ফার্স্টবয়

টুনি স্কুলের বারান্দায় বসে মাঠে ছেলেমেয়েদের দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে দেখছিল। তার বয়সী ছেলেমেয়েরাই সবচেয়ে বেশি কিন্তু টুনি তাদের মাঝে নেই। কীভাবে কীভাবে জানি তার মাঝে একটা বড় মানুষ বড় মানুষ ভাব চলে এসেছে তাই সে আর তার বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে না। টিফিনের ছুটিতে বারান্দায় বসে বসে তাদের খেলতে দেখে–মাঝে মাঝে মনে হয় সেটাতেই বুঝি মজা বেশি।

টুনি মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের কোনা দিয়ে দেখল তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় রাজু আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। রাজুও অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলে না তবে তার কারণটা ভিন্ন। ক্লাসে তার কোনো বন্ধু নেই, সে বেশির ভাগ সময় একা একা থাকে। রাজু একবার ডান থেকে বাম দিকে গেল তারপর আবার বাম থেকে ডান দিকে গেল। টুনির মনে হলো রাজু হয়তো তার সাথেই কথা বলতে চাইছে, কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।

তাই যখন রাজু আবার ডান দিকে থেকে বাম দিকে যেতে শুরু করেছে তখন টুনি তাকে ডাকল, “এই রাজু।”

রাজু কেমন জানি চমকে উঠল। বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ।”

“কী হয়েছে?”

“সবাই কত মজা করে খেলছে, তুই খেলিস না কেন?”

এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া উচিত ছিল পাল্টা প্রশ্ন করে, তুই খেলিস না কেন?’ কিন্তু রাজু প্রশ্নটা না করে মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমাকে কেউ কখনো কোনো খেলায় নেয় না।”

টুনি থতমত খেয়ে গেল, কথাটা মোটামুটি সত্যি কিন্তু এরকম সত্যি কথা কেউ কখনো এভাবে বলে ফেলে না। টুনি কথাটাকে একটা ঠাট্টার মতো ধরে নিয়ে হাসার ভঙ্গি করে বলল, “তুই খেলবি?”

রাজু মাথা নাড়ল, “না।”

“তুই যদি নিজেই খেলতে না চাস তাহলে তোকে খেলায় নেবে কেমন করে?”

রাজু কোনো উত্তর দিল না আবার চলেও গেল না। টুনির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথাবার্তা না বলে দুজন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা যথেষ্ট অস্বস্তির ব্যাপার, টুনি তাই রাজুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করল। রাজুর সাথে কথা বলার সময় বিষয় মাত্র একটাই হতে পারে, সেটা হচ্ছে লেখাপড়া। তাই টুনি জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রাজু, জালাল স্যার যে অঙ্কটা দিয়েছিল সেটা করেছিস? ঔ যে চৌবাচ্চার অঙ্ক–এক দিক দিয়ে পানি আসে অন্যদিক দিয়ে পানি যায়”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না। করি নাই।”

এটা রীতিমতো একটা সংবাদ। যে কাজগুলো বাড়ির কাজ হিসেবে দেওয়া হয় রাজু সেগুলো ক্লাসে বসেই করে ফেলে। আর কয়েকদিন আগে দেয়া অঙ্কটা এখনো শেষ করে নাই সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঘটনা। অঙ্কটা রাজু করেছে নাকি করে নাই টুনির অবশ্যি সেটা জানার আসলে কোনো আগ্রহ নাই, সে শুধু একটা আলাপ চালিয়ে যেতে চাইছিল। তাই এবারে আরেকটা পড়ালেখার প্রশ্ন করল, “বিজ্ঞান স্যার যে আলু দিয়ে কী একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে দিয়েছিল সেইটা করে দেখেছিস? আসলেই কাজ করে?”

রাজু বলল, “জানি না।”

“এক্সপেরিমেন্টটা করিস নাই?”

“নাহ।” বলে রাজু তার হাতের তালুর দিকে তাকাল তারপর ওপরের দিকে তাকাল। টুনি আড় চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল ওপরে দেখার মতো কিছু নাই।

লেখাপড়া নিয়ে আর কী প্রশ্ন করা যেতে পারে টুনি সেটা দ্রুত চিন্তা করতে থাকে। সেরকম কিছু মনে পড়ল না। তখন একটা প্রশ্ন বানাতে হলো। জিজ্ঞেস করল, “নাসরীন ম্যাডামের বাংলা পড়ানো তোর কেমন লাগে?”

“নাসরীন ম্যাডাম? যে নূতন এসেছে?”

“হ্যাঁ।”

“কী জানি।”

রাজু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “খেয়াল করি নাই।”

টুনি এবারে রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, “খেয়াল করিস নাই?”

“নাহ।”

“তুই খেয়াল করিস নাই? এটা কী হতে পারে?”

রাজু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “লেখাপড়া আর ভালো লাগে না, ছেড়ে দিয়েছি।”

টুনি প্রায় আর্ত চিৎকার দিয়ে বলল, “ছেড়ে দিয়েছিস?”

“হ্যাঁ।” রাজু আবার তার হাতের তালুর দিকে তাকাল। তারপর আবার ওপরের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নামিয়ে বলল, “লেখাপড়া করে কী হবে? খামোখা।”

টুনি এতক্ষণ ভদ্রতার একটা আলাপ চালানোর চেষ্টা করছিল। এবারে আর দ্রতার আলোচনার মাঝে থাকল না, সত্যিকারের আলোচনার মাঝে চলে এলো। চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস তুই? তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? লেখাপড়া করে কী হবে মানে? তুই আমাদের ফার্স্টবয়, তুই লেখাপড়া না করলে কে লেখাপড়া করবে? তোর কী হয়েছে বল। সমস্যাটা কী?”

রাজু কিছু না বলে আবার তার হাতের তালুর দিকে তাকাল তারপর আবার উপরের দিকে তাকাল, তারপর তাকিয়েই রইল।

টুনি নরম গলায় বলল, “তুই আয়। আমার কাছে বস। আমাকে বল কী হয়েছে।”

রাজু পাশে বসবে টুনি আশা করেনি, কিন্তু তাকে অবাক করে রাজু তার পাশে বসল। তারপর প্রায় এক শ কিলোমিটার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে হাতের তালুর দিকে তাকাল।

টুনি গলার স্বর আরো নরম করে বলল, “বল আমাকে। কী হয়েছে?”

রাজু মুখ তুলে টুনির দিকে তাকাল তারপর বলল, “তার আগে তুমি বল, তোমার আব্বু আর আম্মু কী ঝগড়া করে?”

টুনি এক মুহূর্তে অনেক কিছু বুঝে গেল। সে যে রাজুর সাথে তুই করে বলছে আর রাজু যে ক্লাসে কারো সাথেই তুই করে কথা বলে না, বলতে পারে

সেটাও সে লক্ষ করল। উত্তর দেওয়ার আগে টুনি ভালো করে রাজুর মুখটা লক্ষ করল, সেটা কেমন যেন দুঃখী একজনের মুখ।

টুনি বলল, “অবশ্যই ঝগড়া করে। পৃথিবীর কোনো আব্বু-আম্মু নাই যারা মাঝে মাঝে ঝগড়া করে না। যদি দেখা যায় কোনো আব্বু-আম্মু ঝগড়া করছে। তাহলে বুঝতে হবে কোনো একটা বড় সমস্যা আছে।”

“কী সমস্যা?”

“মনে কর ওয়াইফ-হাজব্যান্ড থেকে বয়সে অনেক ছোট। অনেক ভয় পায় এরকম। তা না হলে যেকোনো হাজব্যান্ড-ওয়াইফ মাঝে মাঝে ঝগড়াঝাটি করে।”

“তোমার আব্বু আর আম্মু কীভাবে ঝগড়াঝাটি করে?”

টুনি মাথা চুলকাল, তারপর ইতস্তত করে বলল, “সেটা ঠিক জানি না। কোননাদিন আমাদের সামনে ঝগড়া করে নাই।”

রাজু ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কেমন করে জান তোমার আব্বু-আম্মু ঝগড়া করে?”

“বোঝা যায়।” টুনি মুখে হাসি টেনে বলল, “দেখা যায় আব্বু-আম্মু কথা বলছে না। খাবার টেবিলে দুজনেই মুখ ভোঁতা করে বসে খাচ্ছে। কিংবা আম্মু খামাখো আমাদের ওপর মেজাজ করছে। কিংবা খারাপ খারাপ কথা বলছে–”

“খারাপ খারাপ কথা?” রাজু এবারে উৎসাহী হলো, জিজ্ঞেস করল, “কী রকম খারাপ খারাপ কথা?”

টুনি রীতিমতো ডায়ালগের মতো ভঙ্গি করে বলল, “যেরকম মনে কর আম্মুর ফেবারিট খারাপ কথা হচ্ছে–” টুনি তখন রীতিমতো নাটকের ডায়লগের মতো ভঙ্গি করে বলল “আমাকে তো পেয়েছিস একজন দাসী বান্দি? লাট সাহেবদের সেবা করতে করতে জান কালি করে ফেলতে হবে। এক গ্লাস পানি পর্যন্ত নিজেরা ঢেলে খেতে পারবে না! এইরকম।”

রাজু একটু অবাক হয়ে বলল, “এইটা সবচেয়ে খারাপ কথা?”

“এই রকমই তো হবে। আর কী হবে?”

“কখনো কখনো—” কিছু একটা বলতে গিয়ে রাজু থেমে গেল।

টুনি বলল, “বল। কী বলতে চাইছিলি বল।”

“বলছিলাম কী–” রাজু ইতস্তত করে বলল, “কখনো তোর আব্বু কী আম্মুর গায়ে হাত তুলে? কিংবা আম্মু—”

টুনি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। মুখ শান্ত করে বলল, “না সেরকম ঘটনা কখনোই ঘটে না। এটা খুব সিরিয়াস ঘটনা। এটা আসলে ঘটা উচিত না। কখনোই ঘটা উচিত না।” টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “তোর আব্বু-আম্মুর বেলায় কী কখনো ঘটেছে?”

“কখনো? রাজু কেমন করে জানি একটা হাসির মতো করে শব্দ করল, তারপর বলল, “প্রত্যেকদিন ঘটে।”

“প্রত্যেকদিন?”

রাজু মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, প্রত্যেকদিন। দুজন অফিস থেকে এসে শুরু করে দেয়। খারাপ খারাপ ভাষায় একজন আরেকজনকে গালি দেয়। তারপর এক সময়ে দুজনেই ভাঙচুর করে। আম্মু মাঝে মাঝে গলা ফাটিয়ে কাঁদে।”

টুনি রাজুকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “রাজু–”

“কী?”

“তোর আর বলার দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি।”

“তুমি মোটেই বুঝতে পারছ না। এর ভেতরে নিজে না থাকলে কেউ বুঝতে পারবে না। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জান?”

রাজু কী বলবে টুনি আন্দাজ করতে পারে, তারপরও জিজ্ঞেস করল, “কী?”

“মনে হয় ছয়তলা বাসার ছাদে উঠে নিচে লাফ দিই।”

টুনি অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপরে বলল, “খবরদার–রাজু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, “ভয় নাই। লাফ দেব না।”

“গুড।” টুনিও হাসার মতো চেষ্টা করে বলল, “তুই যে আমাকে কথাগুলো বলেছিস সেজন্যে তোকে থ্যাংকু।”

“সবাই বলে তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি–”

টুনি মাথা নেড়ে বলল, “না না। আমার মাথায় মোটেও অনেক বুদ্ধি না। চৌবাচ্চার অঙ্কটা কীভাবে শুরু করব তার মাথা-মুণ্ড পর্যন্ত আন্দাজ করতে পারছি না। তুই যখন করবি তখন আমাকে বলিস।”

রাজু বলল, “লেখাপড়ার বুদ্ধি এক রকম আর আসল বুদ্ধি অন্যরকম। দুইটার মাঝে কোনো সম্পর্ক নাই।”

রাজু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তারপর বলল, “তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি, তুমি আমাকে বলবে আমি কী করব?”

টুনির রাজুর জন্যে খুব কষ্ট হলো। সে এখন তাকে কী বলবে? জিজ্ঞেস করল, “এখন তুই কী করিস?”

“কানে আঙুল দিয়ে ঘরে বসে থাকি। আগে জোর করে লেখাপড়া করতাম এখন আর লেখাপড়া করার ইচ্ছা করে না।”

টুনি বলল, “আমি আসলে তো কখনো এরকম অবস্থায় পড়ি নাই, এরকম কিছু দেখি নাই তাই ঠিক কী করতে হয় সেটা জানি না। তবে আমার মনে হয় তুই যেটা করছিস সেটা ঠিকই করছিস।”

“কী করছি?”

“এই যে আমাকে বলছিস।”

“বললে কী হয়?”

“আমি শুনেছি, মনে কষ্ট থাকলে সেটা নিয়ে আরেকজনের সাথে কথা বললে কষ্ট কমে।”

রাজু কিছু না বলে টুনির দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “শুধু একটা ব্যাপার।”

“কী ব্যাপার?”

“আমি তোকে তুই করে বলছি আর তুই আমাকে তুমি করে বলছিস!”

রাজু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমি কাউকে তুই করে বলতে পারি না।”

“চেষ্টা করে দেখ। খুবই সোজা।”

“কীভাবে চেষ্টা করব?”

টুনি বলল, “তুই আমাকে বল, তুই একটা গাধা।”

“তোমাকে গাধা বলব?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু তুমি তো গাধা না।”

“এত প্যাচালে হবে না। বলে ফেলতে হবে। তাহলে এভাবে বল, “চৌবাচ্চার এই সোজা অঙ্কটাও পারিস না? তুই একটা গাধা।”

রাজু মুখটা হাসি হাসি করে টুনির দিকে তাকাল, তারপর বলল, “চৌবাচ্চার এই সোজা অঙ্কটাও পারিস না? তুই একটা গাধা।”

টুনি বলল, “গুড! দেখলি কত সোজা। এবারে আরেকটা কিছু বল।”

“বলব?”

“হ্যাঁ।”

রাজু বলল, “তুই প্লিজ আমার কথা ক্লাসে আর কাউকে বলিস না তাহলে আমার খুব লজ্জা লাগবে।”

টুনি বলল, “মাথা খারাপ? আমি ক্লাসে কাউকে বলব না।”

.

টুনি ক্লাসে কাউকে বলল না কিন্তু বাসায় গিয়ে ব্যাপারটা অনেকের সাথে আলোচনা করল। যেকোনো বড় সমস্যা হলে প্রথমেই ঝুমু খালার সাথে আলাপ করে, এবারেও তাই করল। তাকে সবকিছু খুলে বলার পর জানতে চাইল, এখন কী করা উচিত।

।ঝুমু খালার উত্তর দিতে এক সেকেন্ড দেরি হলো না। চোখে-মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “জরিনি বেওয়ার পান পড়া। একটা পান পড়া খেলেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিল-মহব্বত ফিরে আসবে। আমাদের গ্রামে কাজেম আলী মোল্লার ছিল দুই বউ। বড় বউ একদিন—”

টুনি ঝুমু খালাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, তোমার মনে নাই আমি তোমাদের গ্রামে গিয়েছি? জরিনি বেওয়ার সাথে কথা বলেছি? জরিনি বেওয়া নিজে আমাকে বলেছে তাবিজ-কবজ-পান পড়া বলে কিছু নাই”

ঝুমু খালা মোটেও দমে গেল না। হাত পা নেড়ে বলল, “তোমার মতো ছোট মেয়েরে আর কী বলবে? জরিনি বেওয়ার যে পোষা জীন আছে সেইটা কী তোমারে বলছে? বলে নাই। সত্যি কথা বললে তোমাগো দাঁত কপাটি লাগব না?”

টুনি বলল, “তাবিজ-কবজ-পান পড়ার কথা ভুলে যাও। অন্য কিছু করা যায় কী না বল।”

“এই হলো তোমাগো সমস্যা। চাইর পাতা বই পড়ে মনে করে দুনিয়ার সবকিছু জেনে গেছে। সবকিছু অবিশ্বাস কর। তাবিজ-কবজ মানতে চাও না।”

টুনি ধৈর্য ধরে ঝুমু খালার বক্তৃতা শুনল, বক্তৃতা শেষে ঝুমু খালা আরেকটা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করল, বলল, “নতুন যে হিন্দি সিরিয়ালটা শুরু হইছে জিগি জিগি পেয়ার সেইখানে এইরকম একটা ঘটনা আছে। নায়িকার ব্লাড ক্যান্সার। হাসপাতালে নিছে–”

টুনি বুঝতে পারল ঝুমু খালাকে দিয়ে হবে না। তখন সে গেল ছোটাচ্চুর কাছে। সবকিছু শুনে ছোটাচ্চু বলল, “দুইজন যখন কমিটমেন্ট করে তখন যদি পারস্পরিক সম্মানবোধ না থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে প্রেসক্রিপশনার ফর ডিসাস্টার। আমি তো বুঝতেই পারি না একজন বড় মানুষ ঝগড়া করে কেমন করে?”

টুনি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি বুঝতে পার না? মনে আছে যখন তুমি আর ফারিহাপু ঝগড়া করে কথাবার্তা বন্ধ করে দিলে? আমরা যদি তখন–”

ছোটাচ্চু লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে সেটা তো ছিল খুবই হাস্যকর একটা ব্যাপার–”

“মোটেও হাস্যকর ছিল না। এখন তুমি বল আমি আমাদের ক্লাসের ছেলেটাকে কী করতে বলব?”

ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “হলিউডের একটা সিনেমা দেখেছিলাম, সেখানে একটা মেয়ে তার বাবা আর মায়ের মাঝে মিল করে দিয়েছিল।

“কীভাবে?”

“অনেক জটিল কাহিনি এখন ভুলে গেছি।”

টুনি বুঝল ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলে লাভ নাই। ছোটাচ্চু এখনো বিয়েও করে নাই। আগে বিয়ে করুক তারপর বউয়ের সাথে ঝগড়া করুক তারপর দেখা যাবে।

তখন টুনি তার দাদির (কিংবা নানির) সাথে কথা বলল। সবকিছু শুনে দাদি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললেন, “আহারে! এই টুকুন বাচ্চা ছেলের মনে কী কষ্ট। যদি স্বামী-স্ত্রী এইভাবে বাচ্চার সামনে ঝগড়া করে তাহলে তো মুশকিল। ডিভোর্স না হয়ে যায়। ডিভোর্স হলে বাচ্চাটার কী হবে?”

দাদি অনেকক্ষণ আহা উঁহু করলেন, তারপর বললেন, “চেষ্টা করে দেখ মা’টাকে আমাদের বাসায় আনা যায় নাকি। আমি তাহলে মাথায় হাত বুলিয়ে একটু বুঝিয়ে দেখি।”

টুনি বুঝতে পারল দাদির বুদ্ধিটাও কাজ করবে না। রাজুর মা’কে সে কেমন করে বাসায় আনবে? আর সমস্যা কী শুধু তার মায়ের? তার বাবারও নিশ্চয়ই সমস্যা আছে।

তখন টুনি তার আম্মুর সাথে কথা বলল। আম্মু বেশ অবাক হয়ে টুনির কথা শুনলেন। তার ছোট মেয়েটার যে বড় মানুষদের সমস্যা নিয়েও মাথা ঘামাতে হচ্ছে সেটা দেখে আম্মু খুব অবাক হলেন না। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেন মেয়েটা একটু অন্যরকম।

টুনির কথা শেষ হবার পর আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছে আমি সবকিছু শুনলাম। এখন?”

“এখন তুমি বল রাজু কী করবে?”

“তোর কী ধারণা রাজুর কিছু একটা করার আছে যেটা করলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”

টুনি মাথা চুলকালো, বলল, “না, মানে–”

“দোষটা কী রাজুর? সে কি কিছু একটা দোষ করেছে যে জন্যে তার আব্বু আম্মু এরকম হয়ে গেছে?”

“না। তা নয়।”

“তাহলে ছেলেটা কী করবে? কিছু যদি করতে হয় তাহলে সেটা করবে তার বাবা-মা। ছেলেটার সামনে ঝগড়াঝাটি করা বন্ধ করবে।”

টুনি আবার মাথা চুলকাল। আম্মু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখ, হাজব্যান্ড আর ওয়াইফের মাঝে মিলমিশ না হওয়াটা এমন কিছু অস্বাভাবিক না। সেজন্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়-আমেরিকার অর্ধেক বিয়ে ডিভোর্স হয়ে যায়। আমাদের দেশে আগে মেয়েরা সহ্য করত সেইজন্যে বিয়ে ভাঙতো না, আজকাল এতো সহ্য করে না। ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন এদেশেও ডিভোর্স হলে সমস্যাটা কী হয় জানিস?”

“কী?”

“যদি ছোট বাচ্চা-কাচ্চা থাকে তাহলে এই বাচ্চাগুলো মনে করে দোষটা তাদের। তারা কিছু একটা ভুল করেছে সেই জন্যে বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছে।”

“তাহলে রাজুর কিছু করার নাই?”

“আমি তো কিছু চিন্তা করে পাই না। তুই তার ভালো বন্ধু হয়ে থাকিস যেন তোর কাছে এসে দুঃখের কথাগুলো বলতে পারে। কাউকে দুঃখের কথা বললে মনটা হালকা হয়—”
.

কাজেই টুনি রাজুর ভালো বন্ধু হওয়ার জন্য চেষ্টা করে গেল। দেখা হলেই মুখ হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করে, “রাজু, তোর খবর কী?”

রাজু বেশির ভাগ সময় উত্তর দেয়, “নূতন কোনো খবর নাই।”

“লেখাপড়া শুরু করেছিস।”

“নাহ্।”

“শুরু করে দে, না হলে আমরা বিপদে পড়ব।”

“তোমাদের কী বিপদ?”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু উঁহু হলো না।”

“কী হলো না।”

“তোমাদের বলা যাবে না। ঠিক করে বল।”

“ও আচ্ছা।”

রাজু তখন ঠিক করে বলে, “তোদের আবার কী বিপদ?”

“স্যার ম্যাডাম যখন ক্লাসে কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কেউ উত্তর দিতে না পারলে কেমন রেগে যায় দেখিস না। তুই উত্তর দিয়ে আমাদের বিপদ কাটিয়ে দিবি।”

রাজু হাসার ভঙ্গি করে বলে, “ও আচ্ছা।”

টুনি আরো কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথা বলে, নিজ থেকে তার আব্বু আম্মুর কথা জিজ্ঞেস করে না। রাজুও কিছু বলে না। টুনি অবশ্যি রাজুকে চোখে চোখে রাখে। তাদের ক্লাস একতলায় কিন্তু রাজুকে প্রায়ই দেখা যায় দুই-তিন তলায় ঘোরাঘুরি করে। ছুটির ঘণ্টা পড়ার পর সবাই চিৎকার করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায় শুধু রাজুকে দেখা যায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে যেন বাসায় যাবার কোনো তাড়া নেই।

একদিন রাজু এসে টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “টুনি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“উঁহু। হলো না হলো না।”

রাজুর তখন মনে পড়ে, সে একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“কী কথা?”

“ভূত বলে কী কিছু আছে?”

টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “ভূত?”

“হ্যাঁ।”

“তোর ভূত নিয়ে মাথা ব্যথা কিসের জন্যে? ভূত থাকবে কোথা থেকে?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “আমারও তাই মনে হয়, ভূত নাই। কিন্তু মাহতাব চাচা এমনভাবে বলে যে মনে হয় ভূত আছে।”

মাহতাব চাচা তাদের স্কুলের গার্ড, তার সাথে রাজুর ভূত নিয়ে আলোচনা কেন হচ্ছে টুনি বুঝতে পারে না। টুনি ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই মাহতাব চাচার সাথে জিন-ভূত নিয়ে আলাপ করছিস, ব্যাপারটা কী?”

রাজু কেমন যেন একটু লজ্জা পেল। আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে এইতো–”

টুনি জিজ্ঞেস করল, মাহতাব চাচা ভূত নিয়ে ঠিক কী বলেছে? কোথায় ভূত দেখেছে?”

“এইতো আমাদের স্কুলে। রাত্রে বেলা এইখানে নাকি ভূত দেখা যায়।”

“সত্যি?” টুনি চোখ বড় বড় করে বলল, “কী রকম ভূত?”

রাজু বলল, “ছায়ার মতন। বারান্দা দিয়ে হাঁটে। জানালা খুলে বন্ধ করে।”

টুনি বলল, “কী মজা। একটা যদি কোনোমতে ধরে ফেলতে পারি চিন্তা করতে পারিস কী মজা হবে? শিশিতে ভরে পকেটে করে বাসায় নিয়ে যেতাম। পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখতাম।”

রাজু বলল, “ভূত শিশিতে আটবে?”

“আটবে না কেন। চিপে চুপে ঢুকিয়ে ফেলব।”

টুনি একটা ভূতকে চিপে চুপে একটা শিশিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে দৃশ্যটা চিন্তা করে রাজু একটু হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, “তাহলে তুই ভূত বিশ্বাস করিস না?”

“ভূতের গল্প বিশ্বাস করি। ভূতে করি না।”

“তোকে যদি কেউ বলে এই স্কুলে রাত্রের বেলা একা একা থাকতে হবে তাহলে থাকতে পারবি?”

“কেউ যদি বাজি ধরে তাহলে চেষ্টা করতে পারি, তা না হলে কেন খামোখা রাত্রে এই স্কুলে থেকে মশার কামড় খাব? দিনের বেলাতেই এইখানে থাকতে অসহ্য লাগে, আবার রাত্রে?”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস। স্কুলে অসহ্য লাগে।”

.

কয়দিন পর টুনি দুপুর বেলা বারান্দায় বসে অন্যদের ছোটাচ্চুটি করে খেলতে দেখছে তখন রাজু এসে তার পাশে বসল। বলল, “চৌবাচ্চার অঙ্কটা করেছি।”

টুনি খুশি হয়ে বলল, “করেছিস? গুড। আমাকে দেখিয়ে দিস কীভাবে করতে হবে। আমি বুঝি না কেন একটা অঙ্ক এরকম প্যাচিয়ে দিতে হবে। সোজাসুজি দিতে সমস্যা কী?”

“সোজাসুজি দিলে সেইটা হিসাব। যোগ-বিয়োগ আর গুণ-ভাগ। প্যাচিয়ে দিলে সেইটা অঙ্ক।” রাজু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু তোর মাথায় তো অনেক বুদ্ধি তুই অঙ্ক করতে চাস না কেন?”

টুনি দেখল আজকাল রাজুকে আর তুই করে বলার কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে না নিজেই তুই করে বলছে। টুনি বলল, “আসলে বুদ্ধি নাই সেজন্যে।”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “আসলে তুই বুদ্ধিটা এখানে সেখানে খরচ করতে চাস না। আসল বুদ্ধির জায়গায় খরচ করতে চাস, তাই না?

টুনি হাসল, বলল, “আসল বুদ্ধির জায়গা কোনটা?”

“যেমন মনে কর–” রাজু মুখটা সুচালো করে কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “মনে কর একটা তালাকে এমন কিছু করতে চাই যেন সেইটা আর কাজ না করে–তাহলে কী করতে হবে?”

“কাজ না করে মানে কী? তালা বন্ধ হবে না, নাকি তালা খুলবে না?”

“তালা বন্ধ হবে না।”

“কেন?”

রাজু উত্তর দিল না, ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “এমনি।”

টুনি বলল, “সবচেয়ে সোজা হচ্ছে চিউয়িংগাম খেয়ে সেইটা তালার গর্তে ঠেলে ভর্তি করে রাখা–তাহলে আর বন্ধ করতে পারবে না।”

রাজু অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটু হেসে বলল, “এত সোজা।”

“একটা জিনিস নষ্ট করা সবসময় সোজা। ঠিক করা হচ্ছে কঠিন।”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “তোর মাথায় আসলেই অনেক বুদ্ধি।”

টুনি হাসল, বলল, “এইগুলো আসল বুদ্ধি না। এইগুলো হচ্ছে দুষ্টু বুদ্ধি।”

“তোর মাথায় নিশ্চয়ই ভালো বুদ্ধিও আছে। দেখি পরীক্ষা করে।”

“কীভাবে পরীক্ষা করবি?”

“মনে কর একজন বেশ কয়েকদিনের জন্য এডভেঞ্চারে যাবে, যেখানে কোনো খাওয়া-দাওয়া পাওয়া যায় না। তাহলে তার সাথে কী নিয়ে যেতে হবে যেন না খেয়ে থাকতে হয় না।”

টুনি উত্তর না দিয়ে চশমার ভেতর দিয়ে সরু চোখে রাজুর দিকে তাকাল, বলল, “তুই বাড়ি থেকে পালাবি?”

রাজু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না–”

“তাহলে–?”

“এমনিই জিজ্ঞেস করছি। এমনি”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “এমনি কেউ এগুলো জিজ্ঞেস করে না। সত্যি করে বল, তুই বাড়ি থেকে পালাবি?”

“না। আমি বাড়ি থেকে পালাব না।” “তাহলে কেন এটা জিজ্ঞেস করছিস?”

“তোর বুদ্ধি টেস্ট করার জন্য। ঠিক আছে তোর বলতে না চাইলে বলতে হবে না।”

“এটা বুদ্ধি টেস্ট করার কিছু না। এর মাঝে কোনো বুদ্ধি নাই। এটা জানার বিষয়।”

“ঠিক আছে।” রাজু মেনে নিল। বলল, “তুই জানলেও তোর বলতে হবে না।”

“আমি খুব বেশি জানি না, কিন্তু দাদির কাছে শুনেছি সেভেন্টি ওয়ানে সবাই যখন বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছিল তখন সাথে নিত চিড়া।”

“চিড়া?”

“হ্যাঁ। শুধু চিড়া। খিদে লাগলে চিবিয়ে একটু খেয়ে নিলেই পেট ভরে যেত। এজন্যে বলে শুকনো চিড়া পেট ভরে খেতে নেই। এটা নাকি পেটে গিয়ে ফুলে যায়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ, চিড়া শুকনা, নষ্ট হতো না। দিনের পর দিন রাখা যেত।”

“ইন্টারেস্টিং।”

“আজকাল অবশ্যি আরো অনেক কিছু বের হয়েছে। হাই প্রোটিন বিস্কুট। প্যাকেট দুধ। হাই এনার্জি ড্রিংক।”

“চিড়াই ভালো। একেবারে সহজ সরল।”

টুনি আবার চশমার ভেতর দিয়ে সরু চোখে তাকাল, বলল, “দেখ, রাজু, খবরদার তুই বাসা থেকে পালানোর চেষ্টা করবি না। রাস্তা-ঘাট কিন্তু খুব ডেঞ্জারাস। ভয়ানক কোনো বিপদে পড়ে যাবি।”

রাজু মুখ শক্ত করে বলল, “আমি নিজেকে কোনো বিপদে ফেলব না।”

“খোদার কসম?”

“আমি এই সব কিরা-কসমে বিশ্বাস করি না। কিন্তু তুই যদি সত্যি শুনতে চাস তাহলে বলব।”

“বল।”

“খোদার কসম। আমি নিজেকে কোনো বিপদে ফেলব না।”

টুনি সরু চোখে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল।

.

একদিন সরকারি ছুটি, একদিন স্কুল ছুটি তার সাথে শুক্র-শনিবার মিলে পরপর চারদিন স্কুল ছুটি। যখনই এরকম কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যায় তখন সেই ছুটিতে কোথায় যাওয়া হবে কী করা হবে সেটা নিয়ে নানারকম আলোচনা হয় কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। এবারে যেরকম সবাই মিলে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে শান্ত খবর আনল চিড়িয়াখানায় নতুন এক ধরনের বানর আনা হয়েছে। সেগুলোকে বিশেষ ধরনের শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানোর কথা, কিন্তু সেই শ্যাম্পু পাওয়া যাচ্ছে না বলে বানরকে গোসল করানো যাচ্ছে না এবং সেই কারণে পুরো চিড়িয়াখানায় বিকট দুর্গন্ধ। এই বর্ণনা শুনে অনেকেই পিছিয়ে গেল বলে শেষ পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় যাওয়া হলো না। তারপর ঠিক করা হলো সবাই মিলে নাটক দেখতে যাবে। কোন নাটক দেখা হবে সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হওয়ায় সেটাও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেল। তখন ঠিক করা হলো শপিং মলে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়া হবে। সেজেগুঁজে যখন সবাই বের হবে তখন টুম্পা হড় হড় করে বমি করতে লাগল। আইসক্রিম খাওয়াতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ টুম্পার, কাজেই তাকে ছাড়া তো আর যাওয়া যায় না কাজেই এই প্রোগ্রামটাও বাতিল করতে হলো এবং সে কারণে সবাই কয়েকদিন থেকে বাসায়।

ছুটির তৃতীয় দিন রাত্রি বেলা বাসায় দুজন গেস্ট এলেন। তারা স্বামী-স্ত্রী, চেহারা দেখেই মনে হয় তাদের ওপর দিয়ে বিশাল ঝড় বয়ে গিয়েছে। কেউ বলে দেয় নাই তারপরেও দরজা খুলেই টুনি বুঝতে পারল এরা হচ্ছেন রাজুর বাবা-মা এবং রাজু তার কথা রাখে নাই, সে বাসা থেকে পালিয়েছে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা টুনিকে দেখে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “মা, তুমি নিশ্চয়ই টুনি। আমার রাজু কোথায় তুমি জান?”

অন্য যে কেউ হলে তার পুরো বিষয়টা বুঝতে অনেক সময় লাগত, টুনির কথা আলাদা তার বুঝতে এক সেকেন্ড দেরি হলো না। রাজু বাসা থেকে পালিয়েছে, রাজুর বাবা-মা তার স্কুলের ছেলেমেয়ে আর টিচারদের কাছে খোঁজখবর নিয়েছে। গত কিছুদিন থেকে রাজু টুনির সাথে নিরিবিলি কথাবার্তা বলেছে সেটা নিশ্চয়ই অনেকে লক্ষ করেছে। তারা টুনির নাম বলেছে তাই বাবা মা টুনির কাছে চলে এসেছেন।

টুনি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই মা হাঁটু গেড়ে বসে টুনিকে দুই হাতে ধরে ফেললেন তারপর প্রায় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “মা, তুমি জান আমার রাজু কোথায়? জান?”

“না। জানি না। কিন্তু–কিন্তু—”

“কিন্তু কী?”

“আমি আন্দাজ করতে পারি”

মা প্রায় চিৎকার করে বললেন, “তাহলে আন্দাজ করো। বল।”

টুনি রাজুর আম্মুর হাত ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি আগে একটু শান্ত হয়ে বসেন। আমাকে একটু চিন্তা করতে হবে।”

বসার ঘরে হই-চইয়ের শব্দে বাসার প্রায় সবাই চলে এসেছে। সবার সামনে ঝুমু খালা তার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সে তার বক্তৃতা শুরু করে দেবে। ছোটদের অনেকেই বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে, তারা একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে। বড়দেরও অনেকে এসেছে, ছোটাচ্চু বাচ্চাদের শান্ত করার চেষ্টা করল, ধমক দিয়ে বলল, “তোরা চুপ করবি? শুনি কী হয়েছে।”

টুনি সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে আন্টি আর আংকেল। আমাদের ক্লাসের যে ফার্স্টবয় রাজু, তার আম্মু আর আব্বু। আমার সাথে একটু কথা বলতে এসেছেন।”

বাচ্চারা সব কিছু বুঝে ফেলার মতো ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। শান্ত বলল, “ফার্স্টবয়! উরে বাপরে বাপ।”

টুনি বলল, “আমি আন্টির সাথে আর আংকেলের সাথে একা একা কথা বলব, তোমরা সবাই যাও।”

কেউ চলে যাবার নিশানা দেখাল না। তখন ছোটাচ্চু সবাইকে ঠেলে বের করে দিতে থাকে। ছোট-বড় সবাই বের হয়ে যাবার পর টুনি জিজ্ঞেস করল, “আমাকে একটু বলবেন রাজু কখন বাসা থেকে চলে গেছে।”

“পরশু দিন স্কুলে গেছে, তারপর আর বাসায় আসে নাই।”

“রাজু কী যাওয়ার আগে আপনাদের কোনো চিঠি লিখে গেছে।”

রাজুর আম্মু আর আন্ধু একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন, তারপর দুজনের অস্বস্তিতে নড়ে-চড়ে বসলেন। রাজুর আম্মু নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আব্বু একটু গলা পরিষ্কার করে বললেন, “ইয়ে মানে একটা চিঠির মতো কিছু একটা লিখে গেছে। তার ঘরে পড়ার টেবিলের ওপর ছিল।”

“কী লিখেছে চিঠিতে?”

রাজুর আব্বু আবার একটু কাশলেন, তারপর মাথা চুলকালেন তারপর বললেন, “লিখেছে মানে যেন মানে আমরা যেন ইয়ে–” কথা শেষ না করে রাজুর আব্বু থেমে গেলেন।

টুনি বুঝতে পারল, চিঠিটায় কী লিখেছে বলতে লজ্জা পাচ্ছেন। টুনি তাই জিজ্ঞেস করল, “চিঠিটা সাথে আছে?”

রাজুর আব্বু আবার রাজুর আম্মুর দিকে তাকালেন তারপর রাজুর আম্মু তার ব্যাগ খুলে একটা চিঠি বের করে টুনির হাতে দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ছোট চিঠি। চিঠিতে লেখা :

প্রিয় আব্বু আর আম্মু :
আমি বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করে লাভ নেই, আমাকে তোমরা খুঁজে পাবে না। খুব ইচ্ছা করছে। কোনো একটা জায়গায় শান্তিতে কয়েকদিন থাকি যেখানে তোমরা দুজন দিন-রাত ঝগড়া করছ না। মাঝে মাঝে মনে হয় পাগল হয়ে যাব। তোমরা এরকম কেন? আমার জন্য অস্থির হয়ো না, নিজে থেকেই কোনো একদিন চলে আসব।
রাজু।

টুনি চিঠিটা ফেরত দিয়ে বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম।”

টুনির আম্মু জিজ্ঞেস করলেন “কী ভাবছিলে?”

“যে এইরকম কিছু একটা করে ফেলবে।”

“তোমার সাথে এইটা নিয়ে কথা বলেছে?”

“সরাসরি বলে নাই, কিন্তু তার কথা থেকে আন্দাজ করেছি।”

রাজুর আম্মু খপ করে টুনির হাত ধরে ফেললেন। ভাঙা গলায় বললেন, “আমার ছেলেটাকে বের করে দাও মা, প্লিজ। কোথায় আছে একা একা–”

টুনি বলল, “আন্টি, আংকেল, আপনারা এখন বাসায় যান। আমি দেখি। খুঁজে বের করে আপনাদের জানাব।”

এরকম সময় দরজা ঠেলে ঝুমু খালা একটা ট্রেতে চা-নাশতা নিয়ে ঢুকল। টেবিলে রেখে বলল, “একটু চা-নাশতা খান। আপনাদের দেখে মনে হয় কয়দিন কিছু খান নাই।”

“ছেলেটা হারিয়ে গেছে, খাব কেমন করে?”

“হারায়ে যায় নাই, পালায়ে গেছে। আপনাগো চিন্তার কারণ নাই, টুনি খুঁজে বের করে ফেলবে। টুনির মগজের মাঝে খালি ব্রেন।”

“ঝুমু খালা, মগজের ইংরেজি হচ্ছে ব্রেন।

ঝুমু খালা ধমক দিয়ে বলল, “সব কথার মাঝে তোমার একটা কথা বলার স্বভাব।”

ধমক খেয়ে টুনি চুপ করে গেল। কুমু খালা এবারে রাজুর আম্মুকে উপদেশ দিতে শুরু করল, “আফা, আপনাদের একটা কথা বলি। বাচ্চা জন্ম দিলেই কিন্তু দায়িত্ব শেষ না। বাচ্চারে ঠিক করে মানুষ করতে হয়। বাচ্চারে আদর করতে হয়। বাচ্চার সামনে যদি ঝগড়াঝাটি করেন–”

টুনি ঝুমু খালাকে থামানোর চেষ্টা করল, বলল, “ঝুমু খালা–”

ঝুমু খালা টুনিকে উল্টো একটা ধমক দিল, “আমি একটা কথা বলতেছি তুমি মাঝখানে ডিস্টার্ব দাও কেন?” তারপর ঘুরে রাজুর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চার সামনে ঝগড়াঝাটি করতে হয় না। বাচ্চার সামনে ঝগড়াঝাটি করলে বাচ্চা অমানুষ হয়ে যায়। আমাগো গ্রামে স্বামী-স্ত্রী বাচ্চার সামনে ঝগড়া করত, সেই বাচ্চা বড় হয়ে ডাবল মার্ডারের আসামি।”

টুনি এবারে রীতিমতো গলা উঁচিয়ে বলল, “ঝুমু খালা, আন্টি আর আংকেল এখন খুব টায়ার্ড। তারা বাসায় গিয়ে রেস্ট নেবেন। তার আগে আমার সাথে একটু কথা বলবেন।”

ঝুমু খালা চলে যাবার পর টুনি বলল, “আন্টি, আংকেল আপনারা কিছু মনে করবেন না। ঝুমু খালা সব সময় সবার সাথে এইভাবে কথা বলে।”

রাজুর আম্মু বললেন, “কিন্তু কথাটা তো ভুল বলে নাই। আসলেই আমরা তো রাজুর সামনেই ঝগড়াঝাটি করি। বুঝতে পারি নাই রাজুকে এইভাবে এফেক্ট করবে—”

টুনি বলল, “জী রাজুও বলেছে আমাকে। এত ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। খুব মন খারাপ করে থাকে।”

রাজুর আব্বু রাজুর আম্মুর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন, “আমি একশবার বলেছি ছেলেটার দিকে তাকাও, কিন্তু তোমার সময় নাই।”

রাজুর আম্মু দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিস হিস শব্দ করে বললেন, “কেন? আমাকেই কেন সব দেখতে হবে? তোমার কোনো দায়-দায়িত্ব নাই?”

রাজুর আব্বু হতাশ হবার ভঙ্গি করে বললেন, “এই যে, এই যে আবার শুরু করে দিলে।”

“আমি? আমি শুরু করেছি?”

টুনি অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এরকম অবস্থাতেও টুনির সামনে যদি দুজন ঝগড়া শুরু করে দেয় তাহলে বাসাতে নিশ্চয়ই দুজনে খুনোখুনি করে ফেলে। টুনির হঠাৎ করে রাজুর জন্য মায়া হতে থাকে।

রাজুর আব্বু-আম্মু সত্যি সত্যি ঝগড়া শুরু করে দেয়ার আগে টুনি তাদের থামানোর চেষ্টা করল। বলল, “আংকেল, আন্টি, আপনারা নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড। আপনারা একটু খেয়ে নেন, তারপর বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন। আমি রাজুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।”

“তুমি জান সে কোথায় আছে?”

“এখনো জানি না, কিন্তু মনে হয় বের করতে পারব।”

রাজুর আম্মু তখন আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন। টুনি কী করবে বুঝতে না পেরে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে একটু পরে আবার সবকিছু ভুলে গিয়ে দুজনে ঝগড়া করবেন। বড় মানুষেরা এরকম বোকা কেন?

.

রাজুর আব্বু-আম্মু চলে যাবার পর সবাই এসে টুনিকে ঘিরে ধরল। তারা জানালার পাশে বসে সবকিছু শুনেছে এখন আরো শুনতে চায়। কী হয়েছে জানতে চায়। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “ছেলেটা কোথায় আছে জানিস?”

ঝুমু খালা বলল, “নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়ি। এই বয়সী ছেলেরা বেশি দূর যাইতে পারে না।”

শান্ত বলল, “সেন্ট মার্টিনস। আমি যদি কখনো বাড়ি থেকে পালাই তাহলে সেন্ট মার্টিনস যাব। আগে থেকে বলে রাখলাম।”

টুম্পা বলল, “উঁহু। নিশ্চয়ই কোনো বন্ধুর বাসায় গেছে।”

টুনি বলল, “না। আমার মনে হয় স্কুলে লুকিয়ে আছে।”

সবাই এক সাথে চিৎকার করে বলল, “স্কুলে?”

প্রমি বলল, “ইয়া আল্লাহ। কী বোরিং। কেউ কখনো পালিয়ে স্কুলে যায়?”

টুনি ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছোটা, তুমি আমাকে একটু স্কুলে নিয়ে যাবে?”

সবগুলো বাচ্চা এক সাথে চিৎকার করে বলল, “আমিও যাব। আমিও যাব।”

টুনি বলল, “না, না, এটা নিয়ে মোটেও হইচই করা যাবে না। যদি জানাজানি হয় রাজু স্কুলে থাকছে–তার অনেক ঝামেলা হতে পারে।”

ছোটাচ্চু ভুরু কুচকে বলল, “তাহলে? তাকে খুঁজে বের করবি কীভাবে?”

“তুমি গার্ড চাচাকে একটু ব্যস্ত রাখবে আমি ভেতরে গিয়ে রাজুকে খুঁজে বের করে নিয়ে আসব।”

“আমি? আমি কীভাবে ব্যস্ত রাখব?”

“গার্ড চাচা বিশ্বাস করে আমাদের স্কুলে ভূত আছে। তুমি ভূত নিয়ে আলোচনা করতে পার।”

ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি! এই রাত্রে গার্ডের সাথে ভূত নিয়ে আলোচনা করব?”

“সমস্যা কী? ভান করবে তুমি সাংবাদিক।”

.

কাজেই ঘণ্টা খানেক পর দেখা গেল ছোটাচ্চু টুনিকে নিয়ে তাদের স্কুলে হাজির হয়েছে। টুনি একটু দূরে লুকিয়ে রইল তখন ছোটাচ্চু গিয়ে স্কুলের গেটে ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে একজনের গলার শব্দ শোনা গেল, “কে?”

ছোটাচ্চু বলল, “আমি।”

“আমি কে?”

ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে চিনবেন না। আমি একজন সাংবাদিক।”

এবারে স্কুলের গার্ড মাহতাব চাচা ভেতর থেকে তালা খুলে উঁকি দিল। ছোটাচ্চু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনার সাথে কথা আছে।”

“কী কথা?”

“ভেতরে এসে বলি। গেটে দাঁড়িয়ে বলা যাবে না।”

মাহতাব চাচা খানিকটা অনিচ্ছা এবং খানিকটা বিরক্তি নিয়ে গেট থেকে সরে দাঁড়াল। মাহতাব চাচা আবার গেটে তালা দিতে চাচ্ছিল তখন ছোটাচ্চু বলল, “তালা মারবেন না। খোলা থাকুক।”

“কেন?”

“আমার ফটোগ্রাফার সিগারেট কিনতে গেছে। সে আসবে।”

মাহতাব চাচা সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর বলল,

গেটের পাশে ছোট একটা ঘর, এখানে মনে হয় মাহতাব চাচা থাকে। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “এইটা আপনার ঘর?”

“হ্যাঁ।”

“আসেন, আপনার ঘরে বসি। একটু বসে কথা বলি।” বলে মাহতাব চাচাকে কোনো সুযোগ না দিয়ে তার ঘরে ঢুকে গেল এবং ঠিক তখন টুনি সুড়ৎ করে গেটটা একটু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে স্কুলের বিল্ডিংয়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছোটাচ্চু মাহতাব চাচার ছোট ঘরটার ভেতরে ঢুকে বলল, “আমি আসলে একটা নিউজ করতে চাই।”

“নিউজ?”

“হ্যাঁ। ভূতের ওপরে নিউজ।”

মাহতাব চাচা এইবারে একটু নড়ে চড়ে উঠল। “ভূতের ওপর?”

“হ্যাঁ।” ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি শুনেছি এই স্কুলটাতে নাকী ভূত আছে। এইটাতো অনেক পুরনো বিল্ডিং, পুরনো বিল্ডিংয়ে সবসময় ভূত থাকে। আপনি যেহেতু এইখানে রাতে থাকেন তাই জানতে চাইছিলাম আপনি কী রাতে কখনো কিছু দেখেছেন? শুনেছেন?”

মাহতাব চাচা বিড় বিড় করে কিছু একটা দোয়া পড়ে বুকে একটু থুতু ফেলল, তারপর গলা থেকে ঝুলে থাকা প্রায় ঢোলের মতো বড় একটা তাবিজকে হাত দিয়ে ধরে বলল, “আপনি ভুল শুনেন নাই। এই স্কুলে তেনাদের ভয় আছে।”

ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “তেনারা কারা? তারা কী করে?”

“তেনাদের নাম রাত্রে নিতে চাই না।”

“কিন্তু কী করে?”

“হাঁটে। সারারাত স্কুলের বারান্দা দিয়া হাঁটে।”

“দেখতে কী রকম?”

মাহতাব চাচা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সেইটা কবে কেডা? তারে কাছে থেকে কে দেখতে যাবে? আমার জানের মায়া নাই? কয়দিন থেকে মনে হয় উৎপাত বাড়ছে।”

ছোটাচ্চু ভুরু কুচকালো, জিজ্ঞেস করল, “উৎপাত বেড়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“কেমন করে বুঝলেন?”

“গতরাতে স্পষ্ট শুনলাম বাথরুমে ফ্লাশ করল।”

“ভূতে বাথরুমে ফ্লাশ করল? তার মানে ভূত বাথরুম করে? বড়টা নাকি ছোটটা?”

“কবে কেডা।”

মাহতাব চাচা বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি কী দেখতে গেছি নাকি? আমার জানের মায়া নাই?”

ছোটাচ্চু যখন মাহতাব চাচার সাথে এরকম একটা আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন টুনি স্কুলের বড় বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে চাপা গলায় ডাকে, “রাজু। এই রাজু। তুই কোথায়?”

টুনি একটা একটা ক্লাসঘরের সামনে দিয়ে হাঁটে। আবছা অন্ধকারে দরজার তালা পরীক্ষা করে। কোনো একটা তালা নিশ্চয়ই চিউয়িংগাম দিয়ে নষ্ট করে রেখেছে, সেই ঘরে রাজু আছে। সারাক্ষণ ঘরের ভেতরে বসে থাকবে কে বলেছে? হয়তো অন্ধকারে অন্য কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তাই টুনি হেঁটে যেতে যেতে চাপা গলায় ডাকে, “রাজু। এই রাজু। আমি টুনি। তোর ভয় নাই, বের হয়ে আয়। বের হয়ে আয়। কেউ জানবে না।”

তিন তালার ক্লাসরুমগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় চাপা অন্ধকার থেকে ছায়ার মতো একজন এগিয়ে এলো, এক মুহূর্তের জন্যে টুনি চমকে ওঠে, চাপা গলায় বলে, “রাজু?”

“হ্যাঁ। তুই এখানে কী করছিস?”

“তুই কথা রাখিস নাই। তুই আমাকে কথা দিয়েছিলি বাসা থেকে পালাবি না।”

“উঁহু।” রাজু চাপা গলায় বলল, “আমি বাসা থেকে পালাব না বলি নাই। আমি বলেছিলাম নিজেকে বিপদের মাঝে ফেলব না। আমি কোনো বিপদে পড়ি নাই। মশার কামড়ে কোনো বিপদ নাই।”

“আছে। ডেঙ্গু না হলে চিকুনগুনিয়া অনেক বড় বিপদ।”

“মশার কয়েল আছে।”

“ফাজলামি করবি না।” টুনি কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “কী খাচ্ছিস? চিড়া?”

“হ্যাঁ।”

“আর কিছু?”

“নাহ্।”

“সময় কাটাস কেমন করে?”

“দিনের বেলা বই পড়ি?”

“রাত্রে?”

“চিন্তা করি?”

“কী চিন্তা করিস?”

“এইতো। এইটা সেইটা।”

“মাহতাব চাচার ভূতের সাথে দেখা হয়েছে?”

“এখনো হয় নাই।” রাজু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “তুই এখানে এসেছিস কীভাবে? তোকে কে বলেছে?”

“তোর, আব্বু-আম্মু।”

“সত্যি? রাজুর গলার স্বরে কেমন যেন ঠাট্টার মতো শোনাল, “আমি ভেবেছিলাম এখনো হয়তো জানেই না যে আমি বাসায় নাই।”

টুনি বলল, “ফাজলামি করবি না। তোর আব্বু-আম্মু পাগলের মতো হয়ে গেছে।”

“তারা কোথায়? স্কুলে এসেছে?”

“না। আমি আনি নাই। বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছি তোকে খুঁজে পেলে জানাব।”

“ও।“

দুজন আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর টুনি নরম গলায় বলল, “চল, এখন যাই।”

“বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা করছে না।”

“ঠিক আছে তোর বাসায় যেতে হবে না। আমাদের বাসায় চল।”

“উঁহু। সবার সামনে লজ্জা করবে।”

“কোনো লজ্জা নাই। আমাদের বাসায় কোনো নরমাল মানুষ নাই। সব এবনরমাল। গেলেই বুঝতে পারবি। আয়।”

রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “যেতে চাই না।”

টুনি অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে রাজুর হাত ধরার চেষ্টা করল, বলল, “আয়। দুই দিন থেকে না খেয়ে আছিস। আমাদের বাসায় গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করে ভালো করে খাবি। ঝুমু খালা অসাধারণ রান্না করতে পারে।”

“ঝুমু খালা কে?”

“গেলেই দেখবি। আয়। তোর কোনো লজ্জা নাই। আমাদের বাসায় সবাই পাগল। সবাই তোর জন্যে অপেক্ষা করছে?”

“সবাই? আমার জন্য অপেক্ষা করছে?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“মনে হয় কেমন করে বাসা থেকে পালাতে হয় সেটা তোর কাছ থেকে শিখবে।”

এই প্রথম রাজু হেসে ফেলল।

একটু পরেই টুনি যেভাবে নিঃশব্দে ঢুকেছিল ঠিক সেভাবে নিঃশব্দে রাজুকে নিয়ে বের হয়ে এলো। মাহতাব চাচা টের পেল না কিন্তু ছোটাচ্চু চোখের কোনো দিয়ে ঠিকই লক্ষ করল। ছোটাচ্চু মাহতাব চাচার একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতার মাঝামাঝি ছিল, সেটাকে এবারে দ্রুত শেষ করে দিল। হাত তুলে মাহতাব চাচাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “থামেন থামেন।”

মাহতাব চাচা অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

“ভয় করছে।”

“ভয় করছে?”

“হ্যাঁ, এই দেখেন হাত-পা কাঁপছে।” ছোটাচ্চু বেশ জোরে জোরে তার হাত কাঁপাতে থাকল।

মাহতাব চাচা বেশ অবাক হয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। ছোটাচ্চু বলল, “আমি একলা থাকি, রাত্রে ভয় পেতে পারি। আরেকদিন দিনের বেলা এসে বাকিটা শুনব। আমার বন্ধুটা সিগারেট কিনে আসার কথা ছিল, সে আসল না। এখন একলা বাসায় যেতে হবে।”

“কেন আসল না?”

“মনে হয় ভয়ে। তার ভূতের অনেক ভয়।”

ছোটাচ্চু মাহতাব চাচাকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে এলো। ছোটাচ্চু চলে যাবার পর মাহতাব চাচার মনে হলো কোন পত্রিকায় কবে তার ভূত সংক্রান্ত ইন্টারভিউ ছাপা হবে সেটা জিজ্ঞেস করা হলো না।

.

রাজুকে বাসায় এনে টুনি তার আবু-আম্মুকে ফোন করে জানালো যে তাকে পাওয়া গেছে তবে আজকের রাতটা এই বাসাতেই কাটাবে। আম্মু রাজুর সাথে টেলিফোনে কথা বলতে চাইলেন, টুনি তখন রাজুকে টেলিফোনটা ধরিয়ে দিল। ওই পাশে তার আম্মু কী বললেন শোনা গেল না, এই পাশে রাজু অবশ্যি হু-হা ছাড়া আর কিছু বলল না। সে যখন সাবধানে চোখ মোছার চেষ্টা করল তখন সবাই সেটা না দেখার ভান করে সরে গেল।

রাজু গোসল করে শান্তর ঢলঢলে ঘুমের কাপড় পরে এলো। ঝুমু খালা তার জন্যে খাবার গরম করল। আলাদা করে গরম ভাত রান্না করল। ছোটাচ্চু একটা আইসক্রিমের প্যাকেট কিনে নিয়ে এলো। ডাইনিং টেবিলে সবাই রাজুর চারপাশে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে কে কীভাবে বাসা থেকে পালাবে এবং বাসা থেকে পালিয়ে কে কোথায় যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। বাসা থেকে পালিয়ে যাবার সময় সাথে কী কী নিতে হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হলো এবং পুরো সময়টা ঝুমু খালা এই ব্যাপারে সবাইকে নানা ধরনের উপদেশ দিতে থাকল।

রাজুকে স্বীকার করতেই হলো, টুনি তাকে একটুও বাড়িয়ে বলেনি, এই বাসার মানুষগুলো আসলেই পাগল, এবনরমাল!

সে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আহা, তার পরিচিত সবাই যদি এরকম এবনরমাল হতো।

<

Muhammed Zafar Iqbal ।। মুহম্মদ জাফর ইকবাল