৬। অভিজিৎ

দাদুর সঙ্গে বসবাস করতে গেলে যে মনোভাব এবং চালচলনে অভ্যস্ত হতে হয় তা আমার সহজে হবে না। সন্ধের এবং বিশেষ করে রাতের দিকে একটু বইপত্র না পড়লে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু দাদুর ঘরে বাতির জোগাড় নেই। সরু অঙ্গুষ্টপ্রমাণ মোম সম্বল। তাতে না হয় আলো, না হয় তার আয়ু বেশিক্ষণ।

দাদুর কাণ্ড শুনে ফুলমাসি হেসে গড়াগড়ি খেলেন কিছুক্ষণ। তারপর তেল ভরে প্রায় নতুন একটা হারিকেন দিয়ে বললেন, এটা জ্বালিয়ে নিস। কাল যখন আসবি নিয়ে আসিস, আবার তেল ভরে চিমনি মুছে দেব।

দাদুর ঘরের অন্ধকারটা সেই হ্যারিকেনের দাপটে পিছু হটল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। একটা কাঁচের আলমারিবন্দি পুরনো কিছু বই আছে। প্রায় সবই পড়া। বঙ্কিম, শরৎ, রবীন্দ্রনাথ, বিকেল থেকে অনেকেই আছেন। আমি পুরনো প্রবাসীর একটা বাঁধানো খণ্ড নিয়ে বসে গেলাম।

দাদু বার দুই এসে হ্যারিকেনটা দেখলেন। তারপর থাকতে না পেরে বললেন, কে দিল? গণেশের বউ নাকি?

হ্যাঁ।

তেল পাচ্ছে কোথায়? মহিমের দোকানে এসেছে বুঝি?

কেন, আপনার লাগবে? গণেশকাকাকেবললেই এনে দেবে।

দাদু ঠোঁট উলটে বললেন, তেল দিয়ে কী করব? হ্যারিকেনই নেই। পুরনো দু-তিনটে যা-ও ছিল সব ভেঙে গেছে।

তা হলে তো কথাই নেই।

হ্যারিকেনটা তো বেশ মজবুত দেখছি। ব্রিটিশ আমলে জার্মান হ্যারিকেন পাওয়া যেত। হেঁচা জিনিস, বহুদিন চলত। এখনকার দিশিগুলো বড় হলকা পলক।

সে জিনিস আর কোথায় পানে?

আজকাল হ্যারিকেনের দাম কত হয়েছে বলো তো!

যেমন জিনিস তেমন দাম। তবে পনেরো-ষোলো টাকার নীচে বোধহয় পাওয়া যায় না।

 ও বাবা। এত? দিনে কালে হল কী?

সেই কথাই তো সবাই বলাবলি করে আজকাল।

 একটু আগে ধুপ করে একটা শব্দ হল শুনেছ?

না তো।

 হয়েছে। পুরনো পাকঘরের পিছনের গাছটা থেকে নারকোল পড়ল।

ও।

একবার যাও না। নিয়ে এসো।

এত রাতে।

 রাত কোথায়? হ্যারিকেনটা নিয়ে যাও। নইলে সকালে ফুলকুড়ুনিরা এসে নিয়ে যাবে। রোজ নিয়ে যায়।

যাক না। একটা নারকোল গেলে যাবে।

রোজ একটা দুটো করে গেলে বছরে কতলে যায় হিবে করেছ?

আমি বিরক্ত হয়ে বলি, বাইরে তো এখন একটু জল।

তোমাকে বলতাম না। আমি নিজে রাতবিরেতে চোখে দেখি না। পড়ে-উড়ে গেলে মুশকিল।

একটা টর্চ দিন।

 টর্চ কীসে লাগবে। হ্যারিকেনটা নিয়ে যাও।

গত দুদিনে দাদুকে আমি প্রায় চার বস্তা  নারকোল বিক্রি করতে দেখেছি। গড়পরতা এক একটার দর পাঁচ সিকে। চার বস্তায় কমকরেও শত খানেক নারকোল হবে। দাদুর আয় সে হিসেবে মন্দ নয়। তবু একটা টর্চ কিনবেন না। কিংবা হয়তো আছে, বের করবেন না।

অগত্যা হ্যারিকেনটা নিয়ে বেরোতে হল। একটু আগেই বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু আকাশ গোঁ গোঁ করছে। দাপটের সঙ্গে বইছে বাতাস। হ্যারিকেনের লাফাতে লাগল।

দাদু তার মোটা বেতের লাঠি এগিয়ে দিয়ে বললে, এটা সঙ্গে নিয়ে যাও। লতা-টতা অবশ্য এই দুর্যোগে বেরোয় না। তবে হেলে ঢোঁড়া আছে। সঙ্গে লাঠি রাখা ভাল।

দাদুর অনুমান যে নির্ভুল তাতে আমার সন্দেহ ছিল না। এই বাড়ির সঙ্গে দাদুর সমস্ত সত্তা এমন জড়িয়ে গেছে যে, ঘরে বসে থেকেও একটা অদৃশ্য অ্যানটেনা দিয়ে কোথায় কী ঘটছে তা টের পান।

পুরনো রান্নাঘরের পিছনে জঙ্গলের মধ্যে বাস্তবিকই নারকোলটা পাওয়া গেল। সেটা বগলদাবা করে ফেরার সময় আমার কিন্তু বিরক্তিটা রইল না। কেমন যেন একটা মায়া জন্মাল। নিজের বাড়ি, নিজের জমি, নিজেদের দখলি গাছপালা, এর একটা আলাদা ব্যাপার আছে। সব কিছুই পয়সা দিয়ে কিনতে হচ্ছে না, কলকাতায় আমরা এরকমটা ভাবতেই পারি না। সেখানে কান চুলকোনোর জন্যও পয়সা দিতে হয়।

ঘরে এসে দাদুর হাতে নারকোলটা দিতেই উনি নেড়ে দেখলেন, জলের শব্দ হচ্ছে কি না। তারপর চৌকির নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার চাকরির কী হল?

এখনও কিছু হয়নি।

হবে মনে হয়?

না হওয়ারই কথা। আর একজন লোকাল ক্যান্ডিডেট আছে।

 কে বলো তো!

 জহরবাবু নামে এক ভদ্রলোকের মেয়ে।

 জহর বাঁড়ুজ্জে নাকি?

হতে পারে। পদবিটা জানি না।

ইরিগেশনে এক জহর আছে জানি তার মেয়ে কি তোমার চেয়ে বেশি পাশ?

হ্যাঁ। বি এড।

 দাদু অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন, তা তুমি এতদিন ঘরে বসে কোন ভেরেন্ডা ভাজছিলে? বি এডটা পাশ করতে পারোনি?

তখন কি জানতাম যে মাস্টারি করব?

 তা বলে একটা মেয়ে তোমাকে লেখাপড়ায় ডিঙিয়ে বসে থাকবে, এ কেমন কথা?

ডিঙিয়ে বেশিদূর যায়নি। তবে একটা পাশ বেশি করেছে বটে।

তবে?

আপনি উতলা হচ্ছেন কেন? পারিজাতবাবু এখনও আমাকে না করেননি।

কী বলেছে?

 গণেশকাকা খোঁজ রাখছে। যা বলার ওঁকেই বলবে।

আবার ডেকে পাঠাবে বলছ?

 পাঠাতেও পারে।

চাকরি তোমার একটা হওয়া দরকার। যদি এখানে থাকতে পারো তো খুব ভাল।

দেখছি কী হয়।

 ঘরে বসে সময় না কাটিয়ে একটু পারিজাতের কাছে যাতায়াত করলেও তো পারো।

তদবির করতে বলছেন?

উপায় কী? তদবির বরাবরই করতে হত। এখনও হয়।

ওসব আমি ভাল পারি না।

পারতে হয়। তুমি এখানে থেকে চাকরি করলে শেষ বয়সে আমাকে আর বাস্তুভিটে বিক্রি করতে হয় না। তুমিই সব দেখেশুনে রাখতে পারবে।

চেষ্টা তো করছি।

 তুমি চেষ্টা করছ না। একে কি চেষ্টা বলে?

আমার হয়ে গণেশকাকা করছেন।

 গণেশটা এমনিতে ভাল লোক, কিন্তু কথায় বার্তায় পোক্ত নয়। ও কি পারবে? তুমি নিজেই কাল একবার যাও। রোজই যাও। ওতে ব্যাপারটা ভুল পড়বে না। তোমাকে দেখলে মনে পড়বে।

মেয়েটার বাবা খুব তেল দিচ্ছে।

দেবেই। চাকরির যা বাজার! তুমি কাল সকালেই যাও। একটা মেয়ের কাছে হেরে এসো না।

দাদু কথাটা ভুললেন না! ভোর না হতেই আমাকে ঠেলে তুলে দিলেন, ওঠো, ওঠো, বেলা হয়ে যাবে। এইবেলা বেরিয়ে পড়ো।

জ্বালাতন আর কাকে বলে। তবে উঠতেও হল।

পারিজাতবাবুকে গিয়ে আমি কী বলব তা আমার মাথায় এল না। অনিকভাবে ধীরে ধীরে চারদিক দেখতে দেখতে আমি সাইকেল চালাতে থাকি।

চারদিকে আজ অবশ্য জল ছাড়া প্রায় কিছুই দেখার নেই। সাইকেলের চাকা সিকিভাগ জলের তলায়।খানা-খন্দে পড়ে ঝাং ঝাং করে লাফিয়ে উঠছে। কোথাও ঋথকে আঠালো কাদায় পড়ে থেমে যাচ্ছে ঘচাৎ করে। আমার প্যান্টের নিম্নাংশ গুটিয়ে রাখা সত্ত্বেও কাদায় মাখামাখি হল। একজোড়া হাওয়াই চপ্পল ধার দিয়েছে ফুলমাসি। সেও কাদা থেকে টেনে তুলতে গিয়ে একটা স্ট্র্যাপ ফচাক করে খুলে গেল।

এসব আমার অভ্যাস নেই বটে, তা বলে খুব খারাপ লাগছে না। এই গাঁয়ে আমার জন্ম। জন্মভূমির প্রতি মানুষের এক দুরারোগ্য আকর্ষণ থাকবেই। তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ কারণ থাক বা না থাক। এই গাঁয়ের আরও একটা আকর্ষণ ফুলমাসি। আমার প্রতি তার মেহ যুক্তিসিদ্ধ নয়। আমি তার জামাই হতে পারতাম। কিন্তু হইনি। তবু আমার প্রতি তার এক দুর্জয় দুর্বলতা। কারণটা আমি কখনও খুঁজে দেখিনি। যাকগে, কিছু জিনিস না জানলেও চলে যায়। হয়তো না জানাই ভাল।

সকালে যখন সাইকেলটা চাইতে গেলাম তখন ফুলমাসি চা আর তার সঙ্গে রুটি বেগুনভাজা খাওয়ালেন। খেতে খেতে একসময়ে বলেই ফেললাম, খুব তো আদর দিয়ে মাথায় তুলছ। পরে বুঝবে।

কী বুঝব রে?

যদি চাকরি পাই তো পাকাপাকি আস্তানা গাড়তে হবে এখানে। তখন রোজ জ্বালাতন হয়ে বলবে, অভীটা গেলে বাঁচি।

তাই বুঝি! তুই তো হাত গুনতে জানিস।

আমি মাথা নেড়ে বলি, পাকাপাকিভাবে থাকলে দাম কমে যাবে।

মাসি ঝগড়ার গলায় বলল, সে যদি কমেই তা হলে বরং তোরকাছেই আমার দাম কমবে। তখন বন্ধু হবে, বান্ধব হবে, আড্ডা হবে, মাসি মরল কি বাঁচল কে তার খোঁজ করে। আর যদি বিয়ে করিস তবে তো আর কথাই নেই। বছর ঘুরলেও বাছা আর এমুখো হনে না।

এসব অবশ্য কথার কথা। সবকিছুই নির্ভর করছে একটা জিনিসের ওপর, চাকরিটা আমার হবে কি হবে না। জহরবাবু তার মেয়েকে ঢোকানোর জন্য যে পন্থা নিয়েছেন তা যদি সফল হয় তবে আমার হওয়ার চান্স নেই। কিন্তু পারিজাত লোকটিকে আমার বুদ্ধিমান বলেই মনে হয়েছে। লোকটা জহরবাবুর ফাঁদে পা দেবে বলে মনে হয় না। যদি প্রতিমা আর আমার মধ্যে ওপেন কমপিটিশন হয় তবে আমার চান্স কিছু বেশিই। প্রতিমা বি এড, কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারিতে আমার রেজাল্টটা একটু ভাল। চাকরিতে এই পরীক্ষাটার রেজাল্টই গুরুত্ব পায় বেশি।

বড় রাস্তায় উঠে দেখি, বহু লোকজন জড়ো হয়েছে। রাস্তার উল্টোদিকের মাঠেও বহু লোক। চাংড়াপোতার বাঁধের ওপর সারসার লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাতে লাঠি-সোটা। বেশ একটা উত্তেজনার ভাব চারদিকে।

একজন চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হে মোড়ল, গণ্ডগোল নাকি?

লোকটা আমায় চেনে। বলল, চাংড়াপোতার লোকেরা বাঁধ কেটে দিতে এয়েছিল। তাই সবাই বাঁধ পাহারা দিচ্ছে।

ইরিগেশনের খালের ওপাশে চাংড়াপোতা। জায়গাটা আমি চিনি। ওখানকার ঝিঙে খুব বিখ্যাত। বললাম, বাঁধ কাটতে চায় কেন? ওপাশে জল নাকি?

খুব জল। চাংড়াপোতায় শুধু বাড়িঘরের চালটুকু দেখা যাচ্ছে, আর সব জন্মে তলায়।

আমি একটু শিউরে উঠলাম। বাঁধ কেটে দিলে মউডুবি চোখের পলকে সাগরদিঘি হয়ে যাবে। ঘরে বুড়ো দাদু।

আমি দোকানিকে বললাম, মারদাঙ্গা লাগলে আমাকে খবর দিয়ে। আমিও জুটে যাবখন। পাহারা দিতে হলে তাও দেব।

লোকটা হেসে বলল, দরকার হবে না। আমরা তো আছি। সকলেরই জান কবুল।

লাশ টাশ পড়েছে নাকি?

 আজ্ঞে না।

আমি খানিকটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে রওনা হলাম। মনে মনে একটু হাসিও পাচ্ছে। আমরা কত না স্বার্থপর! চাংড়াপোতা ডুবুক, মউড়ুবি না ডুবলেই হয়। অন্যে মরছে মরুক, আমরা বেঁচে থাকলেই হয়। এই স্বার্থপরতাই এখন ভারতবর্ষের জীবন-বেদ। আমরা তার মধ্যেই লালিত-পালিত হয়েছি। আমাদের জ্যেষ্ঠরা এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের শেখাতে পারেননি।

অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। চাংড়াপোতা থেকে খাল পার হয়ে একটা ছেলে স্কুলে পড়তে আসত। তখনও চাংড়াপোতায় স্কুল হয়নি। সেই ছেলেটা ছিল বিশু। আমার খুব বন্ধু। একবার তার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর নেমন্তন্ন খেয়েছিলাম।

কে জানে বিশু এখনও বেঁচে আছে কি না। না থাকার কথা নয়। কিন্তু আজকাল আমার বয়সি ছেলেদেরও বেঁচে থাকা সম্পর্কে একটা সংশয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য বিশু বেঁচে থাকলেও যে চাংড়াপোতাতেই আছে এমন নয়। আবার থাকতেও তো পারে!

একবার ইচ্ছে হল, সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে চাংড়াপোঁতার দিকটা দেখে আসি। তারপর ভাবলাম, থাক। কী দরকার? কিছু ব্যাপার সম্পর্কে উদাসীন থাকাই ভাল।

আজ বৃষ্টি নেই। মেঘ-ভাঙা একটু রোদও উঠেছে। গাছপালা আর ভেজা মাটির গন্ধ ম ম করছে। আমি বুক ভরে দম নিলাম। পোটলা-পুঁটলি নিয়ে কিছু লোক গাছতলায় বসে গেছে। ইটের উনুনে রান্না চাপিয়েছে কেউ কেউ। কিছু লোক পায়ে হেঁটে চলেছে শহরের দিকে। বুঝতে অসুবিধে নেই, আশপাশের নিচু জায়গাগুলো জলে ডুবেছে।

ডুববেই। বহুকাল ধরে এ দেশের নদীগুলির কোনও বিজ্ঞানসম্মত সংস্কার হয়নি। অধিকাংশ নদীখাতই পলি পড়ে পড়ে অগম্ভীর হয়ে এসেছে। এক ঢল বর্ষার জলও বইতে পারে না। নিকাশি খাল সংখ্যায় অপ্রতুল। প্রতিবছর তাই কোচবিহার থেকে মেদিনীপুর অবধি প্রায় সব জেলাই ভাসে। বছরওয়ারি এই কন্যা সামাল দেওয়া কিছু শক্ত ছিল না। চাংড়াপোঁতার দিককার বাঁধ যদি যথেষ্ট শক্ত-পোক্ত হত তা হলে গ্রামটা ভেসে যেত না। আমি জানি, খরার সময় ওই সেচখাল শুকিয়ে খটখটে হয়ে যায়। আর ভারী বর্ষা হলে সেই খালই হয় বানভাসি।

সাইকেল নিয়ে আমি সারা শহর কয়েকবার টহল দিলাম। বলতে কি পারিজাতের বাড়ি হানা দিতে আমার একটু লজ্জা-লজ্জাই করছে।

গণেশকাকার দোকানে নামতেই গণেশকাকা বলেন, পারিজাতবাবুর বাড়ি হয়ে এলি?

না। এখনও যাইনি।

সর্বনাশ! উনি যে একটু আগে জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

আমি হেসে বললাম, তাড়া কীসের?

 গণেশকাকা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলেন, তাড়া নেই মানে! জহরবাবু পিছনে জোকের মতো লেগে আছে তা জানিস? কাল রাতেও গিয়েছিল পারিজাতবাবুর কাছে। আজ সকালে অসীম দিদিমণির দাদা গুণেন এসে বলে গেল। এই দেখ, জহরবাবুর ছাতা।

গণেশকাকা কাঁচের আলমারির তলা থেকে একটা বাঁশের উটওলা পুরনো ছাতা বের করে বিজয়গর্বে আমাকে দেখালেন।

কিন্তু জহরবাবুর ছাতা দেখেও আমি উত্তেজিত হলাম না। শুধু নিরুৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ওটা পেলেন কোথায়?

কাল পারিজাতবাবুর ওখানে গুণেনবাবুর সঙ্গে জহরবাবুর দেখা হয়েছিল কিনা। ভুল করে গুণেনবাবু জহরবাবুর ছাতাটা নিয়ে এসেছিল। আমাকে দিয়ে গেলেন ফেরত দেওয়ার জন্য।

আমি অসন্তুষ্ট হয়ে বলি, আপনি ফেরত দেবেন কেন? অন্যের ফাইফরমাশ খাটা কি আর কাজ?

গণেশকাকা অতি উদার একটু হাসলেন। বললেন, এটুকু করা কি আর ফাইফরমাশ খাটা রে? ফেরার সময় জহরবাবুর বাড়িতে ফেলে দিয়ে যাব, পথেই পড়বে। গুণেনবাবুর সময় ছিল না।

আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, বরং আমাকেই দিন। দিয়ে আসি।

 তুই দিবি? তা ভাল কথা।

 ছাতা ফেরত দেওয়াটা আমার ছুতো মাত্র। জহরবাবু বা তার মেয়ের সঙ্গে আমার আর একবার মুখোমুখি হওয়া দরকার। মেয়েটার চাকরি কতখানি দরকার তা আমি জানতে চাই। যদি বুঝি ওদের প্রয়োজন আমার চেয়েও বেশি তা হলে আমি চাকরিটা ছোঁব না।

গণেশকাকার নির্দেশমতো জহরবাবুর বাড়ি পৌঁছোতে আমার সময় লাগল সাইকেলে মিনিট দেড়েক। বাড়িটা খুবই পুরনো, জীর্ণ এবং হোট। বাগানের বেড়া ভেঙে পড়েছে বৃষ্টিতে। প্রকাণ্ড একটা গোরু চুকে ফুলগাছ খেয়ে নিচ্ছে আর প্রতিমা একটা ছাতা নিয়ে সেটাকে তাড়ানোর অক্ষম একটা চেষ্টা চালাচ্ছে। বাড়ির সামনে আমাকে নামতে দেখেই সভ য়ে ছাতাটা পিছনে লুকিয়ে ফেলে একদম স্ট্যাচু হয়ে গেল।

আমি বললাম, চিনতে পারছেন? আমি আপনার প্রতিপক্ষ।

প্রতিমা ভারী লজ্জা পেল। আটপৌরে পোশাকে তাকে আজ মন্দ লাগছেনা দেখতে। সাজগোজ বেশি না করলেই যে মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে এই সত্যটা মেয়েরা কখনওই বোঝে না।

প্রতিমা সামান্য একটু হেসে বলল, চিনব না কেন? আসুন।

আপনার বাবা বাড়ি আছেন?

না। বাবা অফিসে গেছেন।

আমি ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলি, এটা উনি কাল পারিজাতবাবুর বাড়িতে ফেলে এসেছেন। নিন।

প্রতিমা তার পিছনে লুকনো ছাতাটা বের করে চোখ কপালে তুলে বলে, ওমা! তাই আমি ভাবছি, বাবার ছাতায় আমি যে নামের আদ্যক্ষর সাদা সুতো দিয়ে তুলে দিয়েছিলাম সেটা কোথায় গেল।

আমার ছাতা বিনিময় করলাম। সেইসঙ্গে হৃদয় বিনিময়ও হয়ে গেল কি না বলতে পারব না। তবে এই সময়ে প্রকাণ্ড গোটা একটা কলাবতী ফুলের গাছ মুড়িয়ে মসস করে খাচ্ছিল। আমরা সেটা দেখেও দেখলাম না।

হাঁস যেমন গা থেকে জল ঝড়ে প্রতিমা তেমনি লজ্জাটা ঝেড়ে ফেলে খুব স্মার্ট হয়ে গেল। বলল, আসুন, গরিবের বাড়ি চা খেয়ে যান। কষ্ট করে এসেছেন।

প্রতিমারা বাস্তবিকই গরিব। ঘরের দেয়ালে বহুকাল কলি ফেরানো হয়নি। বর্ষায় নোনা ধরে গেছে। বাইরের ঘরে তিনটে টিংটিঙে বেতের চেয়ার আর একটা ছোট্ট চৌকি। দেয়ালে কিছু সূচিশিল্প, একটা নেতাজির ছবিওলা ক্যালেন্ডার আর গোবরের চাপড়ার ওপর তিনটে কড়ি লাগানোদরজা জানলা বড়ই নড়বড়ে। একটা জানলার পাল্লায় ছিটকিনি নেই, তার বদলে পাটের দড়ি লাগানো।

কারা বেশি গরিব, প্রতিমারা না আমরা, তা ভাবতে ভাবতেই প্রতিমা ভিতরবাড়ি থেকে এক পাক ঘুরে এসে আমার মুখোমুখি চৌকিতে বসল।

চাকরিটা আপনারই হবে! বলল সে।

কেন?

আমার তেমন ইচ্ছে নেই।

তাই বা কেন?

আমি পারিজাতবাবুর জীবনী-টীবনী লিখতে পারব না। বাবা ভীষণ বোকা। কেবলই আমাকে খোঁচাচ্ছে, পারিজাতবাবুর জীবনী লিখতে। বলুন তো, এসব করতে সম্মানে লাগে না?

আমি বললাম, জীবনী লেখার কথাটা আমিও সেদিন শুনেছি। ব্যাপারটা কী বলুন তো! এত লোক থাকতে হঠাৎ পারিজতাবাবুর জীবনী লেখার কী দরকার পড়ল?

আমারও তো সেই প্রশ্ন। বাবাকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু বাবা কেবল বলে, লোকটা অহংকারী। জীবনী লেখার কথা শুনলে খুশি হয়।

হয় নাকি?

তা কে জানে। আমি লোকটাকে ভাল চিনি না। তবে শুনেছি, পারিজাতবাবু ভাল লোক নন।

আমিও ওরকমই শুনেছি। তবে লোকটাকে আমার খুব খারাপ লাগেনি।

কিন্তু লোকটা খারাপই। ওর বউ আত্মহত্যা করেছিল জানেন?

তাই নাকি?

 বিষ খেয়ে। সবাই বলে ওটা খুন।

তদন্ত হয়নি?

 কে জানে! হলেও পারিজাতবাবুকে ধরা সহজ কাজ নয়।

 আপনি জানেন, খুন?

তা-ই তো সবাই বলে।

 যাঃ। ওসব গুজব। বুদ্ধিমান লোকেরা কখনও বউকে খুন করে না।

 তা হলে কী করে?

 ডিভোর্স করতে পারে। খামোক খুন করতে যাবে কেন?

বামোকা মোটেই নয়। ওর বউ অনেক গোপন খবর রাখত। সেগুলো ফাস করে দিতে চেয়েছিল বলেই একদিন বেচারার জলের গেলাসে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। মাঝরাতে ঘুমের চোখে সেই জল খেয়ে মেয়েটা মরে গেল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, গোপন খবরটা কী রাখত ওর বউ?

 পারিজাতবাবুর অনেকরকম বে-আইনি কারবার আছে তো। সেইসব।

আমি পা নাচিয়ে লঘু স্বরে বললাম, তা হলে আর পারিজাতের দোষ কী? গোপন খবর ফাঁস করতে চাওয়াই তো অন্যায়। আইন ওটাকে বলে ব্ল্যাকমেল।

প্রতিমা বড় বড় চোখে আমার দিকে চেয়ে বলে, আপনি ওকে সাপোর্ট করছেন?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ওকেও করছি না, ওর বউকেও করছি না। মনে হয় ব্যাপারটা হয়েছিল শঠে শাঠ্যং।

আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, পারিজাত খুন করতে পারে না এমন নয়। অতিশয় উচ্চাশাসম্পন্ন, অহংকারী ও যশপ্রতিষ্ঠালোভী লোকের পক্ষে কাজটা অসম্ভবও নয়। কিন্তু পারিজাতকে আমি যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় না যে, সে খুন-টুন করেছে। লোকটার ক্ষুরধার বুদ্ধি। এ যদি কখনও খুন করে তবে এমন সূক্ষ্ম পন্থায় করবে যাতে তার ওপর লোকের বিন্দুমাত্র সন্দেহ হবে না।

প্রতিমা অবশ্য তর্কের গলায় বলল, মোটেই শঠে শাঠ্যং নয়। পারিজাতবাবুর বউ ছিল দারুণ সুন্দরী আর খুব শিক্ষিতা।

আমি প্রতিমাকে একটু জ্বালাতন করার জন্যই বললাম, তাতে কী? সুন্দরীই তো গণ্ডগোল করে বেশি। হয়তো তার গোপন প্রেমিক ছিল।

মোটেই নয়।

খুনটা কি এখানে হয়েছিল?

না। কলকাতায়।

 তা হলে এত ডিটেলস জানলেন কী করে?

শুনেছি।

শোনা কথার ফিফটি পারসেন্ট বাদ দিতে হয়।

চা নিয়ে এলেন প্রতিমার মা। ভারী রোগা-ভোগা মানুষ। পরনে মলিন একখানা শাড়ি। প্রণাম করার সময় ওঁর পায়ে হাজা লক্ষ করলাম। লাজুক মানুষ। চা দিয়ে শুধু বললেন, তোমরা বসে গল্প করো। বলেই চলে গেলেন।

চায়ে চুমুক দিয়ে বুঝলাম, প্রতিমারা বাস্তবিকই গরিব। অত্যন্ত বাজে সস্তা চা-পাতায় তৈরি কাথটি আমি প্রতিমার সুশ্রী মুখখানা দেখতে দেখতে খেয়ে নিলাম। ওই অনুপানটুকু না থাকলে চা গলা দিয়ে নামত না।

পারিজাতের বউকে ছেড়ে প্রতিমা অন্য প্রসঙ্গ তুলল, আচ্ছা, হায়ার সেকেন্ডারিতে আপনি নাকি দারুণ রেজাল্ট করেছিলেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কে বলল?

সব জানি। চারটে লেটার। আপনি কি নকশাল ছিলেন?

ও বাবা! অনেক জানেন দেখছি!

জানিই তো। লোকে বলে আপনি ডেনজারাস ছেলে ছিলেন।

 আমি বললাম, ডেনজারাস জেনেও বাড়িতে ডেকে এনে চা খাওয়াচ্ছেন?

আপনাকে দেখে মোটেই ডেনজারাস মনে হয় না।

 তা হলে কী মনে হয়?

বললাম তো, ডেনজারাস মনে হয় না।

সেটা তো নেতিবাচক গুণ। অস্তিবাচক কিছু বলুন।

মোটে তো আলাপ হল। কদিন দেখি, তারপর বলব।

আমি একটু হতাশার গলায় বললাম, দেখবেন কী করে? আমি তো কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরে যাব।

কেন, ফিরে যাওয়ার কী হল? চাকরি তো পাচ্ছেনই।

চাকরিটা বরং আপনিই করুন। স্কুলের চাকরির সঙ্গে পারিজাতের জীবনী লেখার পার্টটাইম জব। ভালই হবে।

হঠাৎ প্রতিমার মুখখানা ফ্যাকাসে দেখাল। কথাটা বলা হয়তো ঠিক হয়নি। প্রতিমা কিছুক্ষণ মন দিয়ে নিজের হাতের পাতা দেখল। তারপর বলল, একটা মেয়ে বেকার থাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু একটা ছেলে বেকার থাকলে ভারী কষ্ট।

কথাটা শুনে মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভীষণ ভাল লেগে গেল। সুস্থির চিন্তা ও স্নিগ্ধ মন ছাড়া এরকম সিদ্ধান্তে আসা বড় সহজ নয়। বিশেষ করে তেমন মেয়ের পক্ষে, যে দরিদ্র পরিবারে মানুষ হয়েছে এবং সংসারের প্রয়োজনেই যার পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে চাকরিটা পাওয়া দরকার। আজকাল অনেক বড়লোকের বউ বা মেয়ে স্কুল, কলেজ, অফিসের নানা চাকরি দখল করে বসে আছে। তাদের অর্থকরী প্রয়োজন নেই। নিতান্ত সময় কাটানোবা গৃহ থেকে মুক্তিই তাদের উদ্দেশ্য। এরা যদি জায়গা ছেড়ে দিত তা হলে এই গরিব দেশের অনেকগুলো পরিবার বেঁচে যেত।

প্রতিমার এই কথায় ভিতরে ভিতরে একটা আবেগের চঞ্চলতা অনুভব করছিলাম। সেটার রাশ টেনে একটু উদাস গলায় বললাম, আপনার মতো করে তো সবাই ভাবে না।

প্রতিমা মাথা নিচু করে হাসিমুখে বলল, আমার এমনিতেও চাকরিটা হত না। আমার হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট ভাল নয়।

কিন্তু আপনি যে বি এড, নতুন আইনে বি এড ছাড়া নাকি কাউকে চাকরি দিচ্ছেই না।

 আপনাকে দেবে। শুনেছি আপনি অসীমাদির ক্যান্ডিডেট।

 আপনি অনেক কিছু শোনেন তো?

প্রতিমা সরল হাসিমুখে বলে, আমার চাকরির জন্য বাবা এত বেশি অ্যাংশাস যে, আপনার সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়েছেন। আজ ভোরবেলা কোথা থেকে ঘুরে এসে আমাকে বললেন, তোর হবে না রে। ওই ছেলেটা অসীমার ক্যান্ডিডেট।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, আপনি যা শোনেন তার ফিফটি পারসেন্ট বাদ দেবেন। আমি অসীমাদির ক্যান্ডিডেট নই। উনি আমাকে ভাল করে চেনেনও না। তবে একজন মিডলম্যান কিছু তদবির করেছিল। তাতে তেমন কিছু কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ অসীমাদি খুবই অন্যমনস্ক আর বিমর্ষ ছিলেন সেদিন। আমার হয়ে উনি খুব একটা লড়ালড়ি করবেন না। ওঁর বোধহয় মুড নেই।

লড়ালড়ি করতে হবে না। উনি একবার বললেই হবে। পারিজাতবাবুর কাছে অসীমাদির প্রেস্টিজই আলাদা।

আপনি তা হলে আমার কাছে হেরেই বসে আছেন!

হারতেই যখন হবে তখন আগে থেকে হার মেনে নেওয়াই ভাল।

আমি একটা বড় শ্বাস ফেলে বললাম, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম।

 কী আন্দাজ করেছিলেন?

আপনি একটু সেকেলে। এখনকার মেয়েরা চাকরির জন্য জান লড়িয়ে দেয়।

 জান লড়িয়েও আমার লাভ নেই। অসীমাদির ক্যান্ডিডেটের সঙ্গে পারব কেন!

আপনার বাবাও কি হাল ছেড়ে দিয়েছেন আপনার মতো?

এ কথায় প্রতিমা খুব লজ্জার হাসি হেসে বলল, বাবা একটু কীরকম যেন আছে। কে যেন বাবার মাথায় আইডিয়া দিয়েছে যে, চাকুরে মেয়েদের ভাল বর জুটে যায়।

আমি বললাম, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। বিবাহযোগ্য যুবকেরা এখন ওয়ার্কিং গার্লই প্রেফার করছে। এখনও ভেবে দেখুন লড়বেন কি না।

লড়ার ইচ্ছে থাকলে আর এতক্ষণ বসে আছি! বাবা বলে গেছে, আজ সকালে যেন পারিজাতবাবুর কাছে একবার যাই। উনি নাকি ডেকেছেন। কিন্তু আমি যাইনি।

গিয়ে কী হত?

তা কে জানে! পারিজাতবাবুর হয়তো কিছু জানার ছিল।

প্রতিমার জন্য আমার একটু দুশ্চিন্তা হতে লাগল। পারিজাতের বাড়িতে ওকে পাঠানোর পিছনে জহরবাবুর কোনও অদ্ভুত উদ্দেশ্য নেই তো! থাকলেও অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। প্রতিমা আমার কেউ নয়, জহরবাবুরই আত্মজা। ওর ভালমন্দ উনিই বুঝবেন। তবু মনটায় একটা খিচ থেকেই গেল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, পারিজাতের সঙ্গে অসীমা দিদিমণির বিয়ের কথা কি একদম পাকা?

ওমা! পাকা নয়তো কী? খুব অবাক হয়ে প্রতিমা বলে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, বিয়েটা যতক্ষণ না ঘটছে ততক্ষণ কিছুই বলা যায় না। হয়তো কোনও কারণে বিয়েটা ভেঙে গেল।

কী কারণ?

 ধরুন যদি সে কারণ আপনিই হন!

আমি?–প্রতিমা আকাশ থেকে পড়ে বলে, আমি কীসের কারণ? যা!

কথাটা হঠকারিতাবশে বলে ফেলে আমি একটু বিপদেই পড়লাম। প্রতিমা সিধে-সরল মানুষ। বোধহয় সহজেই ঘাবড়েও যায়। মুখখানা কাঁদো কাঁদো করে আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি সাহস করে বললাম, আপনিই বলেছিলেন পারিজাত ভাল লোক নয়, খুন করারও অভ্যাস আছে। ওর কাছে কোনও যুবতী এবং সুন্দরী মেয়ের কি একা যাওয়া ভাল?

প্রতিমার মুখের আহত ভাবটা রয়েই গেল। বলল, কিন্তু আপনি তো সে ইঙ্গিত করেননি। একটা খুব বাজে কথা বলেছেন। কেন বললেন?

আমি নির্বিকার মুখে বললাম, মনে হল, তাই বললাম।

 প্রতিমা অত্যন্ত অকপটে বলল, আপনি খুব খারাপ।

আমার চেয়েও খারাপ লোক আছে।

প্রতিমা আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। ওর চোখে টলটল করছে জল। তবু আমার মনে হচ্ছিল, কথাটা বলে আমি ওর উপকারই করেছি। সরল মেয়ে, হয়তো দুনিয়ার প্যাঁচ খেচ তেমন ভাল জানে না। যদি আমার কথায় সচেতন ও সতর্ক হয় তবে ভালই হবে।

কিছুক্ষণ বিমর্ষভাবে বাইরে চেয়ে থেকে হঠাৎ সে আমার দিকে তাকাল। বলল, আমার চাকরির আর দরকার নেই। তাই পারিজাতবাবুর কাছে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু পারিজাতবাবুর কাছে গেলেই যে মেয়েরা বিপদে পড়ে একথা আপনাকে কে বলল? ওঁর কাছে নানা কাজে কত মেয়ে যাচ্ছে।

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আহা, কথাটা অত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন?

কথাটা আপনি বললেন কেন তা হলে?

আর বলব না।

আপনি ভীষণ খারাপ। বলতে বলতে প্রতিমা উঠে দাঁড়াল এবং কোনও কথা না বলেই ভিতরবাড়িতে চলে গেল হঠাৎ।

কী আর করা! বেকুবের মতো মিনিটখানেক বসে থেকে আমি ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রতিমাকে একটা কথা বলে আসার সুযোগ হল না। নইলে আমি বলতাম, আমি খারাপ বটে, কিন্তু আপনি ভাল। বেশ ভাল। এরকম ভাল থাকারই চেষ্টা করবেন।

সিংহীবাড়িটা পেরোনোর সময় খোলা ফটক দিয়ে দূরে গাড়িবারান্দার কাছে একটা জিপগাড়ির মুখ দেখতে পেয়ে আমি ব্রেক কষি। পারিজাত হয়তো কোথাও গিয়েছিল, ফিরেছে। নয়তো কোথাও যাবে। আমি খুব কিছু চিন্তাভাবনা না করে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে খোলা ফটক দিয়ে ঢুকে পড়লাম।

ভিতরে ঢুকে দেখি, একটা নয়, দুটো জিপ এবং একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়িবারান্দার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটে গাড়িতেই ত্রিসিংহ মার্কা দেখলাম। অর্থাৎ সরকারি গাড়ি।

আজ সিঁড়ির মুখেই দারোয়ান। আমি সাইকেল গাড়িবারান্দার তলায় থামাতেই সে বলল, এখন দেখা হবে না। জরুরি মিটিং হচ্ছে।

বাইরের ঘরের দরজা আঁট করে বন্ধ। বেশ হাই লেভেলের গুরুতর সলাপরামর্শ হচ্ছে নিশ্চয়ই। আমি একটু উগ্র গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ভিতরে কে কে আছে?

দারোয়ানটা এমনিতে হয়তো আমাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু সেদিন সে বোধহয় সকালে আমাকে পারিজাতের সঙ্গে দৌড়োত দেখেছে। আমাদের ঘনিষ্ঠতা কতটা তা আন্দাজ করা তার পক্ষে মুশকিল। একটু ইতস্তত করে সে বলল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আর ফুড অফিসার। আরও কয়েকজন আছে।

আমি সাইকেলটা গাড়িবারান্দার ধারে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বললাম, ঠিক আছে, মিটিং শেষ হোক। আমি বাগানে অপেক্ষা করছি।

দারোয়ান কিছু বলল না।

সিংহীদের বাগান বরাবর আমাকে আকর্ষণ করত। আজও করে। পারিজাতকে ধন্যবাদ যে, বাগানটায় সে হাত দেয়নি। যেমন ছিল প্রায় তেমনই রেখে দিয়েছে। অলস পায়ে আমি বাগানটায় ঘুরতে লাগলাম। সিংহীরা ককর বালি আর কী কী সব মিশিয়ে বাগানের তলায় জলনিকাশি ব্যবস্থা করেছিল। এই ভারী বর্ষাতেও তাই বাগানে তেমন জল দাঁড়ায়নি। তবু চটিজোড়া ভিজে যাচ্ছিল। হাওয়াই চটি ভিজলেই পিছল হয়ে যায়। হাঁটতে অসুবিধে বোধ করে আমি একটা কুঞ্জবনে ঢুকে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। রোদটাও বড্ড চড়চড় করছে।

হাতের কাছে যে কুঞ্জবনটা পাওয়া গেল সেটায় ঢুকেই থমকে যাই। ভিতরের আবছায়ায় একটা মেয়ে বসে আছে। সেই মেয়েটিই, যে আমাকে সেদিন মোটেই আমল দেয়নি। কিন্তু মেয়েটি কেমন যেন গা ছেড়ে মাথা পিছনে হেলিয়ে বসে আছে। চোখদুটো বোজা। আমাকে টের পায়নি। কুঞ্জবনে ঢুকবার মুখটায় দাঁড়িয়ে আবছায়াতেই আমি মেয়েটিকে লক্ষ করি। সম্ভবত ত্রিশের কাছাকাছি বয়স। মুখে এক ধরনের লালসা ও নিষ্ঠুরতা আছে। স্বভাব যে উগ্রতা ওর মুখের হাঁটকাট দেখেই বোঝা যায়। এসব মেয়েরা শরীরকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটি সম্পর্কে পর পর কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিই। আমার একটুও ভয় করছিল না। কারণ ভয় জিনিসটা আমার সহজে হয় না। মেয়েদের সম্পর্কেও আমার অনাবশ্যক ও বাহুল্য কোনও স্পর্শকাতরতা বা সংকোচ নেই। কেউ আমাকে অপমান করতে পারে ভেবেও আমি অস্বস্তি বোধ করি না। এক কথা, আমি বিস্তর অপমান হজম করতে পারি। দ্বিতীয়ত, পালটা অপমান করতেও আমি পিছপা নই।

মেয়েটি তাকাল, কিন্তু চমকাল না। সম্ভবত খুব গভীরভাবে কিছু ভাবছিল। সেই ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে পুরোপুরি ফিরে আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল। তারপর আমাকে দেখল মেয়েটি এবং কিছুক্ষণ চেনার চেষ্টা করল। তারপর অত্যন্ত নিরুত্তাপ গলায় জিজ্ঞেস করল, এখানে কী চাই?

এই প্রশ্নটার জবাব তৈরি করার জন্য আমি অনেকটা সময় পেয়েছি। কিন্তু জবাবটা তৈরি হয়নি। সাদামাটা জবাব দিয়ে লাভও নেই। মেয়েটি কিছু অদ্ভুত। সাধারণ মেয়েরা এরকম পরিবেশে অচেনা কাউকে আচমকা দেখলে চমকায় এবং কে বলে চেঁচিয়ে ওঠে। এ মেয়েটা একটুও চমকায়নি বা কে বলে চেঁচায়নি। বরং অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করেছে এখানে কী চাই। এই প্রশ্নের মধ্যেই দুটো বক্তব্য রয়েছে। এক হল, এটা তোমার জায়গা নয়। দ্বিতীয় হল, এখানে এসে তুমি অন্যায় করেছ, কেটে পড়ো।

এসব অভদ্র মেয়ের কাছে বিনীত হওয়ার কোনও মানেই হয় না। আমি পালটি দেওয়ার জন্যই কুঞ্জবনটায় ঢুকে চারধারে খুব কৌতূহলের চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম, আরিব্বাস! দারুণ জায়গা তো! একেবারে কুঞ্জবন!

মেয়েটা নিশ্চয়ই এরকম ব্যবহার আশা করেনি। বড় বড় চোখ করে অপলকে আমাকে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, এটা বাইরের লোকেদের জন্য নয়। আপনি বারান্দার বেঞ্চে গিয়ে বসুন।

আমি বোকার মতো বললাম, কেন, এখানেও তো দিব্যি বেঞ্চ আছে। এখানে বসা যায় না!

 মেয়েটা যথেষ্ট রেগে যাচ্ছে। কিন্তু দুম করে কোনও বোমা ফাটল না। খুব হিসেবি চোখে আমাকে মাপজোক করল কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডা গলাতেই জিজ্ঞেস করল, আপনি কি পাগল? দেখছেন তো, আমি এখানে বসে আছি।

আমি বোকা ও সরল সেজে বললাম, আপনি কি এ বাড়ির লোক?

 হ্যাঁ। কেন? ভ্রূ কুঁচকে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

আমি ক্যাবলার মতো হেসে বললাম, ও, তাই বলুন। নইলে অত চোটপাট করবেনই বা কেন? আমি প্রথমটায় ভেবেছিলাম, আপনিও বুঝি আমার মতো কোনও কাজে এসেছেন পারিজাতবাবুর কাছে।

আমার বোকা ও সরল ভাবটা বোধহয় বিশ্বাস করল মেয়েটা। একটু ভিজলও মনে হয়। গলা এক পা নামিয়ে বলল, উনি আমার দাদা। আপনার ওপর কি আমি খুব চোটপাট করেছি?

আমি ক্যাবলা ভাবটা ধরে থেকেই ঘাড়-টাড় চুলকে বললাম, তাতে কিছু না। যেখানেই যাই সেখানেই লোকে ধমক চমক করে কথা বলে আজকাল। তাই অভ্যাস হয়ে গেছে।

আপনাকে সবাই ধমকায় বুঝি? মেয়েটা এই প্রথম ক্ষীণ একটু হাসে।

আমি হেঁ হেঁ করতে করতে বলি, আজকালকার যুগটাই পড়েছি অমনি। কারও মেজাজ ঠিক নেই।

মেয়েটা একটু সরে বসে পাশে অনেকটা জায়গা কঁকা করে দিয়ে বলল, বসুন।

আমি বসলাম।

আগের দিন মেয়েটির সিঁথিতে সিঁদুর দেখিনি। আজ বসবার সময় কাছাকাছি হতে আচমকা মনে হল, সিথিতে লালমতোকী যেন একটু দেখা গেল। সিঁদুরও হতে পারে, বা লিপস্টিক কিংবা কুমকুম জাতীয় কিছু যা আজকালকার বিবাহিতা মেয়েরা সিদুরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে ভালবাসে।

সরল এবং বোকা সাজার কতগুলো সুবিধে আছে। মেয়েটা যদি সত্যিই বিশ্বাস করে থাকে যে, আমি নিতান্তই হাবাগোবা গোছের, তা হলে আমি যতই অনভিপ্রেত প্রশ্ন করি না কেন, চটবে না।

আমি বসে একটা ক্লান্তির শ্বাস ফেলে বললাম, আপনি কি এ বাড়িতেই থাকেন?

হ্যাঁ।

আপনার বিয়ে হয়নি?

 মেয়েটা শব্দ করে হাসল। তারপর বলল, নে, হাতে পাত্র আছে নাকি?

আমি নিশ্চিন্ত হলাম। মেয়েটা চটছে না। বোকা বলেই ধরে নিয়েছে। অপ্রতিভ ভাব করে বললাম, আজ্ঞে না। কত বড় মানুষ আপনারা। বড় বড় সব পাত্র আসবে আপনাদের জন্য।

মেয়েটা চুপ করে কুঞ্জবনের আবছায়ায় আমাকে একটু দেখল। তারপর বলল, আপনাকে দেখে তো খুব বোকা মনে হয় না!

আমি জিব কেটে বললাম, কী যে বলেন! গায়ের লোক, বোকা ছাড়া আর কী?

 আপনার কোন গাঁ?

মউডুবি আজ্ঞে। বেশি দূর নয়।-বলেই মনে মনে ভাবলাম, অতি অভিনয় হয়ে যাচ্ছে না তো! এত আজ্ঞে আজ্ঞে করে যারা কথা বলে তারা আমার মতো পোশাক পরে না।

দাদার কাছে আনার কীসের কাজ?

আমি মাস্টারির কথাটা চেপে গেলাম। কারণ সেটা বললে আবার লেখাপড়ার কথাটাও উঠে পড়বে। বললাম, এই ছোটখাটো যা হোক একটা কিছু কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছি। পারিজাতবাবুর তো মেলা জানানো।

গাঁয়ের ছেলে, চাষবাস করেন না কেন?

জমিই নেই।

কী হল?

বিক্রিবাটা, জবর দখল এসব নানারকম হয়ে বেহাত হয়ে গেছে।

চলে কী করে?

চলছে না বলেই তো হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছি।

লেখাপড়া কতদূর?

 ওই স্কুলটা কোনওরকম ডিঙিয়েছিলাম।

বয়স তো বেশি নয়। পড়লেই তো পারেন।

 আর পড়ে কী হবে? শুধু পয়সা খরচ। পড়ে কাজও পাওয়া যায় না।

মেয়েটা আলস্যের বশে একটা হাই তুলে বলল, বেশি লেখাপড়া অবশ্য আমিও পছন্দ করি না। তবে গ্র্যাজুয়েটটা হলে চাকরির অনেক সুযোগ আসে।

আমি হেসে বললাম, গ্র্যাজুয়েট হতে একটু এলেম লাগে।

আপনার সেটা নেই?

না। আমার মাথাটা চিরকালই একটু মোটা।

মেয়েটা খুশিয়াল একটা খিকখিক হাসি হেসে বলল, আমারও তো মাথা মোটা। লেখাপড়া আমারও বেশিদূর হয়নি।

আমি উদাস গলায় বললাম, আপনাদের তো দরকার করে না। টাকা আছে।

মেয়েটা বড় বড় চোখে অবাক ভাব ফুটিয়ে বলে, কে বলল দরকার করে না? লেখাপড়া না শিখলে ভাল বর জোটে না তা জানেন?

আমি নিশ্চিন্তির গলায় বললাম, আপনার মতো সুন্দর মেয়েদের আবার বরের ভাবনা!

ও বাব্বা! কমপ্লিমেন্ট দিতেও জানেন দেখছি! খুব বোকা তো নন।

ঠিক বোকা নয়, তবে গেঁয়ো বটি। রাগ করলেন না তো!

ওমা! প্রশংসার কথায় রাগ করব কেন?

আমি উদাস গলায় বলি, আজকাল ভাল কথাতেও অনেক মেয়ে চটে যায়। গেলবার শীতকালে একবার বাসে বাসেরগঞ্জে যাচ্ছিলাম। একটা সুন্দরমতো মেয়ে দেখি হাতকাটা ব্লাউজ পরে জানলার ধারে বসা। বেশ ঠান্ডা হাওয়াও মারছিল সেদিন। অনেকক্ষণ দেখে থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, দিদি, আপনার শীত করছে না? ও বাবা, এমন রেগে গেল এই মারে কি সেই মারে!

বানিয়ে বলা। মেয়েটা তবু ক্ষীণ একটু হাসল। বলল, ছেলেদেরও অনেক দোষ আছে। মেয়েদের চোখে পড়ার জন্য তারা অনেক বোকা-বোকা কাণ্ড করে।

ইঙ্গিতটা আমার প্রতিই কি না তা বুঝতে না পেরে আমি সরলভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, আজ্ঞে, কথাটা আমাকে মনে করেই বলছেন না তো!

মেয়েটা আমাকে একবার তেরছা চোখে দেখে নিয়ে বলে, আপনি একটু গায়ে পড়া বটে, কিন্তু এখনও তেমন কিছু কাণ্ড করেননি। আমি আর একটা ছেলের কথা জানি। প্রফেসর। লেখাপড়া নিয়ে দিব্যি ছিল। হঠাৎ একটা মেয়েকে খুশি করতে ব্যায়াম শুরু করল। তাতে তার গায়ে ইয়া ইয়া গুলি ফুটে উঠল বটে, কিন্তু মাথাটা গেল মোটা হয়ে। মেয়েটাও পালোয়ান প্রফেসরকে তেমন পছন্দ করতে পারছিল না। তারপর সে কী করল জানেন? গান আর নাচ শিখতে লাগল।

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, বলেন কী? একটা মেয়ের জন্য এত মেহনত? লোকটা মাইরি আমার চেয়েও বোকা আছে। কে বলুন তো?

মেয়েটা মাথা নেড়ে মুখ টিপে হেসে বললে, সব ছেলেই ওইরকম। কিছু কম আর বেশি।

 আমি বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বললাম, আমার অত মেহনত কিছুতেই পোষাত না।

মেয়েটা একটু উষ্মার সঙ্গে বলল, কেন? মেয়েরা কি ফেলনা যে তাদের খুশি করার জন্য কিছু করতে নেই পুরুষদের!

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ঠিক তা বলিনি। তবে যার কথা বললেন সে আদত পুরুষই তো নয়। একটা মেয়ে ডুগডুগি বাজাচ্ছে, আর লোকটা বাঁদরের মতো নেচে যাচ্ছে।

মেয়েটা এবার আর একটু রেগে গেল যেন। ঝামরে উঠে বলল, বেশ করছেনাচছে। ভালবাসার জন্য সবকিছু করা যায়।

আমি বললাম, এই যে বললেন বোকা-বোকা কাণ্ড!

মেয়েটা তেজের সঙ্গে বলে, মোটেই বোকা-বোকা কাণ্ড নয়। লোকটা সত্যিকারের পুরুষ বলেই পেরেছে। সে অলস নয়, অকর্মা নয়, অক্ষম নয়। একজন মেয়ের প্রেমে তার সুপ্ত সব প্রতিভা জেগে উঠেছে।

এবার আমি হাঁ করে রইলাম। গোলমালটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। আবছা মনে হচ্ছিল, সেই বোকা লোকটার নায়িকা বোধহয় এ মেয়েটা নিজেই। তাই চট করে স্ট্র্যাটেজি পালটে নিয়ে বললাম, অবশ্য আপনার মতো একজন মেয়ের জন্য অনেক কিছু করা যায়। ব্যায়াম, নাচ, গান, সব কিছু

মেয়েটা আমার কথা শুনল বলে মনে হয় না। কেমন কুটিকুটিল এবং চিন্তান্বিত মুখে সামনের দিকে চেয়ে আছে। বেশ কিছুটা সময় চেয়ে থেকে বলে, কিন্তু মুশকিল হয়েছে, কিছু পেতন আর শাঁকচুন্নি সেই ছেলেটার পিছনে লেগেছে। কেন যে মেয়েগুলো এমন হ্যাংলা।

বলেই মেয়েটা একটু সচকিতভাবে আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে কথাটা চাপা দেওয়ার জন্য বলল, কিছু মেয়ে এরকম থাকেই। তাই না? তবে জেনারেলি ছেলেরাই হ্যাংলামো বেশি করে। পেতনি আর শাকচুনিগুলোকে কী করা যায় বলুন তো!

আমি একগাল হেসে বললাম, ঝাটাপেটা করুন। কষে ঝাটা মারুন।

 মেয়েটা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে চেয়ে বলল, তাই মারব। খবর পেয়েছি গন্ধর্ব এক দঙ্গল মেয়ের সঙ্গে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছে। যাওয়াচ্ছি! এমন কুরুক্ষেত্র করব এবার।

বলতে বলতে মেয়েটা আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এক ঝটকায় উঠে ঝম করে চলে গেল।

আমি বসে বসে কিছুক্ষণ আমার বিদীর্ণ মস্তিষ্কের টুকরোগুলো জোড়া দিলাম। একটা ছক বা পড়ল। খুব একটা জটিল ছক নয়।

বসে আছি, হঠাৎ দারোয়ান এসে এত্তেলা দিল, বাবু ডাকছেন।

আমি একটু অবাক হলাম। বাবু অর্থাৎ পারিজাতের আমাকে ডাকার কথাই নয়। কারণ, আমি যে এসেছি তা সে জানে না। উপরন্তু আমি উমেদার। আমাকে এড়ানোর চেষ্টাই তার পক্ষে স্বাভাবিক।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে পড়লাম।

পারিজাত বাইরের ঘরে বসে আছে। আমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে বলে ওঠে, আরে তুমি!

আমিও আকাশ থেকে পড়ে বললাম, কেন, আপনিই তো দারোয়ান দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠালেন!

পারিজাত হেসে ফেলল। বলল, তুমিই এতক্ষণ কমার সঙ্গে কুঞ্জবনে বসে ছিলে? কী আশ্চর্য!

এতে অবাক হওয়ার কী আছে?

পারিজাত আমার দিকে নতুন এক আবিষ্কারকের চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি তো দেখছি মেয়েদের পটাতে ওস্তাদ। রুমা আমাকে কী বলে গেল জানো?

না। কী করে জানব?

 বলে গেল, কুঞ্জবনে একটা ছেলে বসে আছে। ভারী ভাল ছেলে। একটু বোকা, কিন্তু খুব সরল। ও যে কাজের জন্য এসেছে সেটা যেন ওর হয়।

আমি বললাম, তাই নাকি?

 শুধু তাই নয়। এইমাত্র জহরবাবুর ছোট ছেলে প্রতিমার একটা চিরকুট দিয়ে গেল। পড়বে সেটা? পড়ো।–বলে পারিজাত একটা রুলটানা এক্সারসাইজ বুকের ভাঁজ করা পাতা আমার দিকে এগিয়ে দেয়।

আমি চিঠিটা খুলি। প্রতিমার হাতের লেখা ভালই। লিখেছে, পারিজাতবাবু, আমার চাকরির দরকার নেই। দয়া করে চাকরিটা অভিজিৎবাবুকেই দেবেন। উনি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আমার বাবা হয়তো ব্যাপারটা সহজে বুঝতে চাইবেন না। আমাদের তো অভাবের সংসার। তবু আমার মনের ইচ্ছেটা আপনাকে অসংকোচে জানালাম।

প্রণাম জানবেন। প্রতিমা।

পারিজাত আমার মুখের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিল। চিঠি পড়া শেষ হতেই একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তিন-তিনটে জোরালো রেকমেনডেশন। অসীমা, রুমা, প্রতিমা। মেয়েদের সাইকোলজি তুমি বোধহয় খুব ভাল বোঝে।

আমি একটু লজ্জা পেলাম। বাস্তবিক গোটা ব্যাপারটা যে এইভাবে আমার অনুকূলে এসে যাবে তা আমি আশা করিনি। আমি মিনমিন করে বললাম, কিন্তু এতে আমার কোনও হাত নেই।

পারিজাত অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? যারা রেকমেন্ড করেছে তারা কারা জানো? একজন আমার ভাবী স্ত্রী, একজন আমার মায়ের পেটের বোন এবং তৃতীয় জন তোমার সবচেয়ে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী। এই তিনজন মহিলাকে হাত করা খুব সহজ ব্যাপার তো নয়।

আমি কোনও জবাব খুঁজে পেলাম না। শুধু হাসলাম।

পারিজাত বলে, রুমা তোমার সম্পর্কে যে সার্টিফিকেট দিয়ে গেল সেটাও অদ্ভুত। তুমি নাকি খুব বোকা এবং সরল। ওকে এই টুপিটা কী করে পরালে? তোমাকে দেখে তো বোকা বা সরল কিছুই মনে হয় না।

উনি নিজে ভাল বলেই বোধহয় আমাকে ভাল বলেছেন।

রুমা ভাল? এই প্রশ্ন করে পারিজাত ওপরে তুলে আমাকে নিরীক্ষণ করে বলে, ওরকম গেছো মেয়ে খুব কম আছে। নিজের পছন্দ করা বরকে দু’দুবার ডিভোর্স করেছে, তা জানো?

না। অতটা জানি না। তবে উনি গন্ধর্ব নামে কে একজন অধ্যাপকের কথা বলছিলেন।

 সেই গন্ধর্বই। বেচারা হয়রান হয়ে গেল মেয়েটার জন্য। গন্ধর্ব সম্পর্কে কী বলছিল তোমাকে?

 কয়েকজন পেতনি আর শাকচুন্নি নাকি গন্ধর্বর পিছনে লেগেছে। উনি খুব জেলাসি ফিল করছেন।

করছে?–পারিজাতের মুখ উজ্জ্বল হল, যাক বাবা। ইট ইজ এ ড্যাম গুড নিউজ। কোনও প্ল্যান করছে বলে বলল নাকি?

না। উনি আমার সাজেশন চাইছিলেন। আমি সাজেস্ট করেছি পেতনি আর শাঁকচুন্নিদের ঝাটা মেরে তাড়াতে।

বুব হাসল পারিজাত। হোঃ হোঃ করে হাসল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, তাই বোধহয় ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ভাবগতিক দেখেই বুঝতে পেরেছি একটা কিছু ঘটিয়ে আসবে। যাক, বাঁচা গেল। তা তুমি এখনও এই মাস্টারির চাকরিটা চাও?

আমি অবাক হয়ে বলি, চাইব না কেন?

 পারিজাত মাথা নেড়ে বলে, তোমার যা প্রতিভা তা এই সামান্য চাকরিতে নষ্ট করবে কেন? ইচ্ছে করলে নিজের যোগ্যতায় অনেক ওপরে উঠে যেতে পারবে। এমনকী, আমার তো মনে হচ্ছে, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হওয়াও তোমার পক্ষে অসম্ভব নয়।

আমি নির্লিপ্ত গলায় বলি, আগে তো মাস্টারিটাই হোক।

হোক মানে! এরপরও না হলে আমাকে কেউ আস্ত রাখবে নাকি! কিন্তু ভাই, আমার ওপর এই ক্রিমুখী আক্রমণ চালানোর কোনও দরকার ছিল না। তিন-তিনটে ভাইটাল রেকমেনডেশন কি সোজা কথা!

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়