টেলিফোনের শব্দে দিলশাদ জেগে উঠল। অনেক রাত, ঘর অন্ধকার। মাথার কাছে দেয়ালঘড়ি টিক টিক করছে। বেশ বাতাস। বাতাসে জানালার পর্দা নড়ছে। চারপাশের পৃথিবী পরিচিত, শব্দাবলি পরিচিত। কিন্তু যে টেলিফোনের শব্দ ঘুম ভাঙাল সেই টেলিফোন এলো কোত্থেকে? এ বাসায় টেলিফোন নেই। কখনো ছিল না। সাজ্জাদের যখন দিনকাল ভালো ছিল তখনো না। সাজ্জাদ টেলিফোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করেছিল, লাইন আসে নি। কে জানে এতদিনে হয়তো এসেছে। পুরনো বাড়িতে টেলিফোন মিস্ত্রিরা ঘোরাঘুরি করছে।

তাহলে ঘুমের মধ্যে টেলিফোনের পরিষ্কার আওয়াজ সে শুনল কীভাবে? শুধু যে ঘুমের মধ্যে শুনেছে তা না। ঘুম ভাঙার পরেও শুনেছে টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। আশ্চর্য তো! তাহলে কি কলিংবেলের আওয়াজ? এ বাসায় কলিংবেল আছে, তার শব্দও টেলিফোন রিং-এর কাছাকাছি। তবে গত দুদিন ধরে সেই কলিংবেল নষ্ট। ফ্ল্যাট বাড়ির কেয়ারটেকার ত্রিশ টাকা নিয়ে গেছে কলিংবেল ঠিক করার জন্যে, এখনো ঠিক হয় নি।

দিলশাদ বিছানা থেকে নামল। বাতি জ্বালাল না। বেশিরভাগ মানুষ রাতে ঘুম ভাঙলে প্রথম যে কাজটি করে তা হচ্ছে বাতি জ্বালানো। হুড়মুড় করে ছুটে যায় সুইচ বোর্ডের দিকে। যেন এই মুহূর্তে সুইচ না টিপলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। দিলশাদের ব্যাপারটা অন্যরকম। সে রাতে ঘুম থেকে উঠে কখনোই বাতি জ্বালায় না। পানির পিপাসা পেলে অন্ধকারেই খাবার টেবিলের দিকে যায়। খাবার টেবিলে পিরিচে ঢাকা জগ থাকে, গ্লাস থাকে। দিলশাদের অন্ধকারে চলাচল করতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়া রাতে এই ফ্ল্যাট কখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয় না। ফ্ল্যাটের বারান্দায় চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাতি সারারাত জ্বলে। বড় রাস্তার পাশে ফ্ল্যাট। রাস্তার হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোও ঘরে ঢোকে।

সাজ্জাদের ধারণা, পুরোপুরি অন্ধকার দেখতে হলে জঙ্গলে যেতে হবে। সত্যিকার অন্ধকার শুধু জঙ্গলেই দেখা যায়। দিলশাদ ঠিক করে রেখেছে নাতাশার চিকিৎসার জন্যে বাইরে যাবার আগে দুদিনের জন্যে হলেও সাজ্জাদের সেই বিখ্যাত জঙ্গল দেখে আসবে। তার নিজের জন্যে নয়, জঙ্গল দেখা বা সত্যিকারের অন্ধকার দেখার শখ তার নেই। নাতাশার জন্যে যেতে হবে। নাতাশা তার বাবার জঙ্গল দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সেই অপেক্ষার ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছে না। এই মেয়ের সবকিছুই গোপন। নিজ থেকে সে কখনোই বলবে না তার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তার শারীরিক সুবিধা-অসুবিধার কথা জানার কোনো উপায় নেই। দিলশাদের ধারণা, এখন নাতাশার চোখের সমস্যা হচ্ছে। বই পড়ার সময় বই চোখের খুব কাছে নিয়ে আসছে। বেশিক্ষণ পড়ছেও না। মনে হয় পড়তেও কষ্ট হচ্ছে। আগে মাঝে মাঝে দেখা যেত খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সে তার খাতায় রাত জেগে লেখালেখি করছে। এখন তাও করে না।

দিলশাদ মেয়ের ঘরে ঢুকল। নাতাশা হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। খাটের একপাশ দেয়ালের সঙ্গে লাগানো, অন্যপাশে দুটি চেয়ার দেয়া। এই ঘরে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। জিরো পাওয়ারের আলো চাঁদের আলোর কাছাকাছি। শুধু চাঁদের আলোয় রহস্য আছে, এই আলোয় রহস্য নেই।

নাতাশা ঘুমুচ্ছে। তার গায়ে পাতলা একটা চাঁদর। কোলবালিশের উপর তার রোগা একটা হাত। কোলবালিশ নাতাশার পছন্দ না, তবু রোজ রাতে দিলশাদ কোলবালিশটা এনে বিছানায় দিয়ে যায়। খাটের পাশে চেয়ার দিয়ে দেয়াল তোলাও নাতাশার অপছন্দ। সে আহত গলায় বলে, তুমি চেয়ার দাও কেন মা? তোমার কি ধারণা আমি গড়িয়ে পড়ে যাব? চেয়ার সরিয়ে নাও তো, আমার বন্দি বন্দি লাগে। নাতাশার খুব অপছন্দের এই কাজটিও দিলশাদ করে। অনেক অপ্রিয় কাজ মাদের করতে হয়।

নাতাশার ঘরে পা দিয়েই দিলশাদের মনে হলো নাতাশা ঘুমুচ্ছে না, জেগে আছে। এরকম মনে হবার যদিও কোনো কারণ নেই। ঐ তো দেখা যাচ্ছে নাতাশার চোখ বন্ধ। ঘুমন্ত মানুষের মতো ধীর লয়ে তার নিঃশ্বাস পড়ছে।

দিলশাদ নরম গলায় ডাকল, নাতাশা! এই বুড়ি!

নাতাশা জবাব দিল না। অথচ দিলশাদ মোটামুটি নিশ্চিত ছিল নাতাশা চোখ মেলে বলবে, কী?

দিলশাদ খাবার ঘরের দিকে গেল। তার পানির পিপাসা হচ্ছে। খাবার টেবিলে পানির জগ-গ্লাস নেই। ফুলির মা আজকাল কাজকর্ম ঠিকমতো করছে না। রুটিন কাজে প্রায়ই ভুল করছে। তিনজন মানুষের সংসারে এরকম হবে কেন? দিলশাদ বাতি জ্বালাল। ফ্রিজের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করল। পানি ঠাণ্ডা হয় নি। ফ্রিজে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। গ্যাস ফুরিয়ে গেছে বা অন্য কিছু হয়েছে। পানি ঠাণ্ডা হয় না। ফ্রিজ ঠিক করার সামর্থ্য এখন দিলশাদের নেই। প্রতিটি পয়সা এখন তার কাছে সোনার টুকরোর মতো। তবে ফ্রিজটা ঠিক করতে হবে। নাতাশা ঠাণ্ডা পানি খেতে ভালোবাসে। তৃষ্ণা পেলেই বলবে, মা, ঠাণ্ডা পানি দাও তো।

খাবার ঘরের চেয়ারে দিলশাদ কিছুক্ষণ বসে রইল। বসে থাকতে ভালো লাগছে, তবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। খুব মশা। এক্ষুনি মশা তাকে হেঁকে ধরবে। দিলশাদ আবার নাতাশার ঘরে ঢুকল। আশ্চর্য, মেয়ে চুপচাপ খাটে বসে আছে। দিলশাদ বলল, ব্যাপার কী রে? নাতাশা লজ্জিত গলায় বলল, কিছু না।

আমি যখন তোকে ডাকলাম তখন তুই কি জেগে ছিলি?

হুঁ।

জবাব দিস নি কেন?

এমনি।

পানি খাবি?

না।

দিলশাদ খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসল। নাতাশার গায়ে কি জ্বর আছে? কিছুদিন হলো রাত করে জ্বর আসছে। বেশ ভালো জ্বর। দিলশাদ বলল, গা গরম নাকি রে মা?

উঁহু।

মেয়ের কথা দিলশাদের বিশ্বাস হলো না। সে মশারির ভেতর হাত ঢুকিয়ে মেয়ের গায়ের তাপ দেখল। জ্বর নেই, গা ঠাণ্ডা। একটু কি বেশি ঠাণ্ডা? শরীর কেমন হিম হয়ে আছে।

মাথার যন্ত্রণা নেই তো মা?

উঁহু।

মশারির ভেতর মশা ঢুকে নি তো?

দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। দিলশাদের উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু নাতাশার বোধহয় বিশ্রাম দরকার।

নাতাশা!

উঁ।

আচ্ছা, তুই কি টেলিফোনের শব্দ শুনেছিস?

না তো!

আমি শুনলাম টেলিফোন বাজছে।

ঘুমের মধ্যে শুনেছ।

তাই হবে, কিন্তু এত স্পষ্ট শুনলাম।

মাঝে মাঝে স্বপ্ন খুব স্পষ্ট হয়। আমি আজকাল প্রায়ই একটা খুব স্পষ্ট স্বপ্ন দেখি।

দিলশাদ আগ্রহের সঙ্গে বলল, কী দেখিস?

নাতাশা শব্দ করে হাসল। দিলশাদ হাসি শুনেই বুঝল এই মেয়ে আর কিছু বলবে না। এই প্রশ্ন আবার করলে সে আবারো হাসবে। দিলশাদ মশারির ভেতর ঢুকে গেল। নিজের ঘরে এখন আর তার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। নাতাশার পাশে শুয়ে পড়লেই হবে। বালিশ নেই। বালিশ আনতে নিজের ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না।

নাতাশা!

উ।

তোর সঙ্গে ঘুমুলে তুই কি রাগ করবি?

নাতাশা হাসল। মিষ্টি হাসি। হাসতে হাসতে বলল, মা, তোমার ঘুম আসছে না, তাই না?

ঠিক ধরেছিস।

এবং তুমি একটু ভয় পেয়েছ।

ভয় পাব কেন?

টেলিফোনের শব্দ শুনে ভয় পেয়েছ।

আমি এত সহজে ভয় পাই না।

আজ একটু পেয়েছ।

আচ্ছা যা, একটু পেয়েছি।

দিলশাদ পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। নাতাশা যে বলেছে মশা নেই তা ঠিক না। এই তো একটা মশা রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। খুঁজলে নিশ্চয়ই আরো পাওয়া যাবে। নাতাশা বলল, তোমার বালিশ লাগবে না?

না।

নাতাশার মাথা ধরেছে। চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা শুরু হলে দুটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। হয় কিছুক্ষণের মধ্যে প্রচণ্ড ঘুম পায়, নয়তো ব্যথা দেখতে দেখতে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন ইচ্ছা করে প্রচণ্ড শব্দে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে। যেন মাথাটা ফাটলেই ব্যথাটা বের হয়ে যাবে। আজ মাথার চাপা ব্যথাটা কোন দিকে যাবে নাতাশা বুঝতে পারছে না। আতঙ্কে তার শরীরের ভেতরটা কাঁপছে। এই কাপন বাইরের কারো বোঝার উপায় নেই।

নাতাশা!

কী মা?

তুই কি তোর বাবাকে তোর অসুখের কথা কিছু লিখেছিস?

না।

না লেখাই ভালো, শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করবে। বিদেশে যাবার সব ঠিকঠাক হলে আমিই জানাব।

আচ্ছা।

গল্প শুনবি?

শুনব।

নাতাশা মার কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে শুয়েছে। দিলশাদ মেয়ের গা ঘেসে এলো। একটা হাত রাখল মেয়ের গায়ের উপর। হালকা করে রাখল যেন চাপ না পড়ে।

ভূতের গল্প শুনবি?

হুঁ।

ভূতের গল্প শুনে আবার ভয় পাবি না তো?

ভয় পাবার জন্যেই তো ভূতের গল্প শোনা। হাসার জন্যে তো কেউ ভূতের গল্প শুনে না।

তাও তো কথা। শোন তাহলে, সত্যিকার ভূতের গল্প। এক বর্ণ মিথ্যা না। আমার মার মামার বাড়ি হচ্ছে সান্দিকোনা বলে একটা জায়গায়। তারা এককালে বিরাট জমিদার ছিলেন। খুব রমরমা ছিল। তাদের বসতবাড়ির নাম ছিল শতদুয়ারি। বাড়িটার দরজা ছিল একশটা। এইজন্যে শতদুয়ারি নাম। প্রকাণ্ড সব দরজা। যেমন মজবুত তেমন ভারি। দরজার কজায় প্রতি সোমবারে ঘি দেওয়া হতো যেন কাঁচ ক্যাচ শব্দ না হয়। সপ্তাহে ঘিয়ের বরাদ্দ ছিল একসের এক ছটাক…।

তুমি দেখেছ সেই বাড়ি?

হ্যাঁ। সেই গল্পই তো বলছি।

এখনো ঘি দেয়?

এখন ঘি দেবে কোত্থেকে? খাওয়ারই পয়সা জুটে না আর ঘি! গল্পটা শোন। শতদুয়ারি বাড়ির একটা দুয়ার সবসময় বন্ধ থাকত। খোলা নিষেধ ছিল। আমার নানাজানের বাবা নিষেধ করে গিয়েছিলেন। শুধু যে মুখে নিষেধ করে গিয়েছিলেন তাই না– দরজার গায়ে খোদাই করে লিখে গিয়েছিলেন। সংস্কৃত মেশানো অদ্ভুত বাংলা অদ্য দ্বাত্রিংশ শ্রাবণঃ ঐশ্য নির্দেশং ক্ষুধিতং…।

তোমার মুখস্থ মা?

হ্যাঁ। ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম। আমি আর বড় আপা। তখন মুখস্থ করেছি।

তোমার বয়স তখন কত?

ঠিক খেয়াল নেই। তবে কত আর হবে? সাত-আট হবে।

কোন ক্লাসে পড়তে?

তোর সঙ্গে গল্প করা ভারি মুশকিল। এত প্রশ্নের জবাব দিয়ে কি আর গল্প করা যায়?

কোন ক্লাসে পড়তে মনে নেই?

না।

আচ্ছা আর প্রশ্ন করব না। তুমি বলো।

দিলশাদ খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করল।

নাতাশা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার শরীর ঝিম ঝিম করছে। বড় ধরনের কোনো আনন্দময় ঘটনার আগে আগে শরীর যেমন ঝিম ঝিম করে সেরকম। নাতাশার এই আনন্দের কারণ তার মা’র গল্প নয়। আনন্দের কারণ হচ্ছে তার মাথাব্যথাটা ঘুমের দিকে যাচ্ছে। এক্ষুনি সে ঘুমিয়ে পড়বে। মা’র গল্প এখন খুব অস্পষ্টভাবে তার কানে যাচ্ছে। মা যেন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছেন। তার গলার স্বর অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে। নাতাশার ঘুম আসছে গাঢ় ঘুম, শান্তিময় ঘুম।

সেদিন কী হলো নাতাশা শোন। ঠিক করা হলো বন্ধ দরজাটা খোলা হবে। তালার চাবি তো অনেক আগে থেকেই নেই। মিস্ত্রি আনা হয়েছে তালা খোলার জন্যে। সে সন্ধ্যা থেকেই তালা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তালা খুলছে না… নাতাশা, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি?….

নাতাশা জবাব দিল না। দিলশাদ মেয়ের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল। ঘুমিয়ে পড়েছে। দিলশাদ মেয়ের কপালে হাত রাখল। কপাল ভেজা। সে ঘামছে। এমন ঘামা ঘেমেছে, মনে হচ্ছে গোসল সেরে উঠল।

গল্পটা শেষ করতে না পেরে দিলশাদের খারাপ লাগছে। আজ আর ঘুম আসবে না। তার বিশ্রী স্বভাব হয়েছে, রাতে ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না। সারারাত জেগে থাকতে হয়। তখন বড় নিঃসঙ্গ লাগে। দিলশাদ সাবধানে মেয়ের পাশ থেকে উঠে এলো। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে পুবদিকের বারান্দার দরজা খুলল। খুব সাবধানে খুলল। মেয়ের ঘুম যেন না ভাঙে। বিছানা থেকে নেমে আসার পর মনে হলো আরে, মশাগুলি তো মারা হলো না। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। দিলশাদ বারান্দার দিকে পা বাড়াল।

রেলিং দেয়া ছোট্ট বারান্দা। নামেই বারান্দা। আলো-বাতাস নেই। আকাশ দেখা যায় না। বারান্দার সামনে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং উঠছে– বারোতলা দালান। দৈত্যের মতো এই দালান দিলশাদের ছোট্ট বারান্দা ঢেকে ফেলেছে। রাতের বেলা বারান্দায় এলে সামনের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটাকে জেলের পাঁচিলের মতো লাগে।

বারান্দায় একটা গদি বসানো বেতের চেয়ার আছে। মেঝের পুরোটা ওয়াল টু ওয়াল কার্পেটের মতো করে শীতল পাটিতে ঢাকা। ছাদের কার্নিশ থেকে ঝুলন্ত টবে অর্কিড। দিলশাদের খুব শখের গাছ। নীল রঙের ফুল যখন ফুটে দিলশাদের অদ্ভুত লাগে।

দিলশাদ বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসল না। মেঝের শীতল পাটিতে বাচ্চাদের মতো পা ছড়িয়ে বসল। কাল বৃহস্পতিবার হাফ অফিস। কাল সারাদিনে কী করবে ভেবে নেয়া যাক। অফিসের পর সে বাসায় না এসে সরাসরি চলে যাবে বড় দুলাভাই ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের অফিসে। ওয়াদুদুর রহমান সাহেবের নিজের অফিস বলেই তিনি ছুটির দিনেও অফিসে থাকেন। তারপরেও টেলিফোন করে যাবে। নাতাশাকে বাইরে পাঠানোর টাকা এক্ষুনি জোগাড় করতে হবে। হাতে সময় নেই। বড় দুলাভাইয়ের কাছে সরাসরি চাওয়াই ভালো। আপার কাছে চেয়ে কিছু হবে না। দুলাভাইয়ের সংসারে আপার অবস্থা জাপানি পুতুলের মতো। তাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে দেয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু না।

ওয়াদুদুর রহমান সাহেবকে দিলশাদ সহ্যই করতে পারে না। তার আচার আচরণ দিলশাদের কাছে অতীতে অরুচিকর মনে হয়েছে, এখনো হয়। বড় আপার বিয়ের পর তিনি এক রাতে তাঁর দুই শালী এবং স্ত্রীকে রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন। যাবার আগে ঘোষণা দিলেন আমার দুই শালী থাকবে আমার দুই পাশে এবং আমি আমার দুহাত শালীদের কোলে ফেলে রাখব। এইটুকু সুযোগ না পেলে সুন্দরী শালী থাকার মানে কী? হা হা হা।

তিনি যে সিনেমাহলে ঢুকে সত্যি সত্যি শালীদের কোলে হাত রাখবেন দিলশাদ তা কল্পনাও করে নি। সে হতভম্ব হয়ে গেল এবং চাপা গলায় বলল, দুলাভাই, হাত সরিয়ে নিন। ওয়াদুদুর রহমান বললেন, পাগল হয়েছ? দিলশাদ বলল, দুলাভাই, আমি কিন্তু উঠে চলে যাব। ওয়াদুদুর রহমান হাত সরিয়ে নিলেন।

বাসায় ফিরে দিলশাদের বড় আপা দিলশাদের সঙ্গে খুব রাগরাগি করল। থমথমে গলায় বলল, তুই এরকম করলি কেন? তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? দুলাভাইরা শালীদের সাথে ঠাট্টা-মশকরা করে না? তুই বিশ্রী ব্যবহার করলি! বেচারা মনে কষ্ট পেয়েছে। কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।

দিলশাদ বলল, গম্ভীর হয়ে থাকলেও কিছু করার নেই আপা। এই জাতীয় ঠাট্টা আমার পছন্দ না।

কোলে হাত রাখলে কী হয়?

কিছুই হয় না, কিন্তু আমার ভালো লাগে না।

আসলে তুই বেশি পেকে গেছিস। এত পাকা ভালো না।

পেকে যখন গেছি তখন তো আর করার কিছু নেই। পেকে যাওয়া ফল কাঁচা করার কোনো পদ্ধতি নেই।

এখন চা নিয়ে তোর দুলাভাইয়ের কাছে যা, তার রাগ ভাঙা। বেচারা যা মন খারাপ করেছে আমারই কান্না পাচ্ছে।

দিলশাদ চা নিয়ে গেল। দেখল, দুলাভাই মোটেই মন খারাপ করে নেই। দিলশাদের মেজোআপা দিলরুবার সঙ্গে মোটা দাগের রসিকতা করে যাচ্ছেন। নিজের রসিকতায় নিজেই হাসছেন। দিলশাদের বড় আপা এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল এবং হাসিমুখে বলল, এই শোন, দিলুদের ঐ গল্পটা বলো তো, মোটা শাশুড়ি আর চিকন বৌয়ের গল্প। একটু অবসিন কিন্তু দারুণ ফানি। ওরা শুনলে মজা পাবে। প্লিজ। একটু রেখে-ঢেকে বলল।

ওয়াদুদুর রহমান তৎক্ষণাৎ মোটা শাশুড়ি আর চিকন বৌয়ের গল্প শুরু করলেন। রেখে-ঢেকে বলার পরেও গল্পের শেষটা শুনে দিলশাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার উপক্রম হলো। তার বড় আপা হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে হেঁচকি উঠিয়ে ফেলল। দিলশাদ ভেবে পেল না তার আপা কী করে এমন আপত্তিকর একটা গল্প তাদের বলতে বলল। বোকা বলেই বোধহয় বলল। স্বামীকে খুশি করার জন্যে বোকা স্ত্রীরা হাস্যকর সব জিনিস করে।

ওয়াদুদুর রহমান কি দিলশাদকে লাখ দুই টাকা দেবেন না? সম্ভবত দেবেন। তাঁর হাতে টাকা আছে। তবে দ্রলোক যেহেতু ব্যবসায়ী সেহেতু টাকা ফেরত আসবে কি-না এই চিন্তাটা তাঁর মাথায় থাকবে। দিলশাদের প্রথম কাজ হচ্ছে ভদ্রলোকের মাথা থেকে এই দুঃশ্চিন্তা দূর করা। কীভাবে দিলশাদ তা করবে তা ঠিক করা আছে। সে অনেক ভেবে-টেবে ঠিক করেছে।

দিলশাদের বাবার হাতেও কিছু টাকা আছে। তার বাবা রিটায়ার্ড ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হাদিউজ্জামান সাহেব তার গ্র্যাচুইটি, সারেন্ডার করে দেওয়া পেনশনের টাকা ব্যাংকে জমা করে রেখেছেন। টাকার পরিমাণ ঠিক কত তা দিলশাদ জানে না। তবে তার অনুমান তিন-চার লাখ টাকা হবে। তাঁর কলাবাগানের দুতলা বাড়ির একতলায় তিনি থাকেন। দুতলাটা ভাড়া দেন। ভাড়ার টাকায় খুব হিসেব করে সংসার চালান।

হাদিউজ্জামান সাহেব প্রায়ই বলেন, আমার তো আর ছেলে নেই যে, বুড়ো বয়সে ছেলের সংসারে থাকব। মেয়েদের সংসার হলো পরের সংসার, সেখানে আমাদের জায়গা হবে না। আমাদের ব্যবস্থা আমাদেরই দেখতে হবে। আমি কাউকে কিছু দেব না। অন্যদেরও আমাকে কিছু দিতে হবে না।

গত রোজার ঈদে দিলশাদ তার বাবার জন্যে মটকার একটা পাঞ্জাবি এবং মা’র জন্যে টাঙ্গাইলের সুতির শাড়ি নিয়ে গেল। হাদিউজ্জামান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, মা, পাঞ্জাবি এনেছ অত্যন্ত খুশি হয়েছি। কিন্তু আমি তো মা তোমার এই পাঞ্জাবি রাখতে পারব না। ইসলাম ধর্মে পুরুষদের রেশমি পোশাক পরা নিষেধ।

দিলশাদ বলল, এটা বদলে সুতির পাঞ্জাবি নিয়ে আসি?

না। আমার জন্যে এবং তোমার মার জন্যে কিছুই আনবে না। উপহার পেলেই উপহার দিতে হয়। আমার কিছু দেবার সামর্থ্য যখন নেই তখন নেবার উপায়ও নেই। তোমরা কষ্ট পাও বা রাগ কর আমার কিছুই করার নেই।

দিলশাদের ধারণা তার বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মাথা খারাপের বীজ আগেই ছিল। যেদিন রিটায়ার করলেন সেদিনই বীজ থেকে চারা বের হলো। যত দিন যাচ্ছে ততই চারা ডালপালা প্রসারিত করে বাড়ছে। সারাজীবন ঘোর নাস্তিক হাদিউজ্জামান সাহেব এখন এক পীর সাহেবের কাছে যাতায়াত শুরু করেছেন। যুবক বয়েসী পীর। চুল-দাড়ি সবই কালো। তাকেই তিনি পরম শ্রদ্ধাভরে বাবা ডাকছেন। দেখা হলেই কদমবুসি করছেন। কঠিন কদমবুসি। পা থেকে ধুলা নিয়ে সত্যি সত্যি কপালে ঘষেন। পীর সাহেব তাঁকে দশলক্ষ একবার সূরা কাফ পড়তে বলেছেন। পড়া শেষ হলেই তিনি তাকে নিয়ে চিল্লায় যাবেন। সেখানে তার জন্যে খাস দিলে দোয়া করা হবে। যার পরপরই বাতেনি জগৎ হাদিউজ্জামান সাহেবের কাছে ধরা দেবে।

বাতেনি জগৎ ধরার জন্যে হাদিউজ্জামান সাহেব এখন সূরা কাফ পড়ে যাচ্ছেন। চার লক্ষ বারের মতো পড়া শেষ হয়েছে। সূরা পাঠের জন্য একটা ঘর আলাদা করা হয়েছে। সেই ঘরে কোনো আসবাব নেই। তিনি নিজের হাতে মেঝে ধোয়ামোছা করেন। অন্য কারো সেই ঘরে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। মাগরেবের নামাজের পর তিনি তাঁর এই ঘরে মোমবাতি জ্বেলে দেন। মোমবাতির আলোয় সূরাপাঠ চলতে থাকে। এশার নামাজের ওয়াক্ত না হওয়া পর্যন্ত সূরাপাঠ থামে না। রাতে যখন ঘর থেকে বের হন তখন ঘামে তার সারা শরীর ভেজা থাকে। চোখ হয় টকটকে লাল। তিনি নাকি সূরাপাঠের সময় বিচিত্র সব শব্দ শুনতে পান। কারা নাকি তার কানে পেছন দিক থেকে ফুঁ দেয়।

এ দেশের স্ত্রীরা যতই স্বাধীনচেতা হোক, তারা স্বামীর অনুকরণ ও অনুসরণ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারেন না। দিলশাদের মা মনোয়ারা বেগমও তার ব্যতিক্রম নন। তিনিও এখন নিয়মিত স্বামীর সঙ্গে পীর সাহেবের কাছে যান। পীর সাহেবকে ভক্তিভরে কদমবুসি করেন। তিনিও মাগরেবের পর তসবি হাতে বসেন এশার নামাজের আগে সেই তসবি তার হাত থেকে নামে না। ইদানীং তিনিও বলছেন তসবি পাঠের সময় কারা যেন তার চারপাশে ফিসফাস করে। তিনি অপূর্ব সুগন্ধ পান। কাঁঠালিচাপা ফুলের গন্ধের মতো গন্ধ। সেই গন্ধে তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে। দিলশাদের ধারণা তার মা’র এই কথাগুলো বানানো। তিনি স্বামীকে খুশি করার জন্যেই মিথ্যা গল্প বানিয়েছেন।

মনোয়ারা বেগম তার মেয়েকে বলে দিয়েছেন এক লাখ টাকার ব্যবস্থা তিনি যেভাবেই হোক করে দেবেন। এই ব্যাপারে দিলশাদ যেন নিশ্চিন্ত থাকে। দিলশাদ নিশ্চিন্ত নেই। কারণ টাকাপয়সা মনোয়ারার নিয়ন্ত্রণে নেই। হাদিউজ্জামান সাহেব বর্তমানে বাতেনি জগতের সন্ধানে ব্যস্ত থাকলেও ইহলৌকিক ব্যাপারগুলিও কঠিন নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। একপোয়া মুড়ি আনার জন্যে দশটা টাকাও মনোয়ারা বেগমকে স্বামীর কাছ থেকে নিতে হয়।

দিলশাদ ঠিক করেছে সে তার বাবার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে। এই কথোপকথনে সে মাকেও সঙ্গে রাখবে না। স্ত্রীর সমর্থনসূচক যে-কোনো কথায় হাদিউজ্জামান সাহেব বিরক্ত হন। এই মুহূর্তে বাবার বিরক্তি তার কাম্য নয়।

টাকার জন্যে সাজ্জাদের দিক থেকে যে-সব আত্মীয়স্বজন আছে তাদের কাছে কি সে যাবে? যাবার কোনো মানে হয় না। সাজ্জাদের বড়ভাই থাকেন জয়দেবপুরে। রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সিনিয়ার সাইন্টিফিক অফিসার। তাকে তার নিজের সংসার দেখতে হয় এবং বিধবা ছোটবোনের সংসার দেখতে হয়। দ্রলোকের স্ত্রী আর্থাইটিসে প্রায় পঙ্গু। ভয়াবহ টানাটানিতে সংসার চলে। তারপরেও ব্যবসার জন্যে তিনি সাজ্জাদকে একসময় দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডে তার কিছু ছিল না। টাকাটা দিয়েছিলেন ধার করে। সেই টাকা ফেরত দেয়া হয় নি।

নাতাশার খবর জানলে তিনি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, তবে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না। খুব লজ্জার মধ্যে পড়বেন। কী দরকার তাকে লজ্জা দিয়ে।

সাজ্জাদের এক মামা থাকেন পুরনো ঢাকায়। দ্রলোকের প্রচুর টাকা। কাপড়ের ব্যবসা করেন। দিলশাদের বিয়েতে একশ টাকার প্রাইজবন্ড দিয়েছিলেন। তাঁর কাছে কিছুই পাওয়া যাবে না। তবু দিলশাদ একবার যাবে। ভয়ঙ্কর কৃপণ মানুষও মাঝে মাঝে খুব দয়ালু হয়ে যায়। চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কিছু নেই।

দিলশাদের নিজের সঞ্চয় সামান্যই। বিয়ের সময়ে পাওয়া বেশ কিছু গয়না ছিল। তার বাবা দিয়েছিলেন। মা নিজের গয়না তিন ভাগ করে তিন মেয়েকে দিয়েছিলেন। তার পরিমাণও কম ছিল না। সেইসব গয়নার কিছুই নেই। একদিন কী কারণে স্টিলের আলমারির লকার খুলে দেখে লকারে রাখা বিসকিটের টিন খালি। বিসকিটের টিনে সব গয়না ছিল। দিলশাদ শুধু উপন্যাসেই পড়েছে স্বামী নেশার পয়সার জন্যে স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে দেয়। স্ত্রী গয়নার শোকে কাঁদতে কাঁদতে বিছানা নেয়। উপন্যাসের মতোই তার জীবনে গয়না বিক্রির ব্যাপার ঘটেছে, শুধু সে কাঁদতে কাঁদতে বিছানা নেয় নি। শান্ত গলায় বলেছে- কাজটা করলে কীভাবে? একদিনে নিশ্চয়ই সব গয়না বিক্রি কর নি আস্তে আস্তে করেছ, তাই না? না-কি একদিনেই বিক্রি করেছ?

সাজ্জাদ অস্বস্তির সঙ্গে বলেছে, বিক্রি করি নি। বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছি। তোমাকে রশিদ দেখাতে পারব।

দেখাও, রশিদ দেখাও।

সাজ্জাদ রশিদ খোঁজা শুরু করল। এই স্যুটকেস খুঁজে, ঐ স্যুটকেস খুঁজে। বইয়ের পাতার ফাঁকে দেখে। রশিদ খোজার আশ্চর্য অভিনয়।

দিলু, তুমি বিশ্বাস করছ না। রশিদ সত্যি আছে। তোমার চোখে যেন না পড়ে সে-জন্যে গোপনে কোনো জায়গায় রেখে নিজেই ভুলে গেছি। তিন মাসের মধ্যে তোমার সব গয়না আমি এনে দিব। আজ থেকে ঠিক তিন মাস।

অনেক তিন মাস পার হয়েছে, গয়না আসে নি। আর কোনোদিন এই প্রসঙ্গ নিয়ে দিলশাদ কথা বলে নি। তার রুচি হয় নি।

নাতাশা তার বাবার এই দিকগুলি জানে না। দিলশাদ জানতে দেয় নি। মেয়েটা তার বাবাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। বাবার এইসব দুর্বলতা জানার পরেও সে নিশ্চয়ই তার বাবাকে ভালোবাসবে কিন্তু মেয়েটার ভালোবাসার অপমান হবে। মা হয়ে দিলশাদ তা করতে দিতে পারে না।

দিলশাদ খুব ভালো করে জানে, নাতাশা তার বাবা-মা’র ভেতরের প্রচণ্ড দূরত্বের জন্যে তাকেই দায়ী করে। কারণ তাকেই সাজ্জাদের সঙ্গে রূঢ় কঠিন আচরণগুলি করতে হয়। নাতাশা শুধু তিক্ততাটাই দেখে তিক্ততার উৎস সম্পর্কে জানে না। যেমন- নাতাশা কোনোদিনই জানবে না তার মেজোখালা এক সন্ধ্যাবেলা এসে ফিসফিস করে দিলশাদকে কী বলে গেল।

সে শুধু দেখেছে, তার মা পাথরের মতো হয়ে গেছে। রাতে কিছু খায় নি। এবং সারারাত এক ফোঁটা ঘুমায় নি। তোরবেলা নাতাশা বলেছিল, তোমার কী হয়েছে মা? তোমাকে এমন ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে কেন?

দিলশাদ বলেছে- মারে, আমার শরীরটা খারাপ।

নাতাশা বলেছে–তোমার শরীর খারাপ না মা। তোমার মন খারাপ। শরীর খারাপ হলে চেহারা একভাবে খারাপ হয়। মন খারাপ হলে অন্যভাবে খারাপ হয়। বলল তো কী হয়েছে?

দিলশাদ চুপ করে থেকেছে। সেদিন সে অফিসেও যায় নি, তার বারান্দায় চুপচাপ বসেছিল। নটার দিকে সাজ্জাদ ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘসতে ঘসতে বারান্দায় এসে বলল, কী ব্যাপার, অফিস যাও নি?

দিলশাদ বলেছে–না।

শরীর খারাপ করেছে? জ্বর-জারি? দেখি টেম্পারেচারটা দেখি।

দিলশাদ কঠিন গলায় বলেছে, গায়ে হাত দেবে না।

এর জবাবে সাজ্জাদ কী একটা রসিকতা যেন করেছিল। কী রসিকতা করেছিল দিলশাদের মনে নেই। তার শুধু মনে আছে সে ভেতরে ভেতরে থরথর করে কাঁপছিল। তার মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল– তুমি মেজোআপার বাসায় গত বৃহস্পতিবার গিয়ে কী করেছ?

সে নিজেকে সামলেছে। কথাগুলি বলা কষ্টের, না বলা আরো কষ্টের।

দিলশাদের মেজোআপা দিলরুবা অবশ্যি খুব সহজভাবেই কথাগুলি বলেছে। সন্ধ্যাবেলা এসেছে। চা খেয়েছে। গল্পটল্প করে উঠে চলে যাবার সময় হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলেছে দিল, তোকে একটা কথা বলি। রাগ করিস না।

দিলশাদ বলল, এমন কী কথা বলবে যে রাগ করব?

হাসব্যান্ডের ব্যাপারে মেয়েরা খুব সেনসেটিভ হয়– এইজন্যেই বলছি।

দিলশাদ শংকিত চোখে তাকাল। দিলরুবা বলল, সাজ্জাদ তোর মেজো দুলাভাইয়ের কাছে বেশ কয়েকবার এসেছে। তার কিছু টাকা দরকার এইজন্যে। এটা তুই বোধহয় জানিস।

না, আমি জানি না।

যাই হোক, ও বিশ হাজার টাকা চাচ্ছে। তোর দুলাভাই দিতে পারছে না। তার ব্যবসার অবস্থা ভালো না। সে স্পষ্ট না করে দিয়েছে। তারপরেও বার বার এসে, এমন চাপাচাপি–খুব অস্বস্তিকর অবস্থা।

আমাকে বলল নি কেন?

আমি ভাবতাম তুই জানিস।

না, আমি জানতাম না।

যাই হোক, সমস্যায় পড়লে আত্মীয়স্বজনের কাছে টাকা ধার চাওয়া কোনো অন্যায় না।

এরচে অন্যায় কিছু কি সে করেছে?

দিলরুবা হাসিমুখে বলল, তুই চোখ-মুখ যেভাবে শক্ত করে ফেলেছিস, তোকে বলতেই তো ভয় লাগছে। যাই হোক, শোন, সাজ্জাদ গত বৃহস্পতিবার গিয়েছে আমাদের বাসায়। আমরা কেউ বাসায় ছিলাম না। ও রাত নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। আমার কাজের বুয়া তাকে চা দিয়েছে। ফ্রিজে গাজরের হালুয়া ছিল। হালুয়া দিয়েছে। ও খেয়েদেয়ে চলে এসেছে। তারপর থেকে বসার ঘরে সাইড টেবিলে রাখা কৃস্টালের ঘড়িটা নেই। এবোনাইটের উপর কৃস্টালের যে ঘড়ি। মৎস্যকন্যার মূর্তির মতো।

তুমি বলতে চাচ্ছ ঘড়িটা সে চুরি করেছে?

আমার কাজের মেয়েটা বলছিল সে হালুয়া নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে সাজ্জাদের। হাতে ঘড়ি। সে খুব মন দিয়ে ঘড়ি দেখছে।

দিলশাদ আবার বলল, তুমি বলতে চাচ্ছ সে তোমার ঘড়ি চুরি করেছে?

এই তো তুই রেগে যাচ্ছিস। হয়তো ঠাট্টা করে নিয়েছে। হয়তো মনের ভুলে পকেটে রেখে দিয়েছে। এইরকম ভুল তো মানুষ সবসময় করে। করে না? তবে ঘড়িটা তোর দুলাভাইয়ের খুব শখের। সেবার আমেরিকায় গিয়ে ‘মেসিস’ স্টোর থেকে কিনেছে। ট্যাক্স নিয়ে দাম পড়েছে দুশ চল্লিশ ডলার। দামটা কোনো ব্যাপার না– শখের জিনিস তো। টাকা দিয়ে তো আর শখের জিনিসের দাম হয় না।

হড়বড় করে দিলরুবা আরো অনেক কথা বলেছে কিছুই দিলশাদের কানে যায় নি। সে পলকহীন চোখে তাকিয়েছিল, একবার শুধু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়েছিল- আপা, চুপ কর। প্লিজ চুপ কর। তাও বলে নি।

সাজ্জাদ যেদিন বলল, সে বান্দরবন যাবে সেদিন আন্তরিকভাবেই দিলশাদ খুশি হয়েছিল। চলে যাক। চোখের আড়ালে চলে যাক। চলে যাবার দিন সে সাজ্জাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। খারাপ ব্যবহারটা নাতাশার চোখে পড়েছে। খারাপ ব্যবহারের পেছনের কারণটা সে জানে না। কোনোদিন জানবে না। সবকিছু সবাইকে জানতে নেই।

.

ফজরের আজান পড়ছে। ঢাকা শহরে শত শত মসজিদ। আগামী দশ মিনিট ধরে আজান হতে থাকবে। কাছ থেকে, দূর থেকে ঘুম ভাঙানোর জন্যে মোয়াজ্জিন অতি মধুর গলায় আহ্বান জানাবেন–

“আসসালাতু খাইরুম মিনাননাউম।”

‘ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম।”

দিলশাদের নানিজান তাকে বলেছিলেন, ঘুম ভাঙানোর জন্যে আজান দেওয়া হলেও, যারা দুষ্ট লোক, আজানের শব্দে তাদের ঘুম গাঢ় হয়। ফজরের আজান হচ্ছে তাদের কাছে ঘুমপাড়ানি গানের মতো। দিলশাদের মনে হচ্ছে সে একজন দুই মহিলা। আজানের শব্দে ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে পাটিতে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটি জীবকোষ ঘুমিয়ে পড়ছে। গভীর অবসাদের ঘুম। যেন এই ঘুম কোনোদিন ভাঙবে না।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ