নেপথ্যে (গান)

ক্ষুধিতের সেবার সব ভার

লও লও কাঁধে তুলে—

কোটি শিশু নরনারী

মরে অসহায় অনাদরে,

মহাশ্মশানে জাগো মহামানব

আগুয়ান হও ভেদ ভুলে।

বৈজয়ন্তী নগর।সকাল।(দূরে কে যেন বলছে)

হে পুরবাসী! হে মহাপ্রাণ,

যা কিছু আছে করগো দান,

অন্ধকারে হোক অবসান

করুণা-অরুণোদয়ে!

বালকদলের প্রবেশ

উদয়ন

ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, আসে ওই

আয় তোরা, ওর সাথে কথা কই।

ইন্দ্রসেন

নগরে এসেছে এক অদ্ভুত মেয়ে

পরের জন্য শুধু মরে ভিখ্ চেয়ে!

সত্যকাম

শুনেছি ও থাকে দূর দেশে,

সেইখান থেকে হেঁটে এসে

দেশের জন্য ভিখ্ চায়

আমাদের খোলা দরজায়।

উদয়ন

শুনেছি ওদের দেশে পথের ধারে

মরছে হাজার লোক বিনা আহারে,

নানান ব্যাধিতে দেশ গিয়েছে ছেয়ে,

তাইতো ভিক্ষা মাগে ওদের মেয়ে।

সংকলিতার প্রবেশ (গান ধরল)

গান

শোনো, শোনো, ও বিদেশে ভাই,

এসেছি আজ বন্ধুজনের ঠাঁই;

দেশবাসই মরছে অনশনে

তোমরা কিছু দাও গো জনে জনে,

বাঁচাব দেশ অন্ন যদি পাই।

উদয়ন

শোনো ওগো বিদেশের কন্যা

ব্যাধি দুর্ভিক্ষের বন্যা

আমরাই প্রাণ দিয়ে বাঁধব—

তোমাদের কান্নায় আমরাও যোগ দিয়ে কাঁদব।

ইন্দ্রসেন

আমরা তোমায় তুলে দেবো অন্ন বস্ত্র অর্থ

তুমি কেবল গান শোনাবে এই আমাদের শর্ত।

সত্যকাম

ওই দ্যাখ আসে হেথা রাজ্যের কোতোয়াল

ইয়া বড় গোঁফ তার, হাতে বাঁকা তরোয়াল;

ওর কাছে গিয়ে তুমি পাতো দুই হস্ত

ও দেবে অনেক কিছু ও যে লোক মস্ত!

কোতোয়ালের প্রবেশ

সংকলিতা (আঁচল তুলে)

ওগো রাজপ্রতিনিধি,

তুমি রাজ্যের বিধি।

তুমি দাও আমাদের অন্ন,

আমরা যে বড়ই বিপন্ন।

কোতোয়াল

যা চ’লে ভিখারী মেয়ে যা চ’লে

দেব না কিছুই তোর আঁচলে।

সংকলিতা

তুমি যদি না দেবে তো কে দেবে এ রাজ্যে?

সবারে রক্ষা করা তোমাদের কাজ যে।

কোতোয়াল

চুপ কর হতভাগী, বড় যে সাহস তোর?

এখুনি বুঝিয়ে দেব আমার গায়ের জোর।

সংকলিতা

তোমরা দেখাও শুধু শক্তি,

তাইতো করে না কেউ ভক্তি;

করো না প্রজার কোনো কল্যাণ,

তোমরা অন্ধ আর অজ্ঞান।

কোতোয়াল

চল্ তবে মুখপুড়ী, বেড়েছিস বড় বাড়—

কপালে আছে রে তোর নির্ঘাত কারাগার।

(সংকলিতাকে পাকড়াও করে গমনোদ্যত, এমন সময় জনৈক পথিকের প্রবেশ)

পথিক

শুনছ হে কোতোয়াল—

নগরে শুনছি যেন গোলমাল?

উদয়, ইন্দ্র, ও সত্য (একসঙ্গে)

ছাড়, ছাড়, ছাড় ওকে—ছেড়ে দাও।

কোতোয়াল

ওরে রে ছেলের দল, চোপরাও!

সংকলিতা

কখনো কি তোমরা ন্যায়ের ধারটি ধারো?

বন্দী যদি করো আমায় করতে পারো,

করি নি তো দেশের আঁধার ঘুচিয়ে আলো

কারাগারে যাওয়াই আমার পক্ষে ভালো।

পথিক

ওগো নগরপাল!

রাজপুরীতে এদিকে যে জমলো প্রজার পাল

পথিকের প্রস্থান

ইন্দ্রসেন

অত্যাচারী কোতোয়ালের আজকে একি অত্যাচার?

এমনিতর খেয়ালখুশি করব না বরদাস্ত আর।

কোতোয়াল

(তরবারি উঁচিয়ে)

হারে রে দুধের ছেলে, এতটুকু নেই ডর?

মাথার বিয়োগব্যথা এখুনি বুঝবে ধড়।

রাজদূতের প্রবেশ

রাজদূত

(চিৎকার ক’রে)

রাখো অস্ত্রের চাকচিক্য

এদেশে লেগেছে দুর্ভিক্ষ

প্রজাদল হয়েছে অশান্ত

মহারাজ তাই বিভ্রান্ত।

কোতোয়াল

একি শুনি আজ তোমার ভাষ্য?

মনে হয় যেন অবিশ্বাস্য,

মহামন্বন্তরের হাস্য,

এখানেও শেষে হল প্রকাশ্য?

উদয়ন

আমরা তো পূর্বেই জানি,

লাঞ্ছিতা হলে কল্যাণী

এদেশেও ঘটবে অমঙ্গল

উঠবেই মৃত্যুর কল্লোল।

কোতোয়াল

বুঝলাম, সামান্যা নয় এই মেয়ে,

নৃপতিকে সংবাদ দাও দূত যেয়ে।

রাজদূতের প্রস্থান

(সংকলিতার প্রতি)

আজকেতোমার প্রতি করেছি যে অন্যায়

তাইতো ডুবেছে দেশ মৃত্যুর বন্যায়;

বলো তবে দয়া করে কিসে পাব উদ্ধার

ঘুচবে কিসের ফলে মৃত্যুর হাহাকার?

সংকলিতা

নই আমি অদ্ভুত, নই অসামান্যা,

ধ্বনিত আমার মাঝে মানুষের কান্না—

যেখানে মানুষ আর যেখানে তিতিক্ষা

আমার দেশের তরে সেথা চাই ভিক্ষা।

আমার দেশের সেই মহামন্বন্তর

ঘিরেছে তোমার দেশও ধীরে অভ্যন্তর।

মহারাজ ও পিছনে কুবের শেঠের প্রবেশ

মহারাজ

কে তুমি এসেছো মেয়ে আমার দেশে,

এসেছ কিসের তরে, কার উদ্দেশে?

সংকলিতা

আমার দেশেতে আজ মরে লোক অনাহারে,

এসেছি তাদের তরে মহামানবের দ্বারে—

লাখে লাখে তারা আজ পথের দুধার থেকে

মৃত্যুদলিত শবে পথকে ফেলেছে ঢেকে।

চাষী ভুলে গেছে চাষ, মা তার ভুলেছে স্নেহ,

কুটিরে কুটিরে জমে গলিত মৃতের দেহ;

উজাড় নগর গ্রাম, কোথাও জ্বলে না বাতি,

হাজার শিশুরা মরে, দেশের আগামী জাতি।

রোগের প্রাসাদ ওঠে সেখানে প্রতিটি ঘরে,

মানুষ ক্ষুধিত আর শেয়ালের উদর ভরে;

এখনো রয়েছে কোটি মরণের পথ চেয়ে

তাইতো ভিক্ষা মাগি এদেশে এ-গান গেয়ে—

t...

গান

ওঠো জাগো ও দেশবাসী,

আমরা যে রই উপবাসী,

আসছে মরণ সর্বনাশী।

হও তবে সত্বর—

দুয়ারে উঠল মহাঝড়।

সংকলিতা

কিন্তু তোমার এই এতবড় রাজ্য

এখানে পেলাম নাকো কোনোই সাহায্য।

রাজদূতের প্রবেশ

রাজদূত

প্রজারা সহসা ক্ষিপ্ত হয়েছে যে মহারাজ—

রাজপ্রাসাদের পাশে ভিড় ক’রে আছে আজ।

প্রস্থান

মহারাজ

বলো মেয়ে তাদের আমি শান্ত করি কী দিয়ে?

সংকলিতা

ধনাগার আজ তাদের হাতে এখুনি দাও ফিরিয়ে।

মহারাজ

তাও কখনো সম্ভব?

অবশেষে ছাড়বো বিপুল বৈভব?

কুবের শেঠ

(করজোড়ে)

শ্রীচরণে নিবেদন করি সবিনয়—

কখনই নয়, প্রভু কখনই নয়।

মহারাজ

কিন্তু কুবের শেঠ,

বড়ই উতলা দেখি এদের ক্ষুধিত পেট।

কুবের শঠ

এ এদের ছল, মহারাজ!

নতুবা নির্ঘাত দুষ্ট চাষীদের কাজ।

মহারাজ

তুমিই যখন এদের সমস্ত,

এদের খাওয়ার সকল বন্দোবস্ত

তোমার হাতেই করলাম আজ ন্যস্ত।

কুবের শঠ

(বিগলিত হয়ে)

মহারাজ ন্যায়পরায়ণ!

তাইতো সদাই সেবা করি ও চরণ!

মহারাজের সঙ্গে শঠের প্রস্থান

ইন্দ্রসেন

বাঘের ওপর দেওয়া হল ছাগ পালনের ভার,

কোতোয়াল হে! তোমাদের যে ব্যাপার চমৎকার!

কোতোয়াল

বটে! বটে! বড় যে সাহস?

গর্দান যাবে তবে রোস!

সংকলিতা

ছেলের দলের সামনে সাহস ভারি,

যোগ্য লোকের কাছে গিয়ে ঘোরাও তরবারি।

কোতোয়াল

চুপ করে থাক্ মেয়ে, চুপ করে থাক্,

তুই এনেছিস দেশে ভীষণ বিপাক।

যেদিন এদেশে তুই এলি ভিখারিণী

অশুভ তোরই সাথে এলো সেই দিনই।

সত্যকাম

কে বলে একথা কোতোয়াল?

ও হেথা এসেছে বহুকাল;

এতদিন ছিল না আকাল।

প্রজার ফসল করে হরণ

তুমিই ডেকেছ দেশে মরণ,

সে কথা হয় না কে স্মরণ?

জমানো তোমার ঘরে শস্য,

তবু তুমি করো ওকে দূষ্য?

কোতোয়াল

কে হে তুমি? দেখছি চোরের পকেটকাটা সাক্ষী,

বলছ কেবল বৃহৎ বৃহৎ বাক্যি?

ইন্দ্রসেন

কোতোয়ালজী, আজকে হঠাৎ রাগের কেন বৃদ্ধি?

তোমার কি আজ খাওয়া হয় নি সিদ্ধি?

কোতোয়াল

চুপ কর্, ওরে হতভাগা!

এটা নয় তামাসার জা’গা!

(দাঁতে দাঁতে ঘ’সে সংকলিতার প্রতি)

এই মেয়ে বাড়িয়েছে ছেলেদের বিক্রম,

তাইতো আমাকে কেউ করে নাকো সম্ভ্রম।

সংকলিতা

চিরদিনই তরুণেরা অন্যায়ের করে নিবারণ,

এদের এ সাহসের আমি তাই নয়কো কারণ।

কোতোয়াল

আমি রামদাস কোতোয়াল—

চটাস্নি ভুলে, কাটিস্‌নি কুমিরের খাল।

সংকলিতা

ছি! ছি! ছি! ওগো কোতোয়ালজী,

আমি কি তোমাকে পারি চটাতে?

শত্রুও পারে না তা রটাতে।

কোতোয়াল

জানে বাতাস, জানে অন্তরীক্ষ,

জানে নদী, জানে বনের বৃক্ষ,

তুই এনেছিস এদেশে দুর্ভিক্ষ।

সংকলিতা

ক্ষমা করো! আমি সর্বনেশে!

পরের উপকারের তরে এসে—

মন্বন্তর ছড়িয়ে গেলাম তোমাদের এই দেশে।

উদয়ন

অমন ক’রে বলছ কেন ভগ্নী!

জ্বালছ মনে কেন ক্ষোভের অগ্নি?

রাঘব বোয়াল এই কোতোয়াল

হানা দেয় এ রাজ্যে

একে তুমি এনোই না গেরাহ্যে।

কোতোয়াল

আমার শাসন-ছায়ায় হয়ে পুষ্ট

রাঘব বোয়াল বলিস আমায় দুষ্ট?

ইন্দ্রসেন

বলা উচিত সহস্রবার যেমন তুমি নির্দয়।

নির্দোষকে পীড়ন করায় যেমন তোমার নেই ভয়।

কোতোয়াল

বার বার করেছি তো সাবধান,

এইবার যাবে তোর গর্দান।

সংকলিতা

চুপ করে থাক ভাই, কথায় নেইকো ফল,

আমার জন্যে কেন ডাকছ অমঙ্গল?

রাজা ধনাগার যদি দেন প্রজাদের হাতে

ওর যে সমূহ ক্ষতি, ভেবে ও ক্ষুব্ধ তাতে।

কোতোয়াল

ওরে ওরে রাক্ষুসী, ওরে ওরে ডাইনী,

তোর কথা আমি যেন শুনতেই পাই নি,

তোর যে ঘনাল দিন, সাহস ভয়ংকর,

দুঃসাহসের কথা বলতে নেইকো ডর?

সত্যকাম

তোমার মতো দুর্জনকে করতে হলে ভয়

পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মোটেই উচিত নয়।

কোতোয়াল

তোদের মুখে শুনছি যেন ভাগবতের টীকা,

নিজের হাতে জ্বালছিস আজ নিজের চিতার শিখা।

ইন্দ্রসেন

একটি তোমার তলোয়ারের জোরে

ভাবছ বুঝি চিরকালটাই যাবে শাসন করে?

সেদিন তো আজ অনেক কালই গত,

তোমার মুখের ফাঁকা আওয়াজ শুনছি অবিরত।

কোতোয়াল

(ইন্দ্রসেনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে)

বুঝলে এঁচোড়পাকা,

আওয়াজ আমার নয়কো মোটেই ফাঁকা।

সংকলিতা

(আর্তনাদ ক’রে)

দরিদ্রের রক্ত ক’রে শোষণ

বিরাট অহংকারকে করো পোষণ,

তুমি পশু, পাষণ্ড, বর্বর

অত্যাচারী, তোমার ও হাত কাঁপে না থরথর!

কোতোয়াল

(হুংকার দিয়ে)

আমাকে বলিস পশু, বর্বর?

ওরে দুর্মতি তুই তবে মর।

(তলোয়ারের আঘাতে আর্তনাদ ক’রে সংকলিতার মৃত্যু)

প্রজাদলের প্রবেশ ও কোতোয়াল পলায়নোদ্যত)

জনৈক পথিক

কোথায় সে কন্যা, অপরূপ কান্তি,

যার বাণী আমাদের দিতে পারে শান্তি;

দেশে আজ জাগরণ যার সংগীতে,

আমরা যে উৎসুক তাকে গৃহে নিতে।

(সংকলিতার মৃতদেহের দিকে চেয়ে আর্তনাদ ক’রে)

এ যে মহামহীয়সী, এ যে কল্যাণী

ধূলায় লুটায়ে কেন এর দেহখানি?

ইন্দ্রসেন

(কোতোয়ালকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে)

ওই দেখ, ভাই সব, ওই অপরাধী

সাবার বিচার হোক ওর প্রতিবাদী—

জনৈক প্রজা

ওরে রে স্পর্ধিত পশু, কী সাহস তোর,

তুই করেছিস আজ অন্যায় ঘোর;

কল্যাণীকে হেনে আজ তোর আর

পৃথিবীতে বাঁচবার নেই অধিকার।

ইন্দ্রসেন

রাজার ওপরে আর করব না নির্ভর—

আমাদের ভাগ্যের আমরাই ঈশ্বর।

সকলে

চলবে না অন্যায়, খাটবে না ফন্দি,

আমাদের আদালতে আজ তুই বন্দী!!!

(কোতোয়ালকে প্রজারা বন্দী করলো)

যবনিকা

Sukanta Bhattacharya ।। সুকান্ত ভট্টাচার্য