গৃহভৃত্য বিষয়ে আমার বাবার কিছু উপদেশবাণী ছিল। উপদেশবাণীর সার অংশ হচ্ছে— মহাপুরুষদের কিছুকাল গৃহতৃত্য হিসেবে থাকতে হবে। তিনি ডায়েরিতে কি লিখে গেছেন হুবহু তুলে দিচ্ছি। এই অংশটি তিনি মৃত্যুর আগে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে লিখেছেন। হাতের লেখা জড়ানো এবং অস্পষ্ট। মানুষের মানসিক অবস্থার ছাপ পড়ে হাতের লেখায়। আমার ধারণা তখন তাঁর মানসিক অবস্থাও ছিল এলোমেলো। লেখার শিরোনাম–হিজ মাস্টার্স ভয়েস। তিনি সব লেখাই সাধু ভাষায় লেখেন। এই প্রথম সাধু ভাষা বাদ দিয়ে চলিত ভাষা ব্যবহার করেছেন।

হিজ মাস্টার্স ভয়েস

হিমু, তুমি নিশ্চয় রেকর্ড কোম্পানি— হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড দেখেছি। তাদের মনোগ্রামে একটি কুকুরের ছবি আছে। কুকুরটা থাবা গেড়ে তার মনিবের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে প্রভুর প্রতি আনুগত্য ঝরে ঝরে পড়ছে।

সব মহাপুরুষদের কিছু দিন কুকুর জীবন যাপন করা বাধ্যতামূলক। সে একজন প্রভুর অধীনে থাকবে। প্রভুর কথাই হবে তার কথা। প্রভুর আদেশ পালনেই তার জীবনের সার্থকতা। প্রভুর ভাবনাই হবে তার ভাবনা। প্ৰভু মিথ্যা বললে সেই মিথ্যাই সে সত্য বলে ধরে নিবে।

কুকুর ট্রেনিং-এ উপকার যা হবে তা নিম্নরূপ :

ক. জীবনে বিনয় আসবে। বিনয় নামক এই মহৎ গুণটি আয়ত্ত করা প্ৰায় অসম্ভব। আমি অতি বিনয়ী মানুষকেও দেখেছি অহংকারের গুদাম। সেই গুদাম তালাবদ্ধ থাকে বলে কেউ তার অহংকার প্রত্যক্ষ করতে পারে না।

খ. আনুগত্য কি তা শেখা যাবে। প্রতিটি মানুষ নিজের প্রতিই শুধু অনুগত। অন্যের প্রতি নয়। নিজের প্রতি আনুগত্য যে সৰ্ব্বজনে ছড়িয়ে দিতে পারবে সেইতো মহামানব।

গ. মানুষকে সেবা করার প্রথম পাঠের শুরু।

কুকুর ট্রেনিং কিংবা গৃহভৃত্য ট্রেনিং তোমাকে সেবা নামক আরেকটি মহৎ গুণের সংস্পর্শে আনবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল না, তোমাকে সত্যি সেবা শিখতে হবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অসুস্থ মানুষদের সেবা করতেন। তারা এমনিতেই সেবার দাবিদার। তোমাকে সুস্থ মানুষকে সেবা করতে হবে।

আমি নিজে এখন অসুস্থ। সময় ঘনিয়ে আসছে। এরূপ মনে হয়। তোমাকে পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিং দিয়ে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। যেসব শিক্ষা দিয়ে যেতে পারব না, আমার আদেশ, সেসব শিক্ষা নিজে নিজে গ্ৰহণ করবে।

এখন অন্য বিষয়ে কিছু কথা বলি—-গত পরশু দুপুরে আমি তোমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্ন মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। মানুষ যখন নিদ্ৰা যায় তখন মস্তিস্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে, তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিষ্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে। ফ্রয়েড সাহেব বলেছেন, সব স্বপ্নের মূলে আছে যৌনতা। এই ধারণা যে কতটা ভুল তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

যাই হোক, এখন স্বপ্নের কথা বলি। আমি তোমার কিশোরী মাকে স্বপ্নে দেখলাম। এটা কীভাবে সম্ভব হল জানি না। কারণ তাকে আমি কিশোরী অবস্থায় কখনো দেখি নাই। যখন তাকে বিবাহ করি তখন তার বয়স বাইশ। সে একজন তরুণী।

আমি দেখলাম। সে তার গ্রামের বাড়িতে। কুয়ার পাড়ে বসে আছে। তার সামনে এক বালতি পানি। সে চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। তোমার মা অতি রূপবতীদের একজন— এই তথ্য মনে হয় তুমি জান না। কারণ, তার মৃত্যুর পর আমি তার সমস্ত ফটোগ্রাফ নষ্ট করে দিয়েছি। তার স্মৃতি জড়িত সব কিছুই ফেলে দেয়া হয়েছে। কারণ স্মৃতি মানুষকে পিছনে টেনে ধরে। মহাপুরুষদের পিছুটান থেকে মুক্ত থাকতে হয়।

স্বপ্নের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তোমার মা চোখেমুখে পানি দিয়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। তোমার মা অত্যন্ত আনন্দিত গলায় বলল, তুমি একা এসেছ, আমার ছেলে কই?

আমি বললাম, তাকে ঢাকা শহরে রেখে এসেছি।

সে করুণ গলায় বলল, আহারে, কত দিন তাকে দেখি না! সে না-কি হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। এটা কি সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি।

তুমি তাকে সুন্দর একটা শার্ট কিনে দিও। একটা প্যান্ট কিনে দিও। এক জোড়া জুতা কিনে দিও।

আচ্ছা দিব।

তোমার মা তখন কাঁদতে শুরু করে এবং কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওরা কি কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে? কোনো মেয়ে কি ভালোবেসে তার হাত ধরেছে?

আমি বললাম, না। সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে। তার জন্যে নারীসঙ্গ নিষিদ্ধ।

তোমার মা চোখের পানি মুছে রাগী ব্লাগী গলায় বলল, সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে, না কিছু করছে। তাকে তুমি আমার কাছে নিয়ে আস। আমি থাবড়ায়ে তাঁর মহাপুরুষগিরি ছুটায়ে দিব।

স্বপ্নের এই জায়গায় আমার ঘুম ভেঙে গেল।

স্বপ্ন যে এক ধরনের ভ্রান্তি তা আমি জানি। তারপরেও স্বপ্নদর্শনের পর পর আমার মধ্যে কিছু আচ্ছন্ন ভাব দেখা দিল। আমার চক্ষু সজল হল। মনে মনে বললাম,

মাতা যস্য গৃহে নাস্তি
অরণ্যং তেন গন্তব্যং
যথারণ্যং তথা গৃহস।

বাবা হিমু, এখন তোমাকে একটি বিশেষ কথা বলি— তোমার মায়ের একটি আট ইঞ্চি বাই বার ইঞ্চি ছবি এবং তার লেখা ডায়েরি আকারে একটা খাতা আমি গোপনে রেখে দিয়েছি। একটা খামে সিলিগালা করে রাখা। যে তোষকে আমি ঘুমাই সেই তোষকের ভেতরে সিলাই করে রাখা আছে। তুমি খামটি সংগ্ৰহ করবে। যে দিন কোনো কারণে তোমার হৃদয় সত্যিকার অর্থেই আনন্দে পূর্ণ হবে সেদিন খামটা খুলবে। তবে একবার খাম খুলে ফেলার পর ছবি, খাতা এবং খাম আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। যেহেতু একবার দেখার পর সব পুড়িয়ে ফেলতে হবে সেই কারণেই তুমি কোনোদিন খামটা খুলতে পারবে না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। হা হা হা। একে কি বলে জান? একে বলে থেকেও নাই।

 

বাবার উপদেশ মেনে এক মাস গৃহভূত্যের কাজ করে আজ বেতন পেয়েছি। পল্টু স্যার সারাদিনের ছুটি দিয়েছেন। আজ তার ডায়ালাইসিসের দিন। সারাদিন কাটাবেন হাসপাতালে। রাতে ফিরবেন, আবার নাও ফিরতে পারেন। শরীর বেশি খারাপ লাগলে হাসপাতালেই থেকে যাবেন। তার অবস্থা দ্রুত খারাপ হচ্ছে। ডাক্তাররা কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই তথ্য জানিয়ে দিয়েছেন।

পল্টু স্যার বলেছেন, অন্যের কিডনী শরীরে নিয়ে বাঁচার তিনি কোনোই কারণ দেখছেন না। তাঁর মতে ঘুম যেমন ভয়াবহ কিছু না, মৃত্যুও না। বরং ঘুমের চেয়ে ভালো! ঘুম এক সময় ভাঙে, বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। গরম, ঘাম, পেটে ব্যথা, ক্ষুধা, বাথরুম নামক অসুবিধায় বাস করতে হয়। মৃত্যুতে এই সমস্যা নেই। তাঁর একটাই সমস্যা— মৃত্যুর পর বইগুলো সঙ্গে থাকবে না।

অনেকদিন পর রাস্তায় হাঁটছি। গরমটা ভালো লাগছে, গায়ের ঘামের গন্ধও ভালো লাগছে। কঠিন রোদের আলাদা মজা আছে।

এফডিসির কাছের রেল ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেন যাবে সেই দৃশ্য দেখব। ছুটন্ত ট্রেনের সঙ্গে মনের একটা অংশও ছুটে যায়, সেই অনুভূতি অন্য রকম। ট্রেন কখন আসবে জানি না। অপেক্ষা করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। হাতে রাত আটটা পৰ্যন্ত সময়। আমি আগ্রহ নিয়ে চারপাশ দেখছি। একটা রিকশায় মায়াকাড়া চেহারার শ্যামলা মেয়ে বসে আছে। বৈশাখের দুৰ্দান্ত রোদেও মেয়েটা রিকশার হুড তোলেনি। রোদে ভাজা ভাজা হচ্ছে। মেয়েটাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে কাঁদতে কাঁদতে এবং চোখের পানি মুছতে মুছতে আসছে। প্রকৃতি মানুষের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করেছেন। দুঃখ পেলে মানুষ কাদবে, তার চোখে পানি আসবে এবং আনন্দ পেলে সে হাসবে, তার দাঁত দেখা যাবে— এই ব্যবস্থা। প্রকৃতি এই কাজটা কেন করল?

আমার ধারণা প্রকৃতি এই ব্যবস্থা করেছে যেন মানুষ তার দুঃখ এবং আনন্দ লুকাতে না পারে। যেন অন্যরা টের পেয়ে যায়। দুঃখ এবং আনন্দ ভাগ করার জন্যে এগিয়ে আসে।

রেল ক্রসিং-এর পেট পরে গেছে। মেয়েটার রিকশা থেমে গেছে। আমি তাকিয়ে আছি রিকশার দিকে। আমার হঠাৎ মনে হল— রিকশার ভাড়া দেবার মতো টাকা মেয়েটার কাছে নেই। তারচেয়েও বড় কথা মেয়েটা ভয়াবহ ক্ষুধার্তা। রাতে সে কিছু খায় নি। এত বেলা হয়েছে এখনো কিছু খায় নি।

মেয়েটা রিকশা থেকে নেমে পড়েছে। রিকশাওয়ালা কঠিন মুখ করে কি যেন বলছে। মেয়েটার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সে হতাশ ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম, ভাড়া কত হয়েছে?

রিকশাওয়ালা বলল, একশ টাকা।

আমি বললাম, ঢাকা শহরে রিকশার ভাড়া একশ টাকা এই প্রথম শুনলাম।

রিকশাওয়ালা বলল, স্যার, আমি ইনারে নিয়া সকাল থাইকা ঘুরতাছি। এর বাড়িতে যায়, তার বাড়িতে যায়। কানতে কানতে ফিরা আসে, যাত্রাবাড়ি গেলাম। মগবাজার গেলাম। রামপুরা গেলাম— এখন আপনি বিবেচনা করেন। একশ টাকা কমই চাইছি।

আমি বললাম, আমারো তাই ধারণা। এই নাও রিকশা ভাড়া একশ টাকা। আর এই নাও বিশ টাকা। বরফ দেয়া লাচ্ছি খাও। গরমে আরাম হবে।

রিকশাওয়ালা এই প্ৰথম ভালোভাবে আমার দিকে তাকালো এবং জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, হিমু ভাই, মাফ দেন। আপনেরে চিনতে পারি নাই। সে নিচু হয়ে কদমবুসি করল।

মেয়েটা হতভম্ভ। আশেপাশের লোকজনও কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে। ট্ৰেন এসে গেছে। আমি তাকিয়ে আছি ট্রেনের দিকে—

বৃষ্টি দেখলেই যেমন ছেলেবেলার গান বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর মনে পড়ে, ট্রেন দেখলেই ট্রেনের ছড়া মনে পড়ে—

রেল গাড়ি ঝমাঝাম
পা পিছলে আলুর দম
ইস্টিশনের মিষ্টি কুল
শখের বাগান গোলাপ ফুল।

ট্রেন চলে গেছে। রেল গেটের জটিলা শেষ। শুধু আমি, মায়াবতী তরুণী এবং রিকশাওয়ালা আটকে আছি।

রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হাসিমুখে বলল, হিমু ভাই কি আমারে চিনেছেন? আমি ছামছু। আমার মেয়ের নাম সাগরিকা। আপনার কারণে মেয়েটার জীবন রক্ষা হয়েছিল। চিনেছেন হিমু।

হুঁ।

একটা পরীক্ষা আছে না, পাস করলে মাসে মাসে টেকা পায়। সাগরিকা সেই পরীক্ষা পাস করছে। টেকা পাওয়া শুরু করছে। এইটা সেইটা কিনতে চায়। আমি বলেছি, খবরদার! আগে হিমু ভাইরে পছন্দের কিছু কিন্যা দিবি। তারপর অন্য কথা। ঠিক বলেছি না?

হুঁ।

এখন বলেন। আপনার পছন্দের জিনিস কি? আইজই কিনব।

চিন্তা-ভাবনা করে বলি। হুট করে বলতে পারব না। আগে খাওয়াদাওয়া করতে হবে। ক্ষুধায় জীবন যাওয়ার উপক্রম। ঢাকা শহরের সবচে স্বভালো মোরগা-পোলাও কোথায় পাওয়া যাবে?

পুরান ঢাকায় যাইতে হবে। সাইনি পালোয়ান।

চল যাই।

আমি রিকশায় উঠে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, চল, মোরগপোলাও খেয়ে আসি।

মেয়েটা চোখ-মুখ খিচিয়ে কঠিন গলায় বলল, আপনি আমাকে মোরগ পোলাও খাওয়াবেন কেন?

আমি বললাম, তোমার ক্ষিধে লেগেছে এই জন্যে।

মেয়েটি গলার স্বর আরো তীক্ষ্ণ করে বলল, আমার ক্ষিধে লাগলে আপনি কেন আমাকে খাওয়াবেন?

আমি বললাম, ঝামেলা করবে না। সারাদিন রিকশা নিয়ে ঘুরেছি, ভাড়া দিতে পার নি, আবার ঝগড়া। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে যদি রিকশায় না উঠ তিনটা থাপ্পর দিয়ে চলে যাব। এক… দুই…

তিন বলার আগেই মেয়েটা চোখ মুছতে মুছতে রিকশায় উঠল। রিকশাওয়ালা বলল, আপনেরে চিনে নাই, এই জন্য ভং করছে। চিনলে লাফ দিয়ে কোলে উইঠ্যা বসত।

আমি বললাম, তোমার ঐ দোকানে আইটেম আর কি পাওয়া যায়?

রিকশাওয়ালা মহানন্দে রিকশার প্যাডেল চাপতে চাপতে বলল, গ্রাসি পাইবেন। খাসির মাংস দিয়া বানায়। এমন গ্লাসি আপনে বেহেশতেও পাইবেন না।

মোরগ-পোলাওয়ের সঙ্গে গ্লাসি যায়?

অবশ্যই যায়। কেন যাইব না? চ্যালচ্যালায় যায়।

ঠিক আছে, মোরগ পোলাও এবং গ্লাসি সাথে আর কি?

কোয়েল পাখির রোস্ট খাইবেন? পেটের ভিতরে থাকবে পাখির ডিম।

অবশ্যই খাব।

দাম আছে কিন্তু।

দাম কোনো বিষয়ই না। একদিনইতো খাব। রোজ রোজ তো খাচ্ছি না।

মেয়েটা শক্ত হয়ে বসে আছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুটা দিশেহারা। তার হাতের আঙুল কাঁপছে। খুব সম্ভব টেনশান এবং ক্ষুধার কারণে।

তোমার নাম কি?

আমার নাম জেনে কি করবেন?

আমি একজনকে মোরগ—পোলাও, গ্লাসি এবং ডিমসহ কোয়েল পাখি খাওয়াবো, তার নাম জানব না?

আমার নাম রানু।

থাক কোথায়?

মহিলা হোস্টেলে। হাতিরপুলের কাছে।

মহিলা হোস্টেলে কত টাকা বাকি পড়েছে? আমার ধারণা মহিলা হোস্টেলের বাকি শোধ করার জন্যেই তুমি ঘুরছে। টাকা জমা দেবার আজই কি শেষ দিন?

রানু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি জেনে কি করবেন? আমাকে টাকাটা দিবেন?

হুঁ। দেব।

বিনিময়ে আমাকে কি করতে হবে? আপনার সঙ্গে শুতে হবে?

আমি কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট গলায় বললাম, হ্যাঁ।

রানু এখন মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ রক্তবর্ণ। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে আছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি বললাম, রানু শোন। তুমি ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছ। সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্যে অন্য পুরুষের সঙ্গে শুয়ে টাকা রোজগারের চিন্তা করছ বলেই আমাকে এমন কুৎসিত কথা বলতে পারলে।

রানু ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, সরি।

আমি তোমাকে একটা ঠিকানা লিখে দেব। এই ঠিকানায় চলে এসো, দেখি কোনো চাকরি দেয়া যায় কি-না।

আমার জন্যে আপনাকে কিছু করতে হবে না।

আচ্ছা যাও–কিছু করব না।

হোস্টেলের টাকাটা আপনার কাছ থেকে ধার হিসেবে নেব। যথা সময়ে ফেরত দেব। আমার তিন হাজার টাকা লাগবে। তিনি হাজার টাকা কি আছে আপনার সঙ্গে?

আছে।

আরেকটা কথা আপনাকে বলি—আপনি নিজেকে যতটা ভালো মানুষ প্রমাণ করতে চাইছেন ততটা ভালো মানুষ আপনি নন।

কিভাবে বুঝলে?

আমি মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারি। সে ভালো না মন্দ।

কখন থেকে পার? ছোটবেলা থেকে?

রানু জবাব না দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। তার শরীরের কাঁপুনি থেকে বুঝতে পারছি সে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। আমি বললাম, টাকাটা যে আমাকে ফেরত দেবে কিভাবে দেবে? তোমার ভাবভঙ্গি পরিষ্কার বলছে তুমি গভীর জলে পড়েছ। কারো কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে?

আপনার টাকা পেলেইতো হল। কোত্থেকে পাচ্ছি সেটা জেনে কি করবেন? যাই হোক আপনাকে বলছি— আমি কিডনী বিক্রি করছি। এক ভদ্রলোক কিনবেন বলে কথা পাকা হয়েছে। ক্রস ম্যাচিং আরো কি কি যেন আছে, সব করা হয়েছে।

কত টাকায় বিক্রি করুছ?

এক লাখ টাকা; যে এজেন্ট বিক্রির ব্যবস্থা করেছে তাকে দশ হাজার দিতে হবে। আমি পাব নব্বই হাজার।

নব্বই হাজারে কিডনী খারাপ না। টাকাটা হাতে পাচ্ছ কবে?

এই মাসের আঠারো তারিখ অর্ধেক টাকা পাব। বাকি অর্ধেক ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরে।

যিনি তোমার কিড়নী কিনছেন তার নাম জান?

রানু বলল, কার জন্যে কিডনী কেনা হচ্ছে তা আমি জানি না। মাজেদা বলে একজন মহিলা সব ব্যবস্থা করছেন। নিউ ইস্কাটনে থাকেন।

আমি বললাম, হলি কাউ। পবিত্ৰ গাভী।

রিকশাওয়ালা বলল, গাভীর কথা কি বললেন স্যার?

গাভীর কথা কিছু বলি নাই। তুমি রিকশা চালাও।

রানু খাওয়া-দাওয়ায় প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গেল। সে বলল, আমি একটা মিষ্টিপান খাব। তার চোখে চকচকে ভাব আগে ছিল না, এখন চলে এসেছে। তাকে পান কিনে দেয়া হল। সে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, আমি এম্নিতে পান খাই না। শুধু বিয়েবাড়িতে গেলে পান খাই। একবার জর্দা দেয়া পান খেয়ে বিয়েবাড়িতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বান্ধবীর বিয়ে। ওর নাম হাসি। আমরা ওকে ক্ষেপানোর জন্যে বলতাম–

হাসি
রজব আলির খাসি।

রজব আলিটা কে?

রজব আলি কেউ না। এম্নি একটা নাম। মজার ব্যাপার কি জানেন? ওর বিয়ে যার সঙ্গে হয়েছে তার নাম রজব আলি। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। অদ্ভুত না?

কিছুটা অদ্ভুত।

রানু বলল, মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আজ যেমন ঘটেছে। যখন খাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ মনে হল আমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আজকের তারিখটা জানেন?

সতেরোই মে।

আজ আমার বাবার মৃত্যু দিন। উনি মারা গিয়েছিলেন দুপুর দুটায়। আমি যখন খাওয়া শুরু করি তখন বাজে দুপুর দুটা। আমি ঘড়ি দেখেছিলামতো, আমি জানি। খাবার সময় আমি যে কাঁদছিলাম। আপনি দেখেছেন? প্লেটে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়েছিল।

দেখেছি।

কাঁদছিলাম, কারণ আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, আমার বাবা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলছেন–মা! আরাম করে ভাত খা। খাওয়ার সময় প্লেটে চোখের পানি ফেলতে নেই। এ রকম কেন মনে হল শুনতে চান?

চাই।

আরেক দিন বলব। একদিনে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আচ্ছা, বলুনতো, আমি কি দেখতে খারাপ?

খারাপ না, তবে রসগোল্লাও না।

কিছু একটা আমার মধ্যে আছে। ভয়ংকর রিপালসিভ কিছু। এখন পর্যন্ত কোনো ছেলে আমার প্রেমে পড়ে নি। অথচ প্রতিরাতে ঘুমুতে যাবার সময় আমি চিন্তা করি— একটা ছেলে আমার প্রেমে পড়েছে আমার মন ভুলাবার জন্যে হাস্যকর সব কাণ্ডকারখানা করছে।

কি রকম হাস্যকর কাণ্ডকারখানা?

একেক রাতে একেক রকম ভাবি। কাল রাতে ভেবেছি–একটা ছেলে ব্লেড নিয়ে আমার ঘরের বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেছে— তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি না হও, তাহলে আমি ব্লেড দিয়ে আমার হাতের শিরা কেটে ফেলব।

তুমি রাজি হয়েছ?

অবশ্যই রাজি হব! যে কোনো ছেলে এই ধরনের কথা বললে আমি রাজি হব।

না, তা হবে না। রিকশাওয়ালা ছামছু বললে রাজি হবে না।

রানু কঁদো কঁদো গলায় বলল, রিকশাওয়ালাকে আপনি টেনে আনলেন কেন? আপনিতো অদ্ভুত মানুষ।

আমি বললাম, তুমি যখন রাজি হলে তখন ছেলেটা কি করল?

রানু বলল, আপনাকে আর কিছুই বলব না। এতক্ষণ বক বক করেছি বলে নিজের উপর রাগ লাগছে। আমি আপনার সঙ্গে ফেরত যাব না। আলাদা রিকশা নিয়ে যাব!

তাহলে বিদায়।

রানু বলল, বিদায়।  আপনি আমাকে যত্ন করে খাইয়েছেন, কোন একদিন সেটা আমি শোধ করব। যত তাড়াতাড়ি পারি করব। প্রমিজ।

রানু চলে গেল। আমিও রওনা হলাম। হাতে অনেক সময়। মাজেদা খালার সঙ্গে দেখা করা দরকার। মাজেদা খালার সঙ্গে দেখা করার পর হাসপাতালে চলে যাব। দেখে আসব পল্টু স্যারকে। হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি, কারণ হাত খালি। টাকা যা ছিল রানুকে দিয়ে দিয়েছি। তিন হাজার টাকা দেবার কথা। তারচে বেশিই দিয়েছি। কত বেশি বুঝতে পারছি না।

ভারপেট খাওয়ার পর কড়া রোদে হাঁটার অন্য রকম মজা আছে। মনে হয় নেশা করে হাঁটছি। ছাতিম গাছের ফুলের গন্ধ শুকলে যে রকম নেশা হয় সে রকম নেশা।

 

মাজেদা খালা দরজা খুলে বললেন, তোর একি অবস্থা? মনে হচ্ছে ঘাম দিয়ে গোসল করেছিস। এক্ষুণি বাথরুমে ঢুকে পর। সাবান ডলে গোসল দে। তার আগে লেবুর সরবত করে দিচ্ছি। সরবত খা। ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে থাক, শরীর ঠাণ্ডা হোক।

আমি ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে শরীর ঠাণ্ডা করতে লাগলাম। মাজেদা খালা ঘরের এসিও ছেড়ে দিয়েছেন। ঘর দ্রুত শীতল হচ্ছে; রোদে হাঁটার নেশা ভাবটা কেটে যাচ্ছে।

মাজেদ খালা সরবত নিয়ে এলেন। চিনির সরবত না, লবণের সরবত। প্রচুর ঘাম হলে এই সরবতই না-কি খাবার বিধান।

তুই কি আমার কাছে কোনো কাজে এসেছিস?

হুঁ।

আমারো তাই ধারণা। ভর দুপুরে বিনা কাজে আসার মানুষ তুই না। কাজটা কি?

বিশেষ একটা ধর্ম নিয়ে আমি গবেষণা করছি। তুমি এই বিষয়ে কি জান। তাই জানতে এসেছি।

ধর্ম বিষয়ে আমি কি জানব। তোর খালু সাহেব জানতে পারেন। সে দেশে নেই। জাপান গিয়েছে।

তুমি যা জান তাই শুনি।

কি ধর্ম সম্পর্কে জানতে চাস?

কক কক ধর্ম।

কক কক ধৰ্ম আবার কি? এই প্রথম এমন এক ধর্মের নাম শুনলাম।

পল্টু স্যার যে কক কক শব্দ করে এই বিষয়ে জানতে চাচ্ছি।

মাজেদা খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, সহজ কথা সহজে বলতে পারিস না? আমি ভাবলাম কি-না কি ধর্ম।

আমি যতদূর জানি কক কক করার কারণে স্যারের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। এটা কি সত্যি?

মাজেদা খালা বললেন, তোকে কে বলেছে? পল্টু ভাইজান বলেছেন?

হুঁ। স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার বিয়ে করেন নি কেন? তখন বললেন।

মাজেদা খালা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছিল, সেটা কি বলেছে?

না।

যাক, এইটুকু সেন্স তাহলে আছে।

তোমার সঙ্গেই বিয়ে হতে যাচ্ছিল?

হুঁ। বিরাট বড়লোকের ছেলে, গাড়ি-বাড়ি এই সব দেখে বাবা রাজি হয়ে গেলেন। আর আমি নিজেও তাকে পছন্দ করতাম। পছন্দ করার মতোই মানুষ। বিয়ে করতে এসেছে। বরযাত্রীর সঙ্গে বসেছে। টেনশনের কারণে মনে হয় কিছু একটা হয়েছে— শুরু করল। কক কক।

আমার বড় চাচা মিলিটারি কর্নেল। তিনি বললেন, জামাই কক কক শব্দ করছে কেন? সমস্যা কি?

পল্টু ভাইজান বড় চাচার হুংকারে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলেন। জোড়ে জোড়ে কক কক করতে লাগলেন। এত জোড়ে যে, ভেতর বাড়ি থেকে শুনা যায়। বিয়ে ভেঙে গেল।

আমি বললাম, পল্টু স্যারের সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে খারাপ হতো না। মানুষটা শুধু যে ভাল তা-না। অন্য রকম ভাল।

মাজেদা খালা চাপা গলায় বললেন, জানি।

আমি বললাম, উনার শোবার ঘরে তোমার যে একটা বঁধানো ছবি আছে এটা কি জান?

নাতো।

বয়সকালে তুমি যে কি রূপবতী ছিলে ছবিটা না দেখলে বিশ্বাস করাই মুশকিল। প্রথম কিছুদিন আমি চিনতেই পারিনি যে এটা তোমার ছবি।

মাজেদা খালা বললেন, তোর দায়িত্ব হচ্ছে আজই ছবিটা সরিয়ে ফেলা। অন্য লোকের স্ত্রীর ছবি তিনি কেন নিজের ঘরে রাখবেন। ছিঃ! আজ দিনের মধ্যে তুই ছবি সরাবি।

আমি বললাম, এই কাজটা আমি করব না, খালা। বেচারার কিছুইতো নেই। থাকুক না একটা ছবি।

মাজেদা খালা চট করে আমার সামনে থেকে সরে গেলেন। বুঝতে পারছি হঠাৎ তার চোখে পানি চলে এসেছে। প্রকৃতি মাঝে মাঝে মানুষকে এমন বিপদে ফেলে। চোখে পানি আসার সিস্টেম না থাকলে জীবন যাপন হয়তো সহজ হতো।

<

Humayun Ahmed ।। হুমায়ূন আহমেদ