃষ্টির ব্যবস্থা করে দেন। গৃহস্থ আরাম করে ঘুমায়। আর চোর সব সাফা করে দেয়।

শ্রাবণ মাস এখনও শুরু হয় নি। আষাঢ় মাস যাচ্ছে কিন্তু ভাবটা শ্রাবণের। সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির মধ্যে বাবা ইলিশ মাছ নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমাদের অঞ্চলে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। যারা ময়মনসিংহে যায় তারাই একটা দুটা ইলিশ মাছ সঙ্গে নিয়ে আসে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের কারোর কাছ থেকে বাবা মাছ যোগাড় করে ফেলেন। মাছ যোগাড়ের কাহিনী তিনি দীর্ঘদিন বলেন। সেই কাহিনী বলে তিনি বড়ই আনন্দ পান।

বুঝলি টগর চারজন নামল ট্রেন থেকে। একজনেরও টিকেট নাই।। আসছে ময়মনসিংহ থেকে, বলে আঠারোবাড়ি ইস্টিশনে উঠেছি। একটা ইস্টিশন পাড়ি দিছি। এর আবার টিকেট কী? আমি বললাম, ইলিশ মাছ কিন্যা ফিরলা, মাছ পাইলা কই? আঠারোবাড়িতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়? রেলের নিয়ম আছে বিনা টিকেটের যাত্রির ভাড়া ধরা হবে যেখান থেকে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে সেখান থেকে। তাও সিঙ্গেল ভাড়া না, ডাবল ভাড়া। তোমরা বাহাদুরবাদ মেইলে আসছ। বাহাদুরবাদ মেইল যাত্রা করেছে চিটাগাং থেকে। সেইমতো ভাড়া দেও। চাইর জনে দুইশ পঁচিশ টাকা।

তাদের তখন কান্দা কান্দা অবস্থা। তখন তাদের মধ্যে একজন বলল, মাষ্টার সাব কুড়িটা টেকা রাইখ্যা ছাইড়া দেন। আমি বললাম, অসম্ভব। জীবনে ঘুষ খাই নাই। খাবও না। সামান্য দুইটা টেকার জন্যে রোজ হাশরে পুলসিরাত পার হতে পারব না। শেষে তারা একটা মাছ দিয়া রফা করল। ঘুষ খাওয়া বিরাট পাপ। কিন্তু খাদ্য দ্রব্য হল রিজিক। রিজিকটা সরাসরি আল্লাহ্ পাকের কাছ থেকে আসে বলে খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ করলে পাপ হয় না।

ইলিশ মাছ ভাজা বাবার পছন্দ না। তাঁর পছন্দ সর্ষে ইলিশ। সরিষা আর কাঁচামরিচ মাখানো ইলিশের টুকরা কলাপাতায় মুড়ে ভাপ উঠা ভাতের হাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হবে।

ঘরে সরিষা ছিল না। রহিমা ফুপু আমাকে সরিষা আনতে পাঠালেন। সরিষা কিনে ফিরছি ভাগ্য খারাপ ধলা সামছুর সামনে পড়ে গেলাম। কতক্ষণে ছাড়া পাব কে জানে। ধলা সামছু সরু গলায় বলল—যায় কেডা ইস্টিশন মাস্টার সাবের ছোট পুলাডা না?

আমি বললাম, হুঁ।

হাতে কী?

সরিষা।

সইন্ধ্যা রাইতে দোকানে তিনটা জিনিস বেচা হয় না, লবণ, সুই আর সরিষা। তোমারে বেচল কী ভাইব্যা?

জানি না।

তোমার দোষ নাই, আইজ কাইল অগা মগা বগা ছগারা ধানবেচা টেকায় নয়া দোকান দেয়। নিয়ম কানুন কিছুই জানে না। তুমি যে জিনিসটা খরিদ করলা তার জন্যে তোমার কোনো ক্ষতি হইব না। যে বেচল তার ক্ষতি। সমূহ ক্ষতি।

ও আচ্ছা।

তোমার একটা ভাই যে পরীক্ষা না দিয়া নিরুদ্দেশ হইছে তার খবর পাইছ?

না।

আসামে খুঁজ নেওন দরকার। পুরুষ নিরুদ্দেশ হইলে তারে পাওয়া যায়। আসামে। আর নারী নিরুদ্দেশ হইলে তারে পাইবা বাজারে। বেশকম কি জান? আসামের পুরুষ ঘরে ফিরত আনা যায়। বাজারের নারী ঘরে আনন যায় না।

চাচা আমি যাই।

আইচ্ছা যাও। তুমি ইস্টিশনের ধারে থাক একটা জিনিস খিয়াল রাখবা–কোনো মেয়েছেলে রেল লাইনে গলা পাইত্যা বইস্যা আছে কিনা। তোমার চাচি অর্থাৎ আমার পরিবার এমন একটা ঘটনা ঘটাইতে পারে। সে আমারে কিছু বলে নাই—অন্য কয়েকজনকে বলেছে। তার মনে বেজায় দুঃখ। এর মধ্যে নিন্দালীশের পীর সাহেব ফতোয়া দিয়েছেন। এই বিষয়ে কিছু শুনেছ?

জি না।

তুমি পুলাপান মানুষ তোমার শোনার কথাও না। পীর সাহেব ফতোয়া দিয়েছেন—বাজারের মেয়েছেলের গলার স্বর যতদূর শোনা যাবে ততদূর পর্যন্ত ফিরেশতা আসবে না। ফিরিশতা না আসলে নামাজও কবুল হবে না। এই মেয়েগুলোরে উঠাইবার ব্যবস্থা। এরা যাইব কই কও দেখি। একটা কুত্তার জন্যেও তো আমরার ঘরের চিপাত জায়গা আছে। এরা তো কুত্তা বিলাই না। আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও—তুমি পুলাপান মানুষ। তোমারে আর কী বলব? কোনো মেয়েছেলে রেল লাইন ধইরা হাঁটাহাঁটি করে কিনা খিয়াল রাখবা। আমি নিজেও খিয়াল রাখি। রাইতের ঘুম অনেক দিন হইল বাদ দিছি।

কুসুম আপুর মধ্যে কি কোনো পীরিতি আছে? সে যা বলে তাই দেখি হয়। বলেছিল জাপানি ইঞ্জিনিয়ার রাতেই চলে আসবে। আসলেই তাই হয়েছে। সরিষা নিয়ে ফিরে দেখি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এসেছেন। বাবার সঙ্গে কথা বলছেন। তার রাতের বেলা আসার কারণ হল— তাঁবুর ভেতর সাপ ঢুকেছে। একটা না দুটা। তিনি এসেছেন কার্বলিক এসিডের খোঁজে। বাবা বললেন, পল্লী। অঞ্চলে এই সব জিনিস তো পাওয়া যায় না। আনাতে হয় ময়মনসিংহ থেকে। আমি আবদুর রহমানকে পাঠায়ে কাল দিনের মধ্যে আনায়ে দিব। আপনি আজ রাতটা এখানেই থাকেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বললেন, তার কোনো দরকার নেই। আমি এক কাপ চা খেয়ে চলে যাব। তাঁবুর ভেতর জ্বলন্ত হারিকেন থাকবে।

বাবা বললেন, অসম্ভব। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আপনাকে আমি ছাড়ব না। ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে। ইলিশ মাছ দিয়ে চারটা ভাত আমার সঙ্গে খেয়ে এই গরিব খানায় শুয়ে থাকবেন।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে দেখে মনে হল নিতান্ত অনিচ্ছায় তিনি রাজি হয়েছেন।

কুসুম আপু সব শুনে বলল, সাপ খোপ কিছু না। এখানে থাকবে এই বুদ্ধি করেই এসেছে।

আমি বললাম, বুঝলে কী করে।

কুসুম আপু ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মেয়েরা এইসব জিনিস বুঝতে পারে। ব্যাটাছেলেরা পারে না। টগর শোন, গল্প করার জন্যে আমাকে যখন ডাকবে তুই বলে দিবি আমার জ্বর।

আচ্ছা।

গায়ে হাত দিয়ে দেখ তো জ্বর কমেছে কিনা।

আমি কুসুম আপুর কপালে হাত রাখলাম। জ্বর কমে নি, বরং অনেক বেড়েছে। শরীর দিয়ে ভাপ বেরুচ্ছে। অথচ কুসুম আপু কত স্বাভাবিক ভাবেই না কথা বলছে। আমার ধারণা ইচ্ছে করলে এই জ্বর নিয়েও কুসুম আপু জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সঙ্গে সারারাত গল্প করতে পারবে। হাসাহাসি করতে পারবে।

কুসুম আপুর জ্বর, তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন আসতে পারবেন না এই খবর শুনে জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের চোখ মুখ কেমন যেন হয়ে গেল। যেন তিনি বিরাট এক দুঃসংবাদ শুনেছেন। যেন চোখের সামনে মগরা ব্রিজের মাঝখানের স্প্যানটা পানির তোড়ে ভেসে গেছে। রেল লাইন শূন্যে ভাসছে। এদিকে সিগন্যাল ডাউন হয়েছে। ট্রেন আসছে।

জ্বর খুব বেশি?

জি।

শুয়েছে কোথায়? চল তার ঘরে গিয়ে তাকে দেখে আসি।

কুসুম আপুর ঘরে যাওয়া যাবে না। উনার ঘরে গেলে উনি খুব রাগ করেন। কুসুম আপু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছেন। এখন দরজা ধাক্কা দিলে চিৎকার করবেন।

জাপানি ইঞ্জিনিয়ার মুখ কালো করে বললেন, তাহলে থাক।

বাবা ইস্টিশনে ঘুমুতে চলে গেলেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের থাকার জায়গা গল ভাইয়ার ঘরে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, তুমিও কি এই খাটে ঘুমাবে?

আমি বললাম, জি।

উনি বললেন, আমার তো একটা প্রবলেম আছে। আমি কারো সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে পারি না। ভালো ঝামেলায় পড়লাম দেখি। আচ্ছা তুমি ঘুমাও—আমি রাতটা বারান্দার চেয়ারে বসে পার করে দেব।

আর তখনি মা খুব হইচই কান্নাকাটি শুরু করলেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চমকে উঠে বললেন, ব্যাপার কী কাঁদে কে?

আমি বললাম মা কাঁদছে। উনার মাথার যন্ত্রণা হলে এ রকম করেন।

উনি ভীত গলায় বললেন, আমার কাছে তো পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে। জিনিস পত্রও তো ভাঙ্গাভাঙ্গি হচ্ছে তোমার মার মাথা খারাপ নাকি?

আমি আহত গলায় বললাম, না।

উনি বললেন, এই বাড়িতে সিনিয়ার কেউ নেই? কুসুমের মা? উনাকে একটু ডাক আমি কথা বলি। মাই গড। আমার তো ধারণা আমি ভয়াবহ বিপদে পড়েছি। ডাক। কুসুমের মাকে ডাক৷

আমি বললাম, রহিমা ফুপু বাইরের কোনো পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না।

ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম তো। আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ঘুমাও। আমি বারান্দায় আছি। তবে ঠিক নেই। আমি চলেও যেতে পারি।

উনি একা বারান্দায় বসে রইলেন। ঝুমঝুম বৃষ্টি শুরু হল। আমি বিছানায় শুয়ে জেগে থাকার চেষ্টা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙ্গল খুব ভোরে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ঘর আবছা আলো হয়ে আছে। এ-রকম সময় ঘুম ভাঙ্গাটা খুব আনন্দের। চোখ বন্ধ করলেই সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়া যায়। আমি ঘুমোতে পারলাম না। কারণ কুসুম আপুর গলা শোনা যাচ্ছে। আপু জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলছে। মনে হচ্ছে আপু কথা বলে খুব মজা পাচ্ছে।

দুটা সাপ দেখেই আপনি ভয় পেয়ে পালিয়ে এলেন। আপনি হচ্ছেন সর্প খাদক। আপনার উচিৎ ছিল সাপ দুটি ধরে কেটে কুটে খেয়ে ফেলা। একটার ঝোল আর একটার দোপেয়াজা।

তুমি তো আশ্চর্য মেয়ে সাপ সাপ করেই যাচ্ছ। সাপ ছাড়া এই পৃথিবীতে কথা বলার আর বিষয় নেই।

আপনি কথা বলুন আমি শুনছি। দেখি কাছে আসতো তোমার জ্বরের অবস্থাটা দেখি।

আধঘন্টার মধ্যে চারবার জ্বর দেখলেন। এর চে একটা কাজ করলে কেমন হয় আপনি সারাক্ষণ একটা হাত আমার কপালে দিয়ে রাখেন। হি হি হি।

কুসুম আপু হেসেই যাচ্ছে। সেই হাসি থামছে না। আমি কুসুম আপুর হাসি। শুনতে-শুনতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ