বিকেল পাঁচটায় ঢাকায় গাড়ি যাবে। লীনা চিঠি লিখতে বসেছে। দুটা চিঠি লিখবে। একটা মাকে আরেকটা বোনকে। চিঠি গতরাতেই লিখে রাখা উচিত ছিল। এখন তাড়াহুড়া করতে হচ্ছে। কত কিছু লেখার আছে তাড়াহুড়া করে কি লেখা যায়? শেষে দেখা যাবে আসল কথাগুলিই লেখা হয়নি। মার কাছে লেখা চিঠি হবে একরকম, বোনের কাছে লেখা চিঠি হবে অন্যরকম। মার চিঠিতে থাকতে হবে—শরীরের খবর, খাওয়াদাওয়া কেমন হচ্ছে তার কিছু কথা। এই চিঠিটা লিখতে হবে খুব গুছিয়ে। বীনার চিঠিতে বানান ভুল থাকলে হবে না। বানান ভুল থাকলে বীনা খুব রাগ করে। চিঠির উত্তর দেবার সময় লেখে : সাধারণ বানান ভুল কর কেন আপা? ধুলা বানান কবে থেকে দীর্ঘউকার হল?

লীনা মার চিঠি লিখতে বসল। মাকে চিঠি লিখতে তার খুব ভালো লাগে। যা ইচ্ছা লেখা যায়।

মা,

তুমি কেমন আছ গো?

রোজ রাতে ঘুমুবার সময় তোমার কথা মনে পড়ে। তোমার সঙ্গে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন অভ্যাস খারাপ হয়েছে, তোমার গায়ের গন্ধ নাকে না এলে ঘুম হয় না। তুমি অবশ্যই একটা বোতলে তোমার গায়ের গন্ধ ভর্তি করে পাঠাবে।

আমাদের এখানে খাওয়াদাওয়া খুব ভালো। সকালে তিন ধরনের নাশতা থাকে। একটা হল কমন আইটেম–খিচুড়ি। মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না হয়। সবাই খুব আগ্রহ করে খিচুড়ি খায়। আরেকটা আইটেম হল— রুটি, ভাজি এবং ডিম। আমি বেশিরভাগ দিন এইটা খাই।

আমাদের স্যার সকালে নাশতা খেতে পারেন না। তিনি এক কাপ চা আর একটা টোস্ট বিসকিট খান। দুপুরে লাঞ্চ খান। মাঝখানে চা ছাড়া আর কিছু না। আমার খুব ইচ্ছা করে তাকে জোর করে নাশতা খাওয়াতে। অন্য সবার খাবারদাবারের দিকে তার এত নজর, কিন্তু নিজের খাবারদাবারের দিকে কোনো নজর নেই।

মা, তুমি যে চালতার আচার বানিয়ে পাঠিয়েছিলে— স্যারকে খেতে দিয়েছিলাম। উনি খুবই পছন্দ করেছেন। আমি আচারের কৌটাটা স্যারের তাঁবুতে রেখে দিয়েছি। বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি যেন রোজ খাবারের সঙ্গে আচার দেয়।

এখন একটা মজার কথা বলি মা। গতরাতে স্যারের তাঁবুতে বিরাট হৈচৈ। ঘুম ভেঙে আমি ছুটে গেলাম। সবাই বলাবলি করছে তাঁবুতে সাপ ঢুকেছে। আমি তাঁবুতে ঢুকে দেখি স্যার বিছানায় পা তুলে বসে ঠকঠক করে কাঁপছেন। তাঁবুভর্তি লোকজন। ঘটনা হচ্ছে–স্যারের তাঁবুতে বড় একটা মাকড়সা দেখা গেছে। স্যারের মাকড়সা-ভীতি যে কী ভয়ংকর, তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। সাধারণ একটা মাকড়সাকে কেউ এত ভয় পায়। অনেকেই এটা নিয়ে হাসাহাসি করছিল— আমার এত মায়া লাগল!

মা তুমি আমাকে নিয়মিত দুধ খেতে বলেছ। তোমার মনের আনন্দের জন্যে বলছি, আমি রোজ রাতে ঘুমুতে যাবার আগে এক কাপ করে দুধ খাচ্ছি। গ্রাম থেকে খাঁটি গরুর দুধ নিয়ে আসছে। আমি বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি সে যেন স্যারকেও শোবার সময় এক কাপ করে দুধ দেয়। সে তাই দিচ্ছে। আমার ধারণা ছিল স্যার সেই দুধ খান না। গতকাল বাবুর্চির কাছে শুনেছি স্যার দুধ খাচ্ছেন।

আমাদের বেশ কয়েকজন বাবুর্চি। স্যারের জন্যে যে বাবুর্চি রান্না করে তার নাম হোসেন মিয়া। সে অনেক রকমের ভর্তা বানাতে জানে। এর মধ্যে একটা ভর্তা হল— চিনাবাদামের ভর্তা। চিনে বাদাম পিষে সরিষার তেল পিয়াজ আর কাঁচামরিচ দিয়ে ভর্তা বানায়। এই ভর্তাটা খেতে খুব ভালো। স্যার এই ভর্তা পছন্দ করে খান।

মা তুমি তো অনেক রকমের ভর্তা বানাতে জানো একটা কোনো বিশেষ ধরনের ভর্তা বানানোর পদ্ধতি আমাকে সুন্দর করে চিঠিতে লিখে জানিও। আমি স্যারকে বেঁধে খাওয়াব।

তুমি শুনে খুবই অবাক হবে যে, সারেরও রান্নার শখ আছে। আমি লক্ষ্য করেছি বাবুর্চি যখন রান্না করে, স্যার প্রায়ই আগ্রহ করে রান্না দেখেন। একদিন দেখি তিনি নিজেই খুঁড়িতে চামচ দিয়ে নাড়ছেন। আমি তাড়াতাড়ি কাছে গেলাম। স্যার বললেন, লীনা জাপানিজ খাবার কখনো খেয়েছে? আমি বললাম, না। স্যার বললেন, একদিন তোমাকে জাপানিজ খাবার রান্না করে খাওয়াব। আমি খুব ভালো জাপানীজ রান্না জানি। দুমাস জাপানে ছিলাম তেমন কিছু শিখতে পারিনি। ওদের রান্নাটা শিখেছি। জাপানিজদের মতো চিংড়িমাছ পৃথিবীর আর কেউ রাঁধতে পারে না।

মা, আমি ভাবিওনি যে স্যার সত্যিসত্যি জাপানিজ খাবার রান্না করবেন। উনি এত ব্যস্ত রান্না করার তাঁর সময় কোথায়? তাছাড়া বড়মানুষরা অনেক কথা বলেন যেসব কথা তাঁরা মনেও রাখেন না। মনে রাখলে চলে না। আমার এই ধারণাটা যে কত ভুল তার প্রমাণ পেলাম গত বুধবারে। স্যার আমাকে কিচেনে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি তিনি রান্নার সমস্ত আয়োজন শেষ করে বসে আছেন। আমার সামনে রাধবেন, যেন আমি শিখতে পারি।

রান্নার জাপানিজ নাম— আলিও ওলিও।

আমি খুব গুছিয়ে লিখে দিচ্ছি যাতে তুমি বঁধতে পার। প্রথমে কিছু স্পেগেটি নিয়ে সাত-আট মিনিট সিদ্ধ করতে দেবে। এই ফঁাকে কড়াইয়ে ওলিভওয়েল নেবে। সেই ওলিভ ওয়েলে একগাদা রসুন কুঁচিকুঁচি করে ছেড়ে দেবে। রসুনের সঙ্গে থাকবে কুঁচিকুঁচি করা শুকনা মরিচ। একটু লালচে হতেই সিদ্ধ স্পেগেটি কড়াইয়ে ছেড়ে এক মিনিট নেড়ে নামিয়ে ফেলবে। খেতে হবে গরম গরম। মা, খেতে কী যে অসাধারণ! আর দেখলে কত সহজ রান্না!…

লীনা ভেবেছিল মাকে ছোট্ট চিঠি লিখবে। এই পর্যন্ত লিখেই সে চমকে উঠল— পাঁচটা বাজতে দুতিন মিনিট বাকি আছে। বীনাকে চিঠি লিখতে হলে গাড়ি মিস হবে। লীনা তার মার চিঠিটা খামে বন্ধ করে ঠিকানা লিখে ছুটে গেল।

ঢাকাগামী গাড়ির কাছে হাসান দাঁড়িয়ে আছে। লীনাকে দেখে সে হাসিমুখে বলল, চিঠি কার কাছে যাচ্ছে?

লীনা বলল, মার কাছে।

হাসান বলল, তুমি তো অনেকদিন হল এখানে পড়ে আছ। ছুটি নাওনি। এক কাজ কর— গাড়িতে করে চলে যাও, একদিন মার সঙ্গে কাটিয়ে আসো।

লীনা বলল, আজ যা না স্যার।

হাসান বলল, আজ না গেলে অবশ্যি একদিক দিয়ে তোমার লাভ হবে–পূর্ণিমা দেখতে পারবে। আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমা দেখার জন্যে আজ বিশাল আয়োজন করেছি। রাতের শিফটের কাজ বন্ধ। কোনো বাতি জ্বলবে না। কোনো ঘটঘট শব্দ হবে না। যার ইচ্ছা সে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরবে। মনের শখ মিটিয়ে পূর্ণিমা দেখবে। বড় সৌন্দর্য দেখার জন্যে বড় আয়োজন লাগে। লীনা, তোমার কি শাদা শিফন শাড়ি আছে? শাদা শিফন শাড়ি থাকলে ঐটা পরো। পূর্ণিমার আলোয় শাদা শিফনের শাড়ি পরা মেয়েদের দেখলে কী মনে হয় জানো? মনে হয়, যে শাড়িটা সে পরেছে সেটাও চাঁদের আলোয় তৈরি।

কী আশ্চর্য কাণ্ড! শাদা শিফনের শাড়ি লীনার আছে। ফিরোজ কিনে দিয়েছিল। লীনা শাড়ি দেখে বলেছিল— শাদা কিনলে কেন বল তো? শাদা হল বিধবাদের রঙ। ফিরোজ বলেছিল, শাদা রঙটা তোমাকে মানাবে এই ভেবে কিনেছি। বিধবা-সধবা ভেবে কিনিনি। হাত দিয়ে দেখ কী সফট। এই শাড়ি লীনা পরে নি। এখানে আনার ইচ্ছাও ছিল না। ভাগ্যিস এনেছে। আজ কী সুন্দর কাজে লেগে গেল।

হাসান বলল, মুসলমানরা চাঁদের হিসেবে চলে। সেইদিকে বিচার করলে ভরা-পূর্ণিমায় মুসলমানদের কোনো চন্দ্র-উৎসব থাকা উচিত ছিল, তা নেই। বৌদ্ধদের আছে। তাদের সমস্ত বড় ধর্মীয় উৎসব পূর্ণিমাকেন্দ্রিক। এক ভর-পূর্ণিমায় বুদ্ধদেব গৃহত্যাগ করেন, আরেক ভরা-পূর্ণিমায় তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন, আরেক ভরা-পূর্ণিমায় তিনি দেহত্যাগ করেন।

লীনা বলল, ইংরেজরা কি পূর্ণিমায় কোনো উৎসব করে?

হাসান বলল, পাগল হয়েছ? ওরা পূর্ণিমায় উৎসব করবে? চাঁদের কোনো গুরুত্ব ওদের কাছে নেই। আমাদের যেমন চাঁদের আলোর আলাদা প্রতিশব্দ আছে–জোছনা। ওদের তাও নেই। চাঁদের আলো হল— Moon light.

 

লীনা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলে কি করে?

হাসান বলল, ভালোমতো চাঁদটা উঠুক, তখন আমাকে মনে করিয়ে দিও। আমি তোমাকে বলব আফ্রিকার একদল আদিবাসী কী বিচিত্র উপায়ে চন্দ্র উৎসব করে সেই গল্প।

জি আচ্ছা।

আমি উত্সবের বর্ণনা বইএ পড়েছি। নিজে কখনো দেখিনি। খুব ইচ্ছা আছে একবার গিয়ে ওদের উৎসবে অংশ নেব। ওদের এই উৎসবটার নাম রাংসানি। আমার জীবনে কয়েকটা শখ আছে। একটা হচ্ছে রাংসানি উৎসবে যোগদেয়া — আরেকটা হল আন্টার্কটিকায় গিয়ে পূর্ণিমা দেখা। চারদিক বরফে ঢাকা, সেখানে চাঁদ যখন উঠবে— অপূর্ব ব্যাপার হবে না? বরফের গায়ে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। চারদিক ঝলমল, ঝলমল করছে।

লীনা চুপ করে আছে। তার বলতে ইচ্ছা করছে, স্যার ঐসব জায়গায় আপনি যখন যাবেন অবশ্যি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। আমি একা একা তো যেতে পারব না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। আমি এমন কাউকে সঙ্গে নিতে চাই যে সৌন্দর্য কী তা জানে। সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতে পারে।

লীনা!

জি স্যার।

আমরা বাঙালিরা শুধু কাজলা দিদির কারণে বাঁশবাগানের মাথার উপরের চাঁদের কথা জানি। এ ছাড়াও যে চাঁদ কত সুন্দর হতে পারে তা জানি না। কল্পনাতেও দেখতে পারি না। মরুভূমির চাঁদও অপূর্ব। জয়সলমীরের মরুভূমিতে এক পূর্ণিমায় আমি ছিলাম— চাঁদ মাথার উপর উঠার পর ভৌতিক অনুভূতি হতে লাগল। ইংরেজিতে এই অনুভূতির নাম Uncarning feeling. জয়সলমীর তো কাছেই, একবার সেখানে গিয়ে জোছনা দেখে এসো।

লীনা বলল, জ্বি আচ্ছা।

হাসান তার ভঁৰুর দিকে রওনা হল। লীনা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে হঠাৎ মনে হচ্ছে সে হাঁটতে পারছে না। তার ভয়ংকর কোন অসুখ হয়ে হাতপা শক্ত হয়ে গেছে। আকাশে রুপার থালার মতো চাঁদ উঠলেই অসুখটা সারবে। চাঁদ না-ওঠা পর্যন্ত অসুখ সারবে না।

 

লীনা অনেক সময় নিয়ে গোসল করল। চোখে কাজল দিল। সঙ্গে কাজল বা কাজলদানি কিছুই ছিল না। কাঁঠালপাতার উল্টোদিকে মোমবাতির শিখা দিয়ে কাজল তৈরি করে সেই কাজল চোখে মাখল। শাদা শিফনের শাড়ি পরে যখন বের হল— তখন আকাশে চাঁদ উঠে গেছে। তবে চাঁদে রঙ ধরেনি–লাল রাগী চাঁদ। লীনার কেমন যেন লজ্জা-লজ্জা লাগছে। যেন সে ভয়ংকর কোনো কাজ করতে যাচ্ছে। ভয়ংকর কিন্তু আনন্দময়।

লীনা হাসানের তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ জেনারেটর ছাড়া হয়নি বলে তাঁবুর ভেতরে অন্ধকার। তারপরেও তাঁবুর পর্দা সরিয়ে সে উঁকি দিতে পারে। কিন্তু তার লজ্জা-লজ্জা লাগছে। স্যার যদি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন— ঘটনা কি? এত সেজেছ কেন?

তাঁবুর ভেতর থেকে বাবুর্চি হোসেন মিয়া ট্রেতে করে খালি চায়ের কাপ পিরিচ নিয়ে বের হল। লীনাকে বলল, আপা, স্যারের খুঁজে আসছেন? স্যার তো নাই।

নাই কেন? উনি কোথায়?

স্যার ঢাকায় গেছেন। বেগম সাহেব আর বাচ্চাদের আনবেন। জোছনা দেখবেন।

কখন গেলেন?

পাঁচটার গাড়িতে গেছেন।

লীনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ইচ্ছা করছে ছুটে গভীর কোনো জঙ্গলে চলে যায়। জঙ্গলে লুকিয়ে বসে থাকে। যেন কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়।

আপা আপনাকে চা দিব?

দাও। আচ্ছা একটা কাজ কর– ছোট ফ্লাস্কে করে চা দাও। আমি জঙ্গলে হাটব, জোছনা দেখব, আর চা খাব।

 

ঢাকায় আসতে জাম-টাম মিলিয়ে দুঘণ্টার মতো লাগে।

আজ রাস্তা অস্বাভাবিক ফাঁকা। কোনো জাম নেই, রেড সিগন্যালে গাড়ি আটকা পড়ল না। এক ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যে হাসান তার বাসায় ঢুকল। বাসায় ঢোকার ব্যাপারটাও সহজে ঘটল। দরজা খোলা, কলিংবেল টিপতে হল না। বাসায় নতুন বুয়া রাখা হয়েছে। হাসান তাকে আগে দেখেনি। সে এসে কঠিনচোখে হাসানের দিকে তাকাতেই হাসান বলল, আমি এই বাড়ির মানুষ। অন্তুর বাবা। তুমি চট করে চা বানাও।

অন্তু টিভি দেখছিল। বাবা এসেছে এটা সে দেখেছে। আনন্দে তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে, কিন্তু সে ভাব করছে যেন বাবাকে দেখেনি। আর দেখলেও তার কিছু যায় আসে না। বাবার সঙ্গে এরকম অভিনয় করতে তার খুব ভালো লাগে।

হাসান বলল, অন্তু ব্যাটা কাছে আয় আদর করে দেই।

অন্তু বলল, আসতে পারব না। টিভি দেখছি।

অন্তুর অবশ্যি ইচ্ছা করছে ঝাপ দিয়ে বাবার কোলে পড়তে। ইচ্ছা করলেই কাজটা করতে হবে তা না। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে টিভির দিকে মনোযোগ দিতে।

হাসান বলল, কী দেখছিসরে ব্যাটা? কার্টুন?

না, জিওগ্রাফি চ্যানেল।

বাবা তুই তো জ্ঞানী হয়ে যাবি। অতীশ দীপংকর টাইপ।

অন্তুর ইচ্ছা করছে জিজ্ঞেস করে— অতীশ দীপংকর টাইপটা কী। সে জিজ্ঞেস করল না। জিজ্ঞেস করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে টিভির দিকে তার মন নেই। তার মন পড়ে আছে বাবার দিকে।

মা কইরে ব্যাটা?

শপিঙে গেছে।

নীতুও গেছে?

হুঁ।

তুই যাসনি কেন?

শপিঙে যেতে আমার ভালো লাগে না।

গুড। আমারো ভালো লাগে না। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঘুরা। দরদাম করা। টিভিতে কী দেখাচ্ছে?

মেরিন লাইফ।

টিভিটা বন্ধ কর তো বাবা। তোর সঙ্গে কিছু সিরিয়াস কথা আছে।

অন্তু আনন্দের সঙ্গে টিভি বন্ধ করল। কিন্তু ভাব করল যেন সে খুব বিরক্ত হয়েছে। হাসান বলল, বেড়াতে যাবি?

অন্তু বলল, যাব।

হাসান বলল, কোথায় বেড়াতে নিয়ে যেতে চাচ্ছি সেট; না-জেনেই বলে বসলি— যাব। হয়তো এমন কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে চাচ্ছি যেখানে যেতে তোর ভালো লাগবে না। তখন কী হবে। স্লাগে জিজ্ঞেস কর— কোথায়?

অন্তু বলল, কোথায়?

জঙ্গলে।

অন্তু বলল, হুঁ বাবা আমি যাব। জঙ্গলে কী আছে?

বাঘ ভাল্লুক কিছুই নেই। থাকলে ভালো হত। তবে এখন যা আছে তাও খারাপ না। দুর্দান্ত একটা চাঁদ উঠেছে– জঙ্গলে সেই চাঁদের আলো আছে।

দুর্দান্ত মানে কী বাবা?

দুর্দান্ত মানে—মারাত্মক।

মারাত্মক মানে কী?

মারাত্মক মানে ভয়ংকর।

ইংরেজি কী বল।

ইংরেজি হল ডেনজারাস।

ডেনজারাস কেন?

ডেনজারাস, কারণ হল–এমন এক চাঁদ উঠেছে যার আলো গায়ে পড়লেই মানুষ অন্যরকম হয়ে যায়। ওয়ার উলফ টাইপ। তখন চিঙ্কার করতে ইচ্ছা করে।

কখন যাব বাবা?

তোর মা এলেই রওনা দিয়ে দেব। ব্যাগ গুছিয়ে নে।

ব্যাগে কী কী নেব?

অনেক কিছু নিতে হবে। সবার প্রথম লাগবে একটা কম্পাস। পথ হারিয়ে গেলে কম্পাস দেখে পথ খুঁজে পেতে হবে। কম্পাস কি আছে?

অন্তু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কম্পাসটা তার বাবাই তাকে গত জন্মদিনে কিনে দিয়েছে। এখনো সে ব্যবহার করতে পারেনি। আজ ব্যবহার হবে।

তারপর লাগবে মোমবাতি দেয়াশলাই।

মোমবাতি-দেয়াশলাই কেন লাগবে?

মনে কর কোনো বিচিত্র কারণে চাঁদ ডুবে গেল। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তখন মোমবাতি জ্বালাতে হবে না?

টর্চ লাগাবে না বাবা? আমার একটা পেন্সিলটর্চ আছে।

টর্চ তো লাগবেই। বিশেষ করে পেন্সিলটর্চই লাগবে। পেন্সিলটর্চ ছাড়া জঙ্গলভ্রমণ মোটেই নিরাপদ হবে না?

বাবা চাকু লাগবে? আমার সুইস নাইফ আছে।

সুইস নাইফ ছাড়া ম্যাকগাইভার কি কখনো জঙ্গলে যেত?

না।

তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন সুইস নাইফ তো লাগবেই। তোর আছে না?

আছে। বাবা দড়ি লাগবে না?

আসল জিনিসই ভুলে গেছি। দড়ি is must. লাইলনের নীল রঙের দড়ি হলে খুব ভাল হয়।

মহা-উৎসাহে অন্তু ব্যাগ গুছাচ্ছে।

হাসানের চা এসে গেছে চায়ের কাপে দ্রুত কয়েকটা চুমুক দিয়ে সে বাথরুমে ঢুকল। অনেকদিন পর নিজের বাথরুমে গোসল। পরিচিত জায়গা। পরিচিত সাবানের গন্ধ। পরিচিত টাওয়েল। ওয়াটার হিটারটা নষ্ট ছিল। ঠিক করা হয়েছে। আগুনগরম পানি আসছে। হাসানের মনে হল, সামান্য ভুল হয়েছে। মগভর্তি গরম চা নিয়ে বাথরুমে ঢোকা উচিত ছিল। হট শাওয়ার নিতে নিতে গরম চা বা কফি খাবার আলাদা আনন্দ। এই আনন্দ তার আবিষ্কার।

বাথরুম থেকে বের হয়ে হাসান দেখল নাজমা চলে এসেছে। তার হাতে প্লেট। নলা বানিয়ে নীতুর মুখে দিচ্ছে। নীতু চোখ ভর্তি ঘুম নিয়ে ভাত খাচ্ছে। নাজমার মুখ শান্ত। সে একবার শুধু চোখ তুলে হাসানকে দেখল।

হাসান বলল, নীতুকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে রেডি হয়ে নাও। রাত এগারোটার মধ্যে আমাদের পৌঁছতে হবে।

নাজমা বলল, কোথায়?

হাসান বলল, অন্তু তোমাকে বলেনি? আমরা জঙ্গলে জোছনা দেখতে যাচ্ছি। বলেছে, নাকি বলেনি।

নাজমা শান্ত গলায় বলল, বলেছে।

হাসান বলল, দুর্দান্ত একটা চাঁদ উঠেছে। আমরা রাত দুটা পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জোছনা দেখব। দুটার পর ঘুমুতে যাব। তোমার জন্যে গাড়ি স্ট্যান্ডবাই থাকবে। ঘুম ভাঙলেই গাড়ি করে চলে আসতে পারবে। আর যদি মনে কর— একটা দিন বাচ্চারা স্কুল মিস করা এমন কিছু না— তাহলে থাকবে। আমি আমাদের কাজের অগ্রগতি তোমাকে দেখাব। তোমার টাসকি লেগে যাবে।

নাজমা চুপ করে রইল।

হাসান নীতুর দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে বুড়ি জঙ্গলে যাবি?

নীতু বলল, না।

পৃথিবীর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে সে না বলে। তার এই না মানে বেশির ভাগ সময়ই হ্যাঁ।

হাসান বলল, আমাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। আমরা পথ থেকে একটা বিগ সাইজ পিজা কিনে নেব।

নাজমা বলল, তুমি টাওয়েল পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ। গা মুছে কাপড় পরে টেবিলে এসে বস। আগে কথা বলি।

হাসান বলল, তোমার কথা বলার টোনটা ভালো লাগছে না। এতদিন পরে এসেছি, এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না।

নাজমা বলল, ঝগড়া করব না। শান্তভাবেই কয়েকটা কথা বলব। তুমি চাইলে হাসিমুখেই বলব।

হাসান বলল, তুমি ঝগড়া করতে চাইলে ঝগড়া করতে পার। চিৎকার চেঁচামেচি করতে পার— আমার দিকে চায়ের কাপ বা গ্লাসও ছুড়ে মারতে পার— শুধু জঙ্গলে জোছনা দেখার ব্যাপারে না বোলো না। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি একা জোছনা দেখতে পারি না।

নাজমা বলল, তুমি কাপড় বদলে বারান্দায় বসো–আমি নীতুকে খাইয়ে আসছি। তখন কথা হবে।

 

হাসান বারান্দায় বসে আছে। হাসানের পাশে ব্যাগ হাতে অন্তু। নাইলনের নীল রঙের দড়ি ছাড়া অন্তুর ব্যাগে সবই নেয়া হয়েছে, শুধু তার পেন্সিলটর্চের ব্যাটারি নেই। হাসান তাকে কয়েকবার আশ্বস্ত করেছে ব্যাটারি কেনা হবে, অন্তু কেন জানি ভরসা পাচ্ছে না। রাস্তার ওপাশের দোকানটা খোলা আছে। অন্তুর ইচ্ছা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এক্ষুনি সে ব্যাটারি কিনবে।

নাজমা নিজের জন্যে মগভর্তি চা নিয়ে হাসানের পাশে বসল। অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, অন্তু তুমি ঘরে যাও। তোমার বাবার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলব।

অন্তু বলল, আমাদের তো দেরি হয়ে যাচ্ছে মা।

দেরি হলেও কিছু করার নেই। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা আগে শেষ হতে হবে। ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে যাও।

অন্তু ঘরে চলে গেল। নাজমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তুমি ঢাকায় এসেছ এক মাস আঠারো দিন পর।

হাসান বলল, কী যে কাজের চাপ যাচ্ছে তুমি এখানে বসে কল্পনাও করতে পারবে না।

আমি তোমাকে তিনটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম, তুমি তার একটার জবাব দিয়েছ। তিন লাইনের জবাব।

একবার তো বলেছি প্রচণ্ড কাজের চাপ।

এতই যখন কাজের চাপ, তাহলে জোছনা দেখানোর জন্যে চলে এলে কেন? কাজের মধ্যে জোছনা কী?

নাজমা তুমি ঝগড়া করার চেষ্টা করছ।

ঝগড়া করছি না। তোমার সঙ্গে আলাপ করছি। আলাপ করার জন্যে তোমাকে পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেছে। ভাগ্যিস তোমাদের জঙ্গলে একটা চাঁদ উঠেছিল।

এই-যে কথাগুলি বলছ, চলো এক কাজ করি–জঙ্গলে জোছনায় বসে আলাপ-আলোচনা যা হবার হোক।

নাজমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপ পাশে রাখতে রাখতে বলল, শুরুতেই বিষয়টা পরিষ্কার করে নেয়া ভাল। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না।

যাচ্ছ না মানে?

যাচ্ছি না মানে যাচ্ছি না। তোমার সঙ্গে জোছনা দেখার আমার শখ নেই। কারো সঙ্গেই নেই।

অন্তু ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে।

এটাও তোমার চমৎকার ট্রিকস-এর একটি। অন্তুকে আগেভাগে বলেছ। সে ব্যাগ গুছিয়ে অপেক্ষা করছে। তুমি জানো এটা আমার উপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। যেতে ইচ্ছা না করলেও ছেলের শুকনোমুখ দেখে আমি যাব। তোমার ট্রিকস আজ কাজ করবে না। আমি যাব না।

যাবে না?

অবশ্যই না। আমাকে বা অন্তু নীতুকে তোমার প্রয়োজনও নেই। দুএকজন মুগ্ধ মানুষ তোমার আশেপাশে থাকলেই হল। সেরকম মানুষ তোমার সঙ্গে আছে। তোমার পি.এ, আছে না! মেয়েটার নাম কী যেন?

লীনা।

হ্যাঁ লীনা। মেয়েটার নাম আমি জানি, তারপরেও তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমি দেখাতে চাচ্ছিলাম তুমি তার নামটা কত মিষ্টি করে উচ্চারণ কর।

খুব মিষ্টি করে কি উচ্চারণ করেছি?

হ্যাঁ করেছ। মুগ্ধ মানবী একজন তো তোমার সঙ্গেই আছে। শুধুশুধু আমাদের নিতে এসেছ কেন?

নাজমা তুমি ভুল লজিক ধরে এগুচ্ছ। তুমি আমার সঙ্গে যাবে না ভালো কথা। মেয়েটাকে শুধু শুধু টানছ কেন?

মেয়েটাকে টানছি কারণ আমি তোমার স্বভাবচরিত্র জানি। তুমি যখন কিছু বলার জন্যে মাথার ভেতর কথা গুছাও–তখন তোমার মুখের দিকে

তাকিয়ে আমি বলে দিতে পারি তুমি কী বলতে যাচ্ছ।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই প্রমাণ দেব?

প্রমাণ দিতে হবে না। প্রমাণ ছাড়াই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি।

তারপরেও প্রমাণ দেই। জোছনা উপলক্ষে তুমি তোমার মায়ানগরে মোটামুটি একটা হৈচৈ ফেলে দিয়েছ। জোছনা-উৎসবের আয়োজন করেছ। করনি?

উৎসবের আয়োজন করিনি। তবে কাজকর্ম বন্ধ রেখেছি। জেনারেটর চালু হয়নি।

লীনা মেয়েটিকে বলনি শাদা শিফন পরে জোছনায় হাঁটতে? চাঁদের আলোয় শাদা শিফন পরলে মনে হবে জোছনার কাপড় পরা হয়েছে। এই কথা একসময় আমাকে বলেছ— আরো অনেককে বলেছ। তাকেও নিশ্চয় বলেছ। বলনি?

হ্যাঁ বলেছি।

জাপানি খাবার রান্না করে খাওয়াও নি? আলিও ওলিও, কিংবা টমেটো বেসড স্পেগেটি পমরো। নিশ্চয়ই খাইয়েছ।

হ্যাঁ খাইয়েছি, তাতে কী প্রমাণিত হয়?

আগে যা অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে তাই প্রমাণিত হয় আমাকে তোমার প্রয়োজন নেই। তোমার প্রয়োজন একজন মুগ্ধ মানবী—যার চোখ সারাক্ষণ বিস্ময়ে চকমক করবে। আমার মধ্যে বিস্ময় নেই, মুগ্ধতাও নেই– আমাকে দরকার হবে কেন?

কথা শেষ হয়েছে, না আরো বলবে?

মূল কথা বলা হয়ে গেছে। মূলের বাইরের একটা কথা বলে নিই। অন্তুর জন্যে যে তীব্র আকর্ষণ তুমি বোধ কর তার কারণটা কি তুমি জানো?

পুত্রের প্রতি আকর্ষণের পেছনে কারণ লাগে?

অবশ্যি কারণ লাগে। অন্তু মুগ্ধ বিস্ময়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে বলেই তুমি তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ কর। মুগ্ধ হবার মতো বয়স নীতুর হয়নি বলে তুমি নীতুর প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ কর না। ওরা যখন বড় হবে, ওদের মুগ্ধতা কেটে যাবে, তখন ওদের প্রতি তুমি কোনোই আকর্ষণ বোধ করবে না। আমার কথা শেষ— এসো খেতে এসো।

হাসান বলল, অন্তু যেতে না পারলে খুবই মনখারাপ করবে। একটা কাজ করি, আমি নতজানু হয়ে তোমার কাছে প্রার্থনা করি। এবারের মতো চলো।

এইসব নাটক অনেকবার করেছ। আর না প্লিজ।

তাহলে যাচ্ছ না?

না।

নাজমা ঘরে ঢুকে গেল। হাসান বসে রইল একা। অন্তু এসে ঢুকল। অন্তু বলল, বাবা তুমি এত বোকা কেন? আসল জিনিসটার কথা তুমি ভুলে গেছ।

হাসান বলল, আসল জিনিস কী?

আমরা যে জঙ্গলে যাচ্ছি সেই জঙ্গলটার একটা মাপ লাগবে না? পথ হারিয়ে ফেললে তো আমাদের ম্যাপ দেখতে হবে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছি পথ হারিয়ে ফেললে এরা ম্যাপ দেখে।

হাসান দ্রুত চিন্তা করছে। আজ যাওয়া হবে না, এই দুঃসংবাদটা ছেলেকে কীভাবে দেয়া যায়। এমনভাবে বলতে হবে যেন ছেলে মনে কষ্ট না পায়। কোনো কিছুই মাথায় আসছে না।

অন্তু বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দ এবং উত্তেজনায় তার চোখ চকচক করছে।

 

লীনা বনের ভেতর বসে আছে। তার হাতে ঘড়ি নেই। সময় কতটা পার হয়েছে বুঝতে পারছে না। তবে রাত অনেক হয়েছে। একটু আগে চাঁদটা ছিল মাথার উপর, এখন নামতে শুরু করেছে। ক্যাম্প থেকে সাড়াশব্দ আসছিল, এখন তাও নেই। লীনা উঠে দাঁড়াল। সে এগুচ্ছে গভীর বনের দিকে। কাজটা ঠিক হচ্ছে না। দিনের বেলাতেই সে একবার পথ হারিয়েছিল আর এখন মধ্যরাত। চাঁদের আলো অবশ্যি আছে। চাঁদের আলো পথ খুঁজতে সাহায্য করে না, বরং পথ ভুলিয়ে দেয়। লীনা এলোমেলো ভঙ্গিতে হাঁটছে। মনে হচ্ছে ঠিক হাঁটছেও না। বাতাসে ভাসতে ভাসতে এগুচ্ছে।

ম্যাডাম স্লামালিকুম।

লীনা থমকে দাঁড়াল। শামসুল আলম কোরেশি নামের অল্পবয়েসী ইনজিনিয়ার ছেলেটা। ওরা তিনজন সবসময় একদলে থাকে। আজ সে একা হাঁটছে। কিংবা তিনজন মিলেই হয়তো হাঁটছে, বাকি দুজন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনকে পাঠানো হয়েছে কথা বলার জন্যে।

কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম?

কোথাও যাচ্ছিনা তো। হাঁটছি, জোছনা দেখছি।

আমি অনেক দূর থেকে আপনাকে দেখে খুবই চমকে গিয়েছিলাম।

কেন?

শামসুল আলম কোরেশি নিচুগলায় বলল, আপনি শাদা রঙের শাড়ি পরেছেন। শাদা রঙের শাড়ি, চাঁদের আলো সব মিলে হঠাৎ মনে হয়েছিল— আপনি বোধহয় মানুষ না। অন্যকিছু।

ভূত-প্রেত?

না, তাও না। আমার কাছে মনে হচ্ছিল পরী। ম্যাডাম, আমার কথায় আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি কিছু ভেবে কথাটা বলিনি।

আমি কিছু মনে করিনি।

ম্যাডাম আসুন, আপনাকে তাঁবুতে পৌঁছে দেই। এত রাতে একা একা জঙ্গলে হাঁটা ঠিক হবে না।

আমাকে পৌঁছে দিতে হবে না, আমি একা একা হাঁটব। ঝিলটা কোন্ দিকে একটু দেখিয়ে দিন।

আমি কি সঙ্গে আসব?

না। থ্যাংক য়্যু। লীনা ঝিলের দিকে এগুচ্ছে। চাঁদের আলোয় ঝিলের পানিতে নিজের ছায়া দেখতে ইচ্ছা করছে।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ