ফেরিঘাট – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  

সিঁড়ির তলা থেকে স্কুটারটা টেনে রাস্তার পাশে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড় করালো মধু, তার হাতে পালকের ঝাড়ন। মুছবে। মুছলেও খুব একটা চকচকে হয় না আজকাল। রংটা জ্বলে গেছে, এখানে-ওখানে চটা উঠে গেছে। বেশ পুরোনো হয়ে গেল স্কুটারটা।

জানালা দিয়ে নীচের রাস্তায় স্কুটারটা একটুক্ষণ অন্যমনে দেখলে অমিয়। বহুকালের সঙ্গী। মায়া পড়ে গেছে। কল্যাণ তিন হাজার টাকা দর দিতে চেয়েছিল। জিনিসটা ইটালিয়ান বলে নয়, মায়া পড়ে গেছে বলেই বেচেনি অমিয়। তা ছাড়া একবার বেচে দিলে নতুন আর কেনা হবে না। অমিয়র দিন চলে গেছে।

মুখ ফিরিয়ে অমিয় টেবিলে সাজানো একপ্লেট টোস্ট, একটা আধসেদ্ধ ডিম, একগ্লাস দুধ, নুন-মরিচের কৌটো, চামচ–এসব আবার দেখে। সকাল আটটা কী শোয়া আটকা এখন। সাড়ে আটটায় সে রোজ বেরোয়। বেরোবার আগে সে রোজ টোস্ট ডিম নুন-মরিচ দিয়ে খায়। দুধ পান করে। আজ কিন্তু খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতেও তার অনিচ্ছা হচ্ছিল। খিদে নেই। বমি-বমি ভাব। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, বার বার উঠে সিগারেট খেয়েছে। সকালে অনেকক্ষণ স্নান করেছে চৌবাচ্চা খালি করে। তবু শরীর ঠিকমত ঠাণ্ডা হয়নি। খাওয়ার কথা এখন ভাবাই যাচ্ছে না।

টেবিলের ওপাশে মুখোমুখি রোজকার মতো হাসি বসে নেই। শোয়ার ঘরের দরজায় হাসি দাঁড়িয়ে আছে। কাল রাতে হাসিও বোধহয় ঘুমোয়নি। ঘুমোলে যে ছোটো ছোটো অবিরল শ্বাস পড়ে ওর, সেই শব্দ তো কৈ শোনেনি অমিয়। বেত আর বাঁশ দিয়ে তৈরি ভারি সুন্দর একটা খাট শখ করে কিনেছিল হাসি, যখন অমিয়র সুদিন ছিল। পুরোনো বড়ো খাটটা বেচে দিয়ে অমিয় কিনে নিল একটা সোফা-কাম-বেড। সেই থেকে দু-জনের বিছানা আলাদা। বেতের খাটে হাসি, সোফা-কাম-বেডে অমিয়। সেইটাই কি মারাত্মক ভুল হয়েছিল?

বস্তুত তো ছোটোবেলা থেকেই অমিয় যৌথ পরিবারে মানুষ। সেখানে বড়ো খাটের সঙ্গে আর একখানা বড়ো খাট জোড়া দেওয়া। বিশাল মাঠের মতো বিছানা, শামিয়ানার মতো বড়ো মশারি। দাদু ঠাকুমা শুত, আর সেই সঙ্গে তার রাজ্যের ছেলেপুলে। পরিবারের অর্ধেক এক বিছানায়। যারা সেই বিছানায় শুয়ে বড়ো হয়েছে তারা আজও কেউ একে অন্যের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়নি, যে যার কাজের ধান্দায় আলাদা হয়ে ভিন্ন সংসার করেছে, দাদু ঠাকুমা মরে গেছে কবে। তবু সেই প্রকান্ড বিছানার স্মৃতি আজও অমিয়র পিসতুতো, মাসতুতো, জ্যাঠতুতো, খুড়তুতো, ভাই আর বোনদের কাছ থেকে খুব দূরে সরাতে পারেনি। দেখা হলে সবাই অকৃত্রিম খুশি হয়, এক-আধবেলা জোর করে ধরে রাখে, প্রাণপণে খাওয়ায়, কত পুরোনো দিনের গল্প হয়।

অমিয় খেতে পারছে না। একদম না। একটা টোস্ট মুখে তুলে দেখল। ভালো টোস্ট হয়েছে, মুড়মুড় করে ভেঙে যাচ্ছে দাঁতের চাপে। তবু অমিয়র কাছে কাঠের গুঁড়োর মতো বিস্বাদ লাগে। ডিমটা থেকে আঁশটে গন্ধ আসে। দুধটাকে খড়িগোলা মনে হয়। অমিয় টোস্ট হাতে ধরে রেখে একবার চেষ্টা করে হাসির দিকে তাকায়। আসলে তাকাতে তার ভয় করছিল।

চোখে চোখ পড়ে। হাসির কোনো দ্বিধা নেই, ভয় নেই। এমন নিষ্ঠুর মেয়ে অমিয় খুব কমই দেখেছে। অমিয়কে কখনো হাসি সমীহ করেনি। আজ পর্যন্ত বলতে গেলে হাসি সঠিক বউ হয়নি অমিয়র। ইচ্ছে হয়নি বলে হাসি সন্তান-ধারণ করল না আজ পর্যন্ত। না করে ভালোই করেছে। তাহলে এখন অসুবিধে হত। হাসি তাই অমিয়র চোখে সোজা চোখ রাখতে পারে। ভয় পায় না। অমিয়র কাছে তার কোনো দায় নেই।

আমি কিন্তু কয়েকটা জিনিস নিয়ে যাব। হাসি সকালে এই প্রথম কথা বলে।

অমিয় ভ্রূ তুলে বলে–কী বললে?

 হাসি বলে–আমি কয়েকটা জিনিস নিয়ে যাব। এখানে তো আমার নিজস্ব কিছু নেই।

কী নেবে?

এই কয়েকটা শাড়ি ব্লাউজ, সাজগোজের জিনিস, একটা স্যুটকেস, কয়েকটা টাকা…

 অমিয় শান্ত গলায় বলে–নিও। বলার দরকার ছিল না।

বলেই নেওয়া ভালো। দরকারে নিয়ে যাচ্ছি। দরকার ফুরোলে ফিরিয়ে দেব।

শরীরের ভিতরটা চিড়বিড় করে অমিয়র। কিন্তু কিছু বলে না। বলা মানেই আবার অশান্তি। ছোটো কথার ঢিল ছুঁড়ে হাসি দেখতে চায় মজা পুকুরটায় কীরকম ঢেউ ওঠে। মজা পুকুর ছাড়া অমিয় নিজেকে আর কিছু ভাবতে পারে না।

হাসি আবার বলে–এ সংসারে আমি তো কিছু নিয়ে আসিনি, কাজেই নিয়ে যাওয়া উচিত নয়।

অমিয় উঠল। টেবিলে তার টোস্ট ডিম আর দুধের ওপর মাছি উড়তে লাগল, বসতে লাগল।

স্কুটারটা রোদে দাঁড়িয়ে আছে। অমিয় জানালা দিয়ে একবার দেখে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে নেয়। দরজার ওপর একটা ছবি টাঙানো আছে। ছবির চারধারে একটা মালা কবে টাঙানো হয়েছিল, মালাটা গত বছরখানেক ধরে শুকিয়ে এখন রুদ্রাক্ষের মালার মতো দেখায়। ছবিতে ধুলো পড়েছে। বেরোবার সময়ে রোজই একবার ছবিটার দিকে অভ্যাসবশত তাকিয়ে বেরোয় সে। একবার হাতজোড় করার ভঙ্গি করে বেরিয়ে যায়।

আজও তাকাল।

বেরোবার মুখে দরজা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–যা খুশি নিয়ে যাও।

হাসি বলল–যা খুশি নেব কেন? যা না হলে চলবে না সেরকম দু-একটা জিনিস ধার নেবো। আবার ফিরিয়ে দেব।

অমিয় বলল–আচ্ছা।

রাস্তায় বেরিয়ে এসে আর হাসির কথা মনে থাকে না। দু-চারদিন বৃষ্টির পর গরম কমে গেছে। আকাশ গভীর নীল। বাতাস পরিষ্কার। স্কুটারটা মৃদু গোঙানির শব্দ করে ছুটছে। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে যত অপ্রীতিকর কথা ভুলিয়ে দিয়ে মাথা পরিষ্কার করে দেয়। পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে কালো রাস্তা। কলকাতার একরকম সুন্দর গন্ধ আছে। বর্ষার পর রোদ উঠলে প্রায়ই গন্ধটা পায় সে। রাস্তার পর রাস্তা পার হয় অন্যমনে।

ত্রিশ নম্বর ধর্মতলায় তার অফিস। ফুটপাথ থেকেই সোজা কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে খাড়া। সিঁড়ির পাশেই ফুটপাথে একটা গেঞ্জি, ব্রেসিয়ার, রুমাল, আণ্ডারওয়্যারের স্টল চালায় আহমদ। অমিয়র স্কুটারটা সারাদিন সে-ই পাহারা দেয়। রুমালটা আণ্ডারওয়্যারটা আহমদের কাছ থেকেই নেয় অমিয়। বদলে আহমদ স্কুটারটা নজরে রাখে। দরকারে অল্প অল্প টাকা ধার দেয়। অমিয়র দু-চারজন পাওনাদারকেও সে চিনে রেখেছে। নীচের তলা থেকেই তাদের তাড়ায়, বলে–তিনতলার সিঁড়ি খামোখা ভাঙবেন কেন, একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন।

সিঁড়িটা সত্যিই খাড়া। উঠতে জান বেরিয়ে যায়। সিঁড়ির আট ধাপে একটা ছোট্ট চাতাল। সেই চাতালটা আহমদের একটা সংসার। দুপুরে তার ভাত আসে, কাছেই কোনো স্কুলে পড়ে তার দুই ছেলে, টিফিনে তারাও এসে হাজির হয়। চাতালে বসে অন্ধকারে বাপ-ব্যাটারা ভাত খায়। গা ঘেঁষে লোকজন ওঠানামা করে, ধুলো ওড়ে, কাঠের সিঁড়ি কাঁপে, তবু তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। চাতালের একদিকে আহমদের পোঁটলা-পুঁটলি, দেয়ালের পেরেকে ঝোলানো জামাকাপড়, জুতো।

তিনতলায় উঠতে আজ বেশ কষ্ট হল। অফিস বলতে যা বোঝায় তা তো নয়। ঘরটা বড়োই, তার তিন অংশীদার। আসলে ঘরটার মূল ভাড়াটে কল্যাণ। দশ-বারো বছর আগে এই ঘর ভাড়া নিয়ে তৃষ্ণা অ্যাণ্ড কোং খুলেছিল। আজও কোম্পানি আছে, কল্যাণও আছে। তফাতের মধ্যে এই যে, সেই ঘরে পাশাপাশি টেবিলে আরও দুটো কোম্পানি চালু হয়েছে। একটা রজতের, একটা অমিয়র। তারা দু-জন কল্যাণের সাবলেটের ভাড়াটে। একই ঘরে এ রকম চার-পাঁচটা কোম্পানিও চলে। একটা টেলিফোন আর একটা ঠিকানা থাকলেই কলকাতায় ব্যবসায় নামা যায়।

মিশ্রিলাল বসে আছে। একমাত্র মিশ্রিলালকেই আহমদ কখনো ঠেকাতে পারেনি। ধৈর্যশীল মিশ্রিলাল ঠিক তিনতলা পর্যন্ত উঠবেই, উঠে অমিয়কে না দেখলে বসে থাকে, বসে থাকতে থাকতে ঝিমোয়। বিকেল পর্যন্তও বসে থাকে সে। অমিয়কে দেখে মিশ্রি একবার চোখ তুলে নামিয়ে নিল। হাতে একটা টেণ্ডারের চিঠি।

রাজের গ্লাসে ঢেকে জল রেখে গেছে। টেবিলে কাগজপত্র প্রায় কিছুই নেই। দুটো চিঠি। টেণ্ডার চিঠি দুটো দেখে রেখে দিল সে। চেয়ার টেনে বসল। রাস্তার ওপারে গভর্নমেন্টের একটা স্টোর। লরি থেকে মাল খালাস করছে। রাস্তায় ট্রামের শব্দ হচ্ছে, বাস যাচ্ছে। কাচের পাল্লাটা বন্ধ করে দিয়ে শব্দ আটকাল অমিয়।

মিশ্রি বলল, কিছু দেবেন নাকি?

ও সপ্তাহে।

ও বাবাঃ, তিনমাস হয়ে গেল। আমিও মাল তুলতে পারছি না, একজনকে নিয়ে তো আমার কারবার নয়!

ও সপ্তাহে এসো।

পুরো চাইছি না, কিছু দিন।

কোত্থেকে দেব? পেমেন্ট চারমাস আটকে আছে।

কেন?

সেনগুপ্ত চারটে এয়ারকণ্ডিশনিং মেশিন কিনেছিল, চারটে স্ক্র্যাপ। মেশিন আমার অর্ডারে খাইয়ে ঝগড়া করে ক্যাপিটাল তুলে নিয়ে গেল। তখনো জানতাম না যে স্ক্র্যাপ মেশিন খাইয়ে গেছে প্যাটারসনে। প্যাটারসন থেকে সেদিন চিঠি এসেছে, মেশিন স্ক্র্যাপ, পেমেন্ট হবে না। সব বিল আটকে রেখেছে। সাত হাজার টাকার।

চুক-চুক করে জিভে একটা ক্ষোভের শব্দ করে মিশ্রিলাল।

 সেনগুপ্ত ডুবিয়ে গেল একেবারে!

 অমিয় একটু হাসে। বলে–ডুবিয়ে যাবে কোথায়? ঠিক পেয়ে যাব।

বিলটার জন্য কবে আসবে? আমার তো বেশি নয়, মোটে ন-শো টাকা। আমি গরিব মানুষ।

মিশ্রি, বিলের আশা ছাড়। বরং আমাকে আরও কিছু ধার দাও। নগদ না দিলে মাল দাও। আমার হাতে তিনটে টেণ্ডার। দুটো লোয়েস্ট হয়েছে, আর একটাও পেয়ে যাব। এখন সেনগুপ্ত নেই, আমি একা। টাকা মার যাবে না।

মিশ্রি গলা চুলকোয়। বলে–তিনমাস পেমেন্ট পাচ্ছি না। কী যে বলেন। পুরোনো লোক বলে ছাড়ছি না আপনাকে কিন্তু। কম্প্রেসারের পার্টসের জন্য লোকে ছিঁড়ে ফেলছে আমাকে। নগদ টাকার ছড়াছড়ি। এসব মাল এখন ক্রেডিটে দেয় কোনো বুদ্ধ?

অমিয় জলটা একটু একটু করে খায়। স্বাদটা ভালো লাগে। তেষ্টা পেয়েছে খুব। গ্লাসটা আবার ঢেকে রেখে বলে–এবার কাটো তাহলে।

সামনের সপ্তাহে আবার আসব।

 রোজ আসতে পার। কিন্তু লাভ নেই।

বললেন যে আসতে। কিছু দেবেন। মোটে তো ন-শো টাকা।

ধৈর্যশীল মিশ্রিলাল ঝগড়া করে না। করলে করতে পারত। কিন্তু শান্ত মুখেই উঠে যায়। আবার ঠিক আসবে।

অমিয় নতুন টেণ্ডারের চিঠি দুটো টুকরো টুকরো করে ছেঁড়ে অন্যমনস্ক ভাবে; ছেঁড়া টুকরোগুলো টেবিলের ওপর সাজায় তাসের মতো। চেয়ে থাকে। সেনগুপ্ত কোথাও-না কোথাও আছে ঠিক। কলকাতা হচ্ছে একটি প্রকান্ড জলাশয়, তাতে ডুবসাঁতার কাটা যায়। কিন্তু একদিন-না-একদিন দেখা হবেই।

আজকালের মধ্যেই হাসি চলে যাবে। আজ বিকেলে বাসায় ফিরবার ইচ্ছে নেই অমিয়র। ফিরে খুব খারাপ লাগবে। হাসি যে কোথায় যাচ্ছে তা অমিয় জানে না। বোধহয় প্রথমে বাপের বাড়ি যাবে আসামে। তারপর বাগনানের কাছে এক গ্রামে, যেখানে ও চাকরি পেয়েছে, আগামী মাস থেকে চাকরি শুরু করবে। তারপর কী করবে হাসি? চাকরি করবে? তারপর? চাকরিই করবে! চাকরিই করে যাবে বরাবর! কিছু মনে পড়বে না! একা লাগবে না। খারাপ লাগবে না।

কল্যাণ টেবিলের ওপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে! তৃষ্ণা কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেছে। দু-জন কর্মচারী আউটডোরে ঘুরে বেড়ায়, কল্যাণকে কেবল অফিসটা দেখতে হয় আর ইনকাম-ট্যাক্স। কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেলে আর তেমন ভাবনা নেই। রজতের টেবিল খালি। বড়ো একটা থাকে না রজত, প্রচন্ড খাটে আর ঘোরে। দাঁড়িয়ে যাবে।

অমিয় নিঃশব্দে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবনাচিন্তা করার মতো মাথার অবস্থা নয়। মনে হয় বেশি ভাবতে গেলেই মাথায় সমুদ্রের মতো বিশাল ঢেউ উঠে সে পাগল হয়ে যাবে।

বসে থাকলে এরকম হবেই, অমিয় তাই উঠল।

কল্যাণ একবার তাকিয়ে বলল–কোন দিকে যাচ্ছেন?

যাই একবার প্যাটারসনে। ওদের কাল মিটিং গেছে। লাহিড়ী বলছিল একটা ডিসিশন হবেই। যদি কিছু হয়ে থাকে দেখে আসি।

মিশ্রিলাল কত পায়?

ন-শো।

গতকাল আমি একটা পেমেন্ট পেয়েছি। শচারেক দিতে পারি। মিশ্রিকে আপাতত কাটাবেন, কিছু দিয়ে হাতে রাখুন।

কেন?

ফুড সাপ্লাইয়ের টেণ্ডারটা ধরে রাখুন। মিশ্রিকে কিছু খাওয়ালে ক্রেডিটে আবার মাল দেবে।

আপনি তো দু-শো অলরেডি পান।

দেবেন এক সময়ে। পালাবেন কোথায়?

আবার চোখ বোজে। কল্যাণ ও-রকমই। খুব মহৎ কাজ ও খুব অবহেলার সঙ্গে করে। অমিয় ঠিক কৃতজ্ঞতা বোধ করতে পারে না। মনটা সেরকম নেই। সেনগুপ্ত পালিয়েছে, হাসি চলে যাচ্ছে। ব্যবসা ঝুল।

নীচে এসে স্কুটারটা চালু করে সে। ভীড় কাটিয়ে ধীরগতিতে এগোয়।

কাচের টেবিলে ছায়া পড়তেই লাহিড়ী মুখ তোলে।

 ভালো খবর মশাই।

কী?

আবার অর্ডার পাবেন। আপনার টেণ্ডার আমরা নেব। কাল খুব লড়ালড়ি হল আপনার জন্য।

কত টাকার অর্ডার?

কম। হাজার পাঁচেক। কিন্তু ব্যাড বুকে আছেন এখন, এই অর্ডারই আপাতত পাঁচলাখের সমান। মেশিনগুলি যদি পালটাতে না পারেন তবে অন্তত মেরামত করে দেবেন, বিল কিছু ছাঁট-কাট হবে। সাত হাজারের জায়গায় হাজার চারেক পেয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা পাবেন মেশিন মেরামতের পর।

অমিয় ম্লান মুখে বসে থাকে। খবরটা ভালোই। খুব ভালো। কিন্তু পাঁচ হাজারের অর্ডার ধরাও মুশকিল। পেমেন্টটা আটকে রইল।

লাহিড়ী চা বলল। তারপর জিজ্ঞেস করে–কী হয়েছে, খারাপ দেখছি যে!

কিছু না। শরীরটা ভালো নেই।

বয়স কত?

পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ।

লাহিড়ী গম্ভীর ভাবে বলে–ড্রিঙ্কস?

একটু-আধটু।

মেয়েছেলে?

নীল।

স্মোক?

দিনে চল্লিশ পঞ্চাশটা।

চেক-আপ করান। হার্ট, ব্লাড, ইউরিন।

চা-এসে যায়। দামি চায়ের গন্ধ। ভালো-লাগে অমিয়র। আস্তে আস্তে চেখে চেখে খায়। প্যাটারসন ওগিলভি অ্যামালগামেশান পুরোনো কোম্পানি। ব্রিটিশারদের হাত থেকে গত বছর কিনল এক পাঞ্জাবি। দশ বছর ধরে প্যাটারসনের সঙ্গে ব্যবসা করছে অমিয়। সকলের সঙ্গেই চেনা হয়ে গিয়েছিল, গুডউইল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেনগুপ্ত ডুবিয়ে দিয়ে গেল। পুরোনো সাপ্লায়ার বলে প্যাটারসন অমিয়কে ছাড়ল না, কিন্তু নীচু নজরে দেখবে এখন, বেশি টাকার অর্ডার দিতে ভয় পাবে।

লাহিড়ীর খাঁই বেশি নয়। ওয়ান পার্সেন্ট নেয় বিল থেকে। অন্য পারচেজ-অফিসারদের বায়নাক্কা অনেক। সেই তুলনায় লাহিড়ী দেবতা।

অমিয় উঠে বলল–অনেক ধন্যবাদ।

 লাহিড়ী হাসল, বলল–সেনগুপ্তর খবর কী?

খবর নেই।

 ক্যাপিটাল তুলে নিয়ে গেছে?

 হ্যাঁ!

ওসব মাল আমরা চিনি। আপনিই চিনতে পারেননি।

অমিয় দীর্ঘশ্বাসটা চেপে রাখে।

 নীচে এসে আবার স্কুটার চালু করে অমিয়। কোথাও যাওয়ার নেই। সব জায়গায় পাওনাদার বসে আছে। হাজার দশ-বারো টাকার ক্রেডিট বাজারে। গোটা দুই বিলের পেমেন্ট সামনের সপ্তাহে পাওয়া যাবে। তার আগে অমিয়র কোথাও যাওয়া হবে না। পেমেন্ট পেলেই কিছু ধার শোধ হবে। হাতে কিছুই থাকবে না।

প্যাটারসন ওগিলভি অ্যামালগামেশন পিছনে ফেলে অমিয়র স্কুটার ধীরগতিতে, ভ্রমরের গুঞ্জন তুলে চলতে থাকে। উদ্দেশ্যহীন।

চললে বাতাস লাগে। থেমে থাকলে গুমোটা একটা পেট্রোল পাম্পে থামতেই গুমোটটা টের পায় সে। তিনটে গাড়ি তেল নিচ্ছে কাজেই একটু অপেক্ষা করতে হয় তাকে। কাঁচা পেট্রোলের গন্ধে একটা মাদকতা আছে। গন্ধটা বরাবর ভালো লাগে তার। মন চনমন করে ওঠে। বুক ভরে সে পেট্রোলের গন্ধ নেয়। ঝিমোয়। কয়েক মুহূর্তেই শার্টের নীচে ঘাম কেঁচোর মতো শরীর বেয়ে নামে। হাতের তেলে ভিজে যায়।

পিছনে একটা গাড়ি তীব্র হর্ন দেয়। অমিয় ঝাঁকুনি খেয়ে চোখ চায়। সামনের গাড়ি চলে গেছে। অমিয় এগোয়। ট্যাঙ্ক-ভরতি তেল নেয়। আবার স্কুটার ছাড়ে। উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে থাকে।

মধ্যকলকাতার অফিসপাড়ায় কত বাড়ি তৈরি হচ্ছে। দারুণ দারুণ বাড়ি, লাখ লাখ টাকা খরচ। ভিতরে কোটি কোটি টাকার লেন-দেন।

অফিস, কোম্পানি, ব্যাঙ্ক, জীবনবিমার বাড়ির ছায়ায় ছায়ায় অমিয় তার স্কুটার চালায়। শরীরের ঘাম মরে আসে। হাসি কিছু টাকা চেয়েছে। কত টাকা তা বলেনি–স্টিলের আলমারিতে শ-তিনেক আছে মনে হয়। অমিয়র পকেটে বড়জোর শ খানেক। হাসি জানে, অমিয় এখন দড়ির ওপর হাঁটছে, তাই বেশি নেবে না বোধ হয়। হাসি টাকা চায় না। মুক্তি চায়। কিন্তু ওকে এ সময়ে কিছু টাকা দিতে পারলে অমিয় খুশি হত।

সোনাদা যে ব্যাঙ্কে চাকরি করে সেই ব্যাঙ্কটা পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থামে অমিয়। বছর তিনেক আগেই সোনাদা অ্যাকাউন্টস অফিসার ছিল। এখন কি আর একটু ওপরে উঠেছে! সাহেবি ব্যাঙ্ক, একগাদা টাকা মাইনে পায় সোনাদা। কপালটা বড়ো হয়ে হয়ে অনেকটা মাথা জুড়ে টাক পড়েছিল। এখন বোধহয় টাকটা পুরো হয়ে গেছে। সোনাদা বরাবর গম্ভীর। দেখা হলে হাসে না, কথাও বেশি বলে না। পাত্তা না দেওয়ার ভাব। কিন্তু অমিয় জানে, সোনাদা মানুষটা বাইরে ওইরকম, ওর মুখে কথা কম, ভাবের প্রকাশ কম। কিন্তু এখনও অমিয়কে দেখলে ওর চোখের পাতা কাঁপে। স্নেহে, মমতায়। কত কষ্ট করেছে সোনাদা! বড়ো কষ্টে মানুষ।

অমিয় স্কুটার থেকে নেমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্কটায় ঢুকে যায়। সোনাদার কাছে কোনো কাজ নেই। তবু একবার অনেকদিন বাদে দেখা করে যেতে বড্ড ইচ্ছে করছে। মনটা ভালো নেই।

কাউন্টারে ভীড়। অজস্র সুন্দর কাউন্টারে ছাওয়া চারদিক। রঙিন দেওয়াল, টিউবলাইট –সব মিলিয়ে ব্যাঙ্কটার ভিতরটা বড়ো চমৎকার।

জিজ্ঞেসা করতেই একজন পিয়োন সোনাদার ঘর দেখিয়ে দেয়। ঘষা কাচের পাল্লা। বাইরে টুলে বেয়ারা বসে আছে। একটা টেবিলের ওপর সাজানো স্লিপ, ডটপেন। নিজের নাম লিখে অমিয় স্লিপ পাঠায়। একটু পরে বেয়ারা এসে ডাকে।

প্রকান্ড টেবিলের ওপাশে সুন্দর পোশাকের সোনাদাকে প্রথমটায় আত্মীয় বলে ভাবতে কষ্ট হয় তার। গোলাপি রঙের টাক মাথায়, নীলাভ কামানো গাল, খুব ব্যস্ত।

একবার চোখ তুলে আবার কাগজপত্রে ডুবে গেল। বসতেও বলল না। অমিয় একটু হেসে নিজেই বসে।

সোনাদা ওইরকমই। বসতে বলে না। জানে, বসতে বলার কিছু নেই। অমিয় তো বসবেই। এটা তার সোনাদার ঘর নয় কী?

ছোটোবেলা থেকে তারা ভাই-বোনরা একে অন্যকে আপন বলে ভাবতে শিখেছিল। যৌথ পরিবার ওই একটা রক্তের গূঢ় সম্পর্ক তৈরি করে দিয়ে গেছে। এ জীবনে ওটা আর ভাঙবে না।

সোনাদা একবার একফাঁকে প্রশ্ন করে–শরীরটা দেখছি শেষ করেছিস?

হুঁ।

কেন?

 শরীরটা ভালো নেই।

কোম্পানি লালবাতি জ্বালেনি তো?

জ্বালছে। জ্বা

লাই উচিত। তখন যদি ব্যাঙ্কের চাকরিটা নিতিস, আজ কত মাইনে হত জানিস?

কত?

হাজার খানেকের ওপরে। গর্দভ।

মাসে ওর চেয়ে অনেক বেশি রোজগার আমি করেছি। ব্যবসা বলে তোমরা গুরুত্ব দাও না। বাঁধা মাইনের লোকেরা ব্যবসাকে ভয় পায়।

সোনাদা ভ্রূ কুঁচকে একটু তাকায়। কোথায় একটা গোপন বোতাম টেপে, বাইরে রি-রি করে বেল বাজে। বেয়ারা এলে সোনাদা চা আনতে বলে। তারপর আবার কাজেকর্মে ডুবে যায়।

ঠাণ্ডা ঘরখানা। অমিয়র ঝিমুনি আসে।

সোনাদা আবার চোখ তুলে তাকে দেখে, হঠাৎ জিজ্ঞেস করে–প্রবলেমটা কী?

তুমি বুঝবে না। অমিয় শ্বাস ছাড়ে, তারপর বলে–সোনাদা, তুমি কী প্রমোশন পেয়েছ?

 চাকরিতে থাকলে প্রমোশন হয়। তার মতো ব্যবসাদাররা চিরকাল ব্যবসাদার থেকে যায়।

তুমি কী খুব বড়ো পোস্টে আছ?

সোনাদা হাসে। মাথা নাড়ে।

তাহলে আমার ব্যবসার জন্য তোমার ব্যাঙ্ক থেকে কিছু ধার পাইয়ে দাও না!

তোকে ধার দেবে কেন? ইণ্ডাষ্ট্রি বা এগ্রিকালচার হলেও না হয় কথা ছিল।

যদি সিকিউরিটি দেখাই, যদি হাই ইন্টারেস্ট দিই?

সোনাদা ভ্রূ কুঁচকে বলে–তোর আবার সিকিউরিটি কী? একটা পুরোনো স্কুটার, ত্রিশ নম্বর ধর্মতলায় একখানা ভাগের অফিস। আর কী আছে তোর? বড়জোর একখানা রিফিউজি সার্টিফিকেট, তা সেখানাও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছিস! কাজে লাগাতে জানলে রিফিউজি সার্টিফিকেটও একটা মস্ত অ্যাসেট–কিন্তু তা তুই লাগালি কোথায়?

অমিয় চুপ করে থাকে।

সোনাদা আবার জিজ্ঞাসা করে–প্রবলেমটা কী?

অমিয় উত্তর দেয়–তুমি বুঝবে না। মানুষ কতরকম গাড্ডায় যে পড়ে সোনাদা!

তোর গাড্ডাটা কী রকম?

অমিয় শুধু হাসে। চারদিকে একবার তাকায়। যে চেয়ারে সে বসে আছে তা ফোম রবারের গদিওয়ালা, টানলে শব্দ হয় না, ভীষণ ভারী। টেবিলখানা লম্বা এল-এর মতো। ঘষা কাচের দরজা, ঢেউখেলানো কাচ দিয়ে তৈরি ঘরের পার্টিশন। ওপাশে লোকজন চললে কাচের ঢেউয়ে বিচিত্র প্রতিবিম্ব দেখা যায়। এই একখানা চেম্বার করতেই ইন্টিরিয়র ডেকরেটর অন্তত দশ বিশ হাজার কি তারও বেশি নিয়েছে। এ-রকম একখানা অফিস-ঘর বানাবার ইচ্ছে তার অনেকদিনের কিন্তু হবে না আর। এ-রকম নিস্তব্ধ, কাচের ঘর, মাছি উড়লে সেখানে শব্দ পাওয়া যায়, এ-রকম ঠাণ্ডা ঘর, ফোম রবারের গভীর তলিয়ে-যাওয়া গদি, বিচিত্র ডিজাইনের সেক্রেটারিয়েট টেবিল, আলো-এইসব আর কোনোদিন হবে না।

লাঞ্চে তুমি কী খাও সোনাদা?

তোর মুন্ডু।

এই ঘরটা সাজাতে কত খরচ পড়েছে?

তোর মতো দশটা ব্যবসাদারকে বিক্রি করলে যত ওঠে।

 এরা তোমায় বাড়িভাড়া দেয়? গাড়ি?

সোনাদা তাকে গ্রাহ্য না করে কাজ করে যায়। কিন্তু সোনাদার কপালে কয়েকটা দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দেয়। কাজ করতে করতেও এক-আধবার চোরা চোখে অমিয়কে দেখে নেয়।

অমিয় বলে–উঠি।

বোস। প্রবলেমটা কী বলে যা।

কিছু না।

টাকা সত্যিই চাস?

অমিয় মাথা নাড়ে–না।

 দরকার হলে ম্যাক্সিমাম হাজার খানেক নিতে পারিস। ব্যাঙ্কের টাকা নয়, আমার টাকা।

 কোনোদিন নিয়েছি?

সোনাদা চুপ করে থাকে।

অমিয় বলে–তুমি যদি সাপ্লায়ার হতে, কিংবা সুদখোর মহাজন, কি আমার ক্লায়েন্ট, তো নিতাম। তুমি আমার সোনাদা, কিন্তু আমার ব্যবসার কেউ নও। তোমার কাছ থেকে নিলে আমি তোমার আর পাঁচজন আত্মীয়ের মতো নীচু হয়ে যাব।

তার মানে?

অমিয় হাসে–আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে তুমিই সবচেয়ে সাকসেসফুল। তোমার কাছ ঘেঁষে বহু আত্মীয় ঘোরাফেরা করে, আমি জানি। কিন্তু তুমি জেনে রেখো, আমি তাদের দলে নই।

সোনাদা একটু হাসে।

সোনাদা, আমার একটা প্রবলেমের কথা তোমাকে বলব? শুনবে ঠিক?

সোনাদা ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। ছোট্ট একটা নড করে।

আমি প্রায়ই একটা স্টিমারঘাটকে দেখতে পাই।

সোনাদা নড়ে-চড়ে বসে বলে–কীরকম?

আমি যেন উঁচু বালির চড়ায় বসে আছি। অনেক দূর পর্যন্ত বালিয়াড়ি গড়িয়ে গেছে– আধমাইল-একমাইল-তারপর ঘোলা জল–একটা জেটি–প্রকান্ড নদী দিগন্ত পর্যন্ত। কখনো কখনো দেখি, রাতের স্টিমারঘাট-কেবল বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলে, জেটির গায়ে জলের শব্দ–ওপারে ভীষণ অন্ধকার। কেন দেখি বলো তো?

সোনাদা তাকিয়ে থাকে।

এ কি মৃত্যুর-প্রতীক নাকি? অমিয় বলে।

 ইয়ার্কি হচ্ছে?

ইয়ার্কি নয় সোনাদা। কাজকর্মে, ঘুরতে ফিরতে হঠাৎ হঠাৎ চোখের সামনে ওই বালিয়াড়ি, আর বালিয়াড়ির পর জেটি, জল–এইসব ভেসে ওঠে।

সোনাদার চোখ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ব্যস্ত সোনাদা একটু হেলান দিয়ে বসে। টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে ইণ্ডিয়া কিংসের সোনালি প্যাকেটটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। মৃদু ধোঁয়ার গন্ধ অমিয়র নাকে এসে লাগে। সোনাদার সামনে খায় না, নইলে এই মুহূর্তে তারও একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যৌথ পরিবারের শিকড়-বাকড় সব রয়ে গেছে ভিতরে। সোনাদার সামনে কোনোদিনই সিগারেট খাওয়া যাবে না।

সোনাদা বলে–এ সবই নস্টালজিয়া। আমারও হয়। দেশের বাড়িতে করমচা তলার ছায়ায় মাটির ওপর শ্যাওলা গজাত। সেই ঠাণ্ডা জায়গাটার কথা হঠাৎ কেন যে মনে পড়ে।

অমিয় মাথা নাড়ে-না এটা শৈশব-স্মৃতি নয়। স্টিমারঘাট আমি আর কবার দেখেছি। দু তিন বার বড়ো জোর। তারপরই তো কলকাতায় পার্মানেন্ট চলে এলাম। তা ছাড়া সেই স্টিমারঘাট তো দেশে যাওয়ার গোয়ার্লন্দী ঘাট নয়। এটা কেমন যেন ধু-ধু বালুর চর, নির্জন অথৈ ঘোলা জল, ওপারটা দেখা যায় না।

সোনাদা হাসে। বলে–ভালো খাওয়া-দাওয়া কর। হাসিকে নিয়ে কিছুদিন বাইরে-টাইরে ঘুরে আয়।

অমিয় অবাক হয়ে বলে-কেন?

তাহলে ওসব সেরে যাবে।

সারাতে চাইছে কে? আমার তো খারাপ লাগে না। কলকাতার ভিড়ভাট্টা, গরম, ঘাম, কাজকর্মের ভিতরে মাঝে মাঝে হঠাৎ ছুটি পেয়ে একটা অচেনা স্টিমারঘাটে চলে যাই, বালিয়াড়িতে বসে থাকি, বেশ লাগে। একে সারাব কেন? শুধু জানতে চাইছি, ব্যপারটা কী। তুমি জানো?

উত্তর দেওয়ার সময় পায় না সোনাদা। স্টেনোগ্রাফার পার্সি মেয়েটি ঘরে ঢোকে। লম্বা ফর্সা, ভাঙাচোরা মুখ। তবু মুখে একটা অদ্ভুত শ্ৰী আছে। দারুণ একখানা বাটিকের শাড়ি পরনে। মেয়েটা সোনাদার ডানদিকে গিয়ে নীচু হয়ে একটা টাইপ করা চিঠি দেখায়। কথা বলাবলি হয়। ততক্ষণ অমিয় মেয়েটার শাড়িটা দেখে। হয়তো-বা এরকম শাড়িতে হাসিকে ভালো মানাত। হাসির কথা মনে পড়তেই অমিয়র একধরনের শারীরিক কষ্ট হয়। বুক পেট জুড়ে একটা তীক্ষ্ণ বেদনার আভাস পাওয়া যায়। দম বন্ধ হয়ে আসে। বুক ধড়ফড় করে। একটা চেক-আপ বোধহয় অমিয়র দরকার ছিল। বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ, ইররেগুলার জীবন, অতিরিক্ত চা আর সিগারেট, ব্যবসার উত্তেজনা, শক, সব মিলিয়ে ভিতরটা ভালো থাকার কথা নয়। হাসিকে এই শাড়িটায় বোধহয় এখনও মানায়। নীলের ওপর হলুদ বাটিকের কাজ। পকেটে এক-শোর কাছাকাছি টাকা আছে। বাজার ঘুরে একবার খুঁজে দেখবে নাকি শাড়িটা। অবশ্য তা আর হয় না। হাসি বড়ো অবাক হবে, তাকিয়ে থাকবে বা দু-একটা বিদ্রুপাত্মক কথাও বলতে পারে। দরকার নেই। হাসি নিষ্ঠুর। তার হৃদয় নেই।

মেয়েটা ফাইলিং ক্যাবিনেটে কাগজপত্র ঘাঁটে। সোনাদা আবার কাজকর্মে ডুবে যায়। একজন দুজন করে অফিসে লোকজন আসে। সুন্দর পোশাকের চটপটে লোকেরা। সোনাদা হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডশেক করে, চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলে। বিজনেসের পিক-আওয়ার। সোনাদার দম ফেলার সময় নেই।

এক ফাঁকে অমিয় বলে–সোনাদা, উঠি।

কাগজপত্র ঘেঁটে কী একটা খুঁজে পায় সোনাদা। সেটা দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ তুলে অমিয়কে বলে–সামনের সোমবার নিন্টুর জন্মদিন। তোর বউদি হয়তো হাসিকে খবর দিয়েছে। তবু বলে রাখছি, বিকেলের দিকে হাসিকে নিয়ে চলে যাস, রাতে খেয়ে একেবারে ফিরবি।

আচ্ছা।

 তোর স্টিমারঘাটের ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখব।

অমিয় হাসে। জন্মদিনে যাওয়া হবে না। স্টিমারঘাটের কথা সোনাদা ভুলে যাবে।

ব্যাঙ্কটা থেকে বেরোতেই জ্বরো কলকাতা চেপে ধরে। কী তাপ রোদের। গুমোট।

 অমিয় তার স্কুটার চালু করে। কোথায় যাবে, ভেবে পায় না, তবু যায়। যেতে থাকে।

টিফিন। কিন্তু টিফিনের সময়েও সোমাদি বাইরে যায় না, আড্ডা মারে না। নিজের জায়গায় বসে থাকে। প্রকান্ড হলঘরের একধারে টাইপিস্টদের সারি সারি মেশিন। সব খালি। কেবল সোমাদি ঠিক বসে আছে। ডান হাতে একখানা এক-কামড় খাওয়া টোস্ট, আলতোভাবে ধরা, বাঁ হাত মেশিনে ছোবল মারার জন্য উদ্যত। অমিয় এগিয়ে যেতে যেতে শুনল টুক করে মেশিনের একটা অক্ষর লাফিয়ে উঠল। অমিয়র করুণা হয়।

সোমাদির বয়স পঁয়তাল্লিশের নীচে নয়। সিঁথির কাছে চুল পাতলা হয়ে এসেছে। চোখে প্লাস পাওয়ারের চশমা! রোগা গড়নের বলে বয়স খুব বেশি দেখায় না, কিন্তু দীর্ঘদিনের ক্লান্তির ছাপ আছেই। নাকের দু-ধার দিয়ে গভীর রেখা নেমে গেছে, মেচেতার ছোপ ধরেছে মুখে। বছরে বড়োজোর এক দু-দিন ছুটি নেয়। চোদ্দো বছর টানা চাকরি করছে আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল কন্ট্রোলে, তবু চাকরি পাকা হয়নি। কন্ট্রোল উঠে যাবে বলে চাকরি কারোরই পাকা নয় এখানে। ওর বিয়ের জন্য কেউ তেমন করে চেষ্টাই করল না। পিসেমশাই মারা যাওয়ার পর একটা চাকরিতে ঢুকেছিল, তারপর চাকরিই করে গেল। বার দুই দু-টি ছেলেকে বোধহয় ভালো লেগেছিল। তাদের একজন ছিল ভিন্ন জাতের, অন্যজনের ছিল কম বয়স। হল না। হবেও না। সোমাদি তা জানে বলেই কোথাও আর যায় না। মনপ্রাণ দিয়ে চাকরি করে! ছুটি পেলে হাঁফ ধরে যায়।

টোস্টটা আর এক-কামড় খাওয়ার জন্য মুখের কাছে এনে সোমাদি তাকায়। প্রথমটায় বোধহয় চিনতেই পারে না। তাকিয়ে থাকে।

সোমাদি, কেমন আছ?

সোমাদি টোস্টটা রেখে দিয়ে একটু চেয়ে থেকে বলে–বেরো, বেরিয়ে যা।

কেন?

লজ্জা করে না? একবছরের মধ্যে একবার মাকে দেখতে যাওয়ার সময় হয়নি? কত বড়ো অসুখ গেল মা-র, তোকে দেখার জন্য আকুলি-বিকুলি, তিনটে চিঠি দিলাম, একটা উত্তরও দিসনি। বেরো–কেন এসেছিস?

তুমি কত মাইনে পাও?

তাতে কি দরকার? চালাকি ছাড়।

 চালাকি না। সত্যিই জিজ্ঞেস করছি।

ভারি তো ব্যবসা। অফিসে মাছি ওড়ে, সেই ব্যবসা করেই তোর সময় হয় না। অমানুষ!

 একটা চেয়ার টেনে অমিয় বসে নিজের থেকেই। মাঝখানে মেশিন, ওপাশে সোমাদি। বলে –এর পরের জেনারেশনে আর এইসব চোটপাট শোনা যাবে না সোমাদি। যা বকাবকি করার তা তোমরাই করে নিলে।

তার মানে?

আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা ফ্যামিলি আছে। স্বামী স্ত্রী আর বাচ্চা ছেলে একটা একদিন সাজগোজ করে বিকেলে কোথায় বেরোচ্ছে, ছেলেটার গাল টিপে জিজ্ঞেসা করলাম– কোথায় যাচ্ছ বাবু? সে উত্তর দিল–ঠাকুমার বাড়ি। বুঝলে সোমাদি, কথাটা সেই থেকে বুকে মাঝে মাঝে ধাক্কা দেয়। ঠাকুমার বাড়ি! মাই গড, ঠাকুরমার বাড়ি যে একটা আলাদা বাড়ি, সেখানে যে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাওয়া যায় তা আমরা ভাবতেই পারি না এখন। ঠাকুমার বাড়ি আবার কী? ঠাকুমা যে আমাদের রক্ত-মাংস-মজ্জায় মিশে আছে–তার বাড়ি কী করে আলাদা বাড়ি হয়। এই যে তুমি আমাকে বকছ, পিসিমাকে দেখতে যাইনি বলে, এসব সম্পর্কের টান আমাদের সময়েই শেষ। এরপর পিসতুতো মামাতো ভাইবোনে দেখা হলে হয়তো হাতজোড় করে নমস্কার করবে, আপনি আপনি করে কথা বলবে। বলবে– একদিন কিন্তু আমাদের বাড়িতে যাবেন, কেমন। খুব খুশি হব।

সোমাদি একটু হাসে। বলে, তোর সঙ্গে তো আমাদের সম্পর্ক তাই দাঁড়িয়ে গেছে। একবছরে ঢাকুরিয়া থেকে বেহালা যাওয়ার সময় হয় না, কী করে বুঝব যে সম্পর্ক রাখতে চাস?

গত একবছর ধরে আমি ভালো নেই সোমাদি।

কী হয়েছে?

তুমি কত মাইনে পাও বললে না?

জেনে কী হবে?

 এমনিই। কৌতূহল। বলো না।

সব কেটে ছেঁটে পৌনে আট-শো। হাসি কেমন আছে?

 ভালো। গত বছর তুমি একটা স্টিলের আলমারি কিনেছ, আর একটা সিলিং ফ্যান, না?

 সোমাদি হাসে–এ বছর একটা সুতোর কার্পেট কিনেছি, ড্রেসিং টেবিল করেছি, গ্যাসের উনুন কিনেছি। দেখে আসিস।

পৌনে আট-শোর মধ্যে কী করে ম্যানেজ করো? তোমার তো উপরিরও রাস্তা নেই।

 এইসব জানতেই এসেছিস? হাসিকে নিয়ে কবে যাবি বল?

তোমার পোষ্যও তো কম নয়। পিসিমা, নীতা, তোমার এক জ্যাঠতুতো ভাই তোমার কাছেই থাকে, কী করে ম্যানেজ করো?

কী করব! তোরা ভাইরা তো আর মাসোহারা দিস না, ওতেই কষ্টে-সৃষ্টে ম্যানেজ করে নিই। একটা টোস্ট দিয়ে টিফিন সারি, বিড়ি সিগারেট খাই না, সাদামাটা পোশাক পরি, সিনেমা দেখি কালে-ভদ্রে, কোথাও বেড়াতেও যাই না। তোমাদের তো তা নয়। হাসির খবর কিছু বললি না, বাচ্চা কাচ্চা হবে নাকি?

-তুমি খুব কষ্ট করো, না সোমাদি?

–দূর পাগলা, তোর হয়েছে কী? এসব বলছিস কেন?

–তুমি এত কষ্ট করছ কেন?

–কেন আবার, নিজের জন্য।

–দূর! নিজের জন্য কষ্ট করে সুখ কী। কষ্ট করলে করতে হয় ভালোবাসার মানুষের জন্য। তুমি সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসো সোমাদি?

-কী জানি? তোর হয়েছে কী?

–কিছু না!

–হাসিকে নিয়ে কবে যাবি? হাসি তো আমাদের ভালো করে চিনলই না।

–যাব একদিন ঠিক। আগে বলো, তুমি কার জন্য এত কষ্ট করছ?

–বললাম তো, নিজের জন্য।

–তবে তো তুমি নিজেকে ভালোবাসো।

–বললাম তো, বাসি।

–আমি বাসি না।

 –তুই হাসিকে বাসিস। ভালোবাসলেই হল।

–নিজেকে ভালোবাসলে হাসিকেও ভালোবাসা যায়। এই যে তুমি নিজেকে ভালোবাসো বললে, স্বামী-পুত্র হলে তাদেরও বাসতে, বাধা হত না। ভালোবাসা তো মাস মাইনে নয় যে টান পড়বে।

–হাসির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস নাকি? কী হয়েছে বল? দরকার হলে আমি না হয় গিয়ে হাসিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মিটমাট করে আসি। মাত্র তিন বছর হল বিয়ে, এখনই ঝগড়াঝাঁটি হলে–

–পাকামি কোরো না। ম্যারেড লাইফ সম্পর্কে তুমি কী জান? ওই ব্যাপারে আমি তোমার সিনিয়র।

–তা হলে এই গরম দুপুরে ঘামে নেয়ে এসে ভালোবাসা-ভালোবাসা করছিস কেন? কিছু খাবি? বেয়ারা ডেকে কিছু আনিয়ে দিই। একটা ডিমভাজা–না গরমে একটু দই খাবি?

–আমার মুশকিল কী জান?

–কী?

–আমি হাসিকে ভালোবাসতাম, ব্যবসাকে ভালোবাসতাম, স্কুটারকে ভালোবাসতাম, কিন্তু এইসব ভালোবাসার মধ্যে মাঝে মাঝে একটা স্টিমারঘাট এসে পড়ছে।

–স্টিমারঘাট?

–হুঁ।

 সোমাদি চেয়ে থাকে। বলে–কী বলছিস?

-খুব উঁচু বালিয়াড়ি থেকে তুমি কখনো কোনো নির্জন ফেরিঘাট দেখেছ? একটা জেটি –তারপর বিশাল ঘোলা জলের নদী–ওপারটা ধূ-ধূ করে–দেখা যায় না। দেখেছ? আমি চোখ বুজলেই দেখি।

সোমাদির মুখটা কেমন হয়ে যায় যেন। বয়েস হয়ে যাওয়া, কৃচ্ছসাধনের ছাপ-ওলা নীরস মুখ সোমাদির। তবু কয়েক পলকের জন্য যেন একটা কোমলতা গাছের ছায়ার মতো মুখে খেলা করে। মুখের কর্কশ লেখাগুলি লাবণ্যের সঞ্চারে হঠাৎ ডুবে যায়।

–কোন স্টিমারঘাটের কথা বলছিস? কলকাতার গঙ্গা, নাকি গোয়লন্দ, আমিনগাঁতেও ফেরিঘাট দেখেছিলাম।

-ওসব নয়। এ একটা অন্যরকম ফেরিঘাট। বহু দূর পর্যন্ত বালিয়াড়ি, তারপর ঘোলা জল –চোখ বুজলেই দেখতে পাই। ভীষণ ভয় করে, আবার ভীষণ ভালোও লাগে।

–আমি ঠিক জানি, তুই হাসির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস। কিংবা ব্যবসাতে মার খেয়েছিস। কত টাকা রেখে গিয়েছিল মামা?

-হাজার দশেক।

–সেটাই ভুল হয়েছিল। কে যে তোর মাথায় ব্যবসা ঢুকিয়েছিল। বাঙালি ছেলে আবার কবে ব্যবসা করতে শিখেছে। তার চেয়ে একটা বাড়ি করে ভাড়াটে বসিয়ে গেলে

–স্টিমারঘাটটার কথা তুমি কিছু জান না, না?

–কী জানব? তোর মাথায় যতসব পাগলামির পোকা। হাসিকে নিয়ে কবে আসবি বল?

–তোমার কিছু মনে হয় না? স্টিমারঘাট বা ওরকম কিছু?

সোমাদি হাসে। বলে–আচ্ছা জ্বালাতন! ভাবনাচিন্তা করার সময় কোথায় আমার বল তো? সকাল সাড়ে আটটার লেডিজ স্পেশাল ধরতে বেরোই, মাইলখানেক হেঁটে বাস-রাস্তা, অফিসে সারাক্ষণ কাজ, ফিরতে ফিরতে আটটা হয়ে যায়। তখন শরীরে থাকে কী? খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, স্বপ্নও দেখি না।

অমিয় শ্বাস ফেলে। বলে–তুমি কাঠ হয়ে গেছ।

একটু ইতস্তত করে সোমাদি বলে–তোর দেশের পুকরঘাটের কথা মনে পড়ে। খুব বড়ো বড়ো কচুপাতা বাতাসে নড়ত। মাছ ফুট কাটত জলে। কদমগাছের ছায়ায় আমরা গঙ্গা-যমুনা খেলতাম। মনে হওয়ার কি শেষ আছে! কত কী মনে হয়। ওসব নিয়ে ভাবনার কী। হাসির সঙ্গে ভাব করে ফেল। ফেরার সময়ে একখানা শাড়ি আর দুটো সিনেমার টিকিট কিনে নিয়ে যা। কালকের দিনটা হোটেল-রেষ্টুরেন্টে খাস। এরকম একটু-আধটু করলেই দেখিস আর ঝগড়া হবে না।

-তুমি এসব কবে থেকে ভেবে রেখেছ সোমাদি! বিয়ে হলে বরের সঙ্গে কীরকম সব মান-অভিমান হবে, সব ভেবে রেখেছিলে। আর বলছ, ভাববার সময় পাও না!

–সোমাদি হেসে ওঠে। বলে–ঠিক বলেছিস।

একজন দু-জন করে মেশিনগুলোর সামনে মেয়েরা এসে বসছে। টিফিন শেষ।

অমিয় উঠে দাঁড়ায়।

–চলি।

সোমাদি গ্লাস পাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে তাকায়। চোখে অন্যমনস্কতা। বলে সম্পর্কটা রাখিস অমিয়। মাকে গিয়ে দেখে আসিস। হার্ট ভালো না, কখন কী হয়ে যায়।

–যাব।

অফিসে এসে অমিয় দেখে, কেউ নেই। দুপুরের ডাকে ইন্সিয়োরেন্সের একটা চিঠি এসেছে। গতবছরের প্রিমিয়াম বাকি। বছর তিনেক আগে, বিয়ের পরই দশ হাজার টাকার একট পলিসি করিয়েছিল। দু-বছর প্রিমিয়াম টেনেছে। যাকগে, পেইড-আপ হয়ে যাবে।

গ্লাসের নীচে চাপা দিয়ে কল্যাণ একটি চিঠি রেখে গেছে–বাগচী, হায়দার তাগাদায় এসেছিল। ভুজং-ভাজুং দিয়ে বিদায় করেছি। ইনকাম-ট্যাক্সের অজিতকে একবার ফোন করবেন, ওকে আপনার কথা বলা আছে। ওর দাদা একটা লোন সোসাইটির মেম্বার, একটা লোন পাইয়ে দিতে পারে। আমি সিনেমায় যাচ্ছি, আজ ফিরব না। রাজেনের কাছে চার-শো টাকা রাখা আছে। কাল সকালেই গিয়ে মিশ্রিলালকে দিয়ে আসবেন। ফুড-সাপ্লাইটা ছাড়বেন না,..

চোখটা একটু ঝাপসা লাগে। চিঠিটা রেখে দেয় অমিয়। অফিস ঘরটা নির্জন। পাখার হাওয়ায় কোথায় যেন একটা কাগজ ওড়বার শব্দ হয় কেবল। অমিয় বসে হাই তোলে। তারপর টেবিলে মাথা রেখে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।

–বিকেলের দিকে রজত ফিরে এসে ডাকে–বাগচী

-উঁ।

–আমার কাছে কেউ এসেছিল?

না।

–দূর! কেউ আসে নি!

 –রাজেনকে জিজ্ঞেস করুন তো।

করেছি। ও তো বিশবার বাইরে যাচ্ছে চা, খাবার সিগারেট আনতে। আমার মোটর পার্টসটা দিয়ে গেল না শালা রায়চৌধুরি। কাল ডেলিভারি নিতে আসবে।

অমিয় আড়ামোড়া ভাঙে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। বাইরে এখনও ফর্সা রোদ।

রজত তার চেয়ার টেনে বলে–ব্যবসার মুখে পেচ্ছাপ। ভিসা পেয়ে যাচ্ছি কাল।

কবে রওনা?

–দিন পনেরোর মধ্যে। প্রথমে ডুসেলডর্ফে যাব মাধুর কাছে। সেখান থেকে বন হয়ে কাজের জায়গায়। দাঁড়ান, আজ আমি চা খাওয়াব, সন্দেশ খাবেন?

খাব। খুব খিদে পেয়েছে। অমিয় বলে।

বেল বাজায় রজত। রাজেন এলে চা সন্দেশ আনবার পয়সা দেয়। তারপর অমিয়কে বলে–খুব দামি সিগারেট কী আছে বলুন তো?

–আপনি তো খান না।

আজ খাব।

 –ইণ্ডিয়া কিংস।

 রাজেনের দিকে ফিরে রজত বলে–ইণ্ডিয়া কিংস এনো, এক প্যাকেট, আর দেশলাই। বাগচী, যাওয়ার আগে একটা পার্টি দেব।

অমিয় হাসে।

–শুধু একটা ভয়, বুঝলেন বাগচী।

–কী?

এর আগে গুরুপদ গিয়েছিল। ল্যাংগুয়েজ জানত না বলে ওকে ফেরত পাঠিয়েছে। আমিও ভালো জানি না। ওদিকে ব্রজগোপালদাকে দিয়ে জার্মান ভাষায় করেসপণ্ডেন্স করেছি, নিজে শেখবার সময়ই পেলাম না। শেষে গুরুপদর মতো ফেরত পাঠাবে না তো?

–সকলের কপাল সমান না।

চেয়ারটা পিছনে হেলিয়ে একটু দোল খায় রজত। ভাবে। বলে–অবশ্য মাধুও জানত না। কোম্পানি ওকে তবু রেখে দিয়েছে।

অমিয় রজতকে একটু দেখে। অন্তত দশ বছরের ছোটো রজত। বাচ্চা ছেলে কোনো জমিতেই শেকড় নেই। কলকাতায় জন্ম-কর্ম। অমিয়র মনে হয়, কলকাতায় জন্মালে মাটির টান থাকে না। রজতের খুব ইচ্ছে, আর ফিরবে না। একটা আবছায়া স্টিমারঘাট চোখের সামনে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। অমিয় ক্যালেণ্ডারের ছবিটা দেখে। একটা মেয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথায় একটা কলসী, কোমরের কলসীটা কাত করে ধরা তা থেকে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে।

রজত মুখ তুলে বলে–আমার একটা লাভ অ্যাফেয়ার প্রায় ম্যাচিওর করে এসেছিল, বুঝলেন বাগচী!

-হুঁ।

–সেটার কী করব বলুন তো?

 –আপনার কী ইচ্ছে?

–ইচ্ছে নেই।

–অমিয় চেয়ে থাকে।

রজত আবার বলে–চলেই যাচ্ছি যখন, তখন আবার এখানে একটা ফ্যাঁকড়া রেখে যাই কেন! মেয়েটা হয়তো অপেক্ষা করবে। করতে করতে বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে। এক ফাঁকে এসে অবশ্য বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু তার আর কী দরকার? ওখানেই যখন বরাবর থাকব তখন ওদিকেই বিয়ের সুবিধে। তাই মেয়েটাকে সব বুঝিয়ে কাটিয়ে দিয়ে যাব। ভালো হবে না?

অমিয় মাথা নেড়ে বলে–হবে।

রজতকে খুশি দেখায়। সে একবার শিস দেয়, দু-কলি গান গুনগুন করে গায়।

কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছে। কেউ আসছে। টপ করে নিজের অজান্তেই উঠে পড়ে অমিয়।

–রজতবাবু, কেউ এলে কাটিয়ে দেবেন। আমি বোসের ঘরে ফোন করতে যাচ্ছি।

 রজতের অভ্যাস আছে। অনেকদিন ধরেই অমিয়র সময় ভালো যাচ্ছে না। রজত মাথাটা হেলিয়ে একটু হাসল–ঠিক আছে ঠিক আছে। বাগচী, উই আর কমরেডস আফটার অল–

সিঁড়ি দিয়ে যে উঠছে সে যে-ই হোক অল্পের জন্য অমিয়কে ধরতে পারল না। অন্ধকার প্যাসেজটা প্রায় লাফিয়ে পার হয়ে এল অমিয়।

বোস বুড়ো মানুষ। দুই ভাই পাশাপাশি চেয়ারে বসে থাকে। এক সময়ে ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটার হিসেবে একটু নাম ছিল। এখন কিছু নেই। অফিস আছে। এই পুরো তিনতলাটা তাদের লিজ নেওয়া। লিজ নিয়ে কল্যাণের তৃষ্ণা এবং আরও কয়েকজনকে অফিস ভাড়া দিয়েছে। ওইটাই আয় এখন। জটাওয়ালা একজন তান্ত্রিক এসে প্রায়ই দুই ভাইয়ের মুখোমুখি বসে থাকে। আজও আছে। ঠাণ্ডা অন্ধকার ঘরে তিনজন বয়স্ক নিস্তব্ধ মানুষ। কোনো কাজ নেই।

টেলিফোনটার সামনে একটু দাঁড়ায় অমিয়। কাকে ফোন করবে বুঝতে পারে না। কোনো নম্বর মনে আসে না। তবু হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নেয়, ডায়াল টোন শোনে। কিড়-কিড় শব্দ হয়। কোনো নম্বর মনে আসে না। তবু অমিয় আঙুল বাড়ায়। দুইয়ের গর্তে আঙুল ঢুকিয়ে ডায়াল ঘোরায় তারপর তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত…। অপেক্ষা করে। টেলিফোন একটু নিস্তব্ধ থাকে। তারপর খুট করে একটা শব্দ হয়। পরমুহূর্তে হঠাৎ অমিয়কে চমকে দিয়ে ওপাশে একটা দীর্ঘ টানা মুমূর্ষু চীৎকার শোনা যায়–অমিয়–ও–ও, অমিয়–ও–ও, অমিয়-ও-ও

অমিয় কেঁপে ওঠে প্রথমে। কে? বলে চীৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়। তারপর বুঝতে পারে, ওটা এনগেজড সাউণ্ড। ধীর কান্নার মতো বিষণ্ণ শব্দ। কতবার শুনেছে সে। আসলে মনটা ঠিক জায়গায় নেই। ফোনটা আবার রেখে দেয় অমিয়। দাঁড়িয়ে থাকে। একটু আগে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কে উঠে এল তা ভাবতে চেষ্টা করে। অন্ধকার সিঁড়িতে আবছায়া নতমুখ একটা অবয়বকে এক ঝলক দেখেছিল। একটু সময় কাটানো দরকার।

আবার ডায়াল ঘোরায় অমিয়। সম্পূর্ণ আন্দাজে। কোন নম্বরে আঙুল তা তাকিয়ে দেখে না। খুব খিদে পেয়েছে অমিয়র। মুখটা তেতো তেতো। বোধ হয় পিত্তি পড়েছে। সকাল থেকে সে প্রায় কিছুই খায়নি। মাথাটা ঘোরে। শরীর দুর্বল লাগে। এরপর থেকে অফিসের নীচে, খোলা রাস্তায় আর স্কুটারটা রাখা যাবে না। নীচে স্কুটারটা দেখে সবাই বুঝতে পারে, অমিয় অফিসে আছে। আহমদকে বলবে একটা গোপন জায়গার বন্দোবস্ত করতে। ঘড়ির দোকানের পাশে একটা এঁদো গলি আছে–সেখানে রাখলে কেমন হয়?

ফোনটা কানে চেপে ধরে থাকে অমিয়। ডায়াল টোন থেমে গেছে। এইবার নম্বর আসবে। অমিয় অপেক্ষা করে। স্পষ্ট শুনতে পায় ওপাশে দু-একটা কলকব্জা নড়ছে, লিভার উঠছে। প্রথমে ভার্টিকাল তারপর হোরাইজন্টল খোঁজ শুরু করে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র! কিন্তু নম্বরটা খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজছে–প্রাণপণে খুঁজছে যন্ত্রটা। খুঁজে পাচ্ছে না। অমিয় অপেক্ষা করে। যন্ত্রের শব্দ থেমে যায়। নম্বরটা কী পাবে না অমিয়? সে অপেক্ষা করে।

যন্ত্রটা অস্ফুট শব্দ করে, তারপর প্লাগ দেয়। রিং করার শব্দ হয় না, এনগেজড থাকারও শব্দ হয় না। কিন্তু তবু কানেকশন ঠিকই পায় অমিয়। স্পষ্ট বুঝতে পারে, ওপাশে টেলিফোন হাতে নিয়েছে এক গভীর নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতায় খুব উঁচু থেকে বালিয়াড়ি নেমে গেছে বহুদূর। ধু-ধু বালিতে শব্দহীন জোৎস্না পড়ে আছে। হাড়ের মতন সাদা বালি-গড়ানে– তারপর অন্ধকার জেটি, ঘোলা জল। শেয়ালের চোখের মতো চকচক করে ওঠে জোনাকি পোকা। এ-পাড়ে দিনের আলো থেকে ও-পাড়ে গভীর রাতের মধ্যে চলে যায় টেলিফোন। সেখানে বাতাসের শব্দ নেই, জলের শব্দ নেই। বালির ওপরে একটা সাপের খোলস উলটে পড়ে আছে। বালিতে ঢেউয়ের দাগ। বহু দূর-দিগন্তব্যাপী সেই নিস্তব্ধতা টেলিফোন ধরে থাকে ওপাশে। অমিয় সেই নিস্তব্ধতাকে শোনে।

ক-দিন ধরেই ইঁদুরের খুটখাট সারা বাড়িময় শুনছে হাসি। কখনো ওয়ার্ডরোবে, কখনো খাটের তলায়, জুতোর র‍্যাকে, রান্নাঘরে। অবিরল দাঁতে কেটে দিচ্ছে সংসার। নিশুতি রাতে ঘুম ভেঙে মাঝে মাঝে শুনেছে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে চি-চিক-চিক আনন্দিত চিৎকার ছুটে যাচ্ছে। কুড়-কুড়-কুড়-কুড় কাটার শব্দ হয়েছে। হাসি তেমন গা করেনি। কাটছে কাটুক।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়