০৬. প্রথম শাস্তি

অনেক দিন পর রাশা তার সুটকেসটা খুলল, আসার সময় সে তার দরকারি জিনিসপত্রগুলো এই স্যুটকেসে করে এনেছে। তার মনে ছিল শেষ মুহূর্তে সে তার কিছু পাঠ্যবই স্যুটকেসটাতে ঢুকিয়েছিল। আজ স্যুটকেসটা খুলে সে সেগুলো বের করল। সবগুলো বই নেই, সেগুলো এখান থেকে কিনে নিতে হবে। অনেক খুঁজে দুটো খাতাও সে পেয়ে গেল, কালকে স্কুলে যাওয়ার মতো জোগাড়যন্ত্র আছে।

রাশা বিছানায় তার বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুলে খুলে দেখছিল, তখন নানি পাশে এসে বসলেন। বললেন, “তোর লেখাপড়ার জন্যে একটা চেয়ার টেবিল লাগবে, তাই না?”

“সেগুলো ধীরে ধীরে করলেই হবে নানি। বিদ্যাসাগর ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়তেন–আমার তো তবু নিজের কুপি বাতি আছে।”

“তোর অনেক কষ্ট হচ্ছে, তাই না?”

“নানি, আমি তোমার কাছে মিথ্যা কথা বলব না, আসলেই অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি জীবনেও কখনো এত দূর হেঁটে যাইনি। পা ব্যথা হয়ে গেছে।”

“দেখি তোর পাগুলো বের করো। টিপে দিই-”

রাশা হি হি করে হাসল, বলল, “নানি তুমি যে কী বলো! তুমি আমার পা টিপে দিবে কেন? তার চেয়ে তুমি আমার পিঠ চাপড়ে বলো, সাবাশ মেয়ে সাবাশ!”

নানি পিঠ চাপড়ে বললেন, “সাবাশ মেয়ে সাবাশ!”

তারপর বলো, “তুমি আমার যোগ্য নাতনি! তুমি নিজে নিজে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছ।”

নানি বললেন, “তুমি আমার যোগ্য নাতনি! তুমি নিজে নিজে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছ।”

“এখন আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে আমার কপালে একটা চুমা দেও।”

নানি তার পিঠ চাপড়ে কপালে মাথায় গালে ঘাড়ে অনেকগুলো চুমো দিলেন।

রাশা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “নানি, তুমি শুধু কোনোদিন আমাকে আমার স্কুলের নাম জিজ্ঞেস করো না। ঠিক আছে?”

“কেন?”

“এই স্কুলটার নাম একটা রাজাকারের নামে দেয়া হয়েছে। আমি আমার মুখে কোনোদিন রাজাকারের নাম উচ্চারণ করব না।”

নানি রাশার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কোনো কথা বললেন না। রাশা বলল, “আমার নানা এত বড় একটা মুক্তিযোদ্ধা আর আমি রাজাকারের নামে দেয়া একটা স্কুলে পড়ব, এটা তো হতে পারে না। এই নামটা বদলাতে হবে।”

“কিভাবে বদলাবি?”।

“আমি জানি না। তারপর নানির দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে নাই তুমি আমাকে একটা মাদুলি দিয়েছ, বলেছ পাকসাফ হয়ে এই মাদুলি হাতে নিয়ে যা চাওয়া যায় সেটাই পাওয়া যায়?”

“হ্যাঁ বলেছি।”

“আমি সেটাই চাইব।”

“ঠিক আছে।”

রাশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “নানি।”

“কী হলো?”

“আমার আম্মু কোনোদিন নানার কথা কিছু বলে নাই। আমি আসলে কিছুই জানি না। তুমি আমাকে একদিন বলবে?”

নানি রাশার দিকে তাকালেন, রাশা দেখল নানির দৃষ্টিটা দেখতে দেখতে কেমন যেন উভ্রান্তের মতো হয়ে গেল। তার হাত অল্প অল্প কাঁপতে শুরু করল, নানি ফিসফিস করে বললেন, “সোনা আমার, আমাকে জিজ্ঞেস করিস না। ওই দিনগুলোর কথা মনে হলেই আমার মাথার ভিতর সব ওলটপালট হয়ে যায়। আমি আর কিছু করতে পারি না।”

রাশা অবাক হয়ে দেখল, নানির সবকিছু সত্যি সত্যি যেন ওলটপালট হয়ে গেল, কেমন যেন দিশেহারা হয়ে বসে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। রাশা ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সরি নানি, সরি! আমি আসলে বুঝতে পারি নাই। আমি আর কোনোদিন জিজ্ঞেস করব না নানি। কোনোদিন জিজ্ঞেস করব না! খোদার কসম নানি কোনোদিন জিজ্ঞেস করব না।”

.

রাশা বইয়ের লিস্টটা বের করে বইয়ের দোকানের মানুষটার হাতে দিয়ে বলল, “আপনার কাছে এই বইগুলি আছে?”

মানুষটা লিস্টটা দেখে বলল, “আছে।”

 “আমাকে দিবেন।”

মানুষটা তাক থেকে বইগুলি এবং সাথে আরো কিছু বই নামাল তারপর সেগুলো রাশার দিকে ঠেলে দিল। রাশা বোর্ডের বইগুলো আলাদা করে অন্য বইগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওগুলো কী?

“গাইড বই।”

“আমার গাইড বই লাগবে না।”

মানুষটা রাশার হাত থেকে বোর্ডের বইগুলো নিয়ে গাইড বইসহ সবগুলো বই আবার তাকে রেখে দিল। রাশা অবাক হয়ে বলল, “কী হলো?”

“গাইড বই ছাড়া আমরা বোর্ডের বই বিক্রি করি না।”

“সেটা আবার কী রকম কথা? আমার যেটা ইচ্ছা সেটা কিনব।”

মানুষটা বলল, “বোর্ডের বই বেঁচে আর কয় পয়সা পাওয়া যায়? আমাদের লাভ আসে গাইড বই বেচে। তুমি গাইড বইসহ কিনলে কিনো। ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দিব।”

রাশা বলল, “কোনোদিনও আমি গাইড বই কিনব না।”

“তাহলে তোমার পাঠ্যবই কেনা হবে না। গাইড বই ছাড়া এই দেশে কেউ পাঠ্যবই বিক্রি করে না।”

“কে বলেছে?”

জয়নব রাশার কনুই ধরে ফিসফিস করে বলল, “সত্যি কথা।”

“সত্যি কথা?”

“হ্যাঁ। আমাদের সবার গাইড বই কিনতে হয়েছে।”

রাশা কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, “ঠিক আছে দেন।”

মানুষটা আবার বইগুলো নামিয়ে দিল। রাশা জিজ্ঞেস করল, “কত?”

মানুষটা একটা কাগজে হিসেব করে দাম বলল, রাশা তার ব্যাগ থেকে টাকা বের করে মানুষটার হাতে দিয়ে বলল, “আপনার কাছে একটা কঁচি আছে?”

“কাচি?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“একটু কাজ আছে।”

মানুষটা ডেস্কের নিচে খুঁজে একটা বড় কাঁচি বের করে দিল। রাশা তখন তার গাইড বইগুলো নিয়ে তার পৃষ্ঠাগুলো কাঁচি দিয়ে কাটতে শুরু করে। মানুষটা হা হা করে উঠল, বলল, “কী করছ? কী করছ?”

“পৃষ্ঠাগুলি কাটছি।”

“কেন?”

“ছোট ছোট টুকরো করব। ঐ যে মোড়ে চানাচুরওয়ালা আছে তাকে দিব। সে এইগুলিতে করে চানাচুর দেবে।”

“তু-তুমি টাকা দিয়ে বই কিনে সেগুলো নষ্ট করছ?”

“আমি মোটেও নষ্ট করছি না। আমি কাজে লাগাচ্ছি। গাইড বই কাজে লাগানোর এটা হচ্ছে উপায়!”

মানুষটা কেমন যেন অস্থির হয়ে যায়, “তুমি যখন নষ্টই করছ আমাকে দিয়ে দাও!”

“আমি মোটেও নষ্ট করছি না। আমি কাজে লাগাচ্ছি। আপনি যদি কোনো ছাত্র না হয় ছাত্রীর কাছে এই গাইড বই বিক্রি করেন সেটা হচ্ছে নষ্ট করা।”

রশি যত্ন করে সবগুলো পৃষ্ঠা কেটে ছোট ছোট টুকরো করল। বইয়ের দোকানের মানুষটা হাঁ করে রাশার দিকে তাকিয়ে রইল, আর রাশা কাগজের টুকরোগুলো হাতে নিয়ে মোড়ের চানাচুরওয়ালাকে দিয়ে দিল। চানাচুরওয়ালা অবাক হয়ে বলল, “এগুলো কী?”

রাশা বলল, “আপনি যখন চানাচুর বিক্রি করবেন তখন এই কাগজে করে দেবেন।”

চানাচুরওয়ালাকে কেমন জানি একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, তার কাগজের একটা মাপ আছে, এই কাগজগুলো মাপমতো হয়নি, একটু বড় হয়েছে। সে এগুলো দিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাশ জয়নবের হাত ধরে তাড়াতাড়ি চলে আসে, চানাচুরওয়ালা যদি কাগজগুলো ফেলেও দেয় তবু মনে হয় সেটা কাজে লাগবে।

.

স্কুলে গণিত ক্লাসে কালোমতন টাকমাথাওয়ালা স্যার আজকেও কয়েকটা অংক তার নোটবই থেকে বোর্ডে টুকে দিলেন। আজকেও ইংরেজি ক্লাসে কোনো স্যার এলেন না, তখন গাজী দুটি গান শোনাল, তারপর মতিন নামে একটা ছেলে ক্যারিক্যাচার করে দেখাল। ছেলেমানুষি কেরিক্যাচার, রাশা তারপরেও জোর করে হাসার ভান করল। বিজ্ঞান ক্লাসে আবার রাজ্জাক স্যার হাতে বেত নিয়ে ঢুকলেন। বেতটা টেবিলে রেখে স্যার ক্লাসের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কয়েকবার হেঁটে ক্লাসের সামনে এসে থামলেন, তারপর ক্লাসের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, “আজকে আমি তোদের কয়েকটা কথা বলব, তোরা মন দিয়ে শুনবি।

সারা ক্লাস নড়েচড়ে বসে। রাজ্জাক স্যার বললেন, “আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন স্যারদের আমরা আলাদাভাবে সম্মান করতাম। যেখানেই স্যারদের সাথে দেখা হতো আমরা গিয়ে সালাম দিতাম। যদি দেখতাম স্যারেরা বাজারের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন আমরা স্যারের বাসায় সেই ব্যাগ পৌঁছে দিতাম। আর এখন?”

রাজ্জাক স্যার চোখ পাকিয়ে তাকালেন, “সেইদিন একটা ছাত্র আমাকে দেখে সালাম দেয়া তো দূরের কথা, না দেখার ভান করে সুট করে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। সে কী ভেবেছে আমি তাকে দেখি নাই? ঠিকই দেখেছি, আমি একদিন চাবুকে তার ছাল তুলে দেব।”

স্যার গম্ভীর হয়ে বললেন, “এই দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এই দেশ কোনো ভালো মানুষের জন্ম দেয় না। শুধু চোর-ছ্যাচড়ের জন্ম দেয়। এই দেশ শিক্ষকের মর্যাদা দেয় না। শিক্ষকের বেতন এত কম যে সংসার চলে না। তারপরেও আমি শিক্ষক হয়েছি। বুঝেছিস? শত শত চোর-উঁচড় বের করার মাঝে যদি একজনও ভালো মানুষ তৈরি করতে পারি তাহলে মনে করব শিক্ষকের জীবন সার্থক হয়েছে। বুঝেছিস?”

ছাত্রছাত্রীরা কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল। স্যার বললেন, “একটা সাবজেক্ট ভালো করে পড়াতে অনেক সময় লাগে, আমাদের কি কেউ সেই সময় দেয়? দেয় না। সেই জন্যে ক্লাসে পড়া শেষ করতে পারি না। অন্য মাস্টারেরা হাল ছেড়ে দেয়, আমি দিই না। আমি আমার বাসায় পড়াই। যারা আমার বাসায় প্রাইভেট পড়ে তারা সবাই ভালো রেজাল্ট করে। আমি গত তিন-চার বছরের বোর্ডের প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা করে সাজেশন দেই, সেই সাজেশন থেকে প্রশ্ন আসে। আমি ইচ্ছা করলে সেই সাজেশন লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারতাম, আমি করি না। খালি আমার ছাত্রছাত্রীদের দিই।”

স্যার ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কাজেই তোরা যারা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে চাস, ঠিকমতন লেখাপড়া করে মানুষ হতে চাস তারা স্কুলের পরে আমার বাসায় পড়তে আসবি। মনে থাকবে?”

ক্লাসের সবাই কলের পুতালের মতো মাথা নাড়ল। স্যার বললেন, “আর যারা আসবি না, আমি ধরে নিব তাদের লেখাপড়ায় উৎসাই নাই। তাদের জন্যে আমার কোনো মায়াদয়া নাই। বুঝলি?” সবাই মাথা নেড়ে জানাল তারা বুঝেছে। রাজ্জাক স্যার তারপর পড়াতে শুরু করলেন, একজন একজন ছাত্রকে রিডিং পড়তে দিলেন। যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদের রিডিং পড়া শুনে বললেন, ভেরি গুড। যারা পড়ে না তাদের ভুল করে পড়ার জন্যে পেটাতে শুরু করলেন।

রাশা আগে কখনো কোনো স্যারকে পেটাতে দেখেনি, তাই সেই দৃশ্য দেখে তার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে, এই দৃশ্য তার পক্ষে দেখা সম্ভব না। কোনোভাবেই সম্ভব না।

পরের এক সপ্তাহ সময়টা রাশার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সপ্তাহ বলে ধরে নেয়া যায়। তার প্রথম কারণ তার আগের স্কুলের জাহানারা ম্যাডামের পাঠানো একটা প্যাকেট। ম্যাডাম টেলিফোনে বলেছিলেন স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্যে কাগজপত্রের দুটো অরিজিনাল কপি করে একটা স্কুলে আরেকটা তার নানির বাড়িতে পাঠাবেন। রাশা তাই সাদামাটা পাতলা একটা খামের জন্যে অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু যেটি এলো সেটি রীতিমতো একটা প্যাকেট। রেজিস্ট্রি করে পাঠানো হয়েছে তাই রাশাকে সাইন করে সেটা নিতে হলো আর পিয়নকে তার সাথে একটু বখশিশও দিতে হলো।

প্যাকেটের ভেতরে ভর্তির জন্যে দরকারি অরিজিনাল কাগজপত্র ছাড়াও রয়েছে দুটি বই আর আরেকটা চিঠি। জাহানারা ম্যাডাম চিঠিটা লিখেছেন, চিঠিটা পড়তে পড়তে কয়েকবার রাশার চোখে পানি এসে গেল। ম্যাডাম লিখেছেন :

প্রিয় রাশা,

আমি জীবনে খুব বেশি চিঠি লিখিনি, কিন্তু মনে হলো তোমাকে একটা চিঠি লিখি। চিঠিতে যে কথাগুলো লিখছি সেটা ইচ্ছে করলে টেলিফোনেও তোমাকে বলতে পারতাম, কিন্তু মনে হলো চিঠিতে লেখাটাই ভালো হবে। অনেক কথা আছে যেগুলো মুখে বলা যায় না, চিঠিতে লেখা যায়। আবার অনেক কথা আছে যেগুলো চিঠিতে লেখা যায় না, কিস্তু মুখে বলা যায়।

আমি অনেক দিন থেকে শিক্ষকতা করছি, আমার অনেক ছাত্রছাত্রী তাদের কেউ কেউ অনেক বড় হয়েছে। তুমি তাদের অনেকের মতোই একজন ছাত্রী ছিলে, আমি আলাদা করে তোমাকে কখনো দেখিনি। এখন দেখছি। তুমি প্রথম যেদিন বলেছিলে তোমার আম্মু তোমাকে ফেলে চলে যাবেন আমি তোমার কথা বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল। ছোট ছেলেমেয়েদের এসব বিষয়ে একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে। হঠাৎ করে তুমি যখন স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলে আর আমি খোঁজ নিয়েও তোমার খোঁজ পেলাম না তখন আমি তীব্র অপরাধবোধে ভুগেছি। আমার মনে হয়েছে তুমি আমার কাছে সাহায্যের জন্যে এসেছিলে, আমি তোমাকে সাহায্য করিনি।

তারপর হঠাৎ করে আমি যখন তোমার টেলিফোন পেলাম আমি ভয়ে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল তোমার মুখে আমি না জানি কী শুনব। তোমার মা গহীন কোনো এক গ্রামে তোমার নানির কাছে ফেলে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন–তোমার লেখাপড়া শেষ, তোমার জীবন শেষ, তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে এটা বলতে পারতে। এটা বললে খুব একটা মিথ্যা কথা বলা হতো না। কিন্তু তুমি আমাকে সেটা বলনি, তুমি আমাকে বলেছ যে তুমি একা–হ্যাঁ পুরোপুরি একা এই ভয়ংকর দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছ। গহীন এক গ্রামের অখ্যাত একটা স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করার প্রস্তুতি নিচ্ছ। আমি যদি তোমাকে স্যালুট না করি কাকে করব?

আমি যে স্কুলে শিক্ষকতা করি সেটা বাংলাদেশের খুব বিখ্যাত একটা স্কুল। প্রতিবছর ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে, পত্রপত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হয়। কিন্তু আমি জানি আমরা তাদের লেখাপড়া শিখাই না, আমরা তাদের ভালো নম্বর পাওয়া শিখাই। তাই তুমি যে এই খুব ভালো স্কুলে না পড়ে কোনো গহিন গ্রামের অখ্যাত একটা স্কুলে লেখাপড়া করছ সেটা কি আসলেই খুব ক্ষতি হলো? মনে হয় না, আমার ছাত্রছাত্রীরা সারাদিন স্কুল করে। স্কুলের পর বাকি সময়টা প্রাইভেট পড়ে আর কোচিং করে। এর চাইতে নিরানন্দ জীবন আর কী হতে পারে। তোমাকে অন্তত সেটা করতে হচ্ছে না, তুমি মনে হয় গাছ দেখতে পাচ্ছ, আকাশ দেখতে পাচ্ছ, ধানক্ষেত, নদী দেখতে পাচ্ছ। তুমি নিশ্চয়ই পূর্ণিমা দেখবে, জোছনার আলো দেখবে। আমরা বহুদিন সেগুলো দেখি না।

লেখাপড়াটা নিজের ওপর। আমি বিশবছর ধরে শিক্ষকতা করছি কিন্তু আমি জীবনে কখনো কাউকে কিছু শিখাইনি, আমার ছাত্রছাত্রীরা যা শিখেছে সব নিজে নিজে শিখেছে। আমি শুধু তাদের শিখতে উৎসাহ দিয়েছি। আমি তাই তোমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্যে এই চিঠিটা লিখছি। আমি তোমাকে তিনটি বই পাঠাচ্ছি। প্রথম বইটা গণিতের বই–ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করতে যাওয়ার আগে যেটুকু গণিত জানা দরকার এখানে তার পুরোটুকু আছে। তুমি এর চ্যাপ্টারগুলো পড়বে, উদাহরণগুলো দেখবে আর চ্যাপ্টারের শেষে অঙ্কগুলো করবে। যেদিন তুমি এই বইটা নিজে নিজে শেষ করবে–সেদিন তুমি নিজে তোমার পিঠ চাপড়ে বলবে, “রাশা! তুমি সত্যিকার জীবনে ঢোকার জন্যে প্রয়োজনীয় গণিত শিখে গেছ।” দুই নম্বর

বইটা ফিজিক্সের। ভূমিকাটা পড়লে বুঝবে এটা আসলে লেখা হয়েছে। কলেজের ছেলেমেয়েদের জন্যে কিন্তু আমি দেখেছি যে এটা আসলে যে কেউ পড়তে পারবে। তুমি যদি এই বইটা শেষ করতে পারো তাহলে আমি নিজে গিয়ে তোমার দুই গালে দুটি চুমো দিয়ে আসব। তোমার নিজের বিশাল একটা লাভ হবে, স্কুলের বিজ্ঞান নিয়ে তোমার জীবনে কোনোদিন কোনো সমস্যা হবে না।

তিন নম্বর বইটা ইংরেজি গল্পের সংকলন। পৃথিবীর সেরা লেখকদের লেখা গল্প এখানে আছে। এটা মোটেও তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ের বই না। কিন্তু আমার ধারণা তুমি এখন মোটেও তোরো-চৌদ্দ বছরের মেয়ে না। তুমি খুব অল্প সময়ে অনেক বড় হয়ে গেছ কে জানে হয়তো আমার থেকেও বড়। তোমার ইংরেজির চর্চাটা রাখা দরকার সে জন্যে এটা পাঠালাম।

আমি বহুদিন গ্রামে যাইনি, গ্রাম হয়তো আর আগের মতো নেই। গ্রামে নিশ্চয়ই এখন নোংরামো, কুসংস্কার, ধর্মের বিধি-নিষেধ এসব ঢুকে গেছে, তুমি খুব সাবধানে থাকবে। তোমার যদি কোনো সাহায্যের দরকার হয় যে কোনোরকম সাহায্য–তাহলে আমাকে জানাবে। আমার টেলিফোন নম্বরটা মুখস্থ করে রেখো, ঠিক আছে?

তোমার
জাহানারা ম্যাডাম

রাশা তার ম্যাডামের চিঠিটা পরপর তিনবার পড়ল তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে একটু কাদল–জ্বালা ধরানো হতাশার কান্না না! অন্য একরকম কান্না। তারপর সে বইগুলো দেখল, নীলক্ষেতের ফটোকপি করা ভুসভুসে বই না, বিদেশি বাধাইয়ের ঝকঝকে বই। বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় নতুন বইয়ের তাজা গন্ধটা পর্যন্ত আছে। কী সুন্দর পিছলে পিছলে পৃষ্ঠা, ঝকঝকে ছাপা, রঙিন ছবি, দেখলেই মনে হয় বইটা বুকে চেপে ধরে রাখি। রাশা অনেকক্ষণ বইগুলো নাড়াচাড়া করল, তার বই রাখার কোনো টেবিল বা সেলফ নেই, তাই সে বইগুলো রাখল তার বালিশের নিচে, সারাদিন যখনই সে একটু সময় পেল তখনই এসে বইগুলোতে একটু হাত বুলিয়ে গেল।

এই সপ্তাহটা রাশার জন্যে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সপ্তাহ হলো সম্পূর্ণ অন্য কারণে এই সপ্তাহে সে জীবনের প্রথম মার খেল। সে কখনো কল্পনা করেনি যে কেউ তার গায়ের ওপর হাত তুলবে কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটল। ঘটনাটা ঘটল এভাবে :

রাজ্জাক স্যারের ক্লাস, স্যার প্রত্যেকদিনের মতো হাতে বেত নিয়ে ঢুকেছেন। টেবিলের ওপর বেতটা রেখে প্রথমে খানিকক্ষণ বকবক করলেন, তারপরে একটু পড়ানোর ভঙ্গি করলেন। তারপর পড়া ধরার ভান করে ছেলেমেয়েদের পেটাতে শুরু করলেন। কোনো একটা কারণে আজকে স্যারের মেজাজটা বেশি খারাপ ছিল, আজকে পেটাতে লাগলেন অনেক বেশি হিংস্রভাবে। ক্লাসের মাঝামাঝি একটা ছেলে মার খেতে খেতে আর সহ্য করতে না পেরে হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল আর তার ফল হলো ভয়ানক। স্যার মনে হয় আরো খেপে গেলেন, ছেলেটার চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে বেঞ্চের ওপর ফেলে এমনভাবে মারতে লাগলেন যে দেখে মনে হতে লাগল বুঝি আজকে ছেলেটাকে মেরেই ফেলবেন।

রাশা আর সহ্য করতে পারল না, কী করছে না বুঝেই হঠাৎ সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিলের মতো চিৎকার করে বলল, “স্যার।”

মনে হলো ক্লাসের মাঝে বুঝি একটা বোমা পড়েছে, স্যার ছেলেটার চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে ঘুরে তাকালেন। তার চোখ দুটি লাল, নাকটা ফুলে উঠেছে, নিচের চোয়ালটা একটু সামনে বের হয়ে এসে দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। হিংস্র গলায় বললেন, “কে?”

রাশা বলল, “আমি স্যার।”

“কী হয়েছে?”

“আপনি এভাবে ওকে মারতে পারেন না।

মনে হলো স্যার নিজের চোখ আর কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললি?”

“বলেছি আপনি এভাবে ক্লাসের মাঝে মারতে পারেন না।”

স্যারের চোখ দুটি আরো লাল হয়ে উঠল, মনে হলো তার নিশ্বাসে বুঝি আগুন বের হয়ে আসবে। স্যার তার বেতটাকে শক্ত করে ধরে রাশার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, “তুই আমাকে শেখাতে এসেছিস আমি কী করব? তোর এত বড় সাহস?”

“স্যার এটা সাহসের ব্যাপার না স্যার-এটা-”

রাশা কথা শেষ করতে পারল না, স্যার হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “তোর এত বড় সাহস তুই আমার মুখের ওপর কথা বলিস?”

“না স্যার–আসলে-” রাশা কথা শুরু করতে গিয়ে থেমে গেল। স্যার ততক্ষণে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন যে স্যারের শরীরের বোটকা একটা গন্ধ রাশার নাকে এসে লাগল। স্যার হিংস্র চোখে রাশার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বেয়াদব মেয়ে। আমি তোর বেয়াদবি আজকে জন্মের মতো শিখিয়ে দেব।”

রাশা কিছু বলল না, হঠাৎ করে বুঝতে পারল, আজকে ভয়ানক একটা কিছু ঘটে যাবে। স্যার বললেন, “হাত পাত—”

রাশা তার হাতটা এগিয়ে দিল। স্যার তার বেতটা ওপরে তুললেন, রাশা দেখল বেতটা ওপর থেকে নিচে তার হাতের ওপরে নেমে আসছে শপাং করে একটা শব্দ হলো আর সাথে সাথে রাশার মনে হলো তার পুরো হাতটা বুঝি আগুনে ঝলসে গেছে। প্রচণ্ড ব্যথার একটা অনুভূতি হাত থেকে সারা শরীরের মাঝে ছড়িয়ে গেল। তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে হাতটা সরিয়ে নেয়ার অদম্য একটা ইচ্ছা হলো রাশার, কিন্তু সে তার হাতটা সরাল না, দাঁতে দাঁত চেপে রাখল, চিৎকারও করল না। শুনতে পেল সারী ক্লাস এক সাথে একটা চাপা আর্তনাদ করল।

রাশা দাঁতে দাঁত ঘষে নিজেকে বলল, “আমি কাঁদব না। মরে গেলেও কাঁদব না। কাঁদব না, কাঁদব না, কাঁদব না—”

সে তার হাতটা সামনে ধরে রাখল, স্যার বেতটা উপরে তুলে আবার মারলেন, বাতাসে শপাং করে আবার একটা শব্দ হলো, যন্ত্রণার প্রচণ্ড অনুভূতিতে রাশার মনে হলো সারা পৃথিবী বুঝি অন্ধকার হয়ে গেছে।

হঠাৎ করে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একে একে দাঁড়িয়ে গেল, সবাই সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছে কেউ কিছু বলছে না কিন্তু সবাই তীব্র দৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার কেমন যেন হকচকিত হয়ে গেলেন, আবার মারার জন্যে বেতটা উপরে তুলেছিলেন, না মেরে আস্তে আস্তে বেতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”

কেউ কিছু বলল না, স্যার আবার চিৎকার দিয়ে বললেন, “কী হয়েছে?” তার নিজের কাছেই চিৎকারটা কেমন যেন ফাঁপা শোনাল। স্যার একটা টোক গিলে বললেন, “পঁড়িয়ে আছিস কেন। বস।”

এবারে ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে বসে পড়ল, শুধু রাশা দাঁড়িয়ে রইল। সে হাতটা সামনে এগিয়ে পেতে রেখেছে! ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট, তুমি মারতে চাইলে আরো মারতে পারো, আমি ভয় পাই না।

রাজ্জাক স্যার সারা ক্লাসের দিকে একবার তাকালেন তারপর টেবিল থেকে তার চক-ভাস্টার নিয়ে বের হয়ে গেলেন।

এতক্ষণ রাশা পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়েছিল, স্যার বের হয়ে যাওয়া মাত্র সে মাথা নিচু করে বসে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

সারা ক্লাসের মাঝে হঠাৎ যেন কী ঘটে গেল, যে যেখানে ছিল সেখান থেকে সবাই রাশার কাছে ছুটে এলো। কয়দিন আগে এই ক্লাসের ছেলেরা মেয়েদের সাথে কথা পর্যন্ত বলত না, হঠাৎ করে সব পাল্টে গেল। কঠিন চেহারার একটা ছেলে রাশর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কান্দিস না। তুই কান্দিস না। আল্লাহর কসম লাগে।”

একটা ছেলে দৌড়ে বাইরে ছুটে গেল। টিউবওয়েলের পানিতে একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে রাশার ডান হাতটা মেলে খুব সাবধানে ভিজে রুমালটা চেপে ধরে রাখল। সেখানে টকটকে লাল হয়ে দুটি দাগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একজন একটা খাতা দিয়ে তাকে বাতাস করতে থাকে। একজন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাশা তখন মুখ তুলে তাকাল, তার চোখ থেকে তখনো ঝরঝর করে পানি ঝরছে। সানজিদা তার চোখ মুছে দেয়ার চেষ্টা করল, রাশা তখন নিজেই চোখ মুছে নেয়। যে ছেলেটাকে নির্দয়ভাবে মারার জন্য রাশা লাফিয়ে উঠেছিল সেই ছেলেটা দুই হাত উপরে তুলে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “তুই এটা কী করলি? আমাদের মার খেয়ে অভ্যাস আছে, তাই বলে তুই? তুই?”

ঠাণ্ডা চেহারার ছোটখাটো একটা ছেলে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “আমি খুন করে ফেলব। খুন করে ফেলব এই ব্যাটাকে।”

রাশা চোখ মুছে শান্ত গলায় বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে সবকিছু। আমি ঠিক আছি। তোরা ব্যস্ত হবি না।”

ছেলেরা এবং মেয়েরা রাশাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল, তারা ঠিক কী করবে বুঝতে পারছিল না।

.

বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর যখন সে অন্যদের সাথে বাড়িতে আসছে তখন তাদের ক্লাসের একটা লাজুক ধরনের ছেলে হঠাৎ তার কাছে এসে নিচু গলায় বলল, “রাশা।”

রাশা বলল, “কী?”

“তু-ই মানে তুমি মানে তুই–”

“আমি?”

“তুই কী এখন আমাদের স্কুল ছেড়ে চলে যাবি?

“না! স্কুল ছেড়ে কোথায় যাব?”

“যাস না! ঠিক আছে? আমরা সবাই তোর সাথে আছি।”

রাশা বলল, “আমি জানি।”

রাশা সত্যি সত্যি জানে রাজ্জাক স্যারের এই ঘটনায় হঠাৎ করে পুরো ক্লাস তার আপন হয়ে গেছে। তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ছিল এটা, কিন্তু এই ঘটনার জন্যেই সে সারা ক্লাসের আপনজন হয়ে উঠল।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল