২৬.

চড়াই পাখিটা ছিল ব্যাচেলার। গত বছর দুয়েক ধরে তাকে লক্ষ করছে বিজু। তার দোতলার একটেরে ঘরে জানালার ধারে কাঠের আলমারির ওপর রাখা একটা পটের পিছনে সন্ধেবেলায় এসে আশ্রয় নিত। সকালে উড়ে যেত বিষয়কর্মে। বাসা-টাসা করেনি। কোনও ঝামেলা ছিল না তার।

পাখিটা মরল হারানির দোষে। দোষ কিছুটা মায়েরও। পাখিটা মরতে পারে এই ভয়ে ঘরের সিলিং ফ্যানটা কখনওই চালায় না বিজু। যদিও অভ্যাস ও স্বাভাবিক আত্মরক্ষার তাগিদে চড়াইপাখিরা সিলিং ফ্যান এড়িয়ে ওড়াউড়ি করতে পারে। তবু সাবধানের মার নেই। হারানিকে পই পই করে বলা আছে, ঘর মোছার পর শুকনোর জন্য যেন সিলিং ফ্যান না চালানো হয়। এখন শীতকাল, শুকনো জলীয় বাষ্পহীন বাতাসে চট করে ঘর শুকিয়ে যায়।

দোতলায় এই একটিই ঘর। তা বলে চিলেকোঠা নয়। আসলে একতলা হওয়ার পর দোতলাও তুলে ফেলছিল নরহরি। তিন ভাইয়ের মাথাতেই ছিট আছে। তাদের জীবনে মাপজোখ বা হিসেবনিকেশের বালাই নেই। তিনজনেরই ঝোঁকের ওপর চলা। আবার সঙ্গে চণ্ড মেজাজও আছে, কেউ কিছু তাদের বোঝাবে তার জো নেই। দোতলা যখন তেড়েফুঁড়ে উঠছে তখন বিজুর মা প্রমাদ গুনল। কারণ একতলাটাই পেল্লায়। পাঁচখানা শোওয়ার ঘর, বৈঠকখানা, দর-দালান সব হাঁ-হাঁ করছে। দুটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, আছে শুধু ছেলেটা। তিনটে প্রাণীর জন্য একতলাটাই তো বড় বড়। কিন্তু নরহরিকে সে কথা বোঝাবে কে? অগত্যা বিজুর মা গিয়ে মহিম রায়কে ধরে পড়ল, দাদা, আপনাদের ভাইকে একটু বোঝাবেন আসুন। কী কাণ্ড যে করছে। অত বড় একতলাটাই আমি সামাল দিতে পারছি না, দোতলা তো আমাদের গিলে খাবে। টাকারও শ্রাদ্ধ হচ্ছে।

মহিম রায় শুনে বলেছিল, বংশের ধারা যাবে কোথায় বউমা, সব যে এক ছাঁচে গড়া। ওদের মাথায় যা চাপে তা মানায় কার সাধ্য। গৌরদাকেও তো দেখি, উঠল বাই তো কটক যাই।

তা মহিম রায় এসেছিল।

নরহরি মহা আহ্লাদে নতুন বাড়ি তাকে ঘুরিয়ে দেখাল।

 কেমন দেখছেন দাদা?

এ যে তাজমহল বানিয়ে ফেলেছিস!

কী যে বলেন! চিরকাল বড় বাড়িতে থেকে অভ্যেস তো, তাই একটু বড় করেই বানালাম।

তা বেশ। কিন্তু বড়রও তো একটা মাপ থাকবে, না কি?

কেন, একটু বেশি বড় বয়ে গেল নাকি?

ওরে আহাম্মক, বড় বাড়িতে ছিলি, তা সেখানে বড় সংসারও ছিল। জনমনিষ্যি ছিল। কিন্তু তোর জন কোথায়? পাঁচখানা শোওয়ার ঘর তোর কোন কাজে লাগবে? একটাতে স্বামী-স্ত্রী, একটাতে বিজু, আর দুখানা ঘরে দুই মেয়ে-জামাই এলে থাকবে–এ পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আরও দুখানা শোওয়ার ঘর দিয়ে কী হবে?

আহা অতিথ-বিতিথও তো আসতে পারে। ও দুটো গেস্টরুম বলেই ধরে নিন।

ধরলুম। তাহলে দোতলাটা কী করবি?

নরহরি থমকাল। ভেবে-টেবে বলল, লেগে যাবেখন কাজে।

ওরে, এত বড় বাড়ি ভরতে গেলে যে তোকে আবার সংসার করতে হয় বাঙালের মতো। সেরকমই ইচ্ছে নাকি?

ছিঃ ছিঃ কী যে বলেন।

তাহলে আর টাকার শ্রাদ্ধ করিসনি। এ হল গ্রামদেশ, বাড়তি ঘরে যে ভাড়া বসাবি তাও হবে না। গৌরদা তোকে পৈতৃক বাড়ির ক্ষতিপূরণ বাবদ অনেক টাকা দিয়েছে জানি, কিন্তু সব টাকাই যে ঢালতে হবে তার কোনও মানে নেই। টাকাটা হাতে রাখ।

সেটা কি দাদার সঙ্গে বেইমানি হবে না?

দুর পাগল! গৌরদা কি বলে দিয়েছে সব টাকা ঢেলে এত বড় বাড়ি করতে? যা না, গৌরদার সঙ্গেই কথা বলে দেখ।

গৌরহরি অবশ্য মহিমের মতে মত দেননি। নরহরির কাছে সব শুনেটুনে বলেছিলেন, মহিমটা হল চিটেগুড়ের পিঁপড়ে। হিসেবনিকেশ ছাড়া এক পা চলে না। ঠিক আছে, বাড়ি কেমন হল আমি কাল গিয়ে দেখে আসব।

গৌরহরি সব দেখেশুনে অবশ্য রায় দিলেন, আজকাল কাজের লোকের খুব সমস্যা শুনতে পাই। এতগুলো ঘর ঝাড়পোঁছ করতে বউমার কষ্ট হবে। দোতলাটা বরং থাক।

নরহরি বলল, তোমার দেওয়া টাকার যে অনেকটাই তাহলে থেকে যাবে। ও টাকা তাহলে ফেরত নাও।

গৌরহরি গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, গৌর চাটুজ্জে দেওয়া জিনিস কখনও ফেরত নেয় দেখেছিস? টাকা আছে থাক। ওটা আমার আশীর্বাদ।

দোতলাটা তাই আধখ্যাঁচড়া হয়ে রইল। একখানা বড় ঘর, লাগোয়া বাথরুম। বাকিটা ভোলা ছাদ। ছাদের চারদিকে পিলারের মাথা শিকসমেত খাড়া হয়ে আছে। রেলিং নেই।

দোতলার ঘরটা দখল করেছিল বিজু। ভারী নিরিবিলি তার এই ঘর। সারাদিন শব্দহীন এই ঘরে তার সারি সারি বন্ধু হল র‍্যাক ভর্তি বই। গল্পের বই ছাড়াও আছে বিজ্ঞান আর আইনের বই। ইনকাম ট্যাক্স প্র্যাকটিস শুরু করার পর থেকে সেইসব বইও বিস্তর ঢুকেছে। আর আছে মিউজিক সিস্টেম, কম্পিউটার, অসময়ে চা খাওয়ার জন্য স্টোভ আর চায়ের সরঞ্জাম।

চড়াইপাখিরা বাসা বাঁধবার কম চেষ্টা করেনি এ-ঘরে। কিন্তু একবার বাসা বাঁধলে ঘরদোর নোংরা হতে শুরু করবে বলে বাসা ভেঙে দেওয়া হত। বারবার বাধা পেয়ে চড়াইপাখিরা হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন একতলার ফাঁকা ঘরগুলোর ঘুলঘুলিতে তারা দিব্যি আঁকিয়ে আছে।

শুধু এই একটা পাখিই দলছুট হয়ে থেকে গিয়েছিল। এ বাসা-টাসা বানানোর চেষ্টাই করেনি। একা একা থাকত। যখন-তখন আসত যেত। কাঠের আলমারির ওপর একখানা কালীঘাটের পট রয়েছে কতকাল। তারই পিছনে রাত কাটাত। বিজুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হত প্রায়ই। বিজু তার নাম দিয়েছিল ব্রহ্মচারী।

জানালার ধারে নিজের টেবিলচেয়ারে বসে পড়াশুনো করার সময় কতবার ব্রহ্মচারী তার কাঁধের ওপর দিয়ে যাতায়াত করেছে। খুব একটা ভয় পেত না তাকে। পাখিরাও শত্ৰুমিত্ৰ চেনে, পছন্দ বা বিদ্বেষ বুঝতে পারে। ব্রহ্মচারীকে সে নানাভাবে নির্ভয় করার চেষ্টা করেছে। তবে মাঝে মাঝে হুমকি দিত। একা থাকো, ওয়েলকাম। কিন্তু গার্লফ্রেন্ড জোটালে মুশকিল আছে।

ব্রহ্মচারী মারা পড়ল ভোরবেলা। তখন বিজু বাথরুমে। ওই সময়েই হারানি এল ঘর ঝাড়পোঁছ করতে। পিছনে মা।

শীতকাল বলে জানালা বন্ধ ছিল। সেটা খুলে দেওয়ার কথাটাও মনে ছিল না কারও। ঘর ঝাট দিয়ে জলন্যায় যখন ঘর মুছছিল হারানি তখন মা বলল, ওরে ছেলেটা এখনই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসবে। ভেজা মেঝেতে পায়ের ছাপ পড়বে। পাখাটা খুলে দে, তাড়াতাড়ি শুকোক।

আর ব্রহ্মচারী তখন ঘরে আগন্তুকের সাড়া পেয়ে বাইরে বেরোবার জন্য পটের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চক্কর কাটছিল বাতাসে। ফুল স্পিডে পাখা খুলে দিয়েছিল হারানি। আর বলেছিল, হুশ, হুশ…

বিভ্রান্ত ব্রহ্মচারী ভয় খেয়ে পাখার চক্করে গিয়ে একটিমাত্র টং শব্দ তুলে ছিটকে পড়েছিল মশারির চালিতে। শবদেহ। ওইটুকু পাখি কি পারে অত বড় চোট সহ্য করতে? কতটুকু শরীর তার? কতই বা প্রাণশক্তি?

বাথরুম থেকেই ঘটনাটা আঁচ করতে পেরে বিজু চেঁচিয়ে বলেছিল, পাখা বন্ধ করো! পাখা চালিও না।

সে কথা শুনতেই পায়নি কেউ।

যখন বেরিয়ে এল তখন অপরাধী মুখ করে মা দাঁড়িয়ে। হারানি ব্যস্ত সমস্ত হয়ে মৃত পাখিটাকে খুঁজছে।

লম্বা বিজু একবার দৃষ্টিক্ষেপেই ব্রহ্মচারীর মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছিল। হাত বাড়িয়ে পাখিটাকে করপুটে নিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে সে শোকাহত গলায় বলল, কী করলে বল তো মা?

কী করব বল! বোকা পাখিটা যে ওরকম পাগলের মতো ওড়াউড়ি করবে তা কি জানতুম! পাখা তো বন্ধ করেছিলাম, কিন্তু তার আগেই

হারাণি মুখ নিচু করে ঘর মুছে যাচ্ছিল। সেও জানে, কাজটা ঠিক হয়নি।

বিজু তার দিকে চেয়ে বলল, দুঃখের কথা কী জানিস হারাণি? মানুষ মারলে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হয়, কিন্তু পশু-পাখির বেলায় হয় না। আইনে থাকলে আজ তোরও ওরকম সাজা হতে পারত।

হারানি অতি ছলবলে ও ফিচেল এক কিশোরী। দীপ্ত ডাগর চেহারা। টানা টানা চোখ, মুখের ডৌলটিও চমৎকার। বিজুর প্রতি তার বয়সোচিত আকর্ষণ যে আছে তা সে প্রায়ই কটাক্ষে প্রকাশ করে। একটু-আধটু ঠাট্টাইয়ার্কি করতেও ছাড়ে না। আজ বুঝল, সে একটা ঘোরতর অন্যায় করে ফেলেছে।

করুণ মুখ তুলে বলল, আমার খুব পাপ হল, না?

খুব পাপ করেছিস। পাখিটা আমার বন্ধু ছিল।

 তুমি রাগ করলে দাদা! কিন্তু পাখিটা যে কেন অমন ভয় খেল!

ভয় তো খাবেই। ওরা যে তোদের বিশ্বাস করতে পারে না।

ভারী ছলছলে হয়ে গেল হারানির চোখ। আর একটিও কথা না বলে ঘর মোছা শেষ করে উঠে হাত বাড়িয়ে বলল, দাও।

বিজু তখন চেয়ারে বসে করপুটে ধরা ব্রহ্মচারীর মৃত শরীরের দিকে চেয়ে ছিল। বলল, কী চাস?

পাখিটা দাও।

কী করবি?

 দাতাবাবার কাছে নিয়ে যাব।

সে কে?

একজন গুণীন।

অবাক হয়ে বিজু বলে, সে কী করবে?

 সে মরা জিনিস বাঁচাতে পারে।

 ধুস। এখন যা, আমার মন ভাল লাগছে না।

 মা যায়নি। দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। বলল, দে না ওকে। গুণীন-টুনিরা তো অনেক কিছু পারে।

 কী যে সব আনসায়েন্টিফিক কথা বলো তার ঠিক নেই।

 চেষ্টা করতে দোষ কী? দুনিয়ায় কত কিছু হয়, আমরা কি তার খোঁজ রাখি!

এসব করে কি আমাকে ভোলাতে পারবে? আমি তো আর বাচ্চা ছেলে নই।

 হারানি হাতটা বাড়িয়েই ছিল। বলল, দাও না আমাকে।

 বিরক্ত বিজু মৃত পাখিটা ওর হাতে দিয়ে বলল, গুণীনের কাছে যেতে হবে না। মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দিস।

সকাল থেকে মনটা বড় খারাপ বিজুর। তার নির্জন ঘরে পাখিটার আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেল। যতদিন না আর কোনও ব্রহ্মচারীর আগমন ঘটে।

পিছনে বিরাট বাগান করেছে নরহরি। ওটা তার বরাবরের নেশা। বাগানে সবজি ফলাবে। যত না খাবে তার বহুগুণ বেশি বিলোবে। মুলো, পালং, কপি, আলু অবধি। এই সময়টায় বাবা বাগানে বহুক্ষণ কাটায়। সঙ্গে জনা দুই মুনিশ থাকে। ঘরের জানালাগুলো খুলে দিল বিজু। পুবের জানালা দিয়ে শীতের রোদ এসে পড়ল অনেকখানি মেঝে আর বিছানা জুড়ে।

মা মশারি খুলে ভাঁজ করে রেখে বিছানায় বেডকভার ঢাকা দিতে দিতে বলল, অমন মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? মানুষ তো মশা-মাছিও মারে। পায়ের তলায় পিঁপড়েও তো মরে। তা বলে কি পাপ হয় নাকি?

বিজু জবাব দিল না। মাকে নিয়েও তার সমস্যা বড় কম নয়। তার মা হল পুত্রগতপ্রাণ। ছেলের প্রতি মার পক্ষপাত দৃষ্টিকটু পর্যায়ের। তার দুই দিদিই বহুবার কথাটা বলেছে। বিয়ের আগে মাঝে মাঝে বিজুকে নিয়ে মার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বাধত তাদের। দিদিদের যুক্তি যথেষ্ট জোরালোই ছিল। বিজু মাকে কতদিন বকেছে, তোমার এত পারশিয়ালিটি কেন মা?

আজও, ছেলের প্রতি মার ওই দুরারোগ্য পক্ষপাত বিজুকে বিরক্তই করে। বিজু একটু চুপ করে বসে থাকলে, বাড়ি ফিরতে একটু দেরি করলে বা কোথাও ট্রেকিং কি বেড়াতে গেলে মা অস্থির হয়ে পড়ে। তার মার জন্যই সে আজ অবধি অনেক ইচ্ছেকে চেপে রেখে দিয়েছে।

টান ভালবাসা যে মানুষকে কখনও কখনও কত অপদার্থ করে দেয় তা বিজু ভালই জানে। দশ-বারো বছর বয়স অবধি সে নিজের হাতে খেতে পারত না, পোশাক পরতে পারত না। এই যে সে দোতলার ঘরে একা থাকে তাতে মার স্বস্তি নেই। দিনে শতেকবার নানা ছুতোয় এসে তাকে দেখে যায় মা। সবসময়ে সামনে আসে না, সবসময়ে জানান দেয় না। কিন্তু গোয়েন্দার মতো নজর রাখে। তার এই ঘরের একাকিত্ব আজও নিরঙ্কুশ নয়।

মাঝে মাঝে মার ওপর রেগে যায় বিজু। আবার মায়াও হয়।

সে মার দিকে চেয়ে বলল, এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও তো। আমার ভাল লাগছে না।

মা চলে যাওয়ার পর ভোলা ছাদে রোদের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ায় বিজু। মন ভাল নেই। মন ভাল নেই। দুদিন ঝড়জলের পর আজ ভারী সুন্দর দিন। তীব্র উত্তরে বাতাস আর রোদ মিলে ঝলমল করছে একটা ধোয়ামোছা সকাল। গাছে গাছে বাতাসের ঝোড়ো শব্দ। চারদিকে পাখির ডাক। মন ভাল নেই।

এই যে এত সহজেই তার মন খারাপ হয়ে যায়, এটা সুলক্ষণ নয়। আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, ব্যক্তিগত মৃত্যুচিন্তা আমার নেই। কারণ চারদিকে যে প্রাণের লীলা, প্রাণের এত প্রকাশ তার মধ্যেই আমিও একজন মাত্র। আমি এই প্রাণবন্যারই একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।

কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি? সে কি এই যে, একটাই সত্তার প্রকাশ ঘটছে ঘটে ঘটে, নানা বিভঙ্গে, মূর্তিতে, আকারে, বিশিষ্টতায়? এই যে ব্রহ্মচারী আজ মারা পড়ল এটা কিছু নয়। একটি প্রাণ নিবে গেলেও যৌথ প্রাণ জেগে আছে? কিংবা এরকমই কিছু?

বিজুদা! এই বিজুদা!

কে রে?

আমি। ন্যাড়া ছাদের ধারে এগিয়ে গিয়ে বিজু দেখে, পান্না। উমুখে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চোখের রোদ আটকাচ্ছে।

কী রে?

একটু ওপরে আসব?

আয় না! অনুমতি নেওয়ার কী হল?

কী জানি বাবা। ছোটমা বলল, পাখি মরেছে বলে তোমার নাকি মন খারাপ।

তা খারাপ একটু আছে। মা কি তোকে আসতে বারণ করল নাকি?

না। শুধু বলল, মেজাজ বিগড়ে আছে, বুঝেসুঝে যাস।

 আসতে পারিস।

 তোমার বাঁদরটা কি ওপরে নাকি?

 আরে না। ও তো রাতেরবেলায় গোয়ালে বাঁধা থাকে।

ভারী অসভ্য বাঁদর।

 কেন রে?

 বাঃ রে, সেদিন তোমার কাধ থেকে নেমে আমাকে তাড়া করেছিল না?

তুই ওকে ক্ষ্যাপাচ্ছিলি বলেই তাড়া করেছিল। এমনি নয়।

 বাঁদরকে সবাই ক্ষ্যাপায়।

তাহলে তাড়াও খেতে হয়।

 আসছি, দাঁড়াও।

 পান্না ওপরে উঠে এল।

এই সাতসকালে কী এমন কথা রে তোর?

তোমার তো ইন্টারনেট আছে, তাই না?

ইন্টারনেট! পাগল নাকি? তোর কি ধারণা পশ্চিমবঙ্গে গাঁয়ে গাঁয়ে ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে?

 এ মা! আমি যে একজনকে বললাম তোমার ইন্টারনেট আছে।

 কাকে বললি?

 সেটা বলা যাবে না। কারণ আছে। নেই তাহলে?

না। ইন্টারনেট দিয়ে কী হবে?

একটা ওয়েবসাইট ধরতে হবে।

কোন ওয়েবসাইট?

ডিপ্রেশন ডট কম।

ডিপ্রেশনটা কার হল? তোর নাকি?

ডিপ্রেশন কার নেই বলো। আমার, তোমার, সকলেরই আজকাল খুব ডিপ্রেশন। এই যে চড়াইপাখিটা মরে গেল তুমি ডিপ্রেসড।

চড়াইপাখিটা আমার একজন ভাল বন্ধু ছিল, জানিস? আসত, যেত, কোনও ঝামেলা ছিল না। ভদ্র, সভ্য, একা একটা পাখি।

বাব্বাঃ, তোমার যে কাব্য বেরোচ্ছে বিজুদা! ক্রৌঞ্চমিথুনের দুঃখে বাল্মীকির যেমন ধারা হয়েছিল।

তোর মাথা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পান্না বলে, একটা পাখির জন্য তোমার যা দরদ তার একশো ভাগের এক ভাগও যদি আমাদের জন্য থাকত।

কেন রে, তোর আবার আলাদা দরদের দরকার হল কেন? দিব্যি তো আদরে আহ্লাদে বখা হয়ে যাচ্ছিস। কাকা আর কাকিমা আসকারা দিয়ে মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে।

আহা, আর বোলা না। বাবা মা দেবে আমাকে আসকারা! উঠতে-বসতে মা চুলের মুঠি ধরতে আসে, জানো? আর বাবা তো কবেই আমাকে বেড়াল পার করতে চেয়েছিল গৌরীদান করে। সব ভুলে গেছ?

তাই তো! তোর তো তবে বড্ড দুঃখ।

ইয়ার্কি কোরো না, ভাল লাগে না।

তোর মাথা আরও একজন চিবিয়ে খাচ্ছে।

 ওমা! আবার কে চিবিয়ে খাবে গো! আমি কি রুইমাছ নাকি যে সবাই আমার মুড়ো চিবোবে!

রুইমাছ নোস, তুই হচ্ছিস হদ্দ বোকা আর গেঁয়ো একটা মেয়ে।

কেন ওকথা বলছ! আমার যে ভয় লাগছে!

 ভয় লাগছে না হাতি! ও মেয়েটার সঙ্গে তোর অত মাখামাখি কীসের?

কোন মেয়ে? কার কথা বলছ?

কার কথা বলছি ভালই জানিস।

বুঝেছি। সোহাগ তো!

ও মেয়েটার নামে নাকি তোর নাল গড়ায়! এই তো সেদিন কাকিমা বলছিল, রাত নেই দিন নেই যখন-তখন এসে হামলে পড়ে। তারপর দরজা বন্ধ করে গুজগুজ ফুসফুস।

যাঃ, মোটেই না। মা ওরকমই। তিল থেকে সবসময়ে তাল বের করে।

তার মানে কি সোহাগ তোর কাছে আসে না?

আসবে না কেন? মাঝে মাঝে আসে।

এসে তোর পড়াশুনো নষ্ট করে?

মোটেই না। খুব এটিকেট মেনে চলে। ও আসে দুপুরবেলা, তখন আমি পড়ি না।

কী মন্ত্রে দীক্ষিত করছে তোকে?

যাঃ, কী যে বলো না। সোহাগ খুব ভাল মেয়ে। খুব দুঃখী। একটু পাগলাটে আছে বটে, কিন্তু খারাপ নয় তো! তোমার বাপু, সোহাগের ওপর বড্ড বেশি রাগ।

অকারণে রাগ তো নয়। যেসব ছেলেরা ওর পিছনে লাগত, আজকাল দেখছি তাদের সঙ্গে মাঠেঘাটে বসে আড্ডা দিচ্ছে।

তাতে কী হয় বিজুদা? ছেলেগুলোর সঙ্গে ভাব করায় ওরা আর তো ওর পিছনে লাগে না।

 মাঝখান থেকে ছেলেগুলোকে শাসন করতে গিয়ে আমিই আহাম্মক হলাম। ডিসগাস্টিং।

 রাগ করছ কেন? দোষটা ওর নয়।

তবে কার?

একটু ভেবে পান্না বলল, বোধহয় আমার।

তোর দোষ কেন হবে?

ছেলেগুলো একদিন আমার সামনেই ওকে যা-খুশি বলছিল। তাতে আমি ভীষণ রেগে গিয়ে তোমার কাছে নালিশ করে দিই। সোহাগ কিন্তু বারণ করেছিল।

জানি। বড়মার কাছেও বলে গেছে ওর নাকি আমার সাহায্যের দরকার নেই। খুব দেমাক। এখন হয়তো আমার মুখে চুনকালি মাখানোর জন্যই ওই ছেলেগুলোকে জুটিয়ে মক্ষীরানি সেজেছে।

ওর ওপর তোমার খুব রাগ, না?

 কথাটা দুবার বললি। রাগ হওয়ার কারণ ঘটলেই রাগ হয়।

কথাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। সোহাগ বলে, পৃথিবীর সব জায়গায় তো বডিগার্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে না। তাই মেয়েদের নিজেদেরই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আর আত্মরক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায় হল শত্রুকে বন্ধু করে নেওয়া।

বেশ কথা। মেয়েদের বন্ধু জোটাতে সময় লাগে না, বিশেষ করে যদি একটু চটক থাকে। ও যেসব ছেলেদের সঙ্গে মেশে তারা কী ধরনের ছেলে তা কি ও জানে? তা ছাড়া এসব বেলেল্লাপনা কি গাঁদেশে চলে?

দিনকাল পালটে গেছে বিজুদা।

কবে পালটাল? আর পালটালে তুই টের পেলি, আমি পেলাম না কেন?

বড্ড রেগে আছ তুমি। আজ পাখিটা মরে যাওয়ায় সত্যিই তোমার মাথা গরম।

হ্যাঁ, গরম। আজ আমার মন ভাল নেই। পাখি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, গাছপালা এসব নিয়েই পৃথিবীর পরিমণ্ডল। সবাইকেই পৃথিবীর দরকার। নইলে এত সব প্রাণীর বৃথা সৃষ্টি হত না। মানুষ সেটা বুঝতে বড্ড সময় নিচ্ছে। ওই যে লোকটা কী নাম যেন জিম করবেট, তাকে প্রায় মহাপুরুষ বানানো হয়েছে। লোকটার শিকারকাহিনী এখনও রাশি রাশি বিক্রি হয়। লোকটার মস্ত কৃতিত্ব হল বন্দুক দিয়ে বাঘ মারা। এটা কোনও বীরত্বের কাজ? আমি সেসময়ে ক্ষমতায় থাকলে লোকটিকে দেশ থেকে বের করে দিতাম। ওরা হচ্ছে সেই জাত যারা বছরে একবার শেয়াল মারার উৎসব করে।

ওঃ, আজ তুমি বড্ড রেগে আছ বিজুদা।

 রাগলে কী হবে? এ হল ফান্টুস রাগ। এ রাগ দিয়ে কাজ হয় না। শুধু হাত কামড়ে মরি। পাখিটা মরল কেন জানিস? মা আর হারানির বুদ্ধির দোষে। পাখাটা চালানোর দরকার ছিল না, জানালাটা খুলে দেওয়া উচিত ছিল। বেরোতে না পেরে পাখিটা ভয় খেয়ে দিশেহারা হয়ে পাখাটায় ধাক্কা খেল। হি ওয়াজ গুড ম্যান।

ম্যান?

আমার কাছে পাখিটা তাই ছিল। এ ম্যান, এ জেন্টেলম্যান।

 মেয়ে পাখিও তো হতে পারে।

তা পারে।

মেয়েই হবে।

কী করে বুঝলি?

 হি হি করে হেসে পান্না বলে, ওটা ছিল তোমার গার্লফ্রেন্ড।

 মারব থাপ্পড়। যা ভাগ এখন।

ওয়েবসাইটটার কী হবে?

কিছু হবে না। তোর বন্ধুকে কলকাতায় যেতে বল।

আচ্ছা, একটা কথা বলবে?

 আবার কী কথা?

সেদিন বৃষ্টির মধ্যে তোমাদের ভিতর কী হয়েছিল?

আচমকা বিজুর কান গরম হয়ে গেল। মুখখানা লাল। পান্নার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল সে। বিজু ভেবেছিল, দৃশ্যটা কেউ দেখেনি। ক্ষীণ আশা ছিল, সোহাগ কাউকে ঘটনাটার কথা বলবে না। তাই ধরা পড়ে গিয়ে নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে তার।

বিজু বলল, কেন বল তো! তোকে সোহাগ কিছু বলেছে?

খুব বেশি বলেনি।

কী বলেছে? 

বলেছে, তোমাদের মধ্যে একটা বিচ্ছিরি ইনসিডেন্ট হয়েছে।

 ওভাবে বললে লোকে অন্য কিছু ধরে নিতে পারে।

তোমরা কি ঝগড়া করেছ?

বরং ঝগড়াই ভাল ছিল। এটা তার চেয়েও খারাপ।

কী হয়েছিল বিজুদা?

 মেয়েটা যে পাগল তা জানিস?

আছে একটু। সকলের মতো তো নয়। ও একটু অন্যরকমভাবে চিন্তাভাবনা করে।

পাগলরাও তো তাই। তারা আর পাঁচজনের মতো নয়, তাদের চিন্তার জগৎ আলাদা। তাই তো!

পায়ে পড়ি, বলো না!

মেয়েটা সেদিন ওই ঠান্ডায় আর ভয়ংকর বৃষ্টির মধ্যে কাঞ্জিলালের জমিটায় নেচে বেড়াচ্ছিল।

হ্যাঁ, এরকম সব কাণ্ড ও করে তো।

দোষের মধ্যে আমি গিয়ে ওকে অ্যালার্ট করার চেষ্টা করি।

 ভালই তো করেছিলে।

করুণ একটু হেসে বিজু বলল, ভাল আর হল কই? আমি বারবার ডাকছিলাম। সাড়া না পেয়ে গিয়ে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই ও কেমন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তারপর উঠে সে কী রাগ! পাগল আর কাকে বলে!

একটু চুপ করে থেকে পান্না বলল, হ্যাঁ, ওর নাকি মাঝে মাঝে একটা ট্রান্সের মতো হয়। সে সময়ে কেউ ওকে ধরলে অজ্ঞান হয়ে যায়।

ও হল মৃগি রোগ, বুঝলি! মৃগির সঙ্গে পাগলামি।

সবাই তো একরকম হয় না বিজুদা। ও ওর মতো।

 বন্ধুর হয়ে ওকালতি করতে এসেছিস?

তা নয়। একটু বুঝবার চেষ্টা করো। ও খুব দুঃখী একটা মেয়ে।

দুঃখী!

খুব দুঃখী। তুমি বুঝবে না বিজুদা। মা-বাবার কাছ থেকে ও কোনও প্রশ্রয় পায় না। খুব অশান্তি ওদের সংসারে। সবাই নাকি সবাইকে ঘেন্না করে।

আমার ওসব জেনে কী হবে?

একটু চুপ করে থেকে পান্না বলে, ও তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে।

নাটক নাকি?

সত্যিই চেয়েছে।

 আর নাটকের দরকার নেই। ঘটনাটা আমি ভুলে যাব।

ওকে কী বলব?

কিছু না।

.

২৭.

চোখ চেয়েই জানালার বাইরে একজোড়া চোখ দেখতে পেল সে। চমকে উঠল। জানালার কপাটের আড়ালে লুকোনো মুখ। শুধু দুখানি চোখ নিবিড় দৃষ্টিতে চেয়েছিল। সে তাকাতেই সরে গেল টপ করে। সঙ্গে কাচের চুড়ির একটু ঠিন ঠিন শব্দ।

কে ওখানে?

প্রথমে জবাব নেই।

গায়ের লেপটা সরিয়ে উঠতে উঠতে সে ফের প্রশ্ন করে, কে রে?

ক্ষীণ জবাব এল এবার, আমি।

আমি কে?

আমি হিমি।

বড্ড সাহস হয়েছে তো মেয়েটার! গত কয়েকদিন শুধু বারবার এ বাড়িতে নানা ছুতোয় হানা দিয়েছে আর সুযোগ পেলেই হাঁ করে দেখেছে তাকে। মুচকি হাসি, চোখের ইশারাও শুরু হয়েছে ইদানীং। কিন্তু এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি!

আজ কেউ বাড়িতে নেই। বাবা গেছে মরণ, হাম্মি আর মরণের মাকে নিয়ে বর্ধমানে কী সব গেরস্থালির জিনিস কেনাকাটা করতে। ফাঁকা বাড়িতে আছে শুধু দুটো কাজের মেয়ে, গোটাকয় মুনিশ আর কুকুর বেড়াল। এই অবস্থায় মেয়েটা কেন এল?

কী চাও?

এমনিই এসেছিলাম। খুড়িমা নেই?

ওরা যখন বর্ধমানে রওনা হচ্ছিল তখন দোতলা থেকে হিমিকে সদর দরজার আগলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সুমন। ন্যাকা! জানে না যেন!

না , নেই।

মেয়েটা চুপ। সুমন টের পেল, এখনও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েদের অভিজ্ঞতা সুমনের কম নেই। নারীসঙ্গ তার প্রিয়। কলকাতায় তার একগাদা মেয়েবন্ধু আছে। বলতে কী, ছেলেবন্ধুর চেয়ে তার মেয়েবন্ধুই বেশি। এখানে এসে অবধি সে নারীসঙ্গের একটু অভাববোধ করছে ঠিক। সে অভাব মেটানোর সাধ্য তো হিমির নেই। একটা সুন্দর চেহারার ছেলে দেখে ঢলে পড়া এবং বিয়ের লাইনে চিন্তা করা ছাড়া ওসব মেয়ের মন আর কোনও চিন্তা করতে পারে না। এইট না নাইনে পড়ে বলে শুনেছিল যেন একবার।

সুমন একটু ভাবল। একটা ধমক দিলেই মেয়েটা চলে যাবে। কিন্তু ধমক না দিয়ে ডেকে একটু কথা বললে কেমন হয়? ঠিক এই ক্লাসের কোনও মেয়ের সঙ্গে তো তার বন্ধুত্ব হয়নি।

ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভিতরে এসো।

মেয়েটা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আসব?

এসো। ডাকলাম তো!

খুব বাধো বাধো পায়ে মেয়েটা এসে দরজার ফ্রেমে দাঁড়াল। পশ্চিমের জানালা দিয়ে শীতের ঢলানি রোদ অনেকটা মেঝে পার হয়ে দরজার কাছে গিয়ে থেমেছে। সেই আলোয় সুমন দেখল, মেয়েটা এই দুপুরেও একটু সেজেছে। জংলা ছাপা শাড়ি, কপালে টিপ, চুল বিনুনিতে বাঁধা। ঠোঁটে একটু লিপস্টিকও কি? এতদিন তাচ্ছিল্যে তাকায়নি সুমন ভাল করে। এখন দেখল, সুন্দরী না হলেও হ্যাঁক ছিঃ নয় মোটেই। যৌবনে কুকুরী ধন্যা।

চৌকাঠে থমকে গেছে মেয়েটা। আর এগোতে সাহস পাচ্ছে না।

সুমন বলল, আরে এসো, এসো।

মেয়েটা কেমন থতমত খেয়ে একটু হাসল, মাথা নত করল।

হঠাৎ এই দুপুরে এলে যে! কী ব্যাপার?

 সুমন ধমকায়নি। কড়া গলাতেও বলেনি। মেয়েটা তবু যেন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, আমাকে পাঠাল যে!

সুমন অবাক।

পাঠাল! কে তোমাকে পাঠাল?

দিদিমা। দিদিমা? কে দিদিমা?

মরণের দিদিমা, জিজিবুড়ি।

সুমন জিজিবুড়িকে দেখেছে। রোগা চেহারার একজন বিধবা মহিলার আনাগোনা আছে এবাড়িতে। সুট করে আসে, আর ফুট করে চলে যায়। গতিবিধি কিছুটা সন্দেহজনক। মহিলা কে তা বুঝতে না পেরে একদিন সে মরণকে জিজ্ঞেস করেছিল, বুড়িটা কে রে?

ও তো জিজিবুড়ি।

জিজিবুড়ি আবার কে? আমার দিদিমা। আমি জিজিবুড়ি বলে ডাকি। ওঃ। বলে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি সুমন। মরণ নিজের থেকেই বলল, জানো তো, জিজিবুড়ি রোজ দুধ খেতে আসে আর মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে।

ঝগড়া করে কেন?

ক্যাট ক্যাট করে অনেক কথা শোনায় মাকে। বলে মার সঙ্গে নাকি বাবার মোটে বিয়েই হয়নি। ও বিয়ে নাকি ভড়ং।

বাবার দ্বিতীয় বিয়েটা সম্পর্কে সুমনের তীব্র বিদ্বেষ আছে। যখন তার বাবা বিয়েটা করেছিল তখন সুমনের বয়স কম। ফুঁসে উঠবার মতো ব্যক্তিত্ব তখনও অর্জন করেনি সে। বাড়িতে যে বিশাল গণ্ডগোল হয়েছিল, মা আর বাবার মধ্যে, তার অনেকটারই সাক্ষী ছিল সে। তার মা তার বাবাকে এত গালাগাল করেছিল যে বলার না। পুলিশ এসে বাবাকে ধরেও নিয়ে গিয়েছিল। রসিক সাহা জামিন না নিয়ে কিছুদিন পুলিশের হেফাজতে থেকেও গিয়েছিল। সেটা বোধ হয় বাড়িতে অশান্তি এড়ানোর জন্যই। তারপর অবশ্য কাজ কারবার লাটে উঠছে দেখে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে। বাড়িতে টিকতে না পেরে কোনও আত্মীয়বাড়িতে গিয়েও কিছুদিন ছিল। বাড়িতে মায়ের তখন পাগলের মতো অবস্থা। কখনও কাঁদে, কখনও বাসন-কোসন ছুঁড়ে ভাঙে, কখনও তাদের ভাইবোন দুটোকে অনর্থক পেটায় আর পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বাবার কীর্তি কাহিনী বলে। প্রথম প্রথম পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে শুনতে আসত। কিছু দিন পরে অবশ্য একই কথা শুনতে শুনতে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়তে থাকে। এমন দুঃসময় তাদের জীবনে আর আসেনি। শেষ অবধি কালক্রমে ধীরে ধীরে চেঁচামেচি কমতে লাগল। বাবাও বাড়ি ফিরতে পারল একদিন। বাইরের উত্তেজনা কমলেও পরিবারটা আর স্বাভাবিক রইল না। তাদের চারজনের যে পরিবারটি ছিল তার বাইরেও যে আর একটা লজ্জার সম্পর্ক তৈরি হয়ে রইল সেইটে মেনে নিতে বা সয়ে নিতে সময় লাগছিল তাদের। বাবাকে তখন তার খুব অপছন্দ হত।

তার বাবা অনেকদিন মায়ের ভয়ে গাঁয়ে আসেনি। তখন একবার খবর পাওয়া গেল যে, গাঁয়ের বিষয় সম্পত্তিতে লুটমার হচ্ছে। বাবার দ্বিতীয় বউ সামলাতে পারছে না। তার বাবা বিষয়ী, একরোখা লোক। দেশভাগ হয়ে ঠাঁইনাড়া মানুষের দঙ্গলে মিশে এদেশে এসে বহু কষ্ট করেছে। ক্যাম্পে থাকার সময় ভিক্ষে অবধি করেছে পেটের দায়ে। তারপর নিজের রোখে উঠে দাঁড়িয়েছে। এইসব লোকের কাছে বিষয়সম্পত্তি হল প্রাণ। তার বাবা মায়ের রাগের তোয়াক্কা না করে ছুটে এল গাঁয়ে। মারধর খেয়েছিল, শত্রুতাও কম হয়নি। গোটা তিন চার মোকদ্দমাও লড়তে হয়েছে। কিন্তু রসিক সাহা হার মানেনি।

এই যে সুমনের হঠাৎ গাঁয়ে আসা এর পিছনেও তার মায়ের প্ররোচনা আছে। দশ-বারো বছর ধরে রসিক সাহার একটা সিস্টেম তৈরি হয়েছে। সপ্তাহান্তে শনিবার সে গাঁয়ে আসে দ্বিতীয় পক্ষের কাছে। সোমবার ফিরে যায়। এই নিয়েও বাড়িতে প্রথম প্রথম কুরুক্ষেত্র বড় কম হয়নি। শুক্রবার রাত থেকে মায়ের মাথা গরম হত। সে কী চেঁচামেচি আর শাপশাপান্ত। একবার একটা ভারী তালা ছুঁড়ে মেরে তার বাবার থুতনি ফাটিয়ে দিয়েছিল। তবু রসিক সাহার সিস্টেম ভাঙেনি। এখন সব গা সওয়া হয়ে গেছে। মা তাকে কয়েকদিন ধরেই বলছিল, একবার যা, গিয়ে দেখে আয় সেই বেশ্যাটার তবিলে কত টাকা ঢালছে।

সুমন রাগ করে বলেছিল, আমি যাব কেন? তোমার জানার হলে তুমি যাও।

আমি! আমি গেলে যে ওকে খুন করে আসব।

তা হলে আমাকে পাঠাতে চাইছ কেন?

তোদের ভালর জন্যই চাইছি। শেষ অবধি যদি সবই ওই মাগীর গর্ভে যায় তা হলে তোদের কী হবে?

আমাদের জন্য তো বাবা কম করছে না!

ছাই করছে। আমি জানি, ওই মেয়েমানুষটার পিছনে আরও টাকা ঢালছে।

ঢালুক। আমি যেতে পারব না।

ঢাললেই হল! আমি উকিলের সঙ্গে কথা কয়েছি। দ্বিতীয় বিয়েটা বিয়েই নয়। ওসব বিষয়সম্পত্তিও আমাদেরই। তুই গিয়ে শুধু ওদের মতলবটা বুঝে আয়।

রোজ এইসব কথা শুনতে শুনতে অবশেষে সুমন রাজি হয়েছিল। এখানে এসে অবধি সে এখনও কিছু বুঝতে পারে না। দিব্যি একটা পাড়াগাঁয়ের গেরস্থের সংসার। বাবার দ্বিতীয় বউকে খুব অপছন্দ হবে বলে মনে হয়েছিল সুমনের। কিন্তু কাছে এসে দেখছে মহিলা ভারী ভিতু আর নিরীহ। আজ অবধি উঁচু গলায় কথা কইতে শোনেনি। আর মহিলা সুমনকে সবসময়ে খুশি করতে একটা প্রাণপণ চেষ্টা করে। কিছু খারাপ লাগছে না সুমনের। মানুষের দুবার বিয়ে করাটা হয়তো খারাপ। কিন্তু সেই খারাপের চিহ্ন বা লক্ষণগুলি খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেও সে পেরে ওঠেনি।

জিজিবুড়ি বা তার মা বিয়েটা স্বীকার না করলেও সুমনের মনে হয়েছে, তার বাবা এখানে এসে বেশ ভালই থাকে। মুখে হাসি-টাসি দেখা যায়। কলকাতার বাড়িতে বাবা ভীষণ গোমড়ামুখো।

 সে মরণকে বলেছিল, তোর দিদিমা ওসব কথা কেন বলে?

জিজিবুড়ি তো ওরইমই। সবসময় মুখে খারাপ খারাপ কথা।

জিজিবুড়ি কেমন লোক তা অবশ্য সুমন ভাল করে জানে না। এখনও আলাপ পরিচয় হয়নি।

সে দিকে চেয়ে বলল, দিদিমা তোমাকে পাঠাল কেন?

হিমি চৌকাঠ থেকে এক পাও এগোয়নি, মুখও তোলেনি। আঙুলে আঁচল জড়াচ্ছে আর খুলছে। ওইভাবে থেকেই বলল, জিজিবুড়ি বলছিল, ছেলেটা একা একা থেকে হাঁপসে পড়ছে, যা না গিয়ে একটু গল্প-টল্প কর। শহরের ছেলে তো, ওদের সঙ্গে কথা কইলেও একটা শিক্ষে হয়।

সুমন হাসল, তাই বুঝি?

জিজিবুড়ি বলছিল।

আর কিছু নয়?

না।

তা হলে ঘরে ঢুকছ না কেন? আমি তো তোমাকে খেয়ে ফেলব না।

 মেয়েটা ফিচিক করে একটু হাসল। তারপর লতানে পায়ে একটু এঁকেবেঁকে ঘরে ঢুকল। ইচ্ছে আর লজ্জায় ভাগাভাগি হয়ে।

ওই চেয়ারটা টেনে বোসো।

মেঝেতেই বসি।

 দুর! মেঝেতে কেন বসবে? মেঝে ভীষণ ঠান্ডা। চেয়ারে বসতে দোষ কী?

আমরা যে গুরুজনদের সামনে চেয়ারে বসি না।

 গুরুজন! বলে সুমন হেসে ফেলে, আমি আবার কোন সম্পর্কে তোমার গুরুজন হলাম?

বাঃ, আপনি বি এ পড়েন না!

বি এ পড়লেই গুরুজন হয় বুঝি? অদ্ভুত যুক্তি তো!

তা হলে দাঁড়িয়েই থাকি।

 সুমন মাথা নেড়ে বলে, অত সংকোচের কারণ নেই। আমাকে বন্ধু বলে ধরে নাও।

উরেব্বাস!

ভয় পেলে নাকি?

আপনি কী করে বন্ধু হবেন! আপনি যে বড়!

বড়! সেটা কোনও ফ্যাক্টর নয়। তোমার চেয়ে আমি হয়তো দু-চার বছরের বড়। বুড়োমানুষ তো নই!

মেয়েটা অগত্যা চেয়ারে বসল। মাথা নিচু।

 তুমি তো আমাকে সঙ্গ দিতে এসেছ!

 হ্যাঁ তো।

সঙ্গ দিতে হলে কথা কইতে হয়।

কী বলব?

সেটাও কি আমি শিখিয়ে দেব? বন্ধুদের সঙ্গে কী করে কথা বলো?

 ও সেসব আজেবাজে কথা।

কীরকম আজেবাজে বলো তো!

আমরা কি ভাল কথা জানি!

 তুমি অত সেজেছ কেন?

মেয়েটা অবাক হয়ে বলে, সেজেছি!

 হ্যাঁ তো!

 মেয়েটা লজ্জা পেয়ে বলে, সে তো একটুখানি। এখানে আসব বলে একটা টিপ পরেছি। টিপ না পরলে মা রাগ করে।

লিপস্টিকও দেখতে পাচ্ছি যেন!

মেয়েটা মুখ নিচু করে হি হি করে হাসল। আজকাল মেয়েরা সাজে না জান তো? কলকাতার মেয়েরা লিপস্টিকও মাখে না বড় একটা।

ওমা! তাই?

কেন জান? তারা এখন ভাবে শরীরে রং মাখার চেয়ে শরীরটাকেই সুন্দর করে তোলা ভাল। তাই তারা যোগব্যায়াম করে, ধ্যান করে আর স্কিনের যত্ন নেয়।

আপনি এত জানেন কী করে?

 বাঃ রে, আমার যে অনেক মেয়েবন্ধু আছে।

কজন?

অনেক। দশ-বারোজন তো হবেই।

উরেব্বাস!

অবাক হওয়ার কী আছে? তোমার ছেলেবন্ধু নেই?

মেয়েটা এবার মুখ তুলে বলে, আছে দু-চারজন। ঠিক বন্ধু নয়, চেনাজানা আর কী।

সমান বয়সি?

 হ্যাঁ।

তা হলে ওরা তোমার ছেলেবন্ধুই। তাদের সঙ্গে আড্ডা হয় না?

ঘাড় কাত করে হিমি বলে, খুব হয়।

তা হলে তো তুমি স্মার্ট মেয়ে। অত লজ্জা পাচ্ছিলে কেন?

সুমন যে লজ্জার কারণটা জানে না তা নয়। তার আন্দাজ, এ মেয়েটা তার প্রেমে পড়েছে। আর দুর্বলতা থেকে ওই লজ্জা। প্রেমে পড়লেও কাঁচা প্রেম। চোখের আড়াল হলেই কেটে যাবে। এরা বেশ মেয়ে, শতেকবার প্রেমে পড়ে আর ওঠে।

শীতের এই দুপুরে গেঁয়ো মেয়েটার সঙ্গ তার বেশ ভালই লাগছিল। বিপজ্জনক না হলে লঘু এই প্রেম-প্রেম লাজলজ্জার খেলা খারাপ তো কিছু নয়।

আপনি একটা গল্প বলুন।

গল্প! না, আমি গল্প-টল্প বলতে পারি না। গল্প শুনতে চাও কেন?

এমনি।

তুমি আমাকে সঙ্গ দিতে এসেছ, গল্প তো তোমার বলার কথা।

আপনার মেয়েবন্ধুরা কেউ সাজে না?

কেউ কেউ সাজে। তবে বেশির ভাগই সাজে না।

তারা শুধু ব্যায়াম করে?

 হ্যাঁ। যোগব্যায়াম কাকে বলে জান?

জানি। আমাদের শিখা দিদিমণি শেখায়।

তুমি শেখ নাকি।

হ্যাঁ। আমি অনেক আসন জানি।

বাঃ, তুমি তো তা হলে প্রোগ্রেসিভ মেয়ে। নাচ গান কিছু জান?

আমার গানের গলা নেই। আর এখানে একজন মাত্র নাচ জানে। তবে শেখায় না।

কে বল তো?

চাটুজ্জেবাড়ির মেয়ে পান্না।

 পান্না নামটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সুমনের বুকটা ধক করে ওঠে। কানটা সামান্য গরম হয়। তবু সে একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে, পান্না?

পুজোর ফাংশনে নেচেছিল, দেখেননি?

সুমন একটু উদাস ভাব দেখিয়ে বলে, তা হবে। মনে নেই। কিন্তু মনে আছে, ভীষণ মনে আছে সুমনের। মনে আছে শুধু নয়, সারাদিন পান্না তার মনে আনাগোনা করে।

পান্না নাচে, তা বলে আনা পাভলোভা নয়। তালজ্ঞান থাকলে যে কোনও মেয়েই অল্পবিস্তর শরীর দোলাতে পারে। বড় পুজোর ফাংশনে যে নৃত্যনাট্যটা হয়েছিল তাতে পান্নাকে যখন ফুলের সাজ আর মেকআপে দেখেছিল সুমন তখনই সে খরচ হয়ে যায়। নাচের ব্যাকরণ সুমন জানে না বটে, কিন্তু দেখেছিল কী বিভোর হয়ে সম্মোহিতের মতো সারা স্টেজ জুড়ে ঢেউ হয়ে বয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।

তারপর থেকেই ছুতোনাতায় কতবার যে ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত হল।

হ্যাঁ রে মরণ, তুই না আগে চাটুজ্জেবাড়িতে নারকোল আর সুপুরি পাড়তিস!

পাড়তুম তো৷ কিন্তু তুমিই যে বারণ করে দিয়েছ!

ওঃ হ্যাঁ, তাই তো!

ওদের বাড়ি যাবে?

 সুমন লজ্জা পেয়ে বলে, না না, আমি কেন যাব?

পান্নাদিরা খুব ভাল লোক। গেলে খুশি হবে কিন্তু।

যাঃ, খুশি হলেই যেতে হবে নাকি?

আসলে মেয়েদের ব্যাপারে সুমনের কোনওদিন লজ্জা সংকোচ ছিল না। আজও নেই। সে ছেলেবেলা থেকে কো-এডুকেশন আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। মেয়েদের নিয়ে তার লজ্জা সংকোচ কেটে গেছে কবে! তবু জীবনে এই প্রথম এবং এই একটি জায়গায় সে কেমন আটকে গেছে যেন। একটা বাধা হচ্ছে।

পাকা মরণটা অবশেষে বলে বসল, চলো না, বিজয়া করে আসি।

বিজয়া! বলে বিস্ময় প্রকাশ করে সুমন।

বাঃ, বিজয়া করতে তো আমরা সব বাড়ি যাই।

তোর চেনা বাড়ি, তুই যেতে পারিস। আমি কেন যাব?

তোমাকেও সবাই চিনে গেছে। পান্নাদি তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল একদিন।

কী জিজ্ঞেস করেছিল?

বলল, ওই সুন্দরমতো ছেলেটা কে রে তোর সঙ্গে ঘোরে?

ওঃ।

 আমি তখন বললাম আমার দাদা।

 গাঁয়ে এসে কি গেঁয়ো হয়ে যাচ্ছে সুমন? এত সংকোচ, লজ্জা, বুক কাঁপা, দুর! দুর! এরকম মেয়ে তো কতই তার বগলের তলা দিয়ে পার হয়ে গেছে।

কিন্তু নিজের মনে এত দেমাক করেও চৌকাঠটা ডিঙোনো যাচ্ছিল না।

তোমার পান্নাদি নাচে বুঝি?

খুব ভাল নাচে। সবাই বলে কলকাতায় গেলে নাম হবে।

তোমাদের শেখায় না কেন?

বলে দুর, আমিই ভাল করে শিখিনি, তোদের কী শেখাব।

ওঃ।

আচ্ছা, আপনি তো খুব ভাল গাইতে পারেন, তাই না?

ওসব বাথরুম সং।

আমি শুনেছি। ঠিক হেমন্তর মতো গলা।

 দুর। কোথায় হেমন্ত, কোথায় আমি!

আমাদের তো বেশ লাগে। কাল সন্ধেবেলায় গাইছিলেন, আমার মা বলল, কী সুন্দর যে গায় ছেলেটা। আমরা টিভি বন্ধ করে দিয়ে আপনার গান শুনছিলাম!

এ মা, ছিঃ ছিঃ। কী কাণ্ড!

আপনার ক্যাসেট নেই?

দুর পাগল! কে আমার ক্যাসেট করবে?

 দেখবেন আপনি ঠিক একদিন প্লে ব্যাক করবেন।

ওরে বাবা! মস্ত সার্টিফিকেট দিয়ে ফেললে যে!

দেখবেন।

মেয়েটাকে বেশ লাগল সুমনের। আড় ভেঙে দিল, আর উঁকিঝুঁকি দেবে না, চোখ মটকাবে না। ওসব ভাল লাগে না সুমনের। তার চেয়ে সোজা স্পষ্ট সম্পর্ক অনেক ভাল।

কিন্তু ব্যাপারটা একটু ঘোরালো হয়ে দাঁড়াল তার বাবা ফেরার পর।

বাসন্তী রাতে তার ঘরে এসে বলল, হ্যাঁ বাবা, এই হিমি মেয়েটা নাকি তোমাকে আজ দুপুরে এসে জ্বালাতন করে গেছে?

জ্বালাতন! বলে হেসে ফেলল সে, না জ্বালাতন করেনি। গল্প করতে এসেছিল।

আমরা বাড়িতে নেই, এ সময়ে আসে কেউ? তোমার কাঁচা ঘুমটা মাটি করে গেছে তো!

 আরে না না। আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

মেয়েটার একটু গায়ে পড়া স্বভাব আছে বাবা। কিছু মনে কোরো না।

 কিছু মনে করিনি। ও তো আমার বন্ধু হয়ে গেছে।

ভারী অবাক হয়ে বাসন্তী বলে, বন্ধু!

 হ্যাঁ। মেয়েটা খারাপ নয় তো! একটু লাজুক।

তা হোক বাবা, ওকে বেশি পাত্তা দিয়ো না। পেয়ে বসবে।

আসে আসুক না। আমারও কথা বলার একটা সঙ্গী হয় তা হলে!

 কিন্তু বাবা বলে বাসন্তী চুপ করে গেল।

কী বলুন না।

ভাবছি, মেয়েটার মতলব তো জানি না।

একটু গম্ভীর হয়ে সুমন বলে, ওকে নাকি আপনার মা আমার কাছে পাঠিয়েছিল।

আমার মা!

হ্যাঁ। তাঁকে অবশ্য আমি ভাল চিনি না।

বিহ্বল মুখে একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল বাসন্তী।

রাত্রিবেলা খাওয়ার টেবিলে যখন বাসন্তী সবাইকে পরিবেশন করছিল তখন সুমন লক্ষ করল, ভদ্রমহিলার মুখে স্পষ্ট কান্নার ছাপ। ঠোঁটে হাসির আভাসটুকুও নেই। কথাও কইছে না। এই প্রথম সুমনের একটু মায়া হল ভদ্রমহিলার জন্য। মানুষটা খুব বুদ্ধিমতী নয়। কিন্তু বোধ হয় মানুষটা ভালই।

মানুষ সম্পূর্ণ পক্ষপাতশূন্য অনাবিল চোখ দিয়ে কোনও কিছু বিচার করতে পারে না সবসময়। সুমনকে বহুকাল ধরে তার মা বুঝিয়েছে, তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষ একজন ঘড়েল ও বদমাশ মহিলা। তার চরিত্রেরও ঠিক নেই। তার বাবাকে হিপনোটাইজ করে, বশীকরণ বা তুকতাক করে দখলে রেখেছে। এই ভদ্রমহিলা নানা ফিকির করে তাদের টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি গ্রাস করে নিচ্ছে।

সুমন সেইরকম পূর্বধারণা নিয়েই ভদ্রমহিলাকে লক্ষ করত। ওই যে শান্ত, নিরীহ মুখ, নরম কথাবার্তা, ভিতু ভাব ওর আড়ালেই আছে সেই দাঁত নখঅলা ভ্যাম্পটা।

কিন্তু গত কয়েকদিনে ধারণাটা এক জায়গায় বসে থাকেনি। সরে গেছে। ভদ্রমহিলাকে তার ততটা খারাপ ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এর ভালমানুষি কিছুতেই অভিনয় নয়।

সকালে রান্নাঘরে জলখাবার তৈরি করতে যখন বাসন্তী ভীষণ ব্যস্ত তখন হঠাৎ সুমন রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

আপনি খুব ব্যস্ত?

চোখ তুলে এমন অবাক হল বাসন্তী যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপর ভারী ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ও বাবা, তুমি রান্নাঘরে যে! কী দরকার বলো বাবা, একটা হাঁক দিলেই তো হত!

সুমন হেসে বলে, এমনিই এলাম। আপনার রান্নাঘরটা তো বিরাট বড়!

হ্যাঁ বাবা, গাঁদেশে রান্নাঘর তো বড়ই হয়। এসো না ভিতরে, জলচৌকি পেতে দিচ্ছি, বোসো।

 সুমন বিনা আপত্তিতে বসল। আপনি সারাদিন খুব কাজ করেন।

বাসন্তীর মুখে একটা স্বর্গীয় হাসি ফুটে উঠল। বলল, সংসার মানেই তো কাজ। কত কী সামলাতে হয়। গোরু, বাছুর, হাঁস-মুরগি, বেড়াল-কুকুর, মানুষজন। কার দিকে নজর না দিলে চলে বলো!

রান্নার লোক পাওয়া যায় না এখানে?

পাওয়া যাবে না কেন? উনি তো আমাকে প্রায়ই রান্নার লোক রাখতে বলেন। আমি রাখতে দিই না।

 কেন বলুন তো! কলকাতায় আমাদের বাড়িতে তো রান্নার লোক আছে।

বাসন্তী যেন একটু অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলে, মাইনে করা বাইরের লোকের তো তেমন দায় নেই। কী রাঁধতে কী রাঁধল, বাসি কাপড়ে হাঁড়ি ছুঁল, কি নাকের শিকনি ঝেড়ে সেই হাতেই কাজ করল। তাই আমি নিজেই করি। আমার বড় ঘিনপিত বাবা। শুচিবায়ুও বলতে পার।

সুমন একটু হাসল। কিছু বলল না।

 হঠাৎ একটা ছায়া পড়ল দরজায়। সুমন তাকিয়ে দেখল, দরজায় জিজিবুড়ি দাঁড়িয়ে। তাকে হাঁ করে দেখছে। আর চোখ দুটো যেন গিলে খাচ্ছে তাকে।

.

২৮.

মানুষ যে কথা কয় সেটা দুনিয়ার এক অত্যাশ্চর্য জিনিস। মনের মধ্যে ভাবের যেসব গ্যাঁজলা ওঠে সেগুলো এই যে দিব্যি ভাষায় ভেসে ওঠে, ভাবলে ভারী অবাক লাগে। কথা জিনিসটা যে কে আবিষ্কার করেছিল কে জানে! ভারী ভাল জিনিস। ধীরেন লক্ষ করেছে, চারপাশে যেসব কথাটথা হয় সেগুলোর বেশির ভাগই আগডুম বাগড়ম। তবে তার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দু-চারটে কথা যেন খচ করে মনের মধ্যে গেঁথে যায়।

ধীরেন কথা শুনতে ভালবাসে। দোকানপাটে, রাস্তায় ঘাটে, চেনা অচেনা লোকের কথা মনে দিয়ে শোনে সে। বেশির ভাগই ফেলে দিতে হয়, দুটো চারটে থাকে, ভদ্রলোক হোক বা ছোটলোক, লেখাপড়া জানা হোক বা মুখ-সুখই হোক এক একজন এমন মোক্ষম কথা বলে বসে যে আক্কেল গুড়ুম হুয়ে যায়। ইরেব্বাস! কথা তো নয়, যেন কুড়ুল।

তার ঘোরাফেরার চৌহদ্দি এই গাঁয়ের মধ্যেই। এক মুঠো তো জায়গা। আর লোকজনই বা কী এমন! ঘুরেফিরে সেই যোদো-মোধো-রেমো। তবু এইটুকু চৌহদ্দির মধ্যেই নিত্যনতুন কথা ফুট কাটছে। ভাবে, একখানা খাতা কিনে কথাগুলো লিখে রাখলে হয়। ভাবাই অবশ্য সার, হয়ে ওঠে না।

এই সেদিন বিকেলের দিকটায় গিয়ে পড়েছিল মহিম রায়ের বাড়ি। মহিমদের বাড়ি সেদিন ভারী সুনসান। জনমনিষ্যি নেই। শুধু কুকুরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে আর ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে একখানা বই পড়ছে অমল। ধীরেনকে দেখে কেউ খুশি হয় না এটা ধীরেন জানে। কিন্তু কী আশ্চর্য সে যখন মহিমার এই বিদ্বান ছেলেটিকে দেখে সসংকোচে ফিরে আসবে বলে মুখ ঘুরিয়েছে তখন অমল ভারী খাতির করে বলল, আরে ধীরেনকাকা না! বসুন।

বসার জন্য চেয়ার বা মোড়া কিছু ছিল না ধারে কাছে। তাই ইতিউতি চেয়ে ধীরেন যখন দাওয়ার এক ধারে বসতে যাচ্ছিল তখন অমল বলল, করেন কী! দাঁড়ান চেয়ার এনে দিচ্ছি।

বিদ্বান মানুষ অমল, তার বাবার ঘর থেকে চেয়ার এনে বসতে দিল তাকে। বড় সংকোচ হচ্ছিল।

বই পড়ছিলে বাবা, এসে রসভঙ্গ করলুম।

 অমল মুখটা তেতো করে বলে, দুর! বই পড়ে কি সময় কাটে! লেখাপড়া করে লোকে মুখ্যুই হয়।

বলে কী ছোকরা! কথাটা ভারী অদ্ভুত শোনাল।

বেশ বাবা, ওকথা বলছ কেন? লেখাপড়া তো ভাল জিনিস!

কাকা, লেখাপড়া হল ধার করা জিনিস। অন্যের চিন্তাভাবনার জঞ্জাল টেনে এনে নিজের মাথায় বোঝাই করা। লেখাপড়া করে তো দেখলাম, ওতে কিছু হয় না!

এ কথাটা ভারী নতুন শোনাল ধীরেনের কানে। লেখাপড়ার মেলা গুণগানই তো করে লোকে। তা হলে লেখাপড়া জানা এ ছেলেটা উলটো কথা কয় কেন?

ধীরেন ভারী আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করে, লেখাপড়া করে কী হয় না বাবা?

অমল একটা আলস্যের আড়মোড়া ভেঙে বলে, মানুষ তো কত কী জানল বুঝল, কত কেরদানিই দেখাল, কিন্তু শেষ অবধি নিজের মনের কাছে জব্দ হয়ে রইল। আপনি ভগবান মানেন কাকা?

এ কথায় একটু ফাঁপরে পড়ে গেল ধীরেন। আমতা আমতা করে বলল, তা মানি বইকী বাবা, একটু আধটু মানি। তবে তেমন মাথা ঘামাই না।

ভগবান কাকে বলে জানেন কাকা?

ধীরেন আবার ডুবজলে। এসব কঠিন প্রশ্নের জবাব কি তার জানা থাকার কথা?

অমল অবশ্য তার জবাবের জন্য অপেক্ষা করল না, বলল, মনই হচ্ছে ভগবান। ওই মনই ভগবান-টগবান বানায়, আবার মনই ভগবানকে নাকচ করে দেয়। মনের মতো বন্ধু হয় না, আবার অমন শত্ৰু কেউ নেই।

বাঃ, এ যে বেশ কাজের কথা হচ্ছে! ধীরেন ভারী আপ্লুত হয়ে নড়েচড়ে বসল, একেই তো এই মহা বিদ্বান মানুষটি তার সঙ্গে যেচে কথা কইছে বলে সে বর্তে যাচ্ছে। তার ওপর কথাগুলো কইছেও ভারী ভাল। টুকে রাখার মতোই কথা সব।

ধীরে হেঁ হেঁ করে হেসে বলে, বড্ড ভাল বলেছ বাবা।

ভাল-মন্দ যে ধীরেন বোঝে এমন নয়। তবে সে কথা শুনতে ভালবাসে। যেসব কথা শুনতে ভাল সেগুলোই তার কাছে ভাল কথা।

অমলকে আজ কথায় পেয়েছে। ধীরেন কাষ্ঠ যে একটা মনিষ্যির মতো মনিষ্যিই নয় সে কথা ভুলে গিয়ে কথা কয়ে যাচ্ছে। লক্ষণটা চেনে ধীরেন এক এক সময়ে মানুষ মনের ভার নামাতে দেয়ালের সঙ্গেও কথা কয়। তা ধীরেন দেয়াল ছাড়া আর কী!

বুঝলেন কাকা, একটা লোককে চিনতুম। ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যানসেলর ছিলেন, একগাদা সরকারি কমিশনের চেয়ারম্যান বা মেম্বার ছিলেন, নামের পাশে বিরাট বিলিতি ডিগ্রি। সাউথ ক্যালকাটায় বিরাট বাড়ি, অগাধ টাকা কিছুর অভাব নেই। দেখে মনে হত দুনিয়াটা যেন ওঁর পকেটে। শেষে কী হল জানেন?

ধীরেন বাঁয়া কোলে করে বসে আছে। প্রতিধ্বনি করল, কী হল?

বুড়ো বয়সে তাকে যখন দেখলুম বউ মারা গেছে, ছেলে বিদেশে, চাকরি থেকে রিটায়ার করে লোকটা একরকম নিষ্কর্মা। কিছু লেকচারে ডাকাডাকি হয়, কিছু মিটিং-টিটিং থাকে বটে, কিন্তু বড্ড ফাঁকা হয়ে গেছে মানুষটা। একদিন আমাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, আচ্ছা তুমি ভূতের গল্প জানো? বলো তো একটা শুনি। আমার আজকাল বড্ড ভূতের গল্প শোনার ইচ্ছে হয়।

ভূতের গল্প?

তাই তো বলছি কাকা। এত লেখাপড়া জানা মানুষ, কিন্তু নিজের একা বোকা ভাবটা কাটাতে পারছেন না। শরীরটা আছে, কিন্তু মনটা অথর্ব হয়ে পড়েছে। ভূতের গল্প শুনে ভারী খুশি, আমাকে আর ছাড়তেই চান না। শেষে আমাকে বললেন, ওহে, এত বড় বাড়িটা বড্ড হাঁ হাঁ করে। আমার তো জন নেই। একটা ভাল ফ্যামিলিতে পেয়িংগেস্ট হিসেবে যদি থাকতে চাই ব্যবস্থা করতে পারবে? আর কিছু না হোক, পাঁচ জনের মধ্যে তো থাকা যাবে।

বলো কী?

তাই তো বলছি কাকা, ওসব বইপড়া বিদ্যে দিয়ে জীবনে সত্যিকারের কিছু হয় না। সেই বিরাট মানুষটা শেষ অবধি এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে জুটলেন। সেখানেই মারা যান। ঘটনাটা আমাকে জোর একটা ধাক্কা দিয়েছিল।

তা তো দেবেই।

সেই থেকেই আমার বড় ভাবনা হয়। মানুষ এত শেখে, এত তড়পায়। এত কাজকর্ম করে। কিন্তু শেষ অবধি তাকে তার মনের ভূত ভয় দেখাতে থাকে। মনই তাকে খায়। মনের সঙ্গে আজও পেরে উঠল না মানুষ।

মনের ভূত ধীরেনকেও কি কম খেয়েছে! আজও সেই ভরা বর্ষার ছাইরঙা সকালটার দৃশ্য পট করে চোখের সামনে বায়স্কোপের মতো ভেসে ওঠে। ডবকা সেই যুবতীর শবদেহ কাঁধে নিয়ে এক বুক জল ভেঙে পিছল উঠোন পেরোচ্ছে, গলায় তারের ফাঁস। ফাঁসের প্রান্ত মিদ্দারের হাতে ধরা। এক চুল এদিক ওদিক হলেই তারের ফাঁস গলা কেটে বসে যাবে। উরে বাবা, সে কী একটা সময় যাচ্ছিল তখন!

মিদ্দার তার গুরুই ছিল একরকম। নিরীহ, ঝঞ্জাটহীন গুণী এক মানুষ নিজের কাজে মজে থাকত। তাঁতির যেমন এঁড়ে গোরু, মিদ্দারের পোয়ের তেমনি কাল হল যুবতী বউ। আর তা থেকে কত কী পাকিয়ে উঠল। সাদামাটা সম্পর্ক ছড়িয়ে গেল জটিল কুটিল নানা খানাখন্দে।

মিদ্দারকে মেরে ফেলেছিল বটে, কিন্তু সে তো ইচ্ছে করে নয়! না মারলে মরতে হত। গৌরদা তাকে বুঝিয়েছিল, ওতে পাপ নেই, আত্মরক্ষার জন্য নরহত্যা করলে পেনাল কোডে সাজাও হয় না। তবু মন কি মানে! কৃতকর্মের জন্য আজও বুক টনটন করে বড়। একা হলেই যেন মিদ্দারের ভূত কাছেপিঠে চলে আসে। ভয় করে, বড্ড ভয় করে।

তখন, সেই খুনের ঘটনার পর তার ঘুম, খিদে সব ছুট হয়ে দিয়েছিল। সারাদিন পাগল পাগল অবস্থা। এই হাসে, এই কাঁদে। আর তখন চারদিকে যেন ভুতুড়ে এক জাল তাকে ঘিরে থাকত। রাতবিরেতে মিদ্দার এসে হানা দিত। দেখা যেত না, কথাও কইত না, কিন্তু তাকে খুব টের পেত ধীরেন।

অমন নিরীহ, ভাল মানুষটা কী থেকে কী হয়ে গিয়েছিল!

মনের ভূতে খায় বইকী বাবা, খুব খায়। মনের ভূতই তো খাচ্ছে আমাদের।

অমল একটু কেতরে হেলে পড়ে আছে ইজিচেয়ারে। কথা কইল না। চোখ চাওয়া, কিন্তু সে চোখের দৃষ্টি কোথায় চলে গেছে কে জানে!

ধীরেন দু-একবার গলা খাঁকারি দিল। বুঝল অমল আর বাইরের জগৎটায় নেই। নিজের ভিতরে ঢুকে অন্ধিসন্ধি খুঁজে বেড়াচ্ছে কিছু। ধীরেন এসব বুঝতে পারে।

গৌরদার ছোট মেয়ে পারুলের সঙ্গে ভাব ভালবাসা ছিল ছেলেটার। সেই বৃত্তান্ত সবাই জানে। তা বিশ-বাইশ বছরের পুরনো কথা। তখন সারা গাঁয়ে বেশ মুখরোচক প্রসঙ্গ ছিল সেটা। তবে নিলেমন্দ হয়নি তেমন। কারণ ছেলেটি ছিল রত্ন, আর মেয়েটিও ছিল ডাকের সুন্দরী। তার ওপর গৌরহরি ছিলেন গাঁয়ের মাথা, মহিম রায়ও পণ্ডিত মানুষ। সবাই ধরে নিয়েছিল বিয়েটা হবেই।

সেই বিয়ে যে ফসকাতে পারে সেটাই অষ্টম আশ্চর্য! এমন হওয়ার কথাই নয়। গৌরহরিকে ব্যাপারটা নিয়ে একবার জিজ্ঞেস করেছিল ধীরেন।

দাদা, পারুলের বিয়েটা অন্য জায়গায় দিচ্ছেন যে!

বিয়ে জিনিসটাই যে ওইরকম রে, কার যে কার সঙ্গে ঘাট বাঁধা তা কে বলবে!

তা অবিশ্যি ঠিক। তা পারুল কান্নাকাটি করছে না?

আরে সে কাঁদবে কী! তার ইচ্ছেতেই তো হচ্ছে।

ধীরেন প্রেম ভালবাসার রহস্য যে খুব ভাল বোঝে তা নয়। শুধু বোঝে, ওসব, বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়, তারপর থমকে যায়। তার নিজের জীবনে তাও হয়নি। বিয়ের রাত থেকেই ফোঁসফোঁস শুরু করেছিল। কাজেই ভাব ভালবাসা নিয়ে তার উচ্চবাচ্য করার কিছু নেই।

কিন্তু পারুল নিজের ইচ্ছেয় অন্য জায়গায় বিয়ে বসছে এটা যেন তার কাছে একটু কেমনধারা মনে হয়েছিল। এরকম তো হওয়ার কথা নয়।

তা পারুলের বিয়ে বেশ ঘটা করেই হল। গাঁ দেশে এমন বিয়ে দেখা ভাগ্যের কথা। গৌরদা টাকাও ঢেলেছিলেন জলের মতো। সেই বিয়েতে বারো পিস মাছ খেয়েছিল ধীরেন, খুব মনে আছে। না, পারুলের হাসি হাসি মুখখানায় কোনও দুঃখের চিহ্ন খুঁজে পায়নি ধীরেন। হাত বাড়িয়ে ধীরেনের হাত থেকে যখন খবরের কাগজে মোড়া শস্তার তাঁতের শাড়িটা উপহার নিচ্ছিল তখনও পারুলের মুখখানা ভাল করে দেখেছিল ধীরেন। বেশ ঢলটলে মুখ, তাতে হাসির মিশেল, বিরহের ভাব-টাব নেই।

বছর না ঘুরতেই অমলের বিয়ে। তা তাতেও ধীরেন হাজির ছিল। বরযাত্রী যেতে বলেনি বটে, কিন্তু বউভাতে গাঁ ঝেটিয়ে নেমন্তন্ন খেয়েছিল লোকে। অমলকে তখন বেশ ভাল করেই দেখেছিল ধীরেন। গরদের পাঞ্জাবি আর ধাক্কাপাড়ের ধুতি পরে অতিথিদের দেখভাল করছিল। মুখে হাসি ছিল, কিন্তু খুশিটা ছিল না যেন। খুশিটা আজও নেই।

অঙ্কটা মেলেনি ধীরেনের। মেয়ে জাতটাই নিমকহারাম বললে এক রকমের মেলে, কিন্তু কথাটা সত্যি হয় না। কোথাও একটা খিঁচ থেকে যায়।

ধীরেন দেখল, ইজিচেয়ারে কেতরে শুয়ে অমল ঘুমিয়ে পড়েছে, কোলে উপুড় করা বই, রাজ্যের মশা ঝাঁক বেঁধে উড়ছে মাথার ওপরে। ধীরেন চোরের মতো উঠে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল। ছোকরা সেই প্রেমের, ফেরেই আজও পড়ে আছে কি না কে জানে! বইয়ে কেতাবে ওরকম হয়-টয় বটে, কিন্তু ধীরেনের দুনিয়ায় ওসব এতকাল টিকে থাকতে দেখেনি কিনা। প্রেম একটা ফুসমন্তর বই তো নয়, হুস বলতেই উড়ে যায়। ফঙ্গবেনে জিনিস। খিদে তেষ্টা বাহ্যে পেচ্ছাপের মতোও স্থায়ী জিনিস নয়। একটা জীবনে প্রেম অনেকবার পাশ ফেরে।

দিনের আলো মরে এলে অসুবিধেটা বাড়ে। চোখে এমন ঝাপসা একটা ভাব হয় যে, চলাফেরায় আজকাল মুশকিল হচ্ছে। চোখ কাটানোর পাকা তারিখ এখনও পাওয়া যায়নি। সামনের মাসে হতে পারে বলে খবর একটা পাওয়া গেছে। পরের দয়া, জোর তো নেই। তবু এই দয়াধর্ম, সেবা-টেবা পতিতোদ্ধারে বড় মানুষরা যে একটু আধটু কাজকর্ম করে তাতেই বাঁচোয়া।

সন্ধেবেলাতেই কেন যে মশারা এমন রক্তপাগল হয়ে ওঠে কে জানে বাবা! এটাই কি ওদের ডিনারটাইম? রাতে উৎপাত অনেক কমে যায়। কিন্তু সন্ধেবেলায় ওদের ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান থাকে না, তখন প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বউদি ডাকছে, ওঠো! মশায় যে হেঁকে ধরেছে একেবারে। ঘরে গিয়ে বোসো, ধোঁয়া দিয়ে এসেছি।

অমল একটু হাসল, ওদের জীবনও তো নিষ্কণ্টক নয় ঠাকরোন।

 কে? কাদের কথা বলছ?

মশাদের কথা। প্রাণ হাতে করেই তো খায়।

 আহা, মশাদের জন্য যে দরদ উথলে উঠছে দেখছি! গান্ধীবাবা হলে নাকি?

 আচ্ছা, আজ বাড়িটা এত ফাঁকা কেন বলো তো! কোথায় গেল সবাই। তুমিও তো বাড়ি ছিলে না!

আমি গিয়েছিলুম একটু শীতলাবাড়িতে। বিষ্ণুর মায়ের দয়া হয়েছিল সেই কবে। পুজোটা আর দেওয়া হয়নি এতদিন। দিয়ে এলুম।

 বেশ করেছ। জলবসন্তের চিকিৎসা নেই, তা জানো? পুজো দিলেও একুশ দিনে সারে, না দিলেও তাই।

আচ্ছা, আর নাস্তিকপানা করতে হবে না। ঘরে যাও, চা আনছি।

 তুমিই সবসময়ে চা দাও, খাবার দাও। কেন বলো তো? আর সবাই কোথায় থাকে?

 কেন গো, বউয়ের হাতে ছাড়া চা খাবার পছন্দ নয় বুঝি!

আহা, তা নয়। এটা একটা জয়েন্ট ফ্যামিলি, সকলেরই তো কিছু না কিছু করা উচিত।

 বউদি একটা শ্বাস ফেলে বলে, কী করব বলো! আমি তো বাড়ির বড়বউ। বড়বউ হলে দায়িত্বও সে বড়।

ওটা কথা নয় ঠাকরোন, তোমাকে আমি সারাদিন কাজ করতেই দেখি, একজন এত পরিশ্রম করবে কেন?

একটু হেসে বউদি বলে, আমি খাটিয়ে পিটিয়ে মেয়ে হিসেবেই তৈরি হয়েছি যে! বিবিয়ানি করার জন্যে তো নয়। পেটে বিদ্যে বা অন্য গুণ না থাকলে যে গতর দিয়ে পুষিয়ে দিতেই হয় ভাই। মেয়ে হয়ে না জন্মালে বুঝবে না।

তা নয় ঠাকরোন। লজিকটা ভুলে ভরা। তুমি যদি দশভুজা হয়ে সব কাজে ঝাঁপিয়ে না-পড়ার অভ্যাস করো, তা হলে দেখবে সবাই যে যার নিজের কাজ করে নিতে শুরু করবে। তুমি করো বলেই অন্যেরা গা বাঁচিয়ে চলে।

সে গুড়ে বালি। উঠোনের কোণে যদি ঘটিটা পড়ে থাকে, বাড়ির সবাই ওর আশপাশ দিয়ে শতেকবার হেঁটে যাবে, কেউ তুলে রাখবে না। আমি না তুললে বাইরের লোক এসে নিয়ে চলে যাবে।

অভ্যাস তুমিই খারাপ করেছ।

দাসী হয়ে জন্মেছি যে ভাই, দাসত্ব না করে উপায় আছে? তবে সবাইকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

মোনাও তো কিছু করতে পারে।

সে দুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে, তাকে কেন ঘানিগাছে জুড়তে যাব বলো! তা ছাড়া সব সংসারেরই কাজকর্মের আলাদা রকম ধাঁচ থাকে। সে অত বুঝবে না। ছোঁয়াছুঁয়ি, পয়পরিষ্কার ওসব কি ওর অভ্যাস আছে, বলো! আর সন্ধ্যাকে তো দেখছ, বেচারা দিনরাত ব্যবসার পেছনে খেটে মুখে রক্ত তুলছে। তাই ওকে আমি সংসারে জড়াই না, দুঃখী মেয়ে তো!

ব্যস, সব জল করে বুঝিয়ে দিলে! এগুলো কোনও যুক্তি নয় ঠাকরোন, এসব হল অজুহাত।

বেশ, না হয় তাই হল। কিন্তু এই বাঘা শীতে তুমি খোলা উঠোনটার মধ্যে বসে আছ কী করে বলল তো! তোমার বউ বাড়ি থাকলে বকুনি দিত।

অমল ম্লান হেসে বলে, তা হলে তো বর্তে যেতুম। সে আমাকে ততটা লক্ষ করে না ঠাকরোন।

আর বউয়ের নিন্দে করতে হবে না। ঘরে গিয়ে ঢাকাঁচাপা দিয়ে বোসো। ঘরের জানালা দরজা হুট করে খুলো না, এ সময়ে মশা ঢোকে।

মোনা কোথায় গেছে? এখানে তো তার যাওয়ার জায়গা নেই! কারও সঙ্গে মেশেও তো না।

রতনের সঙ্গে মোটরবাইকে চেপে বর্ধমানে গেছে।

মোটরবাইকে! রতনের সঙ্গে।

অত অবাক হওয়ার কী আছে?

 এ তো জলে ভাসে শিলা! রতনের সঙ্গে তার ভাব হল কবে?

বউদি মুখ টিপে হেসে বলে, থাকতে থাকতে হয়েছে। ভাব না হওয়ার কথা নাকি!

কিছু বললেই তো বলবে বউয়ের নিন্দে করছি। আমার মুখে মোনার নিন্দে তো তুমি মোটেই পছন্দ করো না।

তাই কী হয় ভাই? গাঁয়ের মেয়েরা তো নিন্দে দিয়ে মেখেই ভাত খায়, জানো না? নিন্দেমন্দ হল আমাদের থিয়েটার বায়স্কোপের মতো। তবে কি না তুমি তো আর পাঁচটা মানুষের মতো নও। তুমি ওসব হ্যাঁন্যাতা জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন?

একটু হেসে অমল বলে, আমি কিন্তু আমার নিজেরও নিন্দে করি।

খুব খারাপ করো। ওরকম করা ভাল নয়।

তোমরা যেরকম ভাবো আমাকে, সেরকম আর হতে পারলাম কই?

অনেক হয়েছ ঠাকুরপো, অনেক হয়েছ। কটা লোক তোমার মতো হয়েছে বলো তো!

গাছে তুলো না, ঠাকরোন, গাছে তুলো না। একগাদা লেখাপড়া করে লম্বা মাইনের চাকরি করছি এই তো! এটা কিন্তু অনেক হওয়া নয়।

আমাকে আর বোঝাতে হবে না। এখন কি তোমার চশমা পরে নিয়ে তোমাকে বিচার করতে হবে নাকি? আমারও তো একটা বিচার আছে!

বরাবর তুমি আমাকে একটু অন্য চোখে দেখ, আমি জানি। দেখাটা কিন্তু ভুলও হতে পারে।

সেটা আমি বুঝব। অনেক ঠান্ডা লাগিয়েছ কিন্তু, এর পর জ্বরজারি বাধিয়ে বসবে। ঘরে যাও। এসে দেখি, অকাতরে ঠান্ডার মধ্যে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছ, মশা ঘেঁকে ধরেছে। এমন মায়া হল। যেন কেউ নেই তোমার।

কেউ নেই-ই তো!

ফের ওসব কথা?

অমল হাসল। বলল, ফাঁকা বাড়িতে চুপচাপ একা বসেছিলাম। বসে বসে ঢুলুনি পেয়ে গেল।

হ্যাঁ, আজ তোমাকে একটু ফাঁকাতেই থাকতে হয়েছে বটে। সন্ধ্যা গেছে আদায় উশুল করতে। বাবা আজ বড়শুলে গেছেন নিমাইকাকার বাড়ি। রাতে হয়তো ফিরবেন না। সোহাগ দুপুরে খেয়েই বেরিয়েছে পান্নার বাড়ি যাবে বলে। দুজনের তো কথার শেষ নেই। আর তোমার দাদাকে তো জানোই। ঘরের খেয়ে কোন বনের মোষ তাড়াতে বেরিয়েছেন কে জানে!

অমল উঠতে উঠতে বলল, তোমার বাজারহাট বা দোকানপাটের জিনিস লাগবে কি না দেখো তো। লাগলে বোলো, একটা পাক দিয়ে গিয়ে নিয়ে আসবখন।

তোমাকে আর কাজ দেখাতে হবে না। ঘরে গিয়ে লেপচাপা দিয়ে বসে থাকো। যা ঠান্ডা পড়েছে আজ!

এই ঠান্ডায় তুমিও আর বসে থাকবে না।

বউদি হিহি করে হেসে বলল, মেয়েমানুষের দুঃখু অত দেখতে নেই গো পুরুষমানুষের। ওতে যে পাপ হয়।

কেন, পাপ হয় কেন?

হবে না? মেয়েমানুষের দুঃখ বুঝলে পুরুষমানুষের পুরুষত্ব থাকে নাকি?

 ঠাট্টা করছ?

না গো, সত্যি কথাই বললুম। ভেবে দেখলেই বুঝবে।

তুমি একটু নারীবাদী আছ কিন্তু ঠাকরোন!

আমি নারীবাদী হলে এ বাড়ির কারও আর খাওয়াপরা জুটত না, বুঝলে!

নারীবাদীদের দোষ কী জান?

কী?

তারা খোঁটা দেবে, আবার সেবা-টেবাও করবে। দুরকম চলে না ঠাকরোন। একরকম হও।

উরেব্বাস! তা হলে তো সংসার ভেসে যাবে গো।

 ওইজন্যই তোমরা ঠিকঠাক নারীবাদী হতে পারলে না।

অমল ধীর পদক্ষেপে দোতলায় উঠল। তারপর নিজের ঘরটিতে এসে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে হাঁটু অবধি লেপটা টেনে আধশোয়া হল। জানালা দরজা বন্ধ থাকায় ঘরটা বেশ গরম। যেন রুম হিটার চলছে।

কিছুক্ষণ পর দরজায় টক টক শব্দ হল।

এসো ঠাকরোন, তোমাকে আর ভদ্রতা করে নক করতে হবে না।

বউদি একগাল হেসে ঘরে ঢুকে বলল, ছোটদের কাছেও কত কী শেখার আছে আমাদের!

কে আবার তোমাকে কী শেখাল?

এই যে দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢোকা এটা আমাকে সোহাগ শিখিয়েছে। বলেছে, এটা অভ্যাস করে নিলে কোথাও অপ্রস্তুত হতে হবে না।

তা বিলিতি কায়দা রপ্ত করছ?

তা বাপু, শিক্ষাটা খারাপ নয় কিন্তু। আজকাল তোমার দাদা ঘরে থাকলেও আমি দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকি। প্রথম প্রথম কায়দা দেখে হাসত। আজকাল দেখি নিজেও তাই করছে।

হাঃ হাঃ করে হাসল অমল, এইসব হচ্ছে তা হলে আজকাল?

তাই ভাই, ভাল জিনিসকে ভাল বলতেই হয়।

 হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বউদি চেয়ার বসে বলল, সাঁজাল দিতে একটু দেরি হল, নইলে আরও আগে তোমাকে চা দিতে পারতাম।

সন্ধের পর চা খাওয়া তো ভুলেই গেছি। প্রায়ই পার্টি বা বন্ধু বা কলিগের বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকে। সেখানে তো আর চা দেয় না।

জানি বাপু, জানি। মদ খাও তো!

হ্যাঁ ঠাকরোন।

তাই মাঝে মাঝে মদের গন্ধ পাই। এখানেও তো খাও, তাই না? খাই ঠাকরোন। বাজে অভ্যাস।

তা বাপু, তোমার দাদাও কখনও-সখনও খায়। আমি তার জন্য বকাঝকা করি না। শুধু চোখ পাকিয়ে তাকাই।

তাতেই ঠান্ডা হয়ে যায় দাদা?

হয় ভাই। জানে তো, বউ ছাড়া গতি নেই। বউ বিগড়োলে তার দুনিয়া অন্ধকার।

 বেশ আছ তোমরা।

সে তো আছি। কিন্তু তুমি বেশ নেই কেন? তোমার বউটা খারাপ নয়, মেয়েটা ভাল, ছেলেটা ভাল, তবে তোমাদের পট খায় না কেন বলো তো!

ঠিক বুঝতে পারি না ঠাকরোন।

ভাল করে ভাবো তো একটু। তোমার মতো এমন ভাল একজন মানুষের সংসারে অশান্তি থাকার কথা নয়।

ভালমানুষ কথাটা শুনেই কেমন যেন বিকল হয়ে গেল অমলের মনটা। চায়ে চুমুক দিয়ে তেতো মুখ করে বলল, ঠাকরোন, আমার মধ্যে যেটুকু ভাল বলে তোমার মনে হয় তা হল মেধা। আমি ছাত্র ভাল ছিলাম, ঠিক কথা। কিন্তু মেধা আর চরিত্র এক নয়।

এখন নিজের চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে নাকি?

 নিজের চরিত্র সম্পর্কে যে আমার কোনও বিশ্বাস নেই। যখন ছোট ছিলাম তখন বেশ ভালমানুষ ছিলাম। দুষ্টুমি নষ্টামি করতাম না, মিথ্যে কথা বলতাম না, মা বাবার বাধ্য ছেলে ছিলাম। কিন্তু সমস্যা কখন দেখা দিল জানো?

কখন?

যখন ক্লাসে ফার্স্ট হতে শুরু করলাম। অনেক নম্বর পেতাম, মাস্টারমশাইরা প্রকাশ্যে প্রশংসা শুরু করলেন, পাঁচজন ধন্য ধন্য করতে লাগল, তখনই একদিন অহংকার চলে এল। খুব সূক্ষ্ম ব্যাপার, বুঝলে? বাইরের লোক ততটা টের পেত না। কিন্তু মনে মনে আমি ক্লাসমেটদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা করুণা করতে শুরু করি। কোনও মাস্টারমশাই কখনও কিছু ভুল করলে মনে মনে অনুকম্পা বোধ করতাম, অশ্রদ্ধার ভাব আসত। আমার বাবা যে ইংরিজিতে এম এ পাশ তা জানো?

জানব না কেন?

আমি বাবাকেও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শুরু করি। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, যত বড় মূর্খ ছেলে তত বড় লেকচার। আমারও ঠিক তাই হয়েছিল। বাবা, মা, দাদা এদের কাউকে তেমন পাত্তা না দেওয়ার মনোভাব এসে গেল।

তাতে কী? ওরকম তো হতেই পারে। এখন তো আর তুমি অহংকারী নও!

অনেক ঠেকে শিখতে হয়েছে যে, অহংকার করার মতো আমার কিছুই নেই। অধীত বিদ্যা আমাকে জীবনে শান্তি বা স্বস্তি কিছুই দেয়নি। এমন কী যৌবন বয়সে আমার পদস্খলনও ঠেকাতে পারেনি। আমি কীসের ভাল ছেলে ঠাকরোন?

দেখ কাণ্ড! নিজের নিন্দে শুরু করে দিলে যে!

সব তো জানো না ঠাকরোন। জানলে আমাকে ঘেন্না করতে।

কী জানি না বলো তো?

সেটা তো তোমাকে বলা যায় না। আমার অধঃপতন যে কবে, কীভাবে শুরু হয়েছিল তা আমিই শুধু জানি।

আচ্ছা ভাই, যে নিজের সম্পর্কে এ কথা বলতে পারে তাকে কি খারাপ বলা যায়?

অমল হাসল, তোমার চোখে খারাপ না হলেই কি আর আমি ভাল?

অত মনস্তাপের দরকার নেই। আমি সব জানি। জেনেও বলছি, তুমি মোটেই খারাপ নও।

একটু অবাক হয়ে অমল বলে, জানো?

হ্যাঁ জানি। কিন্তু তোমাকে বলি বাপু, সব কথা কি সকলের কাছে বলতে হয়? পাত্রভেদ নেই? কাক তো এঁটো ছড়ায়।

তুমি কী জানো ঠাকরোন?

সব জানি। পারুলের সঙ্গে তোমার শরীরের সম্পর্ক হয়েছিল। অবাক হয়ো না। অবাক হওয়ার কিছু নেই।

.

২৯.

চা জুড়িয়ে গেল যে! খাও।

চুপচাপ চা শেষ করল অমল। তারপর বউদির দিকে চেয়ে একটু মলিন হেসে বলল, এখন আমাকে কী চোখে দেখছ ঠাকরোন? ঘেন্না হচ্ছে?

না বাপু, পুরুষমানুষের ওরকম একটু আধটু দোষঘাট হতেই পারে। ঘেন্না হবে কেন? বিয়েই তো হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। পারুল দেমাক দেখিয়ে বিয়ে করল না। না হলে কি এটা নিয়ে কথা উঠত, বল?

অমল মাথা নেড়ে বলে, না, উঠত না। পারুল না হয়ে অন্য কোনও মেয়ে হলে বিয়েও করত। পারুল কেন করল না বল তো!

দেমাক বাপু, বড্ড দেমাক।

না বউদি। এটা দেমাকের ব্যাপার নয়, তবে কাছাকাছি। পারুল আমাকে যে অপমানটা করল সেটা করার জন্য বুকের পাটা চাই। খুব বুকের পাটা চাই। সেদিন পারুলের ওপর রাগ হয়েছিল বটে আমার। কিন্তু এখন ওই জন্যই পারুলের ওপর আমার শ্রদ্ধা হয়। পুরুষের গায়ের জোর বেশি, জোর খাটাতেও সে পিছপা হয় না। চিরকাল মেয়েরা এই প্রবল পুরুষের ইচ্ছের কাছে নত হয়ে আসছে। ওইটাই রেওয়াজ। পারুল সেটা হতে দিল না। ঝগড়া-তর্ক করেনি, ভাষণ দেয়নি, নারীমুক্তির বুলি কপচায়নি, শুধু নীরবে আমাকে নাকচ করে দিয়েছে। ঠাকরোন, ভেবে দেখো, পারুলের মতো এমন কঠিন প্রতিবাদ কটা মেয়ে করতে পারে?

ও বাবা, তুমি যে পারুলের গুণকীর্তন শুরু করলে! আমার বাপু, ওসব মনে হয় না। মেয়েদের অত অহংকার তো ভাল নয়। যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েই আছে সে যদি একটু বাড়াবাড়ি করেই ফেলে তাহলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয় নাকি?

বললাম তো, বেশির ভাগ মেয়েই এসব ক্ষেত্রে মেনে নেয়, আসকারাও দেয়। পারুল যে দেয়নি তাতে প্রমাণ হয় যে সে বেশির ভাগ মেয়ের মতো নয়। তার জাত আলাদা।

অবাক কাণ্ড বাপু। তোমার বউও এরকমই কী যেন বলছিল।

কী বলছিল?

আমার মাথায় বাপু, এত সব ব্যাপার ঢুকতে চায় না। গেঁয়ো মানুষ তো। মোনারও দেখলুম, পারুলের ওপর একটুও রাগ নেই। বরং বলছিল তোমরা সবাই নাকি পারুলের মধ্যে একটা দেবী-দেবী ভাব দেখতে পাও। হ্যাঁ ঠাকুরপো, তোমাদের সবারই কি একসঙ্গে একটু মাথার দোষ হল?

তা নয় ঠাকরোন। পারুলকে আমি ভোগ্যবস্তুর মতো ব্যবহার করে যে মস্ত ভুল করেছিলাম তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি। মেয়েরা তো শুধু ভোগ্যবস্তু নয়, যদিও বেশির ভাগ পুরুষই তাই মনে করে। পারুল আমাকে গ্রহণ না করে সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর মোনার কথা বলব? আমার মনে হয় পারুলের মধ্যে মোনা সেই মেয়েটাকেই দেখতে পায় যে রকমটা সব মেয়েই হতে চায়।

উঃ বাপরে! এবার তুমি আমার মাথাটাই খারাপ করে দেবে। যা ভেবে নিয়েছ তোমরা তা সব মনগড়া। পারুলকে টং-এ চড়িয়ে কেন যে পুজো করতে লেগেছ জানিনে বাপু। যত সব পাগুলে কাণ্ড। একটু মর্ত্যে নেমে এসো তো এখন।

মৃদু হেসে অমল বলে, আচ্ছা, নামলাম। এবার বলো।

 আমি বলি কী, মোনা যখন গাঁয়ে আর থাকতে চাইছে না তখন ওকে নিয়ে কলকাতায় যাও না কেন? এখানে বেচারার একঘেয়ে লাগছে।

যেতে তো হবেই। ছুটি ফুরিয়ে এল।

দু-একদিনের মধ্যেই চলে যাও।

মোনা তোমাকে জপিয়েছে বুঝি? তোমাদের এত ভাব হল কী করে বল তো! আগে তো ও তোমাদের দিকে ফিরেও তাকাত না।

ভাব হয়েছে বটে, তবে ভালবাসাটা এখনও হয়নি।

কী করে হল?

হয়ে গেল। কারও কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে হবে তো!

 ও, তাও তো বটে। মোন তোমার কাধটাই বেছে নিয়েছে তাহলে?

ওরকমই ধরে নাও না কেন?

পারুল আর আমার ঘটনাটা তোমাকে মোনা বলল কেন ঠাকরোন? ও কি চাইছে ব্যাপারটা চাউর হোক?

দুঃখে দুঃখে বলে ফেলেছিল। ভয় নেই, কথাটা পাঁচকান হবে না।

হলেই বা আমার কী বল! আমার কিছু আর যায় আসে না। কিন্তু পারুলের সম্পর্কে রটনা হলে আমার খারাপ লাগবে। ওর তো দোষ ছিল না!

একেবারেই ছিল না?

না ঠাকরোন।

আমি বিশ্বাস করি না।

 কেন করো না?

আমিও মেয়েমানুষ বলেই।

 অমল হাসছিল। বলল, দুনিয়ার সব ঘটনাই মানুষ নিজের নিজের মতো ব্যাখ্যা করে নেয়।

তুমি তোমার মতো বুঝেছ, আমি আমার মতো করে বুঝে নিয়েছি।

ঠাকরোন, আলোচনাটা আজ থাক। ঘটনাটা তো সুখের স্মৃতি নয়। যত ঘাঁটব তত মনটা খারাপ হবে।

তোমার বাপু, সবটাতেই বড় বাড়াবাড়ি। কবে কী হয়েছে তাই নিয়ে একেবারে দুঃখদাস হয়ে বসে আছ, বউকে ভালবাসতে পারলে না, সংসার মন দিলে না। নিজের দোষ ভেবে মনমরা হয়ে থাক। এমন কী ঘটনা যে আউল-বাউল হয়ে যাচ্ছ?

মাথা নেড়ে অমল বলে, আউল-বাউল নই, দুঃখদাসও নই।

তাহলে আবার কী! ওই যে বলেছিলাম, মনে আছে?

কী বলেছিলে?

বর বউ এক বিছানায় শোও এখন থেকে।

তাতেই হবে?

শুয়েই দেখো না। আর কলকাতায় যাও।

অমল হেসে ফেলে বলে, তোমার প্রেসক্রিপশন বড্ড সহজ-সরল। আমাদের সমস্যাটাও যদি তাই। হত।

আচ্ছা মশাই, বউকে ভালবাসা কি এতই কঠিন কাজ?

ভালবাসা কখন কঠিন হয় জান?

 কখন?

 যখন ভালবাসা জিনিসটাই বুকের ভিতর থেকে উবে যায়। তুমি বউকে ভালবাসার কথা বলছ, আমার যে কোনও কিছুর প্রতিই আর ভালবাসা নেই। বেঁচে থাকাটাও আর ভাল লাগে না।

বলে কী গো! শুধুই পারুল! আর কিছু নয়?

মৃদু হেসে অমল বলে, না ঠাকরোন, পারুলও নয়।

তবে তোমাকে খেলো কে?

সেইটেই তো ভাবি।

আর ভাবনা কাজী হয়ে বসে থেকো না। মোনাকে নিয়ে কলকাতায় যাও।

কেন যে কলকাতায় যাওয়ার জন্য হুড়ো দিচ্ছ! কলকাতাতেই কি আমি ভাল থাকি?

সে জন্য নয়।

 তাহলে?

পারুল এখন গাঁয়ে আছে। পুজোর পর চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুনছি তার নাকি আবার ছেলেপুলে হবে। সবে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। কিছুদিন থাকবে এখন। ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে দিচ্ছে জামশেদপুরে। ব্যাপারটা বুঝেছ?

না তো! পারুল গাঁয়ে থাকবে বলেই কি আমাকে কলকাতায় তাড়াতে চাইছ?

এই তো বুঝেছ!

তার মানে কি পারুল আর আমার এক গাঁয়ে থাকাতেও তোমাদের আপত্তি?

আমার আপত্তি নয় ভাই। মনে হয় মোনা এটাকে ভাল চোখে দেখছে না।

তোমাকে তাই বলেছে বুঝি?

 বলা নয়, তবে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে।

সন্দেহটা অমূলক ঠাকরোন, তবু তোমার কথা আমি মানব।

 কবে যাবে?

কাল সকালেই।

 যেও। তোমাকে যেতে বলছি বলে রাগ করলে না তো ভাই?

না। তুমি তো ভাল ভেবেই বলেছ, রাগ করব কেন?

 আর যা বললাম তা মনে রেখো। চল্লিশের ওপর বয়স হল তোমার। এই বয়স থেকেই কিন্তু পুরুষদের বউকে খুব দরকার হয়।

তাই নাকি?

 নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি ভাই। যত বয়স বাড়ে ততই বউকে বেশি বেশি দরকার হয়। পুরুষদের উড়নচণ্ডী, বারমুখো ভাবটা তো বয়স হলে কমে যেতে থাকে। তখন একটু আসকারা চায় বউয়ের কাছে। তুমি টের পাও না?

না তো!

ও কেমন কথা!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমল বলে, এখন আমার কাউকেই দরকার হয় না তেমন। অফিস থেকে ফিরে নেশা করি। তার পর ঘুমোই।

ওটা কি একটা কথা হল? নেশা করে পড়ে থাকলে কি সমস্যার সমাধান হয়?

তুমি মোনার উকিল হয়েছ, ভাল কথা। কিন্তু আমি যে মোকদ্দমায় হেরেই বসে আছি ঠাকরোন, আমার জন্য আর কারও কিছু করার নেই।

তুমি যে কেমন হয়ে গেলে ভাই। বড্ড কষ্ট হয় তোমার জন্য। কত রোখাচোখা চালাক-চতুর ছিলে! এখন কেমন ভ্যাবলার মতো চুপচাপ বসে থাক! কী হয়েছে তোমার? একটু ডাক্তার দেখাও না।

ঠিক আছে, তাই না হয় দেখাব।

তুমি হাসছ! তার মানে ডাক্তার দেখাবে না।

তুমি তো একটা প্রেসক্রিপশন দিয়েছ। সেটাই ফলো করে দেখি।

দেখো গো দেখো। তাতে ভালই হবে।

প্রেসক্রিপশন কাজে লাগানোর কোনও ইচ্ছেই ছিল না অমলের। বউদি চলে যাওয়ার পর সে তার ডায়েরি টেনে নিয়ে বসল। কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করছে। আজকাল নানা উদ্ভট কথা বা আইডিয়া তার মাথায় আসে। এগুলো কারও কোনও কাজে লাগার কথা নয়। অমল তবু লিখে রাখে, নিজের মনের একটা চিত্র রেকর্ড হয়ে থাকে। সে যদি অনেকদিন বেঁচে থাকে- যদি তাকে বেঁচে থাকতেই হয় তাহলে বুড়ো বয়সে সে ডায়েরির পাতা উলটে এই অচেনা অমলকে খুঁজে বের করবে, বিচার করবে, বিশ্লেষণ করবে। সিরিয়াস কিছু নয়, একটা খেলা বলেই ধরে নেওয়া যাক। লিখতে লিখতে মগ্ন হয়ে গিয়েছিল।

রাতে খেয়ে এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ফের লিখছিল সে। একটু বেশি রাতের দিকে দরজায় মৃদু টোকার শব্দ হল।

চমকে উঠে অমল বলল, কে?

আমি। দরজাটা খোলো।

মোনা কাছাকাছি এলেই আজকাল সে ভয় পায়। মনে মনে নানা ব্যারিকেড রচনা করতে থাকে। কোন কথার কোন জবাব দেবে বা কতটা নীরব থাকবে। শেষ অবধি ব্যারিকেড কাজে লাগে না। আজকাল নীরবতাই তার একমাত্র ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সে দরজা খুলে দেখল, মোনা এই শীতেও একটা হলুদ রঙের নাইটি পরে দাঁড়িয়ে।

কিছু বলবে?

মোনা তার গা ঘেঁষে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর মুখোমুখি হয়ে বলল, শুনলাম কাল কলকাতায় ফিরতে রাজি হয়েছ!

হ্যাঁ, আরও দুদিন ছুটি ছিল। ভাবছি ফিরেই যাই।

 হঠাৎ সুমতি হল কেন?

 সুমতি কুমতি নয় মোনা। ফিরে গেলেও হয়।

জিনিসপত্র সব গুছিয়ে ফেলেছ?

বিস্মিত অমল বলে, তুমি তো জানোই আমার জিনিসপত্র বলতে ওই অ্যাটাচিকেসটা। এ-ঘরে তো আর কিছু নেই।

কী করছিলে? ডায়েরি লেখা?

হ্যাঁ।

 কী লিখছ ডায়েরিতে? আমার সম্পর্কে কিছু?

হঠাৎ অমল বুঝতে পারল, মোনা যুদ্ধ করতে আসেনি। এসেছে সন্ধি করতে। সম্ভবত বউদি ওকেও তার গ্রাম্য প্রেসক্রিপশনটা গিলতে বাধ্য করেছে।

ডায়েরি আর কলম রেখে দিল অমল। বলল, না, তোমার সম্পর্কে বা কারও সম্পর্কেই কিছু নয়। মাথায় অনেক কথা আসে। লিখে রাখি।

মোনা দু হাতে তার এলোচুল গোছ করছিল। মুখাবয়বে একটু ভ্রকুটি। ঠোঁট দুটো চেপে বসে আছে। দেহ মিলনের প্রস্তাবটা দিতে লজ্জা বা সংকোচ বোধ করছে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মাঝে মাঝে এত দুস্তর ব্যবধান রচিত হয় যে, কিছুতেই সহজ হওয়া যায় না।

বোসো মোনা।

বসব?

যদি আপত্তি না থাকে।

মোনা বসল।

 কথাটা বউদিকে না বললেও পারতে।

কোন কথাটা?

আমার আর পারুলের।

মোনা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল। জবাব দিল না।

ধীর স্বরে শান্তভাবে অমল বলে, বউদি গাঁয়ের মেয়ে তো। কথা ছড়ানো ওদের স্বভাব।

 মোনা তার চুলের একটা গুছি সামনে এনে নীরবে পাক খাওয়াতে লাগল।

তোমার ইচ্ছে হলে অবশ্য পাঁচজনকে বলতে পার। আমার আর তাতে কোনও লজ্জা বা ভয় নেই। কিন্তু স্ক্যান্ডালটা হয়তো দুটো পরিবারের ক্ষতি করবে। যদিও অনেকদিন আগেকার ঘটনা তবু তারও কিছু প্রতিক্রিয়া তো আছেই। পাড়াগাঁয়ের নিষ্কর্মা মানুষ এসব কেচ্ছা নিয়ে খুব কথা চালাচালি করে।

দিদি বলবে না। কথা দিয়েছে।

অমল ম্লান একটু হেসে বলে, তুমিই তো সিক্রেটটা রাখতে পারলে না, অন্যে রাখবে সেটা কি আশা করা যায়?

আই অ্যাম সরি।

দোষ আমার বড় কম নয় মোনা। তবে আমি এখন এমন একটা মেন্টাল স্টেটে আছি যে এসব আমাকে তেমন স্পর্শ করে না। তোমাকে সত্যিই বলছি, পারুল ভাল মেয়ে। তার দোষ ছিল না। সে আমাকে বিয়ে না করে তার প্রতিবাদও জানিয়েছে। আমি যেমনই হই, পারুলকে খারাপ বলতে পারি না।

মোনা কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, আজ আমি তোমার কাছে অন্য কিছুর জন্য এসেছিলাম। পারুলের কথাটা না তুললেই হত না?

অমল ম্লান হেসে বলে, কেন এসেছ মোনা?

মোনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আজ থাক। কাল সকালে তাহলে আমরা কলকাতা যাচ্ছি?

হ্যাঁ যাচ্ছি। পাক্কা।

তোমার মেয়েও কি যাবে?

তা তো জানি না। ও কি থাকতে চাইছে?

আমার সঙ্গে কথা হয়নি।

তুমি কী বলো? ওকে রেখে যাবে?

না। এখানে ওর পড়াশুনো হবে না। ব্যায়াম হবে না। মিউজিক ক্লাস বা কম্পিউটার তেমন কিছুই হবে না। ও কেন থাকতে চাইছে এখানে জানো?

না।

ও বাজে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারবে। যেমন খুশি চলবে, যা খুশি করবে। এবাড়ির লোকদেরও তো দেখছি। ভীষণ আনকালচার্ড।

তাহলে জোর করে নিয়ে চলো।

 বিস্মিত মোনা বলে, তুমি জোর করতে বলছ?

বলছি। আর কি কোনও উপায় আছে?

জোর করারই বা উপায় কী? চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাবে?

অমল নিভে গিয়ে বলল, ভায়োলেন্সের কথা বলিনি।

 ও যেতে চাইবে না, আমি জানি। বকে ঝকে বুঝিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কোনওভাবেই রাজি করাতে পারিনি। ও তো আমাকে শত্রু বলে ভাবে।

অমল দুর্বল গলায় বলে, তাহলে কী উপায়?

আমি বুঝতে পারছি না।

অমল চুপ করে বসে রইল। তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, যেতে যখন চাইছে না তখন থাক। কিন্তু এর আগে একবার কথাটা বলে ফল ভাল হয়নি। তাই বলল না।

তুমিই জোর করার কথা বলছিলে। জোর কীভাবে করবে?

যদি বুঝিয়ে বলা যায়?

বুঝিয়ে বলা আর জোর করা এক ব্যাপার নয়। বুঝিয়ে বললে ও রাজি হবে না। তখন কী করবে?

অমলের মাথা কাজ করে না আজকাল। তবু হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা কথা মনে পড়ে গেল তার। সে বলল, কয়েকদিন আগে বুডঢা আমাকে বলছিল, দিদির ই-মেল-এ অদ্ভুত অদ্ভুত মেসেজ আসছে। তার কোনও কোনওটা নাকি খুব অশ্লীল জাঙ্ক মেল।

আমাকে বলেনি তো বুডঢা।

বুডঢাকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে। ওর কথা শুনে আমিও সোহাগের ই-মেল চেক করেছি। কথাটা মিথ্যে নয়।

কোথা থেকে আসছে? আমেরিকা?

মোস্টলি।

খুব খারাপ কথা?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অমল বলে, খুব খারাপ। লেসবিয়ান সম্পর্কের কথাও আছে। সেগুলো আমি ডেস্ট্রয় করে দিয়েছি। কিন্তু মনে হয় এরকম আসতেই থাকবে।

জাঙ্ক মেল তো আমারও আসে, তোমারও আসে।

হ্যাঁ, সেগুলো কারা পাঠায় তা আমরা জানি না। কিন্তু সোহাগের কাছে যারা পাঠায় তারা সবাই ওর অচেনা নাও হতে পারে।

ভ্রূ কুঁচকে একটু ভাবল মোনা। তারপর বলল, কিন্তু জাঙ্ক মেল-কে ভয় পেলে তো আমাদের চলবে না। ওটা কোনও বড় ফ্যাক্টরও নয়। তার চেয়ে ওর কলকাতায় যাওয়াটা অনেক জরুরি।

হ্যাঁ, আমিও তো তাই বলছি।

তাহলে এখন কী করব?

তৈরি হও।

আমি তৈরিই আছি। তোমার মেয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওকে ঘুম থেকে তুলে কাল কলকাতায় যাওয়ার কথা বলা ঠিক হবে কি?

তা কেন? ঘুমোচ্ছ ঘুমোক। কাল সকালেই বলে দেখো।

রাজি না হলে?

তখন ভাবা যাবে।

ভাবার সময় হবে কি?

 আমরা কাল সকালে না গিয়ে দুপুরে বা আফটারনুনেও যেতে পারি। সময় পাওয়া যাবে।

সকালে একটা ভাল ট্রেন ছিল।

বর্ধমান থেকে কলকাতায় যাওয়ার কি ট্রেনের অভাব মোনা? দুপুরে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসও তো আছে।

মেয়েকে কী বলবে তা তৈরি করে রেখো।

আচ্ছা।

আমি যাচ্ছি।

 অমল একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলে, যাবে?

 উঠে দাঁড়িয়েও বসে পড়ল মোনা, থাকতে বলছ?

ভাগ্যক্রমে দেহমিলনের জন্য ভালবাসার দরকার হয় না এবং কাম প্রেমের দাস নয়। এবং বেশির ভাগ দম্পতিই বিয়ের বহু বহু বছর পরে প্রেমহীন চুম্বন, ভালবাসাহীন মিলনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।

গভীর রাতে ক্লান্ত দুই নরনারী বিভিন্ন হল।

আমি ও-ঘরে যাচ্ছি।

 যাও।

উঠে দরজাটা বন্ধ করে দাও।

 ভেজিয়ে রেখে যাও, কিছু হবে না।

সামনে সমস্যাসংকুল এক সকাল আসছে। কী হবে কে জানে। মনে দুশ্চিন্তা নিয়েও ঘুমিয়ে পড়ল অমল।

.

একটা রোগা সাদা ছোট্ট ঘোড়া এসে নীচের উঠোনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে চুপ। নড়ছে, চড়ছে না। মাঝে মাঝে শুধু ঝামরে উঠছে লেজ।

ওপর থেকে দেখছিল সোহাগ। এত রোগা যে দেখলে মায়া হয়। হাড় জিরজিরে শরীর, বড় ছোটোখাটো।

একটা কালোমতো ফ্রক-পরা মেয়ে কোথা থেকে খানিকটা ঘাস ছিঁড়ে এনে মুখের কাছে ধরল। ঘোড়াটা খেল না। মুখ ফিরিয়ে নিল। সেই মেয়েটাই গিয়ে ঝপাং করে কুয়ো থেকে এক বালতি জল এনে ধরল মুখের সামনে। ঘোড়াটা জলও খেল না।

মেয়েটা ওপর দিকে চেয়ে বলল, ও সোহাগদিদি!

কী রে?

ঘোড়াটা কিছু খাচ্ছে না যে!

 ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দে।

 ও বাবা, যদি কামড়ে দেয়?

ঘোড়া কি বাঘ যে কামড়াবে?

কামড়ায় গো। আমার মামাকে কামড়েছিল যে!

 দে না একটু হাত বুলিয়ে।

তার চেয়ে বরং তাড়িয়ে দিই।

আহা, তাড়াস না। বড্ড রোগা যে!

মেয়েটা খুব ভয়ে ভয়ে ঘোড়ার মাথায় একটু হাত দিতেই ঘোড়াটা হঠাৎ সামনের দু পা তুলে প্রবল গর্জন করে উঠল, চি হি হি…

মেয়েটা লাফ দিয়ে সরে এসে হিহি করে হাসল।

হাসছিস কেন?

কী বলল শুনলে না?

কী বলল?

বলল, আমি সোহাগের জন্য এসেছি।

 যাঃ। ও তো শুধু চি হি হি করে ডাকল!

তুমি কিছু জান না। আমি ঘোড়ার কথা বুঝতে পারি।

আমাকে ওর কী দরকার?

তা কী জানি! তোমার ঘোড়া তুমি এসে দেখো।

এ কথা শুনে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েই সোহাগ দেখল সে উঠোনে ঘোড়াটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ঘোড়াটা পরিষ্কার মানুষের গলায় বলল, উঠে পড়ো, উঠে পড়ো। সময় নেই…

সোহাগ কখন উঠল কে জানে, হঠাৎ দেখল সে ঘোড়ার পিঠে বসে আছে আর ঘোড়াটা টগবগ টগবগ করে চলেছে।

কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে বল তো!

ঘোড়াটা জবাব দিল না। চলল আর চলল। টগবগ টগবগ।

সামনেই একটা গভীর সবুজ জঙ্গল। এত সবুজ যে মনে হয় সদ্য কেউ সবুজ রঙে চারদিককে চুবিয়ে গেছে। আর এরকম অদ্ভুত গাছপালা সে কখনও দেখেছে কি? দেখেছে, তবে ছবিতে। গাছপালা একটাও তার চেনা নয়। বিশাল বড় বড় পাতা, খুব বড় বড় সব গোল ফল চারদিকে ফলে আছে। আর দেখল মণ্ড আকাশের আধখানা জুড়ে কী বিশাল চাঁদ উঠছে। চাঁদ কি এত বড় হয়? কে জানে বাবা, হয়তো হয়।

চারদিকে আলো আর আলো। আর গাছপালা। আর তার ফাঁকে ফাঁকে ফর্সা আলোয় ঘুরে বেড়াচ্ছে খরগোশ, হরিণ, ময়ূর, টিয়ার ঝাঁক, জেব্রা,, নীল গাই।

বড্ড ভাল তো জায়গাটা। এখানে একটা চড়ুইভাতি করলে কেমন হয়?

ঝুমঝুম করে একটা ঝুমঝুমির শব্দ হচ্ছিল। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটা লোক দৌড়পায়ে আসছে। তার কাছাকাছি এসে লোকটা হাত তুলে বলল, এই যে! আপনার একটা চিঠি আছে।

লোকটার পোশাক দেখে ভারী মজা পেল সোহাগ। পরনে একটা খাকি হাফ প্যান্ট আর গায়ে সান্ডো গেঞ্জি।

আপনি বুঝি ডাক হরকরা?

হ্যাঁ। অনেক চিঠি বিলোতে হবে। যাই।

খামের চিঠিটা হাতে নিয়ে সে দেখল খামের মুখটা খোলা। চিঠিটা বের করে দেখল নীল কাগজে কে যেন অনেক অসভ্য কথা লিখেছে ভুল ইংরিজিতে। সে রেগে গিয়ে চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিল।

ও মা! পান্না!

পান্না অভিমানভরে বলে, সেই কখন থেকে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। এত দেরি করলে যে!

কী করব, ঘোড়াটাই যে দেরি করে গেল আমাকে আনতে।

এবার নামো। দেখছ কেমন সুন্দর জায়গা।

এই জায়গায় আমরা পিকনিক করব, তাই না পান্না?

হ্যাঁ। এখন চলো, কাজ আছে।

জঙ্গলে আবার কী কাজ?

বাঃ, মনে নেই? সেই যে

কী বল তো!

এসো আমার সঙ্গে, দেখবে।

পান্নার পিছু পিছু হেঁটে সোহাগ গভীর জঙ্গলের মধ্যে পৌঁছে দেখতে পেল, ঘাসের ওপর একটা কম্পিউটার। তার সামনে একজন লোক বসে আছে। সে কাছে যেতেই লোকটা মুখ ফেরাল। আর বড্ড চমকে উঠল সোহাগ। বুকটা ধকধক করছে। লোকটা হেসে বলল, তুমি ইন্টারনেট খুঁজছিলে খুকি? এই তো ইন্টারনেট। অ্যান্ড ইউ হ্যাভ এ মেসেজ।

লোকটা বিজু।

.

৩০.

একটা চারকোনা কাগজের মধ্যে থেমে আছে সময়, থেমে আছে ইতিহাস। গৌরহরি দাঁড়িয়ে আছে একটা মৃত বাঘের পেটের ওপর এক পা রেখে। হাতে বন্দুক। মাথায় শোলার হ্যাট। পরনে খাকি প্যান্ট আর সাদা হাফশার্ট। দুখানা চোখ ছবিতেও জ্বলজ্বল করছে। পিছনে জঙ্গলের সিনারি।

হেসে কুটিপাটি হচ্ছিল পারুল, আচ্ছা, বাবা আবার কবে বাঘ মারল বলো তো! জীবনে কখনও শিকার-টিকার করেছে বলে তো শুনিনি!

বলাকা মুগ্ধ চোখে চেয়ে ছিল। ছবিটা মিথ্যে এবং সাজানো। গৌরহরি কখনও বাঘ মারেনি। মনোরঞ্জন সাহা ছিল গৌরহরির মক্কেল। তার স্টুডিওতে শখ করে ছবিটা তুলে দিয়েছিল। তোক মিথ্যে, তবু কী পৌরুষদীপ্ত দেখাচ্ছে মানুষটাকে! বাঘ মারতে চাইলে গৌরহরি কি মারতে পারত না? পারত। তার স্বামীর পক্ষে অসম্ভব কিছুই ছিল বলে বলাকার কখনও মনে হয় না।

বলাকা মৃদু হেসে বলে, এ ছবিটা তুই দেখিসনি, না?

না তো!

 এক মক্কেল তুলে দিয়েছিল। তার স্টুডিওতে ট্যাক্সিডার্মি করা বাঘ-ভালুক ছিল বলে শুনেছি। ছবিটা অনেকদিন খুঁজে পাইনি। এই সেদিন আলমারি হাঁটকাতে গিয়ে কাগজপত্রের মধ্যে পেলুম। সুন্দর না?

সুন্দর। আমার বাবা তো সুন্দরই ছিল। কিন্তু ছবিটা বড্ড নাটুকে। বাঘশিকারি বীর সাজার কী দরকার ছিল বাবার?

দরকারটা তোর বাবার ছিল না, ছিল মক্কেলের। শুনেছি, ছবিটা সে স্টুডিওর শো-কেসে সাজিয়ে রেখেছিল। লোকে ভাবত কোনও সাহেবের ছবি।

তাই বলো! তার মানে এটা হল মডেল হিসেবে বাবার পোজ দেওয়া।

তাই হবে বোধহয়। ছবিটা আমার বেশ লাগে। বাঘ না মারলেও ডাকাবুকো তো ছিল।

তা সত্যি। আমার বাবার মতো সাহসী মানুষ আমি অন্তত দেখিনি। সেই ডাকাতের গল্পটা বলল না মা! সেই যে হরিপুরের দাদুর বাড়িতে

বলাকার শরীর এতকাল পরেও শিউরে উঠল। কতকাল আগেকার কথা, তবু যেন মনে হয় এই সেদিন–না, কত নয়–মনে হয়, গতকালকের কথা। না, আরও টাটকা। যেন আজকের ঘটনা, যেন এখনই ঘটছে।

হরিপুরের খুড়শ্বশুর ছিলেন দিলদরিয়া মানুষ। বাগানের শখ ছিল খুব। বাগানের শাকসবজি, আম কাঁঠাল নিয়ে মাঝে মাঝে চলে আসতেন। জমিয়ে গল্প করতেন। খাওয়া-দাওয়ারও খুব শখ ছিল। সেই মানুষটার সেবার এখন তখন অবস্থা। মরার সময় ঘনিয়ে এলে মানুষ সূক্ষ্মভাবে ঠিক টের পায়, আর তখন আত্মীয়স্বজনকে দেখার জন্য আকুলিব্যাকুলি হতে থাকে। হরিপুর থেকে খবর এল, খুড়শ্বশুর তাদের দেখতে চান।

একটু বৈষয়িক দরকারও ছিল। খুড়শ্বশুরের বড় ছেলে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল বলে তাকে আগেই ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছিলেন। এখন উইল করে সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করার জন্য পাকা ব্যবস্থা করতেও গৌরহরিকে ডাকা।

সেটা মাঘ মাস ছিল, মনে আছে বলাকার। দুপুরে তারা বাসে চেপেছিল। ঘরের বার বেশি হত না বলেই সেই সামান্য সামান্য ভ্রমণগুলোই অসামান্য লাগত বলাকার কাছে। জানলার ধারে বসে ঠান্ডা বাতাস উপেক্ষা করে বাইরের জগতটা দেখছিল সে।

তখন এক গা গয়না পরে থাকতে হত বলাকাকে। শ্বশুরমশাই এবং শাশুড়ি ঠাকরুন দুজনেই পছন্দ করতেন তাঁদের বড়বউ সবসময়ে গয়না পরে থাকুক। পথেঘাটে তখন এত বিপদ-আপদ ছিল না বলেই গয়নাগুলো খুলেও রেখে যায়নি বলাকা। ষোলো-সতেরো বছর বয়সে অত হিসেবনিকেশ করে চলার বুদ্ধিও তো হয়নি।

বাসে একটা লোক গৌরহরির সঙ্গে বেশ গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়ে ফেলল। কোথায় যাচ্ছেন, কী করা হয়, কোথা থেকে আগমন–এইসব অকারণ কৌতূহল।

তারা যেখানে নামল লোকটাও সেখানেই নামল। বাসরাস্তা থেকে হরিপুর মাইল দুই হাঁটা পথ। গোরুর গাড়ি যায় বটে, কিন্তু রাস্তা খারাপ বলে সময় বেশি লাগে। তাই তারা হেঁটেই যাচ্ছিল। লোকটাও তাদের সঙ্গে কিছু দূর এল। তারপর, এবার আমি গাঁয়ের রাস্তায় যাব বলে হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল।

বলাকা দেখল, গৌরহরির মুখটা একটু গম্ভীর। তখন স্বামীর মুখ গম্ভীর দেখলেই বলাকার মন খারাপ হত।

সে বলল, কী ভাবছ গো! কাকার জন্য মনখারাপ?

 গৌরহরি বলল, হুঁ।

কয়েক কদম গিয়ে গৌরহরি দাঁড়িয়ে ডাইনে বাঁয়ে দেখে নিল একটু। দেখার অবশ্য কিছু ছিল না। নির্জন মাঠঘাট, ঝোপঝাড়, বাঁশবন।

কী হল গো?

গৌরহরি মৃদু হেসে বলল, গয়নাগুলো পরে এসে ভুল করেছ বলাই। কিন্তু কী আর করা যাবে।

বলাকা ভয় পেয়ে বলে, হঠাৎ গয়নার কথা বলছ কেন?

এমনি বললাম। ভয় পেও না।

না, তুমি মোটেই এমনি বলোনি। কিছু হবে নাকি গো?

আরে না। আর হলেই বা কী! চলো।

খানাখন্দে ভরা রাস্তায় চলতে চলতেই শীতের বেলা ফুরিয়ে আসছিল। কে যেন আলোর বিছানো চাদরটা টেনে নিচ্ছে দ্রুত। চারদিকে ঝুঝকো আঁধারের জাল নেমে আসছিল। বলাকার বুক ঢিপঢিপ করছিল।

হ্যাঁ গো, ওই লোকটা তোমাকে কিছু বলেছে?

না তো!

তাহলে তুমি চিন্তা করছ কেন?

গৌরহরি মৃদু হেসে বলল, লোকটা মুখে কিছু বলেনি। তবে চোখ দিয়ে বলেছে।

 তার মানে কী গো! চোখ দিয়ে কী বলল?

উকিল মানুষ তো, ক্রিমিন্যাল চিনতে পারি।

কিন্তু লোকটা তো চলে গেল।

হ্যাঁ।

বলাকা রাগ করে বলল, তুমি কিছু খুলে বলছ না।

ভয়ের কী! আমি তো সঙ্গে আছি।

 আমার ভয়-ভয় করছে যে!

ভয় পেও না। ভয় পেলে বুদ্ধিনাশ হয়। আর বুদ্ধিনাশ হলেই বিপদ।

 আমাদের কি কোনও বিপদ হবে?

মনে হয় না। তবু ভালর জন্য যে কটা গয়না পার খুলে ফেল গা থেকে।

 গয়না খুলব?

 হ্যাঁ। সব খোলার দরকার নেই। যেগুলো সহজে খোলা যায় শুধু সেগুলো। খুলে আমার হাতে দাও।

 বলাকা খুব তাড়াতাড়ি নেকলেস, বালা, দুল, আংটি খুলে ফেলতে পেরেছিল। পৌরহরি সেগুলো রুমালে জড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে দিল। ডান হাতে চামড়ার স্যুটকেস আর বাঁ হাতে বলাকার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিরুদ্বেগ গলায় বলল, ছুটছাট ঝামেলা বিপদ তো জীবনে ঘটেই থাকে। শুধু বলে রাখি বিপদ ঘটলে দৌড়ে পালাতে যেও না। মাটিতে উবু হয়ে বসে পেপাড়ো।

কথা শুনে বলাকার বুকে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। সে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরল গৌরহরির হাত।

তখনও আলো সম্পূর্ণ মরে যায়নি। হরিপুরের গাছপালা দেখা যাচ্ছিল দূর থেকে। দু-চারটে আলোও জ্বলে উঠছিল। হঠাৎ বাঁ ধারের মাঠ বরাবর সাত-আটজন লোককে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। হাতে লাঠি, সড়কি, দা।

ও ওরা কারা আসছে গো? অ্যাঁ! ওরা কারা?

আমার পিছনে আড়াল হও বলাই।

ওরা কি ডাকাত?

 শান্ত স্বরে গৌরহরি বলেছিল, এরা ছ্যাঁচড়া ডাকাত। ভয় নেই।

গৌরহরি লোকগুলোকে দেখে ঘাবড়াল না, পালাল না। বলাকাকে উবু হয়ে বসতে বলে শান্তভাবে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইল। বলবান শরীরটা ছাড়া তার কোনও অস্ত্র ছিল না। না ছিল, চরিত্র ছিল, দুর্জয় সাহস ছিল। সেগুলোও কি মানুষের অস্ত্র নয়?

লোকগুলো এত তাড়াতাড়ি চলে এল কাছে যে, বলাকা কিছু ভাববারও সময় পেল না। চোখের পলকে ঘিরে ধরল তাদের। লম্বা চওড়া একটা লোক গৌরহরির বুকে বল্লম ঠেকিয়ে বলল, দিয়ে দে, দিয়ে দে। প্রাণে মারব না। দিয়ে দে।

কী চাও?

গয়নাগুলো দে। তাড়াতাড়ি…তাড়াতাড়ি…অ্যাই, ওই যে মেয়েটা ঘাপটি মেরে বসে আছে, খুলে নে তো গা থেকে…

একটা লোক এগিয়ে এসে বলাকাকে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল।

বোধহয় ওইটেই ভুল করেছিল ডাকাতেরা। বলাকার গায়ে হাত না দিলে গৌরহরি হয়তো গয়নাগুলো দিয়ে দিত, ঝামেলা করত না।

হাতের স্যুটকেসটা একবার দুলিয়ে গৌরহরি প্রথম মারল সর্দার লোকটাকে। সে ছিটকে যেতেই কার হাত থেকে একটা লাঠি হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিয়ে গৌরহরি যেন দশটা গৌরহরি হয়ে গেল।

কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে কাঁদতে দৃশ্যটা দেখছিল বলাকা। আবার ওই ভয় উত্তেজনা উদ্বেগে ভাল করে দেখেওনি কিছু। শুধু দেখল, লোকগুলো কেমন দিশেহারা হয়ে গেল। দু-চারজন মার খেয়ে এবং বাকিরা ভড়কে গিয়ে তফাত হচ্ছিল যেন। বলাকা চোখ বুজে ফেলেছিল এরপর।

লোকগুলো তেমন উঁচুদরের ডাকাত নয়। হয়তো চাষি-বাসি। মাঝেমধ্যে শৌখিন ডাকাতি করে। গৌরহরির রুদ্রমূর্তি আর রাগ দেখে তারা পালিয়ে গেল। দুটো লোক পড়েছিল মাঠে।

টর্চ জ্বেলে গৌরহরি দুজনের মুখ দেখে নিল। তারপর বলল, চলো বলাই, আর ভয় নেই।

গৌরহরি অক্ষত ছিল না। সড়কি লেগেছিল হাতে। লাঠির ঘায়ে কান ঘেঁচে গিয়েছিল। বেশ রক্তপাত হয়েছিল। বলাকা যখন তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছিল তখন গৌরহরি বলল, কাঁদো বলেই তো লোকে পেয়ে বসে।

তোমাকে যদি মেরে ফেলত?

আচ্ছা বলাই, আমাকে মেরে ফেলত বলেই তুমি শুধু ভয় পেয়ে কাঠ হয়ে থাকবে? বরং এক আধটা ঢ্যালা তুলে ছুঁড়ে মারতেও তো পারতে। পুজোর সময় মা দুর্গাকে তো খুব প্রণাম করো, অঞ্জলি দাও, মা দুর্গার লড়াইটা নিতে পারো না?

বলাকা কথাটা আজও ভুলতে পারে না। খুব শিক্ষা দিয়েছিল তাকে গৌরহরি। উপদেশ দিলে মানুষ শেখে না, কিন্তু পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যখন উপদেশ উঠে আসে তখন মানুষ সহজেই শেখে।

খুড়শ্বশুরের বাড়িতে ঢুকবার আগে গৌরহরি বলেছিল, ঘটনাটা কাউকে বলার দরকার নেই। হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম বলে চোট হয়েছে, এটা বলাই ভাল।

আশ্চর্যের বিষয় নিজের এই বীরত্বের কাহিনী কখনও গৌরহরিকে কারও কাছে বলতে শোনেনি বলাকা। যেন কিছুই ঘটেনি, এমনই নির্লিপ্ত থেকেছে মানুষটা।

গল্পটা পারুলের কাছে বলতে বলতে সেই সন্ধেটা যেন ঘিরে ধরল চারিদিকে। যেন পাশেই রয়েছে গৌরহরি। বাঘের মতো চোখ জ্বলছে, দুই সবল হাতে লাঠি চালাচ্ছে প্রবল বিক্রমে।

শুনতে শুনতে চোখ ছলছল করছিল পারুলের।

আচ্ছা মা, সেদিন যদি বাবা ডাকাতের হাতে মারা যেত তা হলে আমাদের তো জন্মই হত না, তাই?

তাই তো মা।

আর তুমি বোধহয় পাগল হয়ে যেতে।

না মা, আমি মরেই যেতাম। হার্টফেল হত।

 খুব হাসল পারুল, সবাই বলে বাবার প্রতি তোমার যেমন ভালবাসা তেমনটা আর দেখা যায় না। নিঃশব্দে নীরবে তুমি বাবার জন্য সব কর্তব্য করেছ।

তারা ভুল বলে মা।

ভুল বলে?

 বলাকা হাসলেন, একদম ভুল। কর্তব্য হিসেবে আমি তার জন্য কখনও কিছু করিনি।

কী যে বলো মা! আমরা তো জানি বাবা কেমন মেজাজি আর খেয়ালি ছিল। সময়-অসময়ে কত অন্যায় বায়না করত, তুমি কখনও রাগ করোনি। সব বায়না সামলেছ, তোমার জন্য আমাদের কষ্ট হত, বাবার ওপর রাগও হত, ভয়ে কিছু বলতাম না। সময় অসময়ে বাবা কতদিন অতিথি এনে হাজির করেছে, মনে নেই? অসময়ে তোমাকে ফের উনুন ধরিয়ে রাঁধতে হত। রান্নার লোক তো রাখা হয়েছে অনেক পরে।

সব মনে আছে মা। মনই তো এখন আমার বন্ধু। মন খুলে বসে সেসব দিনকে ফের কাছে নিয়ে আসি, চোখ ভরে সব দেখি। কিন্তু তুই যা বললি তা তোর নিজের মতো করে বিচার। আমি তো ওভাবে দেখি না। আমার কখনও কোনও কষ্ট হয়নি যে!

হয়নি?

না, কখনও হয়নি। যদি কর্তব্য হিসেবে করতাম তা হলে হত। আমি যা করেছি তা ওই মানুষটাকে ভালবেসে করেছি। কর্তব্যের মধ্যে কষ্ট থাকে, অনিচ্ছে থাকে, নিজের ওপর জোর খাটাতে হয়, শ্রদ্ধা থাকে না। ভালবাসায় ওসব নেই। ভালবাসলে সব করা যায়।

তোমার মতো ভালবাসা কিন্তু এ যুগে অচল। আরও পঞ্চাশ বছর পর জন্মালে তুমি পারতে না।

আরও দুশো বছর পরে জন্মেও যদি তোর বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তাহলেও ঠিক একই রকম আমাকে দেখবি তোরা। ভালবাসা তো মুখের কথা নয় মা, ভসভসে আবেগও নয়, ভালবাসার মধ্যে তার জন্য করাটাও আছে। খুব ভালবাসি, কিন্তু তার জন্য কিছু করতে ইচ্ছেও করে না, সে ভালবাসা হচ্ছে সোনার পাথরবাটি।

পারুল হাসছিল, ইউ আর ইমপসিবল। বাবার ব্যাপারে তোমাকে কখনও টলতে দেখলাম না। হ্যাঁ, মা, একটা কথা বলবে?

বড্ড পেছনে লাগছিস আজ। আবার কী কথা?

বলছি ধরো বাবা যদি এত হ্যান্ডসাম না হত, এত পারসোনালিটি বা সাকসেস না থাকত তা হলে কি এত ভালবাসতে পারতে?

তা তো জানি না। তাকে যেমনটি পেয়েছি তেমনটিই পেয়েছি। আমার তো নালিশ নেই। রূপের আকর্ষণ তো বেশি দিন থাকে না। থাকে অন্য কিছু।

যাই বলল, আমার বাবা ওরকম না হলে কিন্তু তুমি কিছুতেই

দুর পাগলি! এই যে বললি তোর বাবা খামখেয়ালি ছিল, আমার ওপর অন্যায় অত্যাচার করত। আরও অনেকে অনেক কথা বলে। আমার শাশুড়ি তো বুড়ো বয়সে আমাকে প্রায়ই বলত, ও বউমা, ওকে অত আসকারা দাও কেন বলল তো! তোমাকে ভাজা ভাজা করে খেল যে! কখনও-সখনও একটু মুখনাড়া দিও মা, নইলে পুরুষমানুষ নৃসিংহ অবতার হয়ে ওঠে কি না।

বলত বুঝি?

শাশুড়ি বলত, দেওর ননদরা বলত।

 তুমি মানতে না?

 মানব কি, শুনে তো আমার ওর জন্য কষ্টই হত। মনে হত বেচারার আমি ছাড়া তো বন্ধু নেই।

ওঃ, এ যে দারুণ ডায়ালগ।

 পেছনে লাগছিস তো!

না মা, বাবার গল্প শুনতে আমার ভাল লাগে। এক গল্প কতবার শুনি, তবু পুরনো হয় না। তুমি বলো।

হৈমর গল্প তো শুনেছিস?

শুনিনি আবার! মুখস্থ। তবু বলল।

 রায়বাড়ির হৈমর কথা ভাবলে আজও বলাকার মনটা মেদুর হয়ে যায়। ফর্সা টুকটুকে পুতুল-পুতুল চেহারা ছিল হৈমর। হাত পায়ের ডৌল কী সুন্দর। রক্তমাংসের মানুষ বলে মনেই হয় না। রায়েদের ছিল বংশানুক্রমিক বন্ধকী কারবার। বিস্তর পয়সা। হৈমর বাবা মাধবানন্দ রায়ের আমলে ব্যবসা যেন আরও ঠেলে উঠেছিল। তখনও বিয়ে হয়নি গৌরহরির। এম এ পাশ করে ল পড়ছে। ছুটিছাটায় বাড়ি এলে হৈম গিয়ে গৌরহরিকে বলত, তোমার আমার তো সামাজিক বিয়ে হওয়ার নয়, চলো পালিয়ে যাই। হৈমর রাখঢাক ছিল না, স্পষ্টাস্পষ্টি কথা।

গৌরহরি তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করত। সমস্যা হল হৈমরা বৈদ্য। আরও সমস্যা হল হৈম বালবিধবা।

গৌরহরি যদি হৈমকে মন থেকে অপছন্দ করত তা হলে সমস্যা হত না। কিন্তু মেয়েটির প্রতি গৌরহরিরও একটু আকর্ষণ ছিল। শুধু চেহারাই নয়, হৈমর একটা ভারী সুন্দর, সরল স্বভাব ছিল। কোনও উগ্রতা ছিল না। বয়সে গৌরহরির কাছাকাছি। খুব অল্প বয়স থেকেই তাদের মধ্যে একটা মনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তখন তো হুট করে কেউ সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে ফেলত না।

হৈম বলত, আমি সেই কোন ছেলেবেলা থেকে তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে মনে করেই এতকাল শিবের মাথায় জল ঢেলেছি। আমার কী অপরাধ বলো।

গৌরহরি বলত, শুধু ভালবাসা সম্বল করে যদি পালিয়ে যাই তা হলে দেখবে ভবিষ্যতে কষ্টে পড়লে ভালবাসাটাও থাকবে না।

তাই কি হয়? আমি চিরকাল তোমাকে ভালবাসব।

ভালবাসাবাসিতে যেরকম সব কথা হয় তেমনই হত তাদের মধ্যেও। গৌরহরির বিয়ের জন্য যখন পাত্রী দেখা হচ্ছে তখন একদিন হৈম এসে কেঁদে পড়ল, তা হলে আমার কী হবে? আমি কী করে বাঁচব?

গৌরহরি বলল, হৈম, তোমাকে যদি বিয়ে করি তা হলে এমন একটা বিশ্রী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যে শেষে আমাদের পরিণতি ভাল হবে না।

গৌরহরির হাত ধরে অনেক সাধাসাধি করেছিল হৈম, অনেক কেঁদেছিল, শেষে এরকম অসম্ভব প্রস্তাবও করে বসেছিল, তা হলে আমাকে অন্তত একটা সন্তান দাও, তাকে নিয়ে বেঁচে থাকব।

গৌরহরি বলেছিল, দুনিয়ায় কি পাপের অভাব আছে হৈম? আমরা সেটা আর বাড়াব কেন?

বলাকা তখন নিতান্তই বালিকা। কানাঘুষো কিছু কানে এলেও ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো মনই তৈরি হয়নি তার। বিয়ের পর হৈম তার কাছে আসত প্রায়ই। হাঁ করে তাকে দেখত, কাছ ঘেঁষে বসে তার মুখে হাত বুলিয়ে দিত। বড় অস্বস্তি হত বলাকার। তারপর একদিন তাকে বলল, হ্যাঁরে, ভাগ করে নিবি?

কী ভাগ করে নেব?

কেন, তোর বরকে?

বলাকা ভারী অবাক হয়ে যেত। বালিকা হলেও এবং কথাটার নিহিত অর্থ না বুঝলেও তার প্রস্তাবটা মোটেই ভাল লাগত না। সে আড়ালে কেঁদে ফেলেছিল। এবং রাতে গৌরহরিকে বলেও দিয়েছিল।

গৌরহরি তাকে বলল, ভয় পেয়ো না। ও দুঃখী মেয়ে। এর জন্য আমাদের কিছু করার নেই।

ও আবার এলে আমি কী করব?

আমার মায়ের কাছে গিয়ে বসে থেকো।

ধীরে ধীরে হৈমর ভিতরে একটা পরিবর্তন আসছিল। ছোট হলেও বলাকা সেটা বুঝতে পারত। বিধবা হলেও হৈম চওড়া পাড়ের শাড়ি পরত, মুখে পাউডার দিত, কপালে টিপ পরত। গাঁয়ে নিন্দে হলেও গ্রাহ্য করত না। কিন্তু ধীরে ধীরে সাজগোজ কমে যেতে লাগল। চুল আঁচড়াত না। আর বলাকার কাছে এসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক কথা, আয় না রে, ভাগ করে নিই। আমি অর্ধেক, তুই অর্ধেক!

বলাকা সবসময়ে শাশুড়ির ঘরে পালিয়ে যেতে পারত না। শাশুড়িরও কাজকর্ম, পুজো-আচ্চা সংসার আছে। খুব মন খারাপ হত তার। বলত, ওসব কথা বলতে নেই।

কেন রে। তুই তো একটুখানি এক ফোঁটা মেয়ে। বরের কথা তুই কী বুঝিস?

নানা অসভ্য কথাও জিজ্ঞেস করত হৈম। বলাকার খুব রাগ হত। কিন্তু রাগ করে তো কিছু করার ছিল না। তার চেয়ে অন্তত তেরো চোদ্দো বছরের বড় ছিল হৈম, কাজেই বকেও দিতে পারত না।

তবে এটাও ঠিক, বরের মহিমা সে নিজেও বুঝত না তখন। শুধু বুঝত, এ লোকটা আমার সম্পত্তি। তার বেশি কিছু নয়।

আমাকে কি তোর হিংসে হয়?

হিংসে হবে কেন?

জানিস, তোর বরকে আমি নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতাম।

কেন?

ও তো আমারই ছিল। তুই কেড়ে নিলি।

 বাঃ রে, কেড়ে নেব কেন? আমাদের তো বিয়ে হয়েছে।

 ওঃ ভারী তো বিয়ে! ও বিয়ে আমি মানিই না।

কান্না আসত বলাকার।

একদিন হৈম বলল, তোর বরকে বলবি আমাকে একটা ছেলে দিতে!

বলাকা হাঁ।

বল না রে। আমি বললে শোনে না। তুই বললে ঠিক শুনবে। এটুকু তো পারে। বল না রে।

একথাটাও গৌরহরিকে বলে দিয়েছিল বলাকা।

গৌরহরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পাগলামির লক্ষণ।

 ও তোমাকে কেড়ে নিতে চায় কেন?

একটু বড় হলে সব বুঝিয়ে দেব। মন খারাপ কোরো না।

আমার ওকে ভীষণ ভয় করে।

 করারই কথা।

সন্তানের ইচ্ছেটাই বোধহয় শেষ অবধি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিল হৈমর। সেইসময়ে এসে আর স্বামীর ভাগ চাইত না। শুধু বলত, একটা ছেলে হলেই আমার হয়, আর কিছু চাই না। বল না একটু ওকে।

কথাটার মধ্যে অসভ্যতা আছে তা বোঝার মতো মনের অবস্থা বলাকার তখন হচ্ছিল। সে রাগ করত।

হৈম শেষ অবধি যে পন্থা নিয়েছিল তা পাগল না হলে নেওয়া যায় না। বলাকার বিয়ের এক বছরের মাথায় সে গর্ভবতী হয়ে পড়ল। সে যুগে গাঁয়ের চূড়ান্ত কেলেঙ্কারি। তবু এরকম ঘটনা ঘটতও অনেক। হৈম কার সঙ্গে মিশেছিল, কার কাছে নষ্ট করেছিল নিজেকে তা প্রকাশ পায়নি। ভোগী, লোভী পুরুষের অভাব তো নেই।

বলাকার বিয়ের দেড় বছরের মাথায় গর্ভপাত করাতে গিয়ে হৈম মারা যায়। অনেকে বলে, মাধবানন্দ রায়ই নাকি তাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছিল। রহস্যের মীমাংসা হয়নি।

কিন্তু এই ঘটনা থেকে গৌরহরির যে ছবিটা ভেসে ওঠে তা এক অমলিন পুরুষের ছবি। হৃদয় দৌর্বল্যকে সে প্রশ্রয় দেয় না। অধিকার সীমাবদ্ধ রাখে। চৌকাঠ ডিঙোয় না। বলাকার মতো আর কে তাকে জানবে?

বাবা এক অদ্ভুত মানুষ, না মা?

 হ্যাঁ মা, লোকটার থাই পেলাম না।

ছবির পর ছবি দেখে যাচ্ছে তারা। নির্জন দুপুর। বাইরে ঘুঘু ডাকছে।

হ্যাঁ রে, সময় বলে কি কিছু সত্যিই আছে?

পারুল অবাক হয়ে বলে, কেন থাকবে না মা? সময় তো একটা সত্যিকারের জিনিস।

কী জানি। আমার মনের মধ্যে সময় বলে কিছু যেন কাজ করে না। পুরনো কথা ভাবতে গেলে সব যেন সাঁই সাঁই করে কাছে চলে আসে। যেন মনে হয় এই তো সেদিনের কথা!

ও তো স্মৃতি মা।

জানি বাবা, জানি। কিন্তু সময় জিনিসটা তো মানুষের কল্পনা।

পারুল একটু ভেবে বলে, তা ঠিক। কল্পনা মানে তো মিথ্যে নয়।

মিথ্যেই।

 কেন বলছ?

মনে হয় বলে বলছি।

সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে, দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে, বছর ঘুরছে, আমরা বুড়ো হচ্ছি, এটাই তো সময়।

এমন কিছু নেই যেখানে সব থেমে আছে, বাড়ছে না, বুড়ো হচ্ছে না, ওই ছবিগুলোর মতো!

 পারুল হেসে ফেলে, ছবির তো প্রাণ নেই মা।

 কথার মাঝখানে কখন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে মেঝেতে বলাকার কাছ ঘেঁষে বসেছিল দুখুরি। চাপা গলায় বলল, ওই আবার এসেছে গো!

কে আবার এলি।

কে আবার! বাবা। আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।

তা গেলি না একটু বাবার কাছে?

ইস। গায়ে যা ঘেমো গন্ধ, তার ওপর খইনির ঝাঁঝ। মুখ ভেঙিয়ে পালিয়ে এসেছি।

ছিঃ, বাবাকে মুখ ভেঙাতে হয়?

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়