বুড়োসুড়ো লোক, প্রতি রাতই প্রায়
নির্ঘুম কাটে শয্যায়। দিনে মাঝে মাঝে ঈষৎ
ঝিমুনি ধরে আর নানা হিজিবিজি ভাবনা
হাতকড়া পরিয়ে, শেকলে বেঁধে বৃদ্ধকে
দিব্যি মজা লোটে। কিছুকাল আগেও তিনি কবিতার
নানা রঙের চমৎকার সব ঘুড়ি
উড়িয়ে দিতেন নীলাকাশে। অনেকে বাহবাও দিতো,
এরকম গল্প চালু আছে প্রবীণদের মহলে।

আজ বুড়োসুড়ো লোকটা স্থবির, সকল
উচ্ছল চাঞ্চল্যের বাইরে বসে কখনও ঝিমোয়,
কখনও বা অতিশয় ঝাপসা দৃষ্টিতে আশেপাশে কী যেন
খোঁজে। কখনও কখনও ওর মানস-হ্রদে
ভেসে ওঠে একটি কি দু’টি স্মৃতিসিক্ত মুখ, কোনও
জ্বলজ্বলে নেশা-ধরানো শরীর। তাদের নাম
ঘন নীরবতা ও মধুর সুরে আবৃত্তি করে বৃদ্ধকে আচানক
চম্‌কে দিয়ে। একটি কটমটে, রাগান্বিত মুখের চক্ষুদ্বয় বিষ ছড়ায়।

বুড়োসুড়ো লোকটা সেই কটমটে মুখের নাম মাথা কুটেও
স্মরণের চৌহদ্দিতে আনতে অপারগ। দারুণ
অস্বস্তিতে কাটে তার অনেক প্রহর। সেই রোষদগ্ধ চেহারার
অধিকারী বহুকাল আগেই পৃথিবীর রৌদ্রজ্যোৎস্না থেকে
সরে গেছেন চিরতরে। বুড়োসুড়ো লোকটা যৌবনে সেই অপ্রসন্ন,
প্রায় ক্ষ্যাপাটে ভদ্রলোকের জীবনসঙ্গিনীর দেহ-সরোবরে
ডুবসাঁতার কেটেছে, এই অমূলক ধারণা নিয়েই
দুনিয়া থেকে মুছে গেছেন। আসল সাঁতারু কে ছিল তা কি
তিনি জানতে পেরেছিলেন কোনওদিন? কানাঘুষোর
সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় ছিল নিরপরাধ যুবকের, অর্থাৎ আজকের বৃদ্ধের।

বুড়োসুড়ো লোকটা রুষ্ট ভদ্রলোকের কুমারী গৃহিণীর
হৃদয়পদ্মের সুরভিতে সত্যি মজেছিল জ্বলজ্বলে যৌবনে,
কিন্তু তাকে সর্বক্ষণ ভুল শনাক্ত করেছে
ঈর্ষাকাতর স্বামী, অপরের দস্যুতা তার সত্তায় আরোপ করে
নিজে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে বারবার। আজো তার
জ্বলন্ত দৃষ্টিময় চেহারা মনে পড়ে বৃদ্ধের, যদিও বিস্মৃত নাম।
১৫.৬.২০০০

Shamsur Rahman।। শামসুর রাহমান