যখন ট্রেন এল
আমেরিকার মিনেসোটার এক তরুণের অভিজ্ঞতার কাহিনি এটি। আমরা শুনব এটা তার মুখ থেকেই।
কয়েক বছর আগের ঘটনা। সম্ভবত ২০০৫-৬ সালের দিকে হবে। আমার এবং আমার বন্ধুদের মাছ ধরার প্রবল একটা নেশা ছিল সেসময়। নিয়ম করে প্রায় প্রতি হপ্তাতেই মাছ শিকারে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। বিশেষ করে এলক নদীর একটি বিশেষ জায়গায় অনেকবার মাছ ধরতে গিয়েছি আমরা। মাছ ধরার এলাকাটা ছোট্ট একটা সেতুর নীচে। আর এদিকটায় রাস্তাও এক লেনের। সেতুর নীচে নদীটাতে একটা বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
এই নির্দিষ্ট জায়গাটাতে পৌঁছতে হলে প্রথমে ছোটখাট একটা বাণিজ্যিক ভবনের কাছে গাড়ি রেখে নেমে পড়তে হয়। তারপর হেঁটে গাছপালার ভিতর দিয়ে ঢালু পথ ধরে নদীর কাছে পৌঁছতে হয়। নদীতে নামার জন্য সে অর্থে কোনো রাস্তা নেই। লোকজন চলাচলের ফলে একটা পায়ে চলা পথ মত তৈরি হয়েছে। তবে রাস্তার ধার থেকেই পথের দু-পাশে দুই-তিন ফুট উঁচু ঘাসের বিস্তার। কাছেই একটা রেললাইন আছে। ওটাতে খুব একটা ট্রেন চলাচল নেই। রেললাইনটা দেখিনি কখনও। তবে এর কথা জানি।
আরও অনেক রাতের মত সে বিশেষ রাতটিতেও আমাদের এই প্রিয় জায়গাটিকে মাছ শিকারের জন্য বেছে নিই। কিন্তু এদিন এখানে পৌঁছার সঙ্গে-সঙ্গেই কেন যেন অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হলো। মনে হচ্ছে যেন কেউ আমাদের দিকে নজর রাখছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাপিয়ে পড়বে গায়ের ওপর। তবে জোর করে মনের কল্পনা বলে বিষয়টাকে উড়িয়ে দিতে চাইলাম।
আগুন জ্বেলে মাছ ধরা শুরু করলাম। কয়েক মিনিট পরেই হঠাৎ মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস গাড়িতে রেখে এসেছি। ওটা আনতে রওয়ানা হলাম। তবে একা না, দুজন বন্ধুকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে নিয়েছি। লম্বা ঘাসের মধ্য দিয়ে তাদের দুজনের পিছু-পিছু এগোলাম। এসময়ই আবার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। মনে হলো কেউ যেন ঘাসের ভিতর থেকে আমাদের দেখছে। উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম, তবে অন্যদের কিছু বললাম না। কারণ আমার বন্ধু দুজনও বেশ ভীতু। আর অতিপ্রাকৃত ঘটনার প্রতি বিশ্বাসে আমার চেয়েও এক কাঠি বাড়া।
যে জিনিসটা দরকার সেটা নিয়ে আবার ফিরে এলাম। মোটামুটি আধ ঘণ্টা পর হঠাৎ একটা ট্রেন এল। তবে আশ্চর্য ঘটনা, এর আগে যতগুলো রাতে এখানে সময় কাটিয়েছি একবারের জন্যও কোনো ট্রেনের আওয়াজ শুনিনি। আর এটাও এল যেন কোনো ধরনের জানান না দিয়ে। মনে হলো যেন। নিঃশব্দে উড়ে এসেছে। তারপরই ট্রেন থেকে একটা কিছু ফেলার শব্দ হলো। গড়িয়ে-গড়িয়ে একটা গর্তে পড়ল ওটা। ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে উঠল জিনিসটা। আর যাই হোক, ওটা রক্তমাংসের কোনো মানুষের কণ্ঠ না।
আমার পাশেই এক বন্ধু মাছ ধরছে। দুজন দুজনের দিকে তাকালাম। তবে কেউ কোনো কথা বললাম না। কয়েক মুহূর্ত পরেই আগুনের পাশের লম্বা জংলা ঝোপের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আলোড়ন উঠল। ঝোপটা ওই গর্তটার ধারেই। মনে হচ্ছে যেন ঝড়ো বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঝোপটার কাছে বরাবরই বসে আছে আমার বন্ধু। সে কোনো ধরনের বাতাস অনুভব করছে না। দমকা বাতাস গায়ে লাগল না আমাদের আর কারোও। গ্রীষ্মের শান্ত একটা রাত এটা। সেতুটার নীচে মাছ ধরছি আমি। এখান থেকেই জঙ্গলটার দিকে তাকালাম। বাতাস যে নাড়াচ্ছে না ওটাকে এখন পরিষ্কার, বরং মনে হলো এর ভিতরে কেউ একজন আছে, সেই খেপে গিয়ে নাড়াচ্ছে ঝোপগুলো।
এরপর আর ওখানে অপেক্ষা করার মত অবস্থা ছিল না আমাদের। নদীতে আরও কিছু লোক মাছ ধরছে। তবে তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার কিংবা কিছু জিজ্ঞেস করার কথা চিন্তাতেও এল না। তারপরই আমার এক বন্ধু বলল, চল, দোকানে যাই। কারণ অশুভ কিছুর উপস্থিতি টের পেলে বাড়িতে যাওয়ার কথা বলতে নেই। তাহলে ওটা আপনার পিছু-পিছু বাড়ি হাজির হতে পারে।
দেরি না করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে গাড়িতে উঠলাম। তবে সোজা বাড়িতে না গিয়ে সত্যি একটা দোকানে গেলাম। পাছে আবার জিনিসটা অনুসরণ করে আমাদের কারও বাড়ি পৌঁছে যায়। পরে কথা বলে জানলাম, শুধু আমার নয়, আজ এখানে যাবার পর বেশিরভাগেরই কেমন ভয়-ভয় করছিল। ওটা কী জানি না। তবে ভয়ঙ্কর কিছু একটা যে তাতে সন্দেহ নেই। আর কিছুক্ষণ সেখানে থাকলে, হয়তো আমাদের কারও কারও ওটাই হত জীবনের শেষ মাছ শিকার।
<