১১. ফেরা

আম্মুর কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে আমি জানি না। সত্যি কথা বলতে কী কিছু একটা হয়েছে সেটা আমি কেমন করে জানি সেটাও আমি জানি না, কিন্তু আমি মোটামুটি নিশ্চিত আম্মুর কিছু একটা হয়েছে। অন্ধ মানুষেরা চোখে দেখতে পায় না বলে তারা সবকিছু শব্দ দিয়ে অনুভব করে। আমিও আসলে অন্ধ মানুষের মতো, আমি আম্মুকে দেখি না। আম্মুর সাথে আমার দেখা হয় যখন আম্মু আমাকে মারেন তখন। বাকি সময়টুকু আমি আম্মুকে অনুভব করি শব্দ দিয়ে। আমি স্টোররুমে আমার ছোট বিছানা থেকে আম্মুর প্রত্যেকটা শব্দ শুনতে পাই। আম্মু ঘুম থেকে উঠছেন, বাথরুমে যাচ্ছেন, জানালা খুলে বাইরে তাকাচ্ছেন, গুনগুন করে গান গাইছেন–আম্মুর প্রত্যেকটা শব্দ আমি খুঁটিয়ে খুটিয়ে শুনি। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে হাসছেন, সিডিতে গান শুনছেন। কিংবা খাবার টেবিলে বসে ভাইয়া আর আপুর সাথে গল্প করছেন, সবকিছু শুনে শুনে সেগুলো আমার মাথার মাঝে গেঁথে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ যখন আমার সাথে দেখা হয়, এক মুহর্তে যখন রেগে আগুন হয়ে যান, তখন যখন হিংস্রভাবে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়েন তখনও আমি বুঝতে পারি আম্মু কখন কী। করবেন।

অন্ধ মানুষের মতো শুধু শব্দ শুনে শুনে আমি গত তিন বছর আম্মুকে বোঝার চেষ্টা করেছি, তাই যখন স্টোররুমের কোনায় বসে হঠাৎ করে আম্মুর পরিচিত শব্দগুলো শুনতে পাই না তখন বুঝতে পারি আম্মুর কিছু একটা হয়েছে। খাবার টেবিলেও আম্মু আজকাল আগের মতো কথা বলেন না। অনেক সময় নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করেন। মাঝে মাঝে আমার আম্মুকে দেখার ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি সাহস পাই না।

সেদিন রাত্রিবেলা আমি মিচকিকে হাতে নিয়ে তার সাথে ফিসফিস করে কথা বলছি এটা আমার আজকাল অনেকটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে, সারাদিন কী হয়েছে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে বলি। আমি জানি শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে না কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় মিচকি আমার সব কথা বুঝতে পারে! কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমি একটু নিজের অজান্তেই একটু জোরে কথা বলে ফেলেছি। আম্মু কী কারণে রান্নাঘরে এসেছেন আমার গলার স্বর শুনে, নিঃশব্দে স্টোররুমে এসেছেন দেখতে আমি কার সাথে কথা বলছি।

আমি খেয়াল করি নি, হঠাৎ করে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি আম্মু দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার হাতের তালুতে মিচকি বসে ছিল, সেও তখন ঠিক আমার মতো অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়েছে।

আম্মুর মুখটা ঘেন্নায় বাঁকা হয়ে গেলো, মুখ বিকৃত করে বললেন, তোর হাতে এটা কী?

আমি হাতটা নামিয়ে মিচকিকে লুকিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আম্মু চিৎকার করে বললেন, ইঁদুর? তোর হাতে ইঁদুর?

আমি মিচকিকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সেটাকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু বোকা ইঁদুরটা সেটা বুঝলো না, মনে করলো সেটা আরেকটা খেলা, লাফিয়ে আমার হাত বেয়ে কাঁধে উঠে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মুকে দেখে মনে হলো বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন, আমি জানি এখনই আম্মু চিলের মতো চিৎকার করে উঠবেন, তারপর হাতের কাছে যেটাই পান সেটা নিয়ে আমার ওপরে ঝাপিয়ে পড়বেন। কিন্তু আমি দেখলাম আম্মু কিছুই করলেন না, বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়েই থাকলেন।

আমি এতোটুকু শব্দ না করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে আম্মুর দিকে তাকিয়ে রইলাম, আম্মুও আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর আমার মনে হতে লাগলো আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিন্তু আমাকে দেখছেন না। আম্মু তখন ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত দিলেন, তার মুখটায় যন্ত্রণায় একটা চিহ্ন ফুটে উঠল, সেইভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে টলতে টলতে কীভাবে জানি স্টোররুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি একটু পরে শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম আম্মু ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে চুপচাপ নিঃশব্দে বসে আছেন। আমার খুব ইচ্ছে হলো আম্মুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আম্মু তোমার কী হয়েছে? কিন্তু সাহস হলো না।

রাত্রিবেলা আমি দুলি খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, দুলি খালা? আম্মুর কী।

হয়েছে?

দুলি খালা অবাক হয়ে বলল, কী হবে? কিছু হয় নাই?

তাহলে আম্মু আজকাল এতো কম কথা বলে কেন?

তোমার আম্মু কুনোদিনই বেশি কথা বলে নাই–বলে দুলি খালা পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলো।

সেদিন রাত্রে আমি খুব সাহসের একটা কাজ করলাম, রাত্রিবেলা যখন সবাই নিজের নিজের ঘরে চলে গেছে তখন আমি পা টিপে টিপে আপুর ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। আপু আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো, ভুরু কুঁচকে ফিসফিস করে বলল,তপু?

হ্যাঁ, আপু।

কী হয়েছে?

আপু–আম্মুর কী হয়েছে?

আপু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, বলল, কার?

আম্মুর।

কী হবে?

আম্মু কেমন জানি অন্যরকম ব্যবহার করছেন।

আপু তখনও আমার কথা বুঝতে পারছিলো না, মাথা নেড়ে বলল, কীরকম অন্যরকম ব্যবহার করছেন?

আমি বললাম, আমি জানি না।

আপু আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি কী করব বুঝতে না পেরে আমার স্টোররুমে ফিরে এলাম।

 

আমার সন্দেহটা যে সত্যি সেটা সপ্তাহখানেকের মাঝে সবাই বুঝতে পারলো। আম্মুর অফিসের গাড়ি এসেছে, অফিসে যাবার জন্যে আম্মু বের হবেন, হঠাৎ করে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে হাটু ভেঙ্গে পড়ে গেলেন। টেবিলের কোনায় মাথা লেগে মাথার বেশ খানিকটা কেটে গেলো। আম্মু যদিও উঠে বসে, আমার কিছু হয় নি, আমার কিছু হয় নি বলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন কিন্তু অন্যেরা তার কথা শুনলো না। তাকে ধরে একরকম জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। মাথায় ব্যথা পেয়েছেন বলে মাথার এক্সরে করে দেখতে পেলো মাথার ভেতরে একটা বড় টিউমার।

এর পরে সবকিছু কেমন যেন দ্রুত ঘটতে লাগলো। টিউমারটি মোটেও নিরীহ টিউমার না। এটাকে অপারেশন করতে হবে, অপারেশন করলেই যে আম্মু ভাল হয়ে যাবেন কোন ডাক্তার সেটাও দাবি করল না। আম্মু হাসপাতালে আছেন, প্রতিদিন বিকেলে ভাইয়া আর আপুর কাছে আম্মুর খবর শুনতে পাই।

 

যে সব বিষয়ে আম্মু বিচলিত হন সেগুলো না করার জন্যে ডাক্তারের কড়া নির্দেশ তাই আমার হাসপাতালে যাবার কোন প্রশ্নই আসে না। আমি তাই হাসপাতালে যেতে পারি না, আপু কিংবা ভাইয়া বাসায় এলে তাদের কাছে আম্মুর খবর নিই। খুব দ্রুত আম্মুর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যেতে লাগলো, আমাকে কেউ সেটা বলে দেয় নি কিন্তু আমি জানি আম্মুর মাথায় ভয়ংকর একটা অপারেশন হবে। শুধু অপারেশন হলে হবে না। তারপর কোন একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটতে হবে। শুধুমাত্র তাহলেই আম্মুকে বাঁচানো সম্ভব।

আম্মু বাসায় নেই বলে আমাকে স্টোররুমে বসে থাকতে হয় না। আমি মাঝে মাঝে বাসার ভেতরে হাঁটাহাঁটি করি। অনেক দিন পর আমি আম্মুর ঘরে গিয়েছিলাম। ড্রেসিং টেবিলের উপর তার পাউডার, লিপস্টিক পারফিউম সাজানো। চিরুনিতে আম্মুর দুই একটা চুল লেগে আছে। ওয়ারড্রোবের ভেতরে আম্মুর শাড়ি ব্লাউজ। বিছানায় গায়ে দেয়ার কম্বল ভাজ করে রাখা আছে, শুধু আম্মু নেই। দেওয়ালে আব্বু আর আম্মুর ছবি, বিয়ের পরপর তোলা, দুজনকেই দেখাচ্ছে খুব কম বয়সী, দুজনে এমনভাবে হাসছেন যে মনে হয় একটু খেয়াল করলে হাসির শব্দ শোনা যাবে।

বসার ঘরে বসে একদিন টেলিভিশন অন করেছি, কতোদিন টেলিভিশন দেখি না বলে জানি না আজকাল টেলিভিশনে কতো রকম নতুন নতুন চ্যানেল বের হয়েছে। কিছু কিছু খুব মজার আর কিছু কিছু এতো উদ্ভট যে মানুষজন কেমন করে দেখে সেটাই আমি চিন্তা করে পাই না। টেলিভিশন না দেখে না দেখে আমার টেলিভিশন দেখার অভ্যাস চলে গেছে তাই কিছুক্ষণ দেখার পরই আমার কেমন জানি বিরক্তি লাগতে থাকে। আমি টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়ে উঠে আসি। বাইরের ঘরে শেলফে অনেক বই। আমি বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখি কিন্তু মনের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা তাই কোন কিছু আর পড়তে ইচ্ছে করে না।

 

আম্মুর মাথার অপারেশন হলো দুই সপ্তাহ পরে। তাকে বিদেশে নেয়া হবে কী না সেটা নিয়েও একটু আলোচনা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামা খালারা আপু আর ভাইয়ার সাথে কথা বলে এখানেই অপারেশন করবেন বলে ঠিক করলেন। যেদিন অপারেশন করা হবে সেদিন সকাল থেকে আমি হাসপাতালের বারান্দায় দাড়িয়ে রইলাম। যখন আম্মুকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায় তখন আপু আর ভাইয়া আম্মুর কাছে গিয়ে তার হাত ধরে রইলো। আমি দূরে একটা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম যেন আমাকে দেখতে না পান। হঠাৎ করে দেখে ফেললে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।

অপারেশনটি শেষ হতে ছয় ঘণ্টা সময় নিলো, যারা অপারেশন করেন তারা টানা ছয় ঘণ্টা বিশ্রাম না করে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন কে জানে। অপারেশন। থিয়েটার থেকে বের করে আম্মুকে একটা ঘরে নিয়ে রাখা হলো। আম্মুর জ্ঞান নেই বলে আপু আর ভাইয়ার সাথে আমিও দেখতে গেলাম। মাথার মাঝে ব্যান্ডেজ, নাক এবং মুখ থেকে প্ল্যাস্টিকের নল বের হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ এবং মুখ অল্প খোলা, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে এক ধরনের শব্দ হচ্ছে, কেমন যেন অস্বস্তিকর একটি শব্দ, শুনলে বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। শরীরের নানা জায়গা থেকে নানারকম তার বের হয়ে এসেছে, চারপাশে অনেক রকম যন্ত্রপাতি, সেগুলোতে অনেক রকম আলো, অনেক রকম শব্দ। আম্মুকে দেখে আমার কাছে একজন অচেনা মানুষ বলে মনে হতে লাগলো। আমাদের সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে দিলো না, একটু পরেই একজন নার্স এসে আমাদের বের করে নিয়ে এলো।

আম্মুর জ্ঞান ফিরবে কী না সেটা নিয়ে সবার ভেতরে সন্দেহ ছিল, কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আম্মুর জ্ঞান ফিরে এলো। আপু আর ভাইয়া যখন আম্মুর সাথে কথা বলে ফিরে এলো আমি জিজ্ঞেস করলাম, আম্মু কেমন আছেন?

আপু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আগের মতোই।

কথা বলেছেন আম্মু?

হ্যাঁ। একটু বলেছেন।

কী বলেছেন আম্মু?

আপু হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার মতো করে বলল, এই তো এটা সেটা।

আমি অনেক আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার কথা কিছু বলেছেন আম্মু?

আপু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো, বলল, না। আম্মু তোর কথা কিছু জিজ্ঞেস করে নাই।

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে সরে এলাম। আমি একেবারে গোপনে একটা ছেলেমানুষী আশা করে বসেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম আম্মুর মাথায় সেই ভয়ংকর টিউমারটির জন্যে আম্মু আমাকে সহ্য করতে পারেন না। সেই টিউমারটি এখন কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে এখন হয়তো আম্মু আবার আগের মতো আমাকে ভালবাসবেন! আপুর কথা শুনে বুঝতে পারলাম সেটি সত্যি নয়। ঠিক কেন জানি না আমার বুকটা ভেঙ্গে গেলো অন্য রকম একটা কষ্টে।

ধীরে ধীর আম্মুর অবস্থা আরো খারাপ হলো। আমি দেখতে পারবো না জেনেও প্রত্যেক দিন এসে ঘরের বইরে বসে থাকতাম। ভাইয়া আর আপু ভেতরে গিয়ে আম্মুর সাথে একটু কথা বলে বের হয়ে আসতো, আমি তাদের কাছে জানতে চাইতাম আম্মু কেমন আছেন। তারা পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারতো না, দায়সারা কিছু একটা বলতো। আমি অপেক্ষা করতাম কখন আম্মু ঘুমাবেন তখন দূর থেকে তাকে গিয়ে দেখে আসতাম, শুধু ভয় করতো হঠাৎ যদি ঘুম ভেঙ্গে আমাকে দেখে রেগে যান তখন কী হবে? তাকে একবার হাত দিয়ে ছোঁয়ার জন্যে আমার সমস্ত শরীর আকুলি বিকুলি করতো। শুধু মনে হতো একবার যদি আম্মুর বুকের ওপর মাথা রেখে আম্মুর সাথে একটা কথা বলতে পারতাম! সাধারণ একটা কথা। সহজ একটা কথা!

ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পারলো আম্মু আসলে বাঁচবেন না। আম্মু বেশিরভাগ সময় জাগা এবং ঘুমের মাঝামাঝি একটা জায়গায় থাকেন। আজকাল মাঝে মাঝে আপু আর ভাইয়াকেও নাকী চিনতে পারেন না। সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারি না, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে চাই আম্মু আমার কথা কিছু বলেছেন কী না। কিন্তু কখনোই বলেন না। আমি যে আছি সে কথাটাই যেন ভুলে গেছেন। আর কয়দিন পর আম্মু আর কাউকেই চিনবেন না। তখন কী হবে? আম্মুর জীবন থেকে আমি একেবারেই হারিয়ে যাব?

খুব মন খারাপ করে একদিন আমি হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ ডাক্তারদের সাদা গাউন পরা একজন ভদ্রমহিলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে আমি কোথায় দেখেছি?

আমি ইতস্তত করে বললাম, মনে হয় এইখানে। আমি প্রত্যেক দিন এখানে আসি।

উঁহু, এইখানে না। আমি তো এইখানে আগে আসি নাই। ডাক্তার ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ আমার দিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে থাকলেন। হঠাৎ তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললেন, মনে পড়েছে! তুমি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন! গ্রেট ম্যাথমেটিশিয়ান!

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, আমি আমার মেয়েকে সেই কম্পিটিশনে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মেয়ে তোমার অটোগ্রাফ নিয়েছিল।

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বলল, ও।

তুমি এখানে কেন?

আমার আম্মুর মাথায় অপারেশন হয়েছে।

কতো নম্বর বেড।

সতেরো।

ভদ্রমহিলা আর কিছু না বলে ভিতরে ঢুকে গেলেন।

আমি একা একা বাইরে বসে আছি তখন দেখতে পেলাম সেই ডাক্তার ভদ্রমহিলা আবার বের হয়ে এসেছেন। আমাকে দেখে আবার আমার কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কী তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাও?

আমি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লাম, বললাম, না-না।

ডাক্তার ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, কেন না?

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ডাক্তার ভদ্রমহিলা বললেন, এসো ভেতরে এসো। একটু থেমে নরম গলায় বললেন, তোমার আম্মু এই সময়টাতে নিশ্চয়ই তার ছেলেমেয়েকে দেখতে চাইবেন।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, আমার আম্মুর সামনে যাওয়া নিষেধ। আমাকে দেখলেই আম্মু রেগে যান।

ডাক্তার ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার আম্মুর আর রেগে ওঠার ক্ষমতাটুকু নেই খোকা! ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে বললেন, এসো আমার সাথে।

ভেতরে পাশাপাশি অনেকগুলো বেড়। আম্মুর বেডটা এক কোনায়, ডাক্তার ভদ্রমহিলা আমাকে আম্মুর বেডের কাছে নিয়ে গেলেন। আম্মু চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন পায়ের শব্দ শুনে চোখ খুলে তাকালেন। ডাক্তার ভদ্রমহিলা আম্মুকে বললেন, আপনার ছেলে আপনাকে দেখতে এসেছে। তারপর আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, তুমি তোমার আম্মুর সাথে কথা বলো। আমি আমার

পেশেন্টকে একটু দেখে আসি।

আম্মু কিছু না বলে আমার দিকে তাকালেন। আমি ও আম্মুর দিকে তাকালাম। আব্বু মারা যাবার পর আমি যতবার আম্মুর চোখে দিকে তাকিয়েছি ততবার আম্মুর চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠেছে, এই প্রথমবার আম্মুর চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠল না। আম্মু স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। খুব ধীরে ধীরে আম্মুর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো। আম্মুর ঠোঁট দুটো হঠাৎ নড়ে উঠলো, কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। আমি আম্মুর কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম, শুনলাম আম্মু আমাকে ডাকলেন, তপু।

আমি বললাম, কী আম্মু?

আম্মু ফিসফিস করে বললেন, তুই একটু সামনে দাঁড়া। তোকে দেখি।

আমি আম্মুর সামনে দাঁড়ালাম। আম্মু অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর ফিসফিস করে বললেন, আমি তোর ওপর অনেক অত্যাচার করেছি। তাই না?

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না আম্মু করো নি।

আম্মু বললেন, করেছি। আমি জানি। আম্মু কেমন জানি ক্লান্ত হয়ে গেলেন। মনে হলো কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে একটু শক্তি সঞ্চয় করলেন, তারপর বললেন, তোর আব্বু মারা যাবার পর আমার যে কী হয়ে গেলো আমি জানি না। আমি তোকে সহ্য করতে পারতাম না তপু।

আমি আম্মুর আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি তোমার হাতটা একটু ধরি আম্মু?

ধরবি? ধর।

আমি আস্তে আস্তে আমার আম্মুর হাতটি ধরলাম, আহা! কী শুকনো আর ঠাণ্ডা হাত। হাতটা ধরেই আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। আম্মু স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, ফিসফিস করে বললেন, আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তপু। অনেক কষ্ট।

না আম্মু দেও নাই।

দিয়েছি।

আমি আম্মুর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে বললাম, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি আমাকে কতো আদর করতে মনে আছে?

আম্মু মাথা নাড়লেন। তার মুখে হঠাৎ এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। আহা! কতোদিন পর আমার আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমি ফিসফিস। করে বললাম, আমার শুধু সেই আদরের কথা মনে আছে। আর কিছু মনে নাই আম্মু।

আম্মু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, সত্যি?

সত্যি আম্মু।

আম্মু আমাকে তার দুর্বল হাত দিয়ে টানলেন, বললেন, আয় বাবা। আমার আরেকটু কাছে আয়।

আমি আম্মুর আরেকটু কাছে গেলাম। আম্মু আমাকে তার বুকের মাঝে টেনে নিলেন।

আহা! কতো দিন, কতো রাত, কতো যুগ থেকে আমি এই মুহূর্তটার জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম! আমি দুই হাত দিয়ে আম্মুকে শক্ত করে ধরে রাখলাম। আমার শুধু মনে হতে লাগলো ছেড়ে দিলেই বুঝি আম্মু চলে যাবেন। খোদা! হেই খোদা–আমার আম্মুকে তুমি আমার কাছ থেকে নিয়ে যেয়ো না। তোমার দোহাই লাগে খোদা!

কিন্তু খোদা আমার কথা শুনলেন না। আমার আম্মু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখে মারা গেলেন।

 

বাইরে প্রিয়াংকা মৌটুসি শিউলী আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে বের হতে দেখে তারা এগিয়ে এলো। প্রিয়াংকা চোখের পানি মুছে নরম গলায় বলল, তপু।

আমি প্রিয়াংকার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। মা মারা গেলে একজন হাসে কেমন করে সেটা কেউ বুঝতে পারল না। আমি জানি তারা বুঝতে পারবে না। মা মারা গেছেন বলে তো আমি হাসছিলাম না। অনেক দিন পর শেষ পর্যন্ত আমি আমার মায়ের কাছে ফিরে গিয়েছিলাম বলে হাসছিলাম।

কেউ সেটা বুঝতে পারে নি। শুধু প্রিয়াংকা বুঝতে পেরেছিল। আমি দেখলাম শুধু সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।

চোখে পানি আর ঠোঁটের কোণায় একটু হাসি–এটি কী বিচিত্র একটি দৃশ্য!

————

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল