শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, ডাক্তার দেখাব কেন রে? আমার কী হয়েছে?

কিছু হয়েছে বলে নয়। চেক-আপ-এর জন্য। এখন একটু সাবধান হওয়া ভাল।

সারা রাত বৃষ্টির পর সকালে রোদ উঠেছে। কিন্তু বাগানে জল দাঁড়িয়ে গেছে, কাদা থিকথিক করছে, মেলা গাছ শুয়ে পড়েছে বৃষ্টির দাপটে। শ্রীনাথ সযত্নে শুয়ে পড়া গাছগুলোকে ঠেকনো দিয়ে দাড় করাচ্ছিল। দীপনাথের প্রস্তাব শুনে বারান্দার সিঁড়িতে বসেছে খানিক। অবাক হয়ে বলল, চেক-আপ? সেসব তো বড়লোকেরা করে শুনেছি। আমরা নাভিশ্বাস না উঠলে ডাক্তারের কাছে যাই নাকি? গুচ্ছের বাজে খরচ।

টাকার কথা বাদ দাও তো। টাকা আমি দেব।

তুই কি পাগল হলি? আমার কিছু হয়নি। বেশ আছি।

বেশ থাকলে বলতাম না। তোমাকে বেশ দেখাচ্ছে না। চোখের কোল ফুলেছে, শরীরের বাঁধন আলগা, তার ওপর ড্রিংক-ট্রিংক করো, ডাক্তার দেখিয়ে রাখা ভাল।

তার মাথায় এ বুদ্ধি ঢোকাল কে বল দেখি?

কেউ ঢোকায়নি। কাল থেকে আমারই মনে হচ্ছিল।

দূর দূর। ওসব কোনও দরকার নেই। আমার শরীবের ভাল-মন্দ আমি টের পাই না ভেবেছিস?

চেহারা নরম হলেও শ্রীনাথ গোঁয়ার কম নয়। রাজি হল না।

হতাশ দীপনাথ ফিরে এসে তৃষাকে বলল, বউদি, হল না।

আমি তো জানতাম।

আমি আজ চলে যাব বউদি। তুমি মেজদাকে দেখো।

যাবে? কাল রাতে কী কথা হয়েছিল?

সে তো দাদার চেক-আপের জন্য। সেটা যখন হচ্ছে না তখন–।

তৃষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব দীর্ঘশ্বাস-টাস তার বড় একটা আসে না। আজ এল। বলল, ঠিক আছে।

তৃষার অভিমানের আঁচ টের পেল দীপনাথ। কিন্তু বেশি গা করল না। বাঁধা পড়তে তার ভাল লাগে না। একা, আলগা, দূরের লোক হয়ে থাকার মধ্যে ভার অনেক কম।

নিজেদের ঘরের লম্বা বারান্দায় পিচবোর্ডের টার্গেট বানিয়ে এয়ারগান ছোড়ার অভ্যাস করছিল সজল। মাদুর পেতে পাশবালিশ ফেলে তার ওপর কনুই রেখে শুয়ে খুব কায়দা দেখাচ্ছে। দীপনাথ হেসে বলে, কটা লাগালি?

সতেরোটার মধ্যে দুটো মাত্র।

দে আমাকে।

এয়ারগান নিয়ে দীপনাথ ছোট্ট লোহার গুলি ভবে ফটাফট খানিকক্ষণ টার্গেট প্র্যাকটিস করল। আসলে নিজেকে এইভাবে সরিয়ে নেওয়া, প্রত্যাহার করা। বউদির চোখে চোখে তাকাতে হচ্ছে না।

দেরিতে অফিসে গেলেও ক্ষতি ছিল না। তবু দীপনাথ পালনোর জন্য সময়ের আগেই খেয়ে নেয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ির চৌহদ্দি ঠেঙিয়ে রাস্তায় পা দিয়েই শ্বাস ফেলে ভাবল, বাঁচা গেল।

 

বৃষ্টির পর এই শরৎকালের ভোরবেলাটা খুব ভাল কাটছিল না প্রীতমের। পরশু শতম এসেছে। তারপর থেকে প্রতি মুহূর্তেই তার ভয় হয়েছে, এই বুঝি তাকে শিখণ্ডী রেখে বউদি আর দেওরে লেগে যায়। লাগেনি এখনও, কিন্তু আবহাওয়ায় বারুদের গন্ধ ছিল।

কাল ঘটল অন্যরকম। একদম অন্যরকম।

বিলু ফিরল কাল বেশ রাতে। কম করেও ন’টা। পাশের ফ্ল্যাটের মাদ্রাজিদের টেলিফোনে অবশ্য একটা খবর দিয়েছিল, ফিরতে দেরি হবে। কারণ বলেনি।

কারণটা প্রীতম ঝ করে টের পেল, বিলুকে দেখেই।

কী দেখেছিল প্রীতম? শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণ সে চিন্তা করছে, খুঁজছে, প্রশ্ন করছে নিজেকে, কী দেখেছিলাম? কী দেখেছিলাম?

বিল ভিতরের ঘরে ঢুকেই খুব সচকিত চোখে একবার দেখেছিল প্রীতমকে। দৃষ্টি অন্যরকম। চোরের মতো। ভয়ে ভরা। তারপর গেল বাথরুমে।

ফিরে এসে খাটের বিছানায় প্রীতমের পায়ের কাছে এসে বলল, অফিসে যা কাজ না!

অফিসের কাজের জন্য দেরি হল?—খুব নিবিড় তীক্ষ্ণ শার্লক হোমসের চোখে তাকিয়ে বিলুকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে প্রীতম।

না। অফিসের পর একটা ডিনার ছিল।

কারা দিল?

নতুন ডিরেক্টরের রিসেপশন।

চোখ কপালে তুলে প্রীতম জিজ্ঞেস করে, নতুন ডিরেক্টরের রিসেপশনে তোমার নিমন্ত্রণ?

সে তো আমার গুণে নয়। এই ব্যাংকের ডিরেক্টর যে অরুণের বাবা।

তাতে কী? তবু ওই রিসেপশনে তোমাকে ডাকার কথা নয়।

বিলু একটু কাঠ হয়ে বলল, ডাকল তো। কী করব বলো?

কোথায় হল?

পার্ক হোটেলে। শতম কোথায়?

বেরিয়েছে। ফিরবে।

শতমের কথাটা তুলে বোধহয় পাশ কাটাতে চাইল বিলু। প্রীতম তাকে পাশ দিলও। আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। করার দরকার নেই। বিলুর মুখশ্রী, চোখের দৃষ্টি, দেহের শান্ত ভাবই বলে দিচ্ছে অন্য কিছু। ডিনার ছিল ঠিকই, কিন্তু তারপর আরও গভীর কিছু ছিল। অন্তরঙ্গ কিছু ছিল।

বিদ্যুতের ছোবল খেয়ে প্রীতম আঁকড়ে ধরল বালিশ। সে তো জানত। পুরুষ আর রমণী যতই পরিধেয় পরুক, ঘনিষ্ঠতা একদিন তাদের দেহমিলনে প্ররোচিত করবেই।

টের হয়তো পেত না প্রীতম। পেল কেবল এই দীর্ঘ রোগে ভুগে অনুভূতির প্রখরতা বেড়ে গেছে বলে।

না কি অন্যায় সন্দেহ? আবার ভাবতে বসল প্রীতম। ভেবে ভেবে বৃষ্টির রাত পার করল।

শতম কাল অনেক রাতে ফিরেছে। তখন ঘুমের ভান করে শুয়ে ছিল প্রীতম। কথা হয়নি। কথা বলতে ইচ্ছে ছিল না তার কারও সঙ্গেই।

বৃষ্টির পর এই শরৎ ঋতুর মতো উজ্জ্বল ভোরবেলা বিছানায় বসে আছে প্রীতম। শরীরের গাঁটে হালছাড়া ভাব। শরীরে খিল ধরেছে। মাথা ভার। চোখে জ্বালা। ভাবছে, কী দেখেছিলাম?

আজকাল বিলুর বদলে অচলা আসে তার প্রাতঃকৃত্যে সাহায্য করতে। দুর্বল আঙুলে নিজেই দাঁত মেজে নেয় প্রীতম। অচলা কুলকুচের জন্য একটা অ্যালুমিনিয়মের গামলা ধরে রাখে বিছানায়। আজ দাঁত মাজতে গিয়ে বারবার অবশ হয়ে পড়ে যাচ্ছিল হাত।

অচলা বলল, কী হল? আমি মেজে দেব?

না, না। আমি পারব।

কীরকম ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।

রাতে ভাল ঘুম হয়নি।

তা হলে আমাকে ডাকেননি কেন?

তুমি কী করতে?

একটা ট্র্যাংকুইলাইজার খাইয়ে দিতাম।

প্রীতম হাসল, ট্রাংকুইলাইজার? ওতে কিছু হত না। কাল রাতে আমার কিছুতেই ঘুম আসত। বিলু কোথায়?

বউদি ওঠেননি।

কটা বাজে বলল তো?

বেশি নয়। সাতটা।

প্রীতম দেখল সকাল সাতটার তুলনায় অনেক বেশি আলো এসেছে ঘরের মধ্যে। এত আলো ভাল লাগছিল না প্রীতমের। সে বলল, জানালাগুলো ভেজিয়ে দাও তো। চোখে বড় আলো লাগছে।

অচলা জানালা ভেজিয়ে দিয়ে কাছে এল। বলল, কী হয়েছে বলুন তো? ডাক্তারকে খবর দেব?

না।

তা হলে বউদিকে ডাকি?

না, ও ঘুমোক। তুমি যাও অচলা। আমি শুয়ে থাকি।

কিছু খেয়ে নিন।

অচলা আপত্তি শুনল না। তর্ক করতে ইচ্ছে করল না বলে এক গেলাস দুধ খুব অনিচ্ছার সঙ্গে খেয়ে প্রীতম পড়ে রইল বিছানায়। কিছুতেই আজ নিজের প্রতিরোধ রাখতে পারছে না সে। হেরে যাচ্ছে। জয়ের গন্ধে শরীরময় নেচে উঠছে বীজাণুরা। কোলাহল করছে।

ঘুম এল না। অসহ্য কষ্ট। উঠে বসল প্রীতম। ঘর বড় বেশি অন্ধকার। না?

অচলা, জানালাগুলো খুলে দিয়ে যাও।

তাই দিয়ে গেল অচলা। বলল, বউদি উঠে বাথরুমে গেলেন। আসছেন এক্ষুনি।

প্রীতম কিছু বলল না। শূন্যগর্ভ চোখে চেয়ে রইল সামনের দিকে। কোনও মানুষই কোনও মানুষের সম্পত্তি নয়, ক্রীতদাস ক্রীতদাসী নয়। কারও দেহের অধিকার, প্রেমে পড়ার অধিকার কেনই বা থাকবে না মানুষের? এসব ভাবল। অনেক ভাবল।

কী হয়েছে? অচলা বলছিল—

বলতে বলতে বিলু এসে কাছ ঘেঁষে বসে। মুখ থেকে ঝাঁঝালো পেস্টের গন্ধ আসছে।

কিছু নয়। রাতে ঘুম হল না।

কেন?

কী করে বলব? এল না।

আমাকে ডাকোনি কেন?

তুমি কাল খুব টায়ার্ড ছিলে।–বলে এক ঝলক বিলুকে দেখে নেয় প্রীতম।

তাতে কী? তোমার অসুবিধে হলে বলবে না তা বলে?

কিছু অসুবিধে হয়নি। একটু ছটফট করেছি মাত্র।

ডাক্তারবাবুকে টেলিফোন করে দিচ্ছি এখনই।

না। তার দরকার নেই। আজ ভাল আছি।

বিলু আর তেমন উদ্বেগ দেখাল না। অনেকক্ষণ অবশ্য বসে রইল কাছে। হঠাৎ বলল, শতম কেন এসেছে বলো তো!

এমনি।

আমাকে অচলা বলছিল, ও নাকি তোমাকে শিলিগুড়িতে নিয়ে যেতে চায়।

প্রীতম মনে মনে অচলার ওপর বিরক্ত হল। মুখে বলল, তাই তো বলছে।

নিয়ে যাবে কেন? এখানে কি কোনও অসুবিধে হচ্ছে তোমার?

প্রীতম গম্ভীর মুখে বলল, আমার বোঝা তো অনেক টেনেছ বিলু। এবারটা কিছুদিনের জন্য ছেড়ে দিলে দোষ কী?

বিলু এ কথায় স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর অনেকটা সময় পার করে বলে, তুমি কি আমার বোঝা?

বোঝ। ভীষণ বোঝা বিলু। নিজেকে আমার তাই মনে হয়।

তোমার মনে এমন সব জিনিস হয় যা লজিক্যাল নয়।

প্রীতম বিলুর দিকে চেয়ে ছিল। কাল রাতের অপরাধবোধ টানা ঘুমের পর কেটে গেছে। এখন পরিচ্ছন্নই দেখাচ্ছে বিলুকে। তবু এ বিলু কীটদষ্ট। এতদিন ওর প্রতিরোধ ছিল। কাল ভেঙে গেছে। প্রীতম সব টের পাচ্ছে। পৃথিবীতে কে কার?

তোমার অফিসের সময় হয়ে এল বিলু।

বিলু নড়ল না, স্থির হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি জানতাম শেষ পর্যন্ত তুমি এই ডিসিশনই নেবে। কোনওদিন তুমি আমাকে আপনজন ভাবোনি।

এ কথার জবাব দিলে বোধহয় ঝগড়া হবে। কিন্তু প্রীতম কোনওদিন ঝগড়া করেনি। তার সারাজীবনেই ঝগড়া বলে কিছু নেই। যদিও বা দু-চারবার সে কারও সঙ্গে ঝগড়া করেছে, প্রতিবারই গো-হারা হেরেছে। উত্তেজিত হলে তার মুখে কথা ফোটে না, মাথা গুলিয়ে যায়, শরীর ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে থাকে। সে ভারী করুণ অবস্থা!

প্রীতম তাই চুপ করে থাকে।

বিলু বলে, ওরা তোমাকে কেন নিয়ে যেতে চায় তা বলেছে?

নিয়ে যেতে চায় এমনিই। আমি তো ওই পরিবারেরই ছেলে।

তা কি জানি না। কিন্তু ভাবছি আমার কোনও ত্রুটি হল কি না।

না, তুমি যথেষ্ট করেছ।

একটা কথা বলবে? তুমি বাড়িতে চিঠি লিখে কিছু জানাওনি তো?

কী জানাব?

তোমার কোনও অসুবিধের কথা?

না বিলু। আমার তো কোনও অসুবিধে নেই। আমি কখনও কারও কাছে তোমার নামে নালিশ করিনি। ওটা আমার আসে না।

আমিও তাই জানতাম এতদিন।

আজ কি বিশ্বাস করছ না আমায় বিলু?

বিশ্বাস করছি। আমি শুধু ভাবছি আমার দোষটা কোথায়।

এটা দোষগুণের ব্যাপার নয়। আমার মা, ভাই, বাড়ির লোক সবাই চায় আমাকে তাদের কাছে কিছুদিন নিয়ে রাখতে। তোমার দোষের কথা ওঠেই না।

কথা বলতে বলতে প্রীতম গভীরভাবে বিলুকে দেখছিল, অনুভব করছিল। কাল এই বিলু ছিল তার। আজ যেন তার নয় আর। এই সত্য প্রীতমের ভিতরে মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। বেঁচে থাকা নিরর্থক। তার লড়াই শেষ হয়েছে। এবার শিলিগুড়ি চলে যাবে। জানালা দিয়ে দেখবে সারাদিন, উত্তরের পাহাড়। শৈশব ফিরে আসবে। নিবিড় হয়ে উঠবে মায়ের আঁচলের সেই অদ্ভুত গন্ধ। বড় নেই-আঁকড়া ছেলে ছিল সে। আবার তাই হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে লাবুর জন্য কষ্ট হবে খুব। বিলুর কথা বড় মনে পড়বে। কিন্তু বেশিদিন নয়, রোগ-জীবাণুরা ঘোড়সওয়ারের মতো উঠে আসবে মাথায়। সব ভুলিয়ে দেবে। সব ভুলে যাবে প্রীতম।

বিলু আবার নিচু গলায় বলে, তোমার শিলিগুড়িতে যাওয়ার অর্থ আমার সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি।

প্রীতম মাথা নেড়ে বলে, তা-ই বিলু। অস্বীকার করে লাভ নেই। তুমি তো শিলিগুড়িতে যাবে না।

ও কথা থাক। কেন যাব না, কেন যেতে চাই না, তা তো তুমি জানো।

জানি। তবে ছাড়াছাড়ির জন্য দুঃখ নেই বিলু। এখানে থাকলেও খুব শিগগিরই একদিন ছাড়াছাড়ি তো হতই।

বিলু খুব অবাক হয়ে প্রীতমের দিকে তাকিয়ে বলে, তার মানে? ওসব কী বলছ তুমি?

কেন, তুমি জানো না যে, আমার আয়ু বেশিদিন নয়? এটা কি নতুন কথা বিলু?

বিলুর চোখ-মুখ তবু বিস্ময়ে টানটান হয়ে থাকে। অস্ফুট গলায় সে বলে, তুমি তো কোনওদিন এসব বলোনি প্রীতম! আজ কেন বলছ?

ভারী অপ্রস্তুত বোধ করে প্রীতম। মুখে কথা আসে না।

বিলু তার দু’হাত দিয়ে প্রীতমের একখানা হাত ধরে বলে, কেন বললে? তুমি তো কখনও মরার কথা বলো না। আজ কেন বললে?

প্রীতম হাতটা আস্তে টানে। কিন্তু দুর্বল হাতখানা বিলুর হাত থেকে খসে এল না। সে বলল, একটু আস্তে বিলু। শতম শুনবে, অচলা শুনবে।

শুনুক। তোমাকে বলতে হবে প্রীতম।

কী বলব! আমি কিছু ভেবেচিন্তে বলিনি। মনে হল, তাই বললাম।

তোমার মনের সেই জোর কোথায় গেল?

একটু শ্লেষের হাসি অজ্ঞাতেই ফুটে ওঠে প্রীতমের মুখে। বলে, মনের জোরে তুমি তো বিশ্বাস করো না।

আমি না করলেও তুমি তো করতে?

আমার মনের জোর আর নেই। হাল ছেড়ে দিয়েছি। এবার ভেসে যাব।

বিলু তার হাতটা আর-একটু নিবিড়ভাবে চেপে ধরে, কী হয়েছে তোমার বলবে?

আমার কিছু হয়নি। তুমি কেমন আছ বিলু?

এ কথায় বিলু যেন চমকে ওঠে, আমি কেমন আছি? তার মানে?

প্রীতম ঠেস দিয়ে কথা বলতে প্রায় জানেই না। বলতে লজ্জাও করে তার। তবু আজ বলল, এখন তো তোমার একটা আলাদা বাইরের জীবন হয়েছে বিলু। সে জীবনটার কথা তো আমি জানি না! তাই জিজ্ঞেস করছি, কেমন আছ?

বিলুর মুখ থমথম করছে। একটু কঠিন গলায় সে বলে, আলাদা জীবন? চাকরি করলেই কি একটা আলাদা জীবন হয় মানুষের! আজ তুমি অদ্ভুত সব কথা বলছ প্রীতম।

চাকরি কেন করতে গেলে বিলু? সে কি টাকার জন্য?

না তো কী?

এমন তো নয় যে, সারাদিন একজন রুগির সঙ্গ করে করে ঘঁফিয়ে উঠেছিলে বলে, সব সময়ে মৃত্যুর সঙ্গে ঘর করতে হচ্ছে বলে, একটু মুক্তির জন্য, ডানা মেলবার জন্যই চাকরি করতে গেছ?

বিলুর সেই পুরনো কাঠিন্য ফিরে এল মুখশ্রীতে। বহুকাল ওই বরফ-শীতল ভাবটা দেখেনি প্রীতম। মাঝখানে কিছুদিন একটু প্রগ হয়েছিল বিলু। শীতল মুখশ্রীর সঙ্গে ঠান্ডা গলার মিশেল দিয়ে বিলু বলে, তোমার যদি তা-ই মনে হয়েছিল তবে আগে বলোনি কেন?

আমি তো তোমার কোনও কাজে বাধা দিই না। সব মানুষেরই ইচ্ছে মতো চলার স্বাধীনতা আছে। তবু কেন বলছি জানো? মনে হয় বলে।

কেন মনে হবে?

এ প্রশ্নের জবাব হয় না। মনে হয়, তাই বললাম। চাকরি করে কিছু অন্যায়ও করোনি। আমি যদি বাঁচি তবে এ চাকরিটা তোমার দরকার হবে।

বিলু মাথা নিচু করে বসে থাকে। সময় বয়ে যাচ্ছে। প্রীতমের বড় ইচ্ছে হল, নতমুখী এই শীতল মেয়েটিকে একটা চরম আঘাত দিতে। কোনওদিন শত অপরাধেও যা করেনি প্রীতম। কিন্তু এখন সে শেষবারের মতো চলে যাচ্ছে। হয়তো আর কখনও দেখা হবে না। ওকে একটু আঘাত দিয়ে যাওয়া ভাল। তাতে হয়তো ও মনে রাখবে।

প্রীতম গলা ঝাড়ল। অনেক ইতস্তত ভাব, দ্বিধা কাটিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আর একটা কথা।

বলল শুনছি।

তোমার বয়স বেশি নয়। যদি আমার ভালমন্দ কিছু হয় বিলু, তা হলে তুমি একা থেকো না।

বিলু মুখটা নিচুই রাখল। মৃদু কঠিন স্বরে বলল, কী বলতে চাইছ?

বলছি, তুমি আবার বিয়ে কোরো।

বিয়ে?–বলে ভারী অবাক হয়ে তাকায় বিলু, কী বলছ?

বিয়ের কথায় অবাক হোয়ো না। তুমি তো এসব সংস্কার মানো না, আমিও মানছি না। ভেবে দেখেছি, তোমার একা থাকার চেয়ে আবার বিয়ে করাই ভাল।

বলতে মুখে আটকায় না তোমার?

না। কারণ বিয়ে অনেক স্পষ্ট, অনেক পরিষ্কার ও সহজ ব্যাপার। তাতে গোপনীয়তা নেই, লুকোছাপা নেই, ভয়-ভীতি নেই। বিয়েই ভাল বিলু।

এতটা স্পষ্ট কথা, এত সুস্পষ্ট আক্রমণ বোধহয় বিল প্রত্যাশা করেনি। তার শীতল কঠিন মুখশ্রী কাঁপতে থাকে। তারপর হঠাৎ ঠোঁট ফুলে ফুলে ওঠে। চোখ জলে ভরে আসে। ঋলিত গলায় সে বলে, কী বলছ তুমি?

প্রীতম আনমনে দুরের জানালার দিকে চেয়ে আকাশের উজ্জ্বল নীল চৌখুপিটা দেখছিল। উদাস গলায় বলল, সেই ভাল বিলু। না হয় অরুণকেই কোরো। ও তোমাকে খুব ভালবাসে।

বিলু একটু শিউরে উঠল কি?

একটা হাত তুলে সে প্রীতমের মুখ চাপা দিয়ে বলল, বোলো না, ও কথা আর বোলো না। কী বলছ তা তুমি জানো না।

প্রীতমের সমস্ত শরীর এলিয়ে পড়েছে এই পরিশ্রমে। এই কথাটুকু, এই আঘাত করার প্রস্তুতি এবং আঘাত তাকে এক পালটা প্রতিক্রিয়ায় বড় ক্লান্ত করে দিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বালিশে এলিয়ে পড়ে প্রীতম। বড্ড ঘুম আসছে। মনটা হালকা। পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। সারাজীবন ধরে মানুষ কেবলই ভুল দাবিদাওয়া করে যায়।

শুনছ! এই, শুনছ! প্রীতম!

প্রীতম সাড়া দিল না। অগাধ ঘুম তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

বিলু তড়িৎ পায়ে উঠে পাশের ফ্ল্যাটে দৌড়ে গেল টেলিফোন করতে।

আধ ঘণ্টা পর ডাক্তার এল। দেখল। ওষুধ লিখল। কিন্তু বিলুর কোনও প্রশ্নেরই স্পষ্ট জবাব দিল। বলল, খুব স্ট্রেন গেছে। দেখা যাক কী হয়।

সিরিয়াস নয় তো!

মনে তো হচ্ছে না। দেখা যাক।

একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠে শতম গিয়েছিল প্রাতঃভ্রমণে। ফিরে এসে দাদার অবস্থা দেখে কেমনধারা হয়ে গেল। মুখ ফ্যাকাসে, চোখে আতঙ্ক। বারবার জিজ্ঞেস করে, বউদি, দাদা বাঁচবে তো? কিছু হয়নি তো?

না। তুমি ভেবো না শতম।

তুমি অফিসে যাবে বউদি?

না, আজ অফিসে যাওয়ার কথাই ওঠে না।

প্রেসক্রিপশনটা দাও। আমি ওষুধ এনে দিচ্ছি।

অচলাই পারবে।

না, না।—অধৈর্যের গলায় প্রায় হুংকার ছাড়ে শতম, আমি আনব। দাও।

প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে বিলু যখন টাকাও দিতে গেল তখন আবার হুংকার ছাড়ে শতম, টাকা? দাদার ওষুধের জন্য টাকা নেব? রাখো তো! খুব রোজগার করতে শিখেছ।

কথাটায় কামড় ছিল, কিন্তু শতমের মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলতে সাহস পেল না বিলু। ও চলে গেলে বিলু চুপি চুপি বাথরুমে ঢুকে দোর দিল। আয়নায় নিজের মুখখানা দেখল অনেকক্ষণ ধরে। কাল রাতের ব্যাপারটা কি টের পেল প্রীতম? ছিঃ ছিঃ।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়