নিজেকে লুকিয়ে রাখার কোনও চেষ্টাই করল না শ্যাম। খোলা রাস্তায় রোদের মধ্যে সে দাঁড়াল থামে ঠেস দিয়ে। অদুরে কাচের শার্শি লাগানো দরজাটা। চোখ থেকে রোদ-চশমা খুলে নিল শ্যাম। প্রথমে ভাল দেখা গেল না, বেলা তিনটের খর রোদ চোখ ধাঁধিয়ে দিল। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করল সে। তারপর ছায়ামূর্তির মতো আবছা লীলাকে দেখা গেল মদরঙের কাউন্টারের ওপাশে। প্রথমে চেনা গেল না লীলাকে। তার মুখ-চোখ ঝাপসা দেখা যাচ্ছিল, লীলার পিছনের দেয়ালে একটা ফ্লুরেসেন্ট আলো জ্বলছে। তারপর ক্রমে ক্রমে দেখা গেল সেই দুটি সুরে বাঁধা হাত, স্বয়ংক্রিয়, কাজ করে যাচ্ছে। কপাল থেকে চুর্ণ চুল সরিয়ে দিচ্ছে লীলা, ডান হাতে তুলে নিচ্ছে পেনসিল, বাঁ হাতে টেলিফোন, রিসিভার কানে চেপে কাত হয়ে শুনছে কিংবা একটু ক্লান্ত দীর্ঘ মিষ্টি স্বরে বলছে ‘হেঃ…ল্লো…’ দুটি চোখে সামান্য ঘুম-পাওয়া ভাব। – তুলে কথা বলছে তার নানা অতিথির সঙ্গে, হেসে ঠাট্টার উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। তবু কিছুতেই তাকে এই পৃথিবীতে ব্যবহৃত মেয়ে বলে মনে হয় না শ্যামের, মনে হয় না যে, সে খাওয়া-পরার জন্য, উন্নতির জন্য, সঞ্চয়ের জন্য কাজ করছে। মনে হয় না একটি নাম কিংবা পরিচয়ে বাঁধা আছে সে।

শ্যাম সরল একটা গাছের মতো সামান্য একটু পিছনে হেলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মুখে মৃদু হাসি। তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ছায়ার মতো অলীক লোজন—যাদের কোনও অস্তিত্ব নেই, যেন ব্র্যাকেটে। ঝোলানো জামাকাপড়। চারদিকের কোনও শব্দও পায় না শ্যাম—যেন সে এক নিঝুম ঠান্ডা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের কাচের দরজাটা ঠেলে লোকজন আসছে যাচ্ছে, কিন্তু কারও মুখই ভাল করে দেখে না শ্যাম। দুটি ভিখিরি ঘ্যান ঘ্যান করল শ্যামের সামনে, তারা মেয়ে না পুরুষ তাও দেখল না শ্যাম, পকেট থেকে পয়সা তুলে দিয়ে দিল, কী দিল বা কত তা খেয়াল করল না। একবারও ঘড়ি দেখল না শ্যাম, কটা বাজে—এ-প্রশ্ন তার কাছে অপার্থিব মনে হল। সে শুধু টের পাচ্ছিল যে, শুধু দু পায়ের জোরে সে এখানে দাঁড়িয়ে নেই, আর তার ভিতরে জন্ম নেওয়ার আগে শিশুর মতো কোনও বোধ কেঁপে উঠছে। এভির চাদরের তলায় তার সমস্ত শরীর শক্ত, লোহার মতো কঠিন হয়ে আছে সমস্ত পেশি, মাঝে মাঝে তার চোয়ালের হাড় টিবির মতো ফুলে উঠছে। আর ক্রমান্বয়ে বুকের ভিতরে নিঃশব্দে ঘটে যাচ্ছে অদৃশ্য বৃষ্টিপাত, আর হরিণ দৌড়ে যাওয়ার শব্দ। সে টের পায় সে বড় বেঁচে আছে।

লীলা কাজ করে যাচ্ছে। কেবলই কাজ করে যাচ্ছে। নড়ে যাচ্ছে তার দুটি কাজের হাত, তার ঠোঁট কেবলই কথা বলে যাচ্ছে। কোনও কথাই বুঝতে পারেনা শ্যাম, তবু যেন বুঝতে পারে। হ্যাঁ, আমি জানি তুমি কী বলছ। তুমি দূর-দূরান্তের লোককে বলতে চাইছ—দেখো, আমি কত বেঁচে আছি। দেখো, আমার এখনও বয়স হয়নি। আমার কাছে এখনও বড় রহস্যময় এই জীবন। আমি ভালবাসতে শিখেছি…!

মাঝে মাঝে তার সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক চোখ রাস্তার ওপর দিয়ে ঘুরে যাচ্ছিল। হয়তো সে এক পলক দেখে নিল একটা লোকের কালো কোট, একটা গাছের একটু পাতা, দুই-একটি কাক, একটা দেয়ালে সাঁটা মিছিলের আহ্বান।

শ্যাম অপেক্ষা করে রইল। এই ভিড়ের রাস্তায়, এত কিছুর মধ্যে তুমি আমার দিকে একবারও লক্ষ করবে কি!

শ্যাম টের পাচ্ছিল, আস্তে আস্তে আলো মরে আসছে। অন্ধকার হয়ে গেলে লীলা আর তাকে দেখতে পাবে না, কিন্তু তখন উজ্জ্বল ঘরের মধ্যে লীলাকে আরও স্পষ্ট দেখা যাবে। শ্যাম মুখে মৃদু হাসি আর ঋজু শক্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়েই রইল। হয়তো কিছুই ঘটবে না। হয়তো বিস্ফোরণের মতো কিছু ঘটবে। শ্যাম জানে না।

লীলার মুখ আড়াল করে একটি লোক কাউন্টারে ঝুঁকে দাঁড়াল একটুক্ষণ। সরে গেল। লম্বা একটা লোক শ্যামের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল, কয়েক পলক আবার আড়ালে পড়ল লীলার মুখ। বিরক্তিতে আট ফুট লম্বা হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল শ্যামের। সেই ইচ্ছে টের পেয়েই বোধহয় লোকটা তাড়াতাড়ি হেঁটে গেল। সামান্য চমকে উঠল শ্যামমিনু না? পরমুহূর্তেই লোকটাকে ভুলে গিয়ে লীলার ওপর চোখ রাখল। লীলার চারদিকে ক্রমে আলোর উজ্জ্বলতা বাড়ছে, নিঃশব্দে শ্যামের চারদিকে নেমে আসছে অন্ধকার।

আর-একটু হলেই অন্ধকার সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিত শ্যামকে। এ সময়ে লীলা নোট টুকে রাখতে গিয়ে বাধা পেয়ে বাঁ হাতে টেলিফোন নিয়ে মুখ তুলতেই তার চোখ শ্যামের ওপর আটকে গেল। পলকে পাথর হয়ে গেল লীলা, মুখ সামান্য ফাঁক করে সে চেয়ে রইল, চিৎকার করে ওঠার আগের মতো ভয়ে তার ডান হাত উঠে এল মুখের কাছে, যেন সে এক্ষুনি লোক জড়ো করে ফেলবে। কয়েকটি ভয়ংকর মুহূর্ত ধরে সে শ্যামের ছায়ার মতো মূর্তির দিকে চেয়ে রইল। তারপর শ্লথ হয়ে নেমে গেল তার হাত, কাউন্টারের ওপর সেই হলুদ পেনসিল চেপে ধরল প্রাণপণে, চোখ বুজে সে দাঁতে দাঁত চেপে টেলিফোনে কথা বলে গেল।

একটুও নড়ল না শ্যাম। সে মৃদু হাসল। শরীরের ভিতরে চালু কারখানার শব্দ। সে বড় বেঁচে আছে। বুকে হাত রাখে শ্যাম। একটি রহস্যময় রেলগাড়ি বহু দূরের এক অচেনা পুল পেরিয়ে যাচ্ছে।

লীলার হাতে আর সাবলীলতা ছিল না। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে টেলিফোন রেখে দিল, ঝুঁকে পড়ল কাউন্টারের ওপর। জোর করে নামিয়ে রাখা মুখ, ঘাড়ের তেজি বাঁকের ওপর অহংকার আর অবহেলা ফুটে আছে। শ্যাম লক্ষ করল। তার দুঃখ হচ্ছিল যে, সে আজও নিজেকে সাজায়নি। সাজলে আজ লীলা তাকে চিনতই না। গালে রুক্ষ দাড়ি, গায়ে এন্ডির চাদর, ধুতি আর স্যান্ডেল পরা এই চেহারা তার। নিয়তির মতো, লীলার কাছে তাকে এভাবেই আসতে হবে, শ্যাম জানো নইলে লীলা তাকে আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলবে, পেনসিল চেপে ধরবে না প্রাণপণে, চোখ বুজে ফেলবে না, নামিয়ে নেবে না মুখ, শ্যাম জানে।

আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেল লীলার ভঙ্গি। কিন্তু তার অলস ভাব রইল না, সে আর হাসল না এবং আর একবারও তাকাল না শ্যামের দিকে। সে শুধু মাঝে মাঝে আড়চোখে দরজাটা দেখে নিচ্ছিল বোধহয় এই ভয়ে যে, শ্যাম যে-কোনও সময়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়তে পারে।

শ্যাম মৃদু হাসে। দাঁড়িয়েই থাকে। মাঝে মাঝে শুধু শরীরের ভর এ পা থেকে ও পায়ে সরিয়ে নেয়।

অন্ধকার হয়ে এল। শ্যামের মাথার উপর টুক করে জ্বলে উঠল রাস্তার আলো। শ্যামের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বেঁটে লোক, সে একটা দামি চোরাই কলম, কিনবে কি না তা বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল। শ্যাম মাথা নাড়ল। না। বস্তুত কলম শব্দটাই সে ধরতে পারল না।

ক্রমশ সে বুঝতে পারছিল তার চার ধারে লোকজনের ভিড় বেড়ে যাচ্ছে, অফিস-ছুটির ভিড়। এবার অনেকেই তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হবে। কে জানে এদের মধ্যে সেদিন বৃষ্টির বিকেলের দু-একজন লোক আছে কি না, যারা তাকে আর লীলাকে চিনতে পারবে। মৃদু হাসল শ্যাম। তবু দাঁড়িয়েই রইল।

সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, আস্তে আস্তে হাতের কাজ শেষ করে ফেলল লীলা। গুছিয়ে রাখল তার কাগজ। তারপর চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। দ্বিধা। এবার সে বেরিয়ে আসবে। সে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ ঝলমল করে উঠল তার হলুদ শাড়ি, শাড়ির সবুজ পাড়, সবুজ ব্লাউজ, উঁচু চেয়ার থেকে নামতেই তাকে ছোটখাটো দেখাচ্ছিল। সে ক্লান্ত ভঙ্গিতে কপালের চুল সরিয়ে কাউন্টারের ভিতর থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। তারপর আর তাকে দেখা গেল না।

কিছুক্ষণ পরে কাচের দরজা ঠেলে ছায়ামূর্তির মতো বেরিয়ে এল রাস্তায়। শ্যাম দেখল তার সঙ্গে খাকি পোশাক পরা পিয়ন গাছের একজন লোক রয়েছে। সতর্কতা। লোকটা লীলার পাশাপাশি হেঁটে গেল। পিছু নিল শ্যাম। একটু দূরে থেকে দেখল বড় দ্রুত হাঁটছে তারা। লোকটাই একটা ট্যাক্সির সামনে দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সিটাকে দাড় করাল। একবারও ফিরে তাকাল না লীলা। চকিতে ট্যাক্সির ভিতরের অন্ধকারে ঢুকে গেল। এত দ্রুত ঘটল এসব ঘটনা যে, শ্যাম তার ঘোর কাটিয়ে উঠতে না-পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে দেখল। দাঁড়িয়েই রইল। মুখে সেই মৃদু হাসি, সমস্ত শরীরে শক্ত ঋজুভাব।

.

রাতে খাওয়ার সময় আবার মুখোমুখি মিত্রর সঙ্গে দেখা। বলল, অটোমেশন এসে যাচ্ছে মশাই। আমাদের অপশন দিচ্ছে, সময়ের আগেই অবসর নিয়ে নিন, কোম্পানি কমপেনসেশন দেবে মোটা টাকার। তা ভাবছি এবার বসেই পড়ি মশাই, এত খাটাখাটনি যে কার জন্য তা বুঝতেই পারি না।

শ্যাম অন্যমনস্কভাবে হাসে।

পনেরো বছরের ওপর চাকরি হয়ে গেল বয়সের কথাটা বোধহয় খেয়াল ছিল না মিত্রর, তাই বলেই চকিতে একটু হাসল, সার্টিফিকেটে যা-ই থাক মশাই, আমার প্রায় চল্লিশ এখন, কিন্তু এখনই কেমন বুড়ো বুড়ো লাগে নিজেকে। অফিসে যতক্ষণ কাজকর্মে থাকি ততক্ষণ মনে হয় বাইরে বোধহয় খুব আলো বাতাস, হইহল্লা আনন্দের মচ্ছব চলছে, আবার বাইরে এসে সময় কাটতে চায় না। আগে ফুটবল খেলা দেখার ঝোঁক ছিল, একটু-আধটু তাস-দাবা খেলতুম, এখন আর তাও পরিশ্রম বলে মনে হয়। বইপত্রও ঘাঁটি না কতদিন! মাঝে মাঝে শুধু জ্যোতিষের বই খুলে নিজের হাত দেখি আর হাসি। বলতে বলতেই একটু ঝুঁকে পড়ল মিত্র, সামান্য চাপা গলায় বলল, বিশ্বাস করুন মশাই, আমার হাতে অনেক ভাল সাইন ছিল, সুন্দর সান লাইন আর বৃহস্পতির মাউন্ট বলতে বলতে মিত্র তার এঁটো ডান হাতটাই প্লেটের কানায় একটু চেঁছে নিয়ে খুলে দেখাল-দেখুন না!

শ্যাম দেখল মিত্রর এবড়োখেবড়ো হাত, ভোঁতা নখ আর মাছের ঝোল লাগা কালচে একটা হাতের চেটো। বলল, বাঃ!

মিত্র হাসে, হাতের জন্যই কনফিডেন্স ছিল আমার, ভেবেছিলুম এর জোরে বেরিয়ে যাব। তা ছাড়া দেখুন, কুমপৃষ্ঠের মতো আমার লাইন অব হেড। শুক্রস্থান ভাল। হাতে প্রেমের চিহ্ন আছে-লাভ ম্যারেজ। কিন্তু ঠোঁট উলটে হাসল মিত্র, কিছুতেই কিছু হয় না মশাই! চল্লিশে আমি রিটায়ারমেন্টের কথা ভাবছি! ছুটি নিয়ে গ্রামে-টামে চলে যাব, খুলব একটা পোলট্রি, ডিম মুরগি বেচব। কী বলেন?

শ্যাম হাসে।

মিত্র মাথা নাড়ে, কিংবা রমতা যোগীও হয়ে যেতে পাবি। ঠিক নেই। কোরবদ্রী কাশীধাম ঘুরে ঘুরে বেড়াব। বড় ইচ্ছে ছিল মশাই, ঘুরে বেড়াবার, কিন্তু কেমন যেন মন হয়নি, হাওড়া ব্রিজ পেরোবার কথা হলেই আলিস্যি ধরে, কতকাল যে রেলগাড়িতে চড়িনি!

বাইরে এসেও শ্যামের সঙ্গ ছাড়ল না মিত্র। বলল, চলুন, অনেককাল পর আজ মনটা হালকা আছে, একটু ঘুরে বেড়াই রাস্তায়। খাওয়ার পর হাঁটা ভাল।

হাঁটতে হাঁটতে মিত্র কথা বলে, জীবনটাকে দেখতে হলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে হয় মশাই। ঘরে থাকলেই কেবল ভার-ভার ভয়-ভয় লাগে, কেবলই ট্রাঙ্ক বাক্সে হাত বুলোই, জানালা দরজা নেড়ে দেখি, অকাজের চিন্তায় বুকে গর্ত খুঁড়ে ফেলি। অথচ আমার ভাবনার কিছু নেইঝাড়া হাত-পা, ভাই চাকরিতে, বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বুড়ো বাপ-মা নেই, কিন্তু ওই একটুখানি একখানা ঘরই আমাকে মেরে রেখেছে মশাই, ওইটুকুরই বড় মায়া! বড় করে শ্বাস ছাড়ে মিত্র, ভাল করে চাদর জড়ায় গায়ে। বলে, ইচ্ছে ছিল ঘরটাকে অমন অনাবাদী ফেলে রাখব না…হাঃ হাঃ…ফুলে-ফুলে ভরে তুলব।

গোল পার্ক থেকে গড়িয়াহাটার দিকে ফিরে আসে দুজন। পাশাপাশি হাঁটে। মিত্ৰই কথা বলে যায়, অটোমেশন এসে গেল, যন্ত্রপাতির হাতে কাজ কর্ম বুঝিয়ে দিয়ে এবার আয়েসি মানুষদের ছুটি। এতদিনে বুঝি মশাই, কাজকর্ম আসলে যন্ত্রপাতিরই, মানুষের নয়।

শ্যাম হাসে। অন্যমনে হাঁটে।

বিধবাতেও আমার আপত্তি ছিল না মশাই, আমি শুধু শান্তশিষ্ট একজনকে চেয়েছিলুম, বয়স জাত রূপ কোনওটাই আমার দেখার ছিল না। কিন্তু কেবল মুখ ফুটে কাউকেই বলতে পারলুম না। বড় লজ্জা করে। একটু বেশি বয়সেই বিয়ের কথা ভেবেছিলুম, বয়স থাকার সময়ে ভাবতুম কেবল তার কথা, যে আমাকে দিব্যি দিয়ে নিজে সরে পড়েছে।…আয়ুটা বড় লম্বা, কী বলেন?…তা ঠিক বয়সে যখন বিয়ে করিনি, এই বয়সে আর লোককে নিজের বিয়ের কথা কী করে বলা যায়!…বলি বলি করেও শেষ পর্যন্ত কোথায় যেন আটকে যায়। বলতে পারি না। লজ্জা করে।

গড়িয়াহাটার কাছে মিত্রকে ছেড়ে দিল শ্যাম। মিত্রকে একই সঙ্গে খুশি আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও পিছু হটে এল মিত্র, বলল, আমাকে খুব অসহায় মনে করবেন না মশাই, আমি নিরস্ত্র নই। অনেক দিন থেকে নিজেকে সশস্ত্র রেখেছি আমি…হাঃ হাঃ…সময় থাকতেই জোগাড় করে রেখেছি পরিমাণ মতো ঘুমের ওষুধ…সতেরোটা ট্যাবলেট আছে আমার, হ মশাই, সতেরোটা। মায়ের ছিল না-ঘুমোনোর অসুখ, তখন থেকে চুরি করে জমিয়ে রাখা…জানতুম একদিন না একদিন কাজে লাগতে পারে…মাঝে মাঝে শিশিটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখি…হাতে নিলেই মশাই, কেমন একটু জোর পাই, মনে বল-ভরসা এসে যায়, আর ভয় লাগে না…হাঃ হাঃ…

তারপর গলা নামিয়ে বলল, দরকার হলে বলবেন। যা ট্যাবলেট আছে তাতে দু’জনের ঢের হয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে আরও এক-আধজনকে বলে দেখবেন। অনেকেই রাজি হবে। আমি ফ্রি দেব…হাঃ হাঃ…

শ্যাম মৃদু হেসে বলল, নেব। আমার দরকার হবে।

আচ্ছা, বলে গম্ভীর মুখে মিত্র চলে গেল।

দূর থেকে শ্যাম দেখল খয়েরি তুস চাদর গায়ে মাতাল একটা ভল্লুকের মতো মিত্র আলো-ছায়ায় হেঁটে যাচ্ছে তার জমিয়ে রাখা সতেরোটা ঘুমের বড়ির দিকে। তাকে পিছু ডাকতে ইচ্ছে হয় না। তাকে শ্যাম চলে যেতে দিল।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়