১০. গৌরাঙ্গ ঘরামি

সকালবেলা জিতু দেখা করতে এলো, তার মুখে এগাল-গাল জোড়া হাসি। রাশাকে দেখে বলল, “কাজ হয়েছে!”

“কী কাজ?”

“রাস্তা ডুবে গেছে।”

“কোন রাস্তা?”

“স্কুলে যাবার রাস্তা। আর স্কুলে যেতে হবে না।” জিতুর মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো।

“সর্বনাশ! তাহলে কী হবে?”

“কী আর হবে। আমরা বাড়িতে বসে থাকব।”

“কি স্কুলে না গেলে কেমন করে হবে? মনে নাই আমাদের কম্পিউটারের ল্যাবরেটরিটা মাত্র তৈরি হলো। এখন কম্পিউটার ডেলিভারি দেবে?”

জিতুর মনে আছে, কিন্তু স্কুলে যেতে না হওয়ার আনন্দ অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। রাশা জিতুর কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করে নিজে একটু খোঁজখবর নিল। সত্যি সত্যি স্কুলের রাস্তা জায়গায় জায়গায় ডুবে গেছে। জায়গায় জায়গায় হাঁটুপানি, জুতো হাতে নিয়ে চলে যাওয়া যায়। কয়দিন পর পানি আরো বাড়বে, বুকপানি গলাপানি হয়ে যেতে পারে। রাশা একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। জয়নবের সাথে সেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল, তখন জয়নব বলল, “দরকার হচ্ছে নৌকা।”

“নৌকা?”

“হ্যাঁ। নৌকা করে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গতি নাই।”

“নৌকা কোথায় পাব?”

“গ্রামের মানুষের নৌকা আছে, ভাড়া করবি, যাবি।”

“প্রতিদিন নৌকা ভাড়া করতে হবে?”

“এ ছাড়া আর রাস্তা কী?”

মতি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, সে বলল, “আমাদের নিজেদের একটা নৌকা থাকলে আমরা নৌকা বেয়ে চলে যেতাম!”

রাশা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই নৌকা বাইতে পারিস?”

মতি কোনো কথা না বলে হাসল, কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “তুমি ভাত খেতে পারো?” তখন সে যেভাবে হাসে সেই হাসি।

রাশা বলল, “তাহলে আমরা একটা নৌকা জোগাড় করি না কেন?”

জয়নব বলল, “কোত্থেকে জোগাড় করবে?”

রাশা মাথা চুলকাল, বলল, “সেইটা তো জানি না।”

.

রাত্রিবেলা সে নানিকে জিজ্ঞেস করল, “নানি, নৌকা কোথায় পাওয়া যায় তুমি জানো?”

“নৌকা? নদীতে, খালে-বিলে।”

রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না, না সেই কথা বলছি না। আমাদের স্কুলে যাবার জন্যে একটা নৌকা দরকার। সেই নৌকাটা কোথায় পাব?”

নানি মাথা চুলকালেন, বললেন, “তোর নানার একটা ছোট নৌকা ছিল, সে তো অনেক আগে। কোথায় গেছে তাও জানি না। খালে ডুবে ছিল হয়তো, ভেঙেচুরে ভেসে গেছে “

রাশা বলল, “ইস! নানি, কেন তুমি নৌকাটাকে ভেঙেচুরে ভেসে যেতে দিলে?”

নানি হাসলেন, বললেন, “কতদিন আগের কথা, সেই নৌকা কি আর এতদিন থাকত? নৌকা সারতে হয়, বছর বছর মেরামত করতে হয়, আলকাতরা দিতে হয়।”

“তাহলে এখন কী করি নানি?”

“এই গ্রামে ঘুরে দেখ। হয়তো কারো ছোট নৌকা আছে, তোদের ব্যবহার করতে দেবে।”

রাশা পরদিন জয়নব, জিতু আর মতিকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো। রাশা একটু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল গ্রামের অনেকেরই ছোটখাটো নৌকা আছে। যাদের নৌকা নাই তাদের অনেকেরই ডোঙ্গা নামে নৌকার মতো একটা জিনিস আছে। তালগাছের মাঝে গর্ত করে এই ডোঙ্গা তৈরি করা হয়, একজন মানুষ বসে সেটাকে বেয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু রাশাদের দিয়ে দেয়ার মতো বাড়তি একটা নৌকা কারো নেই। চারজন একটু হতাশ হয়ে ফিরে আসছিল, কিভাবে সমস্যাটা মেটানো যায় সেটা নিয়ে জোর আলোচনা হচ্ছে, তখন জিতু বলল, “আমরা কলাগাছ দিয়ে একটা ভেলা বানাতে পারি।”

“ভেলা?”

“হ্যাঁ। সেই ভেলায় করে আমরা স্কুলে যেতে পারি।”

মতি কম কথার মানুষ, সে কোনো কথা না বলে হাসার ভঙ্গি করল। জিতু রেগে বলল, “কী হলো, তুমি হাস কেন?”

“তোর কথা শুনে।”

“আমার কোন কথাটা হাসির?”

“যদি কলাগাছের ভেলা দিয়ে স্কুলে যেতে হয় তাহলে দিনে দুইটা করে ভেলা বানাতে হবে। যাওয়ার জন্যে একটা আসার জন্যে আরেকটা! এই দশ গ্রামের যত কলাগাছ আছে সব কেটে ফেলতে হবে!”

জিতু চিৎকার করে বলল, “কেন দশ গ্রামের কলাগাছ কাটতে হবে? কেন কাটতে হবে?”

ঠিক তখন শুনল, কে জানি বলছে, “কী ব্যাপার তোমরা কী কাটাকাটি করতে চাইছ?”

তারা তাকিয়ে দেখে গাছে হেলান দিয়ে সালাম নানা বসে আছেন। হাতে একটা বই, মনে হয় চোখের খুব কাছে ধরে বইটা পড়ছিলেন, তাদের চেঁচামেচি শুনে এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।

চারজনই দাঁড়িয়ে গিয়ে সালাম দিল। সালাম নানা বললেন, “কী ব্যাপার, তোমরা এই সকালে কী কাটাকাটি করতে চাইছ?”

রাশা হাসল, “আমাদের জিতু মিয়া কলাগাছ কেটে ভেলা তৈরি করতে চাচ্ছে।”

“ভেলা? কলাগাছের ভেলা?” রাশা একটু গিয়ে সালাম নানার কাছে বসে পড়ে–তার দেখাদেখি অন্যেরাও। সালাম নানার ক্রাচ দুটো পাশে শুইয়ে রাখা ছিল, জিতু সাবধানে সেগুলো একবার ছুঁয়ে দেখল। রাশা বলল, “আসলে আমরা নৌকা খুঁজতে বের হয়েছিলাম। নৌকা পাই নাই তাই জিতু বলল কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানাবে।”

“নৌকা! নৌকা কী জন্যে?”

“রাস্তা ডুবে গেছে, তাই স্কুল যেতে পারছি না। একটা নৌকা হলে স্কুলে যাওয়া যেত সে জন্যে।”

সালাম নানা এবারে একটু ঘুরে চারজনের এই ছোট দলটার দিকে ভালো করে তাকালেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “তার মানে মজা করার জন্যে নৌকা খুঁজছ না? রীতিমতো স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করার জন্যে নৌকা খুঁজছ?”

“জি নানা।” রাশা মাথা নাড়ল, তার দেখাদেখি অন্যেরাও।

“হুম।” নানা এবার চশমা খুলে শার্টের কোনা দিয়ে চশমাটা মুছে বললেন, “এরকম একটা মহৎ কাজে আমাদের তো সাহায্য করা দরকার। কী বলো?”

রাশার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, “আপনার নৌকা আছে নানা? আছে?”

“নাই। কিন্তু তাতে কী আছে? আমি তোমাদের নৌকা জোগাড় করে দেব!”

“সত্যি? সত্যি?” রাশার চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করতে থাকে।

“হ্যাঁ, সত্যি।”

“কোথা থেকে জোগাড় করবেন?”

“বাংলাদেশে নৌকা জোগাড় করা কোনো ব্যাপার নাকি? সারা দেশটাই তো চলে নৌকা দিয়ে। যুদ্ধের সময় আমরা সবসময়ে নৌকার ওপর ছিলাম। যুদ্ধের সময় আধঘণ্টার নোটিশে পাঁচ-দশটা নৌকা জোগাড় করেছি আর এখন শাস্তির সময় বাচ্চাদের স্কুলে যাবার জন্য নৌকা জোগাড় করতে পারব না? কী মনে করো তুমি আমাকে?”

জয়নব মাথা নাড়ল, “পারবেন নানা। আপনি চাইলেই পারবেন।

জিতু জানতে চাইল, “নৌকাটা কি আপনি কিনবেন?”

“কেন তো সোজা! তার থেকেও বেশি কিছু করব।”

“কী করবেন, বলেন না, নানা!” রাশা অনুনয় করল, “প্লিজ!”

নানা আবার চোখ থেকে চশমা খুলে সেটা মুছলেন, তারপর চোখে লাগিয়ে বললেন, “আমার একজন বন্ধু আছে, নাম হচ্ছে গৌরাঙ্গ। সে হচ্ছে ঘরামি। সে নৌকা বানায়। বহুদিন তার সাথে যোগাযোগ নাই। কয়দিন থেকে ভাবছিলাম তার একটু খোঁজ নিই। এখন তোমাদের অছিলায় তার সাথে যোগাযোগ করার একটা সুযোগ হলো, তাকে বল আসতে। গল্পগুজব করবে, তোমাদের একটা নৌকা বানিয়ে দেবে।”

রাশা আনন্দে হাততালি দিল, “বানিয়ে দেবে। আমাদের চোখের সামনে?”

“হ্যাঁ। তোমাদের চোখের সামনে।“

“কয়দিন লাগবে নানা?”

“সকালে শুরু করলে সূর্য ডোবার আগে সে একটা নৌকা বানাতে পারে। এখন অবশ্যি বয়স হয়েছে, এখন একদিনে পারবে কি না জানি না।”

জিতু বলল, “আমরা সবাই সাহায্য করব।”

“তাহলে মনে হয় একমাস লেগে যাবে।”

সালাম নানার কথায় সবাই হি হি করে হাসতে লাগল, জয়নব বলল, “আপনি ঠিকই বলেছেন নানা। জিতু হাত দিলেই সর্বনাশ–তখন একদিনের কাজ শেষ হতে একমাস লাগবে।”

রাশা জিজ্ঞেস করল, “নানা আপনার বন্ধুকে কবে খবর দিবেন?”

“আজকেই দিব।”

“কবে থেকে বানাবেন?”

“কাঠ কিনতে হবে, গজাল, শিরিষ, আলকাতরা এইসব কিনতে হবে, জোগাড়যন্ত্রে একটু সময় লাগবে। মনে করো পরশু না হলে তার পরের দিন।”

“কোথায় বানাবেন, নানা?”

“তোমার নানাবাড়িতে। সামনে খাল আছে, খালের পাড়ে তৈরি করে খালে ভাসিয়ে দেয়া হবে।”

রাশা আবার হাততালি দিল, “কী মজা হবে।”

সালাম নানা হাসলেন, বললেন, “হ্যাঁ। অনেক মজা হবে।”

সালাম নানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চারজন বাড়ির দিকে রওনা দেয়, কয়েক পা অগ্রসর হয়ে রাশা থেমে গেল, অন্যদের বলল, “তোরা হাঁটতে থাক, আমি সালাম নানার কাছ থেকে একটা জিনিস জেনে আসি।”

রাশা দৌড়ে আবার সালাম নানার কাছে এসে বলল, “নানা।”

“বলো।”

“নৌকার জন্যে কাঠ, আলকাতরা এসব তো কিনতে হবে। তার জন্যে তো একটু টাকা লাগবে। আর আপনার বন্ধুকে তো নৌকা তৈরি করার জন্যে একটু মজুরি দিতে হবে। আমি বলছিলাম কী-”

“কী বলছিলে?”

“আমার মা যাবার সময় আমাকে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। স্কুলে ভর্তি হবার সময় একটু টাকা খরচ হয়েছে। বাকি টাকাটা আছে। যদি কাঠ কিনতে টাকা লাগে—”

“কাঠ কিনতে টাকা লাগবে না। আমার বাড়িতে অনেক কাঠ পড়ে আছে। গজাল, আলকাতরা, শিরিষ এইসবের জন্যে এমন কিছু খরচ নাই। বাকি থাকল গৌরাঙ্গের মজুরি?”

“জি নানা।”

“আমি তোমাকে বলেছি গৌরাঙ্গ আমার খুব ভালো বন্ধু। প্রাণের বন্ধু। তোমার নানা যেরকম আমার প্রাণের বন্ধু ছিলেন সেরকম। বন্ধুর কাছে সব রকম আবদার করা যায়, কিন্তু বন্ধুকে কখনো মজুরি দিতে হয় না। সেইটা খুব লজ্জা–”

“ও আচ্ছা!” রাশা একটু লজ্জা পেয়ে যায়, “আমি আসলে বুঝতে পারি নাই। আপনারা একসাথে যুদ্ধ করেছিলেন?”

“হ্যাঁ। আমি, তোমার নানা, গৌরাঙ্গ আমরা সব একসাথে যুদ্ধ করেছিলাম। এখন একজন শিক্ষিত মানুষ আর নৌকার মিস্ত্রি বন্ধু হতে পারবে না। যুদ্ধের সময় হয়েছিল। স্কুলের মাস্টার আর কুলি, ইউনিভার্সিটির ছাত্র আর পকেটমার সব একজন আরেকজনের বন্ধু ছিল। বুঝেছ?”

“জি বুঝেছি।”

“যাও তাহলে। তোমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।”

রাশা উঠে দাঁড়াল, বলল, “নানা।”

“বলো।”

“আমার নানিকে আমি নানার কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না, জিজ্ঞেস করলেই নানি জানি কেমন হয়ে যান। আপনি কি কোনো একদিন আমাকে একটু বলবেন কী হয়েছিল?”

সালাম নানা কিছুক্ষণ রাশার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “বলব? নিশ্চয় বলব।”

.

সালাম নানার বন্ধু গৌরাঙ্গ ঘরামি দেখতে যেরকম হবে বলে রাশা ভেবেছিল দেখা গেল মানুষটা দেখতে ঠিক সেরকম। হালকা-পাতলা, শুকনো, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মুখে বয়সের চিহ্ন কিন্তু চোখ দুটি সজীব, একেবারে বাচ্চাদের মতো। সালাম নানা আর গৌরাঙ্গ দুজন পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ গল্প করলেন, পুরানো বন্ধুদের খোঁজ নিলেন। অনেকে মারা গিয়েছে তাদের কথা বলে নিশ্বাস ফেললেন, যারা বেঁচে আছে তারা কে কেমন আছে সেটা নিয়ে গল্প করলেন। নানি বাড়ির ভেতর থেকে চা বানিয়ে পাঠালেন। সালাম নানা আর গৌরাঙ্গ বসে বসে চা খেলেন, তারপরে গৌরাঙ্গ ঘরামি কাজ শুরু করলেন।

রাশা মুগ্ধ হয়ে তার হাতের কাজ দেখতে লাগল। সালাম নানা আগেই কাঠগুলো মাপমতো কেটে রেখেছিলেন, গৌরাঙ্গ ঘরামি সেগুলো ব্ল্যাদা দিয়ে একটু সমান করে নিলেন। তারপর মাপজোখ করে কেটে সাইজ করলেন। কানের ওপর একটা ছোট পেন্সিল গুঁজে রাখা আছে সেটা দিয়ে কাঠের ওপর লাইন টানলেন, করাত দিয়ে সেই লাইন ধরে কাটলেন। তারপর কাঠগুলো ঠুকে ঠুকে একটার সাথে আরেকটা লাগালেন, রাশা খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারল না নৌকার কোন অংশটা তৈরি হচ্ছে।

দুপুরে নানি খাবারের আয়োজন করেছিলেন, সবাই বসে তখন খেয়ে নিল। রাশা ভেবেছিল গৌরাঙ্গ ঘরামি এত পরিশ্রম করেছেন নিশ্চয়ই ভালো করে খাবেন, কিন্তু আসলে বলতে গেলে কিছুই খেলেন না। এত কম খেয়ে মানুষ কেমন করে এত কাজ করে কে জানে। খেয়ে একটুও বিশ্রাম না নিয়ে আবার কাজ শুরু করলেন। সালাম নানা আর গৌরাঙ্গ ঘরামি দুজন এত বন্ধু, সারাক্ষণই এটা-ওটা নিয়ে গল্প করছেন কিন্তু মজার ব্যাপার হলো গৌরাঙ্গ ঘরামি যখন কাজ শুরু করেন তখন একটা কথাও বলেন না, মুখ যেন সেলাই করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

বিকেলবেলা রাশা একটু একটু করে নৌকার আকারটা ধরতে পারল, দুই পাশের দুটি অংশ তৈরি করা হয়েছে। মাপজোখ করে গৌরাঙ্গ চাচা সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হলো, তখন দুই পাশের দুই অংশ একত্রে জুড়ে দিলেন, নৌকার মতো হলো সত্যি কিন্তু অত্যন্ত সরু একটা নৌকা! এত সরু নৌকায় তারা কেমন করে বসবে? কিন্তু রাশা কিছু জিজ্ঞেস করল না। ব্যাপারটা মনে হয় ছবি আঁকার মতো, ছবি আঁকার মাঝামাঝি সময়ে ছবির মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু যখন শেষ হয়ে আসে তখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায়।

রাশার ধারণী সত্যি! নৌকার দুই পাশের দুটি অংশ জোড়া দেয়ার পর গৌরাঙ্গ ঘরামি সেটা উল্টো করলেন, তারপর বাঁশের টুকরো দিয়ে সেটাকে ফাঁক করে মাঝখানে এক টুকরো কাঠের পাটাতন লাগালেন, তখন হঠাৎ করে রাশার কাছে পুরো নৌকাটার আকার স্পষ্ট হয়ে গেল! সে হাততালি দিয়ে বলল, “কী সুন্দর!”

গৌরাঙ্গ ঘরামি রাশার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, কিছু বললেন না। পাটাতনের কাঠগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। রাশার নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না যখন দেখল সত্যি সত্যি সন্ধের আগে পুরো নৌকাটা তৈরি হয়ে গেছে! কী সুন্দর একটা নৌকা, দেখে মনে হয় একজন আর্টিস্ট একটা ভাস্কর্য তৈরি করেছে।

সালাম নানা এমন ভান করতে লাগলেন যেন গৌরাঙ্গ ঘরামি না, সালাম নানাই নৌকাটা তৈরি করেছেন। বুকে থাবা দিয়ে বললেন, “আমি তোমাদের বলেছিলাম না আমার বন্ধু একদিনে একটা নৌকা বানাতে পারে! বলেছিলাম কিনা?”

রাশা বলল, “আপনি বলেছিলেন না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নাই, আমি ভেবেছিলাম আপনার বন্ধু তো সেই জন্যে আপনি বাড়িয়েচাড়িয়ে বলেছিলেন।”

“আমি মোটেই বাড়িয়েচাড়িয়ে বলি নাই! আমার বন্ধু একদিনে একটা নৌকা বানাতে পারে, একমাস সময় দিলে একটা জাহাজ বানিয়ে ফেলতে পারবে! তাই না রে গৌরাঙ্গ?”

গৌরাঙ্গ ঘরামি খুক খুক করে হাসল, বলল, “তারপরে তুমি বলবা তিন মাসে একটা উড়োজাহাজ বানাতে পারবে!”

“পারবেই তো। তোমাকে উড়োজাহাজ বানাতে শেখালে তুমি উড়োজাহাজও বানাতে পারতে!”

“ভালো হয়েছে কেউ শিখায় নাই, তাহলে এই নৌকা আর তৈরি হতো না।

রাশা বলল, “গৌরাঙ্গ নানা, থ্যাংকু। আপনাকে অনেক থ্যাংকু।”

গৌরাঙ্গ ঘরামি বললেন, “এখনই থ্যাংকু দিও না সোনা। নৌকাটা মা তৈরি হয়েছে, আসল কাজই বাকি আছে।”

“আসল কাজ কী?”

“ফুটোফাটা বন্ধ করতে হবে, আলকাতরা মারতে হবে সেই আলকাতরা শুকাতে হবে তারপর তুমি নৌকা পানিতে নামাবে।”

রাশা নৌকাটার মসৃণ গায়ে হাত দিয়ে বলল, “এখন নৌকাটার কী সুন্দর রং! আলকাতরা দিলে তো কালো হয়ে যাবে!”

“সেই কালো রং আরো সুন্দর হবে দেখো! কুচকুচে কালো পানকৌড়ির মতো। কালো রং খারাপ কে বলেছে? তোমার সালাম নানাকে জিজ্ঞেস করে দেখো

“কী জিজ্ঞেস করব?”

“তার চুল যে পেকে সাদা হয়েছে সে জন্যে খুশি হয়েছে নাকি যখন কালো ছিল তখন খুশি ছিল?”

রাশা হি হি করে হাসল এবং অন্য সবাই সেই হাসিতে যোগ দিল।

গৌরাঙ্গ ঘরামি তার যন্ত্রপাতি একটা ব্যাগে ভরে বলল, “আজকে এই পর্যন্তই। কালকে আলো হলে, আলকাতরা মারব।”

নানি রাতের বেলাতেও খেয়ে যেতে বলেছিলেন, সালাম নানা রাজি হলেন না। গৌরাঙ্গ ঘরামি তার বাড়িতে খাবে, রাত কাটাবে, দুজনের নাকি অনেক গল্প বাকি আছে।

রাশা দেখল সালাম নানা তার ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, গৌরাঙ্গ ঘরামি তার ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে হাঁটছে। সালাম নানা কী একটা বললেন তখন দুজনেই একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসতে লাগলেন, একজন আরেকজনের পেটে গুতো মারতে লাগলেন–যেন দুটি বাচ্চা মানুষ।

.

পরের দিন সকালবেলাই সালাম নানা তার বন্ধু গৌরাঙ্গ ঘরামিকে নিয়ে চলে এলেন। রাশা, জয়নব, জিতু মিয়া, মতি আরো বাচ্চা-কাচ্চা আগে থেকেই বসে আছে–কখন নৌকাটা শেষ হবে, কখন সেটাকে পানিতে নামানো হবে। গৌরাঙ্গ ঘরামি নৌকাটাকে সোজা করে তার ফুটোফাটাগুলো বুজিয়ে দিতে লাগলেন। নৌকা বানানোর সময় গৌরাঙ্গ ঘরামি একটা কথাও বলেননি, আজকে সেরকম না। কাজ করতে করতে কথা বলছেন, মাঝে মাঝে কাজ থামিয়েও কথা বলছেন। রাশা তাই একসময় বলল, “যুদ্ধের একটা গল্প বলেন না, নানা।”

তখন দুজনেই কথা থামিয়ে রাশার দিকে তাকালেন, সালাম নানা বললেন, “যুদ্ধের গল্প শুনতে চাও?”

“জি নানা।”

জিতু হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফাটাফাটি গল্প!”

সালাম নানা গৌরাঙ্গ ঘরামির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোনটা বলি গৌরাঙ্গ?”

“ঐ যে তুমি আর আমি বাঘাই নদীতে অ্যামবুশ করলাম সেইটা বলো।”

সালাম নানা মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, এই গল্পটা খারাপ না! শোনো তাহলে!”

সালাম নানা খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর শুরু করলেন, “এইটা হচ্ছে যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন আমরা যুদ্ধের য’ও জানি না। বলতে পারো রাইফেল কোনদিক সোজা কোনদিক উল্টা সেইটাও জানি না। গ্রেনেড কী খাওয়ার জিনিস নাকি ছুঁড়ে মারার জিনিস সেইটা পর্যন্ত জানি না। যাই হোক আস্তে আস্তে ধাক্কা খেয়েটয়ে আমরা একটু একটু যুদ্ধ করতে শিখেছি। দেখি পাকিস্তানি মিলিটারির গুলিতে যেরকম আমরা মরি ঠিক সেরকম আমাদের গুলি কোনোমতে তাদের গায়ে লাগাতে পারলে তারাও মরে। তাহলে আর ভয়টা কী? তাদের সাইজ বড় তাদের কাছে হাজার রকম অস্ত্রপাতি, তাদের জামা-জুতো ভালো, আমরা পিচ্চি পিচ্চি প্রায় বাচ্চাকাচ্চা মানুষ, অস্ত্রপাতি কম, জামা-জুতোর তো প্রশ্নই নাই। বেশিরভাগ লুঙ্গি পরে থাকে খালি পা! কিন্তু সমস্যা তো নাই, সুযোগ বুঝে খালি গুলি করা। দেশটা আমার, দেশের মানুষও আমাদের-তারা বাইরের মানুষ কোথায় গিয়ে লুকাবে?”

“আস্তে আস্তে আমাদের সাহস গেল বেড়ে। খোঁজখবর রাখি কোথাও যাচ্ছে–আসছে, খবর পেলেই অ্যামিবুশ করি। যখন বর্ষা নেমেছে তখন একটু সমস্যা! ঝড়ের বেগে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারি না। নৌকা করে যেতে হয়। পাকিস্তানি মিলিটারিদেরও সমস্যা, তারাও যেতে পারে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, পানির মাঝে বড় হয়েছি, পানি দেখে ভয় পাই না। ঐ ব্যাটারা পানি দেখে ভয়ে কাঁপে, সাঁতার জানে না হাঁটুপানিতেই ডুবে মরে এমন অবস্থা!”

“যাই হোক, আমরা তখন এই এলাকাটাতে এসেছি, আশেপাশে কয়েকটা বড় অপারেশন করেছি। দুইটা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছি। রাস্তায় মিলিটারির একটা জিপ উড়িয়ে দিয়েছি। মিলিটারিরা তখন মনে হলো আমাদের শায়েস্তা করবে। হেড কোয়ার্টার থেকে প্রায় দুইশ পাঞ্জাবি মিলিটারি এসেছে। তারা নদীর ঐ পারে আমরা নদীর এই পারে।”

“এর আগে আমরা কখনোই মিলিটারিদের সামনাসামনি আমাদের আক্রমণ করতে দেই নাই। আমরা সবসময় লুকিয়ে তাদের অ্যামবুশ করেছি। এইবার আমরা ভাবলাম সামনাসামনি একটু যুদ্ধ করি। আমরা নদীর পাড়ে বাংকার করে বসে থাকব তারা যদি আমাদের আক্রমণ করতে চায় নদী পার হয়ে আসতে হবে, নদী পার হবার সময় আমরা তাদের ছ্যাড়াব্যাড়া করে দেব। আমরা তাই নদীর পাড়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকলাম। নদীর ঐ পারেও আমাদের লোক আছে তারা খোঁজখবর দিচ্ছে। সকালবেলা খোঁজ পেলাম তারা অনেক রকম অস্ত্রপাতি নিয়ে রওনা দিয়েছে।”

“আমরা অপেক্ষা করছি, কখন তারা আসবে, নদী পার হবে কিন্তু তারা তো আর আসে না। তখন হঠাৎ একজন স্কাউট দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হলো, এসে বলল, মিলিটারিরা দুই ভাগে ভাগ হয়েছে, একভাগ নদীর এই পারে অন্যভাগ নদীর ঐ পারে। তারপর তারা নদীর তীর ধরে আসছে। বদমাইশের বাচ্চাগুলি নদী পার হয়েছে ঠিকই কিন্তু অনেক উজানে যেখানে আমরা আশেপাশে নাই! ব্যাটারা হচ্ছে প্রফেশনাল, যুদ্ধের বইপত্র পড়েছে, সেখানে নিশ্চয়ই কোথায় নদী পার হতে হয়, কেমন করে নদী পার হতে হয়–এইসব শেখায়। আমরা তো আর সেইসব জানি না!”

“যাই হোক, স্কাউটের মুখে খবর পেয়ে আমাদের আক্কেল গুড়ুম। আমাদের কমান্ডার হচ্ছেন রাশার নানা, আজিজ মাস্টার, আমরা আজিজ ভাই ডাকি। আজিজ ভাই খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, একটু সময় চিন্তা করে বললেন, আমাদের বিশ-পঁচিশজন মুক্তিযোদ্ধা কয়েকশ পাকিস্তানি মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করতে পারব না। সবাই মারা পড়ব। তাই তার চেষ্টাও করব না, কাজেই এক্ষুণি সরে পড়তে হবে। যদি সরে পড়তে পারি ভালো। যদি দেখি পারছি না তাহলে কয়েকজনের একটা ছোট দল লাইট মেশিনগান নিয়ে রাস্তার পাশে বসে যাবে, পাকিস্তানিদের আটকে রাখবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সবাই সরে পড়তে পারছে।”

“এইটুকু বলে আজিজ ভাই থামলেন, তারপর বললেন, আমার দুইজন ভলান্টিয়ার দরকার। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? আজিজ ভাই বললেন, ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দিতে চাই। আমি বললাম, কী শিক্ষা? আজিজ ভাই বললেন, তারা নদী পার হয়ে এই পারে এসেছে না? আবার তো ঐ পারে যেতে হবে। যখন ঐ পারে যাবে তখন নৌকাগুলি ডুবিয়ে দিতে হবে। তাই দুজনকে ঐ কচুরিপানায় লুকিয়ে থাকতে হবে! অস্ত্রসহ।”

রাশা এই সময়ে জিজ্ঞেস করল, “পানিতে ডুবে গেলে অস্ত্র নষ্ট হয়ে যাবে না?”

“না। বেশিদিন ডুবিয়ে রাখলে জং ধরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ব্যারেলে কাদা ঢুকলেও সমস্যা! এমনিতে পানিতে ভিজে গেলে, কিছুক্ষণ ডুবে থাকলে কোনো সমস্যা নাই। যাই হোক আমি আর গৌরাঙ্গ, আমরা দুইজন বললাম, আমরা থাকব। দুইটা রাইফেল নিয়ে আমরা কচুরিপানায় লুকিয়ে থাকলাম, অন্যেরা চলে গেল।”

“কিছুক্ষণের ভেতর শুনতে পাই নদীর দুই পার দিয়ে মিলিটারি যাচ্ছে। ব্যাটাদের জানের ভয় আছে, এদিক-সেদিক তাকায়, আস্তে আস্তে হাঁটে, ফাঁকা গুলি করে। কচুরিপানার দিকেও একঝাঁক গুলি করল, কপাল ভালো আমরা বেঁচে গেলাম।”

“যাই হোক আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে শুধু নাকটা ভাসিয়ে বসে আছি, টের পাচ্ছি শরীরে. জেঁক ধরেছে। ব্যাটাদের মনে হলো ঈদ, এরকম ফ্রেশ রক্ত কতদিন খায় নাই! রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে নিজেরাই খসে পড়ছে। কান খাড়া রেখে শোনার চেষ্টা করি কোনো বড় ধরনের গোলাগুলির শব্দ শোনা যায় নাকি, শোনা গেল না। তার মানে সবাই নিরাপদে সরে পড়তে পেরেছে। আজিজ ভাই বুদ্ধি করে ছোট একটা খাল পার হয়ে গেছে, খালের উপর বাঁশের সাঁকো গুলি করে ভেঙে দিয়ে গেছে, নৌকাগুলো ডুবিয়ে দিয়ে গেছে–তাই এত সহজে পিছু নিতে পারে নাই।”

“যাই হোক বিকেলের দিকে টের পেলাম মিলিটারিগুলো ফিরে আসছে, ব্যাটাদের মনে খুব ফুর্তি। তাদের ধারণা তারা সব মুক্তিবাহিনীকে ভাগিয়ে দিয়ে এসেছে। আমরা কচুরিপানায় ডুবে থেকে শুনতে পাচ্ছি শালা মুক্তি বলে একেবারে যা তা ভাষায় গালাগাল করছে। আমাদের সাহস নাই, যুদ্ধ করার ক্ষমতা নাই, আমরা ইন্ডিয়ার দালাল এই রকম আজেবাজে কথা। শুনে আমাদের আরো রাগ চেপে গেল, আজকে ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দিতেই হবে। আমাদের সাহস আছে কি নেই সেইটা আজকে তাদের জন্মের মতো বুঝিয়ে দেব।”

“ওরা যখন নদী পার হয়েছিল তখন সেটা তারা করেছিল খুব সাবধানে, যেখানে আমরা নাই সেইখানে। এখন তারা ধরেই নিয়েছে আমরা কোথাও নাই, তাই তাদের ভয়েরও কিছু নাই। তারা যেভাবে খুশি যেখানে খুশি নদী পার হতে পারবে। তাই তারা ঠিক করল তারা এখন কাছাকাছি এখান দিয়েই নদী পার হয়ে যাবে। হাঁকডাক দিয়ে নৌকা জড়ো করে বদমাইশগুলি নদী পার হতে শুরু করল। আমরা বুঝতে পারলাম এইটাই সুযোগ।”

“আমরা তাদের শান্তিমতো নদী পার হতে দিলাম। যতক্ষণ এই পারে পাকিস্তানি মিলিটারি থাকল আমরা কিছু করলাম না। যখন শেষ মিলিটারিটাও নৌকায় উঠে রওনা দিল আমরা মাথার মাঝে কচুরিপানা লাগিয়ে ভেসে ভেসে কাছাকাছি এলাম। আমি আর গৌরাঙ্গ দুই দিকে সরে গেলাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ঠিক মাঝনদীতে পৌঁছায়। যখন পৌঁছল, তখন আমরা দুইজন দুই দিক থেকে গুলি করতে শুরু করলাম।” ব্যাস। মজা শুরু হয়ে গেল। গুলি শব্দ শুনেই বাঙালি মাঝিরা নৌকা ফেলে পানিতে লাফ দিয়েছে। সাথে সাথে নৌকা চক্কর খেতে শুরু করেছে। গাদাদাদি করে মিলিটারি উঠেছিল, সেগুলো নৌকার ওপর লাফঝাঁপ দিতে লাগল, কেউ কেউ আমাদের গুলি করার চেষ্টা করল। নৌকা গেল কাত হয়ে, কিছু বোঝার আগেই মিলিটারিগুলো পানিতে হাবুডুবু খেতে লাগল, একটাও সাঁতার জানে না, সবগুলি মার্বেলের মতো ডুবে যেতে লাগল।

নদীর জন্য অন্য পারে মিলিটারিগুলি পজিশন নিয়ে গুলি করার চেষ্টা কলল, আমার রেঞ্জের বাইরে, মাথায় কচুরিপানা নিয়ে যেভাবে ভেসে উঠেছিলাম আবার ডুবে গেছি, আমার পাবে কোথায়? পানির নিচে ডুবসাঁতার দিয়ে সরে গেছি, নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দেখি নদীতে যে কয়টা নৌকা ছিল তার নোনোটার চিহ্ন নাই, একটা শুধু উল্টো হয়ে ভেসে যাচ্ছে। দুইটা পাকিস্তানি মিলিটারি কোনোমতে সেটা ধরে ভেসে থেকে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে। আমরা ইচ্ছা করলে ঐ দুটোকে শেষ করে দিতে পারতাম, কিন্তু কেন জানি মায়া হলে। জান বাঁচাবার জন্যে যখন কেউ চিৎকার করে তখন। তারে মারা যায় না। আমারা ঐ দুইটাকে ছেড়ে দিলাম।

জিতু জিজ্ঞেস করল, কয়টা পাকিস্তানি মরেছিল, নানা?

সঠিক সংখ্যা তো জানি না–তিনটা নৌকা, বিশ থেকে ত্রিশজন তো হবেই।

গৌরাঙ্গ ঘরামি মাথা নেড়ে বললেন, “আরো বেশি হবে। বড় বড় নৌকা ছিল, অনেকগুলি করে উঠেছিল, মনে নাই?”

জিতু হাতে কিল দিয়ে বলল, “উচিত শিক্ষা হয়েছে। জন্মের শিক্ষা হয়েছে।”

সালাম নানা মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ। তাদের খুব বড় একটা শিক্ষা হয়েছিল। কিন্তু—”

সালাম নানা কথা বলতে শুরু করে থেমে গেলেন, রাশা জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”

সালাম নানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “দুইদিন পরে আরো অনেক মিলিটারি এসে আশেপাশের সব গ্রাম জ্বালিয়ে মানুষ মেরে একবারে ভয়ঙ্কর অবস্থা করেছিল। বুঝলি জিতু তাই বলছিলাম যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। আমাদের কোনো উপায় ছিল না, তাই যুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু এই দেশের মানুষের যেন আর কোনোদিন যুদ্ধ করতে না হয়। কোনোদিন না! বুঝেছিস?”

জিতু মাথা নাড়ল, তার সাথে অন্যেরাও।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল