টহলদার একটা কালো পুলিশ ভ্যান খুব শ্লথ গতিতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ধরে উত্তরমুখো এগিয়ে আসছে। হেডলাইটের সামনে ফুটপাথ ধরে দুজন মাতালকে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছে। একজন লম্বা, ফিট চেহারা। অন্যজন কিছু থলথলে। দুজনেই দৌড়োচ্ছ ল্যাং ল্যাং করে, টলোমলো পায়ে। পড়ছে, আবার উঠছে। পিছু ফিরে দেখছে বারবার। ভ্যানটা তাদের ঠিক তাড়া করছে না, কিন্তু অনুসরণ করছে। লেগে আছে আঠার মতো পিছনে।

হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশান্ত বলে, রোজ ন্যাকড়াবাজি! শালা, রোজ ন্যাকড়াবাজি! আমাদের পেয়েছেটা কী? আই ধ্রুব, আয় কেলো করি সেদিনের মতো।

লম্বাজন ধ্রুব। হাইড্র্যান্টের উঠে-থাকা ঢাকায় একটা হোঁচট খেয়ে খানিক দূর ভারসাম্যহীনভাবে পড়ো-পড়া হয়ে গিয়েও দাঁড়ায়। কোমরটা চেপে ধরে বলে, মাইরি! মাইরি! রোজ পিছনে ভূতের গাড়ি! আর পারা যায় না।

অনেক রাত। ফাঁকা রাস্তায় হকারদের উঠে-যাওয়া অস্থায়ি দোকানপাটের ইট পড়ে আছে ফুটপাথে। প্রশান্ত একটা ইট তুলে নিয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, ঝাড়ব?

কেস খারাপ হয়ে যাবে। সেদিনের কথা মনে নেই?

আজ ফুটো করে দেব। দেব?

দাঁড়া, একটু ভাবি।

গাড়িটা কিছু দূরে হেডলাইট জ্বেলেই দাঁড়িয়ে আছে। তারা দৌড়োলে আবার পিছু নেবে।

ধ্রুব সেদিকে চেয়ে বলল, এটা পুলিশের ভ্যান নয়।

তা হলে?

এটা মাইরি ভূতের গাড়ি।

তোর বাপের মাথা। দুটো ইট ঝাড়, ভাগবে।

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, কালুর দোকানে হুটোপাটা করাটা আজ ঠিক হয়নি।

আলবাত ঠিক হয়েছে। শালা মাল বেচে খায়, তার আবার টাইম লিমিট কীসের? বারোটার পর সেল ক্লোজড, ইয়ার্কি পেয়েছে?

তা বলে ভাঙচুর করবি? সিভিলাইজেশন নেই?

আমি তো সেকথাই কালুকে বললুম, ঘর থেকে বার করে দিচ্ছিস, এটা কোন দেশি ভদ্রতা! বল, প্রথমে আমি রং দেখিয়েছি? ওই শালাই তো রং নিচ্ছিল।

ক্ষমাও তো করতে পারতি!

ক্ষমা?–প্রশান্ত একটু বেকুব বনে চেয়ে থাকে। তারপর জিভে চুক চুক দুটো শব্দ করে বলে, ইস শালা, তখন কথাটা মাথায় আসেনি মাইরি। অথচ দ্যাখ ধু-ধ্রুব, আমি শালা লোককে ক্ষমা করতে কত ভালবাসি। হাজার হাজার লোককে রোজ ক্ষমা করে দিচ্ছি শালা, আর কালুটাকে পারলুম না! এঃ!

ধ্রুব কিছু গম্ভীর হয়ে বলে, কোথায় আমাদের একটা গোলমাল হচ্ছে বল তো! রোজ গণ্ডগোল! একটা না একটা গণ্ডগোল। আর রোজ শালা পিছনে ভূতের গাড়ি।

এঃ। আমার দুগালে দুটো থাপ্পড় মারবি ধ্রুব? কেন শালা আমি রোজ ক্ষমা করতে ভুলে যাই বল তো! মারবি থাপ্পড়!

মারাই উচিত। তোর সঙ্গে মেশাও উচিত নয়।

প্রশান্ত একটু থতিয়ে যায়। ধরা ধরা গলায় বলে, তুইও ওর অনেকগুলো বোতল ভেঙেছিস। টেবিল চেয়ার উলটে ফেলেছিস।

সে তো তোরটা দেখে।

গাড়িটা সামান্য একটু এগিয়ে আসে।

প্রশান্ত বিস্ফারিত চোখে চায়। বলে, আসছে! ধু-ধ্রুব! দৌড়ো!

ইট মারবি না?

না, না। ক্ষমা! ক্ষমা! দৌড়ো!

পারবি না। গাড়ির সঙ্গে কোনও হিউম্যান বিয়িং দৌড়ে পেরেছে?

তা হলে?

ফেস কর। বিবেকানন্দ বলেননি, বর্বরদের মুখোমুখি হও!

কে?

গ্রেট ম্যান।

বিবেকানন্দ? কোথায় বলেছে বল তো!

কোথায় যেন।–বলতে বলতে ধ্রুব একটা ইট তোলে।

প্রশান্ত চাপা উত্তেজিত স্বরে বলে, মার! ফুটো করে দে! হুই-হুই-হু–ই-ই—

ধ্রুব ইটটা ছুড়তে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে উবু হয়ে পড়ে যায়। ইটটাও প্রায় তার সঙ্গেই পড়ে।

এঃ মিস।-বলে প্রশান্ত নিজের হাতের ইটটা খুব নিশানা করে ছুড়ে মারে। অদূরের হাইড্রান্টের জল ছিটকে ইটটা নিরাপদে অবতরণ করে।

গাড়িটা থেমে যায় ফের। সামনের দরজা খুলে একজন নামে। হেডলাইটের আলোর আড়ালে দাঁড়িয়ে নোকটা অনুচ্চ স্বরে বলে, ধ্রুববাবু, হাল্লা মাচাচ্ছেন কেন? বাড়ি যান।

প্রশান্ত চোখ মিটমিট করে গাড়ির আলোর দিকে চেয়ে থেকে বলে, বাড়ি যাব কি না তাতে ওর বাবার কী?

ধ্রুব ওঠে। কাঁকালে হাত দিয়ে একটা ব্যথার শব্দ করে বলে, বাড়ি যেতে বলছে?

বলছে। বাট দ্যাট ইজ নট হিজ বিজনেস। মার ইট। রোজ পিছু নেওয়া! রোজ ন্যাকড়াবাজি! দে ফুটো করে।–বলতে বলতে আর-একটা ইট তোলে প্রশান্ত।

ধ্রুব কর্তৃত্বের একটা হাত তুলে বলে, দাঁড়া, কী হয়েছিল যেন কালুর দোকানে! হাল্লাবাজি?

ও মালের আড্ডায় একটু-আধটু হয়। কালু শালা মাল বেচে খায়, ওর অত ন্যাকড়া কীসের? ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, আজ আমাদের মাল খাওয়ার কথা ছিল না। কাল আমরা প্রমিস করেছিলাম, আজ মাল খাব না।

আজকের কথা হয়নি। কথা ছিল, হপ্তায় একদিন বাদ দেব। সেটা আজ হতে পারে, কাল হতে পারে, পরশু হতে পারে।

আজকের কথাই হয়েছিল। আজ ড্রাই ডে না?

আজ! ওফ, মনেই ছিল না মাইরি! ইস, ছিঃ ছিঃ!

ওই ভূতের গাড়িটার দোষ নেই। ক্ষমা করে দে।

দেব? মাইরি?

দে। ক্ষমার মতো জিনিস নেই।

প্রশান্ত হাতের ইটটা ফেলে দেয়। গাঢ় স্বরে বলে, ক্ষমার মতো জিনিসই হয় না। আমি রোজ হাজার হাজার লোককে ক্ষমা করি। যেদিন কাউকে ক্ষমা করতে ভুলে যাই সেদিন ভাল করে খেতে পারি না, ঘুমোত পারি না, মাল খেলেই কান্না পায়। তোর?

আমারও ওসব হয়। সকলের হয়।

হবেই। ক্ষমা করতে আমি এত ভালবাসি যে, মাঝে মাঝে নিজেকেও ক্ষমা করে দিই।

বহুত মাতলামি করছিস প্রশান্ত! আজ ব্যাপারটা শুরু হল কী করে বল তো!

কোন ব্যাপারটা?

আমাদের মাল টানাটা! উই ব্লাক দা প্রমিস, কী করে শুরু হল?

নার্সিংহোম থেকে। তোর বাচ্চাটা অপয়া। দারুণ অপয়া।

আমার বাচ্চা!–বলে ধ্রুব ভ্রু কোচকায়, তারপর ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে, আমার বাচ্চা! হাঃ হাঃ–

প্রশান্ত সন্দেহের গলায় বলে, তোরই তো! ঠিক বলিনি?

দূর শালা! তোকে একটা কথা বলে রাখি। তোকে বলেই বলছি। বাচ্চাটা আমার নয়।

তবে কার?

অত আমি জানি না। তবে লাস্ট টু ইয়ারস আমি বউয়ের সঙ্গে শুইনি।

মাইরি বলছিস?

মাইরি।

সামনের মোড়ে আর-একটা জিপগাড়ি বাঁক ফেরে এগিয়ে এসে ভ্যানটার পিছনে থামে। দু-একজন লোক নামে। কিন্তু ভ্যানটার হেডলাইট এখনও জ্বলছে বলে কাউকে দেখা যায় না।

একটু অপেক্ষা করে ধ্রুব আর প্রশান্ত।

ভ্যানের কাছ থেকে একজন চেঁচিয়ে বলে, ধ্রুববাবু।

প্রশান্ত আবার ফেলে-দেওয়া ইটটা তোলে। বলে, শালারা বহুত ভ্যানতারা করছে।

ধ্রুব হাত তুলে প্রশান্তকে থামায়। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য লোকটার উদ্দেশে বলে, কেন ঝুটমুট ঝামেলা করছেন? আমরা কিছু করিনি।

লোকটা হেঁড়ে গলায় বলে, বাড়ি যাবেন, না ধরে নিয়ে যাব?

ধ্রুব কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখটা বিকৃত করে একটু। তারপর বলে, যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি।

হেডলাইটের আড়াল থেকে লোকটা আবার বলে, আপনার বাবা একটু আগেই থানায় টেলিফোন করেছিলেন। বলেছেন, এমনিতে না গেলে হাসপাতালে গিয়ে পাম্প করে পেট থেকে মাল বের করে তারপর ভ্যানে করে পৌঁছে দিতে।

ধ্রুব বলে, যাচ্ছি। কিছু করতে হবে না। আপনারা ডিউটিতে যান।

লোকটা নাছোড়বান্দা। বলে, যাচ্ছি বললে হবে না। আপনি ভ্যানে এসে উঠুন। আমরা পৌঁছে দেব।

ধ্রুব দুপা পিছিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে, ভ্যান লাগবে না। আমরা ট্যাকসি ধরে নেব।

তা হলে ধরুন। যতক্ষণ না ট্যাকসিতে উঠছেন ততক্ষণ আমরা ফলো করব। আমাদের ওপর স্ট্রিকট অর্ডার আছে।

প্রশান্ত বিড়বিড় করে বলে, তোর বাপটা বহুত খচ্চর। ভি আই পি আছে তো কী আছে? ছেলে বলে কি চাকর?

ধ্রুব চাপা স্বরে বলে, সিভিলাইজেশন বলে একটা কথা আছে প্রশান্ত। আজ আমরা খুব গণ্ডগোল করেছি।

মাল খায় তো লোকে একটু গণ্ডগোল করবে বলেই গুরু।

ধ্রুব গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলে, আজ গণ্ডগোলের দিন ছিল না। কালুর দোকানে হুটোপাটা করা ঠিক হয়নি।

হুটোপাটা হত না মাইরি। একটা কালো মতো রোগা মতো লোক আজ কালুর দোকানে বসে ছিল। ভেজা বেড়াল শালা। খুব নজর করছিল আমাদের।

বটে! ঠিক দেখেছিস?

খুব ঠিকসে দেখেছি গুরু। গায়ে একটা ফান্টুস জ্যাকেট ছিল। খুনিয়া রঙের জ্যাকেট। শেষদিকে ওই লোকটা কালুকে চোখ মারায় কালু ঝাঁপ ফেলে দিল।

ভূতের বাচ্চাটা কে বল তো!

পুলিশের খোঁচড় হবে। ধ্রুব একটা হাই তোলে। বলে, ঠিক আছে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। চল। লিন্ডসে স্ট্রিটে মোড় নিয়েই দুজনে দাঁড় করানো ট্যাকসি দেখতে পায়। ট্যাকসির সামনে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।

প্রশান্ত একটা হতাশার শ্বাস ফেলে বলে, অ্যারেনজমেন্ট! মাইরি, তোর সঙ্গে ফুর্তি করে সুখ নেই।

মুখটা একটু বন্ধ রাখবি বাবা? কনস্টেবলটা ট্যাকসির পিছনের দরজা খুলে ধরে। বলে, উঠুন। ড্রাইভারকে বলা আছে।

ধ্রুব একটু লজ্জিত মুখ করে গাড়ির ভিতরে গড়িয়ে চলে যায়। প্রশান্ত উঠবার আগে কনস্টেবলটার দিকে কটমট করে একটু চেয়ে থাকে। কনস্টেবল দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ট্যাকসি চলতে থাকে।

প্রশান্ত বুক-পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এ পকেট ও পকেট হাতড়ে বলে, আমার দেশলাই?

ধ্রুব অলস গলায় বলে, আমারটাও কালুর দোকানে পড়ে আছে। এই যে ড্রাইভার, আপনার দেশলাইটা দেখি।

ড্রাইভার জবাব দেয় না, তবে একটা হাতে একটা দেশলাই এগিয়ে দেয়। সিগারেট ধরাতে যাতে অসুবিধে না হয় তার জন্যই বোধহয় গাড়ির গতিও ধীর করে দেয়।

দুজনে সিগারেট ধরানোর পর প্রশান্ত বলে, ভি আই পি-দের হাত লম্বা হয় ঠিক শালা ভূতের হাতের মতো। সেই যে ঘর থেকে হাত বাড়িয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু ছিঁড়ে এনেছিল, মনে নেই? ঠিক সেইরকম।

ধ্রুব ঝিমোতে ঝিমোতে বলে, মুখটা বন্ধ করবি বাপ! আমার মনটা ভাল নেই। আমি একটু চোখ বুজে ভাবছি।

কী ভাবছিস? যে বাচ্চাটা তোর বউ আজ পয়দা করল সেটা তোর নয়?

ওটা আমার নয় ঠিকই, কিন্তু ওটা নিয়ে ভাবছি না।

তবে কী নিয়ে ভাবছিস?

অনেক সিরিয়াস প্রবলেম আছে। তুই সব বুঝবি না। মুখ বুজে থাক। ভবানীপুর এলে নামিয়ে দেব।

প্রশান্ত একটু গম্ভীর হয়ে বিজ্ঞের মতো বলে, তোর প্রবলেম কোনটা জানিস?

আমার অনেক প্রবলেম।

তোর প্রবলেম আসলে একটাই। সেটা হল তোর বাপ।

বাবাও একটা প্রবলেম বটে।

বহুত গভীর কঠিন প্রবলেম। বাপের জন্যই তোর লাইফটা বিলা হয়ে যাচ্ছে। শালা পাবলিকের কাছে ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে, ভোটে টান পড়বে, তাই তোর বাপ তোর পিছনে হরকত লোক লাগিয়ে রেখেছে। তুই বাঁচতে চাস তো পালা। ফোট।

ধ্রুব দুহাতে কান ঢেকে বলে, ওঃ এমন চেঁচাচ্ছিস! মাথা ধরে যাচ্ছে!

চেঁচালুম? আচ্ছা, ক্ষমা।

ধ্রুব একটু বিরক্তির গলায় বলে, সিগারেটের ফুলকি আসছে। ঠিক করে ধর। জানালার কাচটা পুরো তুলে দে।

দিচ্ছি গুরু।

প্রবলেমের কথাটা শুনতে চাস? তোকে বলেই বলছি।

বল না।

কাউকে বলবি না। বাবা রিসেন্টলি এনিমি প্রপার্টির অনেক টাকা পেয়ে গেছে। কয়েক লাখ টাকা।

এনিমি প্রপার্টি? সেটা কী জিনিস?

ধুস শালা! ইস্টবেঙ্গলে আমাদের মেলা প্রপার্টি ছিল না?

ওঃ, সে প্রপার্টি!

সেই প্রপার্টি।

টাকা পেলে আর প্রবলেমের কী?

আছে। টাকাটা আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হওয়ার কথা।

তোর ভাগে কত পড়বে?

ঠিকমতো ভাগ হলে অনেক। কিন্তু হচ্ছে না।

কেন?

বাবারা যে চার ভাই। দলিল বাবার কাছে ছিল বলে বাবা পেয়ে গেছে। কিন্তু টের পেয়ে আমার জ্যেঠতুতো ভাইরা অবজেকশন দিয়েছে।

গাড্ডা। কিন্তু তোর বাপ ঠিক বেরিয়ে আসবে। খচ্চর লোক।

ধ্রুব মাথা নাড়ে। বলে, পারছে না। বহুত গাড্ডা। এখনকার আইনের অনেক প্যাঁচ। বাপের প্রপার্টিতে মেয়েদেরও দাবি আছে। তাই পিসিরাও নেমে পড়েছে।

তোর বাপ তা হলে করছে কী?

বাবা খুব খেপে আছে। আমি ভেবেছিলাম এ টাকাটা হাতে পেলে কেটে পড়ব। একদম হাওয়া হয়ে যাব।

কোথায় যাবি?

যেখানেই যাই, তোর বাপের কী? —ধ্রুব ধমকে ওঠে।

প্রশান্ত খিলখিল করে হাসে, ন্যাকড়াবাজি শালা?

ধ্রুব সিগারেটে একটা টান মেরে বলে, আরে বাবা, এ সেই বাড়ি থেকে পালানো নয়, আমার বাবাও সিরিয়াসলি চাইছে, আমি কেটে পড়ি।

মাইরি?

চাইবেই। আফটার অল হি ইজ এ লিডার। আমি থাকলে বাবার কনস্ট্যান্ট হেডেক। আমাকে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা একটা অ্যারেনজমেন্ট করেছিল। নাসিকে বাবার এক বন্ধু আছে। তার সঙ্গে আমাকে ভেড়াতে চাইছে বাবা। আমি বাবাকে বলেছি, রাজি আছি তবে লাখ দুই টাকা ছাড়ুন।

দু লাখ! সে তো অনেক টাকা!–প্রশান্ত চোখ বড় করে।

দুর শালা! ঘরের টাকা নাকি? বাবা তো এনিমি প্রপার্টির টাকাটা ফালতু পেয়ে গেছে। সেটা থেকেই দেওয়ার কথা ছিল। ঘরের টাকা হলে বাবা রাজি হত নাকি?

সে কেসটা তো বিলা হয়ে গেছে বলছিস!

হ্যাঁ। দারুণ কিচান হচ্ছে। মামলা-টামলাও হতে পারে। তবে বাবাকে সবাই ভয় খায় বলে এখনও তেমন কিছু করছে না।

তোর বাবা পুরো টাকাটা ঠিক হজম করে দেবে। লিডাররা সব পারে।

যা বুঝিস না, জানিস না, তা নিয়ে কথা বলিস কেন?

এ আর না বোঝার কী আছে গুরু?

আছে। সম্পত্তিটা আসলে বাবারই ছিল। শেষ বয়সে দাদু বাবার নামে সব লিখে দিয়ে যায়। উইলের প্রবেটও আছে। কিন্তু উইল কেউ মানছে না বলে ঝামেলা। বাবা সকলের সঙ্গে নেগোশিয়েসন চালাচ্ছে, আত্মীয়দের বলছে, কিছু ছাড়ছি, তোমরা মেলা ঝামেলা কোরো না।

তোর বাপকে সব দিয়ে গেল কেন?

বাবা ছিল যাকে বলে ড্যাডিজ ব্লু আইড বয়। সে অনেক কথা। আমাদের ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার তোর অত জানার কী দরকার?

প্রশান্ত একটা হাই তুলে বলে, কে জানতে চাইছে গুরু? তখন থেকে তুইই তো ফ্যাচ ফ্যাচ বকে যাচ্ছিস। আমার মাথা ধরে গেছে। পাকিস্তানে তোদের ক পহার সম্পত্তি ছিল রে? তোর বাপ লিডারি করে তার চেয়ে ঢের বেশি কামিয়েছে। ওসব বাত ছোড়।

কামিয়েছে তা কী? আমার বাবা সাফারও করেছে। হি ওয়াজ এ পোলিটিক্যাল সাফারার।

প্রশান্ত আবার খিক খিক করে হেসে বলে, জানি বাবা জানি। ব্রিটিশ আমলে তিন দিন যে জেল খেটেছে তারও এখন রবরবা। তামার তকমা পাচ্ছে, মাসে মাসে পেনসন। বিজঘুট্টি কারবার। ওয়াঃ ওয়াঃ।

মুড়ি মিছরির কি এক দর রে শালা? আমার বাবার নাম স্বাধীনতার ইতিহাসেও লেখা আছে। পড়ে দেখিস। বাপ তুলে কথা বলিস শালা? আমার বাপ যখন জেল খাটছে তখন তোর বাপ কী করত জানিস? ধুতির মধ্যে শার্ট খুঁজে পরে হাফ সাহেব সেজে সাহেবদের তেল দিত। ইয়েস স্যার, নো স্যার, ভেরি গুড স্যার।

প্রশান্ত একটু মাথা চুলকে বলে, তা হতে পারে। তবে আমাদের ফ্যামিলিতে অত ঝুট ঝামেলা নেই। ফালতু কেউ চুলকে ঘা করতে যেত না।

চামচা ফ্যামিলি।

ঠিক কথা। কিন্তু স্ট্রেট ফ্যামিলি। চামচা তো সবাই চামচা। তোর ফ্যামিলিটা জগাখিচুড়ি, একটা চামচা, একটা বিপ্লবী, একটা কেপ্লন তো আর-একটা হাড় বজ্জাত।

সবচেয়ে বজ্জাত কোনটা জানিস?

কোনটা?

লালটুদা।

আরে বাবা! যে লোকটা ইস্টবেঙ্গলে খেলত সে-ই না?

সে-ই। এখন ব্যাংকের অফিসার। সাপের পাঁচ পা দেখেছে।

বহোত খানেপিনেওলা লোক মাইরি।

খায়। আবার খাওয়ায়ও। ওসব ঠিক আছে। কিন্তু বাবার সঙ্গে যে সবচেয়ে বেশি লড়ে যাচ্ছে সে হল লালটুদা।

প্রশান্ত হঠাৎ একটু ঝুঁকে রাস্তাটা দেখে নিয়ে ড্রাইভারকে বলে, আরে ব্যস, ব্যস। আমার গাড়ায় এসে গেছে।

ট্যাকসি থামে। প্রশান্ত নেমে যায়। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলে, গুড নাইট গুরু! ফির মিলেঙ্গে।

চোখ বুজে মাছি তাড়ানোর মতো একবার হাত নাড়ে ধ্রুব। কোথায় যেতে হবে ড্রাইভার জানে। সুতরাং সে আর বাকি রাস্তাটা মুখ খোলে না।

ধ্রুব যখন তাদের কালীঘাটের বাড়ির সামনে এসে ট্যাকসি থেকে নামে তখনও তিনতলার একটা ঘরে আলো জ্বলছে। অনেক রাত পর্যন্ত সেই ঘরে আলো জ্বলে।

বাড়ির সামনে একটু বাগান আছে। ফটক পেরিয়ে ঢুকলে ঘোরানো রাস্তা। তারপর গাড়িবারান্দা। সিঁড়ি, বৈঠকখানা। বাড়িটার চেহারা বেশ পয়মন্ত। নিজেদের বাড়ি হলেও ধ্রুব মাঝে মাঝে নিরপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তির চোখে বিচার করে দেখেছে। তার মনে হয়েছে, এ বাড়ির মালিকের বর্তমান সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকার মতো এলেম আছে।

বৈঠকখানার দরজায় জগাদা দাঁড়িয়ে। মাথায় সেকেলে লেঠেলদের মতো ঝাকড়া চুল। জোয়ান চেহারা। গায়ে এই শীতকালেও একটা ফরসা গেঞ্জি আর ধুতি। বয়স ষাটের ওপরে হবে, কিন্তু বিপুল স্বাস্থ্যে চাপা পড়ে বয়স চি চি করছে।

আরে জগাদা!

জগা এক ধরনের নিষ্পলক চোখে তাকে দেখছিল। এখন জগাকে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ধ্রুবর। তবে সে যখন ছোট ছিল, এবং জগাদা যখন আরও কমবয়সি এবং আরও স্বাস্থ্যবান তখন চড়-চাপড়টা মাঝে মাঝে খেতে হত। আশ্চর্য এই, এ বাড়ির কাজের লোক হয়েও জগাদার সেই অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করত না। এখন আর ভয় খায় না ধ্রুব, বরং পিছনে লাগে।

জগা বললে, এতক্ষণে এলে?

খুব রাত হয়ে গেছে নাকি? —ধ্রুব একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে।

জগা মাথা নেড়ে বলে, ফুর্তির পক্ষে রাত হয়নি মোটেই। কিন্তু আজকের দিনটা রাত না করলেও পারতে।

কেন, আজ কী?

আজ কী সে তো তোমারই জানার কথা।

ওঃ!–ধ্রুব মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বলে, সব ব্যাপারে তোমরা অত সিরিয়াস কেন বলল তো! দুনিয়াটা গোমড়ামুখোয় ভরে গেল মাইরি।

জগা একটু চাপা গলায় বলে, জোরে কথা বোলো না। বাড়িসন্ধু সবাই জেগে আছে।

কেন? জেগে আছে কেন? আমার বিচারসভা বসবে নাকি?

সে কে জানে। তুমি ঘরে যাও! বেশি শব্দসাড়া কোরো না।

যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। চতুর্দিকে এত গার্জিয়ান থাকলে বড় মুশকিল। তোমাকে এখানে খাড়া থাকতে বলেছে কে?

কেউ বলেনি। তুমি ঘরে যাও।

জগাদা, তুমি কি এখনও এ বাড়ির চাকর?

জগা একটু হাসে, তোমার কী মনে হয়?

মনে হয় তুমি চাকর হয়েই জন্মেছ। এ জন্মে আর স্বভাবটা ছাড়তে পারবে না।

না হয় নাই পারলাম।

কেন পারছ না? ম্যাকিনেল বেরীতে তুমি আটশো টাকা মাইনেব চাকরি করো। বাগনানে তোমার জমিজিরেত বউ-বাচ্চা আছে। এই সমাজব্যবস্থায় তুমি যথেষ্ট ভদ্রলোক, তবু চাকরের মতো হাবভাব কেন?

চেঁচিয়ো না, বলছি না, সবাই জেগে আছে।

ধ্রুব চট করে জিভ কেটে বলে, তাই তো। ভুলে যাচ্ছিলাম। আসলে তোমাকে দেখলে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারি না। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি এ বাড়ি তোমার রক্ত মজ্জা মেদ মাংস শুষে খেয়েছে। তোমার গায়ে, চরিত্রে, স্বভাবে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে চাকর বলে। আমার চোখের সামনে একবার তোমাকে সোনাজ্যাঠা চটিপেটা করেছিল। আজও তবে কেন তুমি এ বাড়ির গোলামি করো? তোমার ভিতরে আগুন নেই? বিদ্রোহ নেই?

একতলার একটা লম্বা প্যাসেজ পেরোচ্ছিল তারা। অনেকগুলো সারিবদ্ধ ঘর। বেশির ভাগই খালি এবং তালা দেওয়া। শেষ প্রান্তের ঘরটায় আলো জ্বলছে। এ ঘরটাই ধ্রুবর। ধ্রুবর একার। তার বউ এ ঘরে থাকে না। এখন অবশ্য সে নার্সিংহোমে।

জগা কথা বলছিল না। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল শুধু।

ধ্রুব নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জগার দিকে ফিরে বলল, ভাঙো জগাদা, ভাঙতে শুরু করো।

কী ভাঙব?

এ বাড়ির বনিয়াদ। হাতের কাছে যা পাও তাই দিয়েই ভাঙতে শুরু করে। বাড়ি ভাঙো, মানুষ ভাঙো, সিস্টেম ভেঙে উড়িয়ে দাও।

জগার কাছে এসব কথা নতুন নয়। বহুবার শুনেছে। পেটে জিনিস পড়লেই ধ্রুব একটু বিপ্লবী হয়ে যায়। জগা হাত ধরে ধ্রুবকে ঘরে টেনে ঢোকাল। তারপর দরজাটা আবজে দিয়ে বলল, আজকের দিনটা বাদ দিতে পারলে না? তোমার আজ প্রথম ছেলে হল!

কার ছেলে? আমার? মাইরি জগাদা, সব জেনেশুনে তুমিও একথা বললে!

চুপ!–আচমকাই জগা একটা বাঘা গর্জন করে ওঠে।

ধ্রুব দুপা পিছিয়ে যায়, কী যে চেঁচাও না! মাথা ধরে যাচ্ছে! চেঁচাচ্ছ কেন? এমন কী বলেছি?

যা বলেছ তা আর বোলো না।

কেন বলব না?

জগা একটা গভীর হতাশার চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে বলে, বউমার অবস্থা ভাল নয়।

তার মানে?

নার্সিংহোম থেকে একটু আগেই টেলিফোন এসেছে। ছোটবাবু খবর পেয়েই চলে গেছেন।

ধ্রুব চুপ হয়ে যায়। তার আর কিছু বলার থাকে না।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়