রাশা – কিশোর উপন্যাস –মুহম্মদ জাফর ইকবাল
উৎসর্গ : নাইরাহ্ অনোরা সাইফ
তুমি কি জানো তুমি কত আনন্দ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছ?

০১. আব্বুআম্মু যখন অন্যরকম

রাইসার বয়স যখন দশ তখন তার ক্লাসের একটা ফাজিল ছেলে তাকে নিয়ে একটা কবিতা বানিয়েছিল। কবিতাটা শুরু হয়েছিল এভাবে :

রাইসা
মাছের কাঁটা খায় বাইছা বাইছা।

এটা মোটেও কোনো ভালো কবিতা হয়নি, ক্লাসের কোনো ছেলেমেয়ে এই ফাজিল কবি কিংবা তার কবিতাকে কোনোই পাত্তা দেয়নি। কিন্তু রাইসা কেঁদেকেটে একাকার করল। বাসায় এসে ঘোষণা করল সে তার নামটাই বদলে ফেলবে। রাইসার আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “নাম বদলে ফেলবি মানে? নাম কি টেবিল ক্লথ, নাকি বিছানার চাদর যে পছন্দ না হলেই পাল্টে ফেলবি?”

রাইসা তার আম্মুর সাথে তর্ক করল না, খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করল তার নূতন নামটি কী হতে পারে। আনুস্কা নামটা তার খুব পছন্দ কিন্তু রাইসা থেকে হঠাৎ করে এক লাফে আনুস্কা করে ফেলা যাবে না, তাই সে রাইসার কাছাকাছি একটা নাম বেছে নিল। রাইসার ই’ ফেলে দিয়ে প্রথমে সে তার নামটাকে বানাল রাসা কিন্তু উচ্চারণ করল রাশা। প্রথমে সবাই ভেবে নিল এটা একধরনের ঠাট্টা কিন্তু রাইসা হাল ছেড়ে দিল না। একদিন নয় দুইদিন নয়, তিন বছর পর তার বয়স যখন তেরো তখন সত্যি সত্যি তার নাম হয়ে গেল রাশা। একসময় যে তার নাম ছিল রাইসা সেটা সবাই প্রায় ভুলেই গেল।

দশ বছরের রাইসা যখন তেরো বছরের রাশাতে পাল্টে গেল সে তখন আবিষ্কার করেছে নামের সাথে সাথে তার চারপাশের পৃথিবীটাও কেমন যেন পাল্টে গেছে। যখন তার বয়স ছিল দশ বছর তখন তার ধারণা ছিল তার। আব্বু-আম্মুর মতো ভালো মানুষ বুঝি পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। তেরো বছর বয়সে রাশা আবিষ্কার করল তার ধারণাটা পুরোপুরি ভুল-তার আব্বু আম্মু মোটেও ভালো মানুষ নন, তাদের নানা রকম সমস্যা। তার আব্বু বদমেজাজী আর স্বার্থপর ধরনের মানুষ। নিজের ভালো ছাড়া আর কিছুই। বোঝেন না। শুধু তাই না দরকার না থাকলেও অবলীলায় মিথ্যে কথা বলে ফেলেন। রাশা আস্তে আস্তে আবিষ্কার করল তার আম্মুর মনটা খুব ছোট, কেমন যেন হিংসুক ধরনের মহিলা। অল্পতেই বেশ রেগে উঠে বাসায় যে কাজের মেয়েটা আছে তাকে মারধর শুরু করেন। সেটা দেখে রাশা লজ্জায় একেবারে মাটির সাথে মিশে যেত। দেখতে দেখতে অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকল, খুব ধীরে ধীরে তার আব্বু-আম্মু খুবই খারাপভাবে ঝগড়া। করতে শুরু করলেন। প্রথম প্রথম রাশা থেকে লুকিয়ে একটু গলা নামিয়ে ঝগড়া করতেন, আস্তে আস্তে তাদের লজ্জা ভেঙে গেল, তখন গলা উঁচিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে রাশার সামনেই ঝগড়া করতে শুরু করলেন। কী খারাপ তাদের ঝগড়া কার ভঙ্গি, কী জঘন্য তাদের ভাষা, রাশার একেবারে মরে যেতে ইচ্ছে করত।

তারপর একদিন তার আব্বু-আম্মুর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, রাশা আগেই টের পেয়েছিল এরকম একটা জিনিষ ঘটেবে, তাই দুঃখে তার বুকটা ভেঙে গেল সত্যি কিন্তু সে মোটেও অবাক হলো না। সে ভাবল তার আব্বু একন। অন্য জায়গায় চলে যাবেন, ঝগড়াকাটি করার জন্যে কোনো মানুষ নেই তাই বাসায় তখন একটু শান্তি ফিরে আসবে। আব্বু নুতন একটা বাসা ভাড়া করে চলে গেলেন, ঝগড়াঝাটি কমে এলো কিন্তু বাসায় মোটেও শান্তি ফিরে এলো না। আম্মু একটা ব্যাংকে চাকরি করেন, যতক্ষণ অফিসে থাকেন ততক্ষণ ভালো, বাসায় ফিরে এসেই আব্বুকে গালাগাল করতে শুরু করেন, যখন রাত হয়ে আসে তখন ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে থাকেন। রাশা কী করবে বুঝতে পারে না; এক-দুইবার আম্মুকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু তার ফল হলো একেবারে উল্টো, আম্মু রাশাকেই দোষী ধরে মুখ খারাপ করে তাকেই গালাগাল দিতে লাগলেন।

এই ভাবে এক বছর কেটে গেল, রাশার বয়স হলো চৌদ্দ। কিন্তু তার মনে হতো তার বয়স বুঝি হয়েছে চল্লিশ। এই এক বছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে। তার আব্বু কোথা থেকে একজন মাঝবয়সী মহিলাকে খুঁজে বের করে বিয়ে করে কানাডা চলে গেলেন। রাশা ভাবল আব্বু যেহেতু দেশ ছেড়েই চলে গেছেন এখন আম্মু হয়তো একটু শান্ত হয়ে অন্য কিছুতে মন দেবেন।

কিন্তু সেটা মোটেও ঘটল না, আম্মু কেমন যেন আরো খেপে উঠলেন, তার কথাবার্তা শুনে মনে হতে লাগল পুরো দোষটাই বুঝি রাশার। একদিন রাশা স্কুল থেকে এসেছে, বাসায় এসে দেখে আম্মু বসার ঘরে গুম হয়ে বসে আছেন। রাশা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আম্মু?”

আম্মু তার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, রাশা আবার জিজ্ঞেস করল, “আম্মু, কী হয়েছে?”

এবারে আম্মু রাগে একেবারে ফেটে পড়লেন, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বললেন, “সব দায়-দায়িত্ব আমার? তোর বাপের কোনো দায়-দায়িত্ব নাই?”

রাশ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কিসের দায়-দায়িত্ব?”

আম্মু মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কিসের আবার? তোর দায়-দায়িত্ব।”

রাশার বুকটা কেন যেন ঘঁৎ করে উঠে, সে শুকনো মুখে বলল, “আমার দায়-দায়িত্ব?”

“হ্যাঁ। তুই কি আমার একার মেয়ে নাকি তোর বাপেরও একটু দায়িত্ব আছে? আমার ওপর তোর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সে একটা ঘাগী বুড়িকে বিয়ে করে কানাডা ভেগে গেল?”

রাশার কেমন যেন ভয় ভয় লাগতে থাকে। কেন যেন তার মনে হতে থাকে তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে–আম্মু কিছুই বলেননি, কিন্তু রাশা পরিষ্কার বুঝতে পারল আম্মু কী বলতে চাইছেন। তার আব্বু একজনকে বিয়ে করে নূতন করে ঘর-সংসার শুরু করেছেন। তার আম্মু রাশার জন্যে সেটা করতে পারছেন না।

যতই দিন যেতে থাকে রাশার সন্দেহটা ততই পাকা হতে থাকে। আম্মু অফিসে যাবার সময় একটু বেশি সাজগোজ করে যেতে লাগলেন, অফিস থেকে ফিরে আসতে লাগলেন একটু দেরি করে। প্রায়সময়েই রাশাকে খাবার টেবিলে বসে একা একা একটা গল্পের বই পড়ে খেতে হয়। সে পড়াশোনায় ভালো ছিল কিন্তু এখন পড়াশোনায় মন দিতে পারে না। তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হচ্ছে গণিত, সেই গণিতের একটা পরীক্ষায় সোজা সোজা দুইটা অঙ্ক ভুল করে ফেলল। ক্লাশে খাতা দেবার সময় তাদের গণিতের জাহানারা ম্যাডাম বললেন, “রাশা, ক্লাসের শেষে তুমি আমার সাথে দেখা করবে।”

রাশা ক্লাসের শেষে ম্যাডামের সাথে দেখা করতে গেল, সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাডাম বললেন, “রাশা, তোমার কী হয়েছে?”

রাশা বলল, “কিছু হয় নাই ম্যাডাম।”

“নিশ্চয়ই হয়েছে। আমি লক্ষ করছি তোমার লেখাপড়ায় মন নাই। তুমি গণিতে এত ভালো ছিলে আর পরীক্ষায় সোজা সোজা দুইটা অঙ্ক ভুল করলে?”

রাশা কথা বলল না। ম্যাডাম বললেন, “শুধু গণিতে না, বাংলা পরীক্ষাতেও নাকি খারাপ করেছ। ক্লাসে কথাবার্তা বলো না, চুপ করে বসে থাকো। কী হয়েছে?”

রাশা এবারেও কথা বলল না, শুধু তার চোখে পানি চলে এলো। পানিটা লুকানোর জন্যে সে মাথা আরো নিচু করল। ম্যাডাম তখন নরম গলায় বললেন, “রাশা, আমি জানি তোমার আবু-আম্মুর মাঝে ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি জানি তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়ের বাবা-মায়ের যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তখন তোমরা সেটা মেনে নিতে পারো না। ক্রাইসিস তৈরি হয়। পুরো ফ্যামিলির ওপর খুব চাপ সৃষ্টি করে। তোমারও নিশ্চয়ই করেছে। তোমার এই চাপ সহ্য করা শিখতে হবে। আজকাল এটা খুবই কমন ব্যাপার। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে সিক্সটি পার্সেন্ট ডিভোর্স, আমাদের দেশে স্ট্যাটিস্টিক্স নাই, নিলে দেখবে অনেক–হয়তো ফরটি বা ফিফটি পার্সেন্টের কাছাকাছি। কাজেই তোমাকে ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে।”

রাশা এবারে কথা বলল, “ম্যাডাম আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম।”

“তাহলে?”

“অন্য কিছু হচ্ছে ম্যাডাম।”

জাহানারা ম্যাডাম এবারে একটু শঙ্কিত গলায় বললেন, “অন্য কী হচ্ছে?”

রাশা বলবে কিনা বুঝতে পারছিল না, অনেক দিন সে কারো সাথে মন খুলে কিছু বলতে পারে না, আজকে তার ম্যাডামের নরম গলায় কথা শুনে সে একটু ভেঙে পড়ল। কোনোমতে চোখের পানি আটকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, আমার আম্মু আমাকে আর সহ্য করতে পারছে না।”

ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বলছ! তোমার আম্মু তোমাকে আর সহ্য করতে পারছেন না! তোমাকে সহ্য করতে পারবেন না কেন? তুমি কী করেছ?”

“আম্মুর মনে হয় কাউকে পছন্দ হয়েছে। মনে হয় আবার বিয়ে করতে চান।”

এবারে কথা বলার আগে ম্যাডাম খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “দেখো রাশা, এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তোমার মায়ের এত কম বয়স, বাকি জীবনটা কি একা একা থাকবেন? কাজেই তোমার এটাও মেনে নিতে হবে। আসলে দেখবে ব্যাপারটা তোমার জন্যে ভালোই হবে। তুমি তোমার বাবার জায়গায় একজনকে পাবে, বাবা-মা মেয়ে সবাই মিলে পুরো একটা পরিবার হবে–অনেক মজা হবে তখন।”

রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না ম্যাডাম। আমি সেটা বলছি না।”

“তুমি কী বলছ?”

“আমার জন্যে আম্মু বিয়ে করতে পারছে না। আমি হচ্ছি ঝামেলা। আমাকে আম্মু কেমন করে সরিয়ে দিতে পারে সেটা চিন্তা করছে।”

জাহানারা ম্যাডাম থতমত খেয়ে গেলেন, একটু ইতস্তত করে বললেন, “ছিঃ ছিঃ রাশা, এটা তুমি কী বলছ! একজন মা কখনো তার বাচ্চাকে সরিয়ে দেবার কথা ভাবতে পারে না।”

রাশা কোনো কথা বলল না, শুধু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।

ম্যাডাম বললেন, “পৃথিবীটা টিকে আছে মায়েদের জন্যে। একটা মা তার বাচ্চাদের কখনো ছেড়ে যায় না। বুঝেছ?”

রাশা এবারেও কোনো কথা বলল না। ম্যাডাম বললেন, “আমারও দুইটা বাচ্চা আছে–আমিও একজন মা। আমি জানি।”

রাশা কোনো উত্তর দিল না। ম্যাডাম বললেন, “তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না। দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তোমার নূতন করে একটা ফ্যামিলি হবে–কমপ্লিট ফ্যামিলি। বুঝেছ?”

রাশা মাথা নেড়ে জানাল যে সে বুঝেছে। যখন সে চলে যাচ্ছিল তখন জাহানারা ম্যাডাম ডেকে বললেন, “শোনো রাশা। তোমার যখন কিছু দরকার হয়, কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে হয় তখনই তুমি আমার কাছে চলে আসবে। ঠিক আছে?”

রাশা আবার মাখী নাড়ল।

.

যদিও জাহানারা ম্যাডাম রাশাকে বলেছিলেন যে একজন মা কখনোই তার বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে চলে যায় না, কিন্তু দেখা গেল রাশার সন্দেহটাই ঠিক। একদিন রাত্রিবেলা রাশা যখন তার কম্পিউটারে কাজ করছে, তখন আম্মু এসে বললেন, “রাশা, কী করছিস মা?”

আজকাল আম্মু কখনোই এই সুরে নরম গলায় কথা বলেন না, তাই রাশা ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা বুঝতে দিল না। বলল, “ইন্টারনেটে একটা জিনিস দেখার চেষ্টা করছিলাম। নেটটা এত স্লো-”

“কয়দিন থেকেই ভাবছি তোর সাথে একটা জিনিস নিয়ে কথা বলি—”

রাশার বুকটা ছাৎ করে উঠল, সে অনেক কষ্ট করে মুখটা শান্ত রেখে বলল, “বলো আম্মু।”

আম্মু বললেন, “তুই তো এখন আর ছোট মেয়ে না। তুই তো বড় হয়েছিস। ঠিক কিনা?”

রাশা কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল। আম্মু বললেন, “তোর বাপ যে আমার ওপর তোর পুরো দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল, সেটা ঠিক হয়েছে?”

রাশা দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল যে কাজটা ঠিক হয়নি। আম্মু মুখটা কঠিন করে বললেন, “আমি তো অনেক দিন তোর দায়িত্ব নেবার চেষ্টা করলাম, এখন তোর বাপ কিছুদিন তোর দায়িত্ব নিক।”

রাশা শুকনো মুখে তার আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু রাশার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে নেল পালিশ দিয়ে রং করা নিজের হাতের নখগুলো দেখতে দেখতে বললেন, “তুই তোর বাপরে ফোন করবি। ফোন করে বলবি তোকে যেন নিয়ে যায়।”

রাশা কী বলবে বুঝতে পারল না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “আব্বু আমাকে নিয়ে যাবে?”

আম্মু কঠিন গলায় বললেন, “কেন নিবে না? তুই কি আমার একার বাচ্চা?”

রাশা কে গিলে বলল, “যদি নিতে না চায়?”

আম্মুর চোখগুলো ছোট হয়ে গেল, সেই ভাবে রাশার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “যদি নিতে না চায় তাহলে তার অন্যব্যবস্থা করে দিতে হবে।”

“অ-অন্য ব্যবস্থা? অন্য কী ব্যবস্থা?”

আম্মু হিংস্র গলায় বললেন, “আমি সেটা জানি না। তোর বাপকে বলিস বের করতে সে কী ব্যবস্থা নিতে চায়।”

আম্মু আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলেন, বিড়বিড় করে আরো নানা রকম কথা বললেন, রাশা কিছু শুনতে পেল কিছু শুনতে পেল না। তার মনে হতে লাগল, চারপাশের সবকিছু যেন ভেঙে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল, ঘরের সব বাতি নিভে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল, সে বুঝি বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আর আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছে, হু হু করে বাতাস বইছে, আর কালো মেঘ এসে চারদিক ঢেকে ফেলছে।

রাশা সারারাত ঘুমাতে পারল না, বিছানায় ছটফট ছটফট করে কাটিয়ে দিল।

.

দুইদিন পর আবার রাত্রিবেলা আম্মু হাজির হলেন। হাতে একটা টেলিফোন। টেলিফোনটা রাশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে টেলিফোন কর।”

কাকে টেলিফোন করার কথা বলছেন সেটা বুঝতে রাশার একটুও দেরি হলো না। তবু সে জিজ্ঞেস করল, “কাকে?”

“তোর বাপকে।”

“আব্বুকে? এখন?”

“হ্যাঁ।”

রাশা কেমন যেন অসহায় বোধ করে। সে দুর্বল গলায় বলে, “আম্মু, প্লিজ আম্মু-”

“ঘ্যান ঘ্যান করবি না। টেলিফোন করো।”

“করে কী বলব?”

আম্মু মুখ শক্ত করে বললেন, “বলবি আমাকে নিয়ে যাও। না হলে আমার একটা ব্যবস্থা করো।”

“আম্মু–” রাশা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি তো জানো আম্মু-”

“আমি কিছু জানি না। আমি কিছু জানতেও চাই না।” আম্মু টেলিফোনটা রাশার মুখের কাছে ধরলেন। বললেন, “টেলিফোন করো।”

রাশা কিছুক্ষণ আম্মুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি সত্যিই আমাকে বিদায় করে দিতে চাও আম্মু?”

আম্মু হঠাৎ কেমন যেন খেপে উঠলেন, বললেন, “ঢং করবি না। টেলিফোন করো।”

“টেলিফোন নাম্বার?”

আম্মু নিজেই ডায়াল করলেন তারপর কানে লাগিয়ে কিছু একটা শুনলেন তারপর টেলিফোনটা রাশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “রিং হচ্ছে।”

রাশ টেলিফোনটা হাতে নিল। কানে লাগিয়ে শুনল একটু পরপর রিং হচ্ছে। বেশ কয়েকটা রিং হবার পর খুট করে একটা শব্দ হলো তারপর একটা ভারী গলার আওয়াজ শোনা গেল, “হ্যালো।”

অনেক দিন পর শুনছে ভারপরেও রাশা তার আব্বুর গলার স্বরটা চিনতে পারল। রাশা বলল, “আব্বু আমি রাশা।”

ও পাশ থেকে আব্বু বললেন, “এক্সকিউজ মি?”

রাশা আবার বলল, “আব্বু, আমি রাশা। বাংলাদেশ থেকে।”

আব্বু এবারে চিনতে পারলেন এবং মনে হলো একটু থিতিয়ে গেলেন, আমতা আমতা করে বললেন, “রাশা, কী খবর?”

“আম্মু বলেছেন তোমাকে ফোন করতে।”

“কেন? কী হয়েছে?”

রাশা ঠিক কিভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না। একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এক নিশ্বাসে বলেই ফেলল, “আম্মু বলেছেন আমাকে নিয়ে যেতে।”

“নিয়ে যেতে?” আব্বু শব্দ করে একটু হাসলেন, তারপর বললেন, “নিয়ে যাওয়া এতো সোজা নাকি? ইমিগ্রেশান লাগে, ভিসা লাগে, প্লেনের টিকিট লাগে! এগুলো কি গাছে ধরে নাকি?”

অপমানে রাশার কানের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেল, তারপরেও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আম্মু বলেছেন যে, আমার দায়িত্ব আম্মু আর নিতে পারবেন না। এখন তোমাকে নিতে হবে।”

“আমাকে?” আলু আবার শব্দ করে হাসলেন, যেন খুব মজার কথা বলেছে। “আমি কেমন করে তোর দায়িত্ব নিব? আমার নিজেরই ঠিক নাই। ইমিগ্রেশন হয়েছে তাই কোনোভাবে ওয়েলফেয়ারে আছি। ভদ্রলোকের দেশ তাই রক্ষা।” তা না হলে তো না খেয়ে থাকতে হতো।”

আম্মু শীতল চোখে তাকিয়ে ছিলেন, রাশা আম্মুর দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আব্বু তোমার কিছু একটা করতে হবে। প্লিজ।”

“আমি কী করব? দুনিয়ার আরেক মাথা থেকে আমার কিছু করার আছে নাকি? বললেই হবে দায়িত্ব নিতে পারবে না? তোর আম্মুকে বল পাগলামি না করতে।”

রাশা কিছু বলল না। আব্বু বললেন, “তোর আম্মু সবসময়ই এরকম। দায়িত্বজ্ঞান বলে কিছু নাই। যত্তোসব।”

রাশা এবারেও কিছু বলল না। আব্বু হঠাৎ সুর পাল্টে বললেন, “কয়দিন আগে তোকে একটা ভিউকার্ড পাঠিয়েছিলাম। পেয়েছিস? নায়েগ্রা ফলসের ভিউকার্ড। নায়েগ্রা ফলসটা খুবই ইন্টারেস্টিং–অর্ধেকটা আমেরিকাতে অন্য অর্ধেক কানাডাতে। আমরা কানাডার সাইডে গিয়েছিলাম। না দেখলে বিশ্বাস করবি না–”

আব্বু কথা বলে যেতে থাকলেন, কানাডা যে কত ভালো একটা দেশ আর বাংলাদেশ যে কত খারাপ একটা দেশ আন্তু সেটা ঘুরে-ফিরে অনেকবার বললেন। রাশা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, একসময় লক্ষ করল অন্য পাশে আব্বু টেলিফোন রেখে দিয়েছেন।

রাশা কান থেকে টেলিফোনটা সরিয়ে আম্মুর দিকে তাকাল। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী বলেছে?” রাশা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “বলেছেন পারবেন না।”

“পারবে না? বদমাইশটা পারবে না? বাচ্চা জন্ম দেবার সময় মনে ছিল না?”

রাশা কোনো কথা বলল না! আম্মু হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থর মতো চিৎকার করে উঠলেন, “শুধু তোর বদমাইশ বাপ ফুর্তি করবে? কানাডা ইউরোপ আমেরিকা করবে? আর আমি বাংলাদেশের চিপা গলিতে বসে বসে আঙুল চুষব? আমার মেয়েকে পালব? আমার জীবনে কোনো সাধ-আহ্লাদ থাকবে না?”

রাশা কী বলবে বুঝতে পারল না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “তুমি কী চাও আম্মু? কী করতে চাও?”

“আমি নূতন করে লাইফ শুরু করতে চাই।”

“করে আম্মু। তুমি করো।”

“করব?” আম্মু চিৎকার করে বললেন, “কিভাবে করব? তুই আমার গলার মাঝে ঝুলে থাকলে কিভাবে শুরু করব? এই রকম ধাড়ি একটা মেয়ে নিয়ে লাইফ শুরু করা যায়? যায় শুরু করা?”

রাশা আস্তে আস্তে প্রায় শোনা যায় না এভাবে বলল, “যাবে আম্মু। শুরু করা যাবে। আমি বলছি শুরু করা যাবে।”

সেদিন রাতে রাশা ঘুমাতে গেল অনেক দেরি করে। ঘুমানোর আগে পৃথিবীতে মানুষেরা কেমন করে আত্মহত্যা করে সেটা সে ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বের করল। তারপর অনেক দিন পর সে শান্তিতে ঘুমাতে গেল।

পরের দুই সপ্তাহ আম্মু তাকে কিছুই বললেন না, কিন্তু রাশা বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটছে। কী ঘটছে সে জানে না কি সেটাও অনুমান করতে পারে। দুই সপ্তাহ পর গভীর রাতে আম্মু তার ঘরে এলেন, তার বিছানায় বসে নরম গলায় বললেন, “রাশা, মা। তোর সাথে একটু কথা আছে।”

আম্মুর গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যেটা শুনে রাশা হঠাৎ করে বুঝে গেল খুব বড় একটা কিছু ঘটে গেছে। সে কম্পিউটারের কি-বোর্ড থেকে হাত সরিয়ে বলল, “বলো আম্মু।”

“আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি।”

রাশা কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কোথায় চলে যাচ্ছ?”

“অস্ট্রেলিয়া।” আম্মু রাশার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আমি জানি তুই আমার ওপর নিশ্চয়ই খুব রাগ হবি, হওয়ারই কথা। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।”

রাশা আবার বিড়বিড় করে বলল, “অস্ট্রেলিয়া?”

“হ্যাঁ। বুঝতেই পারছিস, আমাকে অস্ট্রেলিয়া কে নিবে? সেই জন্যে আমার একজন অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনকে বিয়ে করতে হয়েছে। মানুষটা ভালো, কিন্তু

রাশ আবার বিড়বিড় করে কী বলছে না বুঝেই বলল, “অস্ট্রেলিয়া!”

“মানুষটা ভালো। আমাকে খুব লাইক করে কিন্তু কোনো বাড়তি ঝামেলা চায় না। আগের পক্ষের বাচ্চা নিতে রাজি না।”

রাশা অবাক হয়ে তার আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আমার বয়স হয়েছে। আমাকে কে বিয়ে করবে বল? এই মানুষটা রাজি হয়েছে, কিন্তু শর্ত একটা। তোকে রেখে যেতে হবে।”

রাশার পৃথিবীটা চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে গেল। তার খুব ইচ্ছে হলো বলে, “প্লিজ আম্মু তুমি আমাকে রেখে চলে যেয়ো না।” কিন্তু সে বলল না। জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কোথায় রেখে যাবে?”

“তোর বড় খালাকে বলেছিলাম, রাজি হলো না। এখন টেলিফোন করলে লাইন কেটে দেয়।”

রাশা তার আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু বিড়বিড় করে বললেন, “মেয়েদের হোস্টেল আছে শুনেছিলাম। এত এক্সপেনসিভ যে আমার পক্ষে কুলানো সম্ভব না। তোর বাপ সাহায্য করলে একটা কথা ছিল। সে তো কিছু করবে না।”

রাশা নিজের ভেতরে কেমন যেন আতঙ্ক অনুভব করে। আম্মু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “অনেক চিন্তা করে দেখলাম তোকে তোর নানির কাছে রেখে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো। নানি দেখে শুনে রাখবে। আদর-যত্ন করবে।”

রাশা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, মুখ হাঁ করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু বললেন, “তোর নানি ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।”

রাশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কিন্তু আম্মু, নানি তো পাগল।

আম্মু জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “একটু মাথার দোষ আছে, সেটা কার নাই? এত কম বয়সে এত বড় ধাক্কা খেলে সবারই মাথা খারাপ হয়ে যেত।”

“তুমি কোনোদিন নানি বাড়ি যাও নাই। কোনোদিন আমাকে যেতে দাও নাই। তুমি বলেছ নানি বদ্ধ উন্মাদ, বেঁধে রাখা দরকার। তুমি বলেছ”

আম্মু বললেন, “কিন্তু আর কোথায় রেখে যাব? শুনেছি তোর নানি এখন অনেক ভালো। সম্পত্তি দেখেশুনে রাখছে না? পাগল হলে কি পারত?”

“আমার স্কুল?”

আম্মুকে দেখে মনে হলো, কথাটা শুনে যেন খুব অবাক হয়ে গেছেন। খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে বললেন, “ওখানে নিশ্চয়ই স্কুল আছে। সেই স্কুলে পড়বি। লেখাপড়া কি আর স্কুল দিয়ে হয়? লেখাপড়া তো নিজের কাছে?”

রাশা দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। আম্মু ফিসফিস করে বললেন, “আমাকে একটু সময় দে মা। আমি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে গুছিয়ে নিই, তারপর তোকে নিয়ে যাব। আই প্রমিজ।”

রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “তুই আমার ওপর রাগ করে থাকিস না মা। আমার কোনো উপায় ছিল না। বিশ্বাস করো, আমার কোনো উপায় ছিল না। একটা মা কি কখনো তার বাচ্চাকে ফেলে রেখে যেতে পারে? পারে না?”

তারপর আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাশা তার আম্মুর দিকে তাকিয়ে থাকলেও তাকে দেখছিল না! সে ইন্টারনেটে দেখা আত্মহত্যার উপায়গুলোর কথা ভাবছিল। অনেকগুলো উপায়ের কথা সেখানে লেখা ছিল কিন্তু সে একটাও মনে করতে পারছিল না।

একটাও না। তাতে অবশ্যি কিছু আসে যায় না, যখন সময় হবে তখন মনে করতে পারলেই হবে। তখন নিশ্চয়ই মনে হয়ে যাবে।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল