বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

উৎসর্গ

জীবনসায়াহ্নে যিনি আমার সর্বকর্মের অধিষ্ঠাত্রী সেই মহামান্যা লীলালক্ষ্মী বিঘ্নরাজাকে, তস্যা মাতা সুকন্যাকে এবং তাঁহার মা হাসিকে

দ্বিতীয়সংস্করণের নিবেদন

‘বাঙালনামা’ পাঠকগোষ্ঠীর কাছে আশাতীত অভ্যর্থনা পেয়ে দ্বিতীয় সংস্করণে পা দিতে ভরসা পেল। লেখক এই সৌভাগ্য অনুপার্জিত জেনে অধিগুণ পাঠক-পাঠিকাদের বিনীত ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

প্রথম সংস্করণটি তার যোগ্যতার অতিরিক্ত সমাদর পেলেও কিছু কঠিন সমালোচনারও লক্ষ্য হয়েছিল। সেই সমালোচনার উত্তরে দু’-একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। প্রথমেই এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সমালোচনার কথা বলি। আমার বহুদিনের বন্ধু ডক্টর অশোক মিত্র লিখেছেন যে তার ‘বাঙালনামা’ এই শিরোনামটি পছন্দ হয়নি। কারণ আমি পনেরো বছর বয়েস থেকে দেশত্যাগী, সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছি, আমার স্ত্রী কখনও পূর্ববঙ্গে যাননি (কথাটা সত্যি না), বইটার নাম বোধহয় ‘দুনিয়ানামা’ হওয়া উচিত ছিল। আমার বক্তব্য, আমি একুশ বছর বয়সে বাস্তুহারা হয়েছি, ৫২ বছর পরে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে, বহু মানুষের অশ্রুজলে গঙ্গাস্নান করে মাতৃভূমিকে ফিরে পেয়েছি, যে মাতৃভূমি কখনও আমার চেতনা থেকে দূরে সরে যায়নি। বাঙালের শ্রমের অন্নে আমার দেহ পুষ্ট, বাঙালের ভাষা আমার ভাষা, বাঙালের পবিত্র ক্রোধ আমার দুর্দিনের সহায় আমি বাঙাল না হলে কে বাঙাল? বাঙালের দেহ বাঙালের চরিত্র নিয়ে দুনিয়ার ঘাটে ঘাটে নৌকা বেঁধেছি, অন্নের সংস্থান করেছি। আমার বাঙালের চাপরাস কেড়ে নেয় এমন ক্ষমতা কার আছে? সুতরাং এ কেতাবের নাম ‘বাঙালনামা’-ই রইল। এ নিয়ে আপত্তি করলে শুনব না।

দ্বিতীয় একটি আপত্তি বহু চিঠিপত্রে, মানুষের মৌখিক মন্তব্যে বারবারই চেতনাগোচর হয়েছে। সেই আপত্তি আমাদের চরম দুর্ভাগ্যর কাহিনি নিয়ে। কলকাতা শহরে ১৯৪৬ সনে অমানুষিক দাঙ্গা তথা গণহত্যার আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী আর কয়েক লক্ষ মানুষের মতো। তার বিবরণ দিতে গিয়ে আমি নাকি মুসলমানদের পক্ষ টেনে কথা বলেছি, সরোয়ার্দি সাহেব যে ওই দাঙ্গার মূল নায়ক এমন কথা আমি নির্দ্বিধায় বলিনি। আমি দাঙ্গার যে ঘটনাগুলি স্বচক্ষে দেখেছি, তারই বর্ণনা দিয়েছি। হিন্দু পাড়ায় থাকতাম সুতরাং তাদের সুকীর্তিই চোখে পড়েছে বেশি। আর ভাগ্যদোষে আমি ঐতিহাসিক। সরোয়ার্দি সাহেবের অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পথ বন্ধ, কারণ সে বিষয়ে দলিলপত্র যদি কিছু থাকে তা কেউ দেখেনি, দেখবার উপায়ও নেই। আর বিনা প্রমাণে ফাঁসির আদেশ দিতে আমার পেশাগত অসুবিধে আছে। জুরির বিচারেও লোকটি বেনিফিট অফ ডাউট পেতেন। আমিও তাকে তার বেশি কিছু দেইনি।

কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনের এক ভয়াবহ সম্ভাবনা আমাকে বিচলিত করেছে। পথেঘাটে ক্লাবে রেস্তেরাঁয় শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোকদের কথাবার্তায় এক মারাত্মক প্রবণতা দেখি যার তুলনীয় কিছু আমি ৪৬-৪৭-এর প্রাণঘাতী বর্বরতার সময়েও দেখিনি। আমাদের জীবনের যাবতীয় দুর্ভাগ্যের কারণ নাকি মুসলমান তোষণ। এর থেকে সম্ভাব্য মুক্তিদাতা একমাত্র গুজরাট গণহত্যার নায়ক নরেন্দ্র মোদী। এই জাতীয় চিন্তা এবং রাজনৈতিক প্রবণতার পথেই জার্মানিতে নাৎসিরা ক্ষমতায় এসেছিল। আমরাও কি সেই পথেই চলেছি?

আমার নীরদবাবু সম্বন্ধে বক্তব্যগুলি কারও কারও অসদিচ্ছাপ্রণোদিত মনে হয়েছে। বলা প্রয়োজন–এরা সবাই আমার প্রতি ব্যক্তি হিসাবে বিরূপ নন। ওঁর এক আত্মীয় শুনলাম মন্তব্য করেছেন, “আমাদের গাল দিয়েছে।” কথাটা এতই অশ্রদ্ধেয় যে এ নিয়ে আলোচনার কোনও প্রয়োজন দেখি না। কিন্তু যেসব সদিচ্ছাসম্পন্ন মানুষ ওই পরিচ্ছেদটির মধ্যে অসুয়ার গন্ধ পেয়েছেন, তাদের কাছে আমার কিছু নিবেদন আছে। নীরদবাবু আমার নিতান্ত প্রিয়জন, এক অর্থে আমার পিতৃস্থানীয়। ভারতীয় সংস্কৃতিতে উনি প্রবাদপুরুষ। ওঁকে আমি যা বুঝেছি তা লিখে রেখে যাওয়া আমার কর্তব্য মনে হয়েছে। আমি ঐতিহাসিক। স্তুতি রচনা আমার পেশা না। ওঁর লেখা যারা পড়েছেন বা ওঁকে যারা চিনতেন তারা প্রায় সকলেই ওঁর চিন্তা ও ব্যক্তিত্বে আপত্তিকর কিছু প্রবণতার সম্বন্ধে সচেতন। ওঁর সেই প্রবণতাগুলি জাতিবর্ণ এবং বংশগত সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। এই প্রসঙ্গে কারও নিন্দা করা যদি আমার উদ্দেশ্য হয় তবে তা আমাদের হতভাগ্য সমাজের, কোনও ব্যক্তিবিশেষের না, নীরদবাবুর তো নয়ই। উনি সম্ভবত কায়স্থেতর কোনও জাতির মানুষ, একবিংশ শতাব্দীতে এরকম কথা কেউ গালিগালাজ মনে করতে পারেন এমন চিন্তা স্বপ্নেও আমার গোচরিভূত হয়নি। উনিশ শতকে জাতিবর্ণ নিয়ে উদবেগ ব্রাহ্মণেতর সব বাঙালির মধ্যে দেখা যায়, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলেও এ জাতীয় প্রবণতা লক্ষণীয়। কোনও কোনও কায়স্থ নিজেকে বৈদ্য বলে ঘোষণা করলেন, বৈদ্যরা উপবীত ধারণ করতে শুরু করলেন, আগুরিরা উগ্ৰক্ষত্রিয়ত্ব দাবি করলেন এবং কার কোন বর্ণ তা নিয়ে রীতিমতো লাঠালাঠি শুরু হয়ে গেল। এর সঙ্গে নতুন উপসর্গ জুটল কার কী পেশা বা চাকরি তা নিয়ে মবারি। নীরদবাবুর স্পর্শকাতর পূর্বপুরুষদের কেউ কেউ উপরোক্ত দু’রকম সামাজিক বিকৃতিরই শিকার হয়েছিলেন, এমন প্রমাণ আছে। ওঁর জীবন ও কর্মের অবাঞ্ছিত দিকগুলির মূলে এই দুর্ভাগ্য বলে আমার ধারণা। এ কথা বলায় আমি ওঁকে “এক্সপোস” করেছি এমন যদি কারও মনে হয় তবে বুঝতে হবে যে উনিশ শতকে যে সব বিকৃত মূল্যবোধ আমাদের সমাজশরীরে প্রবেশ করেছিল তারা আজও শুধু সজীব না, প্রবল শক্তিতে লাথি ছুড়ছে।

আরও একটি সমালোচনার কথা বলি। আমার প্রিয়তম বন্ধু অমল দত্তের জীবনের একটি ঘটনা–ওঁর প্রেম ও বিবাহ এবং সেই প্রসঙ্গে এক মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি যা আমাদের সকলের জীবনেই ছায়া ফেলেছিল সম্পর্কে সত্যিতে কী ঘটেছিল তা আমি লিখেছি। এ নিয়ে অত্যন্ত রুচিবান কিছু মানুষও আমার কাছে আপত্তি জানিয়েছেন। আমার বক্তব্য–ঘটনাটি নিয়ে নানা মিথ্যা গুজব ষাট বছর পরে এখনও চালু আছে। তাই এ নিয়ে সত্যি কথাটি লেখা প্রয়োজন মনে করেছি। এ ব্যাপারে কারও কোনও দোষ ছিল না। সেই কথাটাই বলার চেষ্টা করেছি। আমার এই সিদ্ধান্ত কারও নিন্দনীয় মনে হলে আমার কিছু করার নেই।

এই সংস্করণটি সম্পর্কে আর একটি কথা বলে আমার বক্তব্য আপাতত শেষ করব। শরীরে বড় একটি অস্ত্রোপচারের ঠিক আগের দিন ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার লেখাটির শেষ কিস্তি প্রকাশিত হয়। আমার ধারণা হয়েছিল সেই ১৮ এপ্রিল আমার জীবনের শেষ দিন হবে। মনে মনে সবার কাছে বিদায় নিয়ে অস্ত্রোপচার কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম। যখন জ্ঞান হল, নিছক বেঁচে থাকা যে কত সুখের হেতু সে কথা উপলব্ধি হয়েছিল। তরঙ্গিত দুঃখ সুখ না, রাত্রিদিন প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যান অবান্তর মনে হয়েছিল। সেই কৈবল্যবোধ স্থায়ী হয়নি। নানা ব্যর্থতা নিয়ে মনোবিকলন, বার্ধক্যের সঙ্গী শোকতাপ, মানুষের প্রতি কারণ-অকারণে বিরক্তি সবই ফিরে এসেছে। দুঃখে অনুদ্বিগ্ন মন, সুখে বিগতস্পৃহ–ওসব হয় না স্যার, ওসব কথা ভগবদগীতা জাতীয় ভাল ডাল বইয়ে লেখা থাকে। অবশ্য পড়বেন, কিন্তু ভুলেও বিশ্বাস করবেন না। এই কেতাবে ব্যক্তিগত কথা কমই আছে।

কিন্তু এমন একটি পরিচ্ছেদ যোগ করলাম তাতে শুধুই ব্যক্তিগত কথা, আসন্ন মৃত্যুর আলোয় পৃথিবীটা কেমন দেখায় তার ব্যক্তিগত বিবরণী। এটা সত্যিই হাইকোর্ট দেখানোর প্রচেষ্টা, জীবজীবনের অন্তিম হাইকোর্ট। আশা করে আছি, শুধু বাঙাল না, সব পাঠকই এই সংক্ষিপ্ত মৃত্যুচিন্তা থেকে কিছু চিন্তার খোরাক পাবেন।

গ্রন্থকার

.

প্রথম সংস্করণের নিবেদন

২০০৬ সালের গোড়ার দিকে ‘বাঙালনামা’ লেখা শেষ করি। ২০০৭-এর ১৭ এপ্রিল ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখাটির শেষ কিস্তি প্রকাশিত হওয়ার কথা। ‘বাঙালনামা’র শেষ পরিচ্ছেদে লিখেছি,~~ আমি হৃৎপিণ্ডের একটি ‘ভালব’ বদল করার জন্য অস্ত্রোপচারে সম্মতি দিয়েছি। সেই অস্ত্রোপচার হবে ২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিল ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বাঙালনামা’র শেষ কিস্তি ছাপা হওয়ার পরের দিন। এই যোগাযোগের পিছনে ভাগ্যদেবতার কোনও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে কি না জানি না।

‘দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক শুনি লক্ষাধিক। তা হলে পাঠকসংখ্যা তার অন্তত দু’-তিন গুণ। এই বিরাট সংখ্যার পাঠকমণ্ডলীর কাছ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তা সত্যিই অপ্রত্যাশিত এবং আমার কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য। কারণ আমার জীবন সাদামাটা শিক্ষাজীবীর। দীর্ঘদিন প্রবাসী, তবে সে অভিজ্ঞতাও কয়েক হাজার বাঙালি শিক্ষাজীবীর। তাই রোমাঞ্চহীন এই জীবনকথা পাঠক-পাঠিকার কেন ভাল লাগল তার কোনও সদ্ব্যাখ্যা আমি পাইনি।

পাঠকদের চিঠিতে আমার অনেক ভুল দেখানো হয়েছে। সম্পূর্ণ স্মৃতিভিত্তিক রচনা,–এবং অস্ত্রোপচারটি এক বছর আগে হওয়ার কথা ছিল, সেই কারণে একটু তাড়াতাড়িতে লেখা। ফলে বেশ কিছু ভুল আছে। সেগুলি শোধরাতে যারা সাহায্য করেছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তবে বলি, অনেক ক্ষেত্রে ভুল পত্রলেখকরাই করেছেন, আমি না। আর কিছু পত্রলেখকের চিঠিতে এক বিচিত্র বিদ্বেষ-প্রণোদিত মনোভঙ্গির প্রকাশ দেখেছি। অনেকেরই আপত্তি–মুসলমানদের আমি যথোচিত গালিগালাজ করিনি। এবং এক পত্রলেখকের গালিগালাজের লক্ষ্য সুশোভন সরকার এবং সুখময় চক্রবর্তী। এ বিষয়ে তার বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। চিঠিটি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত না হওয়ায় শুনেছি লেখক অন্যত্র ওটি ছাপাবার ব্যবস্থা করেন। ওঁর উদ্যোগ যথোচিত প্রশংসা করার ভাষা আমার নেই। আক্ষেপের কথা, শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে এ জাতীয় ব্যক্তি অপ্রতুল না, ঔপনিবেশিক যুগের বহুব্যাপী ব্যর্থতাবোধ আমাদের জাতীয় চরিত্রের অঙ্গ হয়ে গেছে। আমাদের ঈর্ষা-বিদ্বেষের ব্যাখ্যা সেইখানে খুঁজতে হয়।

বহু মানুষের সাহায্য এবং উৎসাহ এই রচনা সম্ভব করেছে। তাদের মধ্যে অনেকে ‘দেশ’ পত্রিকা এবং ‘আনন্দ পাবলিশার্স’-এর কর্মী। এই দুই সংস্থা তাদের কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না-জায়েজ ঘোষণা করেছেন। অতএব হৃদয়ের কথা হৃদয়েই রইল। যাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারলাম না, আশা করি তারা টেলিপ্যাথির সাহায্যে বুঝে নেবেন।

কয়েকটি মানুষকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারে আর একটু সোচ্চার হচ্ছি। তাদের শীর্ষে প্রয়াত বন্ধু কুমার মুখার্জি এবং অমর সান্যাল। কুমার ‘রোমন্থন’ প্রকাশ হওয়া অবধি বর্তমান লেখাটি লিখতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। দুই কিস্তি প্রকাশ হওয়ার পর তিনি চলে গেলেন। আমার নানা অনুল্লেখ্য কাজের সাক্ষী অমর সান্যাল মহা উৎসাহে লেখাটি পড়ছিলেন। যে কিস্তিতে ওঁর কথা লিখেছি, সেটি প্রকাশিত হওয়ার কয়েকদিন আগে তিনিও লোকান্তরিত হলেন। আমার সমস্ত লেখাটি ধাপে ধাপে যাঁদের মাথায় লোষ্ট্রবৎ নিক্ষেপ করেছি তাদের মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক-অধ্যাপক কুণাল বসু এবং তাঁর পত্নী সুস্মিতা। অক্সফোর্ডে ওঁদের বহু শ্রান্ত সন্ধ্যা স্মিত মুখে এই অত্যাচার সহ্য করে কেটেছে। আমার স্ত্রীও এই উৎপীড়নের সহ-শিকার ছিলেন। চতুর্থ এবং পঞ্চম যে দুই ব্যক্তি এইভাবে উৎপীড়িত হয়েছেন দুর্ভাগ্যক্রমে তারাও আনন্দবাজার সংস্থার কর্মী, ফলে তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা তাদেরও টেলিপ্যাথি মারফত বুঝে নিতে হবে।

এই বইটি উৎসর্গিত লীলালক্ষ্মী বিঘ্নরাজা, তাঁর জন্মদাত্রী আমার কন্যা সুকন্যা এবং তস্যা মাতা হাসিকে। আমার জীবনরস যখন শুকিয়ে আসছিল তখন লীলালক্ষ্মীর আবির্ভাব। এখন আরও একশো বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে। শুনে লীলা সন্দেহ প্রকাশ করলেন। বললেন “Dadu, you will be very old by that time.’ তারপর একটু চিন্তা করে,–‘So shall I’।

তপন রায়চৌধুরী
কলকাতা ২২ মার্চ, ২০০৭

‘বাঙালনামা’
০১. প্রারম্ভিক

বেশ কয়েক বছর আগে ‘রোমন্থন’ নাম দিয়ে বাল্য ও প্রথম যৌবনের স্মৃতির ভিত্তিতে কয়েকটি নকশা জাতীয় রচনার একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলাম। লেখাটি জনপ্রিয় হয়েছিল। সত্যি বলতে শিক্ষিত বাঙালির কাছে আমার নাম যেটুকু পরিচিত তা ওই রোমন্থনের দৌলতে। যৌবনে দেখেছি, শিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই স্যার যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সেন এবং নীহাররঞ্জন রায়ের নাম জানতেন। অনেকে তাদের লেখাও কিছু কিছু পড়তেন। অনুরূপ পাণ্ডিত্য বা খ্যাতি যে আমার ভাগ্যে জোটেনি, তা আমার বহুমুখী অসাফল্যরই অন্যতর দ্যোতক। পাঠক-পাঠিকা এই আত্মবিলাপ মার্জনা করবেন।

রোমন্থনের সময়সীমা ছিল ১৯৪৭-৪৮ : দেশবিভাগের নিদারুণ অভিজ্ঞতা। বন্ধুবান্ধব এবং গুণগ্রাহী পাঠকরা দেশবিভাগের পরবর্তী কাল, তথা সুদীর্ঘ প্রবাসজীবনের স্মৃতিকথা লিখতে বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু কী লিখব, কী ভাবে লিখব তা ঠিক করতে করতে অনেক বছর কেটে গেল।

একটা নেতিবাচক সিদ্ধান্ত প্রথমেই নিতে হল। ‘আত্মকথা’ লেখা আমার পক্ষে সম্ভব না। কারণ তার জন্য যে-সাহস দরকার তা আমার নেই। অনেক খ্যাতনামা মানুষের আত্মচরিত পড়েছি। তার অধিকাংশই যে অসত্য বা অর্ধসত্যে ভরা এ কথা আজ বহুবিদিত। অন্তহীন সাহস না থাকলে সত্যিকার আত্মকথা লেখা যায় না। রুসোরও অনেক আগে সন্ত অগাস্টিনের যুগ থেকে অনেক আত্মচরিতকারই নিজের যৌনতা সম্পর্কে নির্দ্বিধায় লিখেছেন। এ যুগে তো ও ধরনের স্বীকারোক্তি আর ফ্যাশন নেই, নিতান্তই জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যে-মানুষ আধুনিক সংবেদনশীল চেতনা সত্ত্বেও বাড়ির ঝি-র গায়ে হাত তুলেছেন অথবা দুঃখিনী মাকে ঘেন্না এবং অবহেলা করেছেন, এসব কথা লিখতে ইতস্তত করেননি, তাঁর সমতুল্য লোক বেশি নেই। আমি বা আমার মতো অনেক লোকই নিজকৃত বহু কাজ নিজের কাছে স্বীকার করতেও লজ্জিত। সেসব কথা লেখার সাহস কোথায় পাব? আর নিজের গভীরতর চেতনা, অবদমিত মনের নানা বিকৃতির কথা লিখলে তা মনস্তাত্ত্বিকের কাছে হয়তো মূল্যবান বিশ্লেষণযোগ্য উপাদান হত, পূতিগন্ধপ্রিয় পাঠকরা লুফে নিতেন। কিন্তু ও পথে অর্থোপার্জন করতেও বুকের পাটা লাগে। আমার মতো ভিতু ছাপোষা লোকের তা নাগালের বাইরে। সব অপ্রিয় সত্য, যাবতীয় লজ্জাকর তথ্য বাদ দিয়ে নিজের কীর্তিকাহিনির সত্যমিথ্যা মেশানো বিবরণ যেসব আত্মচরিতের মূল উপাদান, তাদের সাহিত্য হিসাবে মূল্য থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের সামগ্রিক আত্মপ্রকাশ যা আত্মচরিতের গোড়ার কথা, অনেক ক্ষেত্রেই এগুলি তা কোনও অর্থেই নয়। সুতরাং আত্মচরিত লেখার প্রচেষ্টা সাহসের অভাবেই ছাড়তে হল।

কিন্তু বয়স আশির দিকে এগুচ্ছে। মানুষের স্বল্পস্থায়ী জীবনের হিসাবে সময়টা লম্বা। এই দীর্ঘ সময় ধরে নানা ঘাটের জল খেতে হয়েছে। পিছনের দিনগুলি সত্যিই নানা রঙের, যদিও রঙগুলি প্রায়শই ঘনকৃষ্ণ অথবা অভাব আর নৈরাশ্যে ধূসর। তবু সেসব দিনের স্বাদ আজকের প্রজন্মের কাছে অচেনা। অপরিচয়ের দান যে-মাদকতা, তার সম্ভাবনায় ভরা। আর যে-পৃথিবী ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকেও চিনতাম, তার অনেকাংশই সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে বরিশাল গিয়ে এই সত্য প্রবলভাবে অনুভব করি। যে-শহরে এখন থাকি, সেই অক্সফোর্ডও আর পঞ্চাশের দশকের অক্সফোর্ড নেই, এই পশ্চিমি নালন্দার চিরন্তনী বলে আত্মশ্লাঘা সত্ত্বেও। বার্ধক্যের এই রচনা সেই বিস্মৃত বা বিলুপ্ত জগতের বিবরণ। লেখক সেখানে দর্শক, বড়জোর পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা। অর্থাৎ বর্তমান রচনাটি আত্মজীবনী নয়, স্মৃতিকথা। আর শুরু করছি ১৯২৬ সাল, অর্থাৎ জন্মের বছর থেকে, যদিও অবশ্যম্ভাবী কারণেই সে সময়ের কোনও স্মৃতি আমার নেই। বন্ধু ও শুভার্থীদের উপদেশ, দেশবিভাগের সময় থেকে শুরু করা, অনেক ভেবে গ্রহণ করলাম না। কারণ, রোমন্থনও স্মৃতিকথা না, স্কেচবুক মাত্র।

<

Super User