অসমাপ্ত কবিতা

-নির্মলেন্দু গুন

অসমাপ্ত কবিতা-নির্মলেন্দু গুনমাননীয় সভাপতি ....।সভাপতি কে? কে সভাপতি?ক্ষমা করবেন সভাপতি সাহেব,আপনাকে আমি সভাপতি মানি না।তবে কি রবীন্দ্রনাথ? সুভাষচন্দ্র বসু? হিটলার?মাও সে তুং? না, কেউ না, আমি কাউকে মানি না,আমি নিজে সভাপতি এই মহতী সভার।মাউথপিস আমার হাতে এখন, আমি যা বলবোআপনারা তাই শুনবেন।উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আমার সংগ্রামী বোনেরা,(একজন অবশ্য আমার প্রেমিকা এখানে আছেন)আমি আজ আপনাদের কাছে কিছু বলতে চাই।আপনারা জানেন, আমি কবি,রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়ার, এলিয়েটের মতোইআমিও কবিতা লিখি এবং মূলত কবি,কবিতা আমার নেশা, পেশা ও প্রতিশোধ গ্রহণেরহিরুময় হাতিয়ার! আমি কবি, কবি এবগ কবিই।কিন্তু আমি আর কবিতা লিখবো না ।পল্টনের ভরা সমাবেশে আমি ঘোষণা করছি,আমি আর কবিতা লিখবো না।তবে কি রাজনীতি করবো? কান্ট্রাক্টারঃ পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশক?পত্রিকার সাব-এডিটর?নীলক্ষেত কলাভবনের খাতায় হাজিরা?বেশ্যার দালাল?ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে তেল-নুন-ডালের দোকান?রাজমিস্ত্রি? মোটর ড্রাইভিং? স্মাগলিং?আন্ডারডেভেলপমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা?নাকি সবাইকে ব্যঙ্গ করে, বিনয়ের সব চিহ্ন-সূত্রছিঁরে-খুঁড়ে প্রতিণ্ঠিত বুড়ো, বদ-কবিদেরচোখ-নাকে-মুখে কিংস্টর্কের কড়া ধোঁয়া ছুঁড়ে দেব?-অর্থাৎ অপমান করবো বৃদ্ধদের?আপনারা কেউ বেশ্যাপাড়ায় ভুলেও যাবেন না,এরকম প্রতিশ্রুতি দিলে বেশ্যার দালাল হতে পারি,রসোন্মত্ত যৌবন অবধি-, একা-একা।আমার বক্তব্য স্পট, আমার বিপক্ষে গেলেইতথাকথিত রাজনীতিবিদ, গাড়ল বুদ্ধিজীবি,অশিক্ষিত বিজ্ঞানী, দশতলা বাড়িওয়ালা ধনী-ব্যবসায়ীসাহিত্য-পত্রিকার জঘন্য সম্পাদক, অতিরিক্ত জনসমাবেশেআমি ফুঁ দিয়ে তুলোর মতো উড়িয়ে দেবো।আপনারা আমার সঙ্গে নদী যেমন জলের সঙ্গেসহযোগিতা করে, তেমনি সহযোগিতা করবেন,অন্যথায় আমি আমার ঘিরা পাঞ্জাবির গভীর পকেটেআমার প্রেমিকা এবং ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ ছাড়াঅনায়েসে পল্টনের ভরাট ময়দান তুলে নেবো।ভাইসব, চেয়ে দেখুন বাঙলার ভাগ্যাকাশেআজ দুর্যোগের ঘনঘটা, সুনন্দার চোখে জল,একজন প্রেমিকার খোজে আবুল হাসানকী নিঃসঙ্গ ব্যাথায় কাঁপে রাত্রে, ভাঙে সূর্য,ইপিআরটিসি’র বাস, লেখক সংঘের জানালাপ্রেসট্রাস্টের সিঁড়ি, রাজীয়ার বাল্যকালীন প্রেম।আপনারা কিছুই বোঝেন না, শুধু বিকেল তিনটা এলেইপল্টনের মাঠে জমায়েত, হাততালি, জিন্দাবাদ,রক্ত চাই ধ্বনি দিয়ে একুশের জঘন্য সংকলন,কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিনে নেন।আমি শেষবারের মত বলছিআপনারা যার-যার ঘরে, পরনে ঢাকাই শাড়িকপালে- সিঁদুরে ফিরে যান। আমি এখন অপ্রকৃতিস্থপূর্ব বাঙলার অন্যতম ভীষণ মাতাল বক্তা একজন,ফুঁ দিয়ে নেভাবো আগুন, উন্মাদ শহর,আপনাদের অশ্লীল-গ্রাম্য-অসভ্য সমাবেশে,লালসালু ঘেরা স্টেজ, মাউথ অর্গান, ডিআইটি,গল স্টেডিয়াম, এমসিসি’র খেলা,ফল অফ দি রোমান এ্যাম্পায়ারের নগ্ন পোষ্টার।এখন আমার হাতে কার্যরত নীল মাইক্রোফোনউত্তেজিত এবং উন্মাদ।শ্রদ্ধেয় সমাবেশ, আমি আমার সাংকেতিকভয়াবহ সান্ধ্য আইনের সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গেমাধবীর সারা মাঠ খালি করে দেবেন।আমি বড় ইনসিকিওরড, যুবতী মাধবী নিয়েফাঁকা পথে ফিরে যেতে চাই ঘরে,ব্যক্তিগত গ্রামে, কাশবনে।আমি আপনাদের নির্বাচিত নেতা।আমার সঙ্গে অনেক টাকা, জিন্নাহর কোটি কোটিমাথা; আমি গণভোটে নির্বাচিত বিনয় বিশ্বাস,রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, অথচ আমার কোনোসিকিউরিটি নেই, একজন বডিগার্ড নেই,সশস্ত্র হামলায় যদি টাকা কেড়ে নেয় কেউ-আমি কী করে হিসেব দেবো জনতাকে?স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি হলে কন্যার কাঁকন যাবে খোয়া,আপনার আমার সকলের ক্ষতি হবে,সোনার হাতে সোনার কাঁকন আর উঠবে না।আপনার ভাবেন, আমি খুব সেখেই আছিকিন্তু বিশ্বেস করুন, হে পল্টন,মাঘী পূর্ণিমার রাত থেকে ফাল্গুনের পয়লা অবধিকী ভীষণ দুর্বিষহ আগুন জ্বলছে আমার দুখের দাড়িতে,উষ্কখুক চুলে, মেরুদণ্ডের হাড়ে, নয়টি আঙুলে,কোমরে, তালুতে, পাজামার গিঁটে, চোখের সকেটে।দেখেছি তো কাম্যবস্তু স্বাধীনতা, প্রেমিকা ও গ্ণভোটহাতে পেয়ে গেল নির্জন হীরার আগুনেপুলিশের জীপ আর টায়ারের মতো পুড়ে-পুরে যাই,অমর্যাদা করি তাকে যাকে চেয়ে ভেঙেছি প্রসাদ,নদী, রাজমিস্ত্রী এবং গোলাপ।আমি স্বাধীনতা পেয়ে গেলে পরাধীন হতে ভালোবাসি।প্রেম এসে যাযাবর কন্ঠে চুমু খেলে মনে হয় বিরহেরস্মৃতিচারণের মতো সুখ কিছুই নেই।বাক-স্বাধীনতা পেলে আমি শুধু প্রেম, রমণী, যৌনতাও জীবনের অশ্লীলতার কথা বলি।আমি কিছুতেই বুঝিনা, আপনারা তবু কোন বিশ্বাসেবাঙলার মানুষের ভবিষ্যৎ আমার স্কন্ধ চাপিয়ে দিলেন।আপনারা কী চান?ডাল-ভাত-নুন?ঘর-জমি-বউ?রূপ-রস-ফুল?স্বাধীনতা?রেফ্রিজারেটর?ব্যাংক-বীমা-জুয়া?স্বায়ত্তশাসন?সমাজতন্ত্র?আমি কিছুই পারি না দিতে,আমি শুধু কবিতারঅনেক স্তবক, অবাসস্ত অন্ন বস্ত্র বীমাহীন জীবন বুকে ফুক এনে দিতে পারি সকলের হাতে।আমি স্বাভাবিক সুস্থ সৌভাগ্যের মুখে থুথু দিয়েঅস্বভাবিক অসুস্থ শ্রীমতী জীবন বুকে নিয়েকী করে কাটাতে হয় অরণ্যের ঝ্রের রাত্রিকেতার শিক্ষা দিতে পারি। আমি রিজার্ভ ব্যাংকেরসবগুলো টাকা আপনাদের দিয়ে দিতে পারি,কিন্তু আপনারাই বলুন অর্থ কি বিনিময়ের মাধ্যম?জীবন কিংবা মৃত্যুর? প্রেম কিংবা যৌবনের?অসম্ভব, অর্থ শুধু অনর্থের বিনিময় দিতে পারে।স্মরণকালের বৃহত্তম সভায় আজ আমিসদর্পে ঘোষণা করছি, হে বোকা জমায়েত,পল্টনের মাঠে আর কোনোদিন সভাই হবে না,আজকেই শেষ সভা, শেষ সমাবেশে শেষ বক্তা আমি।এখনো বিনয় করে বলছি, সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গেআপনারা এই মাঠ খালি করে দেবেন।এই পল্টনের মাঠে আমার প্রেমিকা ছাড়াআর যেন কাউকে দেখি না কোনোদিন।এই সারা মাঠে আমি একা, একজন আমার প্রেমিকা।

{youtubegalleryid=114,1}

Nirmalendu Goon ।। নির্মলেন্দু গুণ