স্বামীর দোকানের দিকে হাঁটতে থাকে নীপা। কলকাতা শহর চারদিকে, তবু কেবলই মনে হয়, বালিয়াড়ির ভেতরে ডুবে যাচ্ছে পা। সামনে জল। জলের শব্দ। কেউ কোথাও নেই, কেবল বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে যায়। মাথার ওপর কালো আকাশ ঝুঁকে আছে।

টাপে টোপে প্যাণ্ডেলের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে উঁকি দেয় কুকুরের মুখ। তারা আসছে সতর্ক পায়ে। ক্রমে ক্রমে। বেড়ালেরা আসছে নিঃশব্দে, ভিখিরিরা বাইরের গাছতলায় অনেকক্ষণ বসে আছে। একটা ভিখিরির ছেলে ঢুকে গেছে প্যাণ্ডেলে। কুকুর-বেড়ালের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে পাতার ঠোঙায় কুড়িয়ে নিচ্ছে এঁটোকাঁটা। মাংসের হাড়, লুচির টুকরো, মাছের কাঁটা জড়ো করছে এক জায়গায়। খাঁ-খাঁ করছে প্যাণ্ডেল। স্টিক লাইট জ্বলছে, ঘুরছে পাখা, এঁটো পাতা উড়ে উড়ে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। উৎসব-শেষের বীভৎসতা চারদিকে।

বর-বউ শোওয়ার ঘরে চলে গেল। নিয়ম নয়, কিন্তু আজকাল তো কেউ আর বাসর জাগে না। প্যাণ্ডেলের এক কোণে এখনও যজ্ঞের ছাই পড়ে আছে, দুটো রং করা বিচিত্র পিঁড়ি এখনও তোলা হয়নি, দেবদারু পাতায় সাজানো দরজায় মঙ্গল কলস, রঙিন কাগজের শিকল দুলছে হাওয়ায়।

একটা সিগারেট ধরিয়ে অমিয় দৃশ্যটা দেখে। সে এরকম ভাবে বিয়ে করেনি। কয়েকটা সই করে তারা বিছানায় চলে গিয়েছিল।

পিসেমশাইয়ের হাতে একহাজার টাকা দেওয়া গেছে অবশেষে। গতকাল সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে অমিয়। টাকা-টাকা করে। প্যাটারসনের লাহিড়ি শুনে বলল–দূর মশাই, কে-বি ফিট করুন না।

-কে বি কী?

–কাবলে। আপনার যদি জানাশুনো না থাকে আমি ফিট করে দিচ্ছি। কিন্তু সাবধানে ট্যাকল করবেন। এক হাজার ধার নিলে দু হাজার লিখে দিতে হবে।

–সে কী?

-ভয় নেই। আসলে ওরা লাইসেন্স-ওলা মানি লেণ্ডার, গভর্নমেন্টের বেঁধে দেওয়া সুদের বেশি আইনত নিতে পারে না। আপনাকে লেখাবে ছয় পারসেন্ট সুদ, নেবে তার দ্বিগুণের বেশি। যদি বাইচান্স আপনি সুদ নিয়ে ঝামেলা করেন, তখন মামলা করবে দু হাজার টাকার ওপর। আর যদি সুদ ঠিকমতো দিয়ে এক হাজার শোধ দেন তাহলে কাগজ ছিঁড়ে ফেলবে। কিন্তু সাবধানে ট্যাকল করবেন।

আজ সকালে টাকা পেয়ে গেছে অমিয়। এক হাজার। পিসেমশাইকে কথামতো দেওয়া গেল। রেখার বর ভালোই হল। টাটার ইঞ্জিনিয়ার। দু হাজার নগদ, গোদরেজের আলমারি, সিঙ্গল খাট দুটো, সোফাসেট, পনেরো ভরি গয়না। পিসেমশাইয়ের বোধহয় আকাশ-বাতাস চাঁদ-সূর্যের আলো ছাড়া আর কিছু রইল না। অমিয়র জন্য সারাদিন হা-পিত্যেশ করে বসে ছিলেন বুড়ো মানুষ। অমিয় এসে টাকাটা হাতে দিতেই উদ্ভাসিত হয়ে গেল মুখখানা। চোখের কোলে জল। বললেন–ভাবলাম তুই বুঝি আর এলি না! ভয়ে তোর অফিসে ফোন করিনি, যদি খারাপ খবর শুনি!

অমিয় একটু হেসেছিল।

হাসি আজ কিছুতেই ট্যাক্সিতে উঠতে চায়নি। বলেছে–এত সুন্দর রাত আজ। বাতাস দিচ্ছে, চাঁদ উঠেছে, বন্ধ গাড়িতে বসে কেন যাব! আমাকে তোমার স্কুটারে নিয়ে চলো।

তাই এনেছে অমিয়। তার কোমর ধরে বসে এল হাসি। মেয়েদের দঙ্গলে মিশে গেছে এখন। উৎসবে হাসিকে চেনা যায় না।

রাস্তায় পার্ক করা শেষ দুটো মার্ক টু গাড়ির একটা ছেড়ে গেল সোনাদাকে নিয়ে। যাওয়ার সময়ে সোনাদা মুখ বাড়িয়ে বলল–অমিয় তোর সঙ্গে কথা আছে।

-কী কথা?

–সেই যে, মনে নেই কী বলেছিলি?

–কী সোনাদা?

 –তুই বড়ো পাজি অমিয়, চিরকাল পাজি ছিলি।

–কেন?

–আমার বয়স হচ্ছে না রে? এই বয়সে মানুষ একটু গুছিয়ে বসতে চায়, এই বয়সেই তো সংসারের ভোগ সুখ, এই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশে।

অমিয় চেঁচিয়ে হেসে বলেছে–ঠিকই তো।

তবে তুই কেন আমাকে স্টিমারঘাটের কথা বলতে গেলি?

 –কেন, কী হয়েছে?

–অমিয়, তুই কী বলিস তুই জানিস না! তুই চিরকালের পাজি। জানিস না, ওটা বলতে নেই! অমিয়, তুই চলে আসার পর থেকেই আমার বড় অস্থির লাগে। রাতে ঘুম হয় না। সারাদিন যখন-তখন অন্যমনস্ক হয়ে যাই। কেবলই মনে পড়ে–স্টিমারঘাট–স্টিমারঘাট।

শেষ মার্ক টু-টা দাঁড়িয়ে আছে। ওটা কার তা জানে না অমিয়। গাড়িটার আড়ালে তার স্কুটার হিম হয়ে আছে। হ্যাণ্ডেলটা একদিকে বাঁকানো। দেখে মনে হয়, ক্লান্ত মানুষ যেমন বসে বসে ঘুমোয় তেমনি ঘুমোচ্ছে।

পরিবেশনের সময়ে এঁটোকাঁটার গন্ধে গা গুলিয়েছে বলে কিছু খায়নি অমিয়। হাসি কখন আসবে কে জানে! রাত অনেক হয়েছে। পায়ে পায়ে প্যাণ্ডেল ছেড়ে খোলা মাঠে আসে অমিয়। ঠাণ্ডা দক্ষিণের বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাসে আকাশজোড়া এক বৃক্ষ নড়ে ওঠে, বকুলের মতো খসে পড়ে একটি তারা।

অন্ধকার বারান্দায় দুই বুড়ো বসে আছেন। বরের মামা, আর পিসেমশাই। বরের মামার দুগালে পানের ঢিবি। তিনি পিসেমশাইয়ের দিকে ঝুঁকে বলছেন–পুরুতরা আজকাল বড়ো শর্টকাট শিখেছে বিয়াই, আধ ঘণ্টায় কুসুমডিঙে সেরে ফেলল! আমার বিয়ের সময় চারঘণ্টা লেগেছিল যজ্ঞে। কনে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তাকে ঢুলতে দেকে আমি চিমটি কেটে জাগিয়ে দিই।

পিসেমশাই মুখ তুলে বলে–তুই কিছু খাসনি অমিয়?

-না। বমি-বমি করছে।

–খুব খেটেছিস। সোনাকে বলি তোকে একটু সরবৎ করে দিক।

-না, আমি এবার চলে যাই।

–অমিয়, লোকজন খেয়ে কী বলল? কিছু দোষ ধরেনি তো?

 বরের মামা পিচ ফেলে বললেন–আজকালকার বাজারে যা করেছেন যথেষ্ট।

 ঘরে মেয়েদের ভিড়। অমিয় দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে। হাসিকে দেখা যায় না।

সেই ভীড় থেকে সোমাদি এগিয়ে আসে–অমিয়, কী খাবি?

–কিছু না।

-আমি তো নেমন্তন্নের রান্না খেতে পারি না, তাই এ ঘরে একটু ঝোল-ভাত রেঁধে রেখেছি। খাবি তো আয় ভাগ করে খাই।

-হাসি কোথায় সোমাদি?

-ওকে তো সব ঘিরে রেখেছে। বলছে, তুমি ফাঁকি দিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করেছ, আমাদের খাওয়া মার গেছে। এবার খাওয়াও। অমিয়, হাসি দেখতে কী সুন্দর হয়েছে।

-রাত অনেক হয়ে গেল সোমাদি। হাসিকে ডাকো।

–তোর তো স্কুটার আছে, ভুস করে চলে যাবি। রাত হলে ভয় কী? তোকে একটু দই মিষ্টি এনে দিই?

সোমাদি, তুমি এত কষ্ট করো কেন?

–কীসের কষ্ট?

–খুব খাটো তুমি, টিফিনের পয়সা বাঁচাও, এত খেটে কী হবে সোমাদি?

–তোকে তো বলেছি, আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?

সোমাদি, একটা স্টিমারঘাট

 –অমিয়, আমার এখনো অনেক কিছু করা বাকি, টাকা জমাচ্ছি, আমার অনেকদিনের শখ, একটা রেকর্ড-চেঞ্জার কিনব। রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গানের অনেক রেকর্ড। শোন অমিয়, তুই নাকি রেখার বিয়ের জন্য মেসোমশাইকে এক হাজার টাকা দিয়েছিস। সত্যি?

–সোমাদি, তোমাকে সেদিন বলছিলাম

—-কী বলছিলি?

–একটা ফেরিঘাটের কথা

-অমিয়, মেসোমশাইকে এক হাজার টাকা দিয়ে খুব ভালো করেছিস। আমারও দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কী করে দেব? জানিস তো, গত চোদ্দো-পনেরো বছর আমার চাকরির ওপরই সংসার চলছে। রেখাকে একটা আংটি দিলাম, তাতেই ধার হয়ে গেল। তুই টাকা দিয়ে ভালো করেছিস। মেসোমশাই সবাইকে ডেকে ডেকে তোর দেওয়া টাকার কথা বলছেন।

সোমাদি

 –শোন অমিয়, এখন আর আমার চাকরি করতে ভালো লাগে না রে। তুই যে সেদিন গিয়ে বললি, ভালোবাসার লোক না থাকলে রোজগার করে সুখ নেই, সেটা বাজে কথা নয়। এখন আমি বুঝতে পারি সংসারে আমার যেটুকু আদর তা ওই চাকরিটার জন্য। এ চাকরিটা যদি ছাড়ি তবে দেখব আমি কিছু নই, কেউ নই। আজকাল তাই ভীষণ টায়ার্ড লাগে। বাসায় ফিরে রাত্রে এমন মন খারাপ লাগে! একটা ইজিচেয়ার কিনেছি, সামনের মাসে কিনব একটা রেকর্ড-চেঞ্জার। বুঝলি অমিয়, বারান্দায় অন্ধকারে বসব, উঠোনে থাকবে অন্ধকার, চুপচাপ বসে চেঞ্জার চালিয়ে দেব–গান হবে–দুঃখের গান–বিরহের গান–শুনতে শুনতে কাঁদব হয়তো–আর মনে পড়বে…কী মনে পড়বে রে অমিয়…?

অমিয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–তুমি তো জান সোমাদি…

 সোমাদি মাথা নেড়ে চাপা গলায় বলে–জানিই তো, জানব না কেন? মনে পড়বে..

পিসেমশাই সামনে এসে দাঁড়ান। কুজো দেখায় তাঁকে, বুড়ো দেখায়। অমিয়র দিকে অপলক একটু তাকিয়ে থেকে বলেন–আমি ভাবতাম ওর পিসিমা মরে গেছে বলেই বোধহয় অমিয় আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না, কিন্তু তা নয়। সোমা, অমিয় আমাকে

–জানি মেসোমশাই। অমিয় বড়ো ভালো ছেলে।

পিসেমশাই শ্বাস ছেড়ে বলেন–আমি বড়ো একা হয়ে গেলাম। শেষ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। সোমা, মাঝে মাঝে আসবি তো? অমিয় তুই?

–আসব না কেন!

–কী কথা হচ্ছিল তোদের?

 সোমাদি মাথা নীচু করে বলে কিছু না মেসোমশাই, অমিয় মাঝে মাঝে একটা ফেরিঘাটের কথা বলছে–

–ফেরিঘাট! কীসের ফেরিঘাট? কী রে অমিয়?

–স্টিমার বাঁধার জেটি, জল…

-ওঃ। পিসেমশাই হাসেন–স্টিমারঘাট মনে পড়তেই খালাসিদের মাংস রান্নার গন্ধ নাকে এসে লাগে এখনও। গোয়ালন্দে পারাপারের সময়ে ওই গন্ধ যে কী ভালো লাগত। বুঝলি, বাহাদুরাবাদে একবার কাজলি মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম সরষেবাটা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঝোল– তেমন আর কখনো কি খাওয়া হবে? এক কাঠা চালের ভাত তুলে ফেলেছিলাম। তুই কোন ফেরিঘাটের কথা বলছিস অমিয়? গোয়ালন্দ? নাকি…

-কী জানি! আমি ঠিক জানি না। খুব উঁচু একটা বালিয়াড়ি গড়িয়ে নেমে গেছে বহু দূর পর্যন্ত…কালো ছোট্ট একটা জেটি…নির্জন…বালিতে একটা সাপের খোলস পড়ে আছে। কেবল…আবছায়ায় জল দেখা যায়…সেকী জল…অনন্ত, অথৈ এক নদী বয়ে যাচ্ছে…

পিসেমশাই আর একটু কুঁজো হয়ে যান। একটা শ্বাস ফেলে বলেন–এখন এই বাড়িতে আমার একা কাটবে, বাদবাকি যে কটা দিন আছি। অমিয় রাত হল রে, বউমাকে নিয়ে যাবি, অনেকটা রাস্তা, এইবার বেরিয়ে পড়। সোমা, তুই তো আজ যাবি না, না?

–না।

–অমিয় আর দেরি করিস না। সোমা, বউমাকে ডেকে দে।

দিই।

-বড়ো একা লাগবে, বুঝলি অমিয়? মাঝে মাঝে বউমাকে নিয়ে চলে আসবি। দু-চারদিন করে থেকে যাবি। মনে করিস, আমি তোর এক বুড়ো ছেলে, আমার তো কেউ রইল না…

অমিয়র স্কুটার ডাকছে। গুড় গুড় গুড় গুড়। পেছনে হাসি। বাতাস সামনে থেকে পেছনে বয়ে যাচ্ছে। তবু মাঝে মাঝে এক এক ঝলক হাসির গন্ধ এসে নাকে লাগে। হাসির গন্ধ! তা তো নয় হাসির আবার গন্ধ কী? ও তো ওর খোঁপার বেলফুলের গন্ধ, সেন্ট আর প্রসাধনের গন্ধ।

হাসির মুখ দেখতে পাচ্ছে না অমিয়। কেবল তার দু-খানা হাত অমিয়র কোমর বেষ্টন করে আছে। একবার ঝুঁকে নিজের পেটের কাছে হাসির জড়িয়ে থাকা হাতের পাতাদুটি দেখল অমিয়। আঙুলে আংটি ঝলসে ওঠে। মোমে মাজা আঙুলগুলি কী নরম হয়ে লেগে আছে তার পেটে।

হাসি দুরন্ত শ্বাসের সঙ্গে বলে–আরও জোরে চালাও না।

—কেন?

–জোরে না চালালে স্কুটারে ওঠার আনন্দ কী।

–হাসি, আমার স্কুটারটা পুরোনো হয়েছে। স্পিড নেয় না।

–পচা, তোমার স্কুটারটা পচা।

অমিয় হাসে। তিন, সাড়ে তিন বছর আগে ক্যাথিড্রাল রোডে এই স্কুটারে…

-জ্যোৎস্না ফুটেছে কেমন, দেখছ?

 –হুঁ।

–ঠিক দুধ-ভাতের মতো জ্যোৎস্না, আমার খেতে ইচ্ছে করে।

–হাসি তুমি কবে যাচ্ছ?

–তেরোই।

–তোমার যদি টাকার দরকার থাকে…

–সামনে ওটা কী, ওই উঁচু মতো?

 –গড়িয়াহাটা ব্রিজ।

ওমা! ওর ওপর দিয়ে তো রোজই যাই আসি, কই অত উঁচু বলে তো মনে হয় না, ঠিক টিলার মতো দেখাচ্ছে দেখো। চা-বাগানে আমরা ছেলেবেলায় টিলা থেকে ছুটে নামতাম -একবার দৌড় শুরু করলে আর থাকা যায় না, কেবলই গতি বেড়ে যায়।

–হুঁ।

–তোমার স্কুটারটা পচা। আর একটু জোরে চালাও না।

—কেন?

–আমার স্পিড ভালো লাগে।

গুড় গুড় করে স্কুটার ডাকে। গড়িয়াহাটা ব্রিজের গোড়া থেকে চড়াই ভাঙে। অমিয় স্পষ্টই টের পায় তার বয়স্ক স্কুটারটার এই চড়াই ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে। খুব বেশিদূর নয় আর সে মনে মনে তার স্কুটারকে বলে, আর একটু কষ্ট করো স্কুটার। তারপর অন্ধকার সিঁড়ির নীচে তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোবে।

–ব্রিজের ওপর ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়াবে?

—হাসি, অনেক রাত হয়েছে।

-কটা বাজে?

বারোটা চল্লিশ।

–হোকগে। তুমি দাঁড়াও।

-ব্রীজের ঠিক ওপরটায় বাতাসের জোর বেশি। আকাশের কাছাকাছি উঠে তারা দাঁড়ায়। হাসি রেলিংয়ের কাছে চলে যায়। ডেকে বলে–দেখো, কত দূর পর্যন্ত কী ভীষণ জ্যোত্সা। সব দেখা যাচ্ছে। এত রাতে কলকাতা কখনো দেখিনি।

অমিয় বাতাসে সিগারেট ধরাতে পারছিল না। বার বার দেশলাইয়ের কাঠি নিভে যাচ্ছে। সে স্কুটারের ওপর না-ধরানো সিগারেট মুখে নিয়ে বসে রইল। হাসি তাকে ডাকে না। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাসি একা জ্যোৎস্নায় প্লাবিত অনন্ত শহরটি দেখে মুগ্ধ চোখে। এখন যদি নিঃশব্দে অমিয় তার স্কুটারকে ব্রিজের ঢালুর ওপর দিয়ে গড়িয়ে দেয়, যদি চলে যায়, তাহলে হাসি অনেকক্ষণ টেরই পাবে না যে অমিয় চলে গেছে। কিছুক্ষণ পরে মুখ ফিরিয়ে স্কুটার এবং অমিয়কে না দেখে একটুও অবাক হবে না হাসি। তার মনে পড়বে না যে, এই ব্রিজের ওপর সে অমিয়র সঙ্গে এসেছিল, তার স্কুটারে। হাসির মনেই পড়বে না।

না-ধরানো সিগারেট মুখে অমিয় অপেক্ষা করে। বাতাসে আকাশজোড়া এক বৃক্ষ নড়ে। বকুলের মতো খসে পড়ে তারা। অমিয় অপেক্ষা করে।

একদিন যায়। দু-দিন যায়।

 দীর্ঘ টেণ্ডার টাইপ করতে করতে অমিয়র কাঁধ ব্যাথা করে। চোখে ঝাপসা দেখে। সিগারেটে সিগারেটে জিভ বিস্বাদ। রাজেন চা এনে রেখে গেছে। খাওয়া হয়নি।

–বাগচী। কল্যাণ ডাকে।

-উঁ

–আপনার কি কিছু টাকার দরকার?

অমিয় হাসে।

-রাজেনের কাছে আমি আরও ছ-শো টাকা রেখে দিয়েছি। আমি থাকি বা না থাকি, যখন দরকার হয় নেবেন।

–অনেক ধার হয়ে গেল মুখার্জি।

–আপনার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। সেনগুপ্তের কোনো পাত্তা পেলেন?

-না।

 –কত টাকার বিল পেমেন্ট নিয়ে গেছে?

–প্রায় সাত হাজার।

–ওকে খুঁজে পেলে কী করবেন?

 –কিছুই না। কেবল একটা কথা বলব

—-কী কথা?

—বলব…

অমিয় আর বলে না। বলতে পারে না। টাইপরাইটারের ওপর ঝুঁকে পড়ে তার মুখ। চোখে মেঘ। বাষ্পরাশি জমে ওঠে। সে দেখে, টাইপ করা লাইনের অক্ষরগুলো কে যেন আঙুলের টানে লেপে দিয়ে গেছে। কালো রেখার মতো দেখায়। লাইনগুলো ধীর আঁকাবাঁকা হয়ে যেতে থাকে। দুলতে থাকে। অমিয় দেখতে পায়, লাইনগুলো দুলতে দুলতে ঢেউ হয়ে যাচ্ছে। …ঢেউ আর ঢেউ। ফুলে উঠছে জল-অনন্ত অথৈ মহাসমুদ্রের মতো জল। কালো মহা আকাশ ঝুঁকে আছে তার ওপর। বালিয়াড়ি ধু-ধু করে সাদা হাড়ের মতো। গড়ানে বালি, বালির ওপর ঢেউয়ের দাগ। সাপের খোলস উলটে পড়ে আছে।

–মুখার্জি, আমি আপনাকে একটা জিনিস প্রেজেন্ট করব।

–কী?

–আমার স্কুটারটা।

–তা কেন বাগচী! এখন আপনার সময় ভালো যাচ্ছে না। প্রেজেন্ট সুসময়ে করবেন।

 –এই ঠিক সময় মুখার্জি। স্কুটারটার আর আমার দরকার নেই।

কল্যাণ একটু চুপ করে থাকে–যদি দরকার না থাকে তো ওটা আমি কিনে নিতে পারি।

–না মুখার্জি, আমাদের বংশে কেউ কখনো ঘরের জিনিস বেচেনি। আমি ওটা আপনাকে দিয়ে দেব। অভাবের সময়েই দেওয়া ভালো, সুসময়ে দেওয়া হয় না।

কল্যাণ চুপ করে থাকে।

-রাজেনের কাছে টাকাটা আছে বাগচী, দরকার হলে নেবেন।

-আচ্ছা।

টেণ্ডার সিল করে অমিয় বেরোয়। মেঘ কেটে রোদ উঠছে চারদিকে পাথুরে শহর। প্রতিদ্বন্দ্বী কলকাতা। নীচে স্কুটারটা দাঁড়িয়ে আছে। অমিয় চেয়ে থাকে। তারপর স্কুটার ছাড়ে।

–লাহিড়ী।

–উ।

–টেণ্ডার দিয়ে গেলাম।

–আচ্ছা। দেখব।

–লাহিড়ী, প্যাটরসন কি এখনো আমাকে বিশ্বাস করে?

 লাহিড়ী হাসে। বলে-ওসব রোমান্টিক কথা ছাড়ুন। কে কাকে বিশ্বাস করে। অর্ডার আপনি পাবেন। ঠিকমতো রেট দিয়েছেন তো, যেমন বলেছিলাম?

–দিয়েছি।

–ঠিক আছে।

অমিয় বেরোয়। ঘুরতে থাকে। মাঝে মাঝে নিজের অফিস ছুঁয়ে যায়।

–বাগচী।

উঁ?

ল্যাংগুয়েজ নিয়েই সবচেয়ে মুশকিল।

অমিয় হাসে। বলে–কেন?

রজত হাই তুলে বলে–কিছুতেই ল্যাংগুয়েজ খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ মেয়েটা রোজই মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ভারি অস্বস্তি।

চেয়ে থাকে কেন?

–বোধহয় এক্সপেক্ট করে, জার্মানি যাওয়ার আগে আমি তাকে ফাইনাল কিছু বলে যাব। বাঙালি মেয়েদের জীবন খুব অনিশ্চিত তো। অথচ আমি কিছু বলতে পারছি না। ল্যাংগুয়েজ নিয়েই মুশকিল।

–কবে যাচ্ছেন?

 –হরি সিং-এর সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করেছি। দিন কুড়ির মধ্যেই চলে যাব।

 –আমাদের একা লাগবে।

–জানি। আফটার অল উই ওয়্যার কমরেডস। বাগচী, আপনার জন্য কী পাঠাব বললেন না?

ভেবে দেখি।

–সেনগুপ্তকে যদি কখনো খুঁজে পান বাগচী, গিভ হিম অ্যান এক্সট্রা কিক ফর মি। মনে রাখবেন।

অমিয় হাসে।

মিশ্রিলাল এসে চুপ করে বসে থাকে, ধৈর্য ধরে।

-বাগচীবাবু।

–জানি মিশ্রিলাল।

 –আপনি তো আর কোনো অর্ডার পেলেন না! বিজনেসের কী হবে? আমি ডুবে যাব না?

বোধ হয় দূরে কোথাও মেঘ গর্জনের মতো একটা শব্দ হয়। অমিয় কান পেতে শোনে। শার্সির বাইরে আজ প্রবল রোদ। কোথাও মেঘ নেই। তবুও শব্দটা কোথা থেকে শোনে অমিয়? একবার চোখ বোজে সে। অমনি এক পঞ্জরসার দেহে স্তম্ভিত-বিদ্যুৎ সিংহ তার চোখে ছায়া ফেলে দাঁড়ায়। গভীর অরণ্যের ছায়ায় বহু দূরের সিংহ ডাকে–মেঘ-মাটি কেঁপে ওঠে।

সে বলে–ডুববে না মিশ্রিলাল। আমি আছি। থাকব।

হাসির সঙ্গে বড়ো একটা দেখা হয় না আজকাল। রাত পর্যন্ত সে বাইরে থাকে। ফিরে এসে দেখে, হাসির ঘর ফাঁকা। বোধহয় হাসি কলকাতায় তার চেনাশোনা মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে যায়, দেখে সিনেমা-থিয়েটার, বোধহয় তার নেমন্তন্ন থাকে খাওয়ার। কে জানে। মধু তাকে চা করে দেয়। জিজ্ঞেস করে-বাবু, আপনার গাড়ি!

–দিয়ে দিয়েছি একজনকে।

বুড়ো মধু বিড় বিড় করে কী যেন বলে। বোধহয় জীবনের অনিত্যতার কথা নিজেকে শোনায়।

রাত বেড়ে যায়। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। ঘুম হয় না। উঠে বসে অমিয় আলো জ্বালে। অফিসের কাগজপত্র দেখে। টেণ্ডারের খসড়া তৈরি করে। সে সময়ে ভেজানো দরজা ঠেলে হাসি আসে। নিঃশব্দে ঘরে চলে যায়। কাপড় ছেড়ে কলঘরে ঢোকে। বেরিয়ে আসে, জল খায়। শুয়ে পড়ে।

তাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। হাসির যাওয়ার দিন এসে গেল।

রোদের তাপ আজকাল খুব বেড়ে গেছে। অমিয়র তাই কষ্ট হয় খুব। অনেকটা হাঁটতে হয়। কল্যাণ প্রায়ই বলে–বাগচী, স্কুটারটা নিয়ে বেরোবেন।

অমিয় হাসে। নেয় না। কল্যাণ কয়েকদিনে ভালোই শিখে গেছে চালাতে। ও যখন স্কুটার চালায় তখন মুগ্ধ হয়ে দেখে অমিয়। ভালো লাগে। হিংসে হয় না।

রজতের কোনো কাজ নেই আজকাল। ব্যবসা সিল করে দিয়েছে। তবু রোজ এসে দেখা করে যায়।

কবে ফ্লাই করছেন সেন?

–বলিনি আপনাকে? বিশ তারিখ, টিকিট পেয়ে গেছি।

–বাঃ! ভালো খবর।

–বাগচী, ইউ আর সাফারিং টু মাচ।

 ধারগুলো শোধ করতে হবে সেন।

পালিয়ে যান না। সেনগুপ্তকে কে আর ধরতে পেরেছে।

 –ঠিক দেখা হবে একদিন…তখন? অমিয় হাসে।

–বাগচী যদি সত্যিই কেটে পড়তে চান তো ব্যবস্থা করতে পারি।

–কীরকম ব্যবস্থা?

–জব ভাউচার। তিন মাসের মধ্যে আপনাকে নিয়ে যাব।

অমিয় হাসে।

 কখনো কখনো শূন্য ঘরে, তার টেবিলের ওপর বিশাল সিংহ এক লাফ দিয়ে উঠে আসে। ধক ধক করে জ্বলে তার শরীর, পঞ্জরসার দেহ, পিঙ্গল কেশর। মুখে বৈরাগ্য, চোখে দূরের প্রসার। পুরুষের এরকমই হওয়ার কথা ছিল। কে তাকে শেখালো নারী-প্রেম, হাঁটু গেড়ে প্রণয়ভিক্ষা, মোলায়েম ভালোবাসার কথা! অপরূপ মগ্ন হয়ে দেখে অমিয়।

তারপর টাইপরাইটার টেনে নিয়ে বসে।

–আপনি বার বার কেন একটা স্টিমারঘাটের কথা বলেন জামাইবাবু?

 –আমি বলি না। অমিয় বলে। তুমি ওর কাছ থেকে কখনো শুনে নিও।

–কী করে শুনব! আমি কাল চলে যাচ্ছি।

–শুনলে ভালো করতে।

–কেন?

 জামাইবাবু টেলিফোনের অন্য প্রান্তে শ্বাস ফেলে।

-হাসি, আমাদের বয়স হয়ে গেল।

হঠাৎ একথা কেন?

 –কী জানি! আজকাল হঠাৎ কাজকর্মের মাঝখানে বয়সের কথা মনে পড়ে। আর মনে পড়ে…

–কী?

–স্টিমারঘাট…তুমি সাবধানে যেও হাসি। গঙ্গার ওপর ব্রিজটা যে কবে ওরা শেষ করবে।

 –আমি পাগল হয়ে যাব জামাইবাবু, স্টিমারঘাটের কথাটা আগে বলুন। কোন স্টিমারঘাট?

ফারাক্কা।

–না, ফারাক্কার কথা আপনি বলছেন না।

জামাইবাবু চুপ করে থাকে।

-বলবেন না?

—তুমি অমিয়র কাছে শুনো।

–ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে কখন? ও অনেক রাতে ফেরে, খুব সকালে বেরিয়ে যায়।

 –কাল স্টেশনে অমিয় যাবে না?

–বলেছিল তো যাবে। অফিসে কাজ আছে, সেখান থেকেই সম্ভব হলে স্টেশনে যাবে।

 –তবে আর সময় হবে না।

–কীসের?

 –ষ্টিমারঘাটের কথা শোনার। ফোন রেখে দিচ্ছি হাসি…

হাসি রিসিভার রেখে দেয়।

পরমুহূর্তেই আবার তুলে দ্রুত ডায়াল করে।

-হ্যালো আমি অমিয় বাগচীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। এক্ষুনি, জরুরি দরকার।

 একটু অপেক্ষা করতে হয়। তারপর অমিয়র গলা ভেসে আসে–বাগচী বলছি।

–শোনো, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে।

–কী কথা?

–তুমি আমাকে একটা কথা কোনোদিন বল নি।

–কী?

–স্টিমারঘাটের কথা। সবাইকে বলেছ, আমায় ছাড়া। একবার আমাকে বলবে?

 –আমার সময় নেই হাসি।

–কেন?

–আমি খুব ব্যস্ত।

–কেন ব্যস্ত?

–অনেক কাজ হাসি। আমাদের সময় তো বেশি নয়।

–বলবে না?

–সময় বড়ো কম হাসি।

–স্টিমারঘাটের অর্থ কী?

–কী করে বলব। আমিই কি জানি?

–কী আছে সেখানে?

–কিছু নেই। শুধু একটা উঁচু বালিয়াড়ি, ধু-ধু বালি গড়িয়ে নেমে গেছে, একটা সাপের খোলস উলটে পড়ে আছে। বালির শেষে দূর থেকে একটা কালো জেটি দেখা যায়। তারপর জল। সে খুব অথৈ জল, অনন্ত জল, প্রকান্ড এক নদী, তার ওপর কালো আকাশ ঝুঁকে আছে…হাসি স্তব্ধ হয়ে থাকে।

এর মানে কী?

–আমি জানি না। তবে মনে হয়, ওখানে একদিন সকলের দেখা হবে।

–কেন

-কেন?

—কেন?

-কেন?

প্যাটারসনের অর্ডারটা আজ বেরিয়েছে।

সকাল থেকেই অমিয় ঘুরছে বাজারে। ভাদ্র মাস পড়ে গেল প্রায়। রোদের তাপ অসম্ভব। মাঝে মাঝে ধুলোর ঝড় ওঠে। ঘুর্ণ হাওয়ার মতো হাওয়া দেয়। হাঁটতে খুবই কষ্ট হয় অমিয়র। তবু সে হাঁটে। মাঝে মাঝে স্পষ্ট দেখতে পায় সামনে, ভিড় ভেদ করে চলেছে এক প্রকান্ড সিংহ। পিঙ্গল কেশর, পঞ্জরসার দেহটিতে স্তম্ভিত বিদ্যুৎ, গায়ে বৈরাগ্যের ধূসর রং, চোখে দূরের প্রসার। সিংহ মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে নেয়। দেখে নেয়, অমিয় ঠিকঠাক চলছে কিনা।

অমিয় চলে। সাপ্লায়ারদের কাছে ঘোরে। দোকান যাচাই করে। সে আছে। থাকবে।

স্টিমারঘাটের ছায়াটা চকিতে ভেসে ওঠে চোখে। মিলিয়ে যায়। দেখা হবে, একদিন সকলের সাথে দেখা হবে।

দুপুরের দিকে অফিসে ফিরে একটা সিগারেট মুখে টাইপরাইটারের সামনে বসে অমিয়। টাইপ করতে থাকে।

কল্যাণ ঘরে ঢুকেই বলে, এ কী বাগচী?

—-কী।

–আপনি এখনও যাননি?

–কোথায়।

কাল যে বলছিলেন আজ দার্জিলিং মেলে আপনার স্ত্রী চলে যাচ্ছেন!

–ওঃ।

ভুলে গিয়েছিলেন?

 অমিয় লজ্জিত হয়ে হাসে। সে ভুলে গিয়েছিল। হাসির কথা তার মনেই ছিল না।

–কটা বাজে মুখার্জি?

বারোটা চল্লিশ। পঞ্চাশে ট্রেন ছেড়ে যাবে।

–তাহলে আর গিয়ে কী হবে!

–উঠুন তো। নীচে স্কুটার রয়েছে…তাড়াতাড়ি করুন, হার্ড লাক–পেতে পারেন। উঠুন, উঠুন…

দেরিই হয়ে গেল অমিয়র।

স্কুটার থেকে নেমে সে দ্রুত পায়ে উঠে এল স্টেশনের হলঘরে। আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষ–যারা প্রিয়জনদের বিদায় জানাতে এসেছিল। কোলাপসিবল গেটের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অমিয় শূন্য লাইনটা দেখে। বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়, লাইনটা চকচক করছে। কয়েকজন লোক বেরিয়ে আসছিল। তারা সরে যেতেই অমিয় দেখতে পেল হাসি দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে সুটকেস। সে একা।

–কী হল?

 হাসির মুখ চিন্তান্বিত। কপালে ভ্রূকুটি। কেমন যেন আস্তে, আস্তে, চিন্তা করে করে বলল, আমি ট্রেনটা ধরতে পারিনি।

-কেন?

পারলাম না।

-কেন?

হাসি খুব বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে–কী জানি! আমাকে কখনো জিজ্ঞেস কোরো না।

অমিয় একটু হাসে।

আজকাল অমিয় যখন সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ঘুমোয় তখন তার স্বপ্নের মধ্যে উপর্যুপরি সিংহের ডাক শোনা যায়।

মেঘগর্জনের মতো সেই ডাক। মাটিতে লেজ আছড়ানোর শব্দ হয়। পিঙ্গল কেশর, পঞ্জরসার দেহে স্তম্ভিত বিদ্যুৎ, গায়ে ধূসর রঙের বৈরাগ্য, চোখে দূরের প্রসার–সিংহেরা তার ভিতরে ঘুরে বেড়ায়। উপর্যুপরি ডাক দেয়, মেঘ-মাটি কেঁপে ওঠে। ঘুমের মধ্যে অমিয় হাসে।

অন্য ঘরে হাসির তেমন ঘুম হয় না। বহুদূর থেকে এক অচেনা রহস্যময় স্টিমারঘাটে এগিয়ে আসে। সে দেখে ধু-ধু বালিয়াড়িতে চাঁদের আলো পড়েছে। পড়ে আছে সাপের খোলস। উঁচু থেকে দেখা যায়–গড়ানো বালিয়াড়ির শেষে জেটি, তারপর অনন্ত নিঃশব্দ জলরাশি–অথৈ। সেই স্রোতের ওপর আবহমান কাল ধরে ঝুঁকে আছে এক কালো আকাশ। ওইখানে সকলের দেখা হবে। কেননা, তারা বিশ্বস্ত থাকেনি নিজের প্রতি, এই দুর্লভ পার্থিব জীবন নিয়ে তারা হেলাফেলা করেছিল।

এসব সে নিজেই ভাবে। ভাবতে ভাবতে ভাবনা পালটে ফেলে। বারংবার সে ওই স্টিমারঘাটের অর্থ খুঁজতে থাকে। খুঁজে পায় না। কিন্তু না বুঝেও সে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে অপলক চেয়ে থাকে। জলে চোখ আপনি ভেসে যায়।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়