শোবার ঘরের বারান্দায় ইয়াকুব সাহেব বসে আছেন। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসা না। শরীর টানটান করে বসা। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি নেই। হাসাল চিন্তিত বোধ করছে। এমন কিছু কী ঘটেছে যে ইয়াকুব সাহেব তার উপর বিরক্ত? এই মানুষটির সঙ্গে তার তেমন পরিচয় নেই। পরিচয় থাকলে হাসান তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারত-মানুষটা বিরক্ত না-কি বিরক্ত না। বিরক্তি প্রকাশের একটা সাধারণ ভঙ্গি আছে! এই মানুষটাকে ঠিক সাধারণের পর্যায়ে ফেলা যাচ্ছে না।

হাসান, ভালো আছ?

জি ভালো আছি।

লণ্ডভণ্ড শব্দটার ইংরেজি জানো?

কোন্ ধরনের লণ্ডভণ্ড মানসিক লণ্ডভণ্ডের এক ইংরেজি, আবার ঘরবাড়ির লণ্ডভণ্ডের আরেক ইংরেজি।

শুনলাম তুমি আমার জায়গাটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছ?

হাসান চুপ করে রইল। আলোচনা কোনদিকে যাবে সে এখনো বুঝতে পারছে না।

ইয়াকুব সাহেব বললেন, লণ্ডভণ্ড কর বা অন্য কিছু কর কিছুই যায় আসে না–যে সময় তোমাকে বেঁধে দিয়েছি, ঐ সময়ে কাজটা শেষ করতে হবে। পারবে?

পারব।

এটা বলার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি। তুমি আরো কিছু টাকা চেয়েছিলে। পাঠানো হয়নি। চেকটা রেডি করে রেখেছি তোমাকে হাতে হাতে দেবার জন্যে বসে আছি।

থ্যাংক য়্যু স্যার, আপনি কি এর মধ্যে গিয়ে কাজের প্রগ্রেস দেখবেন?

তুমি কি চাও আমি দেখি?

না, চাই না।

চাও না কেন?

হাসান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি মায়ানগর বানাচ্ছেন আপনার নাতনীকে চমকে দেবার জন্যে। আমি এটা বানাচ্ছি আপনাকে চমকে দেবার জন্যে। আগেভাগে যদি দেখে ফেলেন, পুরো চমকটা পাবেন না।

শুনেছি তোমার মায়ানগরে অনেক নতুন নতুন ব্যাপার রেখেছ। এর যে-কোনো একটার কথা আমাকে বলো তো। না-যে-কোনো একটা না, তোমার সবচে পছন্দের প্রজেক্টের কথা বলো।

হাসান চুপ করে রইল। কিছু বলল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, হাসান তোমার কাছে কি সিগারেট আছে? ডাক্তাররা আমার জন্যে সিগারেট নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বাড়িতে কোনো সিগারেট নেই। একটা খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি একটা সিগারেট ধরাও। আমি একটা ধরাই।

হাসান সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। ইয়াকুব সাহেব খুবই আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট ধরালেন।

হাসান!

জ্বি স্যার।

তোমার সবচে প্রিয় প্রজেক্টের ব্যাপারটা আমাকে বলো। শুনতে ইচ্ছা করছে।

প্রজেক্টের ব্যাপারটা বলার আগে, একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে। গল্পটা শোনার ধৈর্য কি আপনার আছে?

অনেকদিন আমি গল্প শুনি না। শোনাও একটা গল্প। হাসান শোনো, এই সিগারেট শেষ করে আমি কিন্তু আরেকটা সিগারেট খাব।

ইয়াকুব সাহেব ছেলেমানুষের মতো হাসলেন। হাসান গল্প শুরু করল।

স্যার, আমার একটা ছেলে আছে তার নাম অন্তু। ছেলেটা অন্যরকম। কথাবার্তা খুব কম বলে। কোনো ব্যাপারে মনে কষ্ট পেলে লুকিয়ে একা একা কাঁদে। একদিন কী একটা ব্যাপারে স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছে। সে ঠিক করেছে আমার ছেলেমেয়ে দুজনকে নিয়েই তার বাবার বাড়িতে চলে যাবে। আমি বললাম, আচ্ছা চলে যাও। তারা চলে গেল। আমার খুবই মেজাজ খারাপ। কিছুক্ষণ বই পড়লাম, গান শুনলাম। নিজেই কফি বানিয়ে কফি খেলাম। মন ঠিক হল না। আমি বসলাম টিভির সামনে। কুৎসিত একটা প্রেমের নাটক হচ্ছে। মেজাজ খারাপ নিয়ে তাই দেখছি, হঠাৎ কানে আসল অন্তু কাঁদছে। আমি হতভম্ব। টিভি বন্ধ করলাম। অন্তুর কান্নার শব্দ আরো স্পষ্ট হল। আমার শরীর ঘেমে গেল। আমি বুঝলাম আমার হেলুসিনেশন হচ্ছে। বোঝার পরেও এ-ঘরে সে-ঘরে খুঁজলাম। কান্নার শব্দ হয়, শব্দ শুনে এগিয়ে গেলে আর শব্দ পাওয়া যায় না। তখন অন্য ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসে। আমার হাতপা কাপতে শুরু করল। শেষে টেলিফোন করলাম শ্বশুরবাড়িতে। অন্তুর মা নাজমা টেলিফোন ধরল। আমি বললাম, অন্তুকে একটু দাও তো কথা বলি। নাজমা বলল, অন্তুকে দাও তো মানে? অন্তুকে তো আমি আনিনি। সে তো তোমার এখানেই আছে। সে এমন কাঁদতে শুরু করল, বাবার সঙ্গে থাকবে, যে আমি তাকে রেখে চলে এসেছি। ও ঘরেই কোথায় লুকিয়ে আছে। খুঁজে বের করে আমাকে টেলিফোন কর।

আমি অন্তুকে খাটের নিচ থেকে উদ্ধার করলাম। আমার গল্পটা স্যার এখানেই শেষ। এখন প্রজেক্টের কথাটা বলি।

ইয়কুব সাহেব বললেন, তোমার গল্পটা ইন্টারেষ্টিং। প্রজেক্টের সঙ্গে এই গল্পের সম্পর্ক বুঝতে পারছি না।

স্যার, আমি একটা গোলকধাঁধা বানাচ্ছি। গোলকধাঁধায় যখন কেউ ঢুকবে তখনই সে বাচ্চা একটা ছেলের ফুপিয়ে কান্নার শব্দ শুনবে। ছেলেটাকে খুঁজে বের করার ইচ্ছা হবে। খুঁজতে শুরু করবে, কিন্তু খুঁজে পাবে না। এক ঘর থেকে আরেক ঘর। একটা বাচ্চাছেলে কাঁদছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে দেয়ালে তার হাতের লেখা আমি হারিয়ে গেছি। কখনো দেখা যাবে একটা ফুটবল পড়ে আছে। ছেলেটাই ফেলে গেছে। এক জায়গায় দেখা যাবে চুইংগামের খোসা। এই হল আমার প্রজেক্ট।

ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার ছেলে অ্যুকে আমি নিমন্ত্রণ করছি। আমার নাতনীকে নিয়ে আমি যখন মায়ানগরে পা দেব তখন অন্তুও থাকবে আমার সঙ্গে থাকে। দুজন থাকবে আমার দুপাশে। হাসান, তুমি আজই তোমার ছেলেকে আমার নিমন্ত্রণ পৌঁছে দেবে।

জ্বি স্যার, আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। রাতটা বাসায় থাকব। অন্তুকে বলব। স্যার উঠি?

আচ্ছা যাও।

একটা সিগারেট রেখে যাচ্ছি স্যার।

থ্যাংক য়্যু।

 

নাজমা দরজা খুলে দিল। নাজমার মুখ শান্ত। হাসান স্বস্তিবোধ করল। ঘরে ঢুকেই কঠিন মুখ দেখতে ভালো লাগে না। ঘর মানেই আশ্রয়। যিনি আশ্রয় দেবেন তার মধ্যে মায়া থাকতে হবে। প্রতিটি ঘর হবে ছোট্ট একটা মায়ানগর। আশ্রয় যিনি দেবেন তিনি হবেন মায়াবতী।

নাজমা, কেমন আছ?

ভালো। এত রাতে?

ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

না ঘুমাইনি। খাওয়াদাওয়া করে এসেছ, না খাবে?

ভাত খাব। কিছু থাকলে একটা ডিম ভেজে দাও। অন্তু নীতু কেমন আছে?

ভালো আছে।

দুজনই ঘুমুচ্ছে?

হুঁ। তুমি কি গোসল করবে?

হ্যাঁ করব।

ধীরেসুস্থে গোসল কর—এর মধ্যে আমি চারটা চাল ফুটিয়ে ফেলি। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত ছাড়া ডিম ভাজা দিয়ে খেয়ে আরাম পাবে না। তোমার প্রজেক্ট কেমন এগুচ্ছে?

খুব ভালো এগুচ্ছে। একদিন বাচ্চাদের নিয়ে চলো— তাঁবুতে থাকবে, জঙ্গলে ঘুরবে। বিদেশীদের মতো ক্যাম্পিং।

দেখি।

কোনো এক ছুটির দিনে চলো।

আচ্ছা যাব।

হাসান বাথরুমে ঢুকল। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করল। রাতের খাবারটা আরাম করে খেল। আগুনগরম ভাতের উপর ঘি ছিটিয়ে দেয়া, ডিম ভাজা, শুকনামরিচ ভাজা। হাসানের মনে হল— ঢাকা শহরে এরকম একটা রেস্টুরেন্ট খুব চলবে। রেষ্টুরেন্টের ফিক্সড মেনু–

বিরুই চালের গরম ভাত
গাওয়া ঘি
দেশী মুরগির ডিম ভাজা
শুকনামরিচ ভাজা

ডিম আগেই ভাজা হবে না। ঘি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করলে ডিম ভাজা হবে। কড়াই থেকে চামচে করে এনে সরাসরি পাতে দিয়ে দেয়া হবে।

হাসান খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাল। নাজমা তাকে পান এনে দিল। সে নিজে পান খায় না। হাসান দুপুরে এবং রাতে পান খায় বলে তার জন্যে ঘরে পান রাখা হয়।

নাজমা বলল, অন্তুর জ্বর।

হাসান বলল, তবে যে বললে ওরা ভালো।

মাত্র ঘরে এসে ঢুকেছ এই সময় অসুখ-বিসুখের খবর দিলাম না। ওর পায়ে পানিও এসেছে। ডাক্তার সন্দেহ করছেন কিডনি বিষয়ক জটিলতা।

আমাকে খবর দাওনি কেন?

খবর দিলে কী করতে? সব কাজ ফেলে ছুটে আসতে? না, আসতে। ছেলের জন্যে দুশ্চিন্তা নিশ্চয়ই করতে, কিন্তু আসতে না। ধরো ছেলেকে যদি চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরেও নিয়ে যেতে হয়, আমাকেই নিয়ে যেতে হবে। তুমি কিন্তু নিয়ে যাবে না।

হাসান চমকে উঠে বলল, দেশের বাইরে নিয়ে যেতে হবে নাকি?

নাজমা বলল, ডাক্তার এমন কিছু বলেননি। তবে তাকে খুব গম্ভীর মনে হল। তিনি বললেন কিডনির অসুখটা ছোটবাচ্চাদের এখন খুব হচ্ছে। অসুখটা ভালো না।

হাসান সিগারেট ফেলে অদ্ভুর কাছে গেল। কেমন অসহায় ভঙ্গিতে সে খাটে শুয়ে আছে। গায়ে বেগুনি রঙের কম্বল। হাসান পাশে বসতেই অন্ত চোখ বড় বড় করে বাবাকে দেখেই ফিক করে হেসে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাসান বলল, জেগে আছিস নাকি রে ব্যাটা?

অন্তু চোখ বন্ধ করেই হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল।

হাসান বলল, কখন ঘুম ভাঙল?

অন্তু বলল, তুমি যখন ঘরে ঢুকেছু তখনই ঘুম ভেঙেছে।

ডাকিসনি কেন?

ইচ্ছা করেনি।

অসুখ বাধিয়েছিস কেন?

জানি না।

ঘরে কোনো ভালো মুভি আছে? ভিসিআরে ভালো কোনো মুভি দেখতে ইচ্ছা করছে। কার্টুন ফান্টুন না, সিরিয়াস ভূতের ছবি। কফিন থেকে ভূত উঠে আসছে–এই টাইপ। আছে?

ঘোস্ট স্টরি আছে। কিন্তু বাবা তুমি ভয় পাবে।

বেশি ভয়ের নাকি?

খুবই ভয়ের।

তাহলে এক কাজ করি, চাদরের নিচে শরীরটা ঢেকে শুধু মাথা বের করে দেখি। ভয় লাগলে চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলব। বুদ্ধিটা কেমন?

বুদ্ধিটা খুবই ভালো।

তাহলে উঠে আয়–ছবি দেখব।

মা বকবে না তো বাবা?

সেই সম্ভাবনা তো আছেই। তারপরেও রিস্ক নিতে হবে। ভালো কথা অন্তু, তোর একটা দাওয়াত আছে।

কিসের দাওয়াত।

মায়ানগরে ঢোকার নিমন্ত্রণ। তুই ঢুকবি আর এক বিদেশী মেয়ে ঢুকবে। মেয়েটার নাম এলেন। তোর বয়েসী। দেখিস আবার যেন মেয়েটার সঙ্গে প্রেম না হয়ে যায়।

ধ্যাৎ বাবা! তুমি সবসময় এত অসভ্য কথা কেন বলো। আমি প্রেমও করব না, বিয়েও করব না।

তুই না করলে কী হবে। মেয়েরা তো করতে চাইবে।

বাবা অসভ্য কথা বলবে না। আমি কিন্তু রাগ করছি।

হাসন চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছে। চাদরের ভেতর হাসানের সঙ্গে গুটিসুটি মেরে বসেছে অন্তু। ভিসিআরে ভূতের ছবি চলছে।

নাজমা দৃশ্যটা দেখেও কিছু বলল না। তার মন অসম্ভব খারাপ। হাসানকে সে এখনো জানায়নি যে অন্তুকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়েছে। নাজমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তারও ইচ্ছা করছে চাদরের নিচে ছেলের পাশে বসে ছবি দেখতে ইচ্ছাটাকে সে আমল দিল না। নাজমা জানে অন্তর একটি ভুবন আছে শুধুই তার বাবাকে নিয়ে। সেই ভূবনে নাজমার প্রবেশাধিকার নেই।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ