হাসানের মাথায় ক্রিকেটারদের টুপির মতো শাদা টুপি। গায়ে হালকা নীল রঙের শার্ট। পরনে জিনসের তিনচার পকেটওয়ালা প্যান্ট। কিন্তু পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। গতকালই গর্তে পড়ে পায়ের গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। জুতা পরার কোনো উপায় নেই। সাইটে কাজ করার সময় তার পায়ে থাকে কাপড়ের জুতা। আগামী কয়েকদিন এই জুতা সে পরতে পারবে তেমন সম্ভাবনা নেই। তার ডান পা ফুলে উঠেছে। এখন পা ফেললেই তার জন্যে সমস্যা।

সকাল দশটা।

হাসান আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে চারপাশের অবস্থা দেখে সে মোটামুটি তৃপ্ত। তবে আরো অনেক কিছু করার বাকি। এক সপ্তাহে কাজ যতটুকু আগানোর কথা ততটুকু অবশ্যি আগায়নি। তিনটা টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। ডীপ টিউবওয়েলের কাজ চলছে— এখনো শেষ হয়নি। দুটা বড় জেনারেটর চলে এসছে। ইলেকট্রিক লাইন টানার কাজ মোটামুটি শেষ।

ওয়ার্কারদের থাকার জন্যে চারটা লম্বা টিনের শেড করা হয়েছে। এই মুহূর্তে একশ আঠারোজন ওয়ার্কার কাজ করছে। এই সংখ্যা আরো বাড়বে। আরো দুটা টিনশেড বানাতে হবে। একেক ধরনের ওয়ার্কার একেকটা টিনশেডে থাকবে। মাটি কাটার মানুষরা একটিতে, রাজমিস্ত্রিরা আরেকটিতে, লোহার কারিগররা আরেকটিতে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি। অনেকগুলি দল।

সংখ্যায় বেশি হলেই কাজ ভালো হয় না— সংখ্যাটাকে কাজে লাগানোর জন্যেও একদল হুকুম দেবার লোক লাগে। হাসান এই শ্রেণীর লোকেরই অভাব অনুভব করছে। তবে সে অত্যন্ত আনন্দিত যে মজুকে পাওয়া গেছে। মজুর বয়স চল্লিশের মতো–কাকলাসের মতো চেহারা। চামড়া রোদে পুড়ে প্রায় ঝলসে গেছে। গলার স্বরে সমস্যা আছে। কথা বলে চি চি করে। তার খুব ঘনিষ্ঠজন ছাড়া তার সব কথা কেউ বুঝতে পারে না।

মজু যে-কোনো কাজ জানে। যে-কোনো সমস্যা বুদ্ধি খাটিয়ে করতে পারে। মজুকে যদি বলা হয়–মজু এই কাজটা করতে হবে। সম্পূর্ণ মাটির ঘর বাড়ি হবে— ঘরের ছাদও মাটির। বৃষ্টি পড়লে মাটির ছাদ গলে বাড়ি ধসে যাবে। একটা বুদ্ধি বের কর যেন ছাদ ধসে না যায়। মজু দাঁত দিয়ে আঙুলের নখ কাটতে কাটতে বলবে— আচ্ছা।

পারা যাবে না?

মজু অবশ্যই হা-সূচক মাথা নাড়বে। হাসানের ধারণা মজুর ঘাড়ে কোনো সমস্যা আছে বলে সে না-সূচক মাথা নাড়তে পারে না। শারীরিক সমস্যার কারণে হা-সূচক মাথা নাড়ে। যেহেতু হা-সূচক মাথা নেড়ে ফেলেছে সেহেতু কোনো-না-কোনো বুদ্ধি বের করে কাজটা করে ফেলে।

হাসানের মতে এরকম একটা লোক পাশে থাকা আর দশটা হাতি পাশে থাকা সমান। মঞ্জুর মতো আরেকজন আছে মোবারক। হাসান তাকে। ডাকে ফাঁকিবাজ মোবারক। তার প্রধান লক্ষ্য কীভাবে ফাঁকি দেবে। শুধু একা ফাঁকি দেবে না, তার পুরা দল নিয়ে ফাকি দেবে। ফাকি ধরা পড়লে মিষ্টি করে হাসবে, মাথা চুলকাবে। মোবারক মূলত রঙমিস্ত্রি, কিন্তু সেও মজুর মতো। সব জানে এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধি। মোবারকের বুদ্ধি কানে লাগাতে হলে তার পেছনে সবসময় একজনকে লেগে থাকতে হয়, যার প্রধান কাজ মোবারক কোন্ দিক দিয়ে ফাঁকি দিচ্ছে সেটা বের করা।

ইনজিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য পাস-করা তিনজনকে হাসান তার প্রজেক্টে কাজ দিয়েছে। এদের বয়স অল্প নতুন চিন্তাভাবনায় এরা ভালো করবে। কার্যক্ষেত্রে সেরকম দেখা যাচ্ছে না। প্রজেক্টের ব্যাপার দেখে এরা মোটামুটি হকচকিয়ে গিয়েছে। তারা তিনজনই একসঙ্গে ঘোরে। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে নিচুগলায় কথা বলে। খুবই আনাড়ি ভঙ্গিতে সিগারেটে টান দিয়ে খুকখুক করে ক্যশে। হাসানের ধারণা, চাকরি পাবার পর তারা সিগারেট ধরেছে। হাসানকে তারা তিনজনই কোনো কারণ ছাড়াই অসম্ভব ভয় পায়। হাসান তাদেরকে এখনো কোনো কাজ দেয়নি। বিরাট কর্মযজ্ঞে পড়ে তিন তরুণ ইনজিনিয়ারের শুকনা মুখ দেখতে তার ভালো লাগে। তিনজন এখন গিটু পাকিয়ে আছে। গিঁট ফাড়িয়ে তিনজনকে তিনদিকে লাগিয়ে দিতে হবে। এমন কাজের চাপে ফেলতে হবে যেন তাদের দেখা হয় রাত দশটার পরে।

হাসান পা লেংচাতে লেংচাতে এগুচ্ছে। তাকে এগুতে দেখে দূর থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে লীনা উপস্থিত হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, স্যার আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

হাসান বলল, কোথাও না। একটু হাঁটি।

আপনার পা ফুলে কী হয়েছে। এই অবস্থায় আপনি হাঁটছেন। পা তো আরো ফুলবে।

ফোলা পা-কে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। আপনি যাচ্ছেন কোন দিকে? বিশেষ কোনো দিকে না, আমি পুরো জায়গাটায় একটা চক্কর দেব।

লীনা আতঙ্কিত গলায় বলল, পুরো জায়গাটা চক্কর দিতেতো স্যার সন্ধ্যা হয়ে যাবে। স্যার, আপনি একটা ভ্যানগাড়িতে বসুন। ভ্যানগাড়ি আপনাকে টেনে নিয়ে যাক।

হাসান বলল, তুমি আমার জন্যে ব্যস্ত হয়ো না। আমি যত বেশিবার জায়গাটা ঘুরব ততবেশি জায়গাটা আমার মাথায় ঢুকবে। পরিকল্পনা করতে আমার তত সুবিধা হবে।

স্যার আমি আপনার সঙ্গে আসছি।

তোমাকে সঙ্গে আসতে হবে না। তোমার গেস্ট এসেছে। গেস্ট এন্টারটেইন কর। গেস্টদের মধ্যে একজনকে দেখে মনে হল তোমার বোন। একই রকম চেহারা। আরেকজন কে?

লীনা লজ্জিত গলায় বলল, ফিরোজ ভাই।

হাসান বলল, ও আচ্ছা–ইনার সঙ্গেই তোমার এনগেজমেন্ট হয়েছে। বিয়ে কবে?

এখনো ঠিক হয়নি স্যার।

ফিরোজ সাহেব কী করেন?

একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করেন।

তোমার গেস্টরা কি আজ থাকবেন, না চলে যাবেন?

চলে যাবেন।

তাদের রেখে দাও। থাকার তো অসুবিধা নেই। তোমার বোন তোমার সঙ্গে তাঁবুতে থাকতে পারে। ফিরোজ সাহেব থাকবেন গেস্টদের তাঁবুতে।

স্যার আমি বলে দেখব।

লীনা তুমি আরেকটা কাজ কর। তিনজন ইয়াং ইনজিনিয়ার আছে না? একসঙ্গে গিটু পাকিয়ে ঘুরছে। ঠিক একঘণ্টা পর এদের একজনকে আমার কাছে পাঠাবে। তার প্রথম এসাইনমেন্ট হচ্ছে আমাকে খুঁজে বের করা।

কোন্ জনকে পাঠাব স্যার?

যে-কোনো একজনকে পাঠালেই হবে। এক ঘণ্টা পরে পাঠাবে। এখন at

জ্বি আচ্ছা স্যার।

যাকে পাঠাবে তার বায়োডাটার কাগজটা একটা ইনভেলপে ভরে সিল করে তার হাতে দিয়ে দেবে। ইনভেলপে কী আছে তাকে বলবে না। শুধু বলবে ইনভেলপটা যেন আমার হাতে দেয়।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

তুমি তোমার গেস্টদের কাছে যাও— আজ তোমার ছুটি।

 

লীনা ফিরোজ এবং বীনাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছে। লীনা যাচ্ছে আগে আগে। লীনার পেছনেই বীনা। তার পেছনে ফিরোজ। লীনা এমন ভঙ্গিতে হাঁটছে যেন পুরো অঞ্চলটা তার চেনা। যেন এটা তারই রাজত্ব। সে রাজত্ব দেখতে বের হয়েছে। অথচ জায়গাটা সে মোটেই চেনে না। পরশুদিনই সে একবার শালবনে হারিয়ে গিয়েছিল। শালবন থেকে কোন দিকে বের হবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। আজও সে শালবনের ভেতরই ঢুকেছে।

ফিরোজ বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

লীনা বলল, বালির পাহাড় দেখতে যাচ্ছি।

ফিরোজ বলল, বালির পাহাড় মানে?

লীনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, দু-শো ট্রাক বালি এনে ফেলা হয়েছে। মায়মেনসিং সেভ। মোটাদানার বালি। আরো দু-শো ট্রাক বালি আসবে। চারশো ট্রাক বালির দাম চার লাখ টাকা। এক হাজার টাকা করে ট্রাক।

বীনা বলল, বালির দাম কত তাও তোমার জানতে হয়?

লীনা বলল, বালির দাম কত জানতে হয় না। জানার ইচ্ছা হয়েছিল— ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।

ফিরোজ বলল, চারশো ট্রাক বালি দিয়ে কী হবে? মরুভূমি বানানো হবে নাকি?

লীনা বলল, ঠিক ধরেছ। নকল মরুভূমি বানানো হচ্ছে। আমাদের দশ একর প্লেন ল্যান্ড আছে। পুরোটা বালি দিয়ে ঢাকা হবে। ঠিক মাঝখানে মাটির কিছু উঁচু উঁচু ঘর তৈরি হবে। ঘরগুলি একটার গায়ে একটা লেগে আছে। অদ্ভুত ড্রিজইন। দেখলেই গা শিরশির করে। স্যারের ড্রয়িংবোর্ডে ডিজাইন আছে। তুমি দেখতে চাইলে ডিজাইন এনে দেখাব। আইডিয়াটা অদ্ভুত না? মরুভূমির মাঝখানে কিছু স্ট্রেঞ্জ লুকিং উচু উঁচু মাটির ঘর।

ফিরোজ বলল, লীনা তুমি কিছু মনে করো না–আমার কাছে নকল মরুভূমির ব্যাপারটা খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে।

লীনা বলল, হাস্যকর কেন?

ফিরোজ বলল, মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি যদি চারদিকে সবুজ গাছপালা দেখ, শালবন দেখ— তাহলে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যায় না? এমন এক মরুভূমি তৈরি হচ্ছে যার চারপাশে সবুজের ছড়াছড়ি।

লীনা আহত গলায় বলল, স্যার হাস্যকর কাজ কখনো করবেন না। চারপাশের গাছপালা যেন দেখা না যায় সেরকম কোনো ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে।

ফিরোজ বলল, ব্যবস্থা নেয়া হলে তো ভালোই। তুমি এমন রাগ করছ কেন?

স্যার সম্পর্কে কেউ হেলাফেলাভাবে কথা বললে আমার খুব রাগ লাগে।

কেন, রাগ লাগবে কেন? উনি কি মহাপুরুষ নাকি।

লীনা কঠিন গলায় বলল, উনি মহাপুরুষ না। উনি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ হয়েও উনি স্বপ্ন তৈরি করার কাজ করেন।

ফিরোজ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তিনি কিন্তু নিজের স্বপ্ন তৈরি করার কাজ করেন না। অন্যের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করেন। অন্যের ফরমায়েসি স্বপ্ন অন্যের অর্থে তৈরি করা।

লীনা দাঁড়িয়ে পড়ল। চাপা গলায় বলল, প্লিজ স্টপ ইট। বালির পাহাড় দেখতে হবে না। চলো ফিরে যাই।

ফিরোজ বলল, তুমি অকারণে রাগ করছ। রেগে আগুন হবার মতো কোনো কথা আমি বলিনি। কিছু সত্যিকথা বলেছি। চলল তোমার বালির পাহাড় দেখে আসি।

না দেখতে হবে না।

লীনা উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। বীনা এসে পাশে দাঁড়াল। বীনা চাপা গলায় বলল, তুমি এরকম ছেলেমানুষি করছ কেন আপা?

লীনা বলল, কী ছেলেমানুষি করলাম।

তুমি কাঁদছ। কাঁদার মতো কিছু হয়নি। তুমি অবশ্যই চোখ মুছে আমাদের বালির পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবে। আপা চোখ মোছো।

লীনা চোখ মুছল।

আপা, তুমি কি জানো যে তুমি খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছ?

জানি না। মন খারাপ হয়েছে এইটুকু জানি।

মন খারাপটা এত ঘন ঘন না করে একটু কম করলে হয় না আপা।

আমার মধ্যে তোর মতো কোনো সুইচ নেই যে, মন খারাপের সুইচ অফ করে মন ভালো করার সুইচ অন করে দেব।

চোখ মোছে আপা। আবার তোমার চোখে পানি।

লীনা চোখ মুছল।

 

হাসান ঝিলের পাড়ে একা বসে আছে। জায়গাটা ঝিল না— নিচু জায়গা। প্রজেক্টে এই জায়গার নাম দেয়া হয়েছে ঝিল। মাটি কেটে কৃত্রিম ঝিল বানানো হবে। মাটি কাটার লোকজন আছে– এখনো মাটিকাটা শুরু হয়নি। ঝিলের জন্যে জায়গাটা হাসানের পছন্দ হচ্ছে না। জায়গাটা নিচু বর্ষায় এমনিতেই পানি জমে থাকে। সুবিধা বলতে এইটুক। হাসানের মতে ঝিলটা শালবনের ভেতর দিয়ে যাবে। ঝিলের পানি হবে কাকচক্ষুর মতো টলটলে। পানি খুব গভীর হবে না, সূর্যের আলো যতটুকু যেতে পারে তটুকুই গভীর হবে।

স্যার আমাকে ডেকেছেন?

হাসান পাশ ফিরল। তার পা ভালোই যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। সে পা নাড়িয়ে শুধু পাশ ফিরেছে। এতেই পা টনটন করছে।

লীনা আপা এই খামটা আপনাকে দিতে বললেন।

হাসান খাম হাতে নিল।

আপনার একটা চিঠি এসেছে। চিঠিটাও আপা আপনাকে দিতে বলেছেন।

থ্যাংক য়্যু।

হাসান ব্যক্তিগত লেখা খামটা চোখের সামনে ধৰ্বল। নাজমার চিঠি। ডাকে আসেনি–হাতে হাতে এসেছে। প্রতিদিনই একটা গাড়ি ঢাকা থেকে আসছে, ঢাকায় যাচ্ছে। চিঠি আনা-নেয়া কোনো সমস্যা না। হাসানের মনে হল— অতি দ্রুত এমন কোনো ব্যবস্থা করা উচিত যেন সরাসরি চিঠি চলে আসে।

সেইসঙ্গে একজন পাস-করা ডাক্তারও দরকার। জরুরি কিছু ওষুধপত্র।

হাসান নাজমার চিঠি রেখে অন্য খামটা খুলল। নাজমুল আলম কোরেশির বায়োডাটা। হাসান লীনাকে বলেছিল যে-ছেলেটিকে পাঠাবে তার বায়োডাটা সঙ্গে দিয়ে দিতে। কীজন্যে বলেছিল, এখন মনে পড়ছে না। সে কি অতিরিক্ত চাপের মধ্যে আছে? আছে হয়তো।

নাজমুল আলম কোরেশি, তোমার ডাক নাম কী?

বাবুল।

দাঁড়িয়ে আছ কেন, ঘাসের উপর বস। প্যান্ট অবশ্যি নোংরা হবে। তাতে কী?

নাজমুল বসল। হাসান তার দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, সিগারেটে টান দিতে ইচ্ছা করলে টান দাও। আমাকে লজ্জা করার কিছু নেই। চাকরি কেমন লাগছে?

ভালো লাগছে।

ভালো লাগার কী আছে? কোনো কাজ নেই। তিনবন্ধু একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ। চাকরি করতে এসেছ। ঘুরে বেড়াতে তো আসেনি।

কী করব বুঝতে পারছি না স্যার। কোনো দায়িত্ব যদি পাই চেষ্টা করতে পারি।

বিশেষ কোনো দায়িত্ব কি তুমি নিতে চাও?

আমি সেইভাবে চিন্তা করিনি স্যার।

নকল মরুভূমির মাঝখানে কিছু অদ্ভুত ধরনের ঘর তৈরি হচ্ছে–শুনেছ নিশ্চয়।

জ্বি।

তার ডিজাইন দেখেছ?

জ্বি না।

ডিজাইনটা আমার ড্রাফট-টেবিলে আছে। ডিজাইনটা খুব ভালোমতো দেখবে। ঘরে বিশেষ ধরনের লাইটিং হবে। দরজা জানালা দিয়ে গাঢ় হলুদ আলো আসবে। বালির উপর হলুদ আলো পড়ে বালি চিকচিক করবে। বিল্ডিঙের বাইরেও হলুদ আলো ফেলা হবে। লাইটের সোর্স এমন হবে যে সোর্স দেখা যাবে না। কেউ বুঝতেও পারবে না— আলো কোথেকে আসছে।

ডিজাইনে নিশ্চয়ই এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

অবশ্যই রাখা হয়েছে। তোমার দায়িত্ব হচ্ছে লাইটিঙের ব্যাপারটা দেখা। তোমার সঙ্গে একজন ডিপ্লোমা ইনজিনিয়ার থাকবে। রহিম নাম। খুবই এক্সপার্ট। তার কাছ থেকে অনেককিছু শিখতে পারবে। সমস্যায় পড়লে মিজুর সাহায্য নেবে। মিজুকে চেনো?

জ্বি না।

খুঁজে বের করবে। তার সঙ্গে খাতির জমাবার চেষ্টা করবে। এই খাতিরটা কাজে লাগবে।

জ্বি আচ্ছা।

লাইটিং প্ল্যানে বড় একটা ভুল আছে। ভুলটা বের করে আমাকে বলবে। আমি দেখতে চাই তোমার বুদ্ধি কেমন! আচ্ছা এখন যাও।

নাজমুল চলে যাচ্ছে। খুব উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ! মনে হয় ছেলেটা টিকে যাবে। হাসান সিগারেট ধরাল। ছোট্ট ভুল হয়েছে। ফ্লাস্কে করে চা আনা উচিত ছিল। চা খেতে ইচ্ছা করছে। হাসান নাজমার চিঠি খুলল। কী সুন্দর পরিষ্কার ঝকঝকে লেখা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

হাসান,

চিঠিতে কঠিন কঠিন কথা লেখা আমার খুব অপছন্দ। কঠিন কথা সামনা সামনি হওয়া উচিত। যে মানুষটা দূরে আছে, চিঠি লিখে তাকে হার্ট করার কোনো অর্থ হয় না। তারপরেও বাধ্য হয়ে তোমাকে কঠিন চিঠি লিখছি।

অন্তু এবং নীতুর জ্বর তুমি দেখে এসেছ। সাধারণ জ্বর না, বাড়াবাড়ি ধরনের জ্বর। তারপরেও তুমি ঢাকা ছেড়ে চলে গেলে। কিছু টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করলে। একবার খোঁজ নিলে না, ওদের জুর কেমন। পনেরো দিনে একবারও তোমার ঢাকায় আসার কথা মনে পড়ল না। জয়দেবপুর ঢাকা থেকে এমন কোনো দূরত্বে অবস্থান করছে না।

আমার ব্যাপারে তোমার আগ্রহ ফুরিয়ে গেছে এটা আমি যেমন জানি তুমি তারচে অনেক ভালো করে জানো। তারপরেও বাচ্চাদের প্রতিও তুমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

Workaholic কথাটার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কাজ নিয়ে নেশাগ্রস্ত মানুষ অবশ্যই আছে। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনও কিন্তু কাজেরই অংশ। বারে তারিখে আমার জন্মদিন গিয়েছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এই দিনটা তোমার মনে থাকবে এবং ঢাকায় এসে হৈ চৈ করে (মেকি হৈ চৈ) কাটাবে।

অঙ্কু এবং নীতুকেও বললাম– আজ তোমাদের বাবা আসবে। অন্তু এটা শুনেই বলল, সে আজ স্কুলে যাবে না। বাচ্চাদের স্কুল কামাই আমি খুবই অপছন্দ করি। তারপরেও বললাম আচ্ছা ঠিক আছে যেতে হবে না। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছে। তার একবারও টিভির কার্টুন চ্যানেল ছাড়ার কথা মনে হয় নি।

আমি বুঝতে পারছি অন্তুর অপেক্ষার কথা শুনে তোমার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। আবার এও বুঝতে পারছি চিঠি পড়ে পুত্রপ্রেমে পাগল হয়ে তুমি হা পুত্র হা পুত্র করতে করতে ছুটে আসবে না। তুমি তোমার মতো কাজ করবে।

বারো অরিখে আমি অন্তুর মতো বারান্দায় বসে না-থাকলেও অপেক্ষা করেছি। বুঝতে পারছি সূতায় প্রকল টান পড়েছে। একটা সুতাকে দুজন দুদিকে টানছি। যে-কোনো মুহূর্তে সূতা ছিড়বে। সূতা ছিড়লে ক্ষতি নেই, কিন্তু সূতা ধরে অন্তু এবং নীতু ঝুলছে। ওদের কী হবে কে জানে।

একটা সময় ছিল যখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি। তোমার সঙ্গে আমার সামানাই পরিচয়। আমি গ্রামের বাড়িতে আছি। হুট করে এক দুপুরে তুমি উপস্থিত। আমার প্রাচীনপন্থী বাবা খুবই রেগে গেলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না অতি সামান্য পরিচয়ে কী করে একটা ছেলে ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে একটি মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়। তোমাকে তৎক্ষণাৎ বিদায় করা হল। তুমি নান্দাইল রোড স্টেশনে গিয়ে বসে রইলে ফিরতি ট্রেনের অপেক্ষায়। দুপুরবেলা আমি এসে তোমাকে স্টেশন থেকে বাসায় নিয়ে গেলাম।

যাই হোক, তুমি তোমার স্বপ্নরাজ্য সাজাতে থাকে। অন্তু এবং নীতুর জ্বর সেরেছে। তারা ভালো আছে। তাদের নিয়ে টেনশান করার কিছু নেই। মানসিক দিক দিয়ে আমি ক্লান্তিবোধ করছি। ক্লান্তি কাটানোর জন্যে চিটাগাঙে মেজভাইয়ার কাছে যাচ্ছি। সেখান থেকে টেকনাফে যাবার কথা। তোমার বাচ্চারা আসন্ন ভ্রমণের আনন্দে উল্লসিত। তুমি ভাল থেকো।…

হাসান উঠে দাঁড়াল। সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। রোদে মাথা চিড়বিড় করছে। পায়ের যন্ত্রণাও বাড়ছে। পা টেনে টেনে এতদূর আসাটা বোকামি হয়েছে। ফিরে যাওয়া কঠিন হবে। হাসান আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে চিল উড়ছে।

সব পাখি জোড়ায় জোড়ায় ওড়ে পক্ষীকুলে শুধুমাত্র চিলকেই নিঃসঙ্গ উড়তে দেখা যায়। নিঃসঙ্গতার আনন্দের সঙ্গে এই পাখিটির কি পরিচয় আছে?

উড়ন্ত চিল দেখার পরপরই হাসানের মাথায় পাখি বিষয়ক একটা চিন্তা এসেছে— মরুভূমির ঘরগুলিতে কবুতর থাকার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়। পোষ মানিয়ে শত শত কবুতর যদি রাখা যায়! যত অদ্ভুত, যত সুন্দরই ঘরগুলো হোক না কেন, ঘরের কোনো প্রাণ থাকে না–শত শত কবুতর যদি সেই ঘরগুলি ঘিরে ওড়াওড়ি করতে থাকে, তবেই ঘরগুলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে।

 

বিকেল পাঁচটার সময় সাইট থেকে ঢাকায় একটা গাড়ি যায়। তার পরের গাড়িটা ছাড়ে রাতের ডিনারের পর পর। দশটা-সাড়েদশটা বাজে। ফিরোজ বিকালের গাড়িতে যাবে বলে ঠিক করেছে। তার রাতে থেকে যাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বীনাকে যেতেই হবে। পরীক্ষা সামনে, একটা মিনিট নষ্ট করার সময়ও তার নেই। তাছাড়া ঢাকায় মা একা। একটা কাজের মেয়ে ছিল, সেও পাঁচ কেজি চালের একটা ব্যাগ এবং লীনার দুটা ব্যবহারী শাড়ি নিয়ে সরে পড়েছে। এখন বাড়িতে মা একা।

বীনা বলল, মা বাড়িতে একা–এটা কোনো সমস্যা না। একৗ থাকা তাকে অভ্যাস করতে হবে। আমরা দু-বোন বিয়ে করে চলে যাব, মাকে তখন তো একা থাকতেই হবে। মা নিশ্চয়ই প্ল্যান করছেন পুঁটলি-পাঁটলা নিয়ে জামাইএর বাড়িতে উঠবেন।

লীনা বলল, তুই এমন কঠিন কথা কীভাবে বলিস।

বীনা বলল, খুব সহজভাবে বলি। কথাগুলি মোটেই কঠিন না। কথাগুলি বাস্তব। বাস্তব আমাদের ভালো না লাগলেও স্বীকার করতে হবে।

ফিরোজ হাসতে হাসতে বলল, বাস্তবতা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে তুমি বিকেল পাঁচটায় চলে যাচ্ছ।

বীনা বলল, আপনার কি থাকার ইচ্ছা নাকি?

ফিরোজ বলল, জঙ্গলে কোনোদিন রাত কাটাইনি। জঙ্গলে রাত কাটাতে কেমন লাগে দেখতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু তুমি ঢাকায় গেলে আমি অবশই যাব। আমি তোমাকে একা ছেড়ে দেব না।

আমি কি কচি খুকি।

কচি খুকি হও বা বুড়ি নানী হও, আমি তোমাকে একা ছাড়ব না। আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি, সঙ্গে নিয়ে যাব।

তাহলে চলুন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি।

আমার ব্যাগ সব সময় গোছানোই থাকে। তুমি তোমার ব্যাগ গুছাও।

লীনা তাঁবুর ভেতরের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। ফিরোজ তার পাশে বসতে বসতে বলল, শরীর খারাপ নাকি?

লীনা বলল, না।

ফিরোজ বলল, আমরা চলে যাব। আমাদের হাসিমুখে বিদায় দাও। উঠে বোস। যাবার আগে তোমার হাতে এক কাপ চা খেয়ে যাই।

লীলা উঠে বসল। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, তোমরা থেকে যাও। স্যার থেকে যেতে বলেছেন।

ফিরোজ বলল, তোমার স্যার কী বলছেন বা না বলছেন তা তোমার কাছে যত গুরুত্বপূর্ণ, আমার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ না। তোমার বলাটা গুরুত্বপূর্ণ।

আমি বলছি থেকে যাও।

একটা বিশেষ কারণে আমার নিজ থেকেই থেকে যাবার ইচ্ছা ছিল— তুমি না বললেও এটা আমার পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল। বীনা যেহেতু যাচ্ছে কাজেই আমাকে যেতেই হবে।

লীনা বলল, বিশেষ কারণটা কী?

ফিরোজ বলল, শালবনের দিকে চলো। হাঁটতে হাঁটতে বিশেষ কারণটা বলি। এখানে বলা যাবে না। বীনা যে-কোনো সময় এসে পড়বে।

লীমা বলল, আমার হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। এখানেই বলো।

তুমি মনে হয় এখনো আমার উপর রেগে আছ। রাগটা একপাশে সরিয়ে আমার সঙ্গে চলো তো। প্লিজ। তোমার স্যার সম্পর্কে কঠিন কোন কথা বলে যদি তোমাকে হার্ট করে থাকি আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

ক্ষমা প্রার্থনার কী হল?

কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। নয়তো এত রাগ তুমি করবে না। লীনা শোনো, আমি সর্ব অর্থে একজন প্রতিভাশূন্য মানুষ। প্রতিভাধরদের এইজন্যে প্রচণ্ড হিংসা হয়। যা বলি হিংসা থেকে বলি। এটা আমার চরিত্রের প্রধান ত্রুটিগুলির একটি। এই ক্রটি তোমাকে ক্ষমা করতে হবে। চলো একটু হাঁটতে যাই। পাঁচটা বাজতে এখনো পঁয়ত্রিশ মিনিট দেরি আছে। আমরা তার আগেই চলে আসব।

লীনা স্যান্ডেল পরল। তাঁবুর পেছনেই শালবন। তাদের বেশি হাঁটতে হল না। ফিরোজ বলল, বইপত্রে পড়েছি জঙ্গলের পুর্ণিমা অসাধারণ হয়। নেক্সট পূর্ণিমায় আমি চলে আসব।

লীনা বলল, চলে এসো।

ভরা পুর্ণিমায় হাত ধরাধরি করে তোমাকে নিয়ে বনে হাঁটব। আশাকরি তোমার স্যার রাগ করবেন না।

স্যারের কথা এখানে আসছে কেন? স্যার কেন রাগ করবেন?

তাঁর লয়েল কর্মচারী কোম্পানির স্বার্থ চিন্তা না করে অন্য একজন পুরুষমানুষের হাত ধরে হাঁটছে। রাগ করার কথা তো।

উনার সঙ্গে এইভাবে কথা বলবে না।

ঠাট্টা করছিলাম।

লীনা বলল, আমার সঙ্গে ঠাট্টাও করবে না। আমি ঠাট্টা বুঝি না।

ফিরোজ বলল, আচ্ছা যাও ঠাট্টাও করব না। সবসময় সিরিয়াস কথা বলব।

ফিরোজ তার পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতে দিতে বলল, তোমার জন্যে সামান্য একটা উপহার এনেছি।

কী উপহার?

একটা আংটি।

হঠাৎ আংটি দেবার দরকার পড়ল কেন?

কী আশ্চর্য, তোমাকে আমি একটা আংটি দিতে পারব না। তোমার আঙুলে হয় কি-না দেখ।

লীনা বলল, তুমি পরিয়ে দাও।

ফিরোজ হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। লীনা বলল, হাসছ কেন?

একটা বিশেষ ঠাট্টা করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ঠাট্টাটার কথা মনে করেই হাসি আসছে। ঠাট্টাটা করতে ইচ্ছা করছে— আমি আবার প্রমিজ করেছি ঠাট্টা করব না। শোনো লীনা— একটা শেষ ঠাট্টা করি। আর কোনোদিন করব না। প্রমিজ বাই ইওর নেম।

লীলা বলল, কর। ঠাট্টা কর। ঠাট্ট করা যার স্বভাব সে ঠাট্টা না করে থাকতে পারবে না।

ফিরোজ বলল, তুমি যখন আংটিটা আমার কাছে দিয়ে বললে তুমি পরিয়ে দাও তখন আমার বলতে ইচ্ছা করল–আমার পরিয়ে দেয়াটা শোভন হবে না। তুমি বরং আংটিটা তোমার স্যারের কাছে নিয়ে যাও। উনি মুরুব্বিমানুষ। উনি পরিয়ে দেবেন। হা হা হা।

লীনাও হেসে ফেলল। তার আঙুলে পরানো আংটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল— হীরের আংটি নাকি?

ফিরোজ বলল, হ্যাঁ হীরের আংটি। আমি খুবই দরিদ্র মানুষ। দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। তারপরেও আমি ঠিক করে রেখেছিলাম এমন একটা আংটি তোমাকে আমি দেব যার গল্প তুমি কোনো-একদিন তোমার পুত্র-কন্যাদের করবে। তুমি তাদের বলবে–যখন আমাদের বিয়ে হয় তখন তোমার বাবার খুবই খারাপ অবস্থা। একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে সে চাকরি করত, সেই চাকরিও চলে গেছে। তারপরেও তোমার বাবা পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা হীরের আংটি কিনে দিয়েছিল।

লীনা হতভম্ব গলায় বলল, আংটিটার দাম পঁচিশ হাজার টাকা?

ফিরোজ বলল, না— ষোলো হাজার টাকা। গল্প করার সময় তুমি নিশ্চয়ই একটু বাড়িয়ে বলবে। বলবে না?

লীনা বলল, তোমার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চাকরিটা নিশ্চয়ই এখনো আছে।

হ্যাঁ আছে। তবে যাই যাই করছে।

যাই যাই করছে কেন?

বুঝতে পারছি না। আমি লক্ষ্য করেছি বা আমাকে পছন্দ করে না। নিশ্চয়ই আমার চরিত্রে এমন কিছু আছে যা মানুষকে বিরক্ত করে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, কিছুক্ষণ কথা বললেই একজন মানুষ অন্যজনকে পছন্দ করা শুরু করে। আমার বেলায় উল্টোটা ঘটে। কেউ আমার সঙ্গে আধঘণ্টা কথা বললে সে আমাকে অপছন্দ করবে এটা নিশ্চিত। লীনা আংটিটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে। খুব সুন্দর আংটি। এত দাম দিয়ে আংটি কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

তোমার জন্যে হয়তো প্রয়োজন নেই। আমার জন্যে প্রয়োজন। তুমি ধরেই নিতে পার— এটাই হবে তোমাকে দেয়া আমার একমাত্র দামি উপহার। আমার পরের উপহারগুলি দু-শো আড়াইশো টাকা দামের শাড়িতে সীমাবদ্ধ থাকবে।

ঢাকায় যাবার গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। বীনাকে দেখা যাচ্ছে ব্যাগ হাতে গাড়ির পাশে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফিরোজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল : দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি-বেলা দ্বিপ্রহর…।

 

রাত দশটা।

হাসান তার বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। পায়ের ব্যথা তীব্র হয়েছে। ক্লোফেনাক ট্যাবলেট সে কিছুক্ষণ আগে খেয়েছে। ব্যথা তেমন কমেনি, তবে শরীর ঝিম ধরে আসছে। মনে হচ্ছে ব্যথা না কমলেও ঘুম চলে আসবে। তাঁবুর ভেতর আলো জ্বলছে। রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল, হাসান ফেরত পাঠিয়েছে। খিদেয় পেট জ্বলছে, কোনো খাবার মুখে দিতে ইচ্ছা করছে না।

লীনা তাঁবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভীত গলায় বলল, স্যার আসি?

হাসান বলল, এসো।

লীনা তাঁবুর ভেতর ঢুকল। সে রাত আটটা থেকেই ভাবছে স্যারকে দেখে আসবে। কেন জানি সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। হাসান যখন রাতের খাবার ফেরত পাঠান তখন তার মনে হল— যাওয়া উচিত। একটা মানুষ ব্যথায় ছটফট করবে আর সে আরাম করে ঘুমাবে, এটা কেমন কথা।

স্যার ব্যথা কি খুব বেশি?

ব্যথা ভালোই আছে।

আদার রস মেশানো গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে ব্যথা কমবে।

হাসান উঠে বসতে বসতে বলল, এই চিকিৎসা কোথায় পেয়েছ?

আমার বাবাকে করতে দেখেছি। পা মচকে গেলে তিনি গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতেন।

এইসব লাগবে না। সকালে ডাক্তার আসবে। রাতটা পার করতে পারলেই হবে।

লীনা বলল, স্যার আমি আদা মিশিয়ে গরম পানি আনতে বলেছি।

পানি নিয়ে এলে তো পা ডুবাতেই হবে। তোমার অতিথিরা শুনলাম চলে গেছে।

জ্বি স্যার। পূর্ণিমার সময় আবার আসবে।

আমাদের প্রজেক্ট তাদের কেমন লাগল?

ভালো লেগেছে।

খুব ভালো, না মোটামুটি ভালো?

খুব ভালো। আচ্ছা স্যার, মরুভূমির যে-ঘরটা আমরা বানাচ্ছি ঐটা…

লীনা কথার মাঝখানে চুপ করে গেল। হাসান কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে তার অতিথিরা মরুভূমির ঘর নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে। লীনার মনে প্রশ্নটা আছে, তবে স্যারকে বলতে পারছে না। স্যার আবার কিছু মনে করেন। লীনার একটা ব্যাপার হাসানের ভালো লেগেছে–স্যার আমরা যে ঘরটা বানাচ্ছি। সে বলতে পারত যে ঘরটা বানানো হচ্ছে। তা সে বলেনি।

লীনা প্রশ্নটা শেষ কর। তেমন কিছু না স্যার।

তবু শুনি।

মরুভূমিতে কেউ যখন দাঁড়াবে তখন সে দেখবে চারপাশে সবুজ ঘাস, গাছপালা। তার খটকা লাগবে না?

হাসান বলল, চারপাশের গাছপালা তো কেউ দেখতে পারবে না। মরুভূমির চারদিকে পাহাড়ের মতো করা হচ্ছে। দৃষ্টি পাহাড়ে আটকে যাবে। ঝিল কেটে যে মাটি উঠবে, সেই মাটি দিয়ে পাহাড় হবে। পাহাড়ের গায়েও বালি দিয়ে দেয়া হবে। মূল ডিজাইনে আছে। শেলফ থেকে ডিজাইনটা আননা, আমি তোমাকে দেখাচ্ছি।

দেখাতে হবে না স্যার আমি বুঝতে পারছি।

আরো ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। কেউ যদি মনে করে। যে-কোনো দিক দিয়ে মরুভূমিতে ঢুকতে পারবে তাহলে সে ভুল করবে। সরাসরি সেখানে যাবার পথ নেই। খাল কেটে জায়গাটা আলাদা করা।

সেখানে যাবার ব্যবস্থা কী?

টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। অনেকক্ষণ অন্ধকার টানেলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হবে। টালেনের মুখ দিয়ে বের হওয়া মাত্র সে ঝলমলে আলোর জগতে এসে পড়বে। এটা দেখ, এটা হচ্ছে টানেল সাড়ে ছয় ফুট ডায়ামিটার। কাগজ আর কলম নাও–একটা মজার জিনিস বুঝিয়ে দিচ্ছি।

লীলার কেমন যেন লাগছে। স্যার খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে বিরাট বনভূমিতে সে এবং তার স্যার। আর কেউ নেই। গভীর রাত— জোছনায় বনভূমি ভেসে যাচ্ছে। স্যার হাঁটছেন সেও হাঁটছে। খুব বাতাস হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় তার লম্বা চুল মাঝে মাঝে স্যারের চোখেমুখে পড়ছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। আবার কেন জানি খুব ভালো লাগছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ